॥ মীযানুল করীম ॥
একটি দৈনিক পত্রিকা বাজেট পেশের দিন প্রথম পাতায় কার্টুন ছেপেছে। দেখা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রী বিরাট বপু হাতিকে রশি বেঁধে টেনে নেয়ার প্রাণপণ কোশেশ করছেন। কিন্তু বৃহত্তম স্থলচর প্রাণীটির যে একটা পা কাটা। সেই খণ্ডিত পদ হচ্ছে বাজেট ঘাটতির প্রতীক। এবার ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকার বিপুল ঘাটতির বিশাল বাজেট। এই মন্ত্রীই গতবার বলেছিলেনÑ ‘বাজেটের সাইজ কোনো সমস্যাই নয়।’ কিন্তু হস্তীতুল্য বাজেট তিন পা দিয়ে কিভাবে হাঁটবে, সেই জবাব মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আছে কি? মানুষের আকার যেমন খুব বড় হলে বিপদ, তেমনি বাজেটের সাইজও।
‘বাজেট’ কাকে বলে? একজন এর অন্যরকম সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন, ‘যার বর্ণনা দিতে দিতে অর্থমন্ত্রীর হাঁটু ধরে, শুনতে শুনতে এমপিদের ঝিমুনি আর অন্যদের বিরক্তি ধরে; পরে যা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারের মাথা ধরে, এর নাম বাজেট।’
অন্যান্য বছরের মতো এবারো যথাসময়ে যথানিয়মে বাজেট পেশ হলো, পাসও হয়ে যাবে। আর বাজেটের উপরি উক্ত প্রতিক্রিয়াগুলো যে কমবেশি এবারো ছিল, তা বলার দরকার পড়ে না। বাজেট বক্তৃতা এত দীর্ঘ হয় যে, অর্থমন্ত্রীকেবারবার পানি পান করতে হয়। আমাদের সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট উপস্থাপক মন্ত্রী সাইফুর রহমানের চেয়েও বেশি বয়সে বাজেট পেশ করলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত (৭৮)। বাজেটের অতি দীর্ঘ বয়ান দেয়া তার জন্য কষ্টকরই বটে। অবশ্য এর বাস্তবায়ন সরকারের জন্য হবে এর চেয়ে ঢের বেশি কষ্টের। এবারের বাজেট বাস্তবায়ন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জÑ বিজ্ঞজনের এই অভিমত তারই সাক্ষ্য দেয়।
বাজেটে ঘাটতির বিরাট বহর। তাই বলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অবাস্তব অর্থনৈতিক আশাবাদের ঘাটতি নেই। সমাজ ও প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অপচয়, অনিয়ম, আত্মসাতের যে মচ্ছব; তা কমাতে পারলে বাজেট নিয়ে এত উদ্বেগ হতো না। কথায় বলে, Cut your coat according to cloth. এখন cloth কেনার পয়সা জোগাড়ের আগেই coat-এর অর্ডার দিতে দেখা যায়। সরকার বাজেটে দেখাতে চেয়েছে, ব্যয়ের মাত্র ৯ দশমিক ৭ শতাংশের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে। বাকি ৯০ শতাংশ ঘর থেকে সামাল দেয়া যাবে। যে সরকার ঋণ নিতে নিতে ঘরের ব্যাংকগুলো ফতুর করে ফেলছে, তারা ব্যয় মেটাতে করের বোঝা চাপিয়ে জনগণের মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে দিতে পারে।
সাধারণত বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ করা হয়। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। সুবিধা হলো, এতে সংসদ সদস্যরা দু’টি দিন বিশ্রাম নিতে পারেন। শুক্রবার অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন। পরদিন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি-প্রতিক্রিয়া। এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ৭ জুন বাজেট পেশ করেছে, যে তারিখটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেটকেও সরকার ‘ঐতিহাসিক’ কিছুর মতো মহাকাণ্ড হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। লোকে বলছে, এটা মহাজোট সরকারের মহাবাজেট, যার বাস্তবায়নে মহাসমস্যা দেখা দেবে। প্রসঙ্গক্রমে একটি পত্রিকার শীর্ষ শিরোনামÑ ‘আশাবাদ বেশি, পদক্ষেপ কম।’ এটা তো জানা কথা, পদক্ষেপ যেখানে কম হয়, সেখানে হস্তক্ষেপ বেশি করতে হয়। আর আশা বা স্বপ্নের কথা তুললে সেই দু’জনের কথা মনে পড়বে অনেকের। একজন বলছে, গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আমি একটা কারের মালিক। শুনে অন্যজন বলল, স্বপ্নই যদি দেখবে তাহলে কেন দেখলে না যে, তুমি আস্ত একটা প্লেনের মালিক।
জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার। আয় এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি, ব্যয় এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। তাই ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৭ শতাংশ ঘাটতি। বাজেটের বিশাল বহর আর ঘাটতি তথা আয়-ব্যয়ের এত বিরাট ফাঁক দেখে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিত বললেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য, ‘বাজেট মোটেই বিশাল না, ঘাটতিও তত বেশি নয়।’ আগের দিন বাজেট বক্তৃতার ফাঁকে সংসদে তিনি বলেছিলেনÑ ‘চুপি চুপি বলি (যদিও মাইকে সবাই শুনছিলেন), আমার ইচ্ছা ছিল এবার বাজেট দুই লাখ কোটি টাকা করার। তা সম্ভব হয়নি।’ তিনি মোট ব্যয়ের ২৭ শতাংশকেও বিরাট মনে করেন না।
এসব শুনে একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। এক জায়গায় দুই লোকের সাক্ষাৎ হলো। একজন খুব মোটা, আরেকজন একেবারে হ্যাংলা-পাতলা। মোটাজনকে অপর ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেনÑ ‘ভাই, আপনার নাম কী?’ তিনি জবাব দিলেনÑ ‘চিকন আলী।’ এরপর জানতে চাইলেন প্রশ্নকারীর নাম। তিনি বললেন, ‘আমার নাম নাই আলী।’ শুনে মোটা মানুষটি অবাক। বললেন, এমন নামও হয় নাকি? চিকন ব্যক্তি বললেন, যদি এত মোটা হয়েও আপনি ‘চিকন’ আলী হতে পারেন, তাহলে আমি চিকন মানুষটা তো ‘নাই’; মানে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ার কথা।
বাজেট শব্দটা ইংরেজি। কেউ কেউ মনে করেন, এটা ফরাসি bougete থেকে এসেছে। কিন্তু বিশিষ্ট লেখক, শিক্ষাবিদ ও ফরাসি ভাষাবিশেষজ্ঞ প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশী বলেছেন, একটা অতি প্রয়োজনীয় (এবং অপ্রয়োজনীয়) শব্দ বাজেট। এটা ফরাসিতে এসেছে ইংরেজি থেকে। মূল অর্থ কোষাধ্যক্ষের থলে; ফরাসি উচ্চারণ ‘বুদজে’।
অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারিতে বাজেট মানে An official statement by the government of a country’s income from taxes, etc and how it will be spent. (বিভিন্ন কর থেকে একটি দেশের আয় এবং কিভাবে তা ব্যয় হবে, এর যে আনুষ্ঠানিক বিবরণ সরকার দিয়ে থাকে তার নাম বাজেট)। লক্ষণীয়, এখানে সরকারের আয় বলতে করের উল্লেখ থাকলেও কোনো বিদেশী সাহায্য বা ঋণের কথা বলা হয়নি। কারণ অক্সফোর্ড অভিধান বের হয় যে ব্রিটেনে, তারা বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর নয়; বরং ‘দাতা’ নামে মহাজন।
ভারতের সংসদ বাংলা অভিধান খুব উচ্চমানের অভিধান হিসেবে প্রশংসা পেয়ে থাকে। ‘বাজেট’-এর মতো দীর্ঘকাল ধরে বহুলপ্রচলিত শব্দই এতে নেই (২০০৪ সালের পুনর্মুদ্রণ)। অথচ বাজেটের বাংলা প্রতিশব্দ নেই বলে এটি বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বহু আগেই।
এবার দেখা যাক বাংলাদেশের অভিধান। আমাদের যে অভিধান সুনাম কুড়িয়েছে, এমনকি ভারতে যে বই রফতানি হয়ে থাকে, বাংলা একাডেমীর সেই ইংরেজি-বাংলা অভিধান কী বলে? না, ‘বাজেট’ নেই সেখানে! এই অভিধানে বাজেট শব্দটির সংজ্ঞা, অর্থ, ব্যাখ্যাÑ কিছুই দেয়া হয়নি। অথচ বিশেষ্যবাচক বাজেটকে শুরুতেই বিশেষণের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সে শব্দটি হলো ‘বাজেট অ্যাকাউন্ট’। এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, ‘ব্যাংকের যে হিসাবে চলতি হিসাব থেকে সাথে সাথে অর্থ স্থানান্তরিত করে গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিল পরিশোধ করা হয়।’ যে বাংলা একাডেমী এখন নিজকে বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক বলে দাবি করছে, তারা বাজেট সম্পর্কে বাঙালিদের এভাবেই জ্ঞান দান করে কৃতার্থ করছে।
জনগণ চায় সাদা মনের মানুষ। অথচ মনে হচ্ছে এই সরকার কালো মনের মানুষ চায়। যারা কালো টাকার মালিক এবং লজ্জা নেই বলে তার অর্জন রাখে অব্যাহত; ওদের মন কালো না হয়ে পারে না। সবার বিরোধিতা সত্ত্বেও বাজেটে টাকা কালো থেকে সাদা করার মহাসুযোগ রেখেছে মহাজোট সরকার। ধুলেও কয়লা যায় না ময়লা। মুখটা হোয়াইটওয়াশ করলেই ফর্সা হয় না। তেমনি ‘সাদা’ করার অবকাশ দিলেই ‘কালো’ টাকাওয়ালারা ভালো হয়ে যাবে না। কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ আগে থেকেই আছে। কিন্তু এই অবৈধ অর্থের সৃজন ও সঞ্চয় কমেনি। একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘বৈধ আয়ের চেয়ে অবৈধ আয়ের ওপর করের হার কম হলেও কালো টাকার মালিকেরা তা সাদা করতে আগ্রহী নয়। বরং কালো টাকা দেদার রোজগার করে প্রথমে বিদেশে পাচার, পরে ডলারে বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবেও তা দেশে আসছে।’ আর বৈধ আয়ের ওপর বেশি কর চাপানোর মধ্য দিয়ে সরকার কি মানুষকে সৎ থাকার শাস্তি দিচ্ছে না?
বাজেট অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে আতঙ্কের বিষয় হয়ে আছে। সোজা কথায় সাধারণ মানুষ মনে করেÑ বাজেট মানে প্রতি বছর জুন মাসে সংসদে ঘোষণা দিয়ে বেশ কিছু দরকারি জিনিসের দাম বাড়ানো। বাজেটে কিছু জিনিসের ওপর কর কমানো হয়। তাই এগুলোর দাম কমাই স্বাভাবিক। বাস্তবে দেখা যায়, কর কমানোর হারের তুলনায় জিনিসটির দাম কমেছে সামান্য অথবা কমেইনি। অথচ যেখানে ৫ শতাংশ কর বাড়ানো হয়, সেখানে নানা অজুহাতে জিনিসটির দাম বেড়ে যায় এর চেয়ে বেশি। যেগুলোর দাম বাড়ে বাজেটের পর, সেগুলোর প্রভাবে আরো অনেক পণ্য বা পরিষেবার দাম বা খরচ বেড়ে যায় যুক্তিসঙ্গত না হলেও।
বাজেটে কয়েকটি পণ্যের দাম কমার উল্লেখ রয়েছে। তবে খুব খুশি হওয়ার কারণ নেই। আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দাম কমানোর প্রস্তাব গৃহীত হলে দাম কমতে পারে আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে, তার আগে নয়। দাম কমার তালিকার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নাম ফ্রিজ ও মোটরসাইকেল। বাজেটের আগে এগুলো বিদেশ থেকে এখানকার বাজারে এসেছে। তাই কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, দাম কমা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামের ওপর। ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকলে বাজেটে দাম কমালেও সুফল মিলবে না।
আগামী দিনগুলোতে বিদ্যুৎ সঙ্কট কোন পর্যায়ে পৌঁছবে জানি না। তবে সরকার যে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি করতে পারবে না, তা এখন জনগণের সামনে স্পষ্ট। এবার বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণীত হয়েছেÑ এমন খবর উঠেছে পত্রিকায়। ঠিক সেদিনই নতুন করে বিদ্যুৎবিভ্রাট বেড়েছে। রাজধানীর যে এলাকায় থাকি, সেখানে গত কয়েক দিন লোডশেডিং কমে গিয়েছিল; কিন্তু বাজেট ঘোষণার পরদিনই দেখা গেল ১ ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে আর ১ ঘণ্টার জন্য। শুক্রবার মাগরিবের সময় বিদ্যুৎ ছিল না। এশার আজান শেষ হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ বিদায় নেয়ায় আজানের বাকিটা শোনা যায়নি। অন্ধকারে ভ্যাপসা গরমে নামাজ আদায় করতে হয়েছে। এ অবস্থা চলে রাত ১টা পর্যন্ত ‘বিদ্যুৎ বাবু’র ঘনঘন আসা-যাওয়া দেখে একজন মন্তব্য করলেন, সরকার এবার বিদ্যুৎ খাতকে গুরুত্ব দেয়ার অর্থ, লোডশেডিং বাড়ানোর দিকে আরো মনোযোগী হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিদায়ী অর্থবর্ষের বাজেটের ওপর সুদীর্ঘ পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। এতে একপর্যায়ে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া যায় এডিপি ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এডিপি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি এবং সরকারের অর্থব্যয়ের অধিকতর উৎপাদনশীল অংশের অন্তর্ভুক্ত। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ধরেই এডিপির জন্য ব্যয় করা হয়েছে দুঃখজনকভাবে কম। এডিপির বরাদ্দ পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমাতে বাধ্য করা হয়েছে। আর গত জুলাই থেকে এবার এপ্রিল পর্যন্ত আর্থিক পরিমাপে মাত্র ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ কাজ হয়েছে সংশোধিত এডিপির। বর্তমান সরকারের আমলে ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের এটাই সর্বনিম্ন রেকর্ড।
আরো উদ্বেগের বিষয়, বিদেশী সাহায্য ব্যবহারের হার এর চেয়েও কম, যা মাত্র ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ফলে পূর্বোক্ত ১০ মাসে মোট এডিপি ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশের জন্য স্থানীয় অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে হলো। সিডিপির হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে এডিপি বাবদ ব্যয় কমে যেতে পারে ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল এডিপির ৮০ ভাগের কম বাস্তবায়ন হচ্ছে।
সিডিপি আরো আশঙ্কা করেছে, এডিপির জন্য অর্থায়নে প্রকল্প সাহায্য ও স্থানীয় সম্পদের বিদ্যমান অনুপাত বজায় থাকলে ২০১১-১২ সালের এডিপিতে যে পরিমাণ বিদেশী সাহায্য ব্যবহৃত হবে, তা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাজেট নিছক আয়-ব্যয়ের নিরেট হিসাব নয়। এর সাথে, পেছনে ও সামনে বহু বক্তব্য, প্রেক্ষাপট ও লক্ষ্য থাকে। বাজেটের চেহারা অর্থনৈতিক, চালিকাশক্তি রাজনৈতিক। এবারের বাজেটের বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্যের কথা আগেই মিডিয়া উল্লেখ করে বলেছে, ‘নির্বাচনী বাজেট আসছে।’ এ কারণেই এত উচ্চাভিলাষী। অর্থমন্ত্রীও সায় দিয়ে বললেন, ‘এটাই বর্তমান সরকারের আমলে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। তাই এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।’ ২০১৪ সালের গোড়ায় আগামী সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরটা এই সরকার পাবে আংশিক মাত্র। ওই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে তরণী প্রতীকধারী আওয়ামী লীগের জন্য এবারের বাজেট একটা মহা উপলক্ষ। তাই চমক লাগানোর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন এই বিরাট বপু বাজেট।
সরকারের ভাবনায় তো শুধু সামনের নির্বাচনে জেতা নয়, ‘ভিশন-২০২১’ এখনো মাথায় চক্কর দিচ্ছে। এ দিকে জনমত বিগড়ে আছে সরকারের বিরুদ্ধে। তত্ত্বাবধায়ক বাতিলসহ শত ফন্দিফিকিরেও যদি আগামী নির্বাচনে পা ফসকে যায়, তাহলে এই ‘ভিশন’ সরকারের জন্য ‘ভীষণ’ দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনের আগে মুফ্তে সার, ১০ টাকায় চাল, প্রতি ঘরে চাকরির ওয়াদা করে পরে শুধু ব্যর্থই হয়নি, ক্ষমতায় গিয়ে দস্তুরমতো এসব ওয়াদার কথা অস্বীকার করেছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা আবার ভোট বাগানোর খায়েশে বাজেটের মাধ্যমে যে অঙ্গীকার করছে, এটা পূরণ হবে বলে মানুষ আশা করতে পারছে না। ডিজিটাল সরকার বাজেটে ডিজিট বা সংখ্যার খেলায় যত ইন্দ্রজাল ছড়ানোর প্রয়াস পাক না কেন, বিশেষজ্ঞদের মতে এটা ÔHigh thought, low stepÕ মাত্র।
এখনকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পোড়োবাড়ির মতো নড়বড়ে বলে অভিহিত করে একজন ভাষ্যকার স্মরণ করলেন কলকাতার কবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘সংগতি’ কবিতার পঙ্ক্তি : মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার/ ঐ ভাঙা দরজাটা/মেলাবেন।’ সে ভাষ্যকার লিখেছেন, এই ঝড়, এই পোড়োবাড়ি আর এই ভাঙা দরজা নিয়েই অর্থমন্ত্রীকে নৌকায় আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে। মেলানোর সেই ‘সংগতি’ তিনি কতখানি দেখাতে পারলেন বাজেটে? ...এই বাজেটে ভোক্তারা খুশি হবেন না। ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা বজেটে নেই। বাজেটে অতীতের অনেক গুণগান আছে, ভবিষ্যতের জন্য অনেক আশার কথা আছে; কিন্তু আশা পূরণের পরিকল্পনার কথা নেই। এই বাজেট দিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এটা জানা কথা, যত উচ্চাভিলাষী বাজেট হোক, পরিকল্পনা ছাড়া সব আশা ‘পরী’র মতোই ‘কল্পনা’ থেকে যাবে। আর চ্যালেঞ্জটা বাস্তবে অর্থমন্ত্রীর নয়, এটা প্রধানমন্ত্রীর, তার সরকার ও দলের।
পুনশ্চ : এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে বলছে, ‘তুই সোস্যালিস্ট না ক্যাপিটালিস্ট?’ জবাব দিলো, দোস্ত, আমি মাসের প্রথম ১০ দিন ক্যাপিটালিস্ট বা পুঁজিবাদী। তখন হাতে বেতনের পুরো টাকা। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। মাসের মাঝের ১০ দিন আমি সোস্যালিস্ট বা সমাজবাদী। কারণ তখন হাতের টাকা কমে গেছে কিছুটা। অতএব, প্রয়োজনের বাইরে খরচ না করার ব্যাপারে সতর্ক। আর শেষ ১০টা দিন নিহিলিস্ট, মানে নৈরাজ্যবাদী। কারণ তখন হাত প্রায় খালি। দিশেহারা হয়ে উচ্ছৃঙ্খলতা প্রদর্শন করি।’
আমরা আশা করি, আমাদের দেশের সরকার অন্তত এতটা অদূরদর্শী হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন