শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অজ্ঞতা এবং মাহমুদুর রহমানের জবাব



হা সা ন শা ন্ত নু
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তথা নব্য আর পুরনো আওয়ামী লীগাররা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ছকের বাইরে পা ফেলবেন না নিশ্চিত। ফেলা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাদের যে কণ্ঠ আমরা শুনছি, সেটা রিহার্সেল করা। দীপু মনিরা ভারতীয় রাজনৈতিক দাদাদের শব্দ প্রতিধ্বনি করবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের মতো সর্বোচ্চ অঙ্গনে দাঁড়িয়ে তাদের মিথ্যাচার, তাঁবেদারিত্ব, সংসদীয় রীতিকে আওয়ামী কায়দায় নির্যাতিত করা নতুন বিস্ময়ের জন্ম দেয় না। যে কোনো অঙ্গনে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার, নষ্টামি আওয়ামী রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মিশে আছে দীর্ঘকাল ধরে। তবে গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে দীপু মনি সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা, আমার দেশ সম্পাদক, পাঠকনন্দিত কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গে মিথ্যাচার করে বলেছেন, ‘উপদেষ্টার আগ্রাসী সিদ্ধান্ত ছিল গ্যাস ব্লক’। সংসদের মতো অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দীপু মনির এ মিথ্যাচার নতুন বিস্ময়ের জন্ম না দিলেও নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়।
মাহমুদুর রহমানের প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা ভারত ও মিয়ানমারের দখলের প্রতিবাদ সম্পর্কে দীপু মনিদের জানা থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তারা তো ইংরেজি কবিতার সেই বালকের মতো। এক বালককে নৌকার গলুইয়ের মধ্যে বসিয়ে রেখে নৌকা তীরে লাগিয়ে বাবা গেলেন হাঁটে। যাওয়ার আগে বালককে বলে গেলেন, ‘আমি না বললে নৌকা থেকে নামবি না।’ এর মধ্যে নৌকায় আগুন লেগেছে। বালক চিত্কার করছে—‘বাবা আমি কি তীরে আসব?’ বাবা শুনতে পাচ্ছেন না। এক পর্যায়ে আগুন নৌকার গলুইয়ে চলে এলো। বালক পুড়ে মরে গেল। দীপু মনিরাও ওই বালকের মতো বলেন আর করেন ভারতীয়দের নির্দেশে। মাহমুদুর রহমানের বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা দখলের প্রতিবাদ সম্পর্কে জানা থাকলেও দীপু মনিরা মিথ্যাচার করবেনই। তবে সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো একজন ব্যক্তিকে পড়াশোনা করে কথা বলা উচিত। সংসদ তো চূড়ান্ত মূর্খতা চর্চার জায়গা নয়। সেদিন সংসদে ডা. দীপু মনি গঙ্গা চুক্তি নিয়ে ‘আওয়ামী লীগের আগে কোনো চুক্তি হয়নি’ বলে যে মিথ্যাচার করেছেন, তাতে আপাতদৃষ্টিতে তার অজ্ঞতার পাশাপাশি মিথ্যাচারের উদ্দেশ্যও প্রকট হয়ে উঠেছে।
ডা. দীপু মনি সংসদে মাহমুদুর রহমানের নাম উল্লেখ করেননি। নাম উল্লেখ না করলেও জোট সরকারের সময় মাহমুদুর রহমান ছাড়া আর কেউ জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদীয় রীতি উপক্ষো করে সংসদে উপস্থিত নেই, এমন একজনকে নিয়ে কথা বলেছেন, ভেতরে গিয়ে যার জবাব দেয়ার সুযোগ নেই। দীপু মনি বলেছেন, ‘তিনি আবার উপদেষ্টা ছিলেন। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাত্ সেই লোক দিয়ে দিল ব্লক। কিসের ব্লক, সে ব্লক কোথায় দিয়েছিলেন। কার বাড়ি, কার ঘর, কে দেয় ব্লক। আমার সীমানা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমরা যেতে পারি। মিয়ানমারেরও সেই অধিকার রয়েছে। কিন্তু তিনি যে ব্লক চিহ্নিত করলেন তার দূরত্ব মিয়ানমারের কোস্টলাইন থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল। আমি মিয়ানমারের এলাকায় গিয়ে আমার ব্লক দিলাম। এর চাইতে আগ্রাসী অসত্ প্রতিবেশীসুলভ কাজ তো আর হতে পারে না। আর এটা করে আমাদের দেশকে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় জড়িয়ে ফেলেছিলেন তারা’। (আমার দেশ ২৯.০৬.১২)
অথচ সত্য হচ্ছে, ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত বাংলাদেশের স্থলভাগ, সমুদ্রবক্ষে নতুন অনুসন্ধান কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ সুযোগে দীপু মনিদের তথাকথিত ‘বন্ধুপ্রতিম দেশ’ ভারত ও মিয়ানমার (ছোট দাদাদের দেশ) সমুদ্রবক্ষে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান কার্যক্রম বেগবান করে। দু’দেশই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবিকৃত অংশকে তাদের ব্লকভুক্ত করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। মাহমুদুর রহমান জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দু’দেশের দখলি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো আপত্তি উত্থাপন ও প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদ করলে দীপু মনিদের ‘বন্ধুরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায় মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু হয়। ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ্তুঝড়ঁঃয অংরধ অহধষুংরং এত্ড়ঁঢ়্থ-এ ড. আনন্দ কুমার ২০০৬ সালের জুলাইয়ে ্তুঙরষ চড়ধপযরহম ঈড়হঃত্ড়াবত্ংু রহ ইধু ড়ভ ইবহমধষ্থ শিরোনামের নিবন্ধে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। নিবন্ধটির একাংশ এরকম—‘এ যাবত ভারত-বাংলাদেশের হাইড্রো-কার্বন সংক্রান্ত বিরোধ ট্রানজিট, বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এ বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এবার বাংলাদেশ অভিযোগ করছে, ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে সেখানে গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে।... বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান দাবি করেছেন, ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমার অভ্যন্তরে যথাক্রমে ১৯০০০ এবং ১৮০০০ বর্গমাইল এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এ অংশে হাইড্রো-কার্বন অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে।’
তখন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রক্ষার জন্য গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে মন্ত্রণালয় আদালতে আবেদন করে। গ্যাসক্ষেত্র সন্ধান ও রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আদালত ২০০৬ সালের ১৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। মাহমুদুর রহমানের দৃঢ়তায় ২০০৫ সালে ওই সময়ের সরকার ভারতের হাইকমিশনার ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানায়। সে সময় ভারতীয় অনেক মিডিয়া মাহমুদুর রহমানের ‘শত্রুতা-সৃষ্টিকারী’ ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছিল। দীপু মনি তাঁবেদারিত্বের অবস্থান থেকে বলতে গিয়ে দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমানের প্রশংসা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বদলে ভারতীয়দেরই প্রতিধ্বনি করেছেন।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বুঝে গেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালের (ইটলস) গত ১৪ মার্চের প্রশ্নসাপেক্ষ রায়ে সমুদ্র জয়ের দাবি করার পর সেটা প্রমাণ করতে না পেরে ব্লক হারানোর ব্যর্থতায় দীপু মনিরা এখন এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। কেননা, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালতে তারা বাংলাদেশের দাবি ও স্বার্থে ছাড় দিয়ে এসেছেন।
সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘তাঁবেদারদের স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত ভালো লাগে না। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে কঠোর অবস্থান, দেশের স্বার্থ রক্ষা করে ব্লক চিহ্নিত করার ফলেই সমুদ্রে আজ আমরা আমাদের এতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। অন্যথায় তাও পেতাম না। ... আমরা তখন সমুদ্রসীমা ও ব্লক নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে সিদ্ধান্ত না নিলে বর্তমান দুর্বল ও তাঁবেদার সরকার বন্ধুত্ব আর সুসম্পর্কের কথা বলে মিয়ানমার ও ভারতের কাছে আমাদের সমুদ্রসীমা হয়তো তুলে দিত। দীপু মনির মতো রাজনীতিবিদ, যারা বিদেশের তাঁবেদারি করতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক। ... আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব সময়ই জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেছি। বর্তমান সরকারের মতো তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি করে সম্পদ আহরণের চিন্তা মাথায় ছিল না।’
২৮ জুন সংসদে দীপু মনি গঙ্গা চুক্তি নিয়েও মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের আগে কোনো চুক্তি হয়নি।’ অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তিটি হয়েছিল পাঁচ বছর মেয়াদি এবং গ্যারান্টি ক্লজসহ। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৬ সালে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা চেয়ে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন