কনক জ্যোতি
বাংলাদেশে বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বিরোধী দল সেখানে অংশ নেয়নি। তারা তখন জেল-জুলুম আর মামলায় নাকাল হচ্ছিলেন। বাজেটে অংশ নেবেন, না জান বাঁচাবেন, এমনই ছিল তাদের অবস্থা। সরকার চাইলে বাজেটে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের পথ করে দিতে পারতেন। সেটা হয়নি।
বাজেটকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটা নির্বাচনকে সামনে রেখে করা একটি বাজেট। বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও সঙ্গতি কতটুকু রয়েছে-বাজেট নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এমন প্রশ্নও করছেন। নিজস্ব সম্পদ আহরণ এবং বিদেশী সাহায্যের নির্ভরতা এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের আহরণ নিয়েও যে খুব একটা ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। বিশেষ করে বিশ্ব-অর্থনীতির তীব্র মন্দাবস্থায় বিদেশী সাহায্যপ্রাপ্তির বিষয়টিও বিতর্কসাপেক্ষ। অতএব বাজেট সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের ভাবনা-চিন্তা ও বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে।
এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্ব-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও একটি স্বচ্ছ আলোচনা এবং পরিষ্কার চিত্র সামনে থাকা দরকার ছিল। বাজেট প্রণয়নে সেটা কাজে লাগতো। সেটাও করা হয়নি। বরং মনে হচ্ছে, বিশ্ব-অর্থনীতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাথা-ব্যথা নেই এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদিও তাদের হাতে নেই। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন থেকে কাজ করাটা সমীচীন নয়। মনে রাখতে হবে যে, দেশের সাধারণ মানুষ তথ্য-প্রযুক্তির শক্তিতে জাতীয় অর্থনীতি এবং বিশ্ব-অর্থনীতির তথ্য-পরিসংখ্যান সম্পর্কে অবহিত এবং এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত। ফলে রাজনৈতিক বা নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজেট প্রণয়নের ফাঁক আবিষ্কার করতে মানুষের কষ্ট হবে না।
প্রসঙ্গত বিশ্ব-অর্থনীতির দিকেও এক্ষণে নজর দেয়া যেতে পারে। ইংরেজিতে volatile বা বাংলায় টালমাতাল শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। উদ্বেগজনক ধারা অনুধাবনের জন্যে এ শব্দটিই যথেষ্ট। মনে হয়েছিল, আর্থিক সঙ্কট কেবল উন্নয়নশীল দেশেই। বাস্তবে সেটা ছড়িয়ে গেছে উন্নত বিশ্বসহ সর্বত্র।
পন্ডিতরা এমনও মনে করছেন যে, বরং সঙ্কটের উগাতা পশ্চিমা উন্নত বিশ্ব। আমেরিকার পরিস্থিতি প্রথমেই উল্লেখ করি। সেখানে আর্থিক-বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল সীমিত। ব্যাঙ্কার কিংবা আর্থিক উপদেষ্টাদের ভাবা হয়েছিল বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন। কিন্তু তারা অনেক প্রতিষ্ঠানের লাল বাতি-জ্বলা বন্ধ করতে পারেননি। আমেরিকার সার্বিক আর্থিক কার্যক্রমে যে ফাটল ধরেছে, সেটা ক্রমেই বাড়ছে।
ইউরোপীয় অঞ্চলের সমস্যা শুরু হয় গ্রিস থেকে। গ্রিসের ‘সার্বভৌম ঋণপত্র' বিনিয়োগকারীদের তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। এমনই সমস্যায় পড়ে গেছে পর্তুগাল, স্পেন এবং ইতালি। সবাই মিলিতভাবে ইউরোপের আঞ্চলিক অর্থ ভান্ডারের দ্বারস্থ হয়েছে বিপদ উত্তরণের প্রয়োজনে। হিসাব করে দেখা গেছে সমস্যা মেটাতে দরকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের। দেশগুলো মাত্র ২৫০ বিলিয়ন ডলার নিজেরা দিতে পারছে। বাকি অর্থের জন্যে অইউরোপীয় উন্নয়নশীল দেশের কাছেও হাত পাততে হতে পারে। ফ্রান্সের নতুন শাসকের কৃচ্ছ্রতা আর ‘রাজস্ব ক্ষেত্রে শৃক্মখলাবদ্ধ দেশ' নেদারল্যান্ডসের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ইউরো-প্রতি ডলার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩১০৬। কৃচ্ছ্রতা আর মুদ্রার দুর্বলতার কারণে ইউরোপে চাহিদার সঙ্কোচন হয়েছে। এতে শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানির প্রস্তুতকৃত শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে এসেছে। ইউরোপীয় অঞ্চলের ক্রয়ক্ষমতার সূচক বলছে, প্রাইভেট সেক্টরের কর্মকান্ড অপ্রত্যাশিতভাবে কমেছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জার্মানিতে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ কমবে।
অন্যদিকে, এশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীগণ হন্যে হয়ে ঘুরছেন ভাল মুনাফাসম্পন্ন বাজারের সন্ধানে। ভারত এক্ষেত্রে তেমন আশা জাগাতে পারছে না। সুশাসনের অভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল বলে পরিচিত ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। ভারতের ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আস্থার অভাবে ভুগছে। একই সঙ্গে ভারতে আমদানি বৃদ্ধি ও রফতানি হ্রাসের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। সেখানে কমছে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের বিপরীতে ‘রুপি'র অবমূল্যায়ন ঘটছে।
লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে বিশ্ব-অর্থনীতির ঝাপ্টা কিছুটা কম। ব্রাজিল ও পেরু থেকে চীন প্রাথমিক সম্পদ আমদানি করছে। ফলে সেখানে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিকর পর্যায়ে রয়েছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বর্তমান অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতেই থাকলে সমস্যায় পড়বে চীনও। কেননা, তখন সেসব দেশে চীনের রফতানি কমতে থাকবে। লাতিন আমেরিকাও কাঁচামাল বিক্রির চীনাবাজার হারাবে তখন। আফ্রিকা ও এশিয়ার ক্ষুদ্র ও উন্নয়নকামী দেশগুলোও আর্থিক বিষয়ে স্থিরতা অর্জন করতে পারছে না।
আরব বসন্ত এবং যুদ্ধংদেহী অবস্থার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলোও আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের সামগ্রিক অবস্থার বিচারে আর্থিক স্বস্তি কম। বিশ্ব-অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থা চট করে কমিয়ে ফেলার মতো কোনও আশাবাদ দেখা যাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় আশ্চর্যজনকভাবে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রধান হয়েছেন একজন অঅর্থনীতিবিদ; পেশায় যিনি চিকিৎসক! বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সর্বদা সেটির লাগাম ধরে রেখেছে। এবার অনেকেই মনে করেছিল, বিশ্বব্যাঙ্কের আসন্ন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচনে কিছুটা লঘু হতে পারে মার্কিনীদের দাপট। এমনকি, সভাপতির পদ পেতে পারেন নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত তা হলো না। বিশ্ব-আর্থিক সঙ্কটের ভয়াবহতার মধ্যেই বিশ্বব্যাঙ্কের নতুন প্রধান নির্বাচিত হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-মনোনীত কোরীয়-মার্কিন চিকিৎসক ডাক্তার জিম ইয়ং কিম। এবং এই প্রথম একজন চিকিৎসক এই পদে নিযুক্ত হলেন। নানা মহলে তাই সঙ্গত প্রশ্ন, জিম একজন অত্যন্ত দক্ষ সমাজসেবী ও চিকিৎসক হলেও অর্থনীতির বিদ্যমান সঙ্কটের আনাচ-কানাচ সম্পর্কে কি যথেষ্ট যোগ্য, ওয়াকিফহাল ও সঙ্কট মোচনে কার্যকর ব্যক্তি?
বিশ্ব-অর্থনীতির এমন অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলী, আত্মনির্ভরশীল বাজেটের প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। বিশেষ করে এটাও মনে রাখা দরকার যে, সাধারণ মানুষ ঘাটতি বাজেট, না উদ্বৃত্ত বাজেট, সেটা দেখতে চায় না। সাধারণ মানুষ বুঝতে চায় তাদের জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় ভাল না খারাপ হয়েছে। তবে এবার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় পণ্যের ওপর শতকরা ৪ ভাগ ভ্যাট আরোপ করায় মানুষ হতাশ হয়েছে। অর্থাৎ, যেসব পণ্যের ওপর ইতোমধ্যে ভ্যাট আরোপিত আছে, সেগুলির জন্যেও সাধারণ মানুষকে আরো ৪ ভাগ হারে ভ্যাট দিতে হবে। ১৯৯১ সনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রথম ভ্যাট প্রথা চালু করেন। মোটা দাগে মানুষ দেখতে চায় শিক্ষা খাত, কৃষি খাতসহ জনগণের প্রত্যক্ষ উপকারে আসে। এরকম খাতে বরাদ্দ বেড়েছে কিনা। সঙ্গতভাবেই মানুষ শিক্ষা ও কৃষি খাতে আরো বেশি বরাদ্দ আশা করেছিল। সিগারেটের ওপর করারোপ আরো বৃদ্ধি কাম্য ছিল। বিশেষত, বাজেটটি অধিক সংখ্যক মানুষকে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট করলো, নাকি মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থরক্ষা করলো, সেটাও দেখা দরকার।
অতীতে বাজেটকে সমালোচনা করা হতো ‘গরীব-মারার বাজেট' নামে। বিশেষ করে সামরিক সরকারের বাজেটকে এমন ধারার সমালোচনার সম্মুখীন হতে হতো। এখন রাজনৈতিক সরকারের আমলে সমালোচনার ধরন বদলেছে বটে, সমালোচনা শেষ হয়নি। সকল রাজনৈতিক মহলের অংশগ্রহণহীন বাজেটেও যদি ক্ষমতাসীন সরকারের একতরফা মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে, তবে সেটা দুঃখজনক।
বাজেটের সঙ্গে বিশ্ব-অর্থনীতির যেমন সম্পর্ক আছে, তেমনি সম্পর্ক রয়েছে গণতন্ত্র এবং অংশগ্রহণের। সর্বমহলের অংশগ্রহণহীন কার্যক্রম বৈধতার দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান বাজেট তেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রবীণ অর্থমন্ত্রী, যিনি শেয়ারবাজার নিয়ে নানা মন্তব্যের জন্যে আলোচিত-সমালোচিত, তাকে কাজ করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে; সকলকে আস্থায় নিয়ে। এমন একটি আস্থার জায়গাই জনগণ দেখতে চায় বাজেটসহ সরকার পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন