বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

ক্ষমতায় না থাকলে কিসের সংসদ, কিসের গণতন্ত্র

রাহাত খান


বিএনপি সংসদীয় নির্বাচনসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক স্তরের নির্বাচনে অংশ নেয় বটে, তবে দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে আমার মনে হয় না। ক্ষমতায় যেতে পারলে সংসদে তারা যোগ দান করে। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়ার প্রশস্তি কীর্তনে কাটে সংসদের অর্ধেক সময়। এখন আবার জুটেছেন বাচ্চায়ে-সাকো জিয়া খালেদা তনয় তারেক রহমান। হাওয়া ভবনের যাবতীয় কৃতিত্ব অর্জনের বীর হিসাবে তাঁকেই ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপি’র পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। তার প্রশস্তিও যে ক্ষমতাসীন বিএনপি’র সংসদে কীর্তিত হবে এতেও সন্দেহ নেই।
ক্ষমতায় যেতে পারলে এটাই দাঁড়ায় সংসদে বিএনপির সংসদীয় কর্তব্য। কিছুটা সময় অবশ্য দেশের নানা সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়। তবে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপি সাংসদদের সংসদে অনেকটা সময় দিতে হয় নেত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নিন্দা সমালোচনায়। নিন্দা ও সমালোচনার ভাষা ও মান ক্লাস এইট পাস স্ট্যান্ডার্ডের ওপরে যায় না। বাংলা অভিধানে খুঁজে পাওয়া দুরূহ, এমন সব অশ্লীল শব্দের ব্যবহার হয় অহরহ।
আর বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলে? তাহলে সেটা তো আর গণতান্ত্রিক বলে মানা যায় না! বিএনপি নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় যেতে না পারলে কিসের গণতন্ত্র কিসের সংসদ! সংসদের সদস্য থাকাটা খুব লাভজনক বটে। নানা দিক দিয়ে। সে জন্যে সংসদে ৯০ দিনের মধ্যে একবার তো যেতেই হয়। তাই খালেদা জিয়াসহ দলের সব সাংসদ ৯০ দিনে একবার মেহেরবানী করে সংসদে যোগ দেন। বেশিরভাগ সময় তাদের সংসদে যোগ দেয়া দু’এক দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। তারপর তারা কোন না কোন খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে সংসদ বর্জন করেন।
বিএনপির জন্য এটাই স্বাভাবিক। জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায় কিংবা দেশের উন্নয়ন আকাক্সক্ষার লক্ষ্য নিয়ে তো বিএনপি তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম হয়নি। এই দলের জন্মস্থান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। লক্ষ্য বাংলাদেশ নামটা শুধু বজায় রেখে দেশকে আবার পেয়ারে পাকিস্তানে পরিণত করা। এজন্য দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কলমের এক খোঁচায় বাংলাদেশ সংবিধানের চারটি প্রধান ভিত্তির তিনটাই বাতিল করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ছোটে ‘আইয়ুব’ বলে পরিচিত জিয়াউর রহমান তাঁর স্বৈরাচারী ক্ষমতা বলে আরো যা করেন তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর করে যাওয়া দালাল আইন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ আইন বাতিল করা। উদ্দেশ্য খুবই ‘মহৎ’। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর নির্বিচার বাঙালী গণহত্যা, ধর্ষণ, মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী দল যেমন জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের পুনরুজ্জীবনকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া এবং নামটা (বাংলাদেশ) শুধু টিকিয়ে রেখে কার্যত দেশটাকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করা। আশা করি বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাকারী শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেন কথাগুলোর সত্যতা মেনে নেবেন।
না নিলেও অবশ্য ক্ষতি নেই। বিএনপির জন্মকাল থেকে এখনাবধি দলটির লক্ষ্য যে গণতন্ত্র নয়, সেটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। তারা কি চায়, সেটা এখন বিএনপি গোপনও করে না। স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালীবিরোধী মনেপ্রাণে পাকিস্তানের সমর্থক জামায়াতে ইসলামীর তারা এখন জুনিয়র পার্টনার। তারা ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির হাতে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়া পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের প্রতি প্রতিশোধের বদলা নিতে চায়।
এই লক্ষ্য দু’ভাবে পরিপূরিত হতে পারে। এক. ষড়যন্ত্র, বাক-চাতুর্য এবং ক্ষমতাসীন দলের ভুল বা ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গিয়ে রাজনীতিতে ও সমাজজীবনে আবার পাকিস্তানী ভ-ামি এবং ধর্মের নামে জঙ্গীবাদের সৃষ্টিকে পাকাপোক্ত করা এবং প্রগতির অগ্রযাত্রাকে নানা কৌশলে ব্যাহত করা। দুই. দেশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনকৃত সম্পদ পাচারের দরজা হাট করে খুলে দেয়াÑগুম ও হত্যাকা-কে রাজনীতির হাতিয়ার করে তোলা তথা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই দুই লক্ষ্য সামনে রেখে বিএনপি এবং জামায়াত যে তাদের রাজনৈতিক কার্যতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জাতির স্বেচ্ছা-অভিভাবক ব্যারিস্টার রফিকুল হকদের সন্দেহ থাকতে পারে। তবে আমার মতো অনেক অধমেরই এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়ার শাসনকালের রাজনীতি এবং কার্যধারা বিশ্লেষণ করলেই এই উপসংহার অবধারিত বেরিয়ে আসে। তবে জ্ঞানপাপী এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে প্ররোচিত হওয়া রাজনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল সমাজের একশ্রেণীর মিডিয়ার লাইম লাইটে থাকতে চাওয়া লোকদের তো সেটা বলে লাভ নেই। বিএনপি, জামায়াত, মুসলিম লীগ এসব দলকে তারা গণতান্ত্রিক দল বলেই বিশ্বাস করেন বোধহয়।
তা সেটা তারা করতে চান, করুন। আমি যা বলতে চাই সেই বিষয়টিই বরং বলার চেষ্টা করি। আমার কথা কারও কারও কাছে বিস্বাদ এবং একতরফা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি যে ক্ষমতার বাইরে বিরোধী দলে থাকার সময় নানা অজুহাত তুলে সংসদ বর্জন করে গণতন্ত্রের ‘পহেলা সবক’কেই অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ জ্ঞান করে সংসদে যায় না, বিরোধী দলের যে দায়িত্বশীল ভূমিকা আছে, তা পালন করে না, এটা তো তর্ক-বিতর্কের বিষয় নয় এটা তো এ দেশের রাজনীতির রেকর্ডেই আছে।
নানা মহল থেকে বিএনপি-জামায়াতকে সংসদে যোগ দেয়ার এবং সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করার কথা বলা হয়েছে। বিদেশে আমাদের মিত্র দেশসমূহের রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী, প্রতি-উপমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তরফ থেকে বিএনপি-জামায়াতকে সংসদে গিয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এমনকি, ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট সাংসদ ও নেতৃবৃন্দ বিএনপিকে সংসদে যোগ দেয়ার এবং নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য বারবার আহবান জানিয়েছেন। মাননীয় স্পীকার, সর্বজনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আবদুল হামিদও বারবার বিএনপি-জামায়াতকে সংসদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমন আশ্বাস তিনি দিয়েছেন যে, সংসদে ক্ষুদ্র লঘিষ্ঠ সংসদ গোষ্ঠী হলেও তিনি তাদের বেশি সময় দেবেন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? বিএনপি-জামায়াত সংসদে আসন রক্ষা ছাড়া কখনও সংসদের ছায়া মাড়ায় না। মুখে না বললেও, তাদের মনের ও শরীরী ভাষা অতি পরিষ্কার। বিএনপি-জামায়াতের কথা হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় নেই, তাহলে কিসের সংসদ! কিসের গণতন্ত্র! ২০০১-২০০৬ শাসন পর্বে তারা দেশটাকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের দেশে পরিণত করেছিল। অবাধ দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার এবং হত্যার রাজত্ব কায়েম করেছিল। সেই সময়-পর্বে দেশ পরিচালনায় যেমন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, এবার বিরোধী দলে থাকাকালীন সময় পর্বেও সংসদীয় বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আশা করি, বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনে বিএনপি-জামায়াতের এই চরম ব্যর্থতা এবং দায়িত্বহীনতা অধিক বলার বা অধিক প্রমাণের কোন প্রয়োজন নেই।
আসলে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে নামার সত্যিকারের কোন ইস্যু নেই। তাদের আন্দোলনে নামার এবং ক্ষমতাসীন সরকারের বিপক্ষে ‘কঠোর’ অবস্থান নেয়ার একটাই ইস্যু : তাদের সোনার হরিণ চাই, চাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতা ছাড়া কোন সাধারণ নির্বাচন তারা হতে দেবে না। দরকার হলে ‘জনগণ’কে নিয়ে বর্তমান নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হবে। পাক রাষ্ট্র পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামানো যায়, এই ‘তালেবান থিয়োরি’ বাংলাদেশের বেলায়ই বা কার্যকর করা যাবে না কেন? বিএনপি-জামায়াত খুবই আত্মবিশ্বাসী, শীঘ্রই সরকারের পতন ঘটবে, নির্বাচনে জিতে তারা ক্ষমতায় যাবে এবং যারা বিএনপিবিরোধী ছিল তাদের ধরে ধরে বিচার করবে, শাস্তি দেবে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী হবেন দুর্নীতিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘পিএইচডি ডিগ্রী’ অর্জন করা তারেক রহমান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ বলতে তো কিছু ঘটেনি, বিএনপি-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এসে তাই বিচারাধীন এবং অনেকেই দ- পেতে যাওয়া রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং বিএনপির ভাষায় ‘তথাকথিত’ যুদ্ধাপরাধীদের সসম্মানে মুক্তি দেবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস জামায়াতবিরোধী এ দেশের বিশাল তরুণ ভোটারদের ৯০ ভাগই বিএনপি- জামায়াতের এই ‘খোয়াব’কে সত্য হতে দেবে না। গত সাড়ে তিন বছরে কিছু কিছু ভুল, ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ব্যর্থতা সত্ত্বেও বর্তমান মহাজোট সরকারের সাফল্যের পিরিধিও যথেষ্ট বিস্তৃত। আবার বাংলাদেশে তালেবান জঙ্গীবাদ ফিরে আসবে, গ্রেনেড, বোমাবাজি নির্বিচার হত্যার দিন ফিরে আসবে, হাওয়া ভবনের অধিষ্ঠান হবে, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় কয়েক ধাপ এগোবে,বাংলাদেশের মিত্র দেশ এবং দাতাগোষ্ঠী তো বটেই, বাংলাদেশের সাধারণ সচেতন ভোটাররাও সেটা হতে দেবেন বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন