মো. আতিকুর রহমান
আমাদের দেশে শিশুশ্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের ফসল। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত কারণ ও অধিক পরিবারবর্গ এর পশ্চাতে ক্রিয়াশীল। বস্তুত পরিবারের আর্থিক সংকট, হতদরিদ্রতাই মূলত: শিশুদের শিশু শ্রমিক হিসেবে উপার্জনে নিয়োজিত হতে একপ্রকার বাধ্য করে। বর্তমানে অনেক শিশু পারিবারিক চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শহরে এসে কর্মের আশায় শিশুশ্রমিক হয়েছে। এটিই বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্য-পীড়িত দেশে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাওয়ার মুখ্য কারণ। পাশাপাশি এদেশে শিশুশ্রম বৃদ্ধির জন্য আরো অনেক কারণকে বিবেচনায় আনা যায় যেমন- দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের শিশুরাই নিজের এবং পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে কর্মে নিযুক্ত হয়; চরম দারিদ্র্যের ছোবলে অভিভাবকরা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কর্মক্ষেত্রে পাঠাতে একপ্রকার বাধ্য হয়; অভিভাবকদের উপার্জিত অর্থে শিশুদের শিক্ষার জন্য আলাদা ব্যয়ভার বহন করার অক্ষমতা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা ও শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা; শিশুশ্রমের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অজ্ঞতা; শিশু অধিকার সংরক্ষণে আইনগত দুর্বলতা; প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সহায়-সম্বলহীন হওয়া; অতিরিক্ত জনসংখ্যা; পরিবার-পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে সম্যক ধারণার অভাব; অনেক অভিভাবকের অন্ধ ধারণা অধিক সন্তান আয়-রোজগারের হাতিয়ার; ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি; বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে শিল্প-কারখানা কেন্দ্রীভূত হওয়া; বয়স্ক শ্রমিকের বেকারত্ব বৃদ্ধির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে; বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে এবং গৃহহীন ও ভাসমান পরিবার বৃদ্ধির কারণেই মূলত এদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এদেশের ৫৭% এর বেশি মানুষই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। ফলে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাতো দূরের কথা, পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই তাদের চরম হিমশিম খেতে হয়। আমাদের দেশে এখন এমনও অনেক পরিবার আছে যারা এক বেলা পেটপুরে খেতে পায় না। এ সমাজে একজন খেটেখাওয়া দরিদ্র মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করে যে অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে দুই কেজি চাল কিনলে অন্যকিছু কেনার জন্য তাদের হাতে আর পয়সা অবশিষ্ট থাকে না। সেইসব অভিভাবক বা বাবা-মার পক্ষে তাদের সন্তানের মুখে দু-বেলা দু-মুঠো ভাতের যোগান দিতে এক প্রকার বাধ্য হয় তাদের কোমলমতি সন্তানদের কাজে পাঠাতে। কিন্তু প্রত্যেক বাবা-মা-ই চায় তার সন্তান অন্য সবার মতো লেখাপড়া শিখে বড় হউক এবং মানুষের মতো মানুষ হউক। কিন্তু দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যখন সেই বাবা-মা তার সন্তানদের বেঁচে থাকার জন্য দুই-বেলা দু-মুঠো ভাতের যোগাড় করতে পারে না, তখন সেইসব বাবা-মাই তাদের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কাজে পাঠাতে তেমন দ্বিধা প্রকাশ করে না। কিন্তু প্রত্যেক বাবা-মার মনে আশা ও বাসনা তাদের সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ- সম্প্রতি প্রকাশিত ও প্রচারিত একটি সংবাদ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল-ফুটপাতে বসবাসরত একজন মা তার সন্তানকে বই পড়াচ্ছে। সেই মারও আশা তার সন্তান অন্য সবার সন্তানের মত লেখাপড়া শিখে একদিন অনেক বড় হবে। এই দৃশ্য দেখে অন্তত একটি বিষয়ে আমাদের সকলের উপলব্ধি হওয়া উচিত কত কষ্টে এবং কত ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে একজন বাবা-মা তাদের সন্তানকে বাঁচানোর তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু সেইসব বাবা-মার জন্য যদি অধিক আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা যায়, সমাজের বিত্তবান যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা দানের মাধ্যমে তাদেরকে যদি স্বাবলম্বী করা যায় তবে এমনিই শিশুশ্রম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই সমাজ থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শিশুদের বাঁচাতে সম্ভাবনাময় তরুণ যুবসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
দেশে শিশুশ্রম বন্ধে আমরা যত আইন করি না কেন তার কোনটিই কাজে আসবে না যতদিন পর্যন্ত আমরা দারিদ্র্য দূরীকরণে শিশু অভিভাবকদের জন্য আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে না পারি। বর্তমানে এদেশে শিশুশ্রম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশীয় সংস্থাগুলি দিনদিন যতই সোচ্চার হচ্ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা যেন ততোই বেড়ে যাচ্ছে। এই পেক্ষাপটে এই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানে এখনই যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এদেশে অনেক এনজিও এবং দেশীয় সংস্থা শিশু শ্রম রোধে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে নামমাত্র একটি সাইন বোর্ড লাগিয়ে সরকার ও বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত-শত কোটি টাকা। কাজের কাজ তারা কিছুই করছে না। এই ধরনের সংস্থাকে রুখতে সচেতন যুবসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশে নামিদামি কিছু সংস্থা বর্তমানে শিশুশ্রম রোধে করণীয় শীর্ষক সেমিনার বা সিম্পোজিয়াম করে বিদেশি দাতা প্রতিনিধিদের প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি করে তাদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করছে ঠিকই কিন্তু শিশু অধিকার রক্ষা না করে নিজেদের অধিকার ভালভাবেই রক্ষা করছে তারা। সমাজে এই মুখোশধারী ব্যক্তিদের প্রতিহত করতে ভাল কাজের নায়ক এই তরুণ যুবসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। এদেশে প্রতিটি সচেতন যুবসমাজ যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় তাদের সমবয়সী আরো কিছু যুবককে নিয়ে এমন একটি দল গঠন করতে পারে যে দল ঐ সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে সাধ্যের মধ্যে আর্থিক সহযোগিতা এনে ঐ এলাকার দরিদ্র অভিভাবকদের উপার্জনমুখী কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তবে এমনিই শিশুশ্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এই কাজের জন্য প্রতিটি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিত্তবানদের মনে রাখতে হবে, ঐসব দরিদ্র অভিভাবক আপনাদের পরিবারেরই অংশ এবং তাদেরকে যেকোন প্রকার সহযোগিতা করাই আপনার কর্তব্য। অনুরূপভাবে সরকারকে শিশুশ্রম রোধে আইন প্রণয়নের চাইতে সীমিত সম্পদের মধ্যে থেকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব অভিভাবকদের উপার্জনমুখী কর্মের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এইসব সহায়-সম্বলহীন অভিভাবককে যদি কর্মসংস্থানের পথ নিশ্চিতকরণে উত্পাদনমুখী আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে উত্তম । সেইসঙ্গে সুদমুক্ত আর্থিক ঋণ দিয়ে তাদের অর্থ উপার্জনের পথ সৃষ্টি করে দিতে পারলে দেশ থেকে আপনা আপনিই শিশুশ্রম বন্ধ হয়ে যাবে।
তাই সমাজে এইসব কোমলমতি শিশুকে শিশুশ্রম থেকে রক্ষার জন্য সরকার, সমাজের বিত্তবান এবং সর্বোপরি অপার সম্ভাবনাময় যুব সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, সমাজের এই সম্ভাবনাময় যুব সমাজই পারবে শিশুশ্রমের মত অমানবিক কাজ থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করতে এবং এই কাজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে। যদি আমরা এই কাজটি যথাযথ না করতে পারি তবে এই জাতি বিপর্যস্ত মানবতার মধ্য দিয়ে আগামী প্রজন্মের সমাজজীবন নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর হয়ে উঠবে। তাই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যত্ এই শিশুদের দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তুলতে হবে এবং পরিবারে শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন ও সর্বাঙ্গীন বিকাশের লক্ষ্যে দ্রুত ঐ শিশুদের দরিদ্র অভিভাবকদের উত্পাদন ও উপার্জনমুখী অধিক কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মূলত: এই কাজটি সকলে মিলে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলেই দেশ থেকে শিশুশ্রম আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধে এদেশের আপামর যুবসমাজকে সোচ্চার হতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে।
n লেখক :লাইব্রেরিয়ান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি)
atik@bift.info
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন