শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত করার সরকারি চেষ্টা


গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত করার সরকারি চেষ্টা ॥ সিরাজুর রহমান ॥

স্কুলে আমাদের সিনিয়র অঙ্ক শিক্ষক সুধীন ভট্টাচার্য্য ভীষণ রসিক লোক ছিলেন। পাটীগণিতের মতো নীরস বিষয়ের ক্লাসেও তিনি মুহূর্তে হাস্যমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন। সেই দিন তিনি ‘রুল অব থ্রি’ নামে পাটীগণিতের একটি বিধি শেখাচ্ছিলেন আমাদের। তিনটি করে অঙ্ক ক্লাসেই করতে বললেন। একটা ছেলে বাঁ হাত দিয়ে চোখ কচলাচ্ছিল। সুধীন বাবু ওকে জিজ্ঞেস করলেন অঙ্কগুলো পেরেছে কি না? ছেলেটি জবাব দিলো সে এক চোখ বন্ধ করে দুটো অঙ্ক করেছে। শিক্ষক চট করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এক চোখ বন্ধ করে দুটো অঙ্ক করেছিস তুই, দুই চোখ বন্ধ করে চারটা করতে পারতিস? গোটা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠেছিল।
আরেকটি ছেলে অঙ্ক কষে বের করেছিল পটোলের সের ছয় আনা হবে। স্যার তাকে বললেন- আচ্ছা, পটোলের সের যদি ছয় আনা হয় তাহলে যে তুলেছে তার বাবার নাম কী? কলকাতায় তখনকার প্রচলিত বাংলায় ‘পটোল তোলার’ অর্থ ছিল অক্কা পাওয়া বা মারা যাওয়া। সুতরাং আমরা সবাই এই অ-সম্পর্কিত রসিকতায় হেসে উঠেছিলাম। বিশেষ করে এ কাহিনীটার অবতারণা করলাম বাংলাদেশের কিছু ঘটনার প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশের জন্য বর্তমান পরিসি'তি খুবই ট্র্যাজিক না হলে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহু উক্তি স্কুলের অঙ্কের ক্লাসের মতো হাস্যরোল সৃষ্টি করতে পারত। আগেও কোনো কোনো লেখক লিখেছেন, বাংলাদেশে সকালবেলার সূর্য ওঠে পুবের আকাশে কিন' নতুন চাঁদ যে পশ্চিম আকাশে ওঠে শেখ হাসিনা সম্ভবত সে জন্যও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে (জনসাধারণ তিনবার যাকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেছিল এবং বর্তমানেও যিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন বলে জাতি আশা করে) দায়ী করেন। দেশে আইনশৃঙ্খলা নেই, ন্যায়বিচার নেই, জানমালের কিংবা নারীর মর্যাদার নিরাপত্তা নেই। মাত্র গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার ফলে র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা কমলেও বাংলাদেশে মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। দায়িত্ব স্বীকার করে সেসব দুষ্কৃতির প্রতিবিধানের পরিবর্তে কথায় কথায় এবং কারণে-অকারণে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেবেন, বিনা মূল্যে সার দেবেন কৃষককে, রাতারাতি বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করবেন, আরো কত কী? কোন প্রতিশ্রুতিটা পালন করতে পেরেছেন তিনি? মানুষ অসন'ষ্ট। খুবই ক্রুদ্ধ। শেখ হাসিনার সরকার কিছুই দিতে পারছে না তাদের। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী প্রাণ খুলে সব কিছু দিয়ে দিচ্ছেন ভারতকে। ভারত একে-দুয়ে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সব নদীর পানি আটকে দিচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী করজোড়ে বলছেন, ‘দেবো প্রভু, আরো দেবো, যতো চান ততো দেবো’। ভারত আমাদের সড়ক চায়, রেলপথ চায়, নদী চায়, বন্দর চায়। দিল্লিকে সব কিছু দিয়ে কৃতার্থ বোধ করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পর আমাদের ভূগোলকেও তারা নিয়ে নিতে চায়। আমাদের দেশের ভেতরে এসে তারা আমাদের নদীতে, শাখানদী আর খালগুলোতেও বাঁধ দিচ্ছে।

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা আর চাই না
বাংলাদেশের মানুষ তিন বছরে অনেক কিছু সয়েছে। যুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতার ওপর অন্য দেশের পোদ্দারি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো সর্বক্ষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে তাদের। তারা এখন আর নীরব থাকবে না। তারা প্রতিবাদ করছে, হরতাল করছে। তারা বলছে, তারা গণতন্ত্র চায়, তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি চায়। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যত দোষ খালেদা জিয়ার। খেটেখাওয়া মানুষ যৎসামান্য সঞ্চয়, বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়না আর গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে আনা টাকা শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারের সমর্থক আর সরকারের পৃষ্ঠপোষক দুষ্ট লোকেরা সাধারণ মানুষের সে লগ্নির টাকা লুটেপুটে খেয়েছে। গত তিন বছরে আবারো হরির লুট চলেছে শেয়ারবাজারে।
মধ্যবিত্তের লাখ লাখ কোটি টাকা তারা লুট করেছে, সে টাকায় ডলার কিনে বিদেশে পাচার করেছে। কিন' একটাও মুদ্রাপাচারের মামলা হয়েছে কী কারো বিরুদ্ধে? হয়নি। হয়নি, কেননা এরা খালেদা জিয়ার পুত্র নয়, শেখ হাসিনার বরপুত্র। ৩২ লাখ পরিবার শেয়ারবাজারে সর্বস্ব খুঁইয়ে পথে বসেছে, তাদের পোষ্য দেড় থেকে দুই কোটি নরনারী ও শিশু সর্বস্বান্ত হয়েছে। মানুষ ক্রুদ্ধ। এমন সাঙ্ঘাতিক অবিচারে হয়তো পাগলও হয়ে গেছে কেউ কেউ। তারা প্রতিবাদ করছে, হরতাল করছে, রাজপথ অবরোধ করছে। শেখ হাসিনার মনে পড়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা : ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। সে রকম করেই শেখ হাসিনা বলছেন, সব কিছুর জন্য খালেদা জিয়াই দায়ী।
ধরা পড়ার ভয়ে চোর নিজেই ‘চোর চোর’ বলে ছুট দেয়। এ দৃশ্যের সাথে আমাদের অনেকেরই পরিচয় আছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হয়েছে সে দশা। মানুষ ক্রুদ্ধ, অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, সর্বোপরি অপমানিত। এ অবস'া চলতে দিলে তাদের সংযমের বাঁধ ভেঙে যেতে বাধ্য। সরকারি মহলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এরা খালেদা জিয়ার দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। নাগাল পাচ্ছে না বলে পাশের দেশ থেকে আঁকশি ধার করে আনছে। কলকাতার পত্রিকা ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করছে। সে ধুন তুলে ঢাকার সরকার আবারো গান জুড়ে দিয়েছে। সব কিছুর জন্যই খালেদা জিয়া দায়ী। ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। এ দিকে বাংলাদেশের শহর-নগর আর পথে-ঘাটে কী হচ্ছে? সরকারি দলের সোনার ছেলেরা খুন-খারাপি, ছিনতাই-রাহাজানি, নারী ধর্ষণ ও সম্পত্তি গ্রাস করছে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সিট-বাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য ও হত্যা চালাচ্ছে নির্বিবাদে। তাদের নৈরাজ্য আর খুন-খারাপির দায়িত্ব শেখ হাসিনা বহন করতে রাজি নন, ভান করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও তার বরপুত্ররা ধোয়া তুলসিপাতা।

সাত দফা চুক্তি কি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে?
উনিশ শ’ একাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের কাছে বন্ধীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, বিডিআরের বীর জওয়ানেরা আর দলত্যাগী সৈন্যরা নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশের সাধারণ মানুষ সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে তাদের। সে জন্য বহু নির্যাতন সয়েছে তারাও, বাংলাদেশের নারী তার আত্ম মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছেন।
কলকাতার হোটেলে-গেস্ট হাউজে প্রমোদ আর বিলাসে কাটিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা ভারত সরকারের ব্যয়ে। তাদের আশ্রয় আর ভরণ-পোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানের বিনিময়ে ভারত সরকার যা যা দাবি করেছিল সব কিছু মেনে নেয়া ছাড়া দেশ থেকে পলাতক এসব আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতার গত্যন্তর ছিল না। দিল্লির সাথে এরা সাত দফা চুক্তি করেছিলেন। চুক্তিতে তারা মেনে নিয়েছিলেন যে স্বাধীন হলে বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না, নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না বাংলাদেশের এবং বিডিআরকে ভেঙে দিতে হবে। তাজউদ্দীনের সরকার সেসব দাবি মেনে নিলেও ভারতের এসব অন্যায় শর্ত মেনে নেয়া শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সেসব দাবি মানবে না। কিন' প্রমাণ হয়ে গেছে শেখ মুজিব আর শেখের কন্যা হাসিনার সম্মান ও মর্যাদাবোধ এক মাপের নয়।
শেখ হাসিনা এ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। এখন আর কারোই অজানা নয় যে ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে‘ এক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে জিতেছিল। তারপরই শুরু হয়েছে ভারতকে মূল্যদান। সেটি অবশ্যি প্রত্যাশিত ছিল। কিছু পেতে হলে কিছু দিতেই হয়। শেখ মুজিব যে সাত দফা চুক্তি নাকচ করে দিয়েছিলেন সে চুক্তি আবার বহাল করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীত্বের মূল্য হিসেবে।
এ সরকারের দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ ঘটে। প্রায় তিন বছর গড়িয়ে গেলেও সব ঘটনা সাধারণ মানুষেরও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ক’দিন আগে থেকেই বিডিআরের কোনো কোনো সদস্যের সাথে মুঠোফোনে প্রচুর আলাপচারিতা করছিলেন বলে তখনো বলাবলি হচ্ছিল, মিডিয়ার কোনো কোনো অংশেও সেসব কথা প্রচারিত হয়েছে। একপ্রস' হত্যালীলার পর ঘাতকেরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলাপ করেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেন’। বর্ণাঢ্য নামের সব মানুষ তারপরও বিডিআর সদর দফতরে যান এবং তারপর চলে আরো এক দফা হত্যাকাণ্ড। সন্ধ্যায় বিডিআরে হাওয়া খেতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং তখনকার খবর অনুযায়ী তার উপসি'তিতে আরো একবার গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছিল বিদ্রোহ দমন করতে, কিন' তাদের মাঝপথে থামিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহের পরে পরে বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান যেসব আজেবাজে ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেছিলেন সে প্রসঙ্গ না হয় না-ই তুললাম।

আসল রহস্য উদঘাটন করতে হবে
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়নি। লোকদেখানো বিচারের নামে শুধু শত শত জওয়ানকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের গৃহপালিত মিডিয়া এবং কলম সন্ত্রাসীরা ছাড়া অন্যেরা বহুবার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত করে পালের গোদাদের খুঁজে বের করার দাবি জানান। আমি নিজেও একাধিক কলামে সুস্পষ্ট ভাষায় সে দাবি করেছি। কিন' ঘটনার পেছনের ঘটনা ও ষড়যন্ত্র আবিষ্কার এবং পালের গোদাদের মুখোশ খুলে দেয়ার কোনো চেষ্টাই হয়নি।
বিডিআর বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস' ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। তার পর থেকে সেনাবাহিনী যেন যবনিকার অন্তরালে চলে গেছে, কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানেও দেশবাসী তাদের সেনাবাহিনীকে দেখতে পায়নি। শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে জাতিসঙ্ঘের কাছে ভাড়া দিয়ে কিছু বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা হচ্ছে। দিল্লির অভিপ্রায় অনুযায়ী বিডিআরকে ভেঙে দেয়া হয়েছে। তার পরিণতি কী হয়েছে সবাই তা দেখতে পারছে। মাঝে মধ্যেই ভারতীয়রা বাংলাদেশের জমি দখল করে নিচ্ছে। সীমান্তে হরহামেশা বাংলাদেশী খুন হচ্ছে। ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে সেসব ‘ছোটখাটো ঘটনা’, সে দিকে সরকারের গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব লোপ করে দিয়ে কি সাত দফা চুক্তির আরো একটি দফা পালন করা হবে?
আবারো ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। সরকার বিডিআর বিদ্রোহের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করেনি। হঠাৎ করে আবার সে বিদ্রোহের জন্য খালেদা জিয়ার ঘাড়ে দায় চাপানোর কথা মনে হয়েছে কোনো কোনো সরকারি মহলের। এ দিকে আবার অভিযোগ উঠেছে যে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর দিক থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে শুধু অভিযোগই করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগ ও তদন্ত মানেই যে অপরাধের প্রমাণ নয়- এ কথাটা কেউ বোধ হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের শেখায়নি অথবা আজ্ঞাবহ আদালতে অভিপ্রায় অনুযায়ী রায় পেয়ে পেয়ে তাদের বদ অভ্যেস হয়ে গেছে, নিজেদের অভিযোগকে তারা প্রমাণিত অপরাধের সমার্থক বিবেচনা করছে।
এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী তো কোনো রকম তদন্তের আগেই খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে বসেছেন! খালেদা জিয়া সম্পর্কে শেখ হাসিনার গাত্রদাহের কারণ বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার আপসবিহীন সংগ্রামের সময় থেকে বাংলাদেশের মানুষ তাকে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক রূপে গ্রহণ করেছে, গণতন্ত্র বিপন্ন বোধ করলেই তারা তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। অন্য দিকে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা হচ্ছে বাকশালী অথবা অন্য কোনো ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে চিরকালের জন্য গদি আঁকড়ে রাখা। তার এই অশুভ পরিকল্পনার প্রধান বাধা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব। বহু সাজানো মামলায় খালেদা জিয়া ও তার ছেলেদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা। সেটি সম্ভব না হলে জনতার চোখে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যা অভিযোগের তো অবধি নেই।
দুর্ভাগ্যবশত দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে যতটা শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছে, বিএনপির মন্ত্রিত্ব ও নেতৃত্ব-লিপ্সু নেতাদের কেউ কেউ তেমন আন্তরিক সমর্থন ও সুপরামর্শ তাকে দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। তারা যে বেঁচে আছেন হয়তো সেটা প্রমাণ করার জন্যই মাঝে মধ্যে তারা বক্তৃতা করেন কিংবা বিবৃতি দেন। আমার প্রায়ই মনে হয় এরা কৌতুক গানের লিরিকের “রাঁধিব বাড়িব ব্যঞ্জন কুটিব, হাঁড়ি তবু ছোঁ’বনা” গোছের নেতা। তারা মাঠে নামবেন না, সংগঠনের কাজ করবেন না। আমার মনে হয় তাদের সবাই সুপরামর্শও দিচ্ছেন না নেত্রীকে।

অহেতুক বিতর্ক শক্তি ক্ষয় করছে
বর্তমান গণতন্ত্রের আন্দোলনে খালেদা জিয়া সুপরামর্শ পাচ্ছেন বলে আপনাদের মনে হয় কি? সংবিধান থেকে ইসলামকে বর্জন এবং একতরফা সংবিধান সংশোধন করে যেই দিন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাদ দেয়া হয় বাংলাদেশের মানুষ সেই দিনই বুঝে গেছে এ সরকারের মতলব শুভ কিংবা সাধু নয়। তারা পাশের দেশের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করে ‘উগ্র সেকুলারিজম’ চালু করতে চায়। সে মূল্যে ভারতের সমর্থনে গদি পোক্ত করতে চায়।
খালেদা জিয়ার আন্দোলন যখন সাফল্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, তখন বিএনপির কোনো কোনো মহল থেকে ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের‘ কথা উঠছে। কোন সংবিধানের কথা বলছে তারা? যে সংবিধান নিয়ে শেখ হাসিনা ময়দার কাইয়ের দলার মতো খেলা করছেন সে সংবিধানের? মতলবি মহল গুজব ছড়াচ্ছে, ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের সাথে নাকি বিএনপির বোঝাপড়া হয়ে গেছে, সমঝোতা হবে শিগগির। কিন' কিসের বোঝাপড়া? কিসের সমঝোতা? সরকার কি তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছে? অথবা রাজি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে? দিলেই বা তাদের আশ্বাসের মূল্য কী?
বর্তমান গণতন্ত্রের আন্দোলন দুই থেকে তিন মাস আগেই তুঙ্গে উঠেছে। নেতাদের মধ্যে দ্বিমত থাকতে পারে কিন' সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলেছে ঠেলে না ফেললে এ সরকার গদি ছাড়বে না। দলীয়কৃত পুলিশ, প্রশাসন আর বিচারব্যবস'া তাদের হাতে। সেসব ব্যবহার করে তারা গদি আঁকড়ে থাকতে চাইবে, প্রয়োজন হলে দলীয় সরকারের অধীনে আবারো মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচন করে। আরো বস্তা বস্তা টাকা আর চানক্যদের পরামর্শ আসবে পাশের দেশ থেকে। এ অবস'ায় ‘কুইক, কুইক, শ্লো’ আন্দোলনের কৌশল হতে পারে না। আম পাকলে পেড়ে নিতে হবে, নইলে পচে যাবে কিংবা কাকে খাবে। লোহা তপ্ত থাকতে হাতুড়ির ঘা দিতে হয়, নইলে অযথা পরিশ্রমই সার হবে। এসব সাধারণ বুদ্ধির কথা বিএনপির নেতারা কী বোঝেন না? নেতৃত্বের ভেতরে যদি কুচক্রি কিংবা মীরজাফরের বংশধরদের কেউ থেকে থাকেন তাহলে কঠোর ব্যবস'া নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। নইলে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ সেটি আশা করে না।
(লন্ডন, ২৪.০১.১২)
serajurrahman@btinternet.com

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১২

শহীদ জিয়ার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া জরুরি

২০১২-০১-১৯

জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে (সে দিন তিনি সাক্ষাৎকারের পরিবর্তে বলেছিলেন, আমার সাথে তার অনেক কথা আছে) তাকে আমার কাছে একজন সৈনিক বলেই মনে হয়েছিল, আর ভাগ্যাহত দেশটার জন্য অনেক কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন তিনি। প্রথম সমস্যাটার কথা তিনি বললেন তার প্রিয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে। তিনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন, সেনাবাহিনীর নিজের কোনো সমস্যা নেই, তবে বাইরের কিছু লোক সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
সমস্যা যে এত সহজ ছিল না সেটা আমি ভালো করেই জানতাম। স্বাধীনতার সময় থেকেই মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় সেনাবাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর বিরোধ ছিল। জাতীয় বাহিনীকে বঞ্চিত রেখে রক্ষীবাহিনীকে আদরের দুলালের মতো তোষণ করা হচ্ছিল। জাতীয় বাহিনীর সৈনিকেরা যখন রাবারের স্যান্ডেল পায়ে কুচকাওয়াজ করছিল, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুরূপ ইউনিফর্ম পরিহিত রক্ষীবাহিনী নতুন ভারতীয় জিপে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াত। দুই বাহিনীর মধ্যে রেষারেষি তখন লক্ষ না করে উপায় ছিল না।
এর ওপর ভারত আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতাকে ভারতীয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তারা দ্রুত ঢাকা ফিরে আসেন। মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত এই ব্যক্তিরা রক্ষীবাহিনীকে দিকনির্দেশনা দিতেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পালাক্রমে তাদের কারো না কারো উপসি'তি থেকে আমার ধারণা হয়েছিল তারা শেখ মুজিবের ওপরও নজর রাখছিলেন।
মার্ক টালি প্রমুখ বিবিসির ডাকসাইটে সংবাদদাতারা তখন প্রায়ই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে যেতেন। তারা খবরগুলো প্রচার করতেন এবং ‘খবরের পেছনের খবরগুলো’ সম্পাদকীয় বৈঠকে আমাদের শোনাতেন। আমি নিজেও প্রায়ই বাংলাদেশে গিয়েছি তখন। মুজিব মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও অফিসারদের ডবল প্রোমোশন দিয়েছিলেন। পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে বাঙালি অফিসাররা দেশে ফিরে এসে দেখেন তাদের জুনিয়রদের কেউ কেউ এখন তাদের সিনিয়র হয়ে গেছেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনে আরো একটা মাত্রা যুক্ত হলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা কয়েকজন সেনা অফিসারের বিদ্রোহের পরিণতি হলেও তার পেছনে জাতির সমর্থন না থাকলেও আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। অশাসন-কুশাসন, রক্ষীবাহিনীর গুপ্তহত্যা, সর্বময় দুর্নীতি, অর্থনীতির চরম বিপর্যয়, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার লোকের প্রাণহানি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতার প্রভৃতি কারণে জাতীয় জীবন দুঃসহ, দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল এবং মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় জীবনের প্রতিভু, তারা বিশেষ কোনো মার্শাল রেস বা বিশেষ কোনো শ্রেণী থেকে আসেনি।

টানাপড়েনের বৈদেশিক মাত্রা
মুজিব হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর টানাপড়েনে একটা বৈদেশিক মাত্রাও যুক্ত হয়। খোন্দকার মোশতাক আহমদ জাতীয়তাবাদী ছিলেন যদিও তার মন্ত্রিসভায় মুজিব সরকারের আটজন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একাত্তরে আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়ে তিনি দিল্লির বিরাগভাজন হয়েছিলেন, সে জন্য ভারত ও মস্কোর চাপে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই সাউথ ব্লক (ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) তার অপসারণ কামনা করতে থাকে। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেনারেল খালেদ মোশাররফ যখন অভ্যুত্থান করে খোন্দকার মোশতাককে অপসারণ এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন দিল্লিতে তখন আনন্দোৎসব শুরু হয়েছিল, সাউথ ব্লকে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল।
কিন' সাধারণ সিপাইরা তাদের নামে অফিসারদের অভ্যুত্থানপ্রীতি সমর্থন করেনি। কর্নেল তাহের ও অন্য জাসদ নেতাদের প্রভাবে তারা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। আমার বড়ভাই মরহুম এয়ার কমোডোর এ বি এম মাহবুবুর রহমান ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একজন অফিসারের শূন্য বাড়িতে নিয়ে যান। সে বাড়ির দেয়ালে অন্তত হাজারখানেক বুলেটের গর্ত আমি দেখেছি। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সিপাইদের হাতে ধরা পড়েন, সিপাইরা তাকে হত্যা করে।
সাধারণ সিপাইরা ৭ নভেম্বর গৃহবন্দিত্ব থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে কাঁধে চড়িয়ে সেনা সদর দফতরে নিয়ে যায় এবং সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করে। কিন' সে দিনের একটা প্রবণতায় জিয়া উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। সিপাইরা দল বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে সমাজতন্ত্রী প্রচারপত্র বিলি করছিল, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিচ্ছিল। তারা গণচীনের তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবী গণবাহিনীর অনুকরণে বাংলাদেশে চেন অব কম্যান্ড-বিহীন একটা অনিয়মিত সেনাবাহিনী দাবি করছিল। এটাও পরিষ্কার হয়ে যায়, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্নেল তাহের।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত দিন সকালে আমি বিমানে রাজশাহী থেকে এসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামি। পরিচিত এক ব্যক্তি বললেন, সিএমএলএ-এর ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন শুনেছি, কিন' ইন্টারভিউ তো আজ হবে না। তিনি আরো বললেন, আগের দিন পতেঙ্গা ক্যান্টনমেন্টে এক সিপাই জনৈক মেজরকে স্যালুট করতে অস্বীকার করলে মেজর তার আঙুলে গুলি করেন। সেখানে উত্তেজনা চলছে এবং সে উত্তেজনা সামলাতে জিয়া কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। ভদ্রলোক অতিরিক্ত কিছু তথ্যও দিলেন আমাকে। এ রকম অবস'া দেশের সর্বত্রই চলছে এবং পরিসি'তি শান্ত করতে জিয়া এ ক্যান্টনমেন্ট থেকে সে ক্যান্টনমেন্টে ছোটাছুটি করছেন, গুটি চালাচালির মতো করে নন-কমিশন্ড অফিসারদের বদলি করছেন। শেরাটন হোটেলে পৌঁছার অল্পক্ষণের মধ্যেই সিএমএলের পিএসএ কর্নেল অলি আহমদ টেলিফোন করলেন। বললেন, আমার সাথে নাকি জেনারেলের অনেক কথা আছে, আজ তার হাতে সময় কম, আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা এক দিন পিছিয়ে দিলে কি আমি কিছু মনে করব?
পরের দিনের সাক্ষাতে জেনারেল জিয়া অনেক কথা বলেছিলেন আমাকে। আমার টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা তিনি নিজ হাত দিয়ে কর্নেল অলির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, আমার সাথে কথা বলে নিজের ও দেশের সমস্যাগুলো তিনি গুছিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে চেন অব কম্যান্ড ফিরিয়ে আনা তার প্রথম প্রায়োরিটি। সমস্যাগুলো পরে আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। যতই ভেবেছি সমস্যাগুলো ততই দুরূহ মনে হয়েছে। তার মর্মান্তিক হত্যার পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্ক টালি বলেছিলেন, জিয়া তার সেনাবাহিনীকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন, আর হয়তো সে জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

জিয়া যেভাবে সমস্যাগুলো শনাক্ত করেছেন
কুশলী সেনাপতি যেভাবে রণক্ষেত্র ও যুদ্ধ-পরিসি'তির বিশ্লেষণ করেন জিয়াউর রহমান ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের সমস্যাবলি বিশ্লেষণ করছিলেন আমার কাছে। এর পরেও কয়েকবার তার সাথে আমার কথা হয়েছে, একাধিকবার তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। কিন' ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির সে দিনের দীর্ঘ একান্ত আলাপ জিয়াউর রহমানের মূল্যায়নের জন্য আমার বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি বলছিলেন বাংলাদেশের মানুষ মনে-প্রাণে গণতন্ত্রকে ভালোবাসে। তার প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। সুতরাং তাদের গণতন্ত্র দিতেই হবে। কিন' বাকশাল, মুজিব হত্যা, একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান প্রভৃতির পর হঠাৎ করে অবাধ গণতন্ত্র দেয়া নিরাপদ হবে না। নিরাপদে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পন'া নিয়ে তিনি শিগগিরই বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা শুরু করবেন।
এটা হয়তো নতুন প্রজন্মের জানা না-ও থাকতে পারে। শেখ মুজিব সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক ইত্তেফাক আর বাংলাদেশ অবজারভার- এই চারটি ছাড়া অন্য সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছু দিনের ভেতরই জেনারেল জিয়া সব পত্রপত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, পত্রপত্রিকা প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাকশাল চালুর সময় আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। সব রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি, তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ উন্মুক্ত করে দেন এবং নিজেও তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। গোড়া থেকেই তিনি কূটনৈতিক পন'ায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। সেসব উদ্যোগ ব্যর্থ হলে তিনি আওয়ামী লীগের দুইজন শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ ভগিনীদ্বয়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করেন। তারা অবশেষে রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার মাত্র ১৩ দিন আগে ১৯৮০ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
জিয়াউর রহমান বলছিলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ কিন' জনসংখ্যা বিরাট। তার ওপর দেশটা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং প্রাকৃতিক সম্পদও খুবই সীমিত। মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে, বিদেশী রেডিও-টেলিভিশন তাদের প্রত্যাশা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা নিকট-ভবিষ্যতে কিছু পরিমাণেও পূরণ করা না গেলে গণরোষ সামালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে তিনি শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে সমস্যার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, এদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করা না গেলে তারা দেশজোড়া বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। বিগত তিন বছরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সংস'া যেভাবে হত্যা, ছিনতাই, সম্পত্তি গ্রাস, ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডার সন্ত্রাস প্রভৃতি চালাচ্ছে জেনারেল জিয়াউর রহমান খুব সম্ভবত এসব নৈরাজ্য দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছিলেন।
জিয়াউর রহমান তারপরে রাষ্ট্রপতি হন। তিনি যখন দেশজোড়া খাল খনন ও নদী সংস্কারের কাজ শুরু করেন তখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, শিক্ষিত বেকারদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করার এই পন'াটি গোড়াতেই তিনি বেছে নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এই কর্মসূচি দেশের শিক্ষিত ও পেশাজীবী মহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল এবং বিশ্বব্যাপী তাতে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। আর মাত্র একটা ব্যাপারেই সে রকম আন্তর্জাতিক উৎসাহ সৃষ্টি হয়, সেটা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে কখনও বন্যা, কখনও খরা- এই হচ্ছে প্রকৃতির তাণ্ডব। সামপ্রতিক কালে ভারত নিদারুণ পানি আগ্রাসন শুরু করেছে এ দেশের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে তারা সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ বেঁধে পানি আটকাচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে তারা মধ্য ভারতের ঊষর অঞ্চলে সেচের জন্য সেসব নদীর পানি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

পানি আগ্রাসন ও জিয়ার খাল খনন প্রকল্প
অভিন্ন ৫২টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ দুই সপ্তাহের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সুযোগ ভারতকে দিয়েছিলেন। ভারত সেটাকে চিরস'ায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেছিলেন। কিন' চুক্তি অনুযায়ী এক বছরও বাংলাদেশ পানি পায়নি। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ‘নতজানু বন্ধুত্বের’ সম্পর্ক। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে কল্পনার রসগোল্লা খাওয়াচ্ছিলেন এই বলে যে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এসে মনমোহন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করবেন। মনমোহন এলেন ও গেলেন কিন' তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি হলো না।
ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক মানাভিমানের খেলা খেলল, মাঝখান দিয়ে বঞ্চিত হলো বাংলাদেশ। পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নাকি শেখ হাসিনার ‘জানী দোস্ত। হালে আবার মমতা বন্ধুত্বের জালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনিকেও জড়িয়ে ফেলেছেন। কিন' তিনি বলছেন খরার মওসুমে তিস্তার পানি তিনি বাংলাদেশকে দেবেন না, দেবেন বর্ষাকালে, যখন বন্যা সামলাতে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণান্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সর্বনাশ করবে, সুরমা-কুশিয়ারা আর মেঘনা শুকিয়ে যাবে। কিন' শেখ হাসিনা আর দীপুমনি বলছেন ভারতীয়রা কথা দিয়েছে বাংলাদেশের ক্ষতি তারা করবে না।
বাংলাদেশের মানুষকে নতুন করে বেঁচে থাকার চিন্তা শুরু করতে হবে, শহীদ জিয়ার নদী সংস্কার, খাল খনন ও জলাধার নির্মাণের কর্মসূচিতে ফিরে যেতে হবে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে জিয়া যদি নিহত না হতেন, তার এই আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত কর্মসূচি যদি পরিত্যক্ত না হতো তাহলে বাংলাদেশের মানুষ খাবার পানি, সেচের পানি ও মাছ চাষের পানির ব্যাপারে মোটামুটি স্বনির্ভর হতে পারত। বর্তমানের সঙ্কটপূর্ণ সময়ে বেঁচে থাকতে হলে আবারো তাদের জরুরি ভিত্তিতে সে কর্মসূচির কাজ শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের একটা কর্মসূচির কথা তিনি ভাবছেন- এ কথা জেনারেল জিয়াউর রহমান আলোচ্য বৈঠকেই আমাকে বলেছিলেন। পরবর্তী কালের ১৯ দফা কর্মসূচিতে সেটা বিকাশ লাভ করেছে। এ কর্মসূচিকে যথার্থই জাতীয় মুক্তির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়েছে। ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের জমিদার ও জনপ্রতিনিধিরা এক অধিকারের সনদে রাজা জনের স্বাক্ষর আদায় করেছিলেন। ম্যাগনাকার্টা নামে বর্ণিত এ দলিল এখনো ব্রিটিশ গণতন্ত্রের রূপরেখা বলে স্বীকৃত। শহীদ জিয়ার প্রণীত ১৯ দফার প্রথমটিতেই ‘সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার’ কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্য আর পানীয়ের পরেই মানুষের প্রধান ভাবনা শেখ হাসিনার সরকারের ভারতের প্রতি অত্যধিক ঔদার্য থেকে দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার পবিত্রতা রক্ষা করা।
উনিশ দফায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর ও সুশৃঙ্খল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ওপর। নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল। ভুলে গেলে চলবে না, প্রারম্ভিকভাবে ১০ শতাংশ সরকারি চাকরি নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখার এবং বালিকাদের স্কুলে পাঠানোর বিনিময়ে খাদ্যসহায়তা দেয়ার ব্যবস'া রাষ্ট্রপতি জিয়াই প্রথম চালু করেন। জিয়ার ঘোষিত মূলনীতি থেকে আজকের বাংলাদেশ কতখানি সরে এসেছে তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বাংলাদেশে ফসল ভালো হয়েছে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানান ‘মা-দুর্গাকে’, আরো একটা ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ স'াপনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তোড়জোড় চলছে বলে শুনেছি। অন্য দিকে টুপি-দাড়িওয়ালাদের ওপর নাকি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা খবরদারি নজর রাখছে।

সার্ক গঠনের অনুপ্রেরণা
সমতার ভিত্তিতে সব রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা তার ১৯ দফার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নীতি অনুসারেই জিয়া দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সমিতি (সার্ক) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের পিছুটানের কারণে সার্ক পূর্ণতা পায়নি। ভারতের লক্ষ্য ছিল ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিভক্ত ও দুর্বল রেখে তাদের ভারতনির্ভর করে রাখা। স্বভাবতই রাষ্ট্রপতি জিয়ার সার্ক গঠনের উদ্যোগকে তারা সন্দেহের চোখে দেখেছে।
তার বিপরীতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের শোচনীয় পরিসি'তি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ভারতের সাথে ‘নতজানু বন্ধুত্ব’ স'াপন করতে গিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কের গুরুতর অবনতি করা হয়েছে। ভারতকে সন'ষ্ট করার প্রয়োজনে আগ্রাসী ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণ করা হচ্ছে (যদিও ভারতের প্রধান বিরোধী দলই হচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি, যে শিবসেনা গোষ্ঠী মহাত্মা গান্ধীর পরমতসহিষ্ণুতা সহ্য করতে না পেরে তাকে হত্যা করেছিল সে শিবসেনারা এখন বিজেপির অঙ্গদল), সংবিধান থেকে ইসলামকে বাদ দেয়া হয়েছে, নানা উছিলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি হয়েছে। এই দেশগুলো এখন সাহায্য-বাণিজ্য ও শ্রমিক নিয়োগের বেলায় ক্রমেই বাংলাদেশের প্রতি বেশি বৈষম্য দেখাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গত হয়েছেন প্রায় ৩২ বছর আগে। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সে দেশটিকে আমরা বাস্তবায়িত করতে পারিনি। দেশকে আজ যে পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন মনে হচ্ছে। সেটা যদি আমাদের কাম্য না হয় তাহলে শহীদ জিয়াউর রহমানের লক্ষ্য ও আদর্শের নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে আমাদের। জিয়ার প্রয়োজন আজ জরুরিভাবে অনুভূত হচ্ছে।
লন্ডন, ১৬.০১.১২
serajurrahman@btinternet.com

কার কোনটা আহ্লাদ সেটা বোঝা যাচ্ছে না


কার কোনটা আহ্লাদ সেটা বোঝা যাচ্ছে না

॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥


কখনো কখনো এ সরকারকে হীরক রাজা মনে হয়। কখনো মনে হয় রোমের নিরোদের সরকার। রোমের নিরোর কাহিনী সর্বজনবিদিত। রাজা নিরো বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন। রাজকার্যে ছিলেন অমনোযোগী। রাজপ্রশাসনও পরিচালনায় তিনি ছিলেন চরম ব্যর্থ। তাই শত্রুর আক্রমণে রোম যখন পুড়ছিল তখনো নিরো বাঁশি বাজাতে নিমগ্ন ছিলেন।
বর্তমান সরকারের বিষয়টি ক্ষমতায় আসার একেবারে প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার আগে এ ধরনের বিষয়বস'র খুব প্রাচুর্য ছিল না। মীরজাফর জেনারেল মইন নেপথ্য ক্ষমতা গ্রহণের পর এ দেশের সব রাজনীতিক দুর্নীতিবাজ- এমন কথা ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে শুরু করেন। এবং এই দুর্নীতিগ্রস- হিসেবে রাজনীতিবিদ ও শত শত কোটি টাকা মূলধনের ব্যবসায়ীকে ছয় ফাইল ত্রাণের টিন চুরির মামলায় অভিহিত করে জেলে পুরতে শুরু করে। একইভাবে যেসব ব্যবসায়ীর গুদামে আমদানি করা পণ্য পাওয়া গেল, তাদের মজুদদার হিসেবে অভিহিত করে জেলে পুরতে আরম্ভ করে। তার পদলেহী মার্কিন নাগরিক ছদ্মবেশী বাংলাদেশী ফখরুদ্দীন আহমদ রাজনীতিকদের চরিত্র হননের জন্য প্রভুর নির্দেশে এই ঢাক বাজাতে থাকেন।
ওই সরকার যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শে ও প্রত্যক্ষ মদদে ক্ষমতায় এসেছিল সে অভিযোগ বাংলাদেশে কোনো লুকানো ছাপানো ব্যাপার নয়। তারা যে যেভাবে চেয়েছে ওই সরকার ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমছিল, তখন ওই সরকার হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলো। এর যুক্তি কী, জানতে চাওয়া হলে আরেক সেবাদাস ইফতেখার চৌধুরী বড় অসহায় কণ্ঠে বললেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে। যেন তাদের মাথা এতটাই বাঁধা ছিল যে, বিশ্বব্যাংক যদি পশুপাখির বর্জ্য খেতে বলে তাহলে সেটা খেতেও তারা কসুর করবেন না।
এরা সবাই মিলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সবাই দুর্নীতিবাজ এমন কথা প্রচার করতে শুরু করেন। ভারতও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন এসব ক্ষেত্রে জেনারেল মইনের খামখেয়ালির বিরুদ্ধে ভারত তার রক্ষাকর্তা হিসেবে দাঁড়াবে। কিন' ভারত জেনারেল মইনকে সে দেশে ডেকে নিয়ে গিয়ে একজন সেনাপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে বলেই বসেছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় জেনারেল মইনের মতো আর কেউ অধিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনকালে শেখ হাসিনা কী দেননি ভারতকে! কোনো রকম গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই গঙ্গার পানিচুক্তি করে ভারতকে কার্যত গঙ্গার পুরোটা পানিই দিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ এলাকা এখন মরুভূমিতে পরিণত হতে বসেছে। তিনি বাংলাদেশের অভ্যন-রে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'ার অবাধ গোয়েন্দাবৃত্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত শানি-চুক্তি করে বাংলাদেশের ভেতরে যেন আর একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। সীমান- দিয়ে ভারতীয় চোরাই পণ্য অবাধে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সীমানে- মানুষ হত্যার ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশের যুবসমাজকে মাদকে ধ্বংস করে দেয়ার পথও সুগম করা হয়েছিল। তাতেও ভারতের মন টলল না? জেনারেল মইনকে এতটা জামাই আদর করতে থাকল!
এবং শেষ পর্যন- রাষ্ট্রঘাতী সেই মইনকে ভারত সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু বলল? এত বড় বন্ধু আর ক্ষমতাসীন হয়নি। তা হলে ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী শাসন কি একেবারেই বৃথা গেল? মনে খেদ তার ছিল। কিন' যখন নিজে রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস'ায়ী করার জন্য জেনারেল মইন প্রথমেই শেখ হাসিনা ও পরে বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করে বসল, তখন তিনি যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। হয়তো বুকে এইটুকু স্বপ্ন নিয়ে আশার ভ্রমর ধরে অপেক্ষা করতে থাকলেন, যে ভারতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি শেষ পর্যন- কোনো কলাকৌশলে আবারো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া যায়, তাহলে গোটা রাষ্ট্রই, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বসহ, ভারতের যূপকাষ্ঠে বিলিয়ে দিবে। তবু কি ভারতের মন গলবে না।
তার পরের কাহিনী খুব দীর্ঘ নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে জেনারেল মইনের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা এবং পদে পদে খাবি খাওয়ার ফলে অচিরেই জনগণ বুঝতে পারল, আফগানিস-ানের হঠাৎ রাজা দস্যু সর্দারের সাথে জেনারেল মইনের কোনো পার্থক্য নেই। বাদশা আমানুল্লাহকে হটিয়ে ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে শকাব রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। জেনারেল মইনের সরকার তার থেকে বেশি কিছু নয়। এরা লুটপাট করে মসনদের স্বাদ কিছু দিন ভোগ করে তারপর পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। জনগণের চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে এদের বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই। এবং এরা করলও বাচ্চায়ে শকাবের মতোই কাণ্ডকারখানা। এক উপদেষ্টা তো ক্ষণিকের ক্ষমতা পেয়ে এমনো বলে বসল যে, দুর্নীতির হাত থেকে শুধু রাঘব বোয়াল নয়, চুনোপুঁটিদেরও রেহাই নেই। সমপ্রতি তার বিশাল বিশাল দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হচ্ছে।
এরা নির্বিচারে দোকানপাট-হাটবাজার ভেঙে দিয়ে সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে যেতে থাকল। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে গেল। ১০ শতাংশ মানুষের জীবনমান নেমে গেল দারিদ্র্যসীমার নিচে। চার দিকে হাহাকার আর ত্রাস। কোথাও কোথাও শুরু হলো জনতার প্রতিরোধ। দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর জন্য এরা ‘বিএনপির সিন্ডিকেট’কে দায়ী করেছিল। সে সিন্ডিকেটের হদিস তো তারা করতে পারলই না, বরং নিজেরা সিন্ডিকেট গড়ে লুট শুরু করেছিল। দ্রব্যমূল্য হয়ে উঠল সম্পূর্ণ লাগামছাড়া। রাজপথে নামতে বাধ্য হলো সাধারণ মানুষ। শেখ হাসিনা এদের সাথে নরমে গরমে দু’চার কথা বললেও বরাবরের মতো সামরিক শাসকদের প্রতি একটি মমতা প্রদর্শন করে যেতেই থাকেন। আর জানিয়ে দিলেন যে, বিএনপিকে যত পারো মারতে থাকো; তার জন্য সংবিধানের তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেলে আওয়ামী লীগ এদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করবে। ওই বিশ্বাসঘাতক মইন তখন বিএনপির চুনোপুঁটি লেভেলের নেতাদের বিরুদ্ধে একেবারে যেন হামলে পড়ল। আর ধীরে ধীরে ক্ষমতার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের গর্দান রক্ষার্থে শেখ হাসিনার সাথে আঁতাত গড়ে তুলল।
রাঘব বোয়াল, চুনোপুঁটি সবই হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। তখন দুর্নীতি আরো সর্বগ্রাসী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে যখন নগদ মুদ্রার সঙ্কট সৃষ্টি হলো, তখন তৎকালীন এফবিসিসিআই প্রধান আনিসুল হক দাবি করলেন, পাঁচ শ’ টাকার নোট অচল ঘোষণা করা হোক। তার হয়তো ধারণা ছিল যে, দুর্নীতির মাধ্যমে মইন শাসকগোষ্ঠীর অসংখ্য লোকের কাছে বিপুল নগদ টাকা স্যুটকেসবন্দী হয়ে পড়ে আছে। এগুলো বের হয়ে এলেই বোঝা যাবে টাকা কোথায় আছে। কিছুটা সময়ের জন্য রটেও গিয়েছিল যে, ৫০০ টাকার নোট বুঝি সত্যি সত্যি অচল ঘোষিত হয়ে যাবে। তাহলে সমরশাসকদের কাছে টাকা ছিল সেটা ফাঁস হয়ে যাবে। এই ভয়ে কী যে ঘটল, রাত থেকে রেডিও টেলিভিশন, ফখরুদ্দীন থেকে শুরু করে সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অবিরাম ঘোষণা করতে থাকল- না না, সরকার এমন সিদ্ধান- নেয়ার কথা কল্পনাও করেনি। ৫০০ টাকার নোট অচল হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপরই প্রায় দু’দিন ধরে সে ঘোষণা রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। রাঘব বোয়াল, চুনোপুঁটিওয়ালাদের সুনীতির এই ছিল নমুনা!
সে দুর্নীতির অর্থ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর তৎকালীন শাসকদের প্রয়োজন ছিল শেখ হাসিনা সরকারের সাথে আঁতাত গড়ে তোলা। সে আঁতাত ভালোই কাজ দিলো। বেহায়া নির্বাচন কমিশন জনমত সমালোচনার তোয়াক্কা না করে তার সামরিক প্রভুদের সন'ষ্ট করার জন্য ধারাবাহিকভাবে এমন সব কাণ্ড করে যেতে থাকল, যাতে ওই নির্বাচনকে কোনোভাবেই প্রশ্ন করা না যায়। সে নির্বাচনে জিতল আওয়ামী লীগের সব। বেহায়া সিইসি অবশ্য আগে থেকেই বলছিলেন, এ নির্বাচন তিনি করবেন ১৯৭০ সালের মতো, যে নির্বাচনে হাতেগোনা কয়েকটি আসন ছাড়া সব আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল। তাতেও শেখ হাসিনা বিএনপির বিরুদ্ধে মইন সরকারের দুর্নীতির অভিযোগকেই প্রাধান্য দিলেন এবং এখনো দিয়েই যাচ্ছেন। গত তিন বছরে তার শাসনকাল জেনারেল মইনের শাসনের মতোই ব্যর্থতায় আকীর্ণ। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি নেই। দ্রব্যমূল্য অসহনীয়। আইনশৃঙ্খলা বলতে কোনো কিছুর অবশেষ এখন সমাজের ভেতরে নেই। হত্যা-খুন-গুম-ডাকাতি-রাহাজানি ওপেন জেনারেল লাইসেন্সে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন স'ানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের হত্যাকারীদের মনোনয়ন দিচ্ছে। খুনি গ্রেফতার হচ্ছে না। গ্রেফতার হলেও জাদুবলে সকালে জেলে ঢুকে বিকেলে জামিন নিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের জেল থেকে বের করে এনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফুলের মালা দিয়ে মন্ত্রীরা বরণ করে নিচ্ছেন। তখন মোটে একটা খুন করেছিলে, যাও বাছা শত খুনের লক্ষ্যে অগ্রসর হও। শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের দুর্নীতি যখন বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে, তখন তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে সেই পুরনো গীতই গেয়ে যাচ্ছেন, বিএনপি দুর্নীতি করেছে, দুর্নীতি করেছে।
তার মন্ত্রীদের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক আর্থিক সাহায্য বন্ধ করেছে। এডিবি সাহায্য বন্ধ করেছে। কানাডা সাহায্য বন্ধ করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বেশির ভাগ বাদ দেয়া হয়েছে। কর্মসংস'ান স'বির হয়ে গেছে। সরকারকে কেউ টাকা দেয় না বলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ নস্যাৎ করে দিয়েছে। টাকা ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে। তা নিয়ে কেউ যেন কোনো দিন প্রশ্ন করতে না পারে, সে জন্য আইন করা হয়েছে। আর খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলে যাচ্ছেন, দুর্নীতি করবেন অথচ কিছু বলা যাবে না- এত আহ্লাদ তো মানা যাবে না। কার যে কোন আহ্লাদ, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

অরক্ষিত সীমান্ত পরাধীন দেশ

॥ আলফাজ আনাম ॥


ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর গুলি চালিয়ে থাকে- এ দাবি করেছিলেন বিএসএফের সাবেক মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তব। তিনি গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় বসে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালকপর্যায়ের বৈঠকে এ দাবি করেন। তার আরো দাবি ছিল- বাংলাদেশী চোরাকারবারিদের প্রতিরোধ করতে তারা গুলি চালিয়ে থাকেন। এই লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির একজন সদস্যকে ভারতীয় চোরাকারবারিরা অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ২১ ঘণ্টা পর ফেরত দিয়েছে। আহত অবস'ায় তাকে এখন ঢাকায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর আগে বিবিসির খবরে বলা হয়, বিজিবির হাবিলদার লুৎফর রহমান চোরাকারবারিদের হাতে অপহরণের পর হামলায় আহত অবস'ায় ত্রিপুরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ভারতের মাদক চোরাকারবারিদের বাধা দিতে গেলে তাদের সাথে বিজিবি সদস্যদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে তাকে অপহরণ করা হয়। বিজিবি সদস্যরা পাঁচ শ’ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেন। অপহরণের পর বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক হলেও তাকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি সম্পন্ন হতে ২১ ঘণ্টা লেগে যায়। এ জন্য বিজিবির মহাপরিচালককে বিএসএফের মহাপরিচালকের সাথে কথা বলতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিজিবির সদস্যকে রক্তাক্ত অবস'ায় হস্তান্তর করা হয়েছে। মাথায় কয়েকটি সেলাই দিতে হয়েছে। দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছে।
বিএসএফ বরাবর দাবি করে থাকে, বাংলাদেশের চোরাকারবারিদের ঠেকাতে তারা বর্ডারে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করতে বাধ্য হয়। কিন' এই বিজিবি সদস্য অপহরণ ও আহত অবস'ায় উদ্ধারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে, ভারতের চোরাকারবারিদের সাথে বিএসএফের গভীর সখ্য রয়েছে। এমন হতে পারে, চোরাকারবারিদের হাতে বিজিবি সদস্য অপহরণের সাথে বিএসএফের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কারণ এই চোরাকারবারিদের ঠেকাতে বিজিবি গুলি চালিয়েছিল। এ গুলির শব্দ বিএসএফের না শোনার কথা নয়। অথচ এর পরও চোরাকারবারিরা নাকি বিজিবি সদস্যকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ধরে নিয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, তার ওপর এতটাই নির্যাতন করা হয় যে, বিএসএফের ক্যাম্প নয়, হাসপাতালেও ভর্তি করাতে হয়েছে। তাহলে এই বিজিবি সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং নির্যাতনের সময় কোথায় ছিল বিএসএফ?
এ ঘটনার এক দিন আগে ভারতের গণমাধ্যমে বিএসএফের বর্বরতার একটি খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে ধরে নগ্ন করে বাঁশের সাথে বেঁধে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। এই বাংলাদেশী যুবকের কাছে বিএসএফ মোবাইল ফোন, টর্চ লাইট ও টাকা ঘুষ চেয়েছিল, তা দিতে না পারায় তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। ভারতের টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি নির্যাতনের পুরো দৃশ্য প্রচার করে। নির্যাতনের পর বিএসএফ তাকে মৃত ভেবে সীমান্তে ফেলে রেখে যায়। এই বর্বর নির্যাতনের দৃশ্য আবার মোবাইল ফোনে ধারণ করে দুই সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয়।
এই দু’টি ঘটনা প্রমাণ করে, সীমান্তে ভারতীয় চোরাকারবারি ও বিএসএফ এখন যৌথভাবে বাংলাদেশী নাগরিক ও বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সীমান্ত ব্যবস'াপনা পুরোপুরি ভারতের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। বিএসএফ বারবার বলে আসছে, আত্মরক্ষার জন্যই নাকি বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালানো হয়। কিন' আজ পর্যন্ত এরা কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে অস্ত্রসহ ধরতে পারেনি। আত্মরক্ষা করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বিএসএফ সদস্য আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই সাধারণ নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক। কিশোরী ফালানীকে কাঁটাতারে যখন হত্যা করা হয়, তখন বিএসএফের কি কোনো আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছিল? গুলির নিশানা পরীক্ষা ছাড়া বিএসএফের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে হাবিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে বিএসএফের নির্যাতনের যে দৃশ্য টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর মধ্যে ন্যূনতম মানবাধিকারের ধারণা যে দেয়া হয় না, তারই প্রমাণ বহন করে। বিএসএফের একের পর হত্যাকাণ্ড ও বর্বর নির্যাতন প্রমাণ করে, তারা বাংলাদেশের মানুষকে শত্রুজ্ঞান করে। তাদের সেভাবেই প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই বাহিনীকে একটি খুনে বাহিনী হিসেবে অনেক আগেই তুলে ধরেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তথ্য দিয়ে বলছে, বিএসএফ ১০ বছরে এক হাজার বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করেছে।
বেশ কিছু দিন আগে কানাডা বিএসএফকে বর্বর কিলার ফোর্স হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিএসএফের একজন সাবেক মহাপরিচালককে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। দুর্ভাগ্য, বিএসএফ যখন আন্তর্জাতিকভাবে বর্বর বাহিনী হিসেবে পরিচিত হচ্ছে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বাহিনীর সাথে যৌথ সীমান্ত ব্যবস'াপনার নামে যৌথ টহলের। এর আগেও ত্রিপুরা সীমান্তে মদ্যপ অবস'ায় বিএসএফ বাংলাদেশে ঢুকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর নির্যাতনের চেষ্টা চালায়। সীমান্তে ভারতীয় চোরাচালানিদের সাথে বিএসএফ একধরনের যৌথ ব্যবস'াপনা গড়ে তুলেছে। এখন বিজিবিকেও এরা এর আওতার মধ্যে আনতে চায়।
বাংলাদেশী নাগরিক নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে প্রচারের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আত্মতুষ্টি নিয়ে বলেছিলেন, এ ঘটনায় আট বিএসএফ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন বিএসএফের পক্ষে সাফাই গাইছেন। বাংলাদেশের যেখানে উচিত প্রতিবাদের সাথে এ ধরনের ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরা দরকার ছিল, তখন বাংলাদেশের মন্ত্রী খুশি সাসপেন্ডের ঘটনায়। নিরীহ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের শাস্তি কি কাউকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলছে বাংলাদেশী তরুণ হাবিবুরের ওপর বিএসএফের অত্যাচারের যে ভিডিও প্রচারিত হয়েছে, সীমান্তে প্রতি মাসে সে রকম বহু ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে কতটা ব্যাপক, এ ঘটনা তার আভাস মাত্র। অ্যামনেস্টি বলছে, বিএসএফ তাদের আট সদস্যকে বরখাস্ত করায় এটা প্রমাণিত হয় না যে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে সতর্ক। এ রকম বহু ঘটনায় জড়িত থাকার পরও বিএসএফের বিরুদ্ধে অতীতে ব্যবস'াই নেয়া হয়নি। পশ্চিম বাংলার আরেকটি মানবাধিকার সংস'া মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) বলছে- চর মৌসুরি বর্ডার আউটপোস্টের কাছে গত ১৪ জানুয়ারি এ ঘটনা ঘটেছে। ইউটিউবে এই দৃশ্য আপলোড করার পর এক দিনে ২৫ হাজার লোক এই দৃশ্য দেখেছেন। মানবাধিকার সংস'াটি ঘটনায় জড়িত বিএসএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের বা গ্রেফতার না করায় হতাশা প্রকাশ করেছে। সংস'াটি বলছে, বাংলাদেশী এই নাগরিককে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি কোনো অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি বিএসএফের নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলেন। বিএসএফ সদস্যরা তাকে উলঙ্গ করেছে। তার হাত বেঁধে নির্যাতন করেছে। আহত অবস'ায় বারবার তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। মানবাধিকার সংস'াটি বলছে, বিএসএফের এ ধরনের আচরণ অমানবিক এবং গুরুতর অপরাধ। অ্যামনেস্টি ও মানাবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ বিএসএফের বর্বরতার ব্যাপারে যে অবস'ান নিতে পেরেছে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ততটুকুও দাবি করতে পারেননি। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বাণী প্রচারে অধীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এখন নিশ্চুপ। দায়সারা গোছের একটি বিবৃতির মধ্যে যেন তাদের কর্মকাণ্ড এখন সীমিত হয়ে পড়েছে। কিছু দিন যাবৎ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নানা আশার বাণী নিয়ে দীপুমনিকেও দেখা যাচ্ছে না। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলছে- নয়াদিল্লি মনে করে, বাংলাদেশী যুবককে নগ্ন করে মারধর করার ছবি প্রচারের পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস'া আইএসআইর মদদে মৌলবাদীদের হাত রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার যেমন সব কিছুর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের হাত আবিষ্কার করছে, ভারত তেমনি সব কিছুতে আইএসআই ও মৌলবাদের সংযোগ আবিষ্কার করছে। মনে হচ্ছে বিএসএফকেও এখন মৌলবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া বিএসএফে যদি আইএসআই তৎপর থাকে তাহলে বলতেই হবে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
সীমান্তে বিজিবি সদস্যকে অপহরণ করা হয়েছে তার একটি কারণ- বিজিবি সীমান্তে সক্রিয় থাকুক তা বিএসএফ যেমন চায় না, তেমনি চোরাকারবারিরাও চায় না। আর বিএসএফ তো চোরাকারবারিদের মদদদাতার ভূমিকা পালন করছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত রয়েছেন, তারা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি গতকাল পেট্রাপোলে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর বলেছেন, বিএসএফের নির্যাতনকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখে লাভ নেই। মাঝে মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। প্রণব মুখার্জির বক্তব্যে এটা স্পষ্ট- তারা এ ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মনে করেন। অপর দিকে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সীমান্তে এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। বাহ, চমৎকার! রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে বিদেশী সীমান্তরক্ষী বাহিনী উলঙ্গ করে নির্যাতন করার পরেও সেই রাষ্ট্রের মন্ত্রী বলছেন, তারা এ নিয়ে চিন্তিত নন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যকে পিটিয়ে থেঁতলে ও দাঁত ভেঙে দেয়ার পরও চিন্তিত নন। তাহলে রাষ্ট্র কী নিয়ে চিন্তিত? টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চিন্তা নেই, নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা নিয়ে চিন্তা নেই, শেয়ারবাজার লুটপাট নিয়েও চিন্তা নেই, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চিন্তা নেই- এক কথায় এ দেশের মানুষ নিয়েই রাষ্ট্রের চিন্তা নেই। চিন্তা শুধু একটাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি কিসে খুশি হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চোরাকারবারিদের হাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এভাবে অপহৃত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দেয়া হলো, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী আজ চোরাকারবারিদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম নয়। আজকে আমাদের নতুন করে উপলব্ধির সময় এসেছে, বাংলাদেশের সীমান্ত আজ কতটা নিরাপদ। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব যাদের, তাদের সক্ষমতা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? ৫৭ জন চৌকস সেনাকর্মকর্তা হত্যার মধ্য দিয়ে বিডিআর ধ্বংসের পর বাংলাদেশ সীমান্ত যে আজ কতটা অরক্ষিত তার সর্বশেষ উদাহরণ এই বিজিবি সদস্যের অপহরণ। আত্মমর্যাদাহীন ও নতজানু সরকার তার নাগরিকদের যেমন রক্ষা করতে পারছে না, তেমনি সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। বিডিআর ধ্বংসের পর থেকে সীমান্তে একের পর এক বিএসএফ নৃশংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এত দিন এই নৃশংসতার শিকার হয়েছেন সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিকেরা, এখন শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা। অরক্ষিত সীমান্ত যে পরাধীন দেশের প্রতিচ্ছবি তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি? অনুগত সরকার রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে, তখন সাধারণ মানুষের এই উপলব্ধি খুবই জরুরি। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষার কঠিন দায়িত্বে তাদের ভূমিকাই বেশি।
alfazananbd@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

বিশ্বজুড়ে আরব বসন্তের প্রভাব

॥ মহীউদ্দীন আহমদ ॥


২০১১ সাল আরব বসন্তের সূচনাকাল। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উৎসারিত হয়েছে আরব বসন্তের গণজোয়ার। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে জনতার লড়াই-সংগ্রাম ও শক্তির সামনে পতন ঘটেছে স্বৈরশাসকদের। লড়াই চলছে সিরিয়ায়। নব্যস্বৈরাচার বাশার আল আসাদ সেখানে জনগণের শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ, পতন এখন সময়ের ব্যাপার। জনগণের ভোটে সরকার গঠন করার মাধ্যমে মরক্কোর বাদশাহ হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেছেন। জর্ডানে বিরোধী দল শক্তিশালী নয়, তবে পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ওমান এখন শান্ত হলেও পরিসি'তি বেঁকে বসতে পারে। কুয়েতে বিক্ষোভ হয়েছে। পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হলেও সরকারের বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণে জনগণও শান্ত রয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হামাস-ফাতাহ সমঝোতা আরব বসন্তের অন্যতম বড় অর্জন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ঐকমত্যের সরকার গঠনের অঙ্গীকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি ও সি'তিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে অর্থবহ অর্জন বললে অত্যুক্তি হবে না। ফিলিস্তিনিদের বিবদমান উভয় গ্রুপের কৌশল পরিবর্তন এবং কর্মপন'া নতুনভাবে পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকারে এর সুবাতাস বইতে শুরু করেছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। আরব বসন্তের পরিবর্তিত পরিসি'তিতে হামাসের নীতি ও কৌশল যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং ফাতাহ একলা চলার নীতি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর ঐক্যপ্রচেষ্টায় সফলতা আসবে। আরব ভূখণ্ডে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ফিলিস্তিনিদের অবস'ান জোরদারে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে ইসরাইলেও। বিগত মাসগুলোতে তেল আবিবসহ অন্য শহরগুলোতে বড় বড় প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে, জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছে, সাথে সাথে ইসরাইলি গণমাধ্যমেও প্রতিবাদী আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। ইসরাইলি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের সাথে বোঝাপড়ার জন্য নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিতেও দেখা গেছে।
আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছে রুশ ফেডারেশন ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশেও। কোথাও কোথাও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে সরকারের ক্রিয়াকল্পেও। মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া এর অন্যতম। গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল সোভিয়েত রাশিয়া। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড রাশিয়া বিজয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচনে পরাস্ত দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ নির্বাচনকে অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার নির্বাচন অবাধ বা নিরপেক্ষ কোনোটাই হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ভোট জালিয়াতি হওয়ায় পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। পুতিন ও মেদভেদেভের সময় শেষ হয়ে আসছেও বলে তিনি মন্তব্য করেন। গর্বাচেভ বলেন, এটা ভীষণ লজ্জা ও বিব্রতকর। আমি এ জন্য লজ্জিত। রাশিয়ায় ঘুরেফিরে চলছে ভ্লাদিমির পুতিন ও দিমিত্রি মেদভেদেভের ক্ষমতায় টিকে থাকার নাটক। রাশিয়ার চলমান বিক্ষোভকে রুশ বসন্ত বলেও অভিমত বিশ্লেষকদের। ডুমার নির্বাচনের পর যে বিক্ষোভ চলছে সে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস তাতে সন্দেহ নেই। রাশিয়ার নিষ্প্রাণ রাজনীতি এখন দ্রুত গতি সঞ্চার করছে, চলমান বিক্ষোভে তাই প্রমাণিত। ডুমার নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি জোরালো একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বাস্তবে এর প্রভাব পড়বে আগামী মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। কেননা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসতে চাইছেন পুতিন। আগামীতে পুতিন যদি পাতানো নির্বাচনের খেলা খেলতে চান, তাহলে আরব বসন্তের মতো গণ-অসন্তোষ ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বেন তিনি। মিয়ানমারে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে। অং সান সুচি এখন মুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিসি'তি আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুচি পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। বিদেশী অতিথি ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে ফিরে আসবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সুচির দলকে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হলে মিয়ানমার দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মালয়েশিয়ায় স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন চলছে। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগ সরকারের অধীন। কিন' ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর জন্ম নেয়া অসন্তোষ এ বছর জুলাই মাসে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজধানী কুয়ালালামপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কার্যত রাজধানীকে অচল করে রেখেছিল, যা নাকি মালয়েশিয়ার মতো দেশে অকল্পনীয়। সরকারের দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে; কিন' তার জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। আরব বসন্তের পথ ধরে জনগণ যেমন উদ্বেলিত, তেমনই সরকার অপাতত নির্বাচন পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সংস্কার মেনে নিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে পরিসি'তি আগামী নির্বাচন নাগাদ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটেছে তা কোনো ভূমিকম্পের চেয়ে কম নয়। তিউনিসিয়ার গণবিস্ফোরণ এত দ্রুত পুরো আরব বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে তা ২০১০ সালের শেষার্ধেও কেউ ভাবতে পারেনি। বু আজিজির আত্মত্যাগের জন্যই অপেক্ষা করছিল আরব দুনিয়া। যেন স্বৈরাচারদের বিদায় ঘণ্টা বাজানোর জন্যই জন্মেছিলেন এই তরুণ। দীর্ঘ দিনের চাপা অসন্তোষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ আরব বিশ্বের জনগণ খুঁজে পেল এক বু আজিজিকে তাদের দিশারী ও কাণ্ডারি হিসেবে। বাস্তবতা হলো, আরব জনগণ বরাবরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে; সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না কোনো কিছুই। আর তাই আন্দোলন বেগবান হতে সময় লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে অকাতরে রক্তে সিক্ত করেছে রাজপথ। আরব গণআন্দোলন বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে অর্থবহ আন্দোলন। এর পুরোটাই চলেছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কোনো ষড়যন্ত্র বা বহির্বিশ্বের অংশগ্রহণ ছাড়াই এটা সম্ভব হয়েছে।
আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পেয়েছে দেশটি। তিউনিসিয়ার ২১৭ সদস্যের নির্বাচিত পার্লামেন্ট নতুন সংবিধানের প্রস্তাবিত ২৬টি অনুচ্ছেদই অনুমোদন দিয়েছে। নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুস্তফা বেন জাফর বলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত, স্মরণীয় এক রাত, এখন থেকে নতুন তিউনিসিয়ার যাত্রা শুরু হলো।’ ইয়েমেনে শপথ নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। রাজধানী সানার রিপাবলিকান প্যালেসে নতুন সরকারের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে শপথ নেন। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে অর্ধেক সদস্য বিরোধী জোটের, বাকি অর্ধেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহের অনুগত। ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদি শপথ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকার পরিচালনা করবেন। নতুন সরকার তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ছাড়লেও তিনি এখনো প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিরুদ্ধে কোনো বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে না। রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সালেহর অনুগত লোকজনের হাতেই থাকবে এবং তারাই নির্বাচন করবেন এমন বাস্তবতায় ইয়েমেনের জনগণের রায়ের প্রতিফলন ব্যালেট বক্সে ঘটবে কি না সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
এ দিকে মরক্কোর ইসলামী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রধান আবদুল্লাহ বেন কিরান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেছেন। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রধানকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। পার্লামেন্টের ৩৯৫টি আসনের মধ্যে জাস্টিস পার্টি ১০৭টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্য ছোট দলগুলোর জোট গঠনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। আরব অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তার প্রভাব থেকে মরক্কোকে দূরে রাখতে মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ দ্রুত সংস্কার হাতে নেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর মরক্কোর বাদশাহের পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশে সুশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা নতুন সরকারের বড় সাফল্য। তবে মরক্কোর নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার মতো কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখনো বাদশাহর হাতেই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মরক্কোর এখনো অনেক কিছু করার বাকি। মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শাসকদের অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার বিষয়ে সামরিক কাউন্সিলের সদস্য জেনারেল মামদো শাহীদের খোলামেলা বক্তব্যে এই সন্দেহ সৃষ্টির কারণ। পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে ঘোষণা দেয়ার পর আপাতত সমালোচনা শেষ হয়েছে। কিন' সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। জেনারেল মামদো শাহীদের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় বললে বাস্তবে অত্যুক্তি হবে না। পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস ফ্রিডম পার্টির আত্মপ্রকাশের পর মিসরীয় সেনাবাহিনীর ঘোষণায় তাদের আন্তরিকতা ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো। জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। আজ ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি মেনে চলা ও আগেকার সম্পর্ক রক্ষা করার বিষয়ে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিসরের সেনাবাহিনী মোবারকের প্রতি অনুগত না থাকলেও ইসরাইলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী। সেই বিবেচনায় তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না। অন্য দিকে গণরায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ সরকারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিসরে সরকার পরিবর্তন ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও ইসলামপন'ী সালাফি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাদের স্বার্থপরিপন'ী বলে বিবেচনা করছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণকারী মিসরের সেনাবাহিনী পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন দেখছে, তার ফলে মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাস্টিস পার্টির উপপ্রধান এশাম এল ইরিয়ন ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রাদারহুড মিসরে কঠোর ইসলামী বিধিনিষেধ জরবদস্তি চাপিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। কারণ মিসরে মুসলিমদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও অন্য সমপ্রদায়ের লোকের বাস। তিনি বলেন, শরিয়া আইনের মৌলিক বিষয়গুলো উদারভাবে প্রয়োগ করতে চাই, যাতে মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সালাফিপন'ী আল নূর পার্টির দ্বিতীয় স'ান দখল করার ফলে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তাদের অবস'ান পরিষ্কার করল।
আরব গণজাগরণের ফলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিসি'তিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবাধিকার পদদলিত বা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুর লক্ষ করা গেছে, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই শেষ হবে। মিসর ও লিবিয়ায় এখনো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মিসরে পার্লামেন্ট ডাকা এবং শাসনতন্ত্র রচনার প্রক্রিয়ার সাথে ষড়যন্ত্র চলছে- তবে জনরায়কে হাইজ্যাক করার যেকোনো প্রচেষ্টা মিসরীয় জনগণ প্রতিহত করবে সন্দেই নেই। লিবিয়ার দুর্বল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তাই আন্দোলনকারী জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে। সিরিয়ায় স্বৈরাচার সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় অর্জন। আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকলে আঞ্চলিক রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের নীতিনির্ধারণে ইসলামপন'ীদের জোরালো ভূমিকা থাকবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত রাজনীতিতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থানের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে- এটা বর্তমান বাস্তবতায় প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরাইলের একরোখা মনোভাবের পরিবর্তনের দাবি খোদ ইসরাইলি নেতৃত্বের কাছ থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে বাস্তবতার আলোকে। কেননা পুরো আরব ভূমিতে ইসরাইলবিরোধী মনোভাব এখন অনেক বেশি চাঙ্গা। প্রকৃতপক্ষে ইসরাইল একঘরে হয়ে পড়েছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতায় ও ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বকে ইসরাইল তোষননীতি পরিহার করে বাস্তবসম্মত পন'া অবলম্বন করতে হবে। আরব বসন্তের আলোকে পশ্চিমাদের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক
mohi_ahmad15@yahoo.com

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

॥ মাসুদ মজুমদার ॥


নবাব, সম্রাট ও শাসকেরা ভবিষ্যৎ না ভেবে, ভুল করেই ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বাধীনতা হরণের সুযোগ নিয়েছিল ইংরেজরা। এদের সাথে যোগ দিয়েছিল প্রভু পরিবর্তনকামী দেশীয় বিশ্বাসঘাতক বর্ণবাদী গোষ্ঠী। হয়তো এরাও ভাবতে পারেনি, তাদেরই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বণিকের মানদণ্ড শাসনদণ্ডে রূপান্তরিত হবে। মুসলিম শাসকেরাও হয়তো এটা ভাবতে পারেননি, ইংরেজদের সহযোগিতা করবে সরকারেরই ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুবিধাভোগী হিন্দু কর্মকর্তা, দিওয়ান, ফৌজদার, মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্র- যাদের বিশ্বাস করে মুসলিম শাসকেরা প্রধানমন্ত্রী, সিপাহসালার, ফৌজদার, দিওয়ান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদ দেয়া ছাড়াও নানা ধরনের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। এরাই রাতারাতি প্রভু পরিবর্তনের খেলায় মেতে উঠল। ষড়যন্ত্রকে ষোলোকলায় পূর্ণ করল। ইংরেজদের সাহায্য করে বিশ্বাসঘাতকতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নিজেরা সাজল বিশ্বাসহন্তা।
আগেই উল্লেখ করেছি, সম্রাট শাহজাহান প্রথম ইংরেজদের হুগলিতে বাণিজ্যকেন্দ্র স'াপনের অনুমতি দিয়েছিলেন। সেটাকে উপমা ধরে বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৬৫১ সালের কথা। তারই খেসারত দিতে হয়েছিল ১০৬ বছরের মাথায় পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধ নামের প্রহসন ও বিপর্যয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতা হারিয়ে পৌনে দুই শ’ বছর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগের দায় ছিল সেসব বিশ্বাসঘাতক ও নতজানু শাসকদের।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত অবস'ান, জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা আমলে না নিয়েই সম্রাট ও সুবাদারেরা ইংরেজদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলেন। অনেক কিছু না ভেবেই সরলমনে বিশ্বাস করেছিলেন হিন্দু জমিদার, আমাত্য, আমলা ও ফৌজদারদের। তারাই বিশ্বাসভঙ্গ করে পুরো মুসলিম শাসনের ভিত টলিয়ে দিতে শেকড় কেটে দেয়। ইংরেজদের আমন্ত্রণ করে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়। অবশ্য ক্ষমতালোভী মীরজাফর, জগৎশেঠ চক্রও ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছিলেন ঘসেটি বেগম। যদিও ইংরেজদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, অপরাপর ইউরোপীয় বণিকদের উপেক্ষা করা ছিল কূটনৈতিক অদূরদর্শিতাও। তা ছাড়া বাণিজ্য সনদ দেয়ার অনুমোদনটিও স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত ছিল না।
এর ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও এ দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। একই সাথে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়েছিল। কারণ অন্যদের দ্রব্যমূল্যের ওপর শতকরা সাড়ে তিন টাকা শুল্ক দিতে হতো। তা ছাড়া রাজকোষের শুল্কের ক্ষতি ছিল বেশুমার। প্রথম অবস'ায় বাংলাদেশে ইংরেজদের বাণিজ্যের পরিমাণ ও পরিসর ছিল অল্প। বাড়তি সুবিধা পেয়ে কয়েক বছরের মধ্যে তা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। তাদের রাজনৈতিক অভিলাষও স্পষ্ট হতে থাকে। এসব বিবেচনা করেই সম্রাট আরোঙ্গজেব ইংরেজ বণিকদের বিশেষ সুবিধা রহিত করলেন। ইংরেজ বণিকেরা দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের প্রণোদনা পেয়ে এই ব্যবস'ার বিরুদ্ধচারণ করতে প্রয়াস পায়। ফলে স'ানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ বাধে। সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের প্রতি কঠোর ব্যবস'া অবলম্বন করেন। ইংরেজদের বাড়াবাড়িমূলক আচরণ ও ধৃষ্টতার অভিযোগে বাংলাদেশ হতে তাদের বিতাড়িত করেন। পরে তারা নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়। শায়েস্তা খানের মহানুভবতায় আবার বাংলাদেশে ইংরেজেরা বিনয়ী হয়ে বাণিজ্য করার অনুমতি পায়। এ কারণেই শায়েস্তা খান এখনো বাংলার মানুষের কাছে নন্দিত ব্যক্তিত্ব।
সম্রাট ফররুখশিয়ার হেমিন্টন নামক একজন ইংরেজ চিকিৎসকের চিকিৎসায় সন'ষ্ট হয়ে তাকে কিছু ইনাম বা পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। সুচতুর ইংরেজ চিকিৎসক নিজের জন্য কিছু না চেয়ে তার স্বজাতীয় বণিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রার্থনা করেন। সম্রাট ১৭১৫ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দান করেছিলেন, যা আগেই উল্লেখ করেছি। একতরফা বাণিজ্যের সুযোগ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ ও ঐশ্বর্যের বলে ইংরেজদের বাণিজ্য ফেঁপেফুলে ওঠে। বণিকেরা রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়। সাথে সহযোগী হিসেবে পায় হিন্দু জমিদারসহ আমাত্যদের।
বাণিজ্যে উন্নতির সাথে সাথে ইংরেজ বণিকদের মনে এ দেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। হিন্দু ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্কের ফলে তারা বুঝতে পারে, তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা কার্যকর করতে এরা হিন্দু জমিদার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা লাভ করতে সমর্থ হবে। নবাব আলীবর্দীর রাজত্বকালে কর্নেল স্কট নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর একজন ইঞ্জিনিয়ার বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘যদি ইউরোপীয় সৈন্যরা ভালোভাবে অভিযান শুরু করে এবং হিন্দুদের উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তারা ইংরেজদের সাথে যোগ দেবে।’ তিনি আরো লিখেছিলেন, এই কাজে উমিচাঁদ ও অন্য হিন্দু প্রধানদের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। হিন্দু জমিদার ও রাজকর্মচারীদের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে।
ইউরোপীয় অস্ত্রশস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে ইংরেজ বণিকদের দৃঢ় আস'া ছিল এবং হিন্দুদের সহযোগিতা সম্বন্ধেও তাদের আশা ও ভরসা দুটোই ছিল। এ জন্যই তারা আলীবর্দীর রাজত্বের শেষের দিকে ধৃষ্টতার সাথে নবাবের আদেশ উপেক্ষা করতে সাহসী হয়েছিল। আরো জানার বিষয় হচ্ছে, কলকাতায় ইংরেজদের জমিদারি ছিল, এরা এর সব অধিবাসীর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করত। নবাব আলীবর্দী এ ব্যাপারে ইংরেজ বণিকদের কাছে একটি পরওয়ানা পাঠান। এরা পরওয়ানাবাহকের প্রতিও দুর্ব্যবহার করে। এখানেই তাদের ধৃষ্টতার শেষ নয়, তারা নবাবের কাছে অশ্লীল ভাষায় লিখিত এক পত্রে কলকাতার জনগণের ওপর তাদের সার্বভৌমত্ব দাবির বিষয়ে বাড়াবাড়িমূলক ব্যাখ্যা করে। এর কিছু দিন পরে আলীবর্দী খানের মৃত্যু হয়। এই জন্য সাহস ও দেশপ্রেমমূলক দৃঢ়তা থাকলেও আলীবর্দী খান বাধ্যক্যের কারণে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো রূপ ব্যবস'া অবলম্বন করতে পারেননি। সেটাই ছিল ষড়যন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলার উপযুক্ত সময়- ইংরেজরা যার সদ্ব্যবহার করেছিল।
মাতামহের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এক দিকে ইংরেজ বণিকদের অবাধ্যতা, শত্রুতা এবং অন্য দিকে স্বার্থান্বেষী আত্মীয়স্বজন ও রাজকর্মচারীদের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ক্ষমতালোভী সেনাপতি মীরজাফরও তার সাথে যোগ দিলেন। তারা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুৎ করে সিরাজের খালাতো ভাই ও পুর্নিয়ার শাসনকর্তা শওকতজঙ্গকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। সে সময় ইংরেজ বণিকেরা নবাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুযোগ পুরো মাত্রায় ছিল। তারা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে উৎসাহিত হয়। এ সম্পর্কে মিস্টা কুক লিখেছেন, সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনারোহণের সময় ইংরেজ বণিকেরা চলতি প্রথামত আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি। তা ছাড়া তারা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতা দুর্গের আয়তন বাড়ায়। একই সাথে ফোর্ট উইলিয়ামকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সুরক্ষিত করে তোলে।
ইংরেজেরা বাহ্যত দেখায় যে, এরা ফরাসি বণিকদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব ব্যবস'া অবলম্বন করছে। কিন' নবাবের অনুমতি না নিয়ে তার রাজ্যে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধের আয়োজন করে। এরা নবাবের কর্তৃত্বের প্রতিও চরম ধৃষ্টতা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে। এ ছাড়া ইংরেজেরা দস্তক নামে বাণিজ্য সনদের সুবাদে পাওয়া সুবিধার অপব্যবহার করে। বাদশাহী ফরমানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টকে অধিকার দেয়া হয়েছিল, তিনি ইংরেজ বণিকদের ব্যবসায়ের জন্য অনুমতি পত্র দেবেন এবং দস্তকধারীদের তাদের পণ্যদ্রব্যের জন্য খেয়াঘাটে ও নদীতে শুল্ক দিতে হবে না। কোম্পানির ইংরেজ বণিক ছাড়াও তাদের কর্মচারী ও অন্য সমপ্রদায়ের বণিকেরা দস্তকের সুবিধা অপব্যবহার ও ভোগ করত। এর ফলে রাজকোষের শুল্কের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছিল। উল্লিখিত কারণ ছাড়াও নবাবের যেসব অসৎ ও বিদ্রোহী প্রজা তহবিল তসরুপ কিংবা রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হতো অথবা শাস্তির ভয়ে কলকাতায় পালাত ইংরেজ কোম্পানি তাদের আশ্রয় দিত। জাহাঙ্গীরনগরের দিওয়ান রাজা রাজবল্লভ রাজকোষের তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে তার অর্থসম্পদ ও পরিবারসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতার ইংরেজদের দুর্গে আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। নবাব ইংরেজদের বেআইনিভাবে দস্তক ব্যবহার বন্ধ করতে বলেন। বিনানুমতিতে দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দিতে ইংরেজদের আদেশ দেন। কোম্পানির কলকাতার গভর্নর মিস্টার ড্রেক নবাবের সব আদেশ অমান্য করে। অধিকন' নবাবের পাঠানো দূতের সাথে অসৌজন্য আচরণ করে।
বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য নবাব ইংরেজদের অবাধ্যতার শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিলেন। ১৭৫৬ সালের ৪ জুন তিনি তাদের কাসিমবাজার বাণিজ্য কুঠি দখল করে নেন। ২০ জুন তাদের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গও অধিকার করেন। অনেক ইংরেজ কলকাতা ছেড়ে নদীতে ভাসমান জাহাজে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিছু ইংরেজ নবাবের হাতে বন্দী হয়। মিস্টার কুক লিখেছেন, নবাব ইংরেজ বন্দীদের প্রতি কোনো রূপ দুর্ব্যবহার করেননি। মিস্টার ড্রেক উল্লেখ করেছেন, ভিন্ন কথা। হলওয়েল সামান্য ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ‘অন্ধকূপ হত্যার’ কাহিনী সাজিয়েছিলেন।
কলকাতার পতনের পর ড্রেক ও অন্যান্য ইংরেজ সাহেব আশ্রয়হীন ও অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময় এরা যদি উমিচাঁদ, নবকিষণ, জগৎশেঠ ও অন্যান্যের সাহায্য না পেত তা হলে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কয়েকজন হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ী পলাতক ইংরেজদের ফুলতায় আশ্রয় দেয় এবং তাদের জন্য গোপনে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে।
কলকাতা পতনের খবর পেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে বাংলাদেশে সৈন্যদল ও নৌবহর পাঠায়। ক্লাইভ দাক্ষিণাত্যে ফরাসি বণিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে কর্ণাটকে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটস ১৭৫৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর নৌবহর নিয়ে ভাগীরথী নদীতে প্রবেশ করে এবং ফুলতার দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় নবাবের ফৌজদার মানিকচাঁদ তাদের কোনো রূপ বাধা দেয়নি। এই সময়টিতে মানিকচাঁদ ও ক্লাইভের মধ্যে যে পত্র ও বার্তাবাহক বিনিময় হয় তা থেকে জানা যায়, মানিকচাঁদ নিজেকে ইংরেজদের একজন বন্ধু বলে প্রকাশ করে। ফলে ২ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালে ক্লাইভ বিনা বাধায় সহজে কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এর পর ক্লাইভ হুগলি অধিকার করতেও কোনো বাধা পায়নি। মানিকচাঁদ ইরেজদের সাথে যুদ্ধ না করে কলকাতা ও হুগলি থেকে পূর্বপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র মতো ইংরেজদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজে সসৈন্য পিছু হটে যায়।
বাধ্য হয়ে নবাবকেই আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হলো। ইরেজরা হুগলি ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। নবাব কলকাতার শহরতলিতে প্রবেশ করেন। ১৭৫৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ ও ওয়াটস অতর্কিত নৈশ-আক্রমণে নবাবের সেনাছাউনিতে কিছুটা গোলযোগ সৃষ্টি করার সুযোগ নিলেও অবস'া প্রতিকূল বুঝে ক্লাইভ পালিয়ে যায়। কলকাতা অভিযানের পক্ষে নবাবের পর্যাপ্ত জনবল ও সৈন্য ছিল। কিন' তিনি নিজ সেনাকর্মকর্তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। এরা নবাবকে ইরেজদের সাথে আপস করতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় নবাবের আরেকটি বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয়। আশঙ্কা করা হয়, আহমদ শাহ আবদালি বিহার আক্রমণে অগ্রসর হচ্ছেন। এতে নবাব মনের বল হারিয়ে ফেলেন। এক দিকে সেনাকর্মকর্তা ও ফৌজদার মানিক চাঁদ ইংরেজদের হয়ে কাজ করছিল, অন্য দিকে আহমদ শাহ আবদালির আক্রমণ শঙ্কা, বাধ্য হয়ে নবাব ১৭৫৭ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন। এটাই বিখ্যাত ‘আলীনগরের সন্ধি’ নামে পরিচিতি।
ইংরেজেরা বাণিজ্যসুবিধা ফিরে পায়। কলকাতার দুর্গ সুরক্ষিত করার অনুমতিও তারা আদায় করে নেয়। এই সন্ধি করিয়ে নবাবকে যে দুর্বলতার পরিচয় দিতে বাধ্য করা হয় তারই পরিণতি ছিল অনিবার্য বিপর্যয়। যদি নবাব এই সময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিশ্বাসঘাতক সেনাধ্যক্ষদের শাস্তির ব্যবস'া করতে পারতেন, তাহলে তারা ভয় পেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হতো। কারণ তখনো ইংরেজরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারেনি। তাৎক্ষণিক কলকাতার দুর্গ আক্রমণ করলে নবাবের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। সব যড়যন্ত্র তখনই নিপাত যেত। বিশ্বাসঘাতক চক্রও খামোশ হয়ে যেতে বাধ্য হতো। বাংলার ইতিহাসও রচিত হতো ভিন্নভাবে।
ধুরন্ধর ইংরেজরা কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতির জন্য নবাবের সাথে সন্ধি করেছিল। মাত্র এক মাস পরেই এরা আলীনগরের সন্ধি ভঙ্গ করে। উল্লেখ্য, ১৭৫৬ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে তখন ‘সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ’ চলছিল। বাংলাদেশে ইংরেজরা ফরাসিদের চন্দরনগর বাণিজ্যকুঠি আক্রমণের জন্য প্রস'ত হয়। নবাব ইংরেজ ও ফরাসিদের তার রাজ্যে যুদ্ধ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। নবাবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্লাইভ ২৩ মার্চ চন্দরনগর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সেনাপ্রধান রায়দুর্লভ ও মানিকচাঁদ ইংরেজদের সামান্যতম বাধা দিতে চেষ্টা করেনি। এ ব্যাপারে স্ক্রেফটন সাহেব লিখেছেন, ইংরেজরা উমিচাঁদকে দিয়ে নন্দকুমারকে এক হাজার ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়েছিল। নন্দকুমার নবাবের সামরিক তথ্যও ইংরেজদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। তাতে ইংরেজদের শক্তি ও সাহস দুটোই বেড়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য এক গোপন প্রস্তাব পাস করে। মিস্টার হিল লিখেছেন, ক্লাইভ উমিচাঁদকে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন না। নবাব আলীবর্দীর সময় থেকেই মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কুখ্যাতি ছিল। তাকে কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের কাছে শাস্তিও পেতে হয়েছিল। মীরজাফর আলিবর্দীর ভগ্নিপতি ছিলেন। এই জন্য বৃদ্ধ নবাব তাকে ক্ষমা করে আবার সেনাপতি পদে বহাল করেন। কিন' মীরজাফরের স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। মুর্শিদাবাদের মসনদের প্রতি তার লোভ ছিল। সিংহাসনের লোভে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে ষড়যন্ত্রকারীরা জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর, রাজবল্লভ এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেই গোপন বৈঠকে যোগ দেন। ইংরেজ কোম্পানির অ্যাজেন্ট ওয়াটস মহিলাদের মতো পর্দাঘেরা পালকিতে চড়ে সেই বাড়িতে আসেন। সেখানেই বাংলার স্বাধীন নবাব ও স্বাধীনতার ভাগ্য নির্ধারণ করে ষড়যন্ত্রকারীরা।
আজকাল অনেক সন্ধি হচ্ছে। গোপন আঁতাত হচ্ছে। চুক্তি হচ্ছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সুবিধা পাইয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা এসব করছেন তারা অতীত ভাবছেন না। ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন নন। বাংলাদেশ আবার বিদেশীদের বাজারে পরিণত হলেও তাদের উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয় না। আজকের প্রেক্ষাপটে নন্দকুমার, মানিক চাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর চক্রের মতো কারা কার স্বার্থের ক্রীড়নক তা-ও আমরা জানি না। শঙ্কা জাগে- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে না তো?
কারণ কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। একতরফা বাণিজ্যিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ। গোপন বন্ধুত্বের অনেক তথ্যই অজ্ঞাত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও বন্ধুত্বের কাছে হার মানছে। জাতি বিভক্ত। চার দিকে ষড়যন্ত্রের নানা গুজব। ব্যর্থতার নানা গুঞ্জন ও কাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান অসি'র। শাসকদের মেরুদণ্ড এবং ভবিষ্যৎ ভাবনাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কা জাগাটা অস্বাভাবিক না-ও হতে পারে।

রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

টিপাইমুখ বাঁধ: মৌখিক আশ্বাস নয় প্রয়োজন যৌথ সমীক্ষার

জাহিদুল ইসলাম


জানুয়ারী ১৪, ২০১২
zahidul-fসম্প্রতি টিপাইমুখ প্রকল্পের যৌক্তিকতা ও এর স্বপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ গওহর রিজভীর “টিপাইমুখঃ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুরোধ”[১, ২] এবং মহিউদ্দিন আহমদের লেখা “টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করা কেন জরুরি”[৩] শিরোনামের নিবন্ধদুটি সংবাদ মাধ্যমে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ডঃ রিজভী তার নিবন্ধে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাখ্যায় পানিসম্পদ কৌশলগত দিক থেকে কিছু ভুল তথ্য দিয়েছেন, সেই সাথে জনাব আহমদের নিবন্ধটি তথ্যগত ও ভাষাগত বিচারে অত্যন্ত একপেশে মনে হয়েছে, এছাড়া তাদের উভয়ের বক্তব্যের অনেক অংশেই আমার দ্বিমত রয়েছে যা এই নিবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
ডঃ রিজভী তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, টিপাইমুখ প্রকল্প একটি ‘রান অফ দি রিভার’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবে টিপাইমুখ প্রকল্প ‘রান অফ দি রিভার’ জলপ্রবাহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নয় বরং তা একটি ‘গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’। রান অফ দি রিভার ও গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছেঃ প্রথমটিতে বাঁধের উজানে বড় আকারের কোন জলাধার নির্মান করা হয়না এবং বাঁধ দেবার পর নদীর প্রায় সম্পূর্ন প্রবাহকে ঢালু টানেলে করে ভিন্ন পথে বাঁধের ভাটিতে মূল নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়, অন্যদিকে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাঁধের উজানে বিশাল জলাধারে পানি সঞ্চয় করা হয়ে থাকে। ‘রান অফ দি রিভার’ প্রকল্পে উজানে পানি ধরে রাখার দরকার হয়না বলে ভাটিতে নদীর প্রবাহের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়না এবং এর পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক প্রভাব গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়ে অনেকাংশেই কম। প্রাপ্ত তথ্যমতে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার ফলে তা আদতে একটি ‘গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’।

ডঃ রিজভীর মতে, টিপাইমুখ প্রকল্প শুধুমাত্র তখনই ভাটি অঞ্চলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যখন সেখান থেকে সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহার করা হবে এবং যেহেতু ভারত সরকার বলছে যে তারা এই প্রকল্পে কোন ব্যারেজ নির্মান করবে না সেক্ষত্রে বাংলাদেশে বরাক নদের দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয় বরং শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ বাড়বে আর বর্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে। একই রকম যুক্তি পাওয়া যায় জনাব আহমদের নিবন্ধে। কিন্তু এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়। এর একটি নিজস্ব বাস্তুসংস্থান রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে। ‘ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং’ এর ‘হাইড্রোলজিকাল ইম্প্যাক্ট স্টাডি অফ টিপাইমুখ ড্যাম প্রজেক্ট অফ ইন্ডিয়া অন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার আলোকে[৪, ৫] টিপাইমুখ বাঁধের কারণে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার জলাভূমি ও হাওড় আগের থেকে গড়ে যথাক্রমে ২৬% ও ১১% কমে যাবে, কুশিয়ারা নদী তীরে অবস্থিত কুশিয়ারা-বর্দাল হাওড় গড় বর্ষার সময় পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে এবং কাওয়ারদিঘী হাওড়-এর ২৬% প্লাবন এলাকা হারাবে, বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি দীর্ঘায়িত অংশে বিপুল নদীক্ষয়ের ফলে ক্ষয়িত পলি বাংলাদেশে বাহিত হবে যা কিনা বরাক নদীর নিচের অংশে যেখানে থেকে তা সুরমা আর কুশিয়ারা এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে সেখানে জমা হবে যা কুশিয়ারা নদীর বেশ কিছু শাখানদীর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে।
জনাব আহমেদ উল্লেখ করেছেন যে তার নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্য কানাডীয় উন্নয়ন সংস্থার (সিডা) অর্থায়নে বাংলাদেশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নব্বইয়ের দশকে সম্পাদিত একটি বিশেষ সমীক্ষার অংশবিশেষ। যদিও তিনি ঐ সমীক্ষার নাম উল্লেখ করেন নি তবে ধারণা করা যায় উল্লেখ্য গবেষনাটি বাংলাদেশের ‘উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাঃ ফ্লাড একশন প্ল্যান-৬ (NERP-FAP 6)’ এর অধীনে ‘ইনিশিয়াল এনভায়রন্মেন্টাল ইভ্যাল্যুয়েশন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় [৬]। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে টিপাইমুখ প্রকল্পে এটিই একমাত্র উল্লেখ্যযোগ্য গবেষণা যা মূলত কিছু ধারণা বা এসাম্পশনের উপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এর চেয়ে মানসম্মত তথ্য ও উপাত্ত যদি আর কারও কাছে থেকে থাকে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অথচ ঐ রিপোর্টেই উল্লেখ আছে যে, ‘যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে এই প্রকল্পের একটি ন্যূনতম ধারণা পাওয়া যায় যা কিনা ঐ প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রাথমিক প্রভাব যাচাইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।…ভারত কতটুকু পানি এই প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করবে সে সম্পর্কে কোন তথ্য জানা নেই। এই গবেষণার জন্য ধরে নেয়া হয়েছে যে সেচের জন্য ১ মিটার সমপরিমাণ পানি অপসারন করা হবে পানি অপসারন ক্রমাগতভাবে শুষ্ক মৌসুম (নভেম্বর থেকে এপ্রিল)পর্যন্ত চলবে।।’
এছাড়া ঐ রিপোর্টেই মন্তব্য করা হয়েছে যে জলাধার পূরণের সময়কালে অনেক সময় প্রকল্পের সুবিধা তাড়াতাড়ি পাবার জন্য অতিদ্রুত জলাধার পূর্ণ করা হয় যা বাংলাদেশের মত ভাটির অঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ, বিশেষ করে বাস্তুসংস্থান বিপর্যয় ঘটাবে।
হাওড় এলাকার কথা উল্লেখ করে জনাব আহমদ বলেছেন যে, বর্ষাকালে হাওড়গুলি জলে টইটুম্বর থাকে- কোন ফসল হয় না, কিন্তু তিনি বিস্তীর্ন এই হাওড় এলাকার মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্রের কথা এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, হাওড় অঞ্চলের সমস্যা দু’টিঃ এক, আগাম বন্যা, যার ফলে ফেব্রুয়ারি-মার্চে উঠতি ফসল মাঠেই তলিয়ে যায়, এবং দুই, দেরিতে পানি নিষ্কাশন, যার ফলে বোরো ধান রোপণ করতে দেরি হয়ে যায় এবং তা আগাম বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে। তিনি মন্তব্য করেছেন যে বর্ষাকালে বরাক দিয়ে পানিপ্রবাহ হ্রাস পেলে এই দুটো সমস্যাই কমে যাবে। কিন্তু এখানে লক্ষ্যনীয় যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে।এর প্রভাব এই অঞ্চলের বোরো ধান আবাদের উপর পড়তে পারে। এছাড়া হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে ওঠে যা এই লোকগুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়। শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং তার ফলে সেচের জন্য সুফল বয়ে আনা প্রসংগে জনাব আহমদের মন্তব্যের প্রতি উত্তরে বলতে চাই, প্রাথমিক গবেষণা অনুযায়ী টিপাইমুখ প্রকল্পের কারণে শুষ্ক মৌসুমে অমলসিদের আরো ভাটিতে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রবাহ শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে যা কিনা পানির উচ্চতা ২ মিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে সেচের সুবিধা নয় বরং এই বিস্তীর্ন অঞ্চলের ফসল পানিতেই নিমজ্জিত হবে।
টিপাইমুখ প্রকল্পের ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ডঃ রিজভী মন্তব্য করেছেন যে যেহেতু বাংলাদেশ টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে অনেক দূরে সেক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকি অনেক কম। অন্যদিকে জনাব আহমদ এটাকে নিছক ‘জুজুর ভয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। ভূতাত্ত্বিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল আসলে অসংখ্য ‘ফোল্ড ও ফল্ট’ বিশিষ্ট এবং এই অঞ্চলে গত ১৫০ বছরে রিক্টার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে শেষটি ছিল ১৯৫৭ সালে যা কিনা টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে। FAP 6 রিপোর্ট (১৯৯৫) মতে ভূমিকম্পের কারণে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জলাধারের পানি ঢেউ আকারে ঘন্টায় ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে ভাটির দিকে ধাবিত হবে এবং তা ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এই ঢেউয়ের উচ্চতা হবে ৫ মিটার [৬]। এই বিপুল প্রবাহ ১০ দিন ধরে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং সমস্ত বন্যার্ত এলাকা থেকে পানি সরে যেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। সুতরাং টিপাইমুখ প্রকল্পে বাঁধ ভাঙ্গার ঝুঁকিকে ‘জুজুর ভয়’ উল্লেখ করা বা বাঁধ ভেঙ্গে গেলে বাংলাদেশের কম ক্ষতিগ্রস্থ হবার যুক্তি অসাড়।
টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভাটির রাজ্য আসাম ও নাগাল্যান্ড এর আপত্তি না থাকার কথা উল্লেখ করে এই প্রকল্পে বাংলাদেশেরও আপত্তি থাকা উচিৎ নয় এরকম একটি ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন ডঃ রিজভী। এখানে উল্লেখ্য যে বারাক নদী থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারণা আসে মূলত আসামের কাছাড় উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রনের চাহিদা থেকেই। সুতরাং এই প্রকল্পে আসামের আপত্তি থাকার কোন কারন নেই। কিন্তু টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের যে বিস্তীর্ন হাওড় অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র আছে সেটি পরিপূর্নভাবে বিনষ্ট হবে। ফলে আসামের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বাঁধের ইতিবাচকতা টেনে আনা অযৌক্তিক।
জনাব আহমদ অতীতে গঙ্গা নদীর উজানে বাঁধ তৈরি ও জলাধার নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ‘এ ধরনের জলাধার নেপাল কিংবা ভুটানে হলে আপত্তি নেই কিন্তু ভারতে হলেই অনেকের আপত্তি।’ এখানে বলে রাখা ভাল যে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের সেই প্রস্তাব ভারত সমর্থন করলে হয়ত গঙ্গাচুক্তি ১৯৭৪/৭৫ সালেই সংগঠিত হতো। গঙ্গা চুক্তির আপস আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯৭৪-১৯৭৬) যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে সমস্যার উৎপত্তি হয় তাই এই পর্যায়ে ‘গঙ্গায় পানি বৃদ্ধির’ বিষয়টি সামনে আনা হয় [৭]। বাংলাদেশ প্রস্তাব করে যে ভারত বর্ষা মৌসুমের বিপুল পরিমাণ পানিকে উজানের জলাধারে (ভারতে না নেপালে) সঞ্চিত করে তা শুস্ক মৌসুমে ব্যাবহার করতে পারে, অন্যদিকে ভারত একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র থেকে বিপুল পরিমান পানি গঙ্গায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করে।বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা উজানে বাঁধ করতে প্রস্তাব করেছিল কারন তারা চেয়েছিল যেন তাতে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি পায় এবং সেই বর্ধিত পানি ভারত প্রত্যাহার করতে পারে ফলে বাংলাদেশকে আর পানিবিহীন থাকতে হয়না শীতকালে।
ডঃ রিজভী উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পের সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, এর ফলে প্রকল্পটির সকল পর্যায়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ থাকবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থান করে নেওয়া নিশ্চিত হবে। একই কথায় প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জনাব আহমদের নিবন্ধে। তিনি বরং আরো জোরালো ভাবে মন্তব্য করেছেন ‘এ বাঁধ শুধু ভারতের তৈরি করাই উচিত নয়, বাংলাদেশের উচিত ভারতকে চাপ দেওয়া, যাতে বাঁধটি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়।’ এখানে বলে রাখা ভাল যে, ভারতের এই আমন্ত্রন মেনে নেয়া মানে হচ্ছে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে সেটিকে অস্বীকার করা। ডঃ রিজভী উল্লেখ করেছেন যে সংগৃহীত তথ্য এবং ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের উচিত টিপাইমুখ প্রকল্পকে আবেগ ও রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিশীলতার আলোকে বিবেচনা করা। তার এই মন্তব্যের সাথে আমি একমত তবে শুধুমাত্র ভারত সরকারের মৌখিক আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিশ্চয়তার ঢেকুর তোলার পক্ষপাতি নই। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ আগে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যৌথ সমীক্ষা ও গবেষণার উদ্যোগ নিয়ে জেনে নেয়া বাংলাদেশের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব থাকে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।আর যদি এই ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সেটাই হবে আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্যসুত্র:
[১] গওহর রিজভী(২০১১) “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কঃ টিপাইমুখ: যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুরোধ” , দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর ২০১১।
[২] Gowher Rizvi(2011) “Tipaimukh: A plea for rational and scientific discussion”, The Daily Star, 13 December 2011.
[৩] মহিউদ্দীন আহমদ(২০১১) “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কঃ টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করা কেন জরুরি”, দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর ২০১১।
[৪] Institute of Water Modeling (2005) “Hydrological Impact Study of Tipaimukh Dam Project of India on Bangladesh”, April 2005.
[৫]Kibria, M. G. (2005). Gaining Public Acceptance for Large Dams on International Rivers: The Case of Tipaimukh Dam in India and Concerns in Lower Riparian Bangladesh. Gaining Public Acceptance Issue-Based Workshop Proceedings,Page:89-91.
[৬]Initial Environmental Evaluation, Appendix to the Northeast Regional Water Management Plan, Bangladesh Flood Action Plan 6 (IEE NERP FAP 6)
[৭] আইনুন নিশাত (১৯৯৬)“Impact of Ganges Water Dispute on Bangladesh”, Asian International Waters, From Ganges-Brahmaputra to Mekong, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
জাহিদুল ইসলাম: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা, কানাডা।
প্রাক্তন শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট
zahidripon@gmail.com

বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

শফিক রেহমানের কলাম--ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড



               ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড

ডিসেম্বর ২৮, ২০১১
shafik-rehman211111111112111প্রশ্ন : আমেরিকার বিয়াল্লিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন, যিনি তার ইচ্ছানুযায়ী বিল ক্লিনটন নামে বেশি পরিচিত, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আব্দুল মুহিত, যিনি সংক্ষেপে মুহিত নামে পরিচিতÑ এই দুইজনের মধ্যে মিল কী?
উত্তর : দুজনই স্টুপিড শব্দটি ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত।

তবে দুজনের মধ্যে গরমিলটা হচ্ছে ক্লিনটন ক্ষমতায় যাবার আগে শব্দটি বহুল ব্যবহার করেছিলেন। আর মুহিত ক্ষমতাসীন হবার পরে শব্দটি বহুল ব্যবহার করেছেন। শব্দটি ক্লিনটনের মুখ নিঃসৃত ছিল না। একচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট জর্জ হার্বার্ট বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩)-এর পুনঃনির্বাচনের বিরুদ্ধে যখন ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন, তখন লিটল রক শহরে (আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আরকানস-র রাজধানী) তার ক্যামপেইন হেড কোয়ার্টার্সের সামনে ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড (It’s the economy, stupid) স্লোগান সংবলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়। ক্লিনটনের পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজিস্ট জেমস কারভিল ১৯৯২-এ নির্বাচনী অভিযানের সূচনায় এই সাইনবোর্ড টাঙ্গান।তিনি চেয়েছিলেন ভোটারদের বোঝাতে তাদের দলের মূল লক্ষ্যটা কী। বিল ক্লিনটন তখন ছিলেন আরকানস-র তরুণ গভর্নর। তিনি বলেছিলেন, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। তাই আমেরিকান ভোটারদের উচিত হবে বুশকে বাদ দিয়ে ডেমক্রেট ক্লিনটনকে নির্বাচিত করা। এই স্লোগান দিয়ে ক্লিনটন আমেরিকান নাগরিকদের বলেছিলেন, যেহেতু তারা ভাবছেন অর্থনীতির তুলনায় অন্যান্য ইসুগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট সেহেতু তারা স্টুপিড। বস্তুত এই স্লোগান দিয়ে ক্লিনটন প্রতিটি আমেরিকান নাগরিককে স্টুপিড বলে অপমানিত করেছিলেন। অন্যদিকে ক্লিনটন বোঝাতে পেরেছিলেন, ওই সময়ে দেশের একমাত্র রাজনৈতিক ইসু ছিল অর্থনীতি। আমেরিকায় তখন মন্দাবস্থা চলছিল। বহু লোক বেকার ছিল।
ক্লিনটন নির্বাচিত হন। তিনি আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থানকে উন্নত করেন। বেকারের সংখ্যা কমে যায়। তিনি খুব জনপ্রিয় হন এবং পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বলা হয় সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা যদি না থাকতো এবং ক্লিনটন যদি তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী হবার সুযোগ পেতেন তাহলে তিনি অবশ্যই পুনঃনির্বাচিত হতেন। ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সি (১৯৯৩-২০০১) এখনও আমেরিকার সাম্প্রতিক স্বর্ণযুগ রূপে বিবেচিত। তার পরে তেতাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান জর্জ ডাবলিউ বুশ (হার্বার্ট বুশের বড় ছেলে)। তার প্রেসিডেন্সিতে (২০০১-২০০৯) আমেরিকা আবার মন্দাবস্থায় ফিরে যায়। বর্তমান ডেমক্রেট প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা ২০০৯ সাল থেকে আমেরিকার অর্থনীতিকে আবার উন্নত ও দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ২০১১-র মাঝামাঝিতে আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ মিলিয়ন। এই বেকারত্ব দূর করার জন্য দি ডেইলি বিস্ট-এ (১৯.০৮.১১) বিল ক্লিনটন ১৪ দফা প্ল্যান প্রকাশ করেন। আমেরিকায় এখনো ক্লিনটনকে মনে করা হয় তিনি ছিলেন একজন ইকনমিক উইজার্ড (economic wizard) বা অর্থনৈতিক জাদুকর।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে মুহিতের স্টুপিড শব্দটি ছিল মুখনিঃসৃত যা চলতি বছরের শেষে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বর্ষ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠানে আবারো প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি ‘রাবিশ’ শব্দটিও প্রায়ই প্রয়োগ করেন।
ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ যে পাঁচটি অগ্রাধিকারের কথা বলেছিল তার মধ্যে প্রথমই ছিল দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা।
ইশতেহারে বলা ছিল, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি, সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
ক্ষমতায় না থেকেও ক্লিনটন তার দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৪ দফা প্ল্যান দিয়েছেন। আর মুহিত ক্ষমতায় থেকে গত ১৬ ডিসেম্বর ২০১১-তে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি সাপ্লিমেন্টে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন। তার ধ্যান ধারণায় বাংলাদেশের বিপন্ন ভোক্তা বা কনজিউমাররা আশ্বস্ত হতে পারেনি।
বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমলেও
২০১১-তে মূল্য বৃদ্ধির একটি ছবি দৈনিক সমকাল (২৭.১২.২০১১) (প্রকাশক এ কে আজাদ যিনি এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি) তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে দাম বেড়েছে :
আইটেম খুচরা দাম বৃদ্ধির পরিমাণ
চাল (সরু)৫০-৫৫ কেজি প্রতি ৫
তেল ৯৬-১১১ কেজি প্রতি ১৬
চিনি ৫৭-৬৮ কেজি প্রতি ১১
বিদ্যুৎ ইউনিট প্রতি গড় ২১%
সিএনজি ১৬-৩০ ঘনফুট প্রতি ১৪
অকটেন ৭৭-৮৯ লিটার প্রতি ১২
পেট্রল ৭৪-৮৬ লিটার প্রতি ১২
ডিজেল ৪৪-৫৬ লিটার প্রতি ১২
দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টের মতে (২৬.১২.২০১১) সয়াবিন তেলের দাম হয়েছে ১২৩ থেকে ১২৬ টাকা।
গত এক বছরে পাঁচ দফায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। এর প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন খাতে খরচ বাড়ার ফলে শিগগিরই বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের দামসহ বাড়ি ও বাহন ভাড়া আরো বাড়বে সেটা নিশ্চিত।
এখানে মনে করা যেতে পারে যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮-এ দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার অব্যাহতভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ধারায় ফিরে যায়। সেপ্টেম্বর ২০১১-তে বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম আরো এক দফা কমে যায় তার পরেই বাংলাদেশে তেলের দাম আরো এক দফা বাড়ানো হয়।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, ‘জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ালে ইতিমধ্যেই টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া, সরকারের রাজস্ব আয়ের অপর্যাপ্ততা ও সরকারের ঋণগ্রস্ততার ফলে সংকটাপন্ন অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হবে।… মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান প্রায় ১০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চলতি অর্থবছরে অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে।’
এত বিশাল ভর্তুকি দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘এ অবস্থায় জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে হলে এ খাতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হবে, যা সরকারের বর্তমান আয় থেকে সঙ্কুলান করা অসম্ভব। এ পরিমাণ ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হলে অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ব্যয়সহ উন্নয়ন ব্যয় কমাতে হবে, যা কাম্য নয়। অন্য দিকে ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণগ্রহণ অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।’
অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা
এই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য এবং অগ্রহণযোগ্য। এই ব্যাখ্যার বিপরীতে ভোটাররা পাল্টা অনেক প্রশ্ন তুলতে পারে। যেমন, কেন টাকার মূল্যমান কমে গেল? কেন সরকারের রাজস্ব আয় অপর্যাপ্ত হলো? কেন সরকার ঋণগ্রস্ত হলো? কেন অর্থনীতি সংকটাপন্ন হলো?
এরপর ভোটাররা প্রশ্ন তুলতে পারে কেন ইলেকশন ম্যানিফেস্টো প্রকাশের সময়ে আওয়ামী লীগ এসব বোঝেনি বা বলেনি?
ফাইনালি ভোটাররা প্রশ্ন তুলতে পারে এই অবুঝ সরকার কেন এখনো ক্ষমতায় আছে? এই সরকার নিজেদের অক্ষমতা, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা স্বীকার করে নিয়ে কেন পদত্যাগ করছে না?
মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর মতে নভেম্বর ২০১১-তে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশ ছুঁয়েছে যা গত দেড় দশকের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ১৯ ডিসেম্বর ২০১১-তে মুহিত স্বীকার করতে বাধ্য হন ‘শুধু বিশ্বে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে বলেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হয়নি। দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু কারণেই মূল্যস্ফীতি হয়েছে।’
কিন্তু ‘বিশ্বে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে’, এই তথ্যটি কি সঠিক? ১৩ ডিসেম্বর ২০১১-তে বিবিসি থেকে জানানো হয় বৃটেনে নভেম্বরে কনজিউমার প্রাইসেস ইনডেক্স (সিপিআই) আগের মাসের ৫% থেকে কমে ৪.৮% হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর ২০১১-তে ইনফ্লেশন ডেটা ডট কম-এ জানানো হয়, আমেরিকাতে ২০১১-র মে থেকে অক্টোবরে এই ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৩.৬৫ এবং সেটা নভেম্বরে কমে হয়েছে ৩.৩৯%।
বস্তুত পশ্চিমি বিশ্বের চলমান মন্দাবস্থায় বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা নিয়তই চেষ্টা করছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে এবং তাদের অনেকেই সফল হয়েছেন। ইউকে এবং ইউএসএ-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান দুটি এর প্রমাণ।
কিন্তু বিদেশে যাই হোক না কেন দেশের মানুষ সেটা শুনতে আগ্রহী নয়। তারা শাদামাটা ভাবে বোঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বাড়ি ও বাহন ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে এবং আরো বাড়বে। এরা ভাষার মারপ্যাঁচ বোঝে না। এরা পরিসংখ্যানের জটিলতা বোঝে না। অনিয়ন্ত্রিতভাবে দাম বেড়ে যাবার ফলে এদের সংসার বিপর্যস্ত, স্বপ্ন বিধ্বস্ত, জীবন বিপন্ন। সাধারণ মানুষের কাছে দিনদিন বাস্তবতা হলো বাজারের দাম দুঃস্বপ্ন, বাড়ি ও বাহন ভাড়া দুঃসহ। তারা মর্মে মর্মে বুঝছে বর্তমান সময় একটি সুদীর্ঘ দুঃসময়। তারা বোঝে ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মানে তাদের সঞ্চয় এবং আয় প্রকৃত অর্থে ১২ শতাংশ কমে গিয়েছে।
দেশের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার আরো কয়েকটি অনাকাঙ্খিত চিহ্ন হলো :
এক. ডলারের দাম বেড়েছে। ২০১০-এ এই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ৭০ টাকা ছিল। এক বছর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এটি হয়েছে প্রায় ৮০ টাকা। অর্থাৎ, ডলারের বিপরীতে এক বছরে টাকার দাম কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। খোলা বাজারে ডলার এখন ৮৩ টাকা হবার রিপোর্ট এসেছে।
দুই. রাজধানীর কিছু এটিএমে বা ক্যাশ বুথে ক্যাশ টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
তিন. কিছু ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ক্যাশ টাকা দিতে পারছে না। ‘ব্যাংকে টাকার হাহাকার’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
চার. সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা বিপুল পরিমাণে আমানত সরিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, এ বছরের জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে বিপুল পরিমাণ আমানত হারায় এই ব্যাংকগুলো। এ সময়ের মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা ৫৭৩ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। জনতা ব্যাংক থেকে তুলেছেন ৯৯০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৭০৬ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা তুলে নিয়েছেন ছয় কোটি ৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, আমানতকারীরা সরকারি ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকে আমানতকারীদের কম হারে সুদ দেয়া হয় বলে এমনটা ঘটেছে।
পাঁচ. ইনডিয়াতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছাপতে দেওয়া প্রাথমিক স্তরের ৮০ লাখ (অপর একটি সূত্র মতে ২৫ লাখ) কপি বই নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে পৃন্টিং বিল পরিশোধ করতে না পারায় এবং বন্দরের শুল্ক পরিশোধ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় আশংকা করা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে দেশের বহু উপজেলায় শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবই পৌঁছাবে না।

সংকটে জর্জরিত ব্যাংকিং সিসটেম

ডলার সংকট ও তারল্য সংকটে জর্জরিত দেশের গোটা ব্যাংকিং সিসটেম ২০১১-তে বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছে।
এক. দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশে ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শংকা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়ছে। সামনে এ চাপ আরো বাড়বে। যে হারে আমদানি দায় বাড়ছে সে হারে ডলারের সরবরাহ বাড়ছে না। তিনি জানান, চলতি মাসে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানির জন্য পরিশোধ করতে হবে ৫০ কোটি ডলার। এর বাইরে পামঅলিন ও গম আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ, পেট্রোবাংলা থেকে বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কম্পানি শেভরনের পাওনা ও বিসিআইসির সার আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। অপর দিকে কয়েকটি ব্যাংকের বকেয়া আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। সব মিলে চলতি মাসে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে অন্য মাসের তুলনায় বেশি, কিন্তু সে হারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে না। আর সরবরাহ না বাড়লে রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করতে হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে।
সাধারণত একটি দেশের ইমার্জেন্সি খরচ মেটাতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হয়। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে সোয়া তিন বিলিয়ন ডলার করে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। সে হিসাবে তিন মাসে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ রাখতে হয়। দাতা সংস্থা আইএমএফ সব সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার কোটি বা ১০ বিলিয়ন ডলার রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু ১ ডিসেম্বর ২০১১-তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৩০ কোটি ডলারে নেমে যায়। এখন আশঙ্কা হচ্ছে, সামনে রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসবে।
দুই. রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক চারটির পরিচালনায় অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তীব্র মত বিরোধিতা চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ‘… পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো বেশি নজরদারি প্রয়োজন… এই ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো আক্ষরিক অর্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় নিতে হবে।’
প্রতিধ্বনি তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের সম্পদ ও দায় এবং পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা সবক্ষেত্রেই দুর্বলতাগুলোও আরো স্পষ্ট হয়েছে। অনভিজ্ঞদের হস্তক্ষেপে এবং চাপের মধ্যে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।… ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও শক্ত হতে হবে। শুধু চিঠি দিয়ে দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
এদের এসব বক্তব্য অরণ্যে রোদনের মতোই হবে। কারণ সরকার এই ব্যাংকগুলোকে তার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চায়।
তিন. চারটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি সরকারি কৃষি ব্যাংক রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহার করেও রাজনীতি সামাল দিতে পারছে না। তাই ২০১১-তে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো দশটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ চারটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। বাকি ছয়টির সম্পর্কে আরো আলোচনার দরকার আছে বলা হয়েছে পরিচালনা পর্ষদে। নিচে চার্টে দেখুন কোন আমলে কয়টি ব্যাংকের অনুমোদন হয়েছে।
কোন আমলে কয়টি ব্যাংকের অনুমোদন
সাল শাসন ক্ষমতায় যারা অনুমোদিত নতুন ব্যাংকের সংখ্যা
১৯৮২-১৯৯০ এরশাদের আমল ৯টি
১৯৯১-১৯৯৬ বিএনপি ৮টি
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ ১৩টি
২০০১-২০০৬ বিএনপি (চারদলীয় জোট) লাইসেন্স দেয়া হয়নি
২০০৬-২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাইসেন্স দেয়া হয়নি
মোট বেসরকারি ব্যাংক সংখ্যা ৩০টি
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিদেশী ব্যাংক ১৮টি
মোট ব্যাংক সংখ্যা ৪৮টি

রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো ব্যাংক

বর্তমানে দেশের ১৭টি ব্যাংক ঝুকির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও মহাজোট সরকার নতুন আরো দশটি ব্যাংকের অনুমোদন কেন দিতে চাইছে? অন্তত এ ক্ষেত্রে এই সরকার সত্য কথা বলেছে। বলা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে হবে। জানা গেছে বর্তমান সরকারের আমলে বিশটি আবেদন জমা পড়েছে।
এই রাজনৈতিক চাপ কারা সৃষ্টি করেছেন তার উত্তর পাওয়া যাবে মোট ৮২টি জমাকৃত আবেদনপত্রে আগ্রহী উদ্যোক্তাবৃন্দের নাম থেকে। দৈনিক আমার দেশ (২১-০৯-২০১১) এর একটি রিপোর্টের কিছু অংশ।
জানা গেছে, নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তালিকা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন করা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ সালাহ উদ্দিন। তাদের ব্যাংকের নাম দেয়া হয়েছে মধুমতি ব্যাংক। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর একাই চেয়েছেন দুটি ব্যাংক। এর একটির নাম দেয়া হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক ও অন্যটির নাম এসএমই ব্যাংক। দি ফারমার্স ব্যাংক গুলশানে অফিস খুলে এরই মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল রূপায়ণ ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছেন।
শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের নামেও কয়েকটি ব্যাংকের আবেদন করা হয়েছে। সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নামে সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংকের আবেদন এসেছে। ড. এসএম শওকত আলী ‘ক্যাপিটাল ব্যাংক’ এনজিও ব্যক্তিত্ব অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম টিএমএসএস ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক, ড. মো: শামসুল হক ভু্য়াঁ অ্যাপোলো ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন। প্রবাসী কমার্শিয়াল ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা ফরাসত আলী। তার সাথে আছেন ব্যবসায়ী নেতা কুতুবউদ্দিন। দি ব্যাংক অব এনআরবির আবেদন করেছেন মোল্লা ফজলুর রহমান, নিজাম চৌধুরী ও আরিফুর রহমান। আরবান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আবেদনে নাম আছে সাজ্জাদুল ইসলাম, মো: হেলাল মিয়া ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহসীন উদ্দিনের। ডাইনামিক ইসলামী ব্যাংকের আবেদনকারীরা হলেন বারেকুর রহমান, মো: হেলাল মিয়া ও তাজুল ইসলাম। রয়েল ব্যাংকের প্রস্তাবক হচ্ছেন নুরুল কাইয়ূম খান, জাহাঙ্গীর আলম খান ও আজিজুল খান চৌধুরী। কে টি আহমেদ আবেদন করেছেন বন্ড অ্যান্ড মর্টগেজ ব্যাংক (বিএমবি) প্রতিষ্ঠার। এক্সপ্রেস নামে ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন নাসিম আহমেদ, শাহরিয়ার আলম ও এবাদুল করিম।
আইএমএফ-এর বিরোধিতা
আইএমএফ-এর তরফ থেকে ও বাংলাদেশ এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
নতুন ব্যাংক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল হক বলেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো দরকার নেই। বর্তমান সরকার রাজনীতিবিদদের আবদার মেটাতে নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমরা যখন দেখলাম সরকার নতুন ব্যাংক করবেই তখন একটি সমীক্ষাকে সামনে রেখে নতুন কিছু শর্ত দিয়ে একটি খসড়া বা গাইডলাইন তৈরি করেছি। এতে কঠিন অনেক শর্তই আছে। প্রকৃত উদ্যোক্তা ছাড়া অন্যরা হয়তো নতুন ব্যাংক পাবেন না। তবে নতুন ব্যাংক সংখ্যায় খুবই সীমিত হবে।’
বছরের শেষ সপ্তাহে ২৬ ডিসেম্বরে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বোঝা যায় অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের সম্পর্কে হাস্যরসাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ‘অর্থমন্ত্রীর হ্যা গভর্নরের না’ শিরোনামে রিপোর্টের কিছু অংশ : ‘গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭। এবারের টার্গেট করা হয়েছিল ৭। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই সন্দেহ করছিলেন, এটা অর্জিত হবে না। অর্থনীতি ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত বললেন, হ্যাঁ, আমি শঙ্কিত। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। বললেন, না। আমি একমত নই। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ‘হ্যাঁ’ কেন ‘হ্যাঁ’ সেটা বোঝা গেলেও গভর্নরের ‘না’ কেন ‘না’ সেটা বোঝা যায়নি। একজন বিশ্লেষকের মতে, বার্তা সংস্থার খবর পড়ে মনে হয়েছে, গভর্নর জ্যোতিষের মতোই একটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তার অবস্থানের তথ্য ও উপাত্ত জানতে অনেকেরই আগ্রহ থাকবে। তবে আশার কথা শুনতে মন্দ না। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিলেন। তবে এমএ মুহিত কেন ভয় পাচ্ছেন তা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তার কথায়, চার কারণে তিনি ভীত। এই চার কারণ হলো পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, চরম মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ভর্তুকি। অন্য দিকে আতিউর রহমান বলেছেন, তিনি খোজখবর নিয়ে জেনেছেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা ভাল। সে কারণে তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তবে ঢাকার ওয়াকিফহালমহল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের এই আকস্মিক আশাবাদ ব্যক্ত করার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তারা বুঝতে চাইছেন, অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের দুই নীতিনির্ধারকের এ রকম পরস্পরবিরোধী অবস্থান শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক কিনা।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বাংলাদেশ অর্থনীতির একটা লেজেগোবরে অবস্থা সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই সাবধান করছিলেন। ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকার চালানোর পরিস্থিতি একটা বিরাট অশনি সঙ্কেত।
ব্যাংকগুলোতে যে তারল্য সঙ্কট চলছে সেটা এখন আর কারও স্বীকার করা বা না করার ওপর নির্ভর করে না। সাধারণ মানুষও তাদের দৈনন্দিন জীবনে টাকার সঙ্কট অনুভব করছেন। বড় অঙ্কের টাকার চেক আগের মতো বিনা নোটিশে ভাঙানো যাচ্ছে না। অনেকেই রসিকতা করে বলছেন, টাকার উপরে মুদ্রিত ‘চাহিবা মাত্র উহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’-এ কথার মানে ও তাৎপর্য বদলে যাচ্ছে। চাওয়া মাত্র টাকা পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।’
এসব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে মনে হয় মুহিত দ্বৈত ভূমিকা পালন করছেন। এক দিকে তিনি সরকারের অর্থমন্ত্রী রূপে বেসরকারি ব্যাংক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে নিজেকে নিছক সরকারি মুখপাত্র রূপে চিত্রায়িত করতে চাইছেন। অন্য দিকে অর্থনীতিবিদ রূপে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে সৎ মতামত প্রকাশ করতে চাইছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা এবং অর্থনৈতিকভাবে সৎ থাকার দুর্বল প্রচেষ্টার এই কন্ট্রাডিকশন বা বৈপরীত্যে মুহিতের বিবেক কি তাকে দংশন করছে? এর আগেও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে পদচ্যুতি ইসুতে মুহিত আরেকটি কন্ট্রাডিকশনে ভুগেছিলেন।
শেয়ার মার্কেটে অব্যাহত দরপতন
ব্যাংকিং সেক্টরের পরেই উল্লেখ করতে হয় শেয়ার মার্কেটে সারা বছর জুড়ে চলমান সঙ্কট ও বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। ৫ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে শেয়ারে দাম ধারাবাহিকভাবে পড়া শুরু হয়।
শেয়ারবাজারে ধস ঠেকাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনো সুফল হয়নি। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ইনসেনটিভ প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েও মার্কেটের ধস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে বহু বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। তারা অবস্থান এবং অনশন ধর্মঘট করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে। কেউ কেউ করেছেন আত্মহত্যা। কারো পারিবারিক অথবা দাম্পত্য জীবন গিয়েছে ভেঙ্গে। কারো হয়েছে হার্ট অ্যাটাক। অনেকে বেছে নিয়েছেন সহিংস পথ। তাদের তাড়া করেছে নিষ্ঠুর পুলিশ। শেয়ার মার্কেটের এই ছবি বছর জুড়ে ছিল টিভির বিভিন্ন নিউজ ও রিপোর্টে।
শেয়ার মার্কেটের অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় শেয়ার বাজার তদন্ত কমিটি। এই তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু সেই রিপোর্ট পাবলিকের কাছে প্রকাশিত করা হয়নি। ফলে শেয়ার মার্কেটে ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে জড়িতরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মশিউরের হৃদয়হীনতা
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওরা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু। ওদের জন্য মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। তাদের কষ্টে আমার মন কাঁদে না। শেয়ার বাজার ধসে সরকারের মাথাব্যথার কিছু নেই; কারণ শেয়ার বাজারের পুঁজি প্রকৃত বিনিয়োগে যায় না। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীরা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার ব্যবসা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেয়ার মার্কেটে যারা টাকা খাটায় তারা অল্প সময়ে অল্প লগ্নি করে বেশি লাভ করতে চায়। তাই তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।’
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক সংখ্যা কতো? একটি সূত্র জানায়, প্রায় ৩৩ লক্ষ। প্রতিটি বিনিয়োগকারীর পেছনে যদি ধরে নেয়া হয় অন্ততপক্ষে পাঁচজন পারিবারিক সদস্য আছেন (পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, জামাই, শ্বশুর, শাশুড়ি প্রমুখ) তাহলে মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা দাড়াবে ৩৩,০০,০০০x৫ = ১৬,৫০০,০০০ বা প্রায় এক কোটি পয়ষট্টি লক্ষ মানুষ!
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের দুর্দিনে তাদের গালিগালাজ না করে ড. মশিউর রহমান কিছু সমবেদনার বাণী শোনাতে পারতেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ক্ষতিগ্রস্ত কেউ না হয় সেসব পদক্ষেপ নিতে পারতেন।
পশ্চিমে শেয়ার মার্কেটের অনিশ্চয়তা বিষয়ে কিছু বাধ্যতামূলক সতর্কবাণী থাকে বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, পোস্টারে, যেমন share prices may go up or down and you may lose your whole investment. (শেয়ারের দাম বাড়তে পারে অথবা কমতে পারে এবং আপনি আপনার পুরো বিনিয়োগই হারাতে পারেন)। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিলবোর্ড-পোস্টারের পাশাপাশি আপামর বঙ্গসন্তানদের উদ্দেশ্যে এই ধরনের সতর্কবাণী নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। যেমনটা সিগারেটের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং তার যথেষ্ট সুফলও পাওয়া গিয়েছে।
ড. মশিউর রহমানের এই ধরনের নষ্ট মন্তব্যে অথবা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অপ্রকাশিত রাখলেই প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ উপদেষ্টার দায়দায়িত্ব মিটে যাবে না। এয়ারলাইন পাইলটের যেমন অলটিমিটার (ভূমি থেকে আকাশে উড়ন্ত প্লেনের উচ্চতা মাপার যন্ত্র), ডাক্তারের যেমন স্টেথিসকোপ, নার্সের যেমন থার্মোমিটারের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দেশের অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের দৈনন্দিন জানা দরকার স্টক এক্সচেঞ্জ ও তার ইনডেক্স এবং ডলার-পাউন্ড-ইউরো প্রভৃতির এক্সচেঞ্জ রেট। আর সে জন্যই বিবিসি ওয়ার্ল্ড, সিএনএন, স্কাই নিউজ, আল-জাজিরা প্রভৃতি টিভি চ্যানেলে বারংবার দেখানো হয় বিশ্বের বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জ ইনডেক্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট। স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অলটিমিটার বিহীন প্লেনের তুলনা করা যেতে পারে। আর তাই বাংলাদেশে স্টক মার্কেট ক্র্যাশ করেছে ২০১১-তে। ও হ্যাঁ, এর আগের হাসিনা সরকারও একই ক্ষেত্রে ক্র্যাশ করেছিল।
কোনো সুখবর নেই
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে সুসংবাদ ছিল না।
এক. গার্মেন্টস : আমেরিকান বাজারে পোশাক রফতানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে চায়না। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ রয়েছে দ্বাদশ স্থানে। অথচ পোশাক রফতানিকারকদের মতে চায়নার অবস্থান কিছুটা নেমে যাওয়ার সম্ভাবনায় বাংলাদেশের অবস্থান উন্নততর হওয়া উচিত ছিল। চাঁদাবাজি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট প্রভৃতির কারণে বহির্বিশ্বে তৈরি ও নিট পোশাক মার্কেট বাংলাদেশ হারাতে বসেছে। তার পরেও ২০১১-তে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রফতানি ২৫০০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।

দুই. আবাসন শিল্প
: জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাতের অবদান ২১ শতাংশ। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১,০০০ কোটি টাকা। এই খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায় দশ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। সহযোগী শিল্পেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। রিহ্যাবের মতে ২০১১তে আবাসন শিল্প বন্ধ হবার পথে গিয়েছে। এর কারণ তারা বলেছেন, নবনির্মিত বাসস্থানে সেবা সংযোগ (ইলেকটৃসিটি ও গ্যাস) প্রদানে নিষেধাজ্ঞা, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি আট গুণ বাড়ানো এবং বাস্তব সম্মত ভাবে ড্যাপ বাস্তবায়ন ও জলাধার আইন চূড়ান্ত না হওয়া।
রিহ্যাবের মতে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের রেজিস্ট্রেশন ফি ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,০০০ টাকা করা হয়েছে। এই আট গুণ বেশি ফি দিতে ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। উৎস আয়কর বৃদ্ধি করায় বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন খরচ দাড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। ইনডিয়াতে এই ফি ছয় শতাংশ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর ও শ্রীলংকাতে এই ফি এক থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ।
রিহ্যাব জানিয়েছে এসব কারণে অন্তপক্ষে ১৬,০০০ ফ্ল্যাট তারা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে পারছে না। ফলে একদিকে ক্রেতারা এখনো তাদের বাসস্থানের ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে হস্তান্তরিত না হওয়া সত্ত্বেও নতুন ফ্ল্যাটের জন্য কিস্তি পরিশোধে বাধ্য হচ্ছে।
তিন. ম্যানপাওয়ার রফতানি : জনশক্তি রফতানিকারকরা মনে করেন আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়েছে শ্র্রমবাজার চালু রাখতে। দৈনিক প্রথম আলো-র (২৪.১২.২০১১) রিপোর্টে সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়ে তারা বলেছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সে দেশে প্রতি বছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ কর্মী গেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের তিন বছরে গেছেন মাত্র ৩০ হাজারের মতো। এ সময় ফিরে আসে এরও বেশি, ৫০ হাজার লোক।
জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে তিন দশকের মধ্যে কখনো এমন বিপর্যয় হয়নি। সরকারি সূত্র ও ব্যবসায়ী মহল উভয়েরই মতে, এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় শ্রমবাজার মালয়শিয়ায়ও একই অবস্থা। তিন বছর ধরে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ বাজার কুয়েতের চিত্রও তাই।
জনশক্তি রফতনিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়শন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, সৌদি আরব, মালয়শিয়া, কুয়েত, কাতারÑ এগুলো হলো বাংলাদেশের আসল শ্রমবাজার। কিন্তু এগুলো চালু করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে; বরং এসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হয়ে উঠেছে।
নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য বর্তমান সরকার পাচটি কমিটি করে তাদের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। কিন্তু তিন বছরে সেই অর্থে নতুন কোনো বড় শ্রমবাজার খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।
তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে রফতানি বিষয়ে একটি ‘সুসংবাদ’ প্রকাশ করেছে দৈনিক নয়া দিগন্ত । রাজধানীর বেশ কয়েকটি নামীদামি হসপিটালে কিডনি কেনাবেচার পাশাপাশি ‘কলম্বিয়া এশিয়ান আন্তর্জাতিক সেবাকেন্দ্র, বাংলাদেশ’ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিডনি-লিভার পাচার করা হচ্ছে। অনেক সময় রোগীদের চিকিৎসার নামেও বিদেশে পাঠিয়ে তাদের কিডনি লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে রাখা হচ্ছে। মালয়শিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পার্শ্ববর্তী ইনডিয়া সহ বেশ কিছু দেশে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয়।
২০১১ জুড়ে এসব সংকটের মধ্যে যুক্ত হয় জাল নোট সংকট। এই বছরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ ১০০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১০০০ টাকার জাল নোটও বাজারে আসে। ব্যবহারকারীরা ১০০০ টাকার জাল নোটে বিপন্ন হয় বেশি। কারণ একটি নোট জাল পাওয়া মানেই ৫০০ টাকার দ্বিগুণ ক্ষতি। সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে চক মার্কেটের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন রিটেইলারের ক্যাশিয়ারের কাজ বেড়ে যায়। প্রতিটি নোট তারা বারংবার পরীক্ষা করে নিতে বাধ্য হয়। ফলে ট্রানজাকশন বা ব্যবসায়িক লেনদেন বিলম্বিত হয়। এই বিলম্বিত সময়ের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতা পাবলিক যেসব বিশেষণ শেখ হাসিনা, মুহিত ও আতিউর রহমানের প্রতি ছুড়ে দেন সেসব তারা স্বকর্ণে শুনলে লজ্জিত হবেন।
পদ্মা সেতু ও দুর্নীতি
সর্বোপরি ২০১১-তে স্টক এক্সচেঞ্জ ক্র্যাশের মতো আরেকটি ক্র্যাশের সম্ভাবনা আওয়ামী সরকারের মাথায় টাইম বোমা হয়ে ঝুলে ছিল। এটি হচ্ছে মালটি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসা, বিদেশে যাকে বলা হয় পিরামিড মার্কেটিং ব্যবসা। প্রতারণামূরক যে কোনো ব্যবসা বন্ধ করার পাশাপাশি এমএলএম ব্যবসাকে আইনের আওতায় সরকার আনবে বলে জানা গেছে বছরের শেষ মাসে। কিন্তু একটি সূত্র জানিয়েছে দেশের একটি প্রধান এমএলএম কম্পানি পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। বিনিময়ে তারা আইনের আওতার বাইরে থাকার গ্যারান্টি চেয়েছে।
২০১১-তে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থ সাহায্য প্রতিশ্রুতির প্রত্যাহারে। এর ফলে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ফোকাস পলিটিকাল এজেন্ডা
অনেকের মতে আওয়ামী সরকারের এই বিশাল ব্যর্থতার কারণ ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো অনুসরণ না করে তারা ইকনমিক এজেন্ডার বদলে পলিটিকাল এজেন্ডা পূরণে ফোকাসড হয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতিই হয়েছে মুখ্য দেশের অর্থনীতি হয়েছে গৌণ। যেমন, শেখ মুজিবকে হত্যার অভিযোগে পাঁচ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, খালেদা জিয়াকে চল্লিশ বছরের আবাসস্থল থেকে বহিষ্কার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারই সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী সরকার সফল হয়েছে।
কিন্তু ইকনমিক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
২৭ ডিসেম্বর ২০১১-তে আল জাজিরাতে প্রচারিত দি স্টৃম (The Stream) অনুষ্ঠানে লন্ডন প্রবাসী সাবেক পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বলেছেন তিনি পাকিস্তানে ফিরে নির্বাচনে অংশ নিতে চান এবং সেই নির্বাচনে জয়ী হলে প্রথমেই পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হবেন।
বাংলাদেশের মানুষ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে সে রকমটাই আশা করেছিল আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো পড়ে।
কিন্তু…
হতাশার কিছু নেই
এতক্ষণ যে বাস্তব ছবিটা তুলে ধরলাম সেটা কি খুব বেশি হতাশাব্যঞ্জক?
যদি এসব পড়ে ও জেনে এবং বাজার ও ব্যাংকে নিজে গিয়ে হতাশ হন তাহলে আপনি হয়তো বিএনপিপন্থী, জামায়াতপন্থী, রাজাকার, কিংবা যুদ্ধাপরাধী (আপনি টিনএজার হলেও!) রূপে বিবেচিত হবেন।
কারণ?
কারণ ২০ নভেম্বর ২০১১-তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘হতাশার কিছু নেই। বলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে হাহাকার চলছে, টাকা নেই। কিসের টাকা নেই? চালাতে পারলে ঠিকই চালানো যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় দেশে কোনো রিজার্ভ মানি ছিল না। তখন কি দেশ চলেনি? রিজার্ভ মানি রাখা হয়, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে তিন মাসের জন্য খাদ্য আমদানি করা যায়। তাই যেহেতু আমাদের খাদ্য আছে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। মন্দার জন্য বিশ্ব এগিয়ে যেতে না পারলেও আমরা এগোচ্ছি।… যে ওয়াদা আমরা জনগণকে দিয়েছিলাম, তার অনেকাংশ পূরণ করেছি। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে।… হতাশা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু হতাশার কিছু নেই।’
সরকারের ব্যাংক ঋণ নেয়া এবং ব্যাংকে লিকুইড মানির অভাব সম্পর্কে প্রচারণার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘টাকা ধার করে সরকার ঘি খাচ্ছে না। জনগণের উন্নয়নে কাজ করছে।’
সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
আপনি ভাবুন, আপনি নিরাপদে আছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এসব পলিটিকাল প্রপাগান্ডার মধ্যে একটি ইকনমিক ট্রুথ থেকেই যাবে।
সেটা হলো বিল ক্লিনটনের সেই স্লোগান, ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী সরকারের মধ্যে কে বা কারা স্টুপিড?
২৮.১২.২০১১
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান:প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।