আসিফ নজরুল
বাংলাদেশে গালভরা নামের কিছু প্রতিষ্ঠান আগেও ছিল। এখন এর সংখ্যা বেড়েছে। এ দেশে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার কিছুদিনের মধ্যে ক্রসফায়ারের পরিবর্তে গুমের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের তথ্য গোপনের সংস্কৃতি জোরদার হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো প্রায় এক যুগ হলো দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিণত হয়েছে। সেই কমিশন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতি হয়নি এই সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। যাকে-তাকে নয়, এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে সেই মন্ত্রীদের, যাঁরা দুর্নীতি করেননি—এ কথা বিশ্বাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মানবাধিকার আর তথ্য কমিশন শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক সম্পর্কে তা বলার উপায় নেই। দুদকের ইতিহাস বহু পুরোনো, এর শিকড় ১৯৪৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল ফুড রেশনিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে আইনের মাধ্যমে এটি প্রায় স্বাধীন ও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সরকার চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা কর্মতৎপর হতে পারে, তা আমরা দেখেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মাত্র কয়েক মাসে দুর্নীতিবাজদের জন্য এই কমিশন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে দুদক একাই দেড় বছরে ৩৪১টি মামলা করেছিল, যার অধিকাংশ ছিল প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ১৫৬টি মামলায় তখন বিচার সম্পন্ন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করা হয়েছিল।
দুদকের সেই হাঁকডাক আর নেই। কমিশনের প্রধান নিজেই এই কমিশনকে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি ২০১০ সালে কিছু আইনগত সংশোধনীর পক্ষে মত দিলে দুদক নামের বাঘের নখরও খসে পড়বে—এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। সেই সংশোধনী আইনসভায় পাস হবে কি হবে না, এই দোলাচলে দুদক দীর্ঘদিন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। এর মধ্যে দুদকের নতুন সদস্যরা এসেছেন, কর্মকর্তা পর্যায়েও এমন কাউকে কাউকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। বড় দুর্নীতিবাজ দূরের কথা, পুলিশের সাধারণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এখন শেষ হয় না বছর পেরোলেও।
২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পরাক্রমশালী একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? এর নানা ব্যাখ্যা নানাজন দিয়েছেন। আসলে পতনের বীজ রোপিত হয়েছিল এর উত্তরণকালেই। অভিযোগ আছে যে এক-এগারোর নেপথ্য নায়কেরা দুদক ও বিশেষ আদালতের মাধ্যমে যতটা দুর্নীতি দমনে আন্তরিক ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের হেয় করতে। পদ্ধতি না মেনে তড়িঘড়ি মামলা দায়ের, আগ্রাসী তদন্ত, ঢালাওভাবে জামিন নাকচ, বিচারকালে অনিয়ম, রাজনীতিবিদের সন্তানদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম তখনই অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেন মূলত সেই সব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা, যাঁরা গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার লাগাম হাতে ফিরে পান।
এক-এগারোর পর ক্ষমতায় এসে সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেসবের মধ্যে দুদক ছিল অন্যতম। ক্ষমতার প্রথম দুই বছরে সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতির বড় কোনো খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। দুদকের শক্তি হ্রাস নিয়ে তাই তখন ব্যাপক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু গত এক বছরে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে, দুর্নীতির দায়ে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেওয়ার পর দুদকের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার তলানিতে ঠেকানো ইমেজকে রক্ষা করা। দুদক কি পারবে তা? নাকি পূর্বসূরিদের মতো দুদকও এটিই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে যে বাংলাদেশে বিদ্যমান সরকারের মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না? দুদকও কি বলবে যে আগের সরকারের সবাই চোর হতে পারে, কিন্তু বর্তমান সরকারের সবাই সাধু!
৩.
বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আসে সম্ভবত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী ছিলেন মন্ত্রণালয়েরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারপর পাটমন্ত্রী, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টা, শিল্পমন্ত্রী, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক রেলমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিচ্যুতির মাধ্যমে দুর্নীতিবান্ধব একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
এমন পরিস্থিতির কিছু উদাহরণ দিই। প্রথমত, সরকারপ্রধান নির্বাচন চলাকালীন মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও এ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারে লুটপাটের ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার বিরত থাকে। তৃতীয়ত, বিনা টেন্ডারে বহুল বিতর্কিত কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ সরকারের কাছের লোকজনকে প্রদান করার সন্দেহজনক কার্যক্রমকে তদন্তের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আগেই দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। চতুর্থত, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা অভিজ্ঞতা ও বিনা দক্ষতায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার লোকজনকে অবাধে কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পঞ্চমত, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট, ২০১০-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে দিয়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার হিড়িক পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে, এর সঙ্গে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ষষ্ঠত, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করা এবং অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে, সেখানেও চলে নানা হস্তক্ষেপ। যেমন, উচ্চ আদালতে নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতে পোস্টিংয়ে দলীয়করণের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সংসদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কমিটির (যেমন, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি বা অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি) দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠান দুদকের শক্তিও খর্ব করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের স্বাধীনতা ও তদন্তকালীন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং এর এখতিয়ার বাড়িয়ে (যেমন, মানি-লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা) দুটো সংশোধনী অর্ডিন্যান্স আকারে গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেগুলো নাকচ করে দেয়। এমনকি সরকার এমন কিছু সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়, যা কার্যকর হলে দুদকের দুর্নীতি দমন অভিযান ম্রিয়মাণ হতে বাধ্য। যেমন, সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্য কমিশনকে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রী) কাছে কমিশনের জবাবদিহি ও দুর্নীতির মামলা মিথ্যা হলে উল্টো অভিযোগকারীকে কারাদণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়। নাগরিক সমাজের চাপের মুখে পূর্বানুমোদনের বিধানটি প্রত্যাহার করা হলেও বাকি আপত্তিকর বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়।
দুদককে হেয় ও দর্শনগতভাবে দুর্বল করার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ঢালাওভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে। এর মধ্যে কিছু হয়রানিমূলক মামলা হয়তো ছিল, কিন্তু কিছু মামলা, বিশেষ করে জ্ঞাত উৎসবহির্ভূত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলাগুলো ছিল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। সরকার তার লোকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়কের আমলে দায়ের করা এসব মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সব মামলা জারি রাখে। আর এর মাধ্যমেই সম্ভবত দুদককে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার একটি অলিখিত নির্দেশনা সরকার দিয়ে দেয়। দুদক সেই নির্দেশনা ভালোভাবেই পড়তে পেরেছে মনে হয়। গত তিন বছরে কোনো মন্ত্রী বা এই সরকারের আমলের প্রভাবশালী আমলা ও বড় ব্যবসায়ীর দুর্নীতির কোনো হদিস তারা পায়নি; বরং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা আবুল হোসেনের মতো মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও দুদককে দেখা গেছে এদের নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে।
৪.
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রভাবশালী দুজন আমলার বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার প্রস্তাব-সংক্রান্ত কানাডার পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। দুদক কি সঠিকভাবে তদন্ত করবে এসব? সেই ক্ষমতা, সৎসাহস ও স্বাধীনতা কি আছে তাদের? ইতিমধ্যে দুদক ঘুষ-প্রস্তাব বিষয়ে কানাডা ও বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার পক্ষে যেসব বক্তব্য রাখছে, তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করার কারণ আছে—এই তদন্ত সঠিকভাবে হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন—এই বার্তা দুদকের পূর্বসূরিরা যেমন কখনো দিতে পারেনি, বর্তমান দুদক এর ব্যতিক্রম হবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কখনোই কমবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলে আমরা দুর্নীতিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরের বিএনপি সরকার সেই কুখ্যাতি পর পর চার বছর ধরে রেখে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। এখন আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও শীর্ষস্থানীয়। তবে দুদককে যেভাবে চালিত করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজ করছে, তাতে অচিরেই এই চ্যম্পিয়নশিপের কুখ্যাতি আবার এই জাতির ঘাড়ে নেমে আসতে পারে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মানবাধিকার আর তথ্য কমিশন শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক সম্পর্কে তা বলার উপায় নেই। দুদকের ইতিহাস বহু পুরোনো, এর শিকড় ১৯৪৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল ফুড রেশনিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে আইনের মাধ্যমে এটি প্রায় স্বাধীন ও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সরকার চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা কর্মতৎপর হতে পারে, তা আমরা দেখেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মাত্র কয়েক মাসে দুর্নীতিবাজদের জন্য এই কমিশন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে দুদক একাই দেড় বছরে ৩৪১টি মামলা করেছিল, যার অধিকাংশ ছিল প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ১৫৬টি মামলায় তখন বিচার সম্পন্ন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করা হয়েছিল।
দুদকের সেই হাঁকডাক আর নেই। কমিশনের প্রধান নিজেই এই কমিশনকে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি ২০১০ সালে কিছু আইনগত সংশোধনীর পক্ষে মত দিলে দুদক নামের বাঘের নখরও খসে পড়বে—এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। সেই সংশোধনী আইনসভায় পাস হবে কি হবে না, এই দোলাচলে দুদক দীর্ঘদিন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। এর মধ্যে দুদকের নতুন সদস্যরা এসেছেন, কর্মকর্তা পর্যায়েও এমন কাউকে কাউকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। বড় দুর্নীতিবাজ দূরের কথা, পুলিশের সাধারণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এখন শেষ হয় না বছর পেরোলেও।
২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পরাক্রমশালী একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? এর নানা ব্যাখ্যা নানাজন দিয়েছেন। আসলে পতনের বীজ রোপিত হয়েছিল এর উত্তরণকালেই। অভিযোগ আছে যে এক-এগারোর নেপথ্য নায়কেরা দুদক ও বিশেষ আদালতের মাধ্যমে যতটা দুর্নীতি দমনে আন্তরিক ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের হেয় করতে। পদ্ধতি না মেনে তড়িঘড়ি মামলা দায়ের, আগ্রাসী তদন্ত, ঢালাওভাবে জামিন নাকচ, বিচারকালে অনিয়ম, রাজনীতিবিদের সন্তানদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম তখনই অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেন মূলত সেই সব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা, যাঁরা গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার লাগাম হাতে ফিরে পান।
এক-এগারোর পর ক্ষমতায় এসে সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেসবের মধ্যে দুদক ছিল অন্যতম। ক্ষমতার প্রথম দুই বছরে সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতির বড় কোনো খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। দুদকের শক্তি হ্রাস নিয়ে তাই তখন ব্যাপক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু গত এক বছরে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে, দুর্নীতির দায়ে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেওয়ার পর দুদকের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার তলানিতে ঠেকানো ইমেজকে রক্ষা করা। দুদক কি পারবে তা? নাকি পূর্বসূরিদের মতো দুদকও এটিই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে যে বাংলাদেশে বিদ্যমান সরকারের মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না? দুদকও কি বলবে যে আগের সরকারের সবাই চোর হতে পারে, কিন্তু বর্তমান সরকারের সবাই সাধু!
৩.
বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আসে সম্ভবত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী ছিলেন মন্ত্রণালয়েরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারপর পাটমন্ত্রী, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টা, শিল্পমন্ত্রী, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক রেলমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিচ্যুতির মাধ্যমে দুর্নীতিবান্ধব একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
এমন পরিস্থিতির কিছু উদাহরণ দিই। প্রথমত, সরকারপ্রধান নির্বাচন চলাকালীন মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও এ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারে লুটপাটের ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার বিরত থাকে। তৃতীয়ত, বিনা টেন্ডারে বহুল বিতর্কিত কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ সরকারের কাছের লোকজনকে প্রদান করার সন্দেহজনক কার্যক্রমকে তদন্তের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আগেই দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। চতুর্থত, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা অভিজ্ঞতা ও বিনা দক্ষতায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার লোকজনকে অবাধে কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পঞ্চমত, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট, ২০১০-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে দিয়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার হিড়িক পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে, এর সঙ্গে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ষষ্ঠত, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করা এবং অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে, সেখানেও চলে নানা হস্তক্ষেপ। যেমন, উচ্চ আদালতে নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতে পোস্টিংয়ে দলীয়করণের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সংসদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কমিটির (যেমন, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি বা অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি) দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠান দুদকের শক্তিও খর্ব করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের স্বাধীনতা ও তদন্তকালীন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং এর এখতিয়ার বাড়িয়ে (যেমন, মানি-লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা) দুটো সংশোধনী অর্ডিন্যান্স আকারে গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেগুলো নাকচ করে দেয়। এমনকি সরকার এমন কিছু সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়, যা কার্যকর হলে দুদকের দুর্নীতি দমন অভিযান ম্রিয়মাণ হতে বাধ্য। যেমন, সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্য কমিশনকে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রী) কাছে কমিশনের জবাবদিহি ও দুর্নীতির মামলা মিথ্যা হলে উল্টো অভিযোগকারীকে কারাদণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়। নাগরিক সমাজের চাপের মুখে পূর্বানুমোদনের বিধানটি প্রত্যাহার করা হলেও বাকি আপত্তিকর বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়।
দুদককে হেয় ও দর্শনগতভাবে দুর্বল করার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ঢালাওভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে। এর মধ্যে কিছু হয়রানিমূলক মামলা হয়তো ছিল, কিন্তু কিছু মামলা, বিশেষ করে জ্ঞাত উৎসবহির্ভূত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলাগুলো ছিল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। সরকার তার লোকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়কের আমলে দায়ের করা এসব মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সব মামলা জারি রাখে। আর এর মাধ্যমেই সম্ভবত দুদককে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার একটি অলিখিত নির্দেশনা সরকার দিয়ে দেয়। দুদক সেই নির্দেশনা ভালোভাবেই পড়তে পেরেছে মনে হয়। গত তিন বছরে কোনো মন্ত্রী বা এই সরকারের আমলের প্রভাবশালী আমলা ও বড় ব্যবসায়ীর দুর্নীতির কোনো হদিস তারা পায়নি; বরং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা আবুল হোসেনের মতো মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও দুদককে দেখা গেছে এদের নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে।
৪.
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রভাবশালী দুজন আমলার বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার প্রস্তাব-সংক্রান্ত কানাডার পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। দুদক কি সঠিকভাবে তদন্ত করবে এসব? সেই ক্ষমতা, সৎসাহস ও স্বাধীনতা কি আছে তাদের? ইতিমধ্যে দুদক ঘুষ-প্রস্তাব বিষয়ে কানাডা ও বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার পক্ষে যেসব বক্তব্য রাখছে, তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করার কারণ আছে—এই তদন্ত সঠিকভাবে হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন—এই বার্তা দুদকের পূর্বসূরিরা যেমন কখনো দিতে পারেনি, বর্তমান দুদক এর ব্যতিক্রম হবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কখনোই কমবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলে আমরা দুর্নীতিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরের বিএনপি সরকার সেই কুখ্যাতি পর পর চার বছর ধরে রেখে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। এখন আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও শীর্ষস্থানীয়। তবে দুদককে যেভাবে চালিত করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজ করছে, তাতে অচিরেই এই চ্যম্পিয়নশিপের কুখ্যাতি আবার এই জাতির ঘাড়ে নেমে আসতে পারে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন