বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

বিদ্যুত্ সংকট :আমাদের করণীয়


 গাজী নাসিমুর রেজা  

বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে, আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই বর্তমানে লোড শেডিং শব্দটির সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত। গ্রামাঞ্চলে অনেক স্থানে লোড শেডিং এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রায়শ: শুনতে পাওয়া যায় যে, “বিদ্যুত্ যায় না বিদ্যুত্ মাঝে মধ্যে আসে”। প্রচণ্ড তাপদাহে লোডশেডিং-এ জন-জীবন অতিষ্ঠ, শিল্প, কল কারখানা, কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
বর্তমানে সরকার বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য সোলার প্যানেল এর উপর জোর দিচ্ছে। জোর দেয়ার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। সূর্যের অফুরন্ত জ্বালানি শক্তিকে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ব্যবহার করা সর্বোত্তম। আমদানী নির্ভর বলে সোলার প্যানেলের দ্বারা বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যয় অধিক এবং আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। নতুন সংযোগের জন্য সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক করায় এবং পরবর্তী পর্যবেক্ষণ না থাকায়, উপরন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও আর্থিক সুবিধা না থাকাতে গ্রাহকগণ “কুইনান’’-এর মতো গলধঃকরণ করছে। পাওয়া যাচ্ছে না প্রস্তাবিত সুফল। গ্রাহকগণ সংযোগ প্রাপ্তির জন্য যেনতেন প্রকারে সোলার প্যানেল স্থাপন করছে। এমন কি শোনা যাচ্ছে, বর্তমানে সোলার প্যানেল ভাড়া ভিত্তিতে পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না, চুরি হয়ে যাচ্ছে, কার্যকর থাকছে না। পরিশেষে দেশীয় মুদ্রার অনেকটা অপচয় হচ্ছে। বাস্তবে সোলার প্যানেল দ্বারা কত বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে এর সঠিক পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ হয়নি; কিন্তু আমদানীতে প্রচুর ব্যয় হচ্ছে। যার জন্য বাস্তবমুখী নীতিমালা প্রয়োজন। যেমন ঃ (ক) সোলার প্যানেল বিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদান। (খ) দুর্গম গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ না করে সোলার প্যানেল স্থাপনে সহযোগিতা করা, এক্ষেত্রে গ্রাহকগণকে ভর্তুকি প্রদান করা হলে সমষ্টিগত অর্থনৈতিক লাভবান হবে। (গ) পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বিবেচনায়, ব্যাটারী ব্যাক-আপ বাদ দিয়ে অনগ্রিড পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। (ঘ) আবাসিক হোটেল, কল-কারখানা প্রভৃতি স্থানে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ গরম পানি প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সোলার হিটার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। (ঙ) নূতন সংযোগ প্রাপ্তিতে সোলার প্যানেল ব্যয় আদায় করে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিতা মূলক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সোলার বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। সর্বোপরি সোলার প্যানেল দ্বারা বিদ্যুত্ উত্পাদন বিষয়টি বিনিয়োগের সর্বোত্তম পদ্ধতি কিনা? তা পুনরায় বিবেচনা করা প্রয়োজন। জীবনযাত্রার মানের উন্নতির সাথে সাথে বিদ্যুত্ চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই লোড শেডিং-এর বিষয়টি রাতারাতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। বর্তমানে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট লোড শেডিং সামাল দিতে উত্পাদনের পাশাপাশি বিদ্যুত্ সাশ্রয় এর উপর জোর দেয়া প্রয়োজন।
সরকারের ভূমিকা হতে পারে :(ক) “বিলাসিতার জন্য বিদ্যুত্ নয়” এক্ষেত্রে রেশনিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় চাহিদা মোতাবেক ভর্তুকি রেটে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যেতে পারে। বিলাসিতার জন্য অতিরিক্ত চাহিদা, কোনো ভর্তুকি নয়। স্পেসের সাথে বিদ্যুত্-এর চাহিদায় অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে স্পেসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। যেমন একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা বর্তমানে প্রায় ২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ব্যবহার করেন। যা উন্নত বিশ্বের স্পেস নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাত্ Work Station করে, good working Environment নিশ্চিত করার পরও প্রায় ১.০০ কিলোওয়াট-এর নীচে আনয়ন করা সম্ভব। (খ) নকল/নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যবহারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা/যার কারণে বৈদ্যুতিক শক্তির অপচয় হয় এবং দুঘর্টনা ঘটে। (গ) বিদ্যুত্ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও বাতি সমূহ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। (ঘ) জাতীয় অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনা করে কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে বিদ্যুত্-এর অন্তর্ভুক্ত না করা। (ঙ) বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইন বৃদ্ধি না করে পুরাতন সঞ্চালন লাইনসমূহ প্রতিস্থাপন করা। (চ) বিদ্যুত্ চুরি, অবৈধ সংযোগ ও অতিরিক্ত বিদ্যুত্ ব্যবহার প্রতিরোধ করা। (ছ) গৃহস্থালির কাজে ব্যবহূত গ্যাস ও পানির অপচয় রোধ কল্পে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি স্থাপনে বাধ্য করা এবং সহযোগিতা করা।
উন্নত বিশ্বে একটি ভবন নির্মাণের সময় এর ব্যবহারিক দিক বিবেচনা করে বিশেষ করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস-এর ব্যবহার নিশ্চিত করাপূর্বক বিদ্যুত্ সাশ্রয়-এর বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে প্রায় ভবন অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হওয়ায় অনেক অসুবিধার সঙ্গে বিদ্যুত্ শক্তি অপচয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুত্ অপচয় বলব না, বিদ্যুত্ ব্যবহার হ্রাস করার ব্যাপারে আলোচনা হয় সরকারি দপ্তরগুলোর এয়ারকুলার-এর বিষয়টি নিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, Good working Environment উন্নত কর্ম পরিবেশ অর্থ-ই হলো উন্নত সেবা পাওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উন্নত কর্ম পরিবেশ-এর সাথে এয়ারকুলার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এয়ারকুলার উন্নত কর্মপরিবেশ সহায়ক; কিন্তু প্রচুর বিদ্যুত্ শক্তির প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুত্ সাশ্রয় ও উন্নত কর্ম পরিবেশ, দুটো-ই নিশ্চিত করা যায়। যদি উন্নত বিশ্বের জন সাধারণের মানসিকতার মতো আমাদের মানসিকতা হয়। যেমন উন্নত বিশ্বের অনুরূপ working Station করা হলেও। ১৬০ বর্গফুট স্থানে ৪ জন কর্মকর্তার বসার সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রিন্টার ফটোকপিয়ার মানব সম্পদ শেয়ার করার মাধ্যমে বিদ্যুত্ শক্তির ব্যবহার আরো হ্রাস করা যেতে পারে। প্রত্যকটি ভবনে, সমস্ত স্থানে নয়, শুধু প্রয়োজনীয় কুলিং জোন করে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ বিবেচনা করে সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশন স্থাপন করা হলে। বর্তমান পদ্ধতির চেয়ে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ বিদ্যুত্ শক্তির অপচয় রোধ করা সম্ভব। প্রকৃতির আলো-বাতাস ব্যবহার করার জন্য বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে Thai glass ব্যবহূত হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে Thai glass-এর তৈরির জানালাগুলো ভারী পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। যার ফলশ্রুতিতে স্থাপনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ব্যবহূত কাঁচ ব্যবহার করার ফলে কক্ষগুলির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এয়ারকুলারের প্রয়োজনীয়তা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিদ্যুত্ শক্তির অপচয় হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন প্রচুর পানির অপচয় করি। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ২১০-২৩০ কোটি লিটার পানির সরবরাহ করা হয়। একটু সচেতন হলে শতকরা ৩০ ভাগ পানি অপচয় রোধ করা সম্ভব। যার দ্বারা পানি উত্তোলনের জন্য ব্যবহূত বিদ্যুত্ শক্তি সাশ্রয় করা সম্ভব এবং লোড শেডিং মোকাবেলাও সম্ভব। বিদ্যুত্ সাশ্রয়ী বাতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা উচিত। সমস্ত স্থানে নয়, প্রয়োজনীয় স্থানে বাতি অর্থাত্ টাস্ক লাইটিং ব্যবহার করা যেতে পারে। পিক আওয়ার-এ শীতাতপ নিয়ন্ত্রীকরণ যন্ত্র ব্যবহার না করা। স্বল্প স্থানে অধিকাংশ বসবাস করা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদ্যুত্ শক্তি ব্যবহার না করা। অহেতুক কম্পিউটার অন রাখা প্রভৃতি। নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি পরিহার করা, যাতে বিদ্যুত্ শক্তির অপচয় হ্রাস পাবে এবং দুর্ঘটনা রোধ হবে। প্রকৃতির আলো-বাতাস ব্যবহার নিশ্চিত করা। আসবাবপত্রের জন্য শীতাতপ নয়, সাজ-সজ্জা কক্ষে আলো প্রতিফলিত হয় এমন ধরনের রং যেমন- সাদা অথবা হালকা ধরনের রং বিবেচনা করা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রধান ও অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুত্ সংকট। এক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যুত্ শক্তির উত্পাদনের পাশাপাশি পরিকল্পনাবিদ, স্থপতিবিদ, প্রকৌশলী এবং জন সাধারণ বিদ্যুত্ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়, তাহলে বর্তমান পর্যায়ে উত্পাদিত বিদ্যুত্ দ্বারাই লোড শেডিং অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। “সকলের তরে সকলে’’-বিবেচনায় বিদ্যুত্ ব্যবহার অর্থ্যাত্ অপচয় না করলে, লোড শেডিং হ্রাস পাবে এবং সকলে সুবিধা পাবে।
লেখক :প্রকৌশলী
Email : gnreza@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন