সৈয়দ আবদাল আহমদ
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হচ্ছেন রাজা পারভেজ আশরাফ। সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানি এখন আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেই। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি হারিয়েছেন। তবে কোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারালেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন গিলানি। এজন্য ইতিহাস তাকে স্মরণে রাখতে বাধ্য।
ইউসুফ রাজা গিলানি দলের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় যেমন উত্তীর্ণ, তেমনি তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেননি। অন্যদিকে আদালতের প্রতি অশ্রদ্ধা যেমন তিনি দেখাননি, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন। অবশ্য এজন্য তাকে বড় ধরনের ঝুঁকিই নিতে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পদ।
জন্মের ৬৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সামরিক শাসনে। মাঝে-মধ্যে গণতন্ত্রের ছোঁয়া দেশটি পেলেও সেই গণতন্ত্রের স্বাদ আগে খুব একটা ভোগ করতে পারেনি দেশটি। কিন্তু ব্যতিক্রম চলতি সময়টি। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন চলার পর এখনও তা অব্যাহত আছে। তবে পাকিস্তানের পিছু ছাড়ছে না সঙ্কট। নানা সমস্যায় পাকিস্তান হাবুডুবু খাচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালত ইউসুফ রাজা গিলানিকে প্রধানমন্ত্রীর পদে অযোগ্য ঘোষণার পর কেবল অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দিয়েছে, মিলছে না কোনো উত্তর। সুপ্রিমকোর্টের নতুন এই রায়ে সঙ্কট সমাধান হবে, না পাকিস্তান আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে—সেকথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের আদালতে দায়ের হওয়া অর্থ পাচারের মামলা পুনরায় চালু করতে ওই দেশের সরকারকে চিঠি লিখতে প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু গিলানি সেই নির্দেশ পালন না করায় গত ২৬ এপ্রিল তাকে আদালত অবমাননার দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ওই সময় গিলানিকে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেননি গিলানি। ফলে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের সদস্যপদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। এপ্রিলে গিলানিকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করার পর পার্লামেন্টের স্পিকার ড. ফাহমিদা মির্জা বলেছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করবেন না। স্পিকারের রুলিংয়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে পিটিশন দায়ের করেছিলেন একজন আইনজীবী ও সেদেশের বিরোধী দল। সুপ্রিমকোর্ট সেটি শুনানি করে প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে ২৬ এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যপদে অযোগ্য ঘোষণা করে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংবিধানে লেখা থাকে— প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের ফৌজদারি কার্যধারা অচল। পাকিস্তানের সংবিধানেও ২৪৮ অনুচ্ছেদে একই কথা বলা আছে। সুপ্রিমকোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গিলানি সংবিধানের ২৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সেই চিঠি দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
ভুলটি কার, সেটা মূল্যায়ন হবে। তবে এটা ঠিক, বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন গিলানি। পাকিস্তানের ১৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ শপথ নিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ৫০ মাস তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গিলানি অনেক পাকিস্তানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ২০০৮ সালে গিলানি যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন যে, তার মেয়াদ খুব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু সেসব ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তিনি চার বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা হতে পারে বলে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। অবশেষে তা-ই সত্যে পরিণত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বারবার এবং জোর দিয়েই বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসিফ আলি জারদারি দায়মুক্তি পেয়ে থাকেন। ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা চলতে পারে না। আদালত এবং সেনাবাহিনীর চাপের কাছে নতিস্বীকার না করায় দেশ-বিদেশে গিলানির খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। অনেকেই বলছেন, গিলানি এমন একজন লোক যিনি পাকিস্তানের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সফল হয়েছেন। গিলানি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বল শাসন আর দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তার পুরো মেয়াদে একথা অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলই আবারও দেশটিতে একটি নির্বাচিত সরকারের উত্খাত চায়নি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের তীব্র চাপকে উপেক্ষা করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন গিলানি। কিন্তু তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) অনেকেই মোশাররফের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। মোশাররফের কথা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানানোর মাশুলও তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৯৩-৯৬ সালে পাকিস্তানের স্পিকার থাকার সময় সরকারি চাকরিদানে অনিয়মের অভিযোগে তাকে ২০০১ সাল থেকে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়। অনেকেই অভিযোগ করছেন, মোশাররফ সরকারে যোগদান না করায় ভীতি প্রদর্শন ও দমন-পীড়নের জন্য এভাবে সাজা দেয়া হয় তাকে। কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকারের পাত্র ছিলেন না দীর্ঘদেহী আর মৃদুভাষী গিলানি। সঠিক কাজটি করার ব্যাপারে তার সুনাম আছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দলের প্রতি তার আনুগত্য এবং দলের অভ্যন্তরে কোনো কোন্দলে না জড়ানোর কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত হন। প্রধানমন্ত্রী পদ কিংবা অন্য কোনো পদের জন্য গিলানি কখনোই জারদারিকে অনুরোধ করেননি। দলের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি এ কারণটিও তাকে পাকিস্তানের শীর্ষ নির্বাহীর পদে আসীন হতে সহায়তা করেছিল। তার স্বাধীন চিন্তাও অনেক পাকিস্তানির প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকে সন্দিহান ছিলেন যে, তিনি দেশ পরিচালনায় যথেষ্ট কারিশমা দেখাতে পারবেন কিনা। তবে দিন দিনই নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গিলানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট মোকাবিলা করেছেন। দেশের ভয়াবহ বন্যা, তালেবান হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, বিন লাদেনের মৃত্যু, মেমোগেট কেলেঙ্কারি ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলা করেই তিনি টিকে ছিলেন।
সেনাবাহিনী-সরকার বিরোধের মধ্যে এ বছর জানুয়ারিতে জারদারির দুর্নীতি মামলা নতুন করে শুরু করা নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। সুপ্রিমকোর্ট এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। ২৬ এপ্রিল আদালত গিলানিকে এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রতীকী সাজা দেয়। পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণার বিপক্ষে তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতারা তার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে শেষ পর্যন্ত তা আদালতে গড়ায়। অবশেষে ১৯ জুন গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করে সুপ্রিমকোর্ট।
পাকিস্তানে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বের শুরু দেশটি স্বাধীন হওয়ার পরপরই। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনে থাকা পাকিস্তানের ইতিহাসে বিচার বিভাগের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে দেশের জনগণ মনে করে, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সামরিক আদেশের প্রতি বেশি আগ্রহী এবং তা প্রায়ই সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী অবশ্য অনেকাংশেই সে ধারণার অপনোদন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ও গিলানি সরকারের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণের অভিযোগে তিনিও সমালোচিত হচ্ছেন।
অবশ্য এর পেছনেও আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ২০০৭ সালে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মোশাররফ। এতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার একপর্যায়ে মোশাররফ সরকারের পতন ঘটে। ওই বছরই বিচারপতি খলিলুর রহমান রামদের আদালত প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে পুনর্বহাল করেন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোশাররফ বিজয়ী হলেও সুপ্রিমকোর্ট তা চ্যালেঞ্জ করে। ২০০৭-এর নভেম্বরে মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সংবিধান ও সংসদ স্থগিত ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতিসহ আরও বিচারককে গৃহবন্দি করেন। ২০০৮-এর জুনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর পুনর্বহালের দাবিতে আইনজীবীরা লংমার্চ শুরু করেন। লংমার্চ শেষে ইসলামাবাদে তারা প্রেসিডেন্ট মোশাররফের পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০৮-এর আগস্টে ক্ষমতাসীন জোট (পিপিপি ও মুসলিম লীগ-এন) তৃতীয়বারের মতো ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অভিশংসনের পদক্ষেপ নেয়ার পর মোশাররফ পদত্যাগ করেন। সরকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে চৌধুরীকে পুনর্বহালে ব্যর্থ হলে মুসলিম লীগ জোট থেকে বের হয়ে আসে।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান : রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন গিলানি। ১৯৫২ সালের ৯ জুন তিনি সিন্ধু প্রদেশের করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পৈতৃক নিবাস পাঞ্জাবে। সিন্ধুতে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক গিলানির পরিবার। প্রাচীন শহর মুলতানে তাদের নিজেদের বাড়ি অবস্থিত। তাদের পারিবারিক প্রভাবের কারণেই রাজনীতিতেও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছেন গিলানি। গিলানির দাদা এবং চাচাতো দাদা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে তারা ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। গিলানির বাবা আলমদার হুসেন গিলানি পঞ্চাশের দশকে প্রাদেশিক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও ছিলেন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
ইউনিভার্সিটি অব পাঞ্জাব থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করার পরপরই ১৯৭৮ সালে ইউনাইটেড মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ১৯৮৩ সালে দলটির মুলতান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর দুই বছর পর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হলে জিয়াউল হক তাকে প্রথমে গৃহ ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী এবং পরে রেলমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন।
জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর ১৯৮৮ সালে গিলানি বেনজির ভুট্টোর পিপিপিতে যোগদান করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯৮৮ সালে বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)তে যোগ দেন তিনি। পিপিপি থেকে তিনবার পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
ইউসুফ রাজা গিলানি দলের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় যেমন উত্তীর্ণ, তেমনি তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেননি। অন্যদিকে আদালতের প্রতি অশ্রদ্ধা যেমন তিনি দেখাননি, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছেন। অবশ্য এজন্য তাকে বড় ধরনের ঝুঁকিই নিতে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পদ।
জন্মের ৬৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সামরিক শাসনে। মাঝে-মধ্যে গণতন্ত্রের ছোঁয়া দেশটি পেলেও সেই গণতন্ত্রের স্বাদ আগে খুব একটা ভোগ করতে পারেনি দেশটি। কিন্তু ব্যতিক্রম চলতি সময়টি। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন চলার পর এখনও তা অব্যাহত আছে। তবে পাকিস্তানের পিছু ছাড়ছে না সঙ্কট। নানা সমস্যায় পাকিস্তান হাবুডুবু খাচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালত ইউসুফ রাজা গিলানিকে প্রধানমন্ত্রীর পদে অযোগ্য ঘোষণার পর কেবল অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দিয়েছে, মিলছে না কোনো উত্তর। সুপ্রিমকোর্টের নতুন এই রায়ে সঙ্কট সমাধান হবে, না পাকিস্তান আরও গভীর সঙ্কটে পড়বে—সেকথা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের আদালতে দায়ের হওয়া অর্থ পাচারের মামলা পুনরায় চালু করতে ওই দেশের সরকারকে চিঠি লিখতে প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু গিলানি সেই নির্দেশ পালন না করায় গত ২৬ এপ্রিল তাকে আদালত অবমাননার দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ওই সময় গিলানিকে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেননি গিলানি। ফলে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের সদস্যপদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। এপ্রিলে গিলানিকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করার পর পার্লামেন্টের স্পিকার ড. ফাহমিদা মির্জা বলেছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করবেন না। স্পিকারের রুলিংয়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে পিটিশন দায়ের করেছিলেন একজন আইনজীবী ও সেদেশের বিরোধী দল। সুপ্রিমকোর্ট সেটি শুনানি করে প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে ২৬ এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যপদে অযোগ্য ঘোষণা করে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংবিধানে লেখা থাকে— প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের ফৌজদারি কার্যধারা অচল। পাকিস্তানের সংবিধানেও ২৪৮ অনুচ্ছেদে একই কথা বলা আছে। সুপ্রিমকোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে সুইস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গিলানি সংবিধানের ২৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সেই চিঠি দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
ভুলটি কার, সেটা মূল্যায়ন হবে। তবে এটা ঠিক, বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন গিলানি। পাকিস্তানের ১৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ শপথ নিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ৫০ মাস তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গিলানি অনেক পাকিস্তানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ২০০৮ সালে গিলানি যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন যে, তার মেয়াদ খুব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু সেসব ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে এবং নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তিনি চার বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা হতে পারে বলে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। অবশেষে তা-ই সত্যে পরিণত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বারবার এবং জোর দিয়েই বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসিফ আলি জারদারি দায়মুক্তি পেয়ে থাকেন। ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা চলতে পারে না। আদালত এবং সেনাবাহিনীর চাপের কাছে নতিস্বীকার না করায় দেশ-বিদেশে গিলানির খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। অনেকেই বলছেন, গিলানি এমন একজন লোক যিনি পাকিস্তানের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সফল হয়েছেন। গিলানি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বল শাসন আর দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তার পুরো মেয়াদে একথা অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলই আবারও দেশটিতে একটি নির্বাচিত সরকারের উত্খাত চায়নি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের তীব্র চাপকে উপেক্ষা করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন গিলানি। কিন্তু তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) অনেকেই মোশাররফের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। মোশাররফের কথা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানানোর মাশুলও তাকে দিতে হয়েছে। ১৯৯৩-৯৬ সালে পাকিস্তানের স্পিকার থাকার সময় সরকারি চাকরিদানে অনিয়মের অভিযোগে তাকে ২০০১ সাল থেকে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়। অনেকেই অভিযোগ করছেন, মোশাররফ সরকারে যোগদান না করায় ভীতি প্রদর্শন ও দমন-পীড়নের জন্য এভাবে সাজা দেয়া হয় তাকে। কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকারের পাত্র ছিলেন না দীর্ঘদেহী আর মৃদুভাষী গিলানি। সঠিক কাজটি করার ব্যাপারে তার সুনাম আছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দলের প্রতি তার আনুগত্য এবং দলের অভ্যন্তরে কোনো কোন্দলে না জড়ানোর কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত হন। প্রধানমন্ত্রী পদ কিংবা অন্য কোনো পদের জন্য গিলানি কখনোই জারদারিকে অনুরোধ করেননি। দলের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি এ কারণটিও তাকে পাকিস্তানের শীর্ষ নির্বাহীর পদে আসীন হতে সহায়তা করেছিল। তার স্বাধীন চিন্তাও অনেক পাকিস্তানির প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকে সন্দিহান ছিলেন যে, তিনি দেশ পরিচালনায় যথেষ্ট কারিশমা দেখাতে পারবেন কিনা। তবে দিন দিনই নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গিলানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট মোকাবিলা করেছেন। দেশের ভয়াবহ বন্যা, তালেবান হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, বিন লাদেনের মৃত্যু, মেমোগেট কেলেঙ্কারি ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলা করেই তিনি টিকে ছিলেন।
সেনাবাহিনী-সরকার বিরোধের মধ্যে এ বছর জানুয়ারিতে জারদারির দুর্নীতি মামলা নতুন করে শুরু করা নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। সুপ্রিমকোর্ট এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। ২৬ এপ্রিল আদালত গিলানিকে এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রতীকী সাজা দেয়। পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকার ফাহমিদা মির্জা প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণার বিপক্ষে তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতারা তার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে শেষ পর্যন্ত তা আদালতে গড়ায়। অবশেষে ১৯ জুন গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করে সুপ্রিমকোর্ট।
পাকিস্তানে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বের শুরু দেশটি স্বাধীন হওয়ার পরপরই। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনে থাকা পাকিস্তানের ইতিহাসে বিচার বিভাগের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে দেশের জনগণ মনে করে, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সামরিক আদেশের প্রতি বেশি আগ্রহী এবং তা প্রায়ই সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী অবশ্য অনেকাংশেই সে ধারণার অপনোদন করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ও গিলানি সরকারের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণের অভিযোগে তিনিও সমালোচিত হচ্ছেন।
অবশ্য এর পেছনেও আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ২০০৭ সালে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মোশাররফ। এতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার একপর্যায়ে মোশাররফ সরকারের পতন ঘটে। ওই বছরই বিচারপতি খলিলুর রহমান রামদের আদালত প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে পুনর্বহাল করেন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোশাররফ বিজয়ী হলেও সুপ্রিমকোর্ট তা চ্যালেঞ্জ করে। ২০০৭-এর নভেম্বরে মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সংবিধান ও সংসদ স্থগিত ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতিসহ আরও বিচারককে গৃহবন্দি করেন। ২০০৮-এর জুনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর পুনর্বহালের দাবিতে আইনজীবীরা লংমার্চ শুরু করেন। লংমার্চ শেষে ইসলামাবাদে তারা প্রেসিডেন্ট মোশাররফের পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০৮-এর আগস্টে ক্ষমতাসীন জোট (পিপিপি ও মুসলিম লীগ-এন) তৃতীয়বারের মতো ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অভিশংসনের পদক্ষেপ নেয়ার পর মোশাররফ পদত্যাগ করেন। সরকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে চৌধুরীকে পুনর্বহালে ব্যর্থ হলে মুসলিম লীগ জোট থেকে বের হয়ে আসে।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান : রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন গিলানি। ১৯৫২ সালের ৯ জুন তিনি সিন্ধু প্রদেশের করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পৈতৃক নিবাস পাঞ্জাবে। সিন্ধুতে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক গিলানির পরিবার। প্রাচীন শহর মুলতানে তাদের নিজেদের বাড়ি অবস্থিত। তাদের পারিবারিক প্রভাবের কারণেই রাজনীতিতেও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছেন গিলানি। গিলানির দাদা এবং চাচাতো দাদা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে তারা ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। গিলানির বাবা আলমদার হুসেন গিলানি পঞ্চাশের দশকে প্রাদেশিক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও ছিলেন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
ইউনিভার্সিটি অব পাঞ্জাব থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করার পরপরই ১৯৭৮ সালে ইউনাইটেড মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ১৯৮৩ সালে দলটির মুলতান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর দুই বছর পর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হলে জিয়াউল হক তাকে প্রথমে গৃহ ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী এবং পরে রেলমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন।
জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর ১৯৮৮ সালে গিলানি বেনজির ভুট্টোর পিপিপিতে যোগদান করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯৮৮ সালে বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)তে যোগ দেন তিনি। পিপিপি থেকে তিনবার পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন