মো. নূরুল আমিন
আমরা দুই পায়ে ভর করে যে দেহকে প্রতিনিয়ত বহন করছি সে দেহতত্ত্ব সম্পর্কে অনেক সময় আমাদের অজ্ঞতা দেখে আমি বিস্মিত হই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হৃৎপিন্ড দৈনিক ১৩০০০ লিটার রক্ত পাম্প আউট-এর মাধ্যমে পরিশোধন করে, এই তথ্যটি আমরা কয়জনে জানি? দৈনিক আমাদের হৃৎপিন্ডের স্পন্দনের সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ বার। এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের রক্ত সঞ্চালনকারী শিরা-উপশিরাগুলোকে যদি জোড়া দিয়ে লম্বা করা হয় তাহলে তার দৈর্ঘ্য হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, যে দূরত্ব চার বার সারা দুনিয়া ঘুরে আসার দূরত্বের সমান। একটি মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এ ধরনের কিছু তথ্য দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আমরা এগুলো অনেকেই জানি না, যেমন জানি না আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশী কিছু রাষ্ট্র, মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যম এমন কিছু তথ্য ও মন্তব্য সংবলিত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যা অাঁতকে ওঠার মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্টের স্টেট ডিপার্টম্যান্ট কর্তৃক ২০১১ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ফুলস্কেপ কাগজের ৩৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে। এই রিপোর্টে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের জুলুম-নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের দমন-নিপীড়ন, হত্যা-গুম, হামলা-মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গ্রেফতার, রিমান্ড ও নির্যাতন, পুলিশের বেপরোয়া আচরণ, বিচারের নামে প্রহসন, প্রশাসন, আইন-শৃক্মখলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের নির্লজ্জ দলীয়করণ, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহরণ, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ গ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান, সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, জনদুর্ভোগ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং নারীনির্যাতন ও অনৈতিক কাজে অব্যাহতভাবে তাদের সম্পৃক্তি, বেসরকারি সংস্থা এবং শ্রমিক সংগঠনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ প্রভৃতি হচ্ছে এই রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এশিয়ান মানবাধিকার সংস্থাও তাদের প্রকাশিত রিপোর্টসমূহে অনুরূপ তথ্য ও মন্তব্য সরবরাহ করেছে। এই রিপোর্টগুলোতে সরকারের সেবাখাতের দুরবস্থা, সেবামানের অধঃগতি এবং জনদুর্ভোগেরও একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যার সামগ্রিক তাৎপর্য হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতা এবং অকার্যকর অবস্থা। বিশ্বের বহুল প্রচারিত সাময়িকী দ্যা ইকোনোমিস্টের গত ২৬ মে সংখ্যায় বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং এই প্রতিবেদনগুলোর তাৎপর্য ভিন্নমুখী। এই দুটি প্রতিবেদনের একটির শিরোনাম হচ্ছে 'Bangladesh'es Toxic Politics– Hello, Delhi : It is up to India to try to stop Sheikh Hasina ruining Bangladesh.'অর্থাৎ ‘বিষাক্ত রাজনীতির কবলে বাংলাদেশ, হ্যালো দিল্লী, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ ধ্বংসের পথ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করার দায়িত্ব এখন ভারতের।' এই রিপোর্টটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শেখ হাসিনার পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এবং সামরিক হস্তক্ষেপে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই দেশের কোটি কোটি মানুষ একটি স্বপ্ন নিয়ে তাকে এবং তার দলকে সমর্থন যুগিয়েছিলো। এই স্বপ্ন ছিলো স্বাধীনতার, মর্যাদার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার, মানবাধিকার পুনর্বহালের, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, বৈষম্য হ্রাস, শোষণহীন সমাজ এবং ইনসাফ ও আদলের প্রত্যাশার। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরে তাদের সেই স্বপ্ন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নস্যাৎ করে দেয় এবং দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ইতিহাসের অমোঘ ধারায় এদেশে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আমরা বর্তমান অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছি। এখন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানেরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার অভিযোগ উঠেছে। ইকোনোমিস্ট সাময়িকী এই অভিযোগ তুলে এই দেশটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ভারতকে সক্রিয় হবার আহবান জানিয়েছে। ইকোনোমিস্টের ভাষায়, The only Country to have much influence in Dhaka is India Until recently the regional Super Power talerated Sheikh Hasina's excesses, in past because Bangladesh has cracked down on Islamists. অর্থাৎ ঢাকায় প্রভাব বিস্তারকারী একমাত্র দেশ হচ্ছে ভারত এবং এতদিন শেখ হাসিনার বাড়াবাড়িকে এই আঞ্চলিক ক্ষমতাধর দেশটি সহ্য করার আংশিক কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ইসলামপন্থীদের ঘাড় মটকানো। বাংলাদেশের সকল হক্কানী আলেম-উলামা, ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ বিশেষ করে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে। আবার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিকভাবে মেনে নিলেও কখনো আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে যে, সাতচল্লিশের সীমানা মুছে দিয়ে বাংলাদেশ আবার অবিভক্ত ভারতে ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাশা পূরণে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলো। এই অবস্থায় তারা আওয়ামী লীগের কিছু সুবিধাবাদী নেতৃত্বকে প্রভাবিত করে, অর্থবিত্ত দিয়ে কিনে নিয়ে এই দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে ধ্বংস করে তাদের অভিলাষ পূরণ করতে চায়। ইকোনোমিস্ট সাময়িকীটি ২০১১ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পিছনে বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকা ও কৌশলগত পরামর্শের বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছিলো। ইকোনোমিস্ট-এর এই রিপোর্টটির সাথে বেশ কিছুকাল আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে টেলিফোনে যে আলোচনা হয়েছিল পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে কিছুটা অনুধাবন করা যায়। এই আলোচনার এক পর্যায়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, Madame Prime Minister, I thought I would not have to go that far, But unfortunately; I was wrong. I hope you know as much we know, how your government came to power. Don't forget that we helped you congratulating you after the election terming it as a free and fair. You know Prime Minister, how this election result was pre-arranged at the behert of our good friends in New Delli. We acted the way they suggested us. And please don't forget that Gen. Moyeen, who brought you to power, now in the USA and perhaps, we now know, more than you could possibly imagine?- অর্থাৎ ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আমি ভেবেছিলাম আমাকে অতদূর যেতে হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন দেখছি যে, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আশা করি, আমরা যা জানি আপনিও তা জানেন, আপনার সরকার কিভাবে ক্ষমতায় এসেছে। এটা ভুলে যাবেন না যে, নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ অভিহিত করে আপনাকে অভিনন্দন জানানোর ব্যাপারে আমরা সাহায্য করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আপনি জানেন, নয়াদিল্লীর আমাদের বন্ধুদের অনুরোধে, সক্রিয় সহযোগিতায় এই নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা কাজ করেছিলাম এবং মেহেরবানী করে একথা ভুলবেন না যে জেনারেল মঈন আপনাকে ক্ষমতায় এনেছেন তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এবং সম্ভবত আপনার ধারণা নেই এমন অনেক কিছুই আমরা জানি।'
পাঠকরা এখন ইকোনোমিস্টের রিপোর্ট এবং হিলারির মন্তব্য মিলিয়ে দেখলে নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারবেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে প্রতিবেশী ভারত কিভাবে কোটি কোটি মানুষের বুকে পুঁতে দিয়েছে। হিলারি-প্রধানমন্ত্রী কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপ্টটি দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ কারোর পক্ষ থেকেই আজ অবদি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়নি। এই কথোপকথনের প্রথমদিকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত বিষয়েও কিছু প্রশ্ন তুলে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর জবাব ছিল- 'Madame Secretary, I understand your concern and I already asked my Law Minister to take note of what Amb. Rapp suggested. This is a trial we undertook with active support and assistance of New Delhi. I am sure Indian Ambassador in Washington DC will brief you further on that.'- অর্থাৎ ‘ম্যাডাম সেক্রেটারি, আমি আপনার উদ্বেগ উপলব্ধি করতে পারছি এবং ইতোমধ্যে আমি আমার আইনমন্ত্রীকে রাষ্ট্রদূত র্যাপের সুপারিশসমূহ নোট করার নির্দেশ দিয়েছি। নয়াদিল্লীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় আমরা এই বিচারকার্যটি শুরু করেছি। আমি নিশ্চিত যে, ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থানরত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আপনাকে এই বিষয়ে আরও অবহিত করবেন।'
তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের নামে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগসমূহের উৎসটি এখানে পরিষ্কার। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিচার কাজ শুরু করা হয়েছিল। এই বিচারের জন্যই ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি প্রণীত হয়েছিল। আবার এই ভারতেরই প্রত্যক্ষ তৎপরতায় একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের কারাগারে আটক অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে ঐ আইনটি সংশোধন করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বী জামায়াত নেতাদের উপর ১৯৭১ সালে সংঘটিত সকল যুদ্ধাপরাধের দায় চাপিয়ে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, অধ্যাপক গোলাম আযম, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে এবং কারো কারো বিচার কাজ শুরু করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বলা বাহুল্য, ঐ সময়ে এদের কেউই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন না, সামরিক, আধা-সামরিক কোন বাহিনীতে কাজও করেননি, সরকারের কোন অর্গান বা সশস্ত্র শৃক্মখলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়ার মতো কোন অবস্থা বা অবস্থানও তাদের ছিল না। অথচ দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, কিংবা প্রশাসনে তৎকালীন সময়ে কর্মরত কাউকে অভিযুক্ত না করে এই ইসলামী নেতৃবৃন্দকেই সরকার অভিযুক্ত করেছেন, যারা ঐ সময়ে মানবতাবিরোধী তৎপরতা নয়, মানবতা রক্ষার তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এখানে বিস্মিত হওয়ার মতো একটি বিষয় রয়েছে। যারা দাগী অপরাধী তাদের অপরাধের প্রবণতা ও মাত্রা কখনো হঠাৎ করে বন্ধ হতে পারে না, তার একটা ধারাবাহিকতা থাকে। আবার অপরাধী ব্যক্তির অপরাধ তখনই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যখন তার অপরাধের সাথে ক্ষমতার যোগসূত্র স্থাপিত হয়। মাওলানা নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ ৫ বছর ধরে সরকারের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে তাদের ক্ষমতা কম ছিল না। তারা যদি অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের মন্ত্রণালয় এবং দলীয় ও পারিবারিক পরিমন্ডলে এই অপরাধ এবং দুর্নীতির ছাপ অবশ্যই পড়তো। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে যে, এই মন্ত্রিত্ব ও ক্ষমতা তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেনি এবং অপরাধ সংঘটনেও তাদের অনুপ্রেরণা যোগায়নি। বরং তারা মন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। অনেকে বলে থাকেন যে, আমরা যদি সভ্য কোন দেশে বসবাস করতাম এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আমাদের দলীয় ও ব্যক্তিগত আদর্শ না হতো তাহলে নিজামী, মুজাহিদ ও তার দল নিন্দিত নয় বরং নন্দিত হতো।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের সামনে দেশের মানুষের স্বার্থ এখন বড় কথা নয়। তাদের সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং এই লক্ষ্যেই তারা দেশবাসীর নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে সর্বত্র সরকারের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীনদের নিরাপত্তাই পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। তাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ এখন শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, প্রতিদ্বনদ্বী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী সবাইকে পেটাচ্ছে এবং পরিকল্পিতভাবে প্রতিবেশী দেশের দাবি পূরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বলা বাহুল্য, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশ থেকে ১০টি সুবিধা চেয়েছিল। এগুলো ছিল (১) এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক তৈরিতে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহারের অনুমতি, (২) বাংলাদেশের ভূখন্ড দিয়ে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাইপ লাইন আনার অনুমতি, (৩) মিজোরাম-বাংলাদেশ বাণিজ্য রুটের অনুমোদন, (৪) বাংলাদেশের ফেনী নদী এবং কুলাউড়ার রাঙ্গাছেড়া নদীর উপরে সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে ব্রিজ নির্মাণ, (৫) আগরতলা-আখাউড়া ও করিমগঞ্জ শাহবাজপুর রেলসংযোগ পুনঃস্থাপন এবং যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল সুবিধা প্রদান, (৬) ভারত থেকে একদিনের মুরগির বাচ্চা ও ডিম আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত, (৭) সেভেন সিস্টার্স-এর জন্য করিডোর সুবিধা, (৮) চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি, (৯) বাংলাদেশের গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের সুবিধা, (১০) ভারতীয় ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা প্রভৃতি। ভারতের সাথে অনিন্ন অসংখ্য সমস্যা বিশেষ করে সীমান্ত বিরোধ ও বিএসএফ কর্তৃক অহরহ বাংলাদেশীদের হত্যা-নির্যাতন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত কর্তৃক অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে রূপান্তরের ষড়যন্ত্র, ছিটমহল বিনিময়, বাণিজ্য ঘাটতি, টিপাইমুখ ও ফুলতলীতে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ, তিস্তার উজানে বাঁধ নির্মাণ ও বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিতকরণ প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে চারদলীয় জোট সরকার ভারতকে উপরোক্ত সুবিধগুলো দেয়নি। পরবর্তীকালে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের কেয়ারটেকার সরকারের আমলেও ভারত এ দাবিগুলো উত্থাপন করেছিল। এই সরকার বিশেষ করে তৎকালীন যোগাযোগ উপদেষ্টা হাসান মাসউদ চৌধুরী জনমত যাচাই-এর ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টি রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকার ভারতীয় অর্থ ও পরামর্শের জোরে ক্ষমতায় এসে এক বছরের মাথাতেই তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। তারা দেশবাসীকে উন্নত জীবন যাত্রা, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, রাজনৈতিক শিষ্টাচার, দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগ, বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েচিলেন তার কোনটিই পূরণ করেননি। বরং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে ব্যবস্থাটি সংবিধানে ছিল তাও বাতিল করে দিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দলীয় ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রী, এমপি ও ক্যাডারদের ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। বিরোধী দলগুলো এখন কোন প্রকার আন্দোলনে যেতে পারছে না। জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরী অফিস খুলতে দেয়া হচ্ছে না। এই অফিসগুলো খোলার উপর পুলিশ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। দলটির হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে। ধর্ম ও ধর্মীয় অনুভূতির উপর মন্ত্রী ও সরকারি নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে আঘাত হানছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দকেও জেলে পুরা হয়েছে। এবং কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, বেগম জিয়াও গ্রেফতার হতে পারেন। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে ১৮ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হযেছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিরোধী দলসমূহ বিশেষ করে আঠার দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ছে এবং এক্ষেত্রে দ্রুত বিচার আইনের অপব্যবহার করে তাদের শাস্তি দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার অপপ্রয়াস চলছে। বিরোধী জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানিয়ে সরকারের প্রতি একটি আলটিমেটাম দিয়েছে। এই আলটিমেটামের মেয়াদ ১০ জুন শেষ হবে। ১০ জুনের পর কি হবে আমি জানি না। তবে একটা বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই যে, অতীতের ইতিহাস যদি ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা হয় তাহলে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আটক অবস্থায় থাকলেও অধিকার আদায়ের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে থাকবে না। অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে দেশের নির্যাতিত মানুষরাই নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করবে।
আমার দৃষ্টিতে কেয়ারটেকার সরকারই এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি নয়। ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতে প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র আসার যে সব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তাতে দেশকে অস্ত্রমুক্ত করার প্রশ্নটিও মুখ্য হয়ে উঠবে। বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় যে অস্ত্র লুট হয়েছে অনেকে মনে করেন সে অস্ত্র দলীয় ক্যাডারদের হাতেই আছে এবং নির্বাচনের সময় সেগুলোই ব্যবহৃত হতে পারে। বলা বাহুল্য, এই অস্ত্র লুট ও পুনরুদ্ধারের বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সরকার অদ্যাবধি দেশবাসীকে অবহিত করেননি। এরপর আসে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা, কেউ বঙ্গভবন দখল করে এসএসএফর ডাবল নিরাপত্তা নিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে নির্বাচন করবেন আর কেউ সাধারণ নিরাপত্তাও পাবেন না- এই অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কাজেই আগামী দিনগুলো আরো ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ হতে পারে বলে আমার আশঙ্কা। রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের যে আনাগোনা চলছে তা যদি ঝড়ে রূপান্তরিত হয় তা হলে তার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কেউই রক্ষা পাবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন