আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে। ‘রোগ সারলেও তার প্রতিক্রিয়া অনেকদিন দেহে থাকে।’ কথাটি যে সত্য তা রাজনৈতিক রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। বাংলাদেশে এক এগারোর সময় ‘মাইনাস টু’ নামে যে থিওরিটি গজিয়ে উঠেছিল, আসলে তা ছিল দেশের রাজনীতির শরীরে একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগটি আপাতত সেরে গেছে। কিন্তু রোগের প্রতিক্রিয়া থেকে দেশের রাজনীতির শরীর মুক্ত হয়নি।
তার প্রমাণ, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের সভাপতি এবং সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনুর বারম্বার আহ্বান বা দাবি জানানো। আমার ধারণা, এক এগারোর সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টাকে যেমন মাইনাস টু থিওরি আখ্যা দেয়া হয়েছিল, তেমনি এখন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার জন্য হাসানুল হক ইনু একাধিকবার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে মাইনাস ওয়ান থিওরি আখ্যা দেয়া যেতে পারে। আগের মাইনাস টু থিওরিটি (আসলে সেটিও ছিল মাইনাস ওয়ান থিওরি। টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা) যেমন কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, তেমনি বর্তমানের মাইনাস ওয়ান থিওরিটিও খালেদা জিয়া বিবেচনা করবেন অথবা কার্যকর করা যাবে, তা আমি বিশ্বাস করি না।
আগের মাইনাস টু থিওরির উদ্ভাবক হিসেবে দেশের সুশীল-কুশীল সমাজ, হতাশ ও ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতালোভী একশ্রেণীর সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পুরস্কারের অধিকারী, কিন্তু নিজ দেশে একঘরে এমন অনেক ব্যক্তি ও মহলের কথা আমরা জানি। কিন্তু জাসদ নেতার একক প্রচারিত এই থিওরির উদ্ভাবক কেবল তিনি নিজে, না এর উদ্ভাবনার পেছনে আরও কারও মাথা কাজ করছে তা আমি জানি না।
হাসানুল হক ইনু এর আগেও একবার বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ত্যাগে বাধ্য করবেন। কিভাবে করবেন সেই পন্থাটির কথা তখন তিনি প্রকাশ করেননি। এবার তার দাবি বেগম জিয়াকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদী মৌলবাদ এবং যুদ্ধাপরাধী এই তিন অশুভ চক্রের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। নতুবা তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। গত ৯ জুন শনিবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কালো পতাকা মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘর্ষময় করে তোলার জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গী মৌলবাদ, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র।’ অতঃপর খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনি এই অশুভ তিন চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। অবিলম্বে এদের সঙ্গ বর্জন করুন। নতুবা রাজনীতি থেকে বিদায় নিন।’
এই সমাবেশে ‘বেগম খালেদা জিয়া ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন’ এই কথা লেখা ব্যানার টানানো হয়েছিল এবং সমাবেশ শেষে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর কুশপুত্তলিকায় এলোপাতাড়ি লাথি মারা ছাড়াও তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। সমাবেশে জাসদ নেতা আরও বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার পৃষ্ঠপোষক হলেন খালেদা জিয়া। তাঁর কারণেই এরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। খালেদা জিয়া নিজের ঘাড় থেকে চিরদিনের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিদায় না দিলে সংঘর্ষের রাজনীতি বন্ধ হবে না। রাজনীতি করতে চাইলে খালেদা জিয়াকে এদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে আসতে হবে। তিনি যদি তা না করেন তাহলে তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।’
হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সঙ্গে দেশের অনেকের মতো আমিও সহমত পোষণ করি। তার দাবিটিও সঠিক। কিন্তু তার দাবি আদায়ের পন্থাটি সঠিক নয়। খালেদা জিয়াকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলা হলেই তিনি তা করবেন অথবা জাসদ সভাপতি দলীয় মিছিলে বা মিটিংয়ে বক্তৃতা করলেই খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন এটা ভাবা ভাবালুতা, বাস্তবতা নয়। রাজনীতিতে এই ধরনের দাবি চমক সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু দাবি আদায়ের পন্থা হতে পারে না।
এক এগারোর সময় মইন-ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং বন্দুক দুই-ই হাতে নিয়ে মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নে নেমেছিলেন। শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে বিদেশে আটকে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং বেগম জিয়াকে তো প্রায় চৌদোলা করে সউদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সউদি সরকার চালাকি করে বেগম জিয়াকে ভিসা প্রদান আটকে না দিলে বেচারীকে তখন হয়ত রিয়াদে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে গিয়ে থাকতে হতো।
মাইনাস টু থিওরি সফল হয়নি। কারণ দেশের মানুষ তা চায়নি। বরং ক্ষমতায় অবৈধ প্রয়োগ দ্বারা এই থিওরি কার্যকর করতে গিয়ে মইন-ফখরুদ্দীন দু’জনেই বাংলাদেশে মাইনাস হয়ে গেছেন। একজন অসুস্থ এবং স্বেচ্ছাগৃহবন্দী এবং অন্যজন বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত। এখন হাসানুল হক ইনুর মতো এক বাম রাজনীতির নেতা, যার হাতে সরকারী ক্ষমতাও নেই, তিনি কেবল দলীয় সভায় বক্তৃতা দিয়ে কিংবা আসর গরম করার মতো দাবি তুলে তার মাইনাস ওয়ান (খালেদা জিয়া) থিওরি সফল করতে পারবেন কি?
আমার ধারণা, সে আশা তিনি নিজেও করছেন না। তাহলে এই মুহূর্তে দেশের জনজীবনে এত সমস্যা থাকতে তিনি খালেদা জিয়াকে একটি ইস্যু করে একটি অবাস্তব দাবি তুলে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন কেন? নাকি তিনি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় কিছু চটকদার দাবি তুলে দেশের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দাবির দিকে সরাতে চান এবং একই সঙ্গে চান মহাজোটের নেত্রীকেও খুশি করতে?
উদ্দেশ্য যাই হোক, হাসানুল হক ইনু নিজেও জানেন, গণদাবির প্রচণ্ড চাপ ছাড়া তার দাবি বিএনপি নেত্রী কানে তুলবেন না এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরাও এই দাবির কথা শুনে বিচলিত হবে না। তারা জানে, খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভেই তাদের ছাড়বেন না। আর ছাড়তে চাইলেও খালেদা জিয়ার রাজনীতি নেপথ্যে বসে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা তাঁকে ছাড়তে দেবেন না। ইনু কি জানেন না, বর্তমান বিশ্বে ছোট বড় অধিকাংশ দেশের রাজনীতিতে এখনও ব্যক্তি প্রাধান্য থাকলেও সেই ব্যক্তির পেছনে থাকে একটি ইনভিজিবল কোটারি, যারা ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা চক্র, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থ, সুশীল সমাজ অথবা এলিট ক্লাসের সুবিধাভোগী অংশও হতে পারে।
ক্যান্টনমেন্টের এক নিহত জেনারেলের বিধবা স্ত্রীকে (রাজনীতি সম্পর্কে যার কোন ধ্যান ধারণাই ছিল না) রাজনীতিতে টেনে এনেছে এবং ‘দেশনেত্রী’ বানিয়েছে এরাই। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তবায়ন বানচাল করা এবং জাসদ নেতা কর্র্তৃৃক বর্ণিত তিন অশুভ চক্র বিশেষ করে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। এই উদ্দেশে রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। পরে নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে একবার নয়, দু’বার বসানো হয়েছে ক্ষমতায়। তাঁর মাথায় প্রচার প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে দেশনেত্রীর টুপি পরানো হয়েছে।
খালেদা জিয়া বেঁচে থাকতেই তাঁর উত্তরাধিকারীও মনোনীত হয়ে গেছে। সেই উত্তরাধিকারী তাঁরই ‘সুপুত্র’ তারেক রহমান। ক্ষমতায় আসার আগেই তারেক ঘোষণা করেছেন, ‘জামায়াত (৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা) তাদের পরমাত্মীয়, তারা একই পরিবারের লোক।’ এই পারিবারিক বন্ধন মাতা বা পুত্র কেউ ছিন্ন করতে চাইবেন বা পারবেন, তা আশা করা বাতুলতা। কোন কারণে ছিন্ন করতে চাইলে তখন খালেদা জিয়াকে হয়ত নেতৃত্ব থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হবে এবং তারেক রহমানেরও যুবরাজ থেকে রাজা হওয়ার খোয়াব ধূলিসাত হয়ে যাবে।
তখন বিএনপির নেতৃত্বে নতুন নেতা বা নেত্রী আসবেন, এখন অসম্ভব মনে হলেও বিএনপি থেকে সদ্য পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন। তখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাকেই দেশ নেতা বানানো হতে পারে। কেন, পাকিস্তান আমলে তখনকার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রামের যে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দুর্নীতির দায়ে শুধু তার মন্ত্রিসভা থেকে নয়, কনভেনশন মুসলিম লীগ থেকেও বহিষ্কার করেছিলেন, সেই ফজলুল কাদের চৌধুরীকেই কি আইয়ুব খান নিজে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার সময় কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি পদে বসিয়ে যাননি?
আসলে ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যক্তি দৃশ্যত বড়; কিন্তু আসল বড় শক্তি গোত্র। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র এবং তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে যে প্রচ- শক্তিশালী অশুভ গোত্র অথবা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; খালেদা জিয়া এই গোত্রেরই তৈরি নেতা। তিনি এদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন কি করে? হাসানুল হক ইনুর দাবি মেনে তিনি বিচ্ছিন্ন হতে গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।
অশুভ গোত্র বা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া বিচ্ছিন্ন হবেন না। বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি বিচ্ছিন্ন হলে অশুভ গোত্রের অসুবিধা হবে না। তারা নতুন ‘নেতৃত্ব’ তৈরি করবেন। খালেদা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। তবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে যদি দেখা যায়, বিএনপিকে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে জামায়াতকে বর্জন করতে হবে, তাহলে অশুভ গোত্রের নির্দেশেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি এমন একটি কৃত্রিম দূরত্ব সৃষ্টি করবে, যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কিন্তু বঁধূয়ার গোপন পিরিতি অক্ষুণœ থাকবে। নির্বাচনের পর বিএনপি জয়ী হতে পারলে দেখা যাবে কলা আর খোসা আবার এক হয়ে গেছে।
হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের একজন আধুনিক রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের মূল সমস্যাটিকে বিচার করছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস সব কিছু মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বহিঃশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় যে মহাশক্তিশালী ফ্যাসিবাদী দুর্গ গড়ে উঠেছে, একজন ব্যক্তি বা নেতা, তিনি যতই প্রভাবশালী হোন, চলে গেলে বা সরে গেলে সেই দুর্গের তেমন কোন ক্ষতি হবে না।
দেশকে এই ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে নীতিভিত্তিক ও ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দেশের গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নামতে হবে। তারা এ পর্যন্ত এই নীতিভিত্তিক, ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ও আগ্রহের প্রমাণ দেখাননি। সেই আন্দোলন গড়ে না তুলে প্রেসক্লাবের সামনে দলীয় সমাবেশ ডেকে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর চটকদার দাবি জানানো তালগাছের সামনে একা দাঁড়িয়ে তাকে মাথা নোয়ানোর অনুরোধ জানানোর মতো।
লন্ডন ২০ জুন, বুধবার ॥ ২০১২ ॥
বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে। ‘রোগ সারলেও তার প্রতিক্রিয়া অনেকদিন দেহে থাকে।’ কথাটি যে সত্য তা রাজনৈতিক রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। বাংলাদেশে এক এগারোর সময় ‘মাইনাস টু’ নামে যে থিওরিটি গজিয়ে উঠেছিল, আসলে তা ছিল দেশের রাজনীতির শরীরে একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগটি আপাতত সেরে গেছে। কিন্তু রোগের প্রতিক্রিয়া থেকে দেশের রাজনীতির শরীর মুক্ত হয়নি।
তার প্রমাণ, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের সভাপতি এবং সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনুর বারম্বার আহ্বান বা দাবি জানানো। আমার ধারণা, এক এগারোর সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টাকে যেমন মাইনাস টু থিওরি আখ্যা দেয়া হয়েছিল, তেমনি এখন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার জন্য হাসানুল হক ইনু একাধিকবার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে মাইনাস ওয়ান থিওরি আখ্যা দেয়া যেতে পারে। আগের মাইনাস টু থিওরিটি (আসলে সেটিও ছিল মাইনাস ওয়ান থিওরি। টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা) যেমন কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, তেমনি বর্তমানের মাইনাস ওয়ান থিওরিটিও খালেদা জিয়া বিবেচনা করবেন অথবা কার্যকর করা যাবে, তা আমি বিশ্বাস করি না।
আগের মাইনাস টু থিওরির উদ্ভাবক হিসেবে দেশের সুশীল-কুশীল সমাজ, হতাশ ও ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতালোভী একশ্রেণীর সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পুরস্কারের অধিকারী, কিন্তু নিজ দেশে একঘরে এমন অনেক ব্যক্তি ও মহলের কথা আমরা জানি। কিন্তু জাসদ নেতার একক প্রচারিত এই থিওরির উদ্ভাবক কেবল তিনি নিজে, না এর উদ্ভাবনার পেছনে আরও কারও মাথা কাজ করছে তা আমি জানি না।
হাসানুল হক ইনু এর আগেও একবার বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ত্যাগে বাধ্য করবেন। কিভাবে করবেন সেই পন্থাটির কথা তখন তিনি প্রকাশ করেননি। এবার তার দাবি বেগম জিয়াকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদী মৌলবাদ এবং যুদ্ধাপরাধী এই তিন অশুভ চক্রের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। নতুবা তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। গত ৯ জুন শনিবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কালো পতাকা মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘর্ষময় করে তোলার জন্য দায়ী হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গী মৌলবাদ, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র।’ অতঃপর খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনি এই অশুভ তিন চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। অবিলম্বে এদের সঙ্গ বর্জন করুন। নতুবা রাজনীতি থেকে বিদায় নিন।’
এই সমাবেশে ‘বেগম খালেদা জিয়া ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন’ এই কথা লেখা ব্যানার টানানো হয়েছিল এবং সমাবেশ শেষে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর কুশপুত্তলিকায় এলোপাতাড়ি লাথি মারা ছাড়াও তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। সমাবেশে জাসদ নেতা আরও বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার পৃষ্ঠপোষক হলেন খালেদা জিয়া। তাঁর কারণেই এরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। খালেদা জিয়া নিজের ঘাড় থেকে চিরদিনের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিদায় না দিলে সংঘর্ষের রাজনীতি বন্ধ হবে না। রাজনীতি করতে চাইলে খালেদা জিয়াকে এদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে আসতে হবে। তিনি যদি তা না করেন তাহলে তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।’
হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সঙ্গে দেশের অনেকের মতো আমিও সহমত পোষণ করি। তার দাবিটিও সঠিক। কিন্তু তার দাবি আদায়ের পন্থাটি সঠিক নয়। খালেদা জিয়াকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলা হলেই তিনি তা করবেন অথবা জাসদ সভাপতি দলীয় মিছিলে বা মিটিংয়ে বক্তৃতা করলেই খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন এটা ভাবা ভাবালুতা, বাস্তবতা নয়। রাজনীতিতে এই ধরনের দাবি চমক সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু দাবি আদায়ের পন্থা হতে পারে না।
এক এগারোর সময় মইন-ফখরুদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং বন্দুক দুই-ই হাতে নিয়ে মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নে নেমেছিলেন। শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে বিদেশে আটকে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং বেগম জিয়াকে তো প্রায় চৌদোলা করে সউদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। সউদি সরকার চালাকি করে বেগম জিয়াকে ভিসা প্রদান আটকে না দিলে বেচারীকে তখন হয়ত রিয়াদে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে গিয়ে থাকতে হতো।
মাইনাস টু থিওরি সফল হয়নি। কারণ দেশের মানুষ তা চায়নি। বরং ক্ষমতায় অবৈধ প্রয়োগ দ্বারা এই থিওরি কার্যকর করতে গিয়ে মইন-ফখরুদ্দীন দু’জনেই বাংলাদেশে মাইনাস হয়ে গেছেন। একজন অসুস্থ এবং স্বেচ্ছাগৃহবন্দী এবং অন্যজন বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত। এখন হাসানুল হক ইনুর মতো এক বাম রাজনীতির নেতা, যার হাতে সরকারী ক্ষমতাও নেই, তিনি কেবল দলীয় সভায় বক্তৃতা দিয়ে কিংবা আসর গরম করার মতো দাবি তুলে তার মাইনাস ওয়ান (খালেদা জিয়া) থিওরি সফল করতে পারবেন কি?
আমার ধারণা, সে আশা তিনি নিজেও করছেন না। তাহলে এই মুহূর্তে দেশের জনজীবনে এত সমস্যা থাকতে তিনি খালেদা জিয়াকে একটি ইস্যু করে একটি অবাস্তব দাবি তুলে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন কেন? নাকি তিনি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় কিছু চটকদার দাবি তুলে দেশের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দাবির দিকে সরাতে চান এবং একই সঙ্গে চান মহাজোটের নেত্রীকেও খুশি করতে?
উদ্দেশ্য যাই হোক, হাসানুল হক ইনু নিজেও জানেন, গণদাবির প্রচণ্ড চাপ ছাড়া তার দাবি বিএনপি নেত্রী কানে তুলবেন না এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরাও এই দাবির কথা শুনে বিচলিত হবে না। তারা জানে, খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভেই তাদের ছাড়বেন না। আর ছাড়তে চাইলেও খালেদা জিয়ার রাজনীতি নেপথ্যে বসে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা তাঁকে ছাড়তে দেবেন না। ইনু কি জানেন না, বর্তমান বিশ্বে ছোট বড় অধিকাংশ দেশের রাজনীতিতে এখনও ব্যক্তি প্রাধান্য থাকলেও সেই ব্যক্তির পেছনে থাকে একটি ইনভিজিবল কোটারি, যারা ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা চক্র, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থ, সুশীল সমাজ অথবা এলিট ক্লাসের সুবিধাভোগী অংশও হতে পারে।
ক্যান্টনমেন্টের এক নিহত জেনারেলের বিধবা স্ত্রীকে (রাজনীতি সম্পর্কে যার কোন ধ্যান ধারণাই ছিল না) রাজনীতিতে টেনে এনেছে এবং ‘দেশনেত্রী’ বানিয়েছে এরাই। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তবায়ন বানচাল করা এবং জাসদ নেতা কর্র্তৃৃক বর্ণিত তিন অশুভ চক্র বিশেষ করে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। এই উদ্দেশে রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। পরে নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে একবার নয়, দু’বার বসানো হয়েছে ক্ষমতায়। তাঁর মাথায় প্রচার প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে দেশনেত্রীর টুপি পরানো হয়েছে।
খালেদা জিয়া বেঁচে থাকতেই তাঁর উত্তরাধিকারীও মনোনীত হয়ে গেছে। সেই উত্তরাধিকারী তাঁরই ‘সুপুত্র’ তারেক রহমান। ক্ষমতায় আসার আগেই তারেক ঘোষণা করেছেন, ‘জামায়াত (৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা) তাদের পরমাত্মীয়, তারা একই পরিবারের লোক।’ এই পারিবারিক বন্ধন মাতা বা পুত্র কেউ ছিন্ন করতে চাইবেন বা পারবেন, তা আশা করা বাতুলতা। কোন কারণে ছিন্ন করতে চাইলে তখন খালেদা জিয়াকে হয়ত নেতৃত্ব থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হবে এবং তারেক রহমানেরও যুবরাজ থেকে রাজা হওয়ার খোয়াব ধূলিসাত হয়ে যাবে।
তখন বিএনপির নেতৃত্বে নতুন নেতা বা নেত্রী আসবেন, এখন অসম্ভব মনে হলেও বিএনপি থেকে সদ্য পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন। তখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে তাকেই দেশ নেতা বানানো হতে পারে। কেন, পাকিস্তান আমলে তখনকার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রামের যে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দুর্নীতির দায়ে শুধু তার মন্ত্রিসভা থেকে নয়, কনভেনশন মুসলিম লীগ থেকেও বহিষ্কার করেছিলেন, সেই ফজলুল কাদের চৌধুরীকেই কি আইয়ুব খান নিজে রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার সময় কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি পদে বসিয়ে যাননি?
আসলে ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যক্তি দৃশ্যত বড়; কিন্তু আসল বড় শক্তি গোত্র। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এই তিন চক্র এবং তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে যে প্রচ- শক্তিশালী অশুভ গোত্র অথবা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে; খালেদা জিয়া এই গোত্রেরই তৈরি নেতা। তিনি এদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন কি করে? হাসানুল হক ইনুর দাবি মেনে তিনি বিচ্ছিন্ন হতে গেলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।
অশুভ গোত্র বা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া বিচ্ছিন্ন হবেন না। বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি বিচ্ছিন্ন হলে অশুভ গোত্রের অসুবিধা হবে না। তারা নতুন ‘নেতৃত্ব’ তৈরি করবেন। খালেদা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। তবে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে যদি দেখা যায়, বিএনপিকে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে জামায়াতকে বর্জন করতে হবে, তাহলে অশুভ গোত্রের নির্দেশেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি এমন একটি কৃত্রিম দূরত্ব সৃষ্টি করবে, যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কিন্তু বঁধূয়ার গোপন পিরিতি অক্ষুণœ থাকবে। নির্বাচনের পর বিএনপি জয়ী হতে পারলে দেখা যাবে কলা আর খোসা আবার এক হয়ে গেছে।
হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের একজন আধুনিক রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের মূল সমস্যাটিকে বিচার করছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস সব কিছু মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বহিঃশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় যে মহাশক্তিশালী ফ্যাসিবাদী দুর্গ গড়ে উঠেছে, একজন ব্যক্তি বা নেতা, তিনি যতই প্রভাবশালী হোন, চলে গেলে বা সরে গেলে সেই দুর্গের তেমন কোন ক্ষতি হবে না।
দেশকে এই ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে নীতিভিত্তিক ও ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দেশের গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নামতে হবে। তারা এ পর্যন্ত এই নীতিভিত্তিক, ইতিবাচক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি ও আগ্রহের প্রমাণ দেখাননি। সেই আন্দোলন গড়ে না তুলে প্রেসক্লাবের সামনে দলীয় সমাবেশ ডেকে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর চটকদার দাবি জানানো তালগাছের সামনে একা দাঁড়িয়ে তাকে মাথা নোয়ানোর অনুরোধ জানানোর মতো।
লন্ডন ২০ জুন, বুধবার ॥ ২০১২ ॥
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন