সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ১৯-০৬-২০১২
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অতুলনীয় উপন্যাসটির নাম কাঁদো নদী কাঁদো। বাংলার মানুষের চেতনাপ্রবাহ রীতিতে উপন্যাস লেখার ক্ষমতা থাকলে তারা লিখত ‘কাঁদো কবি কাঁদো’।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে ছোটখাটো কবি ছিলেন না। সুখ-দুঃখের বহু রকমের কবিতাই লিখেছেন। চোখের সামনে একের পর এক প্রিয়জন চলে গেছে। দুঃখের গানও লিখেছেন অনেক। মহর্ষিপুত্র নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন অন্যকে। অন্যরাও তাঁর পদ্য আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন তাঁকে। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা ও গান শুনে কাঁদেননি। যদি একবার কোনো রকমে কাঁদতেন, তা হলেই হয়েছিল! সেই কান্নার পটভূমি, কবার রুমালে চোখ মুছেছেন এবং সেই কান্নার তাৎপর্য বাঙালির জীবনে কতটা—প্রভৃতি নিয়ে হতো গবেষণা। এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশে যে ২৫০টির মতো বই বেরিয়েছে সেখানে যোগ হতো আর একখানা, যার শিরোনাম হতো: ‘রবীন্দ্রকান্নার বহুমাত্রিকতা’ অথবা ‘রবীন্দ্রনাথের কান্না ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা’। কিন্তু দূরদর্শী কবি কাঁদেননি, তাই ওই বিষয়ে বই পড়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঙালি বেঁচে গেছে।
কিন্তু যা কখনো আগে হয়নি, বাঙালির জীবনে তা এই কলি কালে ঘটবে না, বাঙালি তেমন জাতিই নয়, চর্যাপদের পর থেকে হাজার বছরের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে গত বুধবারই প্রথম কোনো কবি নিজের কবিতা আবৃত্তি শুনে কাঁদলেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘অনুষ্ঠানে কারাবাসের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তির সিডি বাজানোর একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন এরশাদ। চোখ মুছে বক্তব্য দিতে আসেন মঞ্চে। তিনি বলেন, ছয় বছর কারাবাসের পর নিজের বাড়ির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতাটি লিখেছেন।’ আম, আতাফল বা বরইগাছ নয়; ওই কবির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতা লেখা খুবই অর্থবহ।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছাতিমগাছের তলায় বসে কিছু গান-টান লিখেছেন। কাজী ফকির আহমদের পাগল ছেলেটির মাথার ওপর কোনো গাছপালার ছায়া ছিল না। রাস্তাঘাটে যেখানেই বসেছেন, সেখানেই লিখে ফেলেছেন কবিতা, আর হো হো করে হেসেছেন। আমাদের কবির মতো কাজীপুত্রও কারাগারে গেছেন এবং লিখেছেন: ‘কারার ওই লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট...’। তাঁর কবিতা শুনে তিনি নিজে বা অন্য কেউ কাঁদেনি। কিন্তু তাদের রক্তে আগুন লেগে গেছে।
যে কবি নিজের কবিতা শুনে কাঁদেন, তিনি চাট্টিখানি কবি নন। বিরাট কবি বাল্মীকি কাঁদেননি। মহাকবি কালিদাস তাঁর নিজের কবিতা শুনে কাঁদেননি। মহাকবি ফেরদৌসির শাহনামায় কাঁদার মতো কাহিনি বহু আছে। তা পাঠ করে চোখের পানি ফেলেছেন কেউ কেউ। কবি নিজে কাঁদেননি।
কাঁদো নদী কাঁদোর কাহিনি গড়ে উঠেছে বাঁকাল নদী ও কুমুরডাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। ‘বাঁকাল নদীতে চড়া পড়ার জন্যে আর স্টিমার আসবে না।’ চড়ার কথাটা প্রথমে শহরের প্রভাবশালী উকিল কফিলউদ্দিনও বিশ্বাস করে না, তার প্রশ্ন: ‘কোথায় চড়া পড়েছে, কেই বা বলেছে চড়া পড়েছে?’ আসলে কি গল্প-উপন্যাসে, কি বাস্তব জীবনে নেতৃত্বস্থানীয়রা কোনো অমঙ্গলের কথাই বিশ্বাস করেন না।
এর মধ্যে বিপত্তি ঘটায় মোক্তার মোসলেহউদ্দিনের মেয়ে সখিনা। সে ‘একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়’ নদীর ভেতর থেকে। কুমুরডাঙ্গা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহর কথাই হুবহু উদ্ধৃতি করি: ‘কুমুরডাঙ্গার লোকেরা এমনই হিংসুটে এবং নীচমনা যে নিজের নাক কেটেও পরের ক্ষতি করতে তারা সদা প্রস্তুত। অবশ্য কুমুরডাঙ্গার আর্থিক অবস্থাটা ভালো নয়,...রাহাজানি, খুনখারাবী, নারী ধর্ষণ এসবের মতো দারিদ্র্যও নৈতিক অবনতির একটি লক্ষণ। [শহরবাসী ভাবে]...ভয়ঙ্কর বিপদ গুটিগুটিপায়ে কুমুরডাঙ্গার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন কোনো মহামারী যা সমগ্র শহর উজাড় করে দেবে? বা কোনো মহাপ্লাবন যা দুরন্তবেগে ছুটে এসে মানুষের ঘরবাড়ি গোলাঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? অথবা কোনো প্রচণ্ড ভূমিকম্প যা নিমিষের মধ্যে পায়ের নিচের শক্ত জমিকে বিশালকায় কোনো জন্তুর মুখগহ্বরে পরিণত করবে?’
বাঁকাল নদী আর কুমুরডাঙ্গা আজকের বাংলাদেশের প্রতীক। বাংলার বুক থেকে মধ্যরাতে একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। কুমুরডাঙ্গার মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষের মনেও অজানা আশঙ্কা। কখন কী ঘটে! চেতনার নদীতে চড়া। জনজীবনে নীরব কান্নার আওয়াজ। সখিনার মতো হতভাগিনীরা সে কান্না শোনে। নেতারা বিশ্বাস করেন না। কারণ, তাঁরা নিজের কানে কোনো কান্নার আওয়াজ শোনেননি। কবি ও রাষ্ট্রপতি কাঁদেন নিজের মনের দুঃখে। দেশের দুঃখে চোখে পানি আসে না।
ওই কবিতাপাঠের আসরে শেষ কথা কান্না নয়। খুশির কথাও ছিল। সেটি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম নয়, দ্বিতীয় ঘটনা। অমন ঘটনা প্রথম ঘটে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের জীবনে। তাঁর প্রিয় পুত্র হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায়। তিনি তাঁর শয্যার চতুর্দিকে পায়চারি করতেন আর প্রার্থনা করতেন: হে খোদা, আমাকে তুমি নিয়ে যাও, আমার অবশিষ্ট আয়ু হুমায়ুনকে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলো। শিগগিরই বাবর শয্যা গ্রহণ করেন এবং মারা যান। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের পরমায়ু ৩৩১ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ করেন।
সেদিনের কবিতাপাঠের আসরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব কবিতা শুনে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের সবার কাছ থেকে আয়ু নিয়ে আমার নেতার আয়ু বাড়িয়ে দাও।’
ওই মোনাজাতের পরে আসুন আমরা সবাই বলি: আমিন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অতুলনীয় উপন্যাসটির নাম কাঁদো নদী কাঁদো। বাংলার মানুষের চেতনাপ্রবাহ রীতিতে উপন্যাস লেখার ক্ষমতা থাকলে তারা লিখত ‘কাঁদো কবি কাঁদো’।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে ছোটখাটো কবি ছিলেন না। সুখ-দুঃখের বহু রকমের কবিতাই লিখেছেন। চোখের সামনে একের পর এক প্রিয়জন চলে গেছে। দুঃখের গানও লিখেছেন অনেক। মহর্ষিপুত্র নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন অন্যকে। অন্যরাও তাঁর পদ্য আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন তাঁকে। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা ও গান শুনে কাঁদেননি। যদি একবার কোনো রকমে কাঁদতেন, তা হলেই হয়েছিল! সেই কান্নার পটভূমি, কবার রুমালে চোখ মুছেছেন এবং সেই কান্নার তাৎপর্য বাঙালির জীবনে কতটা—প্রভৃতি নিয়ে হতো গবেষণা। এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশে যে ২৫০টির মতো বই বেরিয়েছে সেখানে যোগ হতো আর একখানা, যার শিরোনাম হতো: ‘রবীন্দ্রকান্নার বহুমাত্রিকতা’ অথবা ‘রবীন্দ্রনাথের কান্না ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা’। কিন্তু দূরদর্শী কবি কাঁদেননি, তাই ওই বিষয়ে বই পড়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঙালি বেঁচে গেছে।
কিন্তু যা কখনো আগে হয়নি, বাঙালির জীবনে তা এই কলি কালে ঘটবে না, বাঙালি তেমন জাতিই নয়, চর্যাপদের পর থেকে হাজার বছরের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে গত বুধবারই প্রথম কোনো কবি নিজের কবিতা আবৃত্তি শুনে কাঁদলেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘অনুষ্ঠানে কারাবাসের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তির সিডি বাজানোর একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন এরশাদ। চোখ মুছে বক্তব্য দিতে আসেন মঞ্চে। তিনি বলেন, ছয় বছর কারাবাসের পর নিজের বাড়ির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতাটি লিখেছেন।’ আম, আতাফল বা বরইগাছ নয়; ওই কবির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতা লেখা খুবই অর্থবহ।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছাতিমগাছের তলায় বসে কিছু গান-টান লিখেছেন। কাজী ফকির আহমদের পাগল ছেলেটির মাথার ওপর কোনো গাছপালার ছায়া ছিল না। রাস্তাঘাটে যেখানেই বসেছেন, সেখানেই লিখে ফেলেছেন কবিতা, আর হো হো করে হেসেছেন। আমাদের কবির মতো কাজীপুত্রও কারাগারে গেছেন এবং লিখেছেন: ‘কারার ওই লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট...’। তাঁর কবিতা শুনে তিনি নিজে বা অন্য কেউ কাঁদেনি। কিন্তু তাদের রক্তে আগুন লেগে গেছে।
যে কবি নিজের কবিতা শুনে কাঁদেন, তিনি চাট্টিখানি কবি নন। বিরাট কবি বাল্মীকি কাঁদেননি। মহাকবি কালিদাস তাঁর নিজের কবিতা শুনে কাঁদেননি। মহাকবি ফেরদৌসির শাহনামায় কাঁদার মতো কাহিনি বহু আছে। তা পাঠ করে চোখের পানি ফেলেছেন কেউ কেউ। কবি নিজে কাঁদেননি।
কাঁদো নদী কাঁদোর কাহিনি গড়ে উঠেছে বাঁকাল নদী ও কুমুরডাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। ‘বাঁকাল নদীতে চড়া পড়ার জন্যে আর স্টিমার আসবে না।’ চড়ার কথাটা প্রথমে শহরের প্রভাবশালী উকিল কফিলউদ্দিনও বিশ্বাস করে না, তার প্রশ্ন: ‘কোথায় চড়া পড়েছে, কেই বা বলেছে চড়া পড়েছে?’ আসলে কি গল্প-উপন্যাসে, কি বাস্তব জীবনে নেতৃত্বস্থানীয়রা কোনো অমঙ্গলের কথাই বিশ্বাস করেন না।
এর মধ্যে বিপত্তি ঘটায় মোক্তার মোসলেহউদ্দিনের মেয়ে সখিনা। সে ‘একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়’ নদীর ভেতর থেকে। কুমুরডাঙ্গা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহর কথাই হুবহু উদ্ধৃতি করি: ‘কুমুরডাঙ্গার লোকেরা এমনই হিংসুটে এবং নীচমনা যে নিজের নাক কেটেও পরের ক্ষতি করতে তারা সদা প্রস্তুত। অবশ্য কুমুরডাঙ্গার আর্থিক অবস্থাটা ভালো নয়,...রাহাজানি, খুনখারাবী, নারী ধর্ষণ এসবের মতো দারিদ্র্যও নৈতিক অবনতির একটি লক্ষণ। [শহরবাসী ভাবে]...ভয়ঙ্কর বিপদ গুটিগুটিপায়ে কুমুরডাঙ্গার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন কোনো মহামারী যা সমগ্র শহর উজাড় করে দেবে? বা কোনো মহাপ্লাবন যা দুরন্তবেগে ছুটে এসে মানুষের ঘরবাড়ি গোলাঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? অথবা কোনো প্রচণ্ড ভূমিকম্প যা নিমিষের মধ্যে পায়ের নিচের শক্ত জমিকে বিশালকায় কোনো জন্তুর মুখগহ্বরে পরিণত করবে?’
বাঁকাল নদী আর কুমুরডাঙ্গা আজকের বাংলাদেশের প্রতীক। বাংলার বুক থেকে মধ্যরাতে একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। কুমুরডাঙ্গার মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষের মনেও অজানা আশঙ্কা। কখন কী ঘটে! চেতনার নদীতে চড়া। জনজীবনে নীরব কান্নার আওয়াজ। সখিনার মতো হতভাগিনীরা সে কান্না শোনে। নেতারা বিশ্বাস করেন না। কারণ, তাঁরা নিজের কানে কোনো কান্নার আওয়াজ শোনেননি। কবি ও রাষ্ট্রপতি কাঁদেন নিজের মনের দুঃখে। দেশের দুঃখে চোখে পানি আসে না।
ওই কবিতাপাঠের আসরে শেষ কথা কান্না নয়। খুশির কথাও ছিল। সেটি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম নয়, দ্বিতীয় ঘটনা। অমন ঘটনা প্রথম ঘটে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের জীবনে। তাঁর প্রিয় পুত্র হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায়। তিনি তাঁর শয্যার চতুর্দিকে পায়চারি করতেন আর প্রার্থনা করতেন: হে খোদা, আমাকে তুমি নিয়ে যাও, আমার অবশিষ্ট আয়ু হুমায়ুনকে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলো। শিগগিরই বাবর শয্যা গ্রহণ করেন এবং মারা যান। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের পরমায়ু ৩৩১ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ করেন।
সেদিনের কবিতাপাঠের আসরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব কবিতা শুনে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের সবার কাছ থেকে আয়ু নিয়ে আমার নেতার আয়ু বাড়িয়ে দাও।’
ওই মোনাজাতের পরে আসুন আমরা সবাই বলি: আমিন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন