বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

সাম্প্রতিক পুলিশি তৎপরতা ও কিছু পরামর্শ

আহমদ রফিক


সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যের ক্রিয়াকলাপ সংবাদপত্রের শিরোনাম ও প্রতিবেদনের বিষয় হয়ে উঠেছে। ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বাহিনীর নাম নষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। বৈঠকখানায়, আড্ডায় বা আলোচনায়- সর্বত্র এ বিষয়ে কথাবার্তা।
পুলিশ বাহিনীর ভালো-মন্দ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই একাত্তরের ঘটনাবলির কথা মনে পড়ে যায়। সেই ভয়াল ২৫ মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাতের পর রাজারবাগে ঘুমন্ত বাঙালি পুলিশের ওপর কী ভয়াবহ আক্রমণই না চালিয়েছিল ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানি সেনারা- কামান, ট্যাংক, মর্টার ও গোলাবারুদ নিয়ে। সংলগ্ন পাড়াগুলো ঘুম ভেঙে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল ত্রাসে ও আতঙ্কে। সে রাতে পুলিশ ব্যারাক-সংলগ্ন চামেলিবাগে চারজন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত পুলিশ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে ওই পাড়ায় আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় চেয়ে বিফল হয়নি। পুলিশের প্রতি মানুষের তখন এমনই সহানুভূতি।
সত্যি, একাত্তরে জনতা-পুলিশে আশ্চর্য সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল। কারণ তাদের ভাবনা ও যাত্রাপথ তখন অভিন্ন। একাত্তরের প্রতিরোধ-যুদ্ধে ও পরবর্তী পরিকল্পিত যুদ্ধে পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। সেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যবিশেষের কর্মকাণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশে এতটা বিতর্কিত হয়ে গেল কেন যে পুলিশ-জনসাধারণ সম্পর্ক অবিশ্বাস্য মাত্রায় পাল্টে গেল? এ পরিবর্তন তো হঠাৎ হয়নি। ধীরেসুস্থেই হয়েছে।
হয়েছে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সরকারি সর্বোচ্চ মহলের চোখের সামনে। কেউ বিষয়টায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না। নেপথ্যে নিহিত কারণ খুঁজে বের করে প্রতিকারের ব্যবস্থাও বোধ হয় নেওয়া হয়নি। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটত না। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যদের পক্ষে দেশপ্রেমিক সমাজসেবক বাহিনী হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। উচ্চস্তরে একাংশের কথা বাদ দিলে মাঠপর্যায়ে সব স্তরে তা হয়নি। পারস্পরিক সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিঃসন্দেহে দুঃজনক।
সেই সূত্রে অপ্রিয় হলেও বলতে হয় যে পুলিশ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জনমানসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ভয় ও বিরূপতার। এ বিষয়ে অতীতকালের একাধিক প্রবাদ স্মরণ করার মতো। এমনকি স্মর্তব্য অনৈতিকতার কথাও, যা মন্দ ঐতিহ্য হিসেবে ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমল থেকে চলে আসছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে ওই দূষিত ঐতিহ্য ভেঙে নব ঐতিহ্য সৃষ্টির চেষ্টা নেওয়া হয়েছে কি না জানি না। অথচ তেমন সুযোগ ছিল এবং তা করাও দরকার ছিল। যেমন- পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষস্তর, তেমনি সরকারি উচ্চমহল থেকে।
তাই প্রশ্ন- পুলিশের জনবিচ্ছিন্নতা দূর করে তাদের জনতাবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পেশাগত ও মানসিক প্রশিক্ষণের কোনো চেষ্টা হয়েছে কি? পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঠিক দিকনির্দেশনা ও মানবিক চেতনার মানসিক প্রশিক্ষণ তাদের জনসেবায় সাহায্য করার কথা। পরিবর্তে মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় যে ধরনের ঘটনা প্রকাশ পায়, তাতে রীতিমতো আঁৎকে উঠতে হয়। কেন এমন হলো?
এই তো কয়েক দিন আগের কথা। দৈনিক পত্রিকায় যেসব ঘটনা লাল কালিতে শিরোনাম হয়ে উঠেছে, তাতে মনে হবে না, পুলিশ বাহিনীর অংশবিশেষ ব্যক্তিক ও নাগরিক অধিকারের রক্ষক। প্রতিটি কাগজে প্রায় একই রকম শিরোনাম : 'পুলিশের বাড়াবাড়িতে বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি', 'বেপরোয়া পুলিশ, প্রশ্ন জবাবদিহি নিয়ে', 'আবারও সাংবাদিক পেটাল পুলিশ', 'পুলিশের নিষ্ঠুরতা, এ আচরণ কাম্য নয়' ইত্যাদি। এসব খবর সবই কি বাড়াবাড়ি?
বাস্তবিক জনাকয় পুলিশ সদস্যের আচরণে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পুলিশের এক সাবেক আইজিকে লিখতে হয়- 'অন্যায়কারী যেন ছাড় না পায়'। আরেক সাবেক আইজিপি লিখেছেন, 'কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়'।
ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে যে পুলিশ ও সাংবাদিক বা জনতার সম্পর্ক 'সহযোগিতা ও সহমর্মিতার'। হক কথা। এমন পারস্পরিকতার কথাই আমরা বরাবর বলে আসছি এবং দেখতে চেয়েছি।
বলে আসছি যে ইংরেজের তৈরি করা যে পুলিশি লাঠির আঘাত পড়েছে তৎকালীন স্বদেশিদের পিঠে, সেই লাঠিই দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানে বেধড়ক পিটিয়েছে বিরোধীপক্ষকে, আর পূর্ববঙ্গে বিশেষ করে প্রতিবাদী রাজনীতিক ও ভাষাসংগ্রামীদের। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে সে লাঠির একই রকম ব্যবহার চলেছে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় পথে নামা প্রতিবাদীদের ওপর এবং বিরোধী দলের ওপর। তাহলে বুঝে নিতে হয় গলদটা কোথায়? কারণ, এমনটা তো প্রত্যাশিত ছিল না এবং হওয়ার কথাও নয়।
তবে এটাও ঠিক যে গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি আগের সব মাত্রা অতিক্রম করে গেছে নির্মমতায় ও দায়িত্বহীনতায়। তা না হলে কাগজে এমন শিরোনাম ছাপা হবে কেন, যা পড়ে অবাক হতে হয় : 'ব্যবসায়ীকে খুনিদের হাতে তুলে দিল পুলিশ।' এমনকি এ প্রসঙ্গে একই সঙ্গে লেখা হয়েছে, 'হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের অবহেলার প্রমাণ পেয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হোসেন।' যদি ধরে নিই খবরে ভুল নেই, তাহলে এসব রীতিমতো ভাববার বিষয়।
স্বভাবতই প্রশ্ন অনেকটা প্রয়াত কবি আবুল হাসানের একটি পঙ্ক্তির মতো করে : একাত্তরের সেই মানবিক চেতনার পুলিশকে দেখি না কেন? দেখব কেমন করে, যখন শর্ষের মধ্যেই যত গণ্ডগোল। যখন নীতিনির্ধারক হাঁটতে চাইছেন শাপগ্রস্ত ঔপনিবেশিক সময়ের দিকে। একাত্তরের স্বদেশচেতনা কাজে লাগাতে, বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী নন তারা। তা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে বা দুর্নীতি দমনে কিংবা স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবহেলায়?
জনসেবায় যদি দলীয় চেতনা প্রাধান্য পায়, প্রশাসন যদি তেমন পথ অনুসরণ করে, তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রশাসনের কোনো শাখা থেকেই কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা বড় একটা থাকে না। পুলিশ বিভাগও এই ঘোরচক্রের বাইরে নয়। এ চক্রের টানে তাদের ঘুরতে হয়। অনেক সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘুরতে হয়। শেষ পর্যন্ত এভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া- তা যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন? তাদের ইচ্ছা পূরণে পথ চলা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের, অপরাধ দমনের কর্তাদের কিংবা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মনে হয় উল্লিখিত ছকে বাঁধা অবস্থানই এক অমোঘ নিয়তি। স্বভাবতই তারা, বিশেষ করে দলনিরপেক্ষ মানসিকতার কর্মকর্তারা নীতির সংকটে আক্রান্ত হতে বাধ্য। বলা চলে, এক ধরনের উভয় সংকট। সংকট আত্মদ্বন্দ্বের এবং নীতিনৈতিকতার- বিশেষ করে আদেশ মানা-না মানা নিয়ে।
পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার যে সংকট তৈরি করে, তার প্রমাণ তো বিগত সরকার আমলের অস্ত্র ধরা-মামলা, সে জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তারক্ষক বাহিনীর জনাকয় শীর্ষ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন মহাসংকটে। এ সংকট মূলত তাদের সৃষ্ট নয়। এর দায় রাজনীতির- যে রাজনীতি দেশের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে।
আলোচনা সংক্ষেপের প্রয়োজনে ঘুষ বা দুর্নীতি সম্বন্ধে বলি : দুর্নীতি কোন খাতে নেই, কম আর বেশি? একা পুলিশ বিভাগকে দোষ দিয়ে কী হবে? তা ছাড়া দুর্নীতিরোধে শিকড় ঘেঁষা বাস্তব প্রতিকারের ব্যবস্থা কি আদৌ নেওয়া হয়েছে? ৯ জুন একটি দৈনিকে জনৈক সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তার 'অবৈধ আয়ের' যে স্বীকারোক্তি, তা সমাজ বাস্তবতার প্রকাশ ঘটিয়েছে- তাতে ব্যক্তিবিশেষের জীবনযাপনের অসহায়তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ হচ্ছে অপ্রিয় এক সামাজিক সত্য। শুধু পুলিশ বিভাগ বলে নয়, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক বিভাগের কর্মকর্তাদের এই জৈবনিক বাস্তবতার কথা অনেক বৈঠকে আলোচিত হতে শুনেছি। অপ্রিয় তথ্যগুলো উদ্ধৃত না করে শুধু পরামর্শ হিসেবে বলব, আপাতত আলোচ্য পুলিশ বিভাগ সম্বন্ধেই বলব যে বাজেট সমস্যার কথা মাথায় রেখেও মধ্য ও নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য সুবিধার ইতিবাচক সংশোধন অতীব জরুরি। জরুরি বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বাজারদর বিবেচনায়।
সেই সঙ্গে জরুরি গোটা পুলিশ বাহিনীর পেশাগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আদর্শিক প্রশিক্ষণ। দরকার সাংস্কৃতিক দিক থেকে স্বদেশ চেতনায় চিত্ত পরিশীলিত করে তোলার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। এ কাজ যথাযথভাবে করা গেলে বাংলাদেশ পেতে পারে বর্তমান অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার, জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী, যা হতে পারে জাতির জন্য সম্পদ। এতে জাতি ও রাষ্ট্র লাভবান হতে পারে। এর ফলে পুলিশ-জনতার সুসম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব। তখন পুলিশ মানেই ভয় নয়, পুলিশ মানেই 'ছাপ্পান্ন ঘা' নয়, পুলিশ মানে দুর্গত জনগণের সহায়।
সব শেষে পুলিশকে আদর্শ প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনীতে পরিণত করার উপযোগী একটি ভাবনার কথা বলি, অস্বাভাবিক শোনালেও বলি। পুলিশকে জনসেবার উপযোগী করে তুলতে সেনাবাহিনীর মতো কঠোর নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোয় এদের নিয়ে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কি অবাস্তব পরিকল্পনা মনে হবে? উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বর্তমান মূল্যস্ফীতির হিসাব মাথায় রেখে যথাযথ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুপ্রশিক্ষিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ পুলিশ বাহিনী গঠন কি একেবারে অসম্ভব?
তাদের জীবিকার সঙ্গে জীবনযাত্রার সংগতি বিধান করে সচ্ছলতা নিশ্চিত করা ও আদর্শিক প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে কর্তব্য সম্পাদন তাদের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি কর্তব্যে অবহেলা বা অন্যায়ের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখাও জরুরি। এখনকার মতো প্রত্যাহার বা সাময়িক অব্যাহতি সংশোধনের উপযোগী কোনো বিধান নয়। এতে অপকর্মে উৎসাহ বাড়ে। সে জন্য পুলিশ বাহিনীতে অন্যায়, কর্তব্যে অবহেলা, এমনকি অপরাধমূলক তৎপরতা বেড়ে চলেছে, ঘুষ দুর্নীতিও তাই, যা অর্থমন্ত্রীকে উচ্চকণ্ঠে বলতে শোনা গেছে। এ ঘটনা সরকারের জন্য, পুলিশের শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য লজ্জাকর।
তাই পুলিশ বাহিনীকে জনসেবায় সংগঠিত করে তোলার পক্ষে ওপরে উল্লিখিত পরামর্শগুলো সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও সরকারপ্রধানকে ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক : কবি, ভাষা সৈনিক ও গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন