ফাহমিদ-উর-রহমান
কবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও ভারতের কংগ্রেস সরকারের আগ্রহ এবং উত্সাহ প্রচুর। এ দুই সরকারের নীতিনির্ধারকদের কথা হলো, রবীন্দ্রনাথ হলেন ভারত ও বাংলাদেশের সেতুবন্ধন। আর তাই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে রবীন্দ্র চিন্তাভাবনা হচ্ছে অন্যতম চাবিকাঠি।
আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। আর সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে Cultural Hero হিসেবে তুলে ধরতে চায়। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলা হচ্ছে এক ধরনের মিথ, যার সঙ্গে ইতিহাসের তেমন একটা মিল নেই।
কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে বছরব্যাপী উদযাপিত হলো কবির সার্ধ জন্ম শতবার্ষিকী। দুই সরকারের এই রবীন্দ্রচর্চার উদ্দেশ্য যত না সাহিত্য ও নান্দনিক বিষয়গত, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমণ্ডিত। এসব রবীন্দ্রচর্চার ভেতর দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংস্কৃতিগত কোনো তফাত্ নেই। সীমান্তের পার্থক্য যেটা আছে, সেটা একান্তই মামুলি ব্যাপার।
কংগ্রেস সরকারের ‘বাঙালি’ মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকার সার্ধ শতবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে আসা আমার কাছে সব সময়ই আনন্দের। একজন বাঙালি হিসেবে এটা সত্যিই একটি সুন্দর ঘরে ফেরার অভিজ্ঞতা।... ভারত ও বাংলাদেশ এক অনন্য বন্ধন ও বিশেষ সম্পর্কের অংশীদার। আমরা সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হতে পারি। কিন্তু অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নীতি ও মূল্যবোধের এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ। (প্রথম আলো, ৭ মে, ২০১২)।
ভারতে বহু জাতি-গোষ্ঠীর বাস। এখানে আছে তিনশ’র বেশি ভাষা ও উপভাষা। এর সবকিছুকে আত্মস্থ করে এক মহাভারতীয় জাতীয়তা গড়ে উঠেছে। এর ভিত্তি কিন্তু ভাষাও নয়, সংস্কৃতিও নয়, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও নয়। এর মূলে আছে অখণ্ড ভারতের এক তত্ত্ব, যার আঁটিতে লুকানো হিন্দুত্বের বীজ। রাজনৈতিক কৌশলের কারণে সেটি গোপন রাখা হয় মাত্র।
প্রণব বাবু নিজেকে বাঙালি দাবি করেছেন, কিন্তু এটা তো তার সাব-ন্যাশনালিটি, প্রিন্সিপাল ন্যাশনালিটি নয়। তিনি আগে ভারতীয়, পরে বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের সব বাংলাভাষীই তাই। তারা তাদের বাঙালিত্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পায়ের কাছে অনেক আগেই সমর্পণ করেছেন। তাদের কাছে বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্ব উভয়েই সমার্থক জিনিস। রবীন্দ্রনাথও বাইরের দুনিয়ায় ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের এমনকি বাঙালি কবি হিসেবে নন। যদিও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। পশ্চিম বাংলার মানুষ বাংলাভাষী হলেও ভারত ভেঙে তারা এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে না বাংলাদেশের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদও তাই পারেনি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের কোনো অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বাঙালি প্রণব মুখার্জি তাহলে কোন বাঙালির কথা বলেছেন, আর তার কোন স্বদেশে ফেরার ইঙ্গিত করেছেন—এটার বিচার-মীমাংসা জরুরি। নিশ্চয় প্রণব বাবুর বাঙালিত্ব আর আমাদের বাঙালিত্ব এক জিনিস নয়। ভারতীয় বাঙালি ও বাংলাদেশী বাঙালির ভেদ-বিভাজনটাও বোঝা দরকার। আমাদের বাঙালিত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রণব বাবুর বাঙালিত্ব পশ্চিম বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষজুড়ে বিস্তৃত।
প্রণব বাবু বলেছেন, সীমান্ত দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও আমরা নাকি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। কথাটা কতটুকু সত্য ও বাস্তবসম্মত? আমাদের সঙ্গে ভারতের পাঞ্জাব, হিমাচল, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরালার মানুষের কী ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য বা মিল আছে, এটা প্রণববাবু ব্যাখ্যা করলে আমরা উপকৃত হতাম। যদি পশ্চিম বাংলার কথা বলা হয়, তাহলেও স্বীকার না করে উপায় নেই, দুই বাংলার বাঙালিত্ব এক জিনিস নয়। দুই বাঙালির মনোলোকও একই ধারায় প্রবাহিত নয়। তাছাড়া দুই বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থও এক রকম নয়। এদের রয়েছে পৃথক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পৃথক রাষ্ট্রীয় দর্শন ও পৃথক সামাজিক মূল্যবোধ। ভাষা একটা মিলের জায়গা হলে, অমিলের জায়গা আছে দশটি। দুই বাংলার অভিন্নতাই যদি সত্য হতো, তাহলে কখনও সীমান্তের দেয়াল উঠত না।
প্রণব বাবু বাঙালিত্বের কথা বলে যে আবেগ উদ্রেক করতে চেয়েছেন, তার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চেতনা বিধ্বস্ত করে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পরিধি বিস্তৃত করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবীরা প্রণববাবুর এই আধিপত্যবাদী পরিকল্পনার সহায়ক শক্তি। প্রগতিশীল বলে পরিচিত এই শ্রেণী এদেশে দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের আড়ালে নানারকমভাবে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত।
এই যে ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কত হৈ-চৈ হলো, নানা সরগরমে তাকে মনে করার চেষ্টা হলো—এর কিন্তু ছিটেফোঁটাও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির শহর কলকাতায় আমরা দেখতে পাইনি। অথচ ওই শহরেই তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশি রকম উচ্ছ্বাস আমরা দেখতে চেয়েছিলাম। এর কারণ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। তেমনি তিনি ধর্মনির্বিশেষে কখনও বাংলা ভাষাভিত্তিক অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্রেরও পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি হিন্দির পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। এই কারণেই ওপার বাংলার বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন করে বাঙালি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেনি।
সম্ভবত এপার বাংলার বাঙালিত্ব নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে মাঝে সংশয় জাগে। এদের মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্বের টানাটানি মাঝে মাঝে তাদের ধন্ধে ফেলে দেয়। এই কারণেই দিল্লিওয়ালারা আমাদের বাঙালিত্বকে টানটান করার জন্য বারবার রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে আনেন।
ফরাসি বিপ্লবের পরে ইউরোপে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ দুটো চালু হয়। যারা পরিবর্তন বা বিপ্লবের পক্ষে রাজনীতি করতে চান, তাদের বলা হয় প্রগতিশীল। আর যারা তার বিরোধিতা করেন তাদের বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীল। ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষণা করা হয়, মানবাধিকারের কথা। এই অধিকারের পক্ষে যারা থাকেন তারা হচ্ছেন প্রগতিশীল। বিরোধীতাকারীদের বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীল।
প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার এই ঐতিহাসিক সংজ্ঞা আমাদের প্রগতিশীল শ্রেণী অনুসরণ করেন বলে মনে হয় না। এখানকার প্রগতিশীলরা প্রমাণ করতে চান, রবীন্দ্র ভাবধারা হচ্ছে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সমার্থক। প্রপাগান্ডার জোরে প্রগতিশীলতা ও রবীন্দ্রনাথকে এখানে প্রায় সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত রূপ গোপন করে নতুন মুখোশে আবৃত করে দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কোনো সমাজবিপ্লবের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি জমিদারি প্রথার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যাচারী জমিদার হিসেবেও অবতীর্ণ হয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের যে একমাত্র বই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, তা কিন্তু উপনিষদ দিয়ে গড়া। তিনি তার কবিতায়, গানে বারবারই উপনিষদের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। কবির পূজার গানগুলো হচ্ছে উপনিষদীয় ভাবের নান্দনিক রূপায়ণ। কবি তার জীবদ্দশায় যে শান্তি নিকেতন গড়েছিলেন, তাও কিন্তু চিন্তার দিক দিয়ে উপনিষদের মুণিঋষিদের যুগ ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা বৈকি। এর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার পরিচয় কোথায়? চিন্তাভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উনিশ শতকীয়। ব্রিটিশের সহযোগিতায় কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ্যবাদভিত্তিক বর্ণবাদী ভাবধারার বাঙালি হিন্দু কুলীন সমাজের যে রেনেসাঁ সেই উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল, যার পথিকৃত্ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নীলচাষের সুপারিশকারী রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ইংরেজ মোসাহেব বঙ্কিম চট্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তারই ধারাবাহিকতার শ্রেষ্ঠ রত্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের এই মানসিক গঠনের পরিচয় দিয়েছেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার :
হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও সজ্ঞানে তাদের অনেকেই কখনোই এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি আর্যঋষি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসঙ্গত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাগুলো শুধু শিখ, রাজপুত ও মারাঠীকুলের বীরদের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোনো মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও এক ছত্রও লেখেননি, যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, উনিশ শতকীয় বাঙালি জাতীয়তাজ্ঞানের উত্সমূলক কোথায় ছিল। (ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার; বাংলাদেশের ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৩)
এই মানসিক গঠনের কারণেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগকে মেনে নিতে পারেননি, কারণ সোনার বাংলার সোনা-রুপা-ধন-দৌলত এই বিভাজনের ফলে জমিদারের সিন্দুকে নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বঙ্গবিভাগ রদ হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার বাবুরা উঠেপড়ে লাগেন। আর তাতে নেতৃত্ব দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ, বঙ্গভঙ্গ রদ আইন হওয়ার অব্যবহিত পর কলকাতার টাউন হলে এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেয়া যাবে না। ওই সভায় সভাপতিত্ব করলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তার বয়স ছিল ৫১ বছর। [কলকাতা : ইতিহাসের দিনলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ পর্ব (বিংশ শতাব্দী : প্রাক স্বাধীনতা কাল) এপ্রিল ১৯৯৫, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত]
কারণটাও স্পষ্ট—পূর্ব বাংলার ‘চাষাভুষা’ মুসলমানের ছেলে-সন্তানরা, যাদের কালচারকে বাবুরা অবজ্ঞা করে বলত এগ্রিকালচার, তারা যদি লেখাপড়া শিখে বাবুদের পাতে ভাগ বসায়!
কবি অনেক পরে বেশি বয়সে কালান্তরের বিখ্যাত লেখাগুলো লিখেছিলেন। সেখানে তিনি হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বয়স ও অভিজ্ঞতা মানুষের চিন্তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আনে। কবির মধ্যেও কিছুটা এসেছিল। কিন্তু তখন তো ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বন্দে মাতরম, শিবাজী উত্সব, হিন্দু মেলার ভেতর দিয়ে যে বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছে, তা তখন ফলতে শুরু করেছে। সেটাও রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্র বন্ধন, রবীন্দ্র ঐক্যের বীণা তখন আর কাজে লাগেনি। কবি লিখেছেন, আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তার বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম এ কেন... তখন জবাব পেলেম, যেসব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসতেও দিতে হবে, অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে। অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে। জাজিম তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তারপর এদের ডেকে একদিন বলেছি, আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে। হঠাত্ দেখি অপরপক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ টুপি মাথায় নিয়ে বলল, আমরা পৃথক।
আমরা বিস্মিত হয়ে বলি রাষ্ট্র ব্যাপারে পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়? বাধা ওই জাজিম তোলা আসনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোট নয়। ওখানে অনুকূল-অতল কালাপানি। বক্তৃতা মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই তা পার হওয়া যায় না।
এই কারণেই ১৯৪৭ সালে যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে স্বাধীন অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন, তা কিন্তু গান্ধী নেহরু চালিত কংগ্রেস আদৌ মেনে নেয়নি। অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব পেয়ে গান্ধী লিখেছিলেন : খসড়াটিতে প্রতিশ্রুতিমূলক এমন কিছু নেই, যাতে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা কিছু করা যাবে না। সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা এবং আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে থাকতে হবে অন্ততপক্ষে হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সহযোগিতা। এই স্বীকৃতিও তাতে থাকা উচিত যে, বাংলা রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিধৃত এক অভিন্ন সংস্কৃতিতে, যার মূল নিহিত আছে উপনিষদসমূহের দর্শনে। (Pyrelal : Mahatma Gandhi the Last Phase, Voll II, Navajiban Publishing House, Ahmedabad, 1958)
সুতরাং কাকে সাম্প্রদায়িকতা বলব আর কাকে বলব ধর্মনিরপেক্ষতা, সেই জিনিসটা আগে নির্ধারিত হওয়া দরকার। আমাদের বুঝতে হবে, ‘বাঙালি, বাঙালি’ বললেই আমাদের আত্মপরিচয় মিলবে না, তেমনি বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতির বৃহত্তর ঐক্য বিধান হবে না।
আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুঃখ পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তাকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তখনকার পাকিস্তানে। স্বাধীন ভারতের কংগ্রেস সরকার কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাড়িটি আয়করের টাকা অনাদায়ের ভুয়া মামলায় নিলামে তুলেছিল।
স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোক্তা আবুল হাশিম সাহেবকেও পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেয়া হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তার বর্ধমানের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। হাশিম সাহেব নেহরু, বিধান রায়ের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এর প্রতিকার চেয়েও কোনো উত্তর পাননি। শেষ পর্যন্ত তাকেও ঢাকায় আসতে হয়েছিল খালি হাতে। সুতরাং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তাত্পর্য উপক্ষো করে যারা ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ তত্ত্ব ফেরি করেন, কিংবা প্রণববাবুর মতো বাঙালি তত্ত্বের আড়ালে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে আবাহন করেন, তারা জেনেশুনে ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন। কিন্তু ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ জিততে পারে না।
আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। আর সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে Cultural Hero হিসেবে তুলে ধরতে চায়। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলা হচ্ছে এক ধরনের মিথ, যার সঙ্গে ইতিহাসের তেমন একটা মিল নেই।
কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে বছরব্যাপী উদযাপিত হলো কবির সার্ধ জন্ম শতবার্ষিকী। দুই সরকারের এই রবীন্দ্রচর্চার উদ্দেশ্য যত না সাহিত্য ও নান্দনিক বিষয়গত, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমণ্ডিত। এসব রবীন্দ্রচর্চার ভেতর দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংস্কৃতিগত কোনো তফাত্ নেই। সীমান্তের পার্থক্য যেটা আছে, সেটা একান্তই মামুলি ব্যাপার।
কংগ্রেস সরকারের ‘বাঙালি’ মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকার সার্ধ শতবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে আসা আমার কাছে সব সময়ই আনন্দের। একজন বাঙালি হিসেবে এটা সত্যিই একটি সুন্দর ঘরে ফেরার অভিজ্ঞতা।... ভারত ও বাংলাদেশ এক অনন্য বন্ধন ও বিশেষ সম্পর্কের অংশীদার। আমরা সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হতে পারি। কিন্তু অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নীতি ও মূল্যবোধের এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ। (প্রথম আলো, ৭ মে, ২০১২)।
ভারতে বহু জাতি-গোষ্ঠীর বাস। এখানে আছে তিনশ’র বেশি ভাষা ও উপভাষা। এর সবকিছুকে আত্মস্থ করে এক মহাভারতীয় জাতীয়তা গড়ে উঠেছে। এর ভিত্তি কিন্তু ভাষাও নয়, সংস্কৃতিও নয়, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও নয়। এর মূলে আছে অখণ্ড ভারতের এক তত্ত্ব, যার আঁটিতে লুকানো হিন্দুত্বের বীজ। রাজনৈতিক কৌশলের কারণে সেটি গোপন রাখা হয় মাত্র।
প্রণব বাবু নিজেকে বাঙালি দাবি করেছেন, কিন্তু এটা তো তার সাব-ন্যাশনালিটি, প্রিন্সিপাল ন্যাশনালিটি নয়। তিনি আগে ভারতীয়, পরে বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের সব বাংলাভাষীই তাই। তারা তাদের বাঙালিত্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পায়ের কাছে অনেক আগেই সমর্পণ করেছেন। তাদের কাছে বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্ব উভয়েই সমার্থক জিনিস। রবীন্দ্রনাথও বাইরের দুনিয়ায় ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের এমনকি বাঙালি কবি হিসেবে নন। যদিও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। পশ্চিম বাংলার মানুষ বাংলাভাষী হলেও ভারত ভেঙে তারা এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে না বাংলাদেশের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদও তাই পারেনি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের কোনো অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বাঙালি প্রণব মুখার্জি তাহলে কোন বাঙালির কথা বলেছেন, আর তার কোন স্বদেশে ফেরার ইঙ্গিত করেছেন—এটার বিচার-মীমাংসা জরুরি। নিশ্চয় প্রণব বাবুর বাঙালিত্ব আর আমাদের বাঙালিত্ব এক জিনিস নয়। ভারতীয় বাঙালি ও বাংলাদেশী বাঙালির ভেদ-বিভাজনটাও বোঝা দরকার। আমাদের বাঙালিত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রণব বাবুর বাঙালিত্ব পশ্চিম বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষজুড়ে বিস্তৃত।
প্রণব বাবু বলেছেন, সীমান্ত দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও আমরা নাকি অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। কথাটা কতটুকু সত্য ও বাস্তবসম্মত? আমাদের সঙ্গে ভারতের পাঞ্জাব, হিমাচল, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরালার মানুষের কী ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য বা মিল আছে, এটা প্রণববাবু ব্যাখ্যা করলে আমরা উপকৃত হতাম। যদি পশ্চিম বাংলার কথা বলা হয়, তাহলেও স্বীকার না করে উপায় নেই, দুই বাংলার বাঙালিত্ব এক জিনিস নয়। দুই বাঙালির মনোলোকও একই ধারায় প্রবাহিত নয়। তাছাড়া দুই বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থও এক রকম নয়। এদের রয়েছে পৃথক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পৃথক রাষ্ট্রীয় দর্শন ও পৃথক সামাজিক মূল্যবোধ। ভাষা একটা মিলের জায়গা হলে, অমিলের জায়গা আছে দশটি। দুই বাংলার অভিন্নতাই যদি সত্য হতো, তাহলে কখনও সীমান্তের দেয়াল উঠত না।
প্রণব বাবু বাঙালিত্বের কথা বলে যে আবেগ উদ্রেক করতে চেয়েছেন, তার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চেতনা বিধ্বস্ত করে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পরিধি বিস্তৃত করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবীরা প্রণববাবুর এই আধিপত্যবাদী পরিকল্পনার সহায়ক শক্তি। প্রগতিশীল বলে পরিচিত এই শ্রেণী এদেশে দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের আড়ালে নানারকমভাবে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত।
এই যে ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কত হৈ-চৈ হলো, নানা সরগরমে তাকে মনে করার চেষ্টা হলো—এর কিন্তু ছিটেফোঁটাও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির শহর কলকাতায় আমরা দেখতে পাইনি। অথচ ওই শহরেই তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশি রকম উচ্ছ্বাস আমরা দেখতে চেয়েছিলাম। এর কারণ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। তেমনি তিনি ধর্মনির্বিশেষে কখনও বাংলা ভাষাভিত্তিক অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্রেরও পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি হিন্দির পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। এই কারণেই ওপার বাংলার বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন করে বাঙালি সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেনি।
সম্ভবত এপার বাংলার বাঙালিত্ব নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে মাঝে সংশয় জাগে। এদের মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্বের টানাটানি মাঝে মাঝে তাদের ধন্ধে ফেলে দেয়। এই কারণেই দিল্লিওয়ালারা আমাদের বাঙালিত্বকে টানটান করার জন্য বারবার রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে আনেন।
ফরাসি বিপ্লবের পরে ইউরোপে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ দুটো চালু হয়। যারা পরিবর্তন বা বিপ্লবের পক্ষে রাজনীতি করতে চান, তাদের বলা হয় প্রগতিশীল। আর যারা তার বিরোধিতা করেন তাদের বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীল। ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষণা করা হয়, মানবাধিকারের কথা। এই অধিকারের পক্ষে যারা থাকেন তারা হচ্ছেন প্রগতিশীল। বিরোধীতাকারীদের বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীল।
প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার এই ঐতিহাসিক সংজ্ঞা আমাদের প্রগতিশীল শ্রেণী অনুসরণ করেন বলে মনে হয় না। এখানকার প্রগতিশীলরা প্রমাণ করতে চান, রবীন্দ্র ভাবধারা হচ্ছে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সমার্থক। প্রপাগান্ডার জোরে প্রগতিশীলতা ও রবীন্দ্রনাথকে এখানে প্রায় সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত রূপ গোপন করে নতুন মুখোশে আবৃত করে দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কোনো সমাজবিপ্লবের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি জমিদারি প্রথার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যাচারী জমিদার হিসেবেও অবতীর্ণ হয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের যে একমাত্র বই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, তা কিন্তু উপনিষদ দিয়ে গড়া। তিনি তার কবিতায়, গানে বারবারই উপনিষদের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। কবির পূজার গানগুলো হচ্ছে উপনিষদীয় ভাবের নান্দনিক রূপায়ণ। কবি তার জীবদ্দশায় যে শান্তি নিকেতন গড়েছিলেন, তাও কিন্তু চিন্তার দিক দিয়ে উপনিষদের মুণিঋষিদের যুগ ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা বৈকি। এর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার পরিচয় কোথায়? চিন্তাভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উনিশ শতকীয়। ব্রিটিশের সহযোগিতায় কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ্যবাদভিত্তিক বর্ণবাদী ভাবধারার বাঙালি হিন্দু কুলীন সমাজের যে রেনেসাঁ সেই উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল, যার পথিকৃত্ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নীলচাষের সুপারিশকারী রাজা রামমোহন, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ইংরেজ মোসাহেব বঙ্কিম চট্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তারই ধারাবাহিকতার শ্রেষ্ঠ রত্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের এই মানসিক গঠনের পরিচয় দিয়েছেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার :
হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও সজ্ঞানে তাদের অনেকেই কখনোই এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি আর্যঋষি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসঙ্গত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাগুলো শুধু শিখ, রাজপুত ও মারাঠীকুলের বীরদের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোনো মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও এক ছত্রও লেখেননি, যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, উনিশ শতকীয় বাঙালি জাতীয়তাজ্ঞানের উত্সমূলক কোথায় ছিল। (ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার; বাংলাদেশের ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৩)
এই মানসিক গঠনের কারণেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগকে মেনে নিতে পারেননি, কারণ সোনার বাংলার সোনা-রুপা-ধন-দৌলত এই বিভাজনের ফলে জমিদারের সিন্দুকে নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বঙ্গবিভাগ রদ হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার বাবুরা উঠেপড়ে লাগেন। আর তাতে নেতৃত্ব দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ, বঙ্গভঙ্গ রদ আইন হওয়ার অব্যবহিত পর কলকাতার টাউন হলে এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেয়া যাবে না। ওই সভায় সভাপতিত্ব করলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তার বয়স ছিল ৫১ বছর। [কলকাতা : ইতিহাসের দিনলিপি, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ পর্ব (বিংশ শতাব্দী : প্রাক স্বাধীনতা কাল) এপ্রিল ১৯৯৫, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত]
কারণটাও স্পষ্ট—পূর্ব বাংলার ‘চাষাভুষা’ মুসলমানের ছেলে-সন্তানরা, যাদের কালচারকে বাবুরা অবজ্ঞা করে বলত এগ্রিকালচার, তারা যদি লেখাপড়া শিখে বাবুদের পাতে ভাগ বসায়!
কবি অনেক পরে বেশি বয়সে কালান্তরের বিখ্যাত লেখাগুলো লিখেছিলেন। সেখানে তিনি হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বয়স ও অভিজ্ঞতা মানুষের চিন্তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আনে। কবির মধ্যেও কিছুটা এসেছিল। কিন্তু তখন তো ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বন্দে মাতরম, শিবাজী উত্সব, হিন্দু মেলার ভেতর দিয়ে যে বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছে, তা তখন ফলতে শুরু করেছে। সেটাও রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্র বন্ধন, রবীন্দ্র ঐক্যের বীণা তখন আর কাজে লাগেনি। কবি লিখেছেন, আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তার বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম এ কেন... তখন জবাব পেলেম, যেসব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসতেও দিতে হবে, অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে। অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে। জাজিম তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তারপর এদের ডেকে একদিন বলেছি, আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে। হঠাত্ দেখি অপরপক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ টুপি মাথায় নিয়ে বলল, আমরা পৃথক।
আমরা বিস্মিত হয়ে বলি রাষ্ট্র ব্যাপারে পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়? বাধা ওই জাজিম তোলা আসনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোট নয়। ওখানে অনুকূল-অতল কালাপানি। বক্তৃতা মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই তা পার হওয়া যায় না।
এই কারণেই ১৯৪৭ সালে যুক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে স্বাধীন অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন, তা কিন্তু গান্ধী নেহরু চালিত কংগ্রেস আদৌ মেনে নেয়নি। অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব পেয়ে গান্ধী লিখেছিলেন : খসড়াটিতে প্রতিশ্রুতিমূলক এমন কিছু নেই, যাতে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা কিছু করা যাবে না। সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা এবং আইন প্রণয়নের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে থাকতে হবে অন্ততপক্ষে হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সহযোগিতা। এই স্বীকৃতিও তাতে থাকা উচিত যে, বাংলা রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিধৃত এক অভিন্ন সংস্কৃতিতে, যার মূল নিহিত আছে উপনিষদসমূহের দর্শনে। (Pyrelal : Mahatma Gandhi the Last Phase, Voll II, Navajiban Publishing House, Ahmedabad, 1958)
সুতরাং কাকে সাম্প্রদায়িকতা বলব আর কাকে বলব ধর্মনিরপেক্ষতা, সেই জিনিসটা আগে নির্ধারিত হওয়া দরকার। আমাদের বুঝতে হবে, ‘বাঙালি, বাঙালি’ বললেই আমাদের আত্মপরিচয় মিলবে না, তেমনি বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতির বৃহত্তর ঐক্য বিধান হবে না।
আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুঃখ পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তাকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তখনকার পাকিস্তানে। স্বাধীন ভারতের কংগ্রেস সরকার কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাড়িটি আয়করের টাকা অনাদায়ের ভুয়া মামলায় নিলামে তুলেছিল।
স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোক্তা আবুল হাশিম সাহেবকেও পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেয়া হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তার বর্ধমানের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। হাশিম সাহেব নেহরু, বিধান রায়ের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এর প্রতিকার চেয়েও কোনো উত্তর পাননি। শেষ পর্যন্ত তাকেও ঢাকায় আসতে হয়েছিল খালি হাতে। সুতরাং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তাত্পর্য উপক্ষো করে যারা ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ তত্ত্ব ফেরি করেন, কিংবা প্রণববাবুর মতো বাঙালি তত্ত্বের আড়ালে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে আবাহন করেন, তারা জেনেশুনে ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন। কিন্তু ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ জিততে পারে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন