মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

পারলেন না স্পিকার


॥ আযম মীর ॥


রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গÑ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক পুরনো। আমাদের দেশে এই তিন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কখনো বড় টানাপড়েন বা বড় কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। ফলে এ বিষয়ে রেফারেন্স হওয়ার মতো অ্যাকাডেমিক আলোচনাও কম। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো তছনছ করে দিয়ে চরম একদলীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েমের সময় বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন করার সময়ও বিচার বিভাগ টুঁ শব্দটি করেনি। এরপর গত ৩৭ বছরে এ দেশে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক শাসন আমরা পেয়েছি। আবার বেসামরিক শাসন হটিয়ে সামরিক শাসন জেঁকে বসেছে। সেই সামরিক শাসন তাড়িয়ে গত ২২ বছর বেসামরিক শাসনের মাঝে দুই বছর সামরিক ছত্রছায়ায় অদ্ভুত এক অনির্বাচিত বেসামরিক শাসনের স্বাদও দেশবাসী পেয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে সংবিধানের অনেক সংশোধনী আমরা পেয়েছি। এসব সংশোধনী নিয়ে নানা প্রশ্ন-বিতর্ক সৃষ্টি হলেও রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে এমন কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি, যা নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি আইন বিভাগের অনুমোদিত পঞ্চম, সপ্তম ও একাদশ সংশোধনী বাতিল করে উচ্চ আদালতের রায়ের পরও কোনো বিরোধ বাধেনি। এর কারণ, বিচার বিভাগের প্রতি আইন ও নির্বাহী বিভাগের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা হলে তা খুশির ব্যাপার হতো। কিন্তু বাস্তব হলোÑ নির্বাহী বিভাগের আকাক্সক্ষার সাথে উচ্চ আদালতের রায়ের কোনো বিরোধ ছিল না বলেই সমস্যা হয়নি। অন্য কথায় আদালতের রায়ে নির্বাহী বিভাগের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ছিল বলেই আমরা নির্বাহী বিভাগকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি।
আমাদের আইন বিভাগ স্বাধীন না নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছার অধীন, সে প্রশ্ন অবান্তর। কেননা নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছার বিপরীতে আইন বিভাগ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন নজির আমরা দেখিনি। মাঝে মধ্যে নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে সংসদে আলোচনা-সমালোচনা হয়। ঝড়ও ওঠে। কিন্তু তা সীমার বাইরে যাওয়ার আগেই অঙ্গুলি হেলন বা চোখরাঙানির সামনে থিতিয়ে যায়। তাই আখেরে নির্বাহী বিভাগের আধিপত্যই চূড়ান্ত। অন্তত বর্তমান শাসনামলে এ নিয়ে দ্বিমত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।
প্রকাশ্য আদালতে একজন বিচারপতির স্পিকার সম্পর্কে চরম মন্তব্যকে ঘিরে সংসদের বাজেট অধিবেশনের শুরুতে যে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাকে কেউ কেউ বিচার বিভাগের সাথে আইন বিভাগের ঠোক্কর হিসেবে দেখেছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার একটা বড় পরীক্ষা দেখার সুযোগ এসেছে। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে কে বড় তারই পরীক্ষা এবার হয়ে যাবে। তাদের সে আশা যে পূরণ হওয়ার নয়, একটু খেয়াল করলেই তারা তা বুঝতে পারতেন। কেননা যতই উচ্চবাচ্য করুক না কেন, নির্বাহী বিভাগের চোখের দিকে কিন্তু সবাই তাকিয়ে ছিল। যেই নির্বাহী বিভাগের চোখ বড় হয়েছে, তখনই সবার সুর বদলে নরম হয়ে গেছে। আলোচ্য বিচারপতি আদালতের আসনে বসে স্পিকারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেন। তার জ্ঞানের পরিধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং আইনজীবীর সনদ বাতিলযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। পার্লামেন্ট এ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ বিুব্ধ হয় এবং ওই বিচারপতির অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণের দাবি ওঠে। স্পিকার ঘোষণা দেন, তিনি এ বিষয়ে রুলিং দেবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। স্বভাবতই সবার নজর পড়ে স্পিকারের রুলিংয়ের দিকে। উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি সম্পর্কে স্পিকারের রুলিংয়ে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ককে কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়, কিভাবে সংসদ সদস্যদের প্রস্তাব গ্রহণের দাবিকে রুলিংয়ে সমন্বয় করা হয়, তা দেখার অপেক্ষায় ছিলেন দেশের বিদগ্ধজন। আশা করা হয়েছিল, স্পিকার স্বাধীনভাবে তার পদমর্যাদার দিকে লক্ষ রেখে এমন রুলিং দেবেন, যা ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ সীমা লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটাতে সাহস না পান।
স্পিকার রুলিংয়ের ঘোষণা দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিচার বিভাগ সম্পর্কে সংসদে ঢালাও বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আইন ও বিচার বিভাগ উভয়ই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের সব বিভাগ নিজ এখতিয়ার ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করবে। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে দুই বিভাগের দ্বন্দ্বে তৃতীয় কেউ সুযোগ নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ইতিবাচক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সাথে আলোচনার দায়িত্ব দেন। ওই মন্ত্রী স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সাথে আলাদা কথা বলেন। তিনি স্পিকারকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মনোভাব জানিয়ে দেন এবং এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বিষয়টির ইতিবাচক সমাপ্তির জন্য স্পিকারকে অনুরোধ করেন। আলোচ্য বিষয়ে পার্লামেন্টে যে বিতর্ক হয় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী তাতে অংশ নেননি। আলোচ্য বিচারক স্পিকার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সে বিষয়েও কোনো বক্তব্য দেননি। ফলে চাপটা গিয়ে পড়ে সংসদ ও স্পিকারের ওপরই। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, স্পিকারের রুলিংয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মনোভাবই প্রতিফলিত হবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। স্পিকার যে দিন রুলিং দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন, সে দিন রুলিং দেননি। আট দিন পর গত সোমবার রুলিং দেন তিনি। ছয় পৃষ্ঠার এ রুলিংয়ে স্পিকার তার ব্যক্তিগত মানমর্যাদা নিয়ে যত কথা বলেছেন, সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলেছেন তার চেয়ে সামান্যই। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সংসদে বিচার বিভাগ নিয়ে আলোচনার সীমা, বিচার বিভাগের সংসদ সম্পর্কে মন্তব্যের সীমা সম্পর্কে এ রুলিংয়ে যে বিস্তারিত আলোকপাত করার অবকাশ ছিল, স্পিকার তার কিছুই করেননি। তিনি শুধু আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যকে অশোভন ও সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করে তার সম্পর্কে প্রধান বিচারপতিকেই ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। 
স্পিকার আবদুল হামিদ তার রুলিংয়ে বলেন, একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না। এ ঘটনাকে দুঃখজনক, অনাকাক্সিত, অনভিপ্রেত ও ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত বলে দাবি করে বলেন, ওই বিচারপতি সংসদ ও আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না সন্দেহ রয়েছে। প্রত্যাশা ছিল তিনি (এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক) সব বিষয় হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অপসারণ-সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের প্রস্তাবের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করলেও বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রেখে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ এই প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানান। একই সাথে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পুরো বিষয়টি প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়ে তাকেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন হবে না। অবশ্য একজন বিচারকের এ ধরনের আচরণে করণীয় সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি যে ব্যবস্থা নেবেন তাতে জাতীয় সংসদের সমর্থন থাকবে বলে জানান স্পিকার।
দীর্ঘ ছয় পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ভিত্তি সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ সংসদ। এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এই পদ্ধতিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানকে সমুন্নত রাখবÑ দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে। স্পিকার বলেন, আমার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই আশা করি এ-সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটবে। অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, আদালতের বিচারকের মন্তব্যের সূত্র ধরে অনেকেই বিশেষ করে পত্রপত্রিকাগুলো একে সংসদের সাথে বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে আসলে এটি কোনো বৈরিতা নয়। এটি সংসদ সম্পর্কে জনৈক বিচারপতির কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত উক্তি। পুরো বিচার বিভাগকে এর সাথে জড়ানো ঠিক হবে না। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা গভীর সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্ক। পারস্পরিক এ সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এদেশটি আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং স্পিকার হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গÑ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ েেত্র স্বাধীন। এ েেত্র কর্মপদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ল্য ও উদ্দেশ্য এক এবং তা হলো সর্বাবস্থায় জনগণের কল্যাণসাধন।
স্পিকারের জানা থাকার কথা যে, আলোচ্য বিচারপতির বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয়েছে। রিট শুনানির এখতিয়ার পরিবর্তন করে তাকে ফৌজদারি বিষয়ে শুনানির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করে পত্র দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। রাষ্ট্রপতি এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয়কে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয় কোনো বিচারপতি সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে পারে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। রাষ্ট্রপতির এ চিঠি প্রধান বিচারপতিকে দেয়া যথার্থ হতো বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতির এ চিঠি মোতাবেক আইন মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানা যায়নি। আলোচ্য বিচারপতির বেঞ্চ পরিবর্তনের সাথে এর সম্পর্ক আছে কি না তা-ও অপ্রকাশিত। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ, স্পিকারের রুলিং একটি বড় বিতর্কের কোনো সুস্পষ্ট সমাধান বা পথনির্দেশ দিতে পারল না। বড় ক্ষতে মলম দিয়ে খানিকটা উপশমের চেষ্টা হয়েছে মাত্র। এখন স্পিকারের আহ্বান মতে প্রধান বিচারপতি কী পদক্ষেপ নেন সে দিকেই জাতি তাকিয়ে থাকবে। 
azammir2003@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন