কাজী সিরাজুল ইসলাম :
বিদ্যুৎ সংকট দেশের মানুষকে প্রতিনিয়তই অতিষ্ঠ করে তুলছে। এই ধ্রুব সত্যটি অস্বীকার করার জো নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে এ সমস্যার সমাধানে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করা সম্ভব হবে। সে চিত্রকল্প যে হতাশাজনক অবস্থার শিকার হয়েছে, বিদ্যমান সংকট তারই প্রমাণ। বিদ্যুৎ সংকট সরকারের জনপ্রিয়তার জন্য ইতোমধ্যে যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে সে সত্যটি স্পষ্ট হয়েছে সংসদে বিদ্যুৎ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর পর্বে। বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে সরকারের ব্যর্থতা আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সরকারি দলের একাধিক সংসদ সদস্য। দলের এক সংসদ সদস্য বলেছেন, নির্বাচনী এলাকার লোকের সঙ্গে দেখা হলে শতকরা ৮০ জনই বিদ্যুৎ দাবি করেন। রাজধানীর একজন সংসদ সদস্যের অভিযোগ, তার নির্বাচনী এলাকায় মধ্যরাতেও বিদ্যুৎ থাকে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে সাধারণ মানুষ মহাজোটকে ভোট দেবে না। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে লোডশেডিং করছে কিনা তা তদন্ত করে দেখারও দাবি জানান তিনি। একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, গত নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার এমপি প্রার্থীরা ভোটারদের বিদ্যুৎ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদ আর মাত্র দেড় বছর বাকি। এ সময়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা জানতে চেয়েছেন তিনি। এসব প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, গত সাড়ে তিন বছরে ৪০ লাখ গ্রাহক বেড়েছে। তারা সে সময় বিদ্যুতের যে হিসাব করেছিলেন এখন চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় সংকট থেকেই যাচ্ছে। তবে এ সংকট স্থায়ী হবে না বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনও এদিক থেকে ছিল সমর্থনযোগ্য। তবে দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা পূরণের জন্য সাশ্রয়ী প্রকল্প গ্রহণ না করে যেভাবে একের পর এক জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয় তা নিয়ে শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন। এ মুহূর্তে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহের কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক সে মুহূর্তে খরচ বাঁচানোর নামে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বন্ধ রাখা দেশবাসীর সঙ্গে রসিকতার নামান্তর। প্রশ্ন হলো, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে যেসব ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে প্রয়োজনের মুহূর্তে সেগুলো যদি বন্ধ রাখা হয়, তবে তা তৈরি করা হয়েছিল কেন?
সম্প্রতি শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। তিনটি ভোল্টেজ লেভেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৯৯ পয়সা। আগামী ১ জুন থেকে কার্যকর হবে এ প্যাকেজ। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৩২ কেভি লাইনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে প্রতি ইউনিট ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা দামে। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা ৩৩ পয়সা। ৩৩ কেভি লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ইউনিট প্রতি দাম নেয়া হবে ১৪ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে এর দাম পাঁচ টাকা ৬১ পয়সা। ১১ কেভি লাইনে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা ৯৯ পয়সা। যার বর্তমান দাম পাঁচ টাকা ৯০ পয়সা। শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্যাকেজ ঘোষণা ইতিবাচক হলেও গড়ে প্রায় তিনগুণ দামে বিদ্যুৎ নিয়ে কেউ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবেন কিনা তা একটি প্রশ্নের বিষয়। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্টদের যে বাড়তি দাম দিতে হবে তাতে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অনুকূল হবে কিনা তাও একটি বিবেচ্য বিষয়। শিল্প মালিকরা বলেছেন, বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য রাখা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ ধরনের সুবিধা নেবেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি পড়বে। এর ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়তে হবে।
সবারই জানা, আজকের যুগ প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে বিদ্যুৎ দৈনন্দিন জীবনেরই অনুষঙ্গ। জনসমর্থন ধরে রাখতে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের বিষয়টি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। শুধু দেশের উন্নয়ন নয়, নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই ক্ষমতাসীনরা এ বিষয়ে যত্নবান হবেন এমনটিই কাম্য।
দেশে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এটা আমলে নিয়ে নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার কোনো বিকল্প নেই। গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রও গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং বিদ্যুতের বর্তমান ভয়াবহ সংকটকে মাথায় নিয়ে তা করতে হবে দ্রুত। এছাড়া বড় বড় মিল-ইন্ডাস্ট্রিগুলোর নিজেদের চাহিদা মেটাতে নিজস্ব পাওয়ার প্লান্ট তৈরির যে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারকে সোচ্চার থাকতে হবে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপচয় রোধের বিরুদ্ধেও। আমরা চাই, বিদ্যুৎ সংকটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সরকার এর ত্বরিত সমাধানে তৎপর হোক। বর্তমান মাত্রার লোডশেডিং অব্যাহত থাকলে রমযানে জনর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। বাড়বে জনঅসন্তোষও। কাজেই সরকারকে লোডশেডিং সহ্যসীমায় রাখতে জরুরভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ফরিদপুর-১ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন