॥ মো: বেলায়েত হোসেন ॥
এক শ্বাসরুদ্ধকর ও চরম অস্থিতিশীল অবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে দেশের চলমান রাজনীতি। অপরিপক্বতা, অসহিষ্ণুতা ও অনৈক্য এবং বিভাজন চরম সীমায় এসে উপনীত হয়েছে। দেশে তো বটেই, বাংলাদেশের অবনতিশীল রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বইছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির গভীর সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা চলছে। তাতে একটি রফতানিমুখী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ মারাত্মক ইমেজ সঙ্কটে পড়ছে; বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন; উদ্বেগ আছে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেও!
বাংলাদেশের মানুষকে অনেক অলীক স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল হবে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে ইত্যাদি। তবে কথা হলো, মানুষকে যে স্বপ্নই দেখনো হোক না কেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি না থাকলে বাংলাদেশকে কোনো মানেই উন্নীত করা সম্ভব হবে না, উল্টো যেটুকু উন্নতি গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের হয়েছে; তা ধরে রাখাই কঠিন হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কোনো স্বপ্ন চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দিন দিন দূরত্ব বাড়ছে, দূরত্ব থেকে তৈরি হচ্ছে ত; আর হামলা-মামলা-গুম-গ্রেফতার ও জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা! আশ্চযের্র ব্যাপার হলো, যারা নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন, সেই মানের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে জামিন অযোগ্য মামলা! দেশকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা তৈরির পরিবর্তে, তাদের ঘুরতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে! কোনো কোনো দলের শীর্ষ রাজনীতিবিদ দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছেন জেলে! তারা জামিন পাচ্ছেন না! এই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তব চিত্র! এখন প্রশ্ন হলো, এই টালমাটাল ও অপরিপক্ব রাজনীতি নিয়ে একটি দেশ কিভাবে সামনে অগ্রসর হবে? কিভাবে মধ্যম আয় বা ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে?
অপরিপক্ব, অনৈক্য, অসহিষ্ণু ও বিভাজনের রাজনীতি চূড়ান্তভাবে দেশকে নিয়ে দাঁড় করাবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব বাড়ছে। শুধু দূরত্ব বাড়ছে এটি বললে বোধ হয় কম বলা হবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্বশূন্য করারও চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
বিএনপি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। দলটি বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক ভোটের অধিকারী। দেশব্যাপী দলটির রয়েছে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে দলটির নেতৃত্বে পাঁচবার সরকার গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক শুভ ও বড় বড় অর্জনের সাথে বিএনপির নাম জড়িয়ে আছে। হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নের ফলে দলটি বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিকূল সময় পার করছে। দলটির প্রধানকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বলতে গেলে এক প্রকার জোর করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে! ঘটনা এখানেই শেষ নয়, খালেদা জিয়াকে প্রতিনিয়ত সরকারের দেয়া মামলায় আদালতে গিয়ে হাজিরাও দিতে হচ্ছে!
অন্য দিকে বিএনপির প্রায় সব শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলায় জড়ানো হচ্ছে। দলটিকে কৌশলে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে দলটির শীর্ষ নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন! হামলা-মামলা, গুম-গ্রেফতার ও দমন-পীড়নের ধরন দেখলে, তাদের কথার যৌক্তিকতা আছে বলেই প্রতিয়মান হয়! এমন অসহিষ্ণু, অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতির ফল কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না। এই অপরিপক্ব রাজনীতি একটি রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নেয়ার পরিবতে, রাষ্ট্রকে অবধারিত পেছনের দিকে নিয়ে যাবে আর বাস্তবে হচ্ছেও ঠিক তাই।
অপর বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী উল্লেখযোগ্য ভোটের অধিকারী। দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী বিস্তৃত। প্রায় ৫০ লাখ সক্রিয় কর্মী-সমর্থক রয়েছে দলটির। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দলটির রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। বর্তমানে দলটির শীর্ষ স্থানীয় ও মধ্যম সারির সব নেতা কথিত মানবতাবিরোধী মামলা ও অন্যান্য অভিযোগে জেলে রয়েছেন! এক কথায় দলটি এখন পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় আছে। ফলে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ােভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। মাঝে মধ্যে এই ােভের বহিঃপ্রকাশও ল করা যাচ্ছে!
এ অবস্থায় যেকোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অজানা গন্তব্য ও মারাত্মক পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কাজেই সময় থাকতে পরস্পরে ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ত্রে তৈরি করার দিকে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়ানো সম্ভব হয়Ñ যাতে সুস্থ রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে আসে।
সরকারকে বুঝতে হবে; রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়, রাজনীতিবিদেরা গুম ও নিখোঁজ হবেন এবং অন্যায়ভাবে জেলে যাবেন এটিও মেনে নেয়া যায় না। কেননা খোদ রাজনীতিবিদদের জন্যই তা ভয়ঙ্কর, আগে-পরে রাজনীতিবিদেরাই এর শিকার হবেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এসব নিঃসন্দেহে অশনিসঙ্কেত। রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। আর শান্তি বিরাজ না করলে, একটি দেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। দেশটি আলোর মুখ দেখার পরিবর্তে, ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতে থাকবে। বাস্তবেও বাংলাদেশে আমরা তা-ই দেখছি! অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতির কারণে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখথুবড়ে পড়ছে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে চরম মন্দা ভাব বিরাজ করছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ, নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে, সর্বোপরি জিডিপির সূচকও নিচের দিকে নামছে। এই অবস্থায় একটি উন্নয়নশীল ও রফতানিমুখী দেশ চলতে পারে না।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপদ নয়। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিশ্বের শক্তিধর দেশ। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরো বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিপ। তৈরী পোশাক শিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জনশক্তি রফতানি ও ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। কাজেই বাংলাদেশের শত্র“ এখন চর্তুমুখী।
একটি রফতানিমুখী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা থাকা অপরিহার্য। সঙ্ঘাতপূর্ণ ও অশান্ত রাজনীতি নিঃসন্দেহে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করছে। এটি এ দেশের রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে। তাদের মন বড় করতে হবে এবং দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। নয়তো অজানা গন্তব্যের দিকেই বাংলাদেশ ধাবিত হবে। তাতে দায়ী থাকবেন রাজনীতিবিদেরাই, বিশেষ করে মতাসীনেরা।
e-mail-belaYet_1@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন