রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

জীবন যেন এক বহতা নদী



ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম
সেই চল্লিশের দশকে এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মেছিলাম। দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে জীবনের শেষের দিকে রাজধানীতে বসবাস করছি। কীভাবে যে সেই ছোট্ট শিশুটি এত তাড়াতাড়ি শেষেরদিকে চলে এলাম বুঝতেই পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখতাম ৬০ বছরেই মানুষ কেমন যেন বৃদ্ধ, অসহায়। কিন্তু এখন আগের মতো অত শারীরিকভাবে কেউই অসমর্থ হয়ে পড়ে না। বছর পেরিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ’এ নিয়মিত লিখি। অন্য কয়েকটি পত্রিকাতেও লেখালেখি করি। এজন্য সময়ের যে খুব একটা অভাব হয় তেমন নয়। গত পর্বে মহামহিম প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে লিখেছিলাম। ১৮ তারিখ রাতে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বড় ভালো লাগল কথা বলে। আমাদের দেশের হঠাত্ বাবুরা সামান্য কিছু হলেই ধরাকে সরাজ্ঞান করে। কিন্তু তাদের মধ্যে ওসব নেই। প্রদ্যুত্ গুহ ফোন ধরতেই বললেন, ‘বাঘা দা, দাদার সাথে কথা বলুন।’ মহামহিম প্রণব মুখার্জি ফোন ধরেই বললেন, ‘অভিনন্দন বার্তা পেয়েছি। তোমরা কেমন আছো, ছেলেমেয়ে কেমন আছে?’ সেই আগের মতো আগ্রহ, আগের মতোই কথাবার্তায় কোনো পরিবর্তন নেই। কিন্তু আমাদের কেমন যেন রোগে ধরেছে। পদ না থাকলে রাস্তায় ঘোস পারে, পদ পেলে আসমান দিয়ে হাঁটে। যাক ওসব। ২৫ জুন ১৯৮৪, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ৪৬, সদরঘাট রোডের বাড়িতে আমার বিয়ে হয়। সে এক অভিনব বিয়ে। ৭ ভরি সোনাদানা খাওয়া-দাওয়া সমেত সর্বমোট ১৩ হাজার কয়েক টাকা খরচ। তখন সোনার দাম ছিল ৪৪০-৪৫০ টাকা। ওসব কথা বললে এখন হয়তো কেউ কেউ হাসবে। কারণ এখন সোনার দাম ৬০ হাজার। একটা সাধারণ মানুষের যেভাবে বিয়ে হয় তার চেয়ে ভালোভাবেই হয়েছিল। কিন্তু একটা ছাপোষা কেরানির বিয়েতেও যে আড়ম্বর থাকে তা আমার ক্ষেত্রে ছিল না। পদে পদে বঞ্চনা, অবহেলা, অভাব লেগেই ছিল। যদিও বৌভাতে ভারতীয় বেশ বড় বড় অনেকেই এসেছিলেন। বিয়ের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি পেয়েছিলাম। প্রণব মুখার্জি, মুচকুন্দ ধ্যুবে, জে.এন. দীক্ষিত, অটল বিহারি বাজপেয়ীসহ আরও অনেকেরই শুভেচ্ছা বাণী পেয়েছিলাম। বৌভাতের প্রায় সব আয়োজন করেছিলেন কংগ্রেস নেতা চুমকির বাবা এমদাদ আলী বাবু মিয়া, কাঠের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, বর্ধমান সরকারি রাজ কলেজের আমার গৃহ শিক্ষক শহিদুল হকসহ আরও কয়েকজন। আসলে জীবনটা কেমন যেন কোনোদিন সোজা পথে চলল না, কোনোকিছু কখনও গতিময় স্বস্তির রূপ নেয়নি। একটি ছন্নছাড়া জীবন বয়ে গেলাম চিরকাল। যখনই অবহেলা পেয়েছি, তখনই কেন জানি আল্লাহর দয়ায় ছোটখাটো আশ্রয় বা ছায়াও পেয়েছি। একেবারে যখন ছোট ছিলাম, পারিবারিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম, তখন মা ওই মা করিমন নেছা বুকে আগলে রাখতেন। একটু বড় হলে রাজনীতিতে অনেক নেতারই চক্ষুশূল ছিলাম। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা কেন যেন চারদিক থেকে ঘিরে থাকত। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে তার ভীষণ স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছিলাম। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অপরিসীম স্নেহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল নতুন জীবন। একদিকে চরম বিদ্বেষী শত্রুদের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে হিতৈষীদের অপরিসীম ভালোবাসা। স্বাধীনতার পর কতজন আমার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কান ভারি করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে এক সময় ভারত গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভীষণ স্নেহ ও সহমর্মিতা পেয়েছিলাম। কংগ্রেস সরিয়ে জনতা দল যখন ক্ষমতায় আসে তারা কংগ্রেসের সবকিছু ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ায় আমিও পড়েছিলাম। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শ্রী সমর গুহ এমপির সহায়তায় পাটনায় গিয়ে শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সমর্থন পেয়েছিলাম। যে কারণে শ্রী মোরারজী দেশাই কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ’৯০-এ দেশে ফিরে অনুকূল স্রোত পাইনি, শুধু শুধু উজানই বয়েছি। উজান বইতে গিয়ে জীবনে কখনও সখনো বাতাসের অনুকূলে হয়তো পাল তুলেছি কিন্তু বেশি সময় নয়। ২৫ জুন আমার বিয়ের দিনে কী করে যে লেখাটি পড়ল ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। এটা হয়তো আল্লাহরই দান। কারণ কিছুদিন আমার লেখা মঙ্গলবার ছাপা হতো। ওই একই দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা লেখা দেই বলে খুব চাপে পড়তে হতো। তাই কয়েক মাস আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সোমবার ঠিক করা হয়। যাক, এটাও একটা আল্লাহর দয়া হিসেবেই ধরে নেব। ২৫ জুন না হলে কথাগুলো বলতাম না। ১৯৭২ সালে কলকাতায় প্রথম সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অমন অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ভারত উপমহাদেশে দ্বিতীয় কেউ নেই। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ’৭৭-এর কোনো একদিন দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে তার সঙ্গে দেখা। এখন আর পালাম বিমানবন্দর তেমন নেই। এখন গোরগাও ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সব থেকে বড়। এরপর কতবার যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কোনো হিসাব নেই। বঙ্গবন্ধুর সমান লম্বা-চওড়া বড় দরদি মানুষ ছিলেন তিনি। সব সময় এটা-ওটা সাহায্য করতেন। নিভৃতে পেলেই বলতেন, ‘টাইগার, যত কিছুই করো, মানুষের একটা জীবনই যথেষ্ট। তুমি যদি একজন মানুষের হাসিকান্না ভালোভাবে তুলে ধরতে পার তাহলে জগত্ জয় করতে পারবে।’ পরে ভেবে দেখেছি সত্যিই তাই। কাহিনীকার একটি মেয়ে বা ছেলেকে নিয়ে তার আনন্দ-বেদনা নিয়ে জাল বুনে। তা ভালোভাবে চিত্রায়িত করতে পারলে শত শত হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর হলে গিয়ে পয়সা দিয়ে দেখে। ও তো শুধু ভালোভাবে উপস্থাপনের কলা-কৌশলের কারণে। অথচ আমাদের কত জনের কত দুঃখ, কত বেদনা, কত হাসি-কান্না, কিন্তু সেগুলো কাউকে স্পর্শ করে না। কারণ স্পর্শ করার মতো করে উত্থাপিত হয় না, বা করার চেষ্টা করা হয় না তাই।
আগেই বলেছি ছেলেবেলায় খুবই দুষ্টু ও চঞ্চল ছিলাম। আমাকে নিয়ে পরিবারের সবাই থাকত বিব্রত। পরিবারের জন্য কত যে মাথা ব্যথার কারণ হয়েছি মস্তবড় হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেও হয়তো সব লেখা যাবে না। খাতার পাতা ফুরিয়ে যাবে কিন্তু আমার দুষ্টুমি ফুরাবে না। আমরা ছিলাম দুই মায়ের ১৫ সন্তান। তার পাঁচজন মারা গেছে। আল্লাহর রহমতে ১০ জন এখনও বেঁচে আছি। সঠিক হিসাবে আমি পরিবারের চতুর্থ, আর জীবিতদের মধ্যে দ্বিতীয়, কারণ উপরের দু’জন মরে গেছে। কি কারণে সেই ’৬৬ সাল থেকেই আমার বিয়ের আলোচনা শুরু হয়েছিল। যখন আমি বাড়ি পালিয়ে ’৬৫ সালে সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম সেই তখন থেকে। কোথায় ’৬৬ আর কোথায় ’৮৪। চেষ্টা শুরুর ১৮ বছর পর শুভ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কারণে অনেকের মনে হতে পারে নাসরীন কোরায়শীর সঙ্গে আমার বিয়ে এক প্রেমের সফল পরিণতি। কিন্তু আসল সত্য তা নয়। নাসরীন কোরায়শীর সঙ্গে বিয়ে হতে পারে এটা চিন্তার মধ্যেও ছিল না। ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তাকে যতটুকু জেনেছি তাতে তারও আমাকে নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না। দুই পরিবারে সব সময় ব্যবধান ছিল আকাশছোঁয়া। ছেলেবেলায় লেখাপড়া করতাম না। গরুর রাখাল ছিলাম বলে ওদের কাছে ছিলাম অপছন্দ। আবার স্বাধীনতার পর ওরা সাদাসিধে নিরিবিলি পরিবার হওয়ায় আমাদের কাছে ছিল বেমানান। বিবাহিত জীবনে যেসব কারণে স্বামী-স্ত্রীর খটাখটি হয়, আমার ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তার কিছুই হলো না। কিন্তু যা নিয়ে কোনোদিন কোনোকিছুই হয় না তার অনেক কিছু নিয়েই স্ত্রীর উপর আমার যেমন মন খারাপ হয়, আমার উপরও হয়তো তার মন খারাপ হয়। জীবনের অনেকদিন এক কথা দু’বার বলার প্রয়োজন হতো না, স্ত্রীর বেলায় বলতে হয়। তাতে আমার মন ভারি হয় কিন্তু ওসবে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিয়ের কয়েক মাস পর একদিন দেখলাম রাজরানীর মুখ ভার। শত চেষ্টা করেও কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। তারও কয়েক মাস পর পত্রিকার এক সাক্ষাত্কারে দেখলাম, পাড়ার বস্তির রিকশাওয়ালাদের ছোট ছোট বাচ্চারা কাদামাটি নিয়ে নাগে পেটাসহ আমার কোলেপিঠে ওঠে, এতে তার ঘেন্না হয়, তাই তার মুখ ভার। আমাকে বলেনি, মাকে বলেনি কিন্তু সাংবাদিকদের ঠিকই বলেছে। আসলে অনেক সময় সাংবাদিকদের সাহায্যে অনেক কিছু জানা যায়। সারা জীবন যে আওয়ামী লীগ করেছি সেই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করায় ষড়যন্ত্র করে দেশে ফেরার কোনো চেষ্টা করেনি। আমার অতি সাধারণ স্ত্রী বাসে চড়ে দেশের কত জায়গায় যে গেছে, কত কষ্ট যে করেছে তার পরিমাপ করা যাবে না। ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের শত বাধার মুখেও ঢাকা বিমানবন্দর জনগণের পদভারে কেঁপে উঠেছিল। ওর আগে অত মানুষ নাকি ঢাকা বিমানবন্দরে আর দেখেনি। আমার রাজকন্যার মতো কুড়িমণি, রাজপুত্রের মতো দীপ। ওরা যখন জন্মে ওদের ভালোভাবে লালন-পালন করেনি। সন্তান পেশাব-পায়খানা করায় কোনো মা অসন্তুষ্ট হয়, আমার স্ত্রীকেই প্রথম দেখেছি। তাতে বিরক্ত হতাম, মন খারাপ লাগত। কিন্তু কুশিমণি যখন এলো সব দুর্বলতা কেটে গেল। আমার স্ত্রী পরিপূর্ণ মা হলেন। ওর পেশাব-পায়খানা, কাপড় ছেঁড়া, নষ্ট করার জন্য কোনো অনুযোগ রইল না। কুশিকে ছাড়া এখন আর তার মা’র ঘুম হয় না, মুখে খাওয়া রোচে না। কুশিমণি দীপ-কুড়ির প্রাণ, মায়ের কলিজা। আমার তো কথাই নেই। ওকে ছাড়া আমি শ্বাস নিতে পারি না, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বাসায় থাকলে কারণে-অকারণে ঘুরঘুর করে। অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী সে। সাহেবী রং-ঢংয়ের মানুষের মতো শহরের ভাবধারা এখনও রপ্ত করতে পারিনি। ক্লাবে যাওয়া, হোটেলে খাওয়া, এখানে-ওখানে আড্ডা দেয়া ওসব আজও হলো না। আমার স্ত্রী নিশাচর পরিবারের সন্তান। ওরা রাতে জাগে, দিনে ঘুমায়। আমি দিনে জাগি রাতে ঘুমাই। এসব কম-বেশি ব্যতিক্রম নিয়েই মানিয়ে চলছি। কারণ এটাই জীবন। এখনও সব থেকে বড় সমস্যা আমার মা যা রাঁধতেন সবই হতো অমৃত। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও খুব ভালো রাঁধতে পারেন। তার মায়ের রান্নাও ছিল অসাধারণ। মায়ের অসাধারণ রান্নার কাছে স্ত্রীর হেলাফেলা কিছুটা অতৃপ্তির তো অবশ্যই সৃষ্টি করে। কিন্তু তবু স্ত্রী-পুত্র, পরিবার নিয়ে ৬৭ বছরের ২৮ বছর বিবাহিত জীবন মোটামুটি ভালোই কাটছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেদিন মানুষের কোনো কাজে লাগব না সেদিন যেন তিনি সুস্থ শরীরেই উঠিয়ে নেন। আর যতক্ষণ তার দয়ায় জীবন আছে ততক্ষণ যেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, সন্তান-সন্তুতি নিয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেকে উত্সর্গ করার তওফিক দেন। দেশবাসীর কাছে এই শুভদিনে মিনতি করি তারা যেন স্রষ্টার কাছে আমাদের জন্য একটু দয়ায় দোয়া করেন। আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন