বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০

করোনাকালে খাদ্য



আখতার আহমেদ ।এই বছরটা দেশের খাদ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে চিন্তা করলে পরিস্থিতি বেশ ভালোই ছিল। দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় মৌসুম হচ্ছে বোরো ধানের মৌসুম। এর বড় অংশ কৃষকের গোলায় উঠে গেছে। গম, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের মতো আমদানি-নির্ভর পণ্যগুলোর আপাতত কোনো সংকট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দেশের খাদ্য পরিস্থিতির সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বিষয় এখন বিতরণ ও সরকারি মজুত ব্যবস্থাপনাকে ঠিক রাখা। দেশের বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা এখন বড় চিন্তার বিষয়। ব্র্যাক ও পিপিআরসির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় আমরা দেখলাম, দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা করোনার কারণে দ্বিগুণ হয়েছে। আগে থেকে যারা গরিব ছিল, তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে করোনার কারণে গরিব মানুষের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব।
গরিব মানুষদের সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা দিয়ে থাকে। করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে থাকা শহরের বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষ, অনানুষ্ঠানিক হাতের ওপর প্রধানত যাদের জীবিকা নির্ভরশীল, যাদের বড় অংশ বস্তি ও উন্মুক্ত স্থানে বসবাস করে। এসব মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যসহায়তা দেওয়া দরকার। এদের মধ্যে অল্প টাকায় হলেও চাল-গম বিক্রি করতে গেলে নানা সমস্যা দেখা দেবে। আবার তালিকা করে দিতে গেলে সেই তালিকা সঠিক হলো কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। সঠিক লোক খাবার পাবে কি না, সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। ফলে আমার পরামর্শ হচ্ছে, এসব গরিব মানুষের বসতি এলাকা, অর্থাৎ বস্তি এলাকায় বিনা মূল্যে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। পাক্ষিক বা মাস ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তাদের কাছে দ্রুত খাবার পৌঁছানো দরকার।
গ্রামে যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিব মানুষকে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া হয়, সেগুলোর সবই যে খুব কার্যকর, তা কিন্তু নয়। এসব কর্মসূচি যেসব তালিকার ভিত্তিতে হয়, তা নিয়েও নানা ধরনের সমস্যা আছে। তবে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, সরকারের কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষদের যে তালিকাটি হয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে সঠিক। সেই তালিকা ধরে গ্রামীণ দরিদ্রদেরও দ্রুত খাদ্যসহায়তা দেওয়া উচিত।
সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর বিস্কুট দেওয়া হতো। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় সেটি আর দেওয়া যাচ্ছে না। তবে শুনেছি ওই বিস্কুট মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি একটি ভালো ও কার্যকর উদ্যোগ বলে মনে করছি। সারা দেশে ওই বিস্কুট পৌঁছে দিলে এই সময়ে মানুষের পুষ্টির যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে এই খাবার দেশের সব গরিবের মধ্যে দেওয়া গেলে ভালো হয়।
সরকারকে খাদ্য বিতরণব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি খাদ্য মজুত পরিস্থিতির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সরকার নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেভাবে চাল-গম বিতরণ করছে, তাতে মজুতে দ্রুত টান পড়বে। সে জন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে চাল দরকার হবে। এই চাল কোথা থেকে আসবে, তা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। সরকার এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে সেই সংগ্রহ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। শুনেছি সম্প্রতি সংগ্রহের গতি কিছুটা ধীর হয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মানুষের মধ্যে চাল-গম বিতরণ বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাল-গম সংগ্রহ না হলে দেশে খাদ্য নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। ফলে সংগ্রহ বাড়াতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা ও মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল কেনার পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে চাল কেনার ব্যবস্থা করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দ্রুত চাল কেনা সম্ভব না-ও হতে পারে। আর করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম ও সরবরাহব্যবস্থা কেমন দাঁড়ায়, তা-ও বলা যাচ্ছে না। তাই দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকেই দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহের জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি রাখতে হবে।
করোনার মাঠপর্যায়ে সবজি, পোলট্রি মুরগি ও মাছের বিপণনের যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। একদিকে উৎপাদন হচ্ছে আর অন্যদিকে ভোক্তারা তা সঠিক দামে পাচ্ছেন না। অর্থনীতির ভাষায় একে আমরা বলি মার্কেট ফেইলর বা বাজারের ব্যর্থতা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার হয়। সরকার সবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য পরিবহনের ব্যাপারে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু এই উদ্যোগ আরও বড় এবং বিস্তৃতভাবে নেওয়া উচিত। সরকারের তত্ত্বাবধানে কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদকদের কাছ থেকে নিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ট্রাক, বাস, রেল, নৌযানসহ সব যানবাহনে বিশেষ ব্যবস্থাপনা দ্রুত তৈরি করা উচিত। নয়তো তা একই সঙ্গে দেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লেখক: কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮

কার পক্ষ নেবেন তরুণ ভোটাররা?

নির্বাচন ২০১৮

নির্বাচন কমিশন ভবননির্বাচন কমিশন ভবনসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফোরাম আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর মতে, ২০১৮ সালে এসে বিএনপির ভোট ৩০ শতাংশ আর আওয়ামী লীগের ভোট ৪২ শতাংশ হয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষা আছে বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা। কিন্তু তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের যে হিসাব দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।
একজন মাঠের রাজনীতিক কথাগুলো বললে বিস্মিত হতাম না। তাঁরা নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে অনেক কথা বলে থাকেন। কিন্তু এইচ টি ইমাম তো প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের একজন থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত। তাঁর অঙ্ক ভুল হলে দলের নির্বাচনী হিসাবও উল্টে যেতে পারে।
এইচ টি ইমাম বলেছেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির ভোট ৩০ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ দেশের এবং জনগণের উন্নয়ন করার কারণে ভোট বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। অথচ বিগত চারটি নির্বাচনের রেকর্ড ভিন্ন কথা বলে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩০.৮ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১ শতাংশ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির ভোট কিছুটা হলেও বেশি। ওই নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ ৮৮টি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আসন ছিল ১৪৬টি এবং বিএনপির ১১৬টি। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এটাই ছিল তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ ফল। পরবর্তী দুটি নির্বাচনের ফলাফলে দুই দলের আসনে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১.৪০ শতাংশ ভোট নিয়ে ১৯৩টি আসন পায়। আর আওয়ামী লীগ ৪০.০২ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯.০ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় ২৩০টি। অন্যদিকে বিএনপি ৩৩.২ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। দুটো নির্বাচনেই ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। এইচ টি ইমামের দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ভোট যদি বেড়েই থাকে, তাহলে ২০০৮ সালের ৪৯ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে দাঁড়াল কেন?
উল্লিখিত চারটি নির্বাচনের ময়নাতদন্ত করলে দেখা যাবে, কখনো আওয়ামী লীগ বা কখনো বিএনপি বেশি ভোট পেয়েছে। সব নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ ভোট বেশি পেয়েছে, এইচ টি ইমামের এই তথ্য মোটেই ঠিক নয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোটের ব্যবধান সামান্য হলেও বিএনপিই এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপি প্রায় ৪ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে ছিল। আবার ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের একক নির্বাচনের বিপরীতে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে বিএনপি অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল। ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে সামান্য পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আসন পায় মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালে ঠিক বিপরীত ঘটনাই ঘটে। বিএনপির আসন নেমে আসে ৩০-এ। এর থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে ভোট কোনো দলের স্থায়ী আমানত নয়। মানুষ দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেন কাজের মূল্যায়ন করে।
২০০১-এর নির্বাচনের পরই আওয়ামী লীগের বোধোদয় ঘটে যে এককভাবে নির্বাচন করে আর জয়ী হওয়া যাবে না। তারা ১৪-দলীয় জোটের পরিসর বাড়িয়ে মহাজোট করে, যার শরিক ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, অলি আহমদের এলডিপি। বিএনপির গোঁয়ার্তুমির জন্য ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনটি বানচাল না হলে হয়তো আজ তারা একই ছাতার নিচে থাকত। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন যতই তাদের ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির জোট’ বলে বিদ্রূপ করুন না কেন, তখন তারাই ছিল আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকারও করেছিলেন তাঁরা। ২০০৭ সালে নির্বাচনটি হলে ধারণা করি, কোনো দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেত না এবং আদালতের রায় সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য, আদালত সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করতে বলেননি। বলেছিলেন, যদি জনপ্রতিনিধিরা রাজি থাকেন, আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি নেতারা যতই হা-হুতাশ করুন না কেন, এই ব্যবস্থা বাতিলের দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না।      
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে দুর্বল না ভাবা, নেতা-কর্মীতদের আত্মতুষ্টিতে না ভোগার যে সদুপদেশ দিয়েছেন, সেটি তারা কতটা আমলে নেবেন, তার ওপরও নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা নির্ভর করবে। আত্মতুষ্টিতে ভুগলে হাতের নাগালে থাকা বিজয় যে কীভাবে হাতছাড়া হয়ে যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনই তার প্রমাণ। ভোটের আগেই আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ পোর্টফোলিও ভাগাভাগিতে ব্যস্ত ছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
এইচ টি ইমাম বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনে নবীন ভোটার বেশি। এই নবীন ভোটাররা বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম সম্পর্কে জানেন না। এই বিষয়গুলো নবীনদের কাছে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে দলের প্রচারের বিষয়ে তিনি আক্রমণাত্মক হতে বলেছেন।’
৩১ জানুয়ারি ২০১৮–এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ১০৫ আর নারী ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৬ জন। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিলেন ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন। ২০০৮ সালে ছিলেন ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার। অর্থাৎ গত ১০ বছরে তরুণ ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ। আগামী নির্বাচনে এরাই জয়-পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। তরুণদের ভোট যঁারা বেশি পাবেন, তঁারা জয়ী হবেন।
এইচ টি ইমাম দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি নতুন ভোটারদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম তুলে ধরার কথা বলেছেন (জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় তারা দলগতভাবে নির্বাচন করতে পারবে না) কিন্তু বিএনপি ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে দেশে যেসব অনাচার-দুর্নীতি ও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার দায় বিএনপির ওপর চাপানো যাবে না। অতীতে বিএনপি কী কী অনাচার করেছে, আর বর্তমান সরকারের আমলে কী কী অনাচার হচ্ছে, ভোটাররা সেটাই তুলনা করে দেখবেন। ক্ষমতাসীনেরা আক্রমণাত্মক প্রচার চালিয়ে জয়ী হয়েছে, এমন নজির বাংলাদেশে নেই।
এইচ টি ইমামের কথামতে, এত প্রচার, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও জনসভায় বুলন্দ আওয়াজের পরও যদি নবীন ভোটাররা বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম সম্পর্কে না জানেন, সেটি সরকারের চরম ব্যর্থতা। নির্বাচনী প্রচারে ভোটাররা প্রার্থীদের কাছে অন্যের গিবত শুনতে চান না। তাঁরা দেখতে চান, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানে সরকার কী করেছে? এই যে নিরাপদ সড়ক নিয়ে এত বড় আন্দোলন হলো, তারপরও কি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে? না এসে থাকলে সেই দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপালে ভোটাররা কি মেনে নেবেন? নেবেন না।
আর নতুন ভোটাররা যা জানতে চাইবেন, তা হলো গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছে? সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে? সুশাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা গুম-খুন, মিথ্যা মামলা বন্ধ হয়েছে কি না? প্রতিবছর যে ২০-২২ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, সরকার তাঁদের কতজনকে চাকরি দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিল, এর কতজন চাকরি পেয়েছেন? যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা কি মেধার জোরে পেয়েছেন, না টাকার বিনিময়ে? তাঁরা জানতে চাইবেন, কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে কতজন তরুণ জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন? সরকার কোটা বাতিল করে তাঁদের দাবির ন্যায্যতাই প্রমাণ করেছে। তারপরও কেন আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা হলো? কেনইবা আন্দোলনকারীদের জেলে যেতে হলো? তাঁরা জানতে চাইবেন, স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর কেন ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন? আমরা বিভিন্ন স্থানে দেখেছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও পুলিশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিল, কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু ছাত্রলীগকে মাঠে নামাতেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গুজব ডালপালা মেলে। দুটো ঘটনাই সরকার অনেকটা হটকারী কায়দায় মোকাবিলা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু সড়ক নয়, ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ দাবি তুলেছে। বিএনপির অতীত অপকর্মের ফিরিস্তি
কিংবা উন্নয়নের বয়ান তরুণদের আকৃষ্ট করবে বলে মনে হয় না। নবীন ভোটাররা তাঁদের পক্ষেই রায় দেবেন, যঁারা সত্যিকারভাবেই রাষ্ট্রের মেরামত কাজটি করবেন।
সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com

শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

ক্ষমতা হস্তান্তর যেভাবে সম্ভব : টনি বেনের বাণী


শফিক রেহমান
৪ মে ২০১৪, রবিবার, ৫:০৬

শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত কোনো ক্যু সফল হবে না। তাই ক্যু সফল করতে হলে শেখ হাসিনার কাছে পৌছাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন (গণভবন) যে গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে তারা শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বস্ত। এই গার্ডরা ভেতরে কাউকেই কোনোভাবেই ঢুকতে দেবে না। তাছাড়া, আমি মনে করি, কোনো ক্যু-র প্রচেষ্টা এত রক্তক্ষয়ী হবে যে, সেই ঝুকি নেওয়ার মতো কোনো অফিসার নেই। আমি আপনাকে বলতে পারি যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। সেটা হতে পারে শুধুমাত্র আমাদের লাশের ওপর দিয়ে।
-ঢাকায় ইনডিয়ান সাংবাদিক দেবদীপ পুরোহিতকে দেওয়া সজীব ওয়াজেদ জয়-এর ইন্টারভিউয়ের একাংশ যা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ২৪ নভেম্বর ২০১৩-তে।
To have a successful coup, you will have to physically get Sheikh Hasina to hand over power. The guards guarding this house (Gano Bhaban, the official residence of the Prime Minister) are faithful to Sheikh Hasina. There is no way the guards will allow anybody to step in.
Besides, any (coup) attempt will be so bloody that I dont think there is any group of officers inclined to take that risk. I can tell you that Sheikh Hasina will not hand over power. It can only happen over our dead bodies.
-Sajib Wazed Joy, in an interview taken by Devadeep Purohit in Dhaka and published in the Telegraph, Calcutta, India on 24 November 2013..

বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) তার চূড়ান্ত মতামত মুজিব কাকুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সায়ীদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি মুজিব কাকুকে ফোন করে বলেছিলেন, আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই... বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সবসময়ে, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্র শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।... বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর কোজিং অল দি ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশন (...আপনার অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আপনাকে সরিয়ে দেওয়ার সব দরজাই আপনি এই পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন)।
-শারমিন আহমদ : তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা (পৃষ্ঠা ১৯১-১৯২)

ক্ষমতাসীনকে প্রশ্ন করুন, কিভাবে আপনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং কিভাবে আমরা আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারি? রাজনীতিতে এই দুটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
- টনি বেন
টনি বেন কে ছিলেন এই প্রশ্নটির উত্তর হয়তো বাংলাদেশের অনেকেরই জানা নেই।
বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে বৃটেনের বামপন্থী রাজনীতিতে টনি বেন ছিলেন একজন প্রধান নেতা যার ওপর অনেক সময়ে নির্ভর করতো লেবার পার্টির সাফল্য এবং ব্যর্থতা। প্রতিপক্ষ টোরি বা কনজারভেটিভ পার্টি দ্বারা তিনি যেমন সমালোচিত হতেন, ঠিক তেমনি তার নিজের লেবার পার্টির মধ্যেও তিনি বিতর্কিত হতেন। কিন্তু দুটি দলই স্বীকার করতে বাধ্য হতো টনি বেনের ভূমিকা অনেক সময়ে ছিল দলের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থে। তাই টনি বেন ছিলেন নিজেই একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
টনি বেনের এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর, গভীর আত্মবিশ্বাস এবং ধূমায়িত পাইপ হাতে মগে চা খাওয়া।
১৪ মার্চ ২০১৪-তে টনি বেন ৮৮ বছর বয়সে পরলোক গমন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী টোরি পার্টির নেত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো তিনি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। নিজের পার্টি, লেবার পার্টির পক্ষ থেকে তিনি কখনো পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারেন নি। তবে তিনি একবার লেবার পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু টনি বেন ১৯৫০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ১৬ বার পার্লামেন্টের সদস্য বা এমপি নির্বাচিত হন। লেবার পার্টির মধ্যে সর্বাধিকবার নির্বাচিত হবার রেকর্ড তারই।
রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত
তার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ সম্মান জানানোর প্রস্তাব ওঠে। এ নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কারণ মার্গারেট থ্যাচার নিজের মৃত্যুর আগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়। তার সেই অনুরোধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু টনি বেন, যিনি শাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন, তিনি নিজের মৃত্যুর আগে এই ধরনের জাকজমক ভরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোনো অনুরোধ করে যান নি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে করার জন্য অনুমতি নিতে হয় বৃটিশ রানীর। কিন্তু বেন ছিলেন বৃটেনে রাজতন্ত্র অবসানের পক্ষপাতী।
এই প্রেক্ষিতে বৃটিশ জনগণ আশ্চর্য হয়ে যায় যখন জানা গেল বর্তমানে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে টনি বেনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষ বিদায় দেওয়ার জন্য এবং রানী এলিজাবেথও তার অনুমতি দিয়েছেন। কিছু কট্টর ডানপন্থী টোরি এবং কিছু কট্টর বামপন্থী লেবার নেতাকর্মীরা মৃদু সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত টনি বেনের মরদেহ এনে রাখা হয় বৃটিশ পার্লামেন্টের নিজস্ব গির্জা সেইন্ট মেরি আন্ডারক্রফটে। একটি উচু টেবিলে তার কফিন ঢাকা হয় বৃটিশ পতাকা দিয়ে এবং তার ওপর রাখা হয় ফুলের তোড়া। এর আগে একমাত্র মার্গারেট থ্যাচারই এমন সম্মান পেয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে ইন্টারনেট জুড়ে চলতে যাকে সকল দলের টপ নেতা, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পপস্টার এবং বৃটিশ সুধী সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীদের শ্রদ্ধাসূচক স্মৃতিচারণ। টনি বেনের সুদীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হতে থাকে রেডিও-টিভিতে। টনি বেনের স্মরণীয় বহু উদ্ধৃতি প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন ব্লগে।
বাংলাদেশিদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
এই ব্যাপক ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্যে বাদ পড়ে যায় টনি বেনের জীবনের একটি দিক এবং সেটি হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বৃটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন আন্দোলনকে তার সমর্থন দান।
টনি বেনকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬০-এর ফেব্রুয়ারিতে শীতের এক বিকেলে সেন্ট্রাল লন্ডনে রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে একটি মিটিংয়ে। সেই সময়ে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রছাত্রীদের কার্যক্রম হোবর্নের এই অঞ্চল জুড়ে হতো। এখানেই অবস্থিত ব্যারিস্টার হতে আগ্রহীদের পীঠস্থান লিংকন্স ইন, ইকনমিস্ট হতে আগ্রহীদের লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স, অন্যান্য সব বিষয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডন ইউনিভার্সিটি, স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সংক্ষেপে সোয়াস) এবং ছাত্রদের থাকার বিভিন্ন হল। এদের কাছেই ছিল বুশ হাউসে বিবিসি বাংলা বিভাগের দফতর যেটি এখন সরে গিয়েছে অন্যখানে। তাই ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ এখানে ঘটতো। কনওয়ে হলটি খুবই শাদামাটা বলে ভাড়া ছিল কম।
১৯৫৮-তে পাকিস্তানে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার সেনাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এই ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা সংক্ষেপে পিএসএফ। রাজনীতি সচেতন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা এই সংগঠনের সদস্য ছিল। তবে এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের একটা নিজস্ব ধারাও প্রবাহিত ছিল।
লর্ড উপাধি ছেড়ে দেওয়ার একক আন্দোলন
পিএসএফের আমন্ত্রণে সেই শীতের বিকেলে টনি বেন কনওয়ে হলে এসেছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার জন্য প্রধান অতিথি হয়ে। সেই সময়ে তার সম্পর্কে দুটি কথা জানতাম। এক. তিনি বৃস্টল সাউথ-ইস্ট আসন থেকে নির্বাচিত লেবার এমপি এবং দুই. বংশগত কারণে বৃটিশ আইন অনুযায়ী তিনি আর এমপি থাকতে পারবেন না তার পিতা ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পরে।
শেষের তথ্যটি আমাকে কৌতূহলী করেছিল।
বৃটেনের পার্লামেন্টে দুটি হাউস বা কক্ষ আছে। আপার হাউস বা উচ্চকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ লর্ডস বা লর্ডস সভা এবং লোয়ার হাউস বা নিম্নকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অফ কমন্স বা কমন্স সভা। বৃটেনে নির্বাচনে যারা বিজয়ী হন, তারা হন কমন্স সভার সদস্য বা এমপি এবং এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে পাচ বছর। পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে এরাই হন প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। এমপিদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা। অন্যদিকে উচ্চকক্ষে লর্ডরা সদস্য হন তাদের বংশগত যোগ্যতায় অথবা সরকারের মনোনয়নে। এদের সদস্য পদের মেয়াদ থাকে আজীবন অথবা স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া পর্যন্ত। নিম্নকক্ষ কর্তৃক পাস হওয়া কোনো বিল পর্যালোচনা করা এবং সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য আবার নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠানো ছাড়া আর বিশেষ কোনো ক্ষমতা উচ্চকক্ষ সদস্যদের বা লর্ডদের নেই। তাই যারা রাজনীতি করতে চান এবং প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দেশ পরিচালনা করতে চান তারা হাউস অফ কমন্স বা নিকক্ষের সদস্য হতে চান। অর্থাৎ, তারা হতে চান এমপি। অন্যভাবে বলা চলে, তারা লর্ড হতে চান না যদিও লর্ড শব্দটির সঙ্গে মর্যাদা, সম্ভ্রম এবং আভিজাত্য জড়িয়ে আছে।
১৯৬০-এ প্রচলিত বৃটিশ আইন অনুযায়ী লর্ডস সভার সদস্য ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট, যার পূর্ণ নাম ছিল উইলিয়াম ওয়েজউড বেন, তার মৃত্যুর পর তার প্রথম পুত্র মাইকেলের হবার কথা ছিল ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইট এবং সেই সুবাদে লর্ডস সভার সদস্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ওই পুত্রের মৃত্যু হওয়ায়, তার দ্বিতীয় পুত্র এনটনি নিল ওয়েজউড বেন, যিনি সংক্ষিপ্ত টনি বেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তাকেই উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডস সভার সদস্য হতে হতো। টনি বেন ইতিমধ্যে মাত্র পচিশ বছর বয়সে ১৯৫০-এ বিপুল ভোটে বৃস্টল সাউথ-ইস্ট থেকে লেবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি হয়েছিলেন পার্লামেন্টে সর্বকনিষ্ঠ এমপি বা বেবি অফ দি হাউস। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে পিতার মৃত্যুর পরে কিছুতেই তিনি নিম্নকক্ষ ছেড়ে উচ্চকক্ষে লর্ড হয়ে যাবেন না। তাই তিনি এককভাবে একটি আন্দোলন চালাচ্ছিলেন যেন বৃটিশ নাগরিকদের অধিকার থাকে লর্ডস সভার সদস্য পদ ছেড়ে দেওয়ার।
নভেম্বর ১৯৬০-এ ভাইকাউন্ট স্ট্যানসগেইটের মৃত্যুর পর টনি বেন অটোম্যাটিকালি হয়ে যান লর্ড এবং হাউস অফ কমন্সের দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এপৃল ১৯৬১-তে টনি বেনের আসনে উপনির্বাচন ধার্য হয়। টনি বেন এর বিরুদ্ধে কমন্সে একটি ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্পিকার তাকে ভাষণ দেওয়ার অনুমতি দেননি।
টনি বেন তার একক আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি জানতেন ভোটাররা তাকে চায় এবং তিনি এটাও জানতেন যে বৃটিশ আইনে একটা ফাক আছে। কমন্সে ঢুকতে না পারলেও কমন্সের নির্বাচনে দাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এবং উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। বিষয়টি তখন ইলেকশন কোর্টে গড়ায়। আদালত রায় দেন যে ভোটাররা সচেতন ছিলেন। সুতরাং টনি বেনের পক্ষে তাদের ভোট দেয়া অনুচিত হয়েছিল। কমন্সে বেন ঢুকতে পারবেন না এবং উপনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী টোরি পার্টির প্রার্থী ম্যালকম সেইন্ট কেয়ারকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। মজার কথা এই যে ম্যালকম সেইন্ট কেয়ারের অবস্থাও টনি বেনের মতো ছিল। সেইন্ট কেয়ারের পিতাও ছিলেন লর্ড এবং তার মৃত্যুর পর সেইন্ট কেয়ারের কমন্স সভার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যেত।
আদালতের রায়ে গভীরভাবে হতাশ হলেও টনি বেন তার ক্যামপেইন চালিয়ে যেতে থাকেন।
ঠিক এই সময়টায় টনি বেনকে আমরা কয়েকবারই পেয়েছিলাম আমাদের ছাত্রসমাবেশে। তিনি সেখানে শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ে বলতে আসতেন। পরোক্ষভাবে এটা ছিল তার নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্যামপেইনের একটা অংশ।
বিজয়ী বেন
অবশেষে টোরি সরকার দি পিয়ারেজ অ্যাক্ট (The Peerage Act 1963) পাস করে, যার ফলে লর্ড পদবি ছেড়ে দেওয়া আইনসম্মত হয়।
৩১ জুলাই ১৯৬৩-তে সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে এই আইনটি পাস হয়। বেন-ই ছিলেন প্রথম লর্ড যিনি তার পদবি ছেড়ে দেন। এটি তিনি করেন সেই দিনই সন্ধ্যা ৬-২২ মিনিটে!
সেই সন্ধ্যায় আমরা, বেন গুণগ্রাহীরা, একটি পাবে (Pub-এ) কয়েক রাউন্ড বিয়ার কিনে তার এই ঐতিহাসিক সাফল্য সেলিব্রেট করেছিলাম। সেদিনের সান্ধ্য পত্রিকাগুলোতে ছিল শুধুই বেনের সাফল্যের সংবাদ।
চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য বেনকে অপেক্ষা করতে হয় আরো বিশ দিন। সেইন্ট কেয়ার তার নির্বাচনের সময়ে বলেছিলেন, আইন বদলে গেলে তিনি এমপি পদ ছেড়ে দেবেন। সেইন্ট কেয়ার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। বৃটিশ সাউথ-ইস্টে আবার উপনির্বাচন হয় ২০ আগস্ট ১৯৬৩-তে। ওই উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টনি বেন পার্লামেন্টে ফিরে আসেন।
ব্যক্তিগত ন্যায্য দাবি আদায় করার জন্য দেশের কয়েক শ বছরের পুরনো আইন বদলানোর লক্ষ্যে এককভাবে আন্দোলন করে সফল হওয়ার এই দৃষ্টান্ত আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন করে বিজয়ী হবার বহু দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এককভাবে আন্দোলন করে সফল হবার এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
মায়ের প্রভাব
টনি বেনের জন্ম হয়েছিল ৩ এপ্রিল ১৯২৫-তে লন্ডনে তার পিতা ভাইকাউন্ট হবার আগে ছিলেন লেবার পার্টির এমপি এবং দুইবার মন্ত্রী। টনির মা মার্গারেট ছিলেন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী নেত্রী এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানী। টনির ওপর তার মায়ের প্রভাব পড়েছিল বেশি। মা যখন তাকে বাইবেল পড়াতেন তখন বলতেন, বাইবেলের গল্পগুলোর ভিত্তি হচ্ছে পয়গম্বর এবং রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ। রাজারা ছিল ক্ষমতাবান। কিন্তু পয়গম্বররা ছিলেন ন্যায় ও নীতিবান। সুতরাং টনির উচিত হবে তার নিজের জীবনে রাজাদের বিরুদ্ধে পয়গম্বরদের সাপোর্ট করা। সম্ভবত বৃটেনের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে টনি বেনের বিতৃষ্ণার সূচনা হয়েছিল তার মায়ের শিক্ষাতে।
টনি বেনের দাদা এবং নানা উভয়েই ছিলেন লিবারাল পার্টির এমপি। অর্থাৎ তিন পুরুষ ধরে টনি বেনরা ছিলেন এমপি। তিন পুরুষেই তারা হয়েছিলেন মন্ত্রী। তার পিতা যখন লেবার সরকারের ইনডিয়া দফতরের মন্ত্রী ছিলেন তখন ১৯৩১-এ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে টনি বেনের দেখা হয়েছিল।
বেনের পৈত্রিক পরিবারের মূল আয় ছিল একটি প্রকাশনা ব্যবসা থেকে। তিনি পড়াশোনা করতে যান অক্সফোর্ডে। ১৯৩৯-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি এয়ার ফোর্সে পাইলট রূপে যোগ দেন। যন্ত্র এবং আধুনিকতার প্রতি টনি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালেও তার এই আগ্রহ অটুট ছিল। যুদ্ধ শেষের পর তিনি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে যান এবং সেখানে ফিলসফি, পলিটিক্স ও ইকনমিক্স পড়েন। ১৯৪৭-এ তিনি অক্সফোর্ড ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন। তখন ধনী এবং অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই অক্সফোর্ড-কেমবৃজে পড়াশোনার সুযোগ পেত। সম্ভবত সেই কারণে সাধারণ মানুষের স্টেটাস পেতে উৎসাহী টনি বেন পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ডে তার লেখাপড়ার বিষয়টি অনুক্ত রাখতেন। ১৯৭৫-এ হু ইজ হু (Whos Who) জীবনীকোষে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন, শিক্ষা এখনো চলছে (Education- still in progress).
অসাধারন পরিবার সাধারন নাম
১৯৪৮-এ গ্র্যাজুয়েট হবার পর কিছু কাল আমেরিকায় কাটিয়ে বেন বিবিসি রেডিওতে প্রডিউসার পদে কাজ করেন (১৯৪৯-৫০)। এই সময় পর্যন্ত তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এনটনি ওয়েজউড বেন এবং ওয়েজি নামে বন্ধুবৃত্তে ও পরিবারে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৩-এ বিবিসির একটি প্রোগ্রামে তিনি ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে এনটনি ওয়েজউড বেনের পরিবর্তে তিনি শুধু টনি বেন নামে পরিচিত হতে চান। এখানেও তার সেই একই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল। তিনি তার অভিজাত এবং দীর্ঘ নাম বদলে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সাধারণ ও সংক্ষিপ্ত নাম রাখেন। এই ধারাতে পরবর্তীকালে আমেরিকার উইলিয়াম জেফারসন কিনটন হয়ে যান বিল কিনটন এবং বৃটেনে এনটনি চার্লস লিনটন ব্লেয়ার হয়ে যান টনি ব্লেয়ার। একই ধারায় বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন হয়েছেন ডেভিড ক্যামেরন এবং বর্তমান বৃটিশ বিরোধীদলীয় নেতা এডওয়ার্ড স্যামুয়েল মিলিব্যান্ড হয়েছেন এড মিলিব্যান্ড!
কিন্তু নাম বদলে ফেললেও তিনি যে উচ্চবংশীয় অভিজাত পরিবারের সন্তান সেটা গোপন করা অসম্ভব ছিল। তাই তিনি এক সময়ে বলেন, যে উচ্চ শ্রেণীর মানুষরা বৃটেন চালায় তাদের আপাদমস্তক আমি জানি। তারা কিসের তালে আছে সেটাও আমি জানি। আর এটাই হচ্ছে লেবার পার্টিতে আমার অবদান।
১৯৪৯-এ তিনি বিয়ে করেন আমেরিকান ধনী নারী ক্যারোলাইন মিডলটন ডিক্যাম্পকে। ক্যারোলাইন বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে এবং কাজ করতেন শিক্ষা ক্ষেত্রে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময়ে টনি বেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। এর নয় দিন পরে অক্সফোর্ডে একটি পার্কের বেঞ্চে ক্যারোলাইনকে পাশে বসিয়ে টনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। টনি বেন বলেন, আমি খুব লাজুক ছিলাম। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল এবং তারা এক কন্যা ও তিন পুত্রের জন্ম দেন। পুত্রদের মধ্যে মধ্যমজন হিলারি রাজনীতিতে এসেছেন এবং লেবার সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। অর্থাৎ, চতুর্থ পুরুষেও বেন পরিবার থেকে এমপি ও মন্ত্রী হয়েছেন। টনি বেন ও তার স্ত্রী বসবাস করতেন পশ্চিম লন্ডনে নটিং হিল এলাকায় একটি বড় বাড়িতে, যেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল লাইব্রেরি। ২০০০-এ ক্যারোলাইন মারা যান। যে বেঞ্চে বসে টনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই বেঞ্চটি তিনি অক্সফোর্ড থেকে কিনে লন্ডনে নিজের বাড়ির বাগানে স্থাপন করেন।
যুদ্ধ বিরোধী বেন
১৯৪৯-এ বিয়ের পরপরই টনি বেন বৃস্টল সাউথ-ইস্টের এমপি হবার জন্য কাজে লেগে যান। ওই আসনে লেবার এমপি ছিলেন স্যার স্ট্যাফোর্ড কৃপস, যিনি রিটায়ার করেছিলেন। ২০০১-এ টনি বেন ৫১ বছর পার্লামেন্টে সদস্য থাকার পর রিটায়ার করেন। রিটায়ার করার সময়ে তিনি বলেন,আমি পলিটিক্সে আরো সময় দেওয়ার জন্য রিটায়ার করছি।
কথাটা টনি বেন হালকাভাবে বলেননি। যখন মার্চ ২০০৩-এ ইরাকের বিরুদ্ধে বৃটেন যুদ্ধে যায় তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার। টনি বেন বলতেন, প্রতিটি যুদ্ধই হচ্ছে কূটনীতির ব্যর্থতার পরিচয় (All war represents a failure of diplomacy)। তাই ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ টনি বেন চলে যান বাগদাদে এবং সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে আসন্ন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হন না। তিনি মনে করতেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। আমেরিকার সহযোগী হবার জন্য তিনি ব্লেয়ারের সমালোচনা করেন।
টনি বেনের যুদ্ধবিরোধী হবার কারণ ছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এয়ার ফোর্স পাইলট রূপে তিনি যুদ্ধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা স্বচোখে দেখেছিলেন। এই যুদ্ধে একটি দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই নিহত হয়েছিলেন। তাই ১৯৫৪ থেকে তিনি পারমাণবিক বোমাবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন। ২০০১-এ তিনি আফগানিস্তান যুদ্ধে বৃটেনের জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেন।
বাগদাদ থেকে ফিরে এসে টনি বেন ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ স্টপ দি ওয়ার কোয়ালিশন (যুদ্ধ থামাও জোট) নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ওই মাসে বৃটেনে যুদ্ধবিরোধীদের একটি মহাসমাবেশে বহু মানুষ যোগ দেয়। এতে পুলিশের মতে ৭,৫০,০০০ প্রতিবাদকারী মানুষ উপস্থিত ছিল এবং সেই সময় পর্যন্ত সেটাই ছিল বৃটেনের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। দি ওয়ার কোয়ালিশন দাবি করে সেখানে ১,০০০,০০০ প্রতিবাদকারী উপস্থিত ছিল। টনি বেনের আবেগি কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা এই সমাবেশের সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল। পার্লামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আমৃত্যু এই জোটের হয়ে যুদ্ধবিরোধী কাজ চালিয়ে যান।
বিনয়ী বেন
প্রায় ৫১ বছর পার্লামেন্টের সদস্য থাকলেও এবং তার দল লেবার পার্টি একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও টনি বেন কখনোই প্রধানমন্ত্রী হননি এমনকি লেবার পার্টি বিরোধী অবস্থানে গেলেও তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেননি। তাই টনি বেন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সব রাজনৈতিক জীবনই ব্যর্থতায় শেষ হয়। আমার রাজনৈতিক জীবন অধিকাংশের তুলনায় আগেই শেষ হয়েছে (All political careers end in failure. Mine ended earlier than most)।
এই উক্তিটি ছিল তার বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেতা না হতে পারলেও তিনি লেবার সরকারের আমলে একাধিকবার মন্ত্রীর সমমর্যাদাসম্পন্ন পদে অথবা মন্ত্রী পদে কাজ করেছিলেন। তিনি হয়েছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল (১৯৬৪-১৯৬৬), টেকনলজি মন্ত্রী (১৯৬৬-১৯৭০), শিল্পমন্ত্রী (১৯৭৪-১৯৭৫) এবং এনার্জি মন্ত্রী (১৯৭৫-১৯৭৯)।
টনি বেন সম্পর্কে বলা হয়, মন্ত্রী পদে থাকার পরে যে গুটিকয়েক পলিটিশিয়ান আরো বামপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। এতে তার সোশালিজম বা সমাজতন্ত্র মার্কসবাদের চাইতে বাইবেল দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিল তার মায়ের কারণে। এক সময়ে বৃটেনে উগ্র বামপন্থীদের বলা হতো বেনপন্থী বা বেনাইট (Bennite)।
চারটি শিক্ষা
মন্ত্রিত্বের পরে কেন তিনি আরো বামপন্থী হয়ে যান সে বিষয়ে টনি বেন বলেন, আমি চারটি শিক্ষা পেয়েছিলাম। এক. জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের নীতি এবং সিদ্ধান্তগুলো কিভাবে আমলারা বা সিভিল সার্ভিস পণ্ড করে দেয়। দুই. লেবার পার্টি যে ধারায় চলছে সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তার ফলে পার্টির নেতা তার জমিদারির মতো পার্টিকে চালাতে পারেন। তিন. লেবার সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার্সদের এবং চার. মিডিয়ার যে ক্ষমতা আছে সেটা মধ্যযুগীয় চার্চের সঙ্গে তুলনীয়। সমাজে যারা অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই মিডিয়া প্রতিদিনের ঘটনাগুলো দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করে।
এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে টনি বেনের এই চারটি শিক্ষা বিবেচনা করতে পারেন।
পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে
দেশের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে আরো প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য বেন ছিলেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার পক্ষে। দলের মধ্যে তিনি আরো গণতন্ত্র চর্চার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। বৃটেনে প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলন বা কনফারেন্স হয়। বেন চাইতেন ওই সম্মেলনে ভোটের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন। ইইউ বা ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে বৃটেনের যোগদানের বিরোধী ছিলেন বেন। এই ইসুতে টনি বেন ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট পলিটিশিয়ান এবং নিজের দল লেবার পার্টির চাইতে প্রতিপক্ষ দল টোরি পার্টির কাছাকাছি।
টনি বেনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার দলের মূলধারার সঙ্গে বহুবার তীব্র বিরোধিতা ঘটেছিল। যেমন, ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান ইসুতে, কিন্তু তিনি কখনোই দল ছেড়ে যান নি। তিনি বলতেন,দলের মধ্যে থেকেই দলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। কোনো ব্যক্তির অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল টেকে না।
বাংলাদেশে বিদ্রোহী অঙ্গ দল গঠনের প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে তাদের উচিত হবে টনি বেনের পূর্ণ জীবনী পড়ে দেখা।
পরিশ্রমী লেখক
তাদের অসুবিধা হবে না। কারণ টনি বেন ছিলেন পরিশ্রমী ডায়রি লেখক। তার জীবন কেন্দ্রিক আটটি ডায়রি প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ডায়রি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। নাম : এ ব্লেইজ অফ অটাম সানশাইন (A Blaze of Autumn Sunshine বা হেমন্তের কড়া সুর্যালোক)। এই চূড়ান্ত ডায়রিতে তিনি ২০০৭-৯ সালগুলোর ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। জীবনের হেমন্তকালে বা পড়ন্ত বেলায় এই দুই বছরে তিনি দেশ জুড়ে প্রায় আশিটি শহরে ঘুরে বেড়ান, ভাষণ দেন, বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন এবং ওয়ান-ম্যান শো বা একক শো উপস্থাপন করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং তার বক্তৃতায় ঘৃণার চাইতে বেশি ব্যঙ্গরস, ক্রোধের চাইতে বেশি যুক্তি এবং কল্পকথার চাইতে বেশি বাস্তব সমাধানের রূপরেখা থাকত, তাই তার ভাষণ শুনতে সর্বত্রই অনেক শ্রোতা টিকেট কিনে আসত। বিশেষত তরুণরা।
একটি স্ট্রোকের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষ ডায়রিতে তিনি লেখেন, আমি আশা করি আবার আমি একাই চলাফেরা করতে পারব। আমি পরনির্ভর হয়ে থাকতে চাই না।... এই ডায়রিতে আমি লিখেছি কিভাবে মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। এই রূঢ় বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়েছে।
এই আট খণ্ডের ডায়রি ছাড়াও আরো দুটি বই লিখেছেন। রেডিও এবং টেলিভিশনে বহু শো দিয়েছেন। টনি বেন লেখালেখির জন্য বিশাল লাইব্রেরি করেছিলেন যেখানে বইয়ের সঙ্গে ছিল অজস্র নিউজ পেপার কিপিংস। এসব লেখা, শো, জনসভার ভাষণ এবং পার্লামেন্টে বিতর্কে বেন তার প্রতিপক্ষকে কখনোই অশোভন ভাষায় আক্রমণ করেন নি। তিনি বলতেন, প্রতিপক্ষকে তিনি ঘৃণা করেন না প্রতিপক্ষের নীতিকে তিনি সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশে যারা বর্তমান ((অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভার ভাষণ শুনেছেন (আপনি (খালেদা) পেয়ারের পাকিস্তানে চলে যান ১ মে ২০১৪, গাজীপুর) তারা টনি বেনের কয়েকটি ভাষন পড়লেই বুঝবেন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ না হোক, মধ্যম সভ্যতার দেশে উন্নীত করতে হলে পলিটিশিয়ানদের ভাষা কেমন হওয়া উচিত।
টনি বেন কেন তার ভাষা ও ভাষণ সম্পর্কে এত সতর্ক থাকতেন? কারণ তিনি জানতেন প্রবীণ পলিটিশিয়ানদের দ্বারা নবীন পলিটিশিয়ানরা প্রভাবিত হয়। বেন সবসময়ই নবীনদের কাছে পৌছাতে চেয়েছেন। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তরুণদের কথা শুনতেন। এটা শুধু যে তিনি ইংরেজ তরুণদের বেলায়ই করতেন, তা নয়। ষাটের দশকে আইয়ুব খান বিরোধী যেসব ছাত্র সম্মেলনে তিনি আসতেন তখন আমাদের কথাও তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং ভালো সাজেশন দিতেন। তার বই পড়ে এবং ভাষণ শুনে ছাত্রজীবনে ডেভিড ক্যামেরন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রাজনীতিতে যোগ দিতে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ক্যামেরন টোরি পার্টিতে যোগ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ক্যামেরন শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন টনি বেনের সৎ এবং আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি।
পপ ও পোশাক, চা ও পাইপ
তরুণদের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র বজায় রাখতে টনি বেন খুব আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ছিলেন পপ মিউজিকে। তিনি জানতেন রাজনীতির চাইতে তরুণরা মিউজিকে বেশি আগ্রহী। এ কারণেই প্রতি বছর তিনি ইংল্যান্ডের গ্ল্যাস্টনবেরি ফেস্টিভালে যেতেন। প্রতি জুনের শেষে সমারসেট, গ্ল্যাস্টনবেরিতে এই আন্তর্জাতিক উৎসবে পপ, ব্লুজ, রক, রেগে, হিপহপ এবং লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলে পাচ দিন ব্যাপী। পাশাপাশি চলে নাচ, নাটক, সার্কাস, ক্যাবারে মিউজিক এবং অন্যান্য ধরনের আর্টস প্রদর্শনী। বিশ্বের টপ পপ আর্টিস্টরা এই ফেস্টিভালে যোগ দেন এবং উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা পৌনে দুই লক্ষের বেশি হয়। টনি বেন বলতেন, গ্ল্যাস্টনবেরি আমার জন্য একটা বার্ষিক তীর্ঘযাত্রা। এখানে এলে রাজনৈতিক তৃনমূলের সঙ্গে আমি পরিচিত হই। তরুণদের আইডিয়া জানি। নতুন শক্তি নিয়ে ফিরে যাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের কজন সিনিয়র পলিটিশিয়ান বাংলাদেশের কোনো পপ মিউজিক ফেস্টিভালে নিয়মিত গিয়েছেন কি? তারা কি জানেন, আসিফ আকবর, আইয়ুব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ প্রমুখ পপ শিল্পীরা এখন কি গাইছেন? তারা কি জানেন, আর্টসেল, শূন্য, অর্থহীন প্রভৃতি নতুন কোন পপ ব্যান্ড এখন তরুণদের মধ্যে প্রিয়?
ষাটের দশক কনওয়ে হলে তিনি আসতেন ক্যাজুয়াল পোশাক পরে। সাধারণত কালো অথবা ব্রাউন টাউজার্স এবং ব্রাউন কর্ডরয়ের জ্যাকেট পরে। তরুণদের সংস্পর্শে থাকার ফলে পরবর্তী সময়ে তরুণদের প্রিয় মালটিপকেট জ্যাকেট পরে তিনি সভায় যেতেন। তিনি ভেজিটারিয়ান বা নিরামিষাসী ছিলেন। কোনো এলকোহলিক ডৃংকস খেতেন না। অনবরত চা খেতেন। তার হাতে থাকত ধূমায়িত পাইপ। ইন্টারনেটে পাইপ হাতে টনি বেনের অনেক ছবি আছে। তবে কেউ কেউ বলেন, সবসময় হাতে পাইপ থাকলেও টনি বেন সবসময় পাইপ স্মোক করতেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে টনি বেন বলেছিলেন,পাইপ স্মোকিং আমার নেশা নয় - ওটা পেশা... প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু তারপর সেই প্যাকেট বৈধভাবে কেনা যায়। বিষয়টা বেশ বিচিত্র।
তরুণদের প্রতি
নিজের জীবনে একক সংগ্রাম চালিয়ে সফল হবার প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী টনি বেন তরুণদের প্রতি একটি মূল্যবান উপদেশ এবং আশার বানী দিয়ে গিয়েছেন। সেটা হলো, ‘প্রথমে তোমাকে ওরা অবজ্ঞা করবে। তারপর ওরা বলবে তুমি একটা পাগল। তারপর বলবে তুমি বিপজ্জনক। তারপর চলবে একটা নীরবতা। আর তারপর তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী কাউকে তুমি দেখবে না।’
তরুণদের যে কর্মসংস্থান দরকার সেটা টনি বেন বুঝতেন। তার যুদ্ধ বিরোধিতার এটাও একটা কারণ ছিল। তিনি বলেন, “যুদ্ধের জন্য যদি টাকা পাওয়া যায় তাহলে মানুষকে সাহায্য করার জন্যও টাকা পাওয়া সম্ভব... স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং সব কিনিক ও হসপিটালে আরো বেশি লোক নিয়োগ করলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।”
 
পাচটি প্রশ্ন করবে
টনি বেন একজন চিন্তাবিদও ছিলেন। বিশেষত গণতন্ত্র বিষয়ে তিনি খুব সহজ ভাষায় তরুণদের প্রতি কিছু উপদেশ দেন। ২০০৫ সালে তিনি লেখেন : 
ক্ষমতাশালীদের পাচটি প্রশ্ন করবে :
১ আপনার কি ক্ষমতা আছে?
২ এই ক্ষমতা আপনি কোনখান থেকে পেয়েছেন?
৩ কার স্বার্থে এই ক্ষমতা আপনি কাজে লাগাচ্ছেন?
৪ কার কাছে আপনি জবাবদিহি করেন?
৫ আপনাকে আমরা কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারি?
মনে রেখ :
ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার শুধু গণতন্ত্রই আমাদের দেয়।
সে জন্যই কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি গণতন্ত্র পছন্দ করে না।
আর সে জন্যই প্রতিটি প্রজন্মকে লড়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে এবং সেটা বজায় রাখতে।
এই প্রজন্মের মধ্যে তুমিও আছ, আমিও আছি - এখানে এবং এখনই।
 
এই উপদেশের অরিজিনাল ইংরেজিটা নিচে প্রকাশিত হলো। টনি বেন নিজের হাতে কয়েকটি শব্দ ক্যাপিটাল লেটারে লিখে আন্ডারলাইন করে দেন। আশা করি তরুণ পাঠকরা সেটা লক্ষ্য করবেন।
Ask the powerful five questions: 
1 What power have you got?
2 Where did you get it from?
3 In whose interest do you exercise it?
4 To whom are you accountable?
5 How can we get rid of you?
- Tony Benn, 2005
 
Only democracy gives us that right.
That is why NO-ONE with power likes democracy. 
And that is why EVERY generation must struggle to win it and keep it. 
- Including you and me here and NOW. 
 
টনি বেন তার একটি ডায়রিতে আরো তিনটি মূল্যবান উপদেশ নিয়ে গেছেন :
১ জনগণকে বিশ্বাস করো।
২ তুমি যা বিশ্বাস করো তার প্রতি সৎ থেকো।
৩ নিজের পরিবারের সঙ্গে থেকো।
 
বাংলাদেশে যখন রাজনীতি থেকে নীতি বিদায় নিয়েছে, সমাজ থেকে আদর্শ বিদায় নিয়েছে, শিক্ষায়তন থেকে মূল্যবোধ বিদায় নিয়েছে, তখন টনি বেনের এসব উপদেশ পলিটিশিয়ান, সমাজপতি ও শিক্ষাবিদরা প্রচারে উদ্যোগী হতে পারেন।
 
একাই একশ হতে পারে
৫ জানুয়ারি ২০১৪-র নির্বাচন বিহীন নির্বাচনে ইনডিয়া ব্র্যান্ড আওয়ামী লীগ “বিজয়ী” হবার পর এবং একজন (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকার পর তরুণ-প্রবীণ কিছু রাজনৈতিক কর্মী-নেতা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা যদি টনি বেনের জীবন পর্যালোচনা করেন অথবা তার আত্মজীবনীমূলক ডায়রিগুলো পড়েন তাহলে তারা আবার আশাবাদী হবেন। পুনরুজ্জীবিত হবেন। তারা বুঝবেন মানুষ একাই একশ হতে পারে। একাই অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
আর সেখানেই (অবৈ:) প্রধানমন্ত্রী ও তদীয় পুত্রের ভয়। 
ইনডিয়ান সহযোগিতায় প্রতিটি দলের উপর নজরদারি করা যায়। দলের কিছু নেতাকর্মীকে ফাসি দেওয়া যায়। গুম করা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নজরদারি করা অসম্ভব। প্রতিটি ব্যক্তিকে গুম-খুন করা অসম্ভব।
ব্যক্তি যখন আদর্শে বলীয়ান এবং ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন কোনো সরকারের পক্ষেই তাকে সামলানো সম্ভব নয়। এটাই সত্য।
নারায়ণগঞ্জে সিরিয়াল অপহরণ, গুম ও খুন এবং তারপর শীতলক্ষ্যাতে সাতটি লাশ পাওয়ার পরে গত কয়েক দিনে সেই শহরে যে জনরোষ বিরাজ করছে সেসব এই সত্যটির প্রাথমিক প্রমাণ মাত্র।
 
ফিরে যাই সেই প্রথম প্রশ্নে।
টনি বেন কে ছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায় জানুয়ারি ২০০৭-এ বিবিসি-র দি ডেইলি পলিটিক্স প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত একটি জনমত জরিপে। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৩৮% -এর মতে বৃটেনের এক নাম্বার পলিটিকাল হিরো টনি বেন। মার্গারেট থ্যাচার পেয়েছিলেন ৩৫% ভোট।
 
এবার ফিরে যাবো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে। এই রচনার প্রথম তিনটি উদ্ধৃতিতে :
 
৩ টনি বেন আজীবন কর্মকাণ্ডে তার বাণী বাস্তবায়িত ও সফল করে গেছেন।
২ তাজউদ্দীন আহমদ যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেটাও বাস্তবে ঘটে গিয়েছে।
১ সজীব ওয়াজেদ জয় যে আত্মবিশ্বাসমূলক নির্ভয়বাণী দিয়েছেন সেটা কি বাস্তবে চলমান থাকবে? নাকি সেটা অবাস্তব ও ভুল প্রমাণিত হবে? ভবিষ্যতই সেটা বলে দেবে।
 
৩ এপৃল ২০১৪

বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

চোখের পানি আটকাতে পারলামনা


old 

এসব কুলাঙ্গার সন্তানের জন্যই মনে হয় জাহান্নাম! বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটলো স্বজনহারাদের রোজার মাস
অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে- প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না। চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
অন্যরকম কষ্টকর ও ভাবনার একটি চিত্র- বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটে স্বজনহারাদের রোজার মাস- চার বৃদ্ধার মৃত্যু, দাফনেও আসল না আপনরা- আমরাও কি পাশ্চাত্যের অমানবিক জীবনের দিকে?
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই ইহার চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভূবনে নাই।” কাজী কাদের নেওয়াজ
স্বার্থের জুয়াখেলায় মত্ত এই বিচিত্র পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে জীবনের জন্য ধ্রুব মৃত্যুর কথাটাই ভুলে গেছি। এমনি সামনে দিয়ে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে গেলেও মনে হয় না মরব। অথচ ঠিক আগামী কালই আমাদের সবাইকে নিম্ন মানের সেলাই বিহীন কাপড় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এর পরও মানুষ পিতা-মাতার খোঁজ-খবর রাখে না, মিথ্যা বলে কিংবা ঘুষ খায়।
সন্তান, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনহারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুরো রমজান মাস কাটলো চোখের জলে। কেউ কেউ ভুলতে পারেননি তাদের পুরানো স্মৃতি। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে রমজান মাসে এক সঙ্গে ঘরে বসে ইফতার করতেন। এতে কতই আনন্দ উপভোগ করতেন। কয়েকজন বৃদ্ধ বলেন, চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা মনে পড়ে যায়। কখন তাদের সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন। তখন চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের কাজ রেখে অথবা দ্রুত শেষ করে বাড়ি ফিরে যান। এমন কি স্ত্রী ও সন্তানরা পিতা কখন আসবে? ইফতারি প্রস্তুত করে বসে থাকতো। কোন কারণে ইফতারিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে ঐ দিন বাসায় আপনজনদের ইফতার ঠিকমত হতো না। কিন্তু বয়সের ভারে পরিবারের সবার প্রিয় ব্যক্তি এক সময় আয়-উপার্জন করতে অক্ষম হওয়ায় সবার বোঝা হয়ে যান। বৃদ্ধের প্রতি মানসিক ও শারীরিকসহ কতই নির্যাতন নেমে আসে। অবশেষে নাড়ি ছেড়া ধন ও কলিজার টুকরা সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা পিতা-মাতা সইতে পারেননি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে পাড়ি দেন অচেনা পথে। অবশেষে ঠাঁই নেন হূদয়বান ব্যক্তি ও শিল্পপতি খতীব আব্দুল জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। মাদারীপুরের মতিজান (৭৪), নারায়ণগঞ্জের নাসিমা বেগম (৮০), বীর মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি (৮১), ময়মনসিংহের ওসমান গনি (৭০), গফরগাঁও-এর আব্দুল খালেক (৭০), পিডব্লিউডির সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম (১০৫) এ সব কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বৃদ্ধাশ্রমে পহেলা রমজানে ইফতারের সময় তাদের সেই স্মৃতি মনে পড়ে। ঐ দিন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন দ্বারা বিতাড়িত হয়ে একাকী ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে। অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। প্রতিদিন রমজানে ইফতার ঘনিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক আগে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে তারা একে অপরের পুরনো স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন। অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে, আসেন ইফতারের সময় হয়েছে, এক সঙ্গে ইফতার করি। প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না, চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
গত রমজানে চারজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা গেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের দাফন বৃদ্ধাশ্রমে হয়েছে। অপরজনের লাশ স্বজনরা নিয়ে যায়। তাও খবর দেয়ার পর স্বজনরা এসেছেন। যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন, লালশটি নিয়ে আপজনরা এর দায় মুক্ত হতে চেয়েছে বলে কয়েক বৃদ্ধ জানান। এ যেন, কাটা ঘায়ে লবণ দেয়ার মত কাজ বলেও কোন কোন বৃদ্ধ অভিমত ব্যক্ত করেন।
বৃদ্ধাশ্রমে ১৯০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে রমজান মাস কাটিয়েছেন। বাকি ১৫০ জনের মধ্যে ৪৫ জন বৃদ্ধ ও ৫৫ জন বৃদ্ধা বৃদ্ধাশ্রমে রোজা রেখেছিলেন। ৫০ জন অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারেননি বলে বৃদ্ধাশ্রমের সুপার মোহাম্মদ শরীফ জানান।
তখনো শেষ বিকালের লালচে আলোর খেলা চলছে দিগন্তে। নতুন আরেকটি সন্ধ্যার আগমনী সংকেত বাজছে। কেন যেন পুরোনো মানুষদের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো। কিভাবেই যে টুপটাপ ঝড়ে গেছে চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো। যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে রাস্তাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো কখনো।
এই জায়গাটাতেই প্রায়ই দেখা হতো এক প্রবীণের সাথে। অশীতিপর এই মানুষটির সাথে আলাপও হতো বটে। এই ভদ্রলোকের হাঁটাটাকে সব সময়ই মনে হতো উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন। আসলে এ রকম অনেক নুয়েপড়া কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধরা এখানে ওখানে ঘরছাড়া বালকের মত ঘুরে বেড়ায়।
বয়স ৬০-৬৫ পেরুলেই খুব ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের শিতি-অশিতি সব শ্রেণীর মানুষেরা মনে করে পশ্চিমা দেশের তুলনায় আমরা আমাদের বাবা মাকে বেশি সম্মান করি, ভালবাসি। কিন্তু আমার কাছে তুলনা করার ব্যাপারটি খুব হাস্যস্পদ মনে হয়।
oldhomeআমরা আমাদের প্রবীণ বাবা মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতার কতটা মূল্য দেই? আমাদের দেশের বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ে; বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেলে মনে করি ওরা বুড়ো হয়েছে। ওদের আবার কি মতামত। ওরা তো সেকেলে। অনেকেতো নিজের কারণেই হোক কিংবা পরিস্থিতির কারণেই হোক বাবা-মাকে বোঝা মনে করে থাকে। এসব বাবা-মা এমন এক পরিস্থিতির শিকার হন যে পরিবার যদি তাদের না দেখে তাহলে তাদের দেখ-ভালের কেউ থাকে না। কারণ আমাদের সমাজে সামান্য হলেও একজন বৃদ্ধের মূল্য শুধু পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
দেশপ্রেমের জোয়ারে এদেশের মানুষ শুধু ভাসতে শিখছে, মানুষের জীবনের দাম দিতে শিখেনি। একজন বৃদ্ধ লোকের প্রতি কোন রকমের সহানুভূতি আমরা দেখাই না। অথচ পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন স্তরের সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া যায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় ডাক্তারের টাকা, হাসপাতালের টাকা, এমনকি ওষুধের টাকাও আসে সরকারি তহবিল থেকে। তারপর পয়ষট্টির পর থেকে বাসের ভাড়া, প্লেনের ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া, কাপড় চোপড়ের দাম, জুতোর দাম সবকিছুতে ছাড় দেওয়া হয়। সময় সময় সরকার তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য ভ্রমনভাতাও দেয়। অথচ আমাদের দেশে এসবের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নেই একজন বৃদ্ধলোকের। সঙ্গত কারনেই বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব সন্তানের।
যেহেতু আমাদের ‘পারিবারিক বন্ধন’ হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। সেহেতু এই বন্ধন অটুট রাখার জন্যেই বৃদ্ধ বাবা-মা’র সকল প্রকার দায়িত্ব সন্তানের। পাশ্চাত্যে কথা ভেবে আজকাল অনেকেই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। তারা মনে করে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য নিয়ে চলাফেরা যায়না। অথচ এই বাবা-মার সন্তান হিসাবে যখন আমরা বড় হয়ে উঠি তখন কোনো বাবা মা কি তার সন্তানকে বোঝা মনে করে ? ছেলে যে বড় হবে মস্ত বড় চাকরি করবে। আমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দেবে। এই ভালবাসার কতটুকু মূল্য ছেলে মেয়েরা দেয় ? খুব বেশী অধিকার সচেতনা আমাদের মন মানসিকতাকে হীন করে দিয়েছে। সুখ অন্বেষণে জীবনটাকে আমরা বারবার ওলট পালট করে দেখি ঠিক, কিন্তু ক’জন সুখী হতে পারছি?
পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও বাবা মা’রা সস্তানকে যথেষ্ট যত্নে লালন পালন করে। সন্তানরাও তাদের বাবা মাকে অনেক বেশী ভালবাসে। তবে তাদের ক্ষেত্র ব্যতিক্রম এটুকুই যে, সেইসব বাবা মায়েরা নিজেদের জীবনকেই সব চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়। যার ফলে তাদের পারিবারিক কোন বন্ধন থাকে না।
কিন্তু আমাদের বাবা মারা তো সন্তানের জন্যেই সব কিছু করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন কোন বাবা মা কি আছে যারা সন্তানের জন্য নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দেননি। যে বাবা মা জীবনের ধন ভেবে সন্তান সংসার আঁকড়ে ধরে রাখে, সেই সন্তানই একদিন বড় হয়ে সেই বাবা মা যে জীবন ধারাতে অভ্যস্ত সে জীবন ধারাটা পালটে দিতে চায়। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য দিতে চায় না। তাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে বরং আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই।
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি একটি বয়সে আমরাও বুড়ো হব। যাদের আমরা বলি বুড়ো হয়েছে, বেশী কথা বললে বলি; ভিমরতিতে ধরেছে, ভেবে কি দেখি আমিও বুড়ো হবো, কানে শুনবো না হয়তো, স্মৃতিভ্রম হবে, হাত-পা কাঁপবে। এমনও তো হতে পারে রাতের আধাঁরে হঠাৎ বেড়িয়ে পড়তে পারি অতীতের খোঁজে।
এখন যারা বলি আমি সন্তানের বোঝা হবো না, তাদের দয়া ওপর নির্ভর করবো না, আমি তাদের এই ধারনার সাথে কখনোই একমত হতে পারি না। আমার সন্তান আমাকে দেখবে না তো কাকে দেখবে? আমার সব কিছুইতো সন্তানের জন্য, সন্তানতো আমার। আমার সাথেতো সন্তানের রক্তের বন্ধন।
আসলে এই যে বন্ধন এই বন্ধন রার দায়িত্ব বাবা মা আর সন্তানেরই। এই বন্ধন অটুট থাকলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়না।
আমি তো মনে করি আমাদের সবার সুস্থ মন মানসিকতাই আমাদের সকল প্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতা রার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সম। যে বাবা মা তিলে তিলে একটি সাজানো সংসার গড়ে তুলেছেন কি করে এই সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা যায়! কি করে সম্ভব এই সংসার গড়ার কারিগরদের উপো করা?
আমরা যদি মনে করতাম গুরুজন রাগ করেছেন, না হয় অন্যায়ই করেছে; আমরা কি পারিনা তাদের সবকিছু ভালবাসার গুনে মেনে নিতে। একটাইতো জীবন। বাবা-মা-সন্তান সবাই মিলে সেই জীবনের পুরোটাকে আনন্দে ভরপুর রাখতে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলে কি এমন ক্ষতি হবে?
তবে একথা অনস্বীকার্য সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বয়স্ক মানুষদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। যে মানুষ দেশের জন্যে কাজ করেছে, দেশের মানুষের জন্য সারাজীবন স্ব স্ব অবস্থান থেকে শ্রম দিয়েছেন। তাদেরকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে সকল সুবিধা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
কেমন আছেন প্রবীণ নিবাসে নির্বাসিত দুখিনী মায়েরা
‘মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাইরে/ মায়ের মতো আপন কেহ নাই।
মা কথাটি ছোট্ট অতি/ কিন্তু জেন ভাই/ তাহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’
মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপস বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা… জীবনমুখী এ বাংলা গানের সুর অনেকের মোবাইল টিউন, ওয়েলকাম টিউনে শোনা যায়।
মায়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে বলেই হয়তো এসব গান তারা ডাউনলোড করছেন। শুধু গান লোড কেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এদেশে এখনও বহু সন্তান রয়েছেন, যারা মায়ের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে পারেন। কিন্তু তার বিপরীতে মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমসহ সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত। প্রবীণ মায়েরা কেমন রয়েছেন—তা জানার জন্য বিভিন্ন আশ্রম ঘুরে জানা গেছে, মৃত্যু মুহূর্তে সংসারবিচ্ছিন্ন লোকচক্ষুর আড়ালে পরবাসে থাকা মায়েদের ভিড় বাড়ছে!
নিষ্প্রাণ, বোধশূন্য, গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে থাকা ওইসব মায়ের সঙ্গে কথা হয়। কেমন আছেন তারা জানতে চাইলে অনেকেরই চোখে পানি এসে যায়! কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, ভাষা খুঁজে পান না। আবার কেউ পাছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মানহানি হয় কিংবা ছেলের রক্তচক্ষু দেখতে হয়—সে ভয়েও গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি। কেউ আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন—‘চোখের সামনে না থাকুক, তবুও আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আশ্রমে এখন শুধু রাজধানী থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মায়েদের ঠাঁই হয়। কেমন আছেন? জানতে চাইলে জবাব আসে—কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালার মতো অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক! আর্থিক সচ্ছলতায় ভরা সংসারে প্রার্থিব সুখ পেয়ে এবং স্বজনদের কাছ থেকে ছিন্ন হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সংযোগের সেতুবন্ধন। অনিশ্চয়তা, উত্কণ্ঠা, শঙ্কায় নিজের ঘরও হয়ে উঠেছে পরবাস। চারপাশটা কেবলই ফাঁকি আর মমতার ফাঁদ! মন তখন খুঁজে বেড়ায় একটা আশ্বাস—আশ্রয়, নির্ভরতা আর শুশ্রূষা। সারাজীবন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সহায়-সম্পত্তি, ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে শেষ আশ্রয় হয় রাজধানীর আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমে—আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলেন নার্গিস সুফিয়া আক্তার। রংপুরের বাসিন্দা সুফিয়ার (৫৫) স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন (নাম প্রকাশ করতে চাননি)। এক ছেলে লেখাপড়া শেষে বাবা-মাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হলেন; তিন মেয়ে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রতাপশালী স্বামীর আত্মম্ভরিতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় দেখে মন বলে ওঠে বিকল্প পথ খুঁজি! পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল মানুষ দুটি রিক্ত জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নির্জনে একাকীত্ব বেছে নিলেন। বিস্তৃত ও নিজস্ব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন সুফিয়া। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ছাদের নিচে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা ইট-পাথরের দেয়াল। কথাগুলো বলতে বলতে তার বুকের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ওঠে। চোখের পানি আড়াল করতেই দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ সুফিয়া খাট থেকে নেমে সামনের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ান। শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ে; কিন্তু মনে করতে চাই না! কারও কাছে তো হাত পাততে হয় না। তবুও জোর করেই মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনা উঁকি দেয়। সব ভুলতে চাই। কাউকে চাই না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের হোমিও (অবসরপ্রাপ্ত) ডাক্তার ছেলেমেয়ের রক্তচক্ষুর ভয়ে নাম বলতে চাননি অশীতিপর ওই বৃদ্ধা। সংসারে দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের অভ্যস্ততা তার সংসারে কাল হলো। তার দায়িত্বশীলতা ছেলেবউয়ের কাছে একরকম নাক গলানোর মতো! যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সংসার জীবনে টুকটাক অশান্তিতে তার জন্য প্রায় ৫০ বছর বয়সী ছেলে জায়গা করে দিল বৃদ্ধাশ্রমে। অভিমানী স্বরে বললেন, ‘ছেলে যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক, আমার সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি ও কখন আমার সামনে আসবে!’ চোখ ছলছল করে ওঠে। নীরব থাকেন কিছুক্ষণ। কোনো সমস্যা নেই বললেও কথায় কথায় অনেক কিছুই বললেন। তার কষ্টটা বুকে চেপে রেখেছেন একরকম জোর করেই। এ প্রতিনিধি চলে আসতে গেলে হাত বাড়ান। তার চোখের ভাষা বলে দেয়—আরও একটু থাকো পাশে, সময় যেন কাটে না! স্বামীহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত পল্লবীর নার্গিস জাহানের মলিন পোশাক। ‘তবুও এই বেশে ভালো আছি। সংসারে একটা মেয়ে। কিছুদিন ছিলাম। তারপর মায়ের আর জায়গা হলো না মেয়ের কাছে’—বললেন তিনি। ভাগ্যপীড়িত করুণ নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গে মোকাবিলায় মানসিক দৃঢ়তা তার মধ্যে। আবুজর গিফারি কলেজের প্রাক্তন এক প্রভাষকের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিমানে সংযত আবেগ—‘এইতো এখানে রেখে খাওয়া-পরার খরচ দিচ্ছে। প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। ভালো না বাসলে কী আর এত খরচ ছেলেমেয়েরা দেয়? তারা দেশে নেই। ভালো হয়েছে, দেশে তো এখন স্বাভাবিক মৃত্যুরও গ্যারান্টি নেই। দু’বছর আগেও তাদের কথা মনে করে কষ্ট হতো। এখন হয় না। যে যেখানেই থাকুক, তারা যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ তবে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমের মায়েরা জানান, এখানে এত লোক আসে। তারা প্রত্যেকই অনেক বয়সী এবং অসুস্থ। এখানে এটাস্টড বাথরুম না থাকায় কষ্ট হয়। রাতে কেউ কেউ অন্ধকারে পড়ে যান। একজন জানান, ক’দিন আগে অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তারা এটাস্টড বাথরুম এবং খাবারের মানটা আরও একটু ভালো করার আহ্বান জানান।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে থাকা বৃদ্ধ নারগিস জাহানের (৭০) মুখোমুখি হতেই তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অবুঝ অসহায় শিশু সন্তানটির ঊনিশ থেকে বিশ হলে যে মায়ের খানাদানা, ঘুম হারাম হয়ে যেত, সেই মাকে ৭ বছর ধরে দেখতে আসেনি তার হতভাগ্য সন্তান। শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ২৯ বছর। ছেলেমেয়েদের নাম পরিচয় অথবা তারা কে কি করছেন তা না জানিয়ে শুধু বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের দেখতে চান। ৪০৬ নম্বর রুমে নিবাস তার। ভীষণ অসুস্থ, বিছানায় শুইয়ে আছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। সন্তানরা যেমন দেখছেন না, তেমনি কোন স্বজন অথবা সহৃদয় সুজনের সাহায্যও মিলছে না।
নারগিস সুফিয়া (৬৬) আর এক মা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে কি যেন বলছিলেন। দু’পায়ে পানি জমে ফুলে রয়েছে। কোমরে দারুণ ব্যথা। স্বামী পুলিশের এসপি ফজলুল হক বসুনিয়া ১৯৯৮ সালে মারা যান। ৫ বছর ধরে প্রবীণ নিবাসে আছেন। একমাত্র ছেলে সাইফুল হক বসুনিয়া ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়ায় জীবনযাপন করে সম্প্রতি সস্ত্রীক দেশে ফিরেছেন। মাকে দু’বার দেখতে এসেছিলেন ফলমূল নিয়ে। নারগিস সুফিয়া জানান, ভয় পান চোখের পানি ফেলতে গিয়ে, শুনেছি চোখের পানি নাকি সন্তানদের অমঙ্গল ডেকে আনে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। তিনি চান তার সন্তানের মঙ্গল। ফলমূল নয়, শেষ বয়সে ছেলের সঙ্গে থাকতে চান তিনি।
মীরা চৌধুরী জানালার গ্রিল ধরে বাইরের সবুজ চত্বরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার বয়স ৭৭ বছর, মা, কেমন আছেন বলতেই মুখ ঘুরিয়ে নির্বাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ব্যথিত কণ্ঠে জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্বামী জোসেফ চৌধুরী প্রায় ৮ বছর আগে মারা গেছেন। জীবনে যা কিছু গড়েছেন সবই একমাত্র সন্তানকে দিয়েছেন। এখন তিনি একা। তার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই। থাকছেন এ প্রবীণ নিবাসে। ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী আমেরিকায় থাকেন। ছেলের মুখখানা দেখতে বড়ই ইচ্ছে করে তার। ভাতের লোকমা মুখের কাছে নিতেই সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গলা দিয়ে খাবার নামে না।
দিলরুবা মাসুদ নামে এক মা চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এ নিবাসেই মারা যান। ৭ বছর এ নিবাসে ছিলেন। ছেলে সৌদ আল মাসুদ আমেরিকা প্রবাসী। নিবাসে থাকা অবস্থায় ছেলে কোনদিনই মাকে দেখতে আসেননি। খোঁজও নেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবাসে কর্মরত একজন বলেছেন, দিলরুবা মাসুদ অনেক দিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য শুধুই কাঁদতেন। এভাবেই কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। নিবাসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জানান, সন্তান সব সময় সন্তান। তাই তাদের নাম বলছি না। তারা অসম্মানিত হলে বড়ই কষ্ট পাব। তারা ভালো থাকুক এটাই খোদার কাছে দোয়া করি। সাংবাদিকদের জন্য তাদের বকা শুনতে হয়। সন্তানরা রাগ করেন। সন্তানরা নিষেধ করে দিয়েছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। কোনভাবেই যেন তারা তাদের ছবি তুলতে না পারে তাও বলে দিয়েছে। মলিন মুখে তিনি বলেন, বেশ ভালোই আছি বাবা। সন্তানরা ভালো থাকুক, প্রত্যেক মা-ই তো তাই চান।
লেখক : এম ইউ আলম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
 http://studentbd24.com/?p=9645

শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থায় বিপন্ন মেধাবীরা


আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ১২-০৭-২০১৩

স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সব বেসামরিক সরকারি চাকরির নিয়োগস্তরে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের পর সরকার এসেছে আর গেছে। কিন্তু কোনো না কোনো পরিবর্তিত রূপে তা রয়েই গেছে। বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে এ কোটাগুলোর অনুপাত। বর্তমান সরকারের আমলে আরও একটি নির্মম নিয়ম চালু করা হয়েছে যে এ ধরনের প্রাধিকার কোটায় কোনো প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো খালি থেকে যাবে। আর তা থাকছেও। মেধাবী প্রার্থী প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেধাতালিকায় ওপরের দিকে স্থান পেয়েও চাকরি পাবে না। অধিক হারে চাকরি পাবে কম মেধাবীরা, প্রাধিকার কোটার বদৌলতে। আর তাদেরও খুঁজে না পাওয়া গেলে পদ খালি রাখা হবে। প্রশাসনব্যবস্থায় এটাকে একটা নির্দয় প্রহসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তবে ৩৪তম বিসিএসে কোটাব্যবস্থার প্রয়োগে আরেকটি নতুন মাত্রা দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি হচ্ছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় অতি নিম্নে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটাভুক্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। পক্ষান্তরে মেধাতালিকার অনেক ওপরে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটা-বহির্ভূত প্রার্থীরাও লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়নি। জানা গেল, সরকারি কর্মকমিশনের যুক্তি, প্রাধিকার কোটা পূরণ নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। তবে চতুর্মুখী ব্যাপক সমালোচনা ও পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে এ ফলাফল আপাতত বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। বোধোদয় দেরিতে হলেও না হওয়ার চেয়ে ভালো। ধন্যবাদ, সরকারি কর্মকমিশনকে। প্রকৃতপক্ষে নিয়োগ পর্যায়েই কোটা প্রয়োগ হওয়া স্বাভাবিক। আর বিসিএস পরীক্ষায় সে পর্যায়টি আসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকা তৈরির পর। সুতরাং আকস্মিকভাবে প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকে এটাকে প্রয়োগ করা হলে বঞ্চিত ব্যক্তিরা সংক্ষুব্ধ হবেই। তবে এই ক্ষোভের নামে বিশৃঙ্খলা কিংবা জনদুর্ভোগ কাম্য নয়।
এখন কোটাব্যবস্থার বিন্যাসটা একটু আলোচনা করা যাক। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য, জেলা, মহিলা ও উপজাতি কোটার অনুপাত যথাক্রমে ৩০, ১০, ১০ ও ৫। অর্থাৎ একুনে ৫৫। তাহলে মেধা কোটায় রইল শতকরা ৪৫ শতাংশ। চার দশকের অধিককাল এভাবে সরকারি চাকরিতে কোটার জোরে অধিক সংখ্যায় কম মেধাবীদের চাকরি পাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ আর কলেজশিক্ষকসহ সব ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ। প্রয়োগ করা হয়েছে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও। ফলে এসব পদে মেধাশূন্যতার অভিযোগ আসা অমূলক বলা যাবে না।
এবার দেখা যাক এ কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা। স্বীকার করতেই হবে, এর একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যেমন—ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে উচ্চতর পদে প্রথমে ভারতীয়দের জন্য, পরে মুসলমানদের জন্য আর পাকিস্তান সময়কালে কিছুটা পশ্চাৎপদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত কোটা ছিল। তবে তা সীমিত ছিল উচ্চতর পদেই আর সীমিত আকারেই। তাঁরাও চাকরি পাওয়ার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করার পরেই তা পেতেন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সবার সমান সুযোগ লাভের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে একই অনুচ্ছেদের তিন উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান রাখার কথাও রয়েছে। ওপরে যে প্রাধিকার কোটাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই কি এ অনগ্রসর নাগরিকদের পর্যায়ে পড়ে? তাহলে কোন যুক্তিতে অধিকাংশ প্রার্থীকে ‘সকলের সমান সুযোগ লাভের’ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? আর সুবিধাভোগী কারা, তাও কিন্তু দেখার বিষয়। এ বিষয়ে অনেক আলোচনা, সেমিনার, গোলটেবিল আর লেখালেখি হয়েছে। এগুলোর পক্ষে জোরালো কেন, দুর্বল কোনো যুক্তি নিয়ে কেউ অবস্থান নিতে পারে না। নেওয়া হয় আবেগের আশ্রয়। মনে হচ্ছে যুক্তি-তর্ক সবই অরণ্যে রোদন।
এবার প্রাধিকার কোটার সংখ্যাটি বিশ্লেষণ করার থাকে। মহিলা ও উপজাতিরা সমাজে এখনো অনগ্রসর। আরও কিছুদিন যেকোনো অনুপাতে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জেলা কোটাটির বিভাজন একটি জটিল ব্যবস্থা। আর্থসামাজিক বিবেচনায় অনুন্নত জেলাগুলোকে গোটা তিনেক গুচ্ছে বিভক্ত করে শুধু তাদের জন্যই প্রাধিকার থাকতে পারে। উন্নত জেলার জন্য তা থাকার কোনো যুক্তি নেই। সবশেষে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যের কোটাটি। প্রথমে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল। এখন তা তাঁদের পোষ্যদের জন্য রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের অবদান বৈষয়িকভাবে কোনো দিন শোধ করা যাবে না। তবে তাঁদের সবাইকে সমাজের অনগ্রসর অংশ বলে চিহ্নিত করা যায়? আর এ ৩০ শতাংশ প্রাধিকার কোটার সুফলভোগীর সংখ্যাও খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের নাম গেজেটভুক্ত করেছে, দিয়েছে প্রত্যয়নপত্র, তাঁদের পোষ্যরাই এর সুফলভোগী। এখন পর্যন্ত এর সংখ্যা দুই লাখের কিছু ওপরে। আবেদন বিবেচনাধীন আছে কয়েক হাজার। সব মিলিয়ে তিন লাখও হয় না। তাদের পোষ্য এর পাঁচ গুণই হতে পারে। তাহলে এ প্রাধিকার কোটাটি যৌক্তিক বলে ধরে নিলেও বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার অনুপাতে শুধু তাঁদের জন্য সব বেসামরিক চাকরির নিয়োগস্তরে ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত রাখাকে কোনো বিবেচনাতেই যৌক্তিক বলা যাবে না। আর এ প্রাধিকার কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ খালি রাখাকেও নির্মমই বলতে হবে। আর প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে এ প্রাধিকার কোটা বারবার খালিই থাকবে? এমনিতেই প্রাধিকার দেওয়া হলো অর্ধেকের বেশি পদে। আবার নিয়োগের নিয়মনীতি থেকে বিচ্যুতির ফাঁকফোকরও খোঁজা হচ্ছে।
পাশাপাশি আমরা দেখি, সামরিক বাহিনীতে সিপাহি পদে নিয়োগে জেলা কোটা অনুসরণ করা হয়। আর অফিসার নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাইয়ে শুধুই মেধা। আর এটাই যথার্থ। সুতরাং তারা কর্মক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতার ছাপ রাখবেই। গোটা জাতি চায় তারা তা রাখুক। পাশাপাশি বেসামরিক চাকরির সব প্রথম শ্রেণীর পদ ও বিচার বিভাগীয় কর্মে একই ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া যৌক্তিক। তবে উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু প্রাধিকার কোটা রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা অনধিক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা সংগত হবে। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার জন্য ছেড়ে দিলে এক দশকের মধ্যে দেশের বেসামরিক চাকরিগুলোতে ইতিবাচক চাপ পড়তে থাকবে।
আমরা কথায় কথায় ভারতের নজির দেখাই। ভারত ব্রিটিশ থেকে প্রাপ্ত তার চাকরি কাঠামোগুলোকে বিবেচনাহীনভাবে বিপন্ন করেনি। অনুন্নত সমপ্রদায়ের জীবনযাত্রার মানকে তারা উন্নত করে চলছে। পাশাপাশি অতি সীমিত সংখ্যায় সর্বভারতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীর চাকরির ভিত্তি পদে নিয়োগে তাদের টেনে আনার কিছু ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু সেসব পদ এ ধরনের সর্বগ্রাসী কোটার বিপরীতে ছেড়ে দেয়নি। ১৯৭৯ সালে অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোকে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি ও সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনার জন্য একজন সাংসদ বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতের ৫৪ শতাংশ মানুষ অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত। মণ্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে প্রদত্ত তাদের প্রতিবেদনে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা আর একই অনুপাতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব করে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এ সুপারিশ বাস্তবায়নের একটি প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। দেশের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় সচেতন ভারতবাসী, এ রিপোর্টটির বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছিল। আর সে অবস্থান ছিল ভারতকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। এর সুফল আজ তারা ভোগ করছে।
অপ্রতুল বেতনাদি ও যুগবাহিত মর্যাদার হ্রাস বিবেচনায় এমনিতেই মেধাবীরা সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। তাঁদের প্রধানত আকর্ষণ করছে পাশ্চাত্যের সুযোগ-সুবিধা। এর পরেই রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিসহ বেসরকারি খাত। তাও পুরোনো ধারাবাহিকতায় কিছু মেধাবী তরুণ-তরুণী চলে আসে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। কিন্তু এখানেও তাদের জন্য তৈরি হয়ে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। শুধু নিয়োগ পর্যায়ে নয়, পদোন্নতি পর্যায়ও তুলনামূলক কম মেধাবীরা (সরকারি কর্মকমিশনের সম্মিলিত মেধাতালিকা বিবেচনায়) রাজনৈতিক আনুকূল্যে টপকে যায় অধিক মেধাবীদের। এমন চিত্র দেখা গেছে সামপ্রতিক কালে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিকালে। সম্মিলিত মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারীদের চেয়ে নিচের দিকে অবস্থানকারীরা প্রাধান্য পেয়েছেন সে পদোন্নতি তালিকায়।
নেতাদের অনেকেই সময়ে সময়ে গণমাধ্যমে সংবিধানের চেতনা সম্পর্কে বলে থাকেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার শুধু চেতনা নয়, সরাসরি আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহের একটি। জেনেশুনে এটাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে দীর্ঘকাল। শুধু বর্তমান সরকার নয়, এর আগের সরকারগুলোও বিষয়টিতে হাত দেয়নি। বর্তমান সরকার দিনবদলের সনদে অঙ্গীকার করেছিল দেশবাসীকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম একটি প্রশাসন উপহার দেওয়ার। সেই প্রশাসন হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ, গতিশীল, আধুনিক ও যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সেই অঙ্গীকারের তেমন কোনো প্রতিফলন জনপ্রশাসনে দেখা যায়নি, বরং বিপরীতটাই দৃশ্যমান হচ্ছে। নিয়োগ পর্যায়ে মেধাবীদের দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাধিকার কোটার নিয়মনীতিকে আরও কঠোর ও সম্প্রসারণ করে কম মেধাবীদের টেনে আনতে সচেষ্ট প্রয়াসই লক্ষণীয় হচ্ছে। তাতে তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশাসন গড়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

মেধাবীদের সামনে অন্ধকার

কোটায় খেয়ে ফেলছে চাকরি



শফিকুল ইসলাম

চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন : নয়া দিগন্ত
সরকারি চাকরি েেত্র কোটাব্যবস্থা তুলে দেয়া অথবা তার সংস্কার করে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে আসার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। প্রায় সব কয়টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ অভিযানে রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, সারা দেশেই বিুব্ধ শিার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। এ আন্দোলন দল ও মতের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেছে। দল ও মতের পরিচয় ঠিকানাবিহীন খেটে খাওয়া প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরাই কোটাব্যবস্থার নির্মম শিকার। নিছক মেধার জোরে উচ্চশিার আঙিনা পেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীায় অবতীর্ণ হতে গিয়েই এসব তরুণ হোঁচট খাচ্ছেন। চাকরি নামের সোনার হরিণ তাদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। মেধা আর কাজে আসছে না। ফলে মেধাবীদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। কোটায় কোটায় ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে সব পদ। বিুব্ধ, হতাশ, ক্রুদ্ধ তরুণেরা তাই রাজপথে নেমে এসেছেন। কী কারণে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও কোটার বি¯তৃতি বাড়ছে; সে এক অজানা রহস্য। সাদা চোখে দেখলে মনে হয় এসবই রাজনীতির কূটকৌশলের ফল। প্রশ্ন উঠেছে, মেধাবীরা যাবেন কোথায়? শ্রম ঘামে অধ্যবসায়ে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার কাজে না লাগলে তারা কী করবেন? যোগ্যরা স্থান না পেলে অযোগ্যরাই দখল করবেন সারা দেশ, যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে সরকারি চাকরি েেত্র ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ৫৬ শতাংশ কোটার সুবিধাভোগী। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধার বাইরে। প্রশাসনে ভারসাম্য রার জন্য কোটার প্রচলন করা হলেও এ ব্যবস্থা এখন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিতি তরুণেরা। আবার কোটার সুবিধাভোগ নিয়ে দুর্নীতিরও শেষ নেই। দেদার অপব্যবহার হচ্ছে এ ব্যবস্থার। এখানে ভারসাম্য রার কোনো বন্দোবস্ত নেই। দেশে শিল্পের বিকাশ নেই। কর্মমুখী শিাব্যবস্থা সঙ্কুচিত। উচ্চশিিিত তরুণদের নিছক শ্রমিক হয়ে প্রবাসে পাড়ি দেয়ার ঘটনা ভূরি ভূরি। এসএসসি কিংবা এইচএসসি উত্তীর্ণ পদের বিপরীতে মাস্টার্স উত্তীর্ণদের দরখাস্ত দেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সরকারি চাকরির েেত্র একটি পদের বিপরীতে প্রার্থী থাকেন কয়েক হাজার। প্রতিটি স্তরেই মেধা ও যোগ্যতার স্বার রাখতে হয়। প্রাথমিক বাছাইয়েই যদি কোটার আগ্রাসন শুরু হয় তাহলে সেসব প্রতিযোগীর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। শিার্থীরা এটাকে রাষ্ট্রের নির্মম আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে এ বিষয়গুলো নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি উচ্চ পদে চাকরিতে নিয়োগকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যদের বাছাই করে নিয়োগ দেয়া। কিন্তু গত কয়েক বছরে পিএসসির কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিরপেতা বজায় রাখতে পারেনি বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি পরীার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় কর্তৃপ তা বাতিলও করে দেয়। এসব ঘটনা মেধাবী শিার্থীদের উদ্যম নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়েছে। এর ওপর কোটার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। বর্তমানে বিসিএস পরীার মাধ্যমে উত্তীর্ণরা নিয়োগের জন্য যেসব কোটার মুখে পড়েন সেগুলো হচ্ছেÑ মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা ৩০ ভাগ, মহিলা ১০ ভাগ, জেলা ১০ ভাগ, উপজাতি ৫ ভাগ ও প্রতিবন্ধী ১ ভাগ। জেলা কোটার মধ্যে আবার সব জায়গা একরকম অগ্রসর না হওয়ায় সুষম বণ্টন নেই। বেশ কয়েকটি জেলা আছে যেখানকার অধিবাসীরা উত্তীর্ণ হয়েও ছিটকে পড়ছেন। জেলার কোনো কোটা না থাকায় মেধাবী হয়েও তারা চাকরি পাচ্ছেন না। আগে সনাতন ক্যাডার সার্ভিসে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদে কোটাপদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি শিকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, প্রাণিসম্পদ সার্ভিসেও কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে কঠোরভাবে। অধস্তন বিচার বিভাগ বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে কিছুদিন আগেও মেধাবীরাই চাকরি পেতেন। সম্প্রতি এখানেও কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিচার বিভাগেও এখন কোটার ভিত্তিতে চাকরি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩১তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৭৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়। অথচ সম্মিলিত মেধা তালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেক প্রতিযোগীই চাকরি পাননি। কারণ মেধা থাকা সত্ত্বেও কোনো কোটার মধ্যে না পড়ায় তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। ২৯তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে ৪১২ জনের মধ্যে ২১১ জন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। আর মাত্র ২০১ জন নিয়োগ পেয়েছেন মেধার ভিত্তিতে। ২৮তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডার সার্ভিসে ৬৫৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এর মধ্যে ৩৪৭ জনই বিভিন্ন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি রাখা হয়। ৩২তম স্পেশাল বিসিএসে শুধু মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও উপজাতি কোটাধারীরাই চাকরি পেয়েছেন। অবাক করা ঘটনা ঘটেছে ৩৪তম বিসিএসে। পিএসসির এ পরীায় প্রিলিমিনারিতেই কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ কোটার বাইরে কোনো শিার্থী প্রাথমিক যোগ্যতা যাচাইয়েরও সুযোগ পাননি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই শিাবিদ। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরই এসব নিয়োগ দেয়া হতো। কখনো কখনো পদস্থ আমলা এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ক্যাডারের প্রার্থী বাছাইয়ে ওইসব ক্যাডার সার্ভিসে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ বোর্ডে সমন্বয় করা হয়েছিল। কিন্তু এবারই প্রথম পুলিশ সার্ভিস থেকে এনে একজনকে পিএসসির সর্বোচ্চ পদে বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশনে বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ নিযুক্ত ১৪ জনের ১৩ জনই সরকারি দলের কট্টর সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ অতীতে কখনো হয়নি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীার পর কোটাব্যবস্থার সমন্বয় করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হতো। কিন্তু এবার যে বিষয়টি করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে এখন যে আন্দোলন শুরু হচ্ছেÑ এ বিষয়ে ড. ফায়েজ বলেন, চাকরিতে কোটাব্যবস্থা থাকবে কি না এ ব্যাপারে সরকার এবং পিএসসিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসির এক সাবেক চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেন, পিএসসি এবার যেভাবে ফল প্রকাশ করেছে তা ঠিক হয়নি। প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ একেবারেই অযৌক্তিক। তিনি বলেন, পিএসসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এখন আর চাকরি পাওয়ার মতো নেই। অনেকের ছেলেমেয়েও বয়স্ক হয়ে গেছেন। তাদের নাতি-নাতনীদের কোটায় চাকরি দেয়া অযৌক্তিক। সুতরাং এখন এ কোটা সীমিত করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত। তবে রাজনৈতিক কারণে কোটাব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা প্রশাসনের সবচেয়ে ভালো ক্যাডারগুলোতে কোটায় চাকরি পান। ফলে মেধাবীরা বঞ্চিত হন। যদি এক হাজার পরীার্থী হয় এর মধ্যে ৩০০ জন হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। কিন্তু সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই শ’ কোটায় পাওয়া যায়। আর বাকি পদগুলো শূন্য থেকে যায়। ফলে প্রকৃত মেধাবীরা আসেন না। তবে ওই সরকারের আমলে তিনি কোটাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন বলে জানান সাবেক ওই চেয়ারম্যান। অন্য দিকে কোটার কারণে পড়ে থাকা শূন্য পদগুলো মেধাবীদের থেকে ‘বিশেষ মেধা‘ দিয়ে পূরণ করার কথা বলেন তিনি।

সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ ধর্ম-অধর্মের নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ


মাসুদা ভাট্টি
শাহবাগের আন্দোলনকে এখন বহুধাবিভক্ত করে এর ভেতর থেকে ‘ফায়দা লুটেরাশ্রেণী’ এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিশেষ করে শাহবাগের আন্দোলনে ধর্মকে ব্যবহারের যে নগ্নতা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এদেশে বহু পুরনো ও বহু ব্যবহৃত একটি কৌশল। মজার ব্যাপার হলো, দেশে দেশে এই কৌশল পুরনো হলেও বার বার ব্যবহৃত হয় এবং জনগণকে উস্কানি দিতে এর চেয়ে চরম কোন পথ আর নেই বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তান আমলে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে কলকাতার ৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় হাত রাঙানো ও অভিজ্ঞ মিনা পেশোয়ারীকে ঢাকায় ভাড়া করে এনেছিল পাকিস্তানী শাসককুল এবং তারই হাতে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আজকে হয়ত পাকিস্তানী শাসককুল নেই, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা রয়েছে; রয়েছে তাদের বেতনভুক কিছু রাজনৈতিক দলও, আজকে যাদের মিনা পেশোয়ারীকে ভাড়া করার নেই। কারণ এ দেশের ভেতরই রয়ে গেছে মিনা পেশোয়ারীর মতো ভয়াবহ দজ্জালের বংশধর, যারা পত্রিকার পাতায় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম ও অ-ধর্মের আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। আমরা এ রকম ঘটনা দেখেছি ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে, যখন ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ নামে টিভি-অনুষ্ঠান নির্মাণ করে এক হাতে কোরান শরীফ আরেক হাতে গীতা নিয়ে মানুষের সামনে দেখানো হয়েছে কারা ক্ষমতায় গেলে কোন্্ ধর্মগ্রন্থ প্রাধান্য লাভ করবে এবং মানুষকে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলু ধ্বনি শোনা যাবে। আজও তারাই নেমেছে শাহবাগ থেকে ইসলাম-আক্রান্ত হচ্ছে বলে ন্যক্কারজনক প্রচারণায়। বিশেষ করে গত শুক্রবার থেকে এই প্রচারণার ফলেই শাহবাগ আন্দোলন এখন বলতে গেলে বেশ বড় ধরনের হুমকির মুখোমুখি। গত সপ্তাহে আমার কলামের পাঠকদের আমি এই ভয়ের কথাটিই বলতে চেয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা এত তাড়াতাড়িই ফলে যাচ্ছে দেখে আমি রীতিমতো শঙ্কা বোধ করছি।
শাহবাগ কোন দীর্ঘ প্রস্তুতিময় আন্দোলন নয়, বরং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি বহুত্ববাদী আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই এ রকম আন্দোলনে ‘নানা মুনি নানা মত’ থাকে এবং এখানেও রয়েছে। কিন্তু একটি জায়গায় এই আন্দোলন তীব্র ও সংগঠিত আর তা হলো, দেশে যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের মতো ইসলাম-ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিষিদ্ধ করা। এই দুই শক্তিশালী দাবি এখন সময়ের, এবং শাহবাগ তা প্রমাণ করেছে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এই দাবি জনগণের এবং জনগণ এই শাহবাগে এসে রাজনৈতিক অবস্থান বা বিশ্বাস থেকে নয়, বরং আত্মার দাবি হিসেবে এই দু’টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং এই দাবি কেবল সরকারের কাছে নয়, বরং দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির কাছেই। জনগণ প্রতিনিয়ত বলছে যে, আপনি যে দলের রাজনীতিই করুন না কেন, আপনি যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারবেন না; আপনাকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবির সঙ্গে একমত হতে হবে। অপরদিকে তারা সরকারকে বলছে যে, এই দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার কিন্তু শাহবাগের এই প্রাণের দাবিটি ঠিকই বুঝেছে এবং সে অনুযায়ী কাজও করছে বলে মনে হয়। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে যে, আসলে সরকার কতটা আন্তরিক? আমরা জানি যে, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও আমরা বহু সময় পার করেছি কিছুই না করে; এমনকি বিচার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়েও আমরা অযতœ-অবহেলা লক্ষ্য করেছি। শুধুমাত্র বিচার প্রক্রিয়া শুরু করাই মুখ্য নয়, এই বিচার থেকে যেন যুদ্ধাপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পায় তাও নিশ্চিত করাটা সরকারেরই দায়িত্ব। কারণ এই সরকার তো কেবল একটি ‘সরকার’ নয়, বরং এই সরকার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার; এই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। মানুষ তাই এই সরকারের কাছে অনেক বেশি কিছুই আশা করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো, শেখ হাসিনা সরকারের অন্য অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিও মানুষ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে রাজি, যদি এই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইস্যুর চিরস্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হয়। যে কারণে মানুষ শাহবাগ আন্দোলনকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, অহিংস এবং দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ধরে নিয়ে এতে অকাতরে অংশগ্রহণ করেছে। এখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই রয়েছে এবং গত সপ্তাহেই বলেছি যে, এই আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে; এটি কেবলমাত্র ব্লগারদের আন্দোলন নয়। গত সপ্তাহের লেখায় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামটি উল্লেখ করতে ভুলে যাওয়ায় আজকের লেখায় আমি সে ভুল স্বীকার করছি এবং একথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই যে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এই আন্দোলন সর্বজনীন রূপ লাভ করেছিল এবং এই শাহাবাগেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিন্তু কথা হলো, আমরা আন্দোলন করছি ঠিকই; তবে আমাদের শত্রুপক্ষের ক্ষমতাকেও আমরা কোনভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না এবং দেখা উচিতও হবে না। কারণ আমাদের শত্রুরা আসলে কেবলমাত্র মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরুদ্ধবাদী, তাই-ই নয়; তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেরও শত্রু। সুতরাং তারা তাদের অবস্থানকে নিশ্চিত রাখার জন্য প্রয়োজনে যে কোন পথ গ্রহণ করবে; এখানে রগকাটা, গলাকাটা কিংবা বোমা হামলা তুচ্ছ ঘটনা মাত্রÑ এসব সবই এতদিন তারা ঘটিয়েছে অনায়াসে। এখন তারা আরও শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ়। সুতরাং তাদের নতুন পথ ও কৌশল ধরতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না, হচ্ছেও না। মজার বিষয়টি হচ্ছে, তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করেছে ঠিকই, কিন্তু যখনই শাহবাগের আন্দোলন তাদের দেশব্যাপী বিপদে ফেলেছে তারা ঠিকই বিএনপিকে পুরোপুরি নিজেদের করে ফেলতে চাইছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আদৌ থাকবে কি না? যদি সরকার আসলেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সেক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক অপশক্তিটি কোন্্ প্ল্যাটফরমে গিয়ে ঠাঁই নেবে? স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র কথাটি এসে যায়। কেউ কেউ একথাও বলতে শুরু করেছেন যে, আজকে যে বিএনপি আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা আসলে খোলশ মাত্র, এই খোলশের ভেতর আসলে পুরোটাই জামায়াতি রাজনীতির শক্তিটি বোঝাই হয়ে আছে। কথাটি খুব যে অসত্য তাই-ই বা বলি কি করে? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো বা ছিঁড়ে ফেলা কিংবা শহীদ মিনার ভাঙার মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের নিন্দা না জানিয়ে তারা জামায়াতের হরতালে সমর্থন দিচ্ছে নির্দ্বিধায়। শাহবাগের আন্দোলনকে তারা নাটক বলে যাচ্ছে কোন রকম রাখঢাক না রেখেই। এর পর আসলে আমাদের তো আর অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকেই না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় যে, এত বড় গণজাগরণকে অস্বীকার করে বিএনপির মতো ভোটের রাজনীতি করা রাজনৈতিক দল যে ভুল করছে সেটা কি দলটির নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না? নিশ্চয়ই পারছেন। কিন্তু তারা হয়ত স্ট্রাটিজি ঠিক করে উঠতে পারছেন না, যা এই মুহূর্তে খুবই জরুরী।
শুরুতেই যে কথা বলছিলাম যে, শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম-বিরোধী বলে আজকে যে চক্রান্ত চলছে তাতে অনেকেই পা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেনও। কারণ ধর্ম হচ্ছে এমনি একটি স্পর্শকাতর বিষয় যার অপব্যাখ্যা-অপব্যবহার করে সুস্থ বিবেককে অসুস্থ আর অস্থির করে তোলা যায়। এ কারণে আমি মনে করি যে, আজকে যারা এই নিন্দার্হ উস্কানি দিয়ে চলছে তাদের অবিলম্বে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং শাহবাগও এই দাবিটিই সরকারের কাছে বিগত সপ্তাহভর করে আসছে। ব্লগার রাজীবকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে চক্রান্তের উদ্বোধন হয়েছে তা শেষ হবে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দিয়ে এবং তা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিন্দনীয় করে তুলবে, সন্দেহ নেই। অনেক বিশ্লেষকই একথা বলতে চাইছেন যে, সরকারের জন্য শাহবাগ আন্দোলন একটি বড় সহায়ক-সিগন্যাল। কারণ মানুষ সরকারের চাওয়াটাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু এটাকে যদি ঠিকভাবে সমাপ্তির দিকে টেনে নেয়া না যায় তাহলে এই সিগন্যালই জনগণকে ভুল সংকেত দেখাতে শুরু করবে। জাহাজ যেমন ঝড়ের রাতে বাতিঘরের দেখানো আলোয় কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই পোতাশ্রয়ে স্থান করে নেয় তেমনই শাহবাগ নামক বাতিঘর থেকে দেখানো আলোয় সরকার যদি নিরাপদে আশ্রয় খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশ নামক এই নৌকোই পড়বে এক তীব্র ঝড়ের মুখে, আসলে আমরা এখনই এই ঝড়ের ভেতর অবস্থান করছি বটে। এই ঝড়কে আরো জোরদার করে তুলছে ধর্মীয় উস্কানি, অপরাজনীতির নোংরামি, স্বাধীনতা-বিরোধীদের অপকৌশল, লোক দেখানো মুক্তিযুদ্ধবাদীদের মিথ্যাচার ইত্যাদি নেতিবাচক প্রপঞ্চসমূহ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এর সঙ্গে যদি রাষ্ট্রের কোন কোন চালিকাশক্তির সরকারবিরোধী অংশ যোগ দেয় (ইতোমধ্যেই আমরা তাদের যোগ দেয়ার বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি) তাহলে যে ভয়ঙ্কর দানবীয় শক্তির উত্থান ঘটবে তার সঙ্গে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। এখনই যে যুদ্ধটিকে শাহবাগপন্থীরা বলছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, সুরের বিরুদ্ধে অসুরের যুদ্ধ, অপরপক্ষ তাই-ই দমাতে চাইছে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার এই ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষটিকেই আরও শক্তিশালী করতে না পারলে নিরস্ত্র শাহবাগপন্থীরা তো রাজীবের মতো বলি হতেই থাকবে, নয় কি? সত্য প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে সত্যের পথকে নির্বিঘœ করার পুরস্কার সরকার নিশ্চিতভাবেই পাবে কিন্তু পুরস্কার লাভের জন্য সব সময়ই যে কঠিন পথ পার হতে হয়, প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের সেই সত্যটা জানা আছে তো?
ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ॥ সোমবার ॥ ২০১৩ ॥
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ।
সধংঁফধ.নযধঃঃর@মসধরষ.পড়স