বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

রাজনৈতিক মিথ্যাচারের শেষ কোথায়?



॥ মুহাম্মদ আবদুল জববার ॥

একটি মিথ্যা কথা আরো ১০টি মিথ্যা কথা বলার পথ নির্দেশ করে। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখতে চাইলেও একদিন সত্য প্রকাশ পাবেই। মিথ্যার পরিণাম ধ্বংস। মিথ্যাবাদী রাখালের কথা সবার জানা আছে। তার আহ্বানে প্রথম দিকে কিছু পথচারী সাড়া দিলেও রাখাল মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হওয়ায় যেদিন বাঘ তাকে আক্রমণ করল সেদিন অনেক কাকুতি-মিনতি করে বাঘ... বাঘ... বাঁচাও... বাঁচাও বললেও তাকে কেউ বাঁচাতে আসেনি। যার পরিণতি ছিল অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।
আমাদের সমাজে এই অপ্রত্যাশিত কালচার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। ভিন্নমতের যে কাউকে আক্রমণ করা বা অপমানিত করাই যেন আমাদের কালচার। এ কালচার থেকে রেহাই পায়নি আমাদের জাতীয় রাজনীতিও।
মিথ্যাচারের কারণে কত মানুষের জীবন ত-বিত। বছরের পর বছর বিনা অপরাধে কারাবরণ করছে কত মানুষ, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ দেশের ইতিহাসে খোঁজ মেলে কত জজ মিয়ার! এসব মিথ্যাচারের বীভৎস চিত্রগুলো চোখের পর্দায় ভেসে এলে গা শিউরে ওঠে। এর কোনো সমাধান কি নেই? 
তখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়তাম। শুনলাম কলেজ আঙিনায় দু’টি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, আর এ মামলায় আমার বড় ভাইকে আসামি করা হয়েছে। সে সেদিন কলেজেও যায়নি। তাকে গ্রেফতার করা হলো, দীর্ঘ তিন মাস কারাভোগ করতে হলো। একজন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। যার যতটুকু অপরাধ আইনের আলোকে অপরাধী হলে সে ততটুকু শাস্তি পাবে। পরে শুনেছিলাম কারো চাপে বাধ্য হয়ে কলেজ কর্তৃপ কিছু নির্দোষ ছাত্রকে দায়ী করে মামলা করে।
ঘটনা ঘটার পরে প্রকৃত দোষীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, অথচ নিরপরাধ নাগরিকের ওপর পুলিশের নির্মম প্রহার, রিমান্ড, জেল-জুলুম চলছেই। মন্ত্রীর মুখ থেকেও শোনা যায়, জেলে গেলে কী হবে? কয়েক দিন পরে ছেড়ে দেবে। এ কেমন কথা? বিনা অপরাধে একজন নাগরিককে কেন জেলে যেতে হবে, কেন তার স্বাধীনতা খর্ব করা হবে। সন্দেহÑ রাজনৈতিক কর্মী! হিউমেন রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কার কথা কে শোনে। বিরোধী দলের কোনো সভা সমাবেশ করলেই আইনশৃঙ্খলা নষ্ট হয়! অথচ এ বছরের ১২ মার্চ বিরোধী দলের সমাবেশকে সামনে রেখে মহাজোট সরকার তিন দিন ধরে অঘোষিত হরতাল দিয়ে জনজীবন স্তব্ধ করে। ১১ জুন ১৮ দলের গণসমাবেশে আগত নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের লালবাহিনী সদরঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে কি আইনশৃঙ্খলা বিঘিœœত হয়নি? বিরোধী দল হরতাল ডাকলে কোনোভাবেই মিছিল মিটিং করতে দেয়া হয় না অথচ নিজ দলের নেতাকর্মীদের পুলিশি প্রহরায় শোডাউন করে জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এটিও কি আইনশৃঙ্খলা রার নমুনা! বিরোধী দলের কর্মসূচি মানেই বাধা, পুলিশের লাঠিচার্জ, ১৪৪ ধারা জারি অথবা সরকারি দলের আক্রমণ। তারপর ধরপাকড়। মামলা, জেল-জুলুম। জামিনের পর শ্যোন অ্যারেস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরও সামনে মতায় আসার স্বপ্ন! এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন নির্বুদ্ধিতা জাতির পথচলাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
কয়েক দিন আগে বিরোধী দল হরতাল ডেকেছিল। সচিবালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮ দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেয়া হলো। তারপর কোর্টে অ্যারেস্ট। অথচ এই ঘটনার দিন অনেকেই ছিলেন রাজধানীর বাইরে। এসব হাস্যকর।
সম্প্রতি সাগর-রুনি রহস্যজনক খুনের কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পর দিন শুনলাম যে, পুলিশ কয়েকজন সন্দেহভাজন হেরোঞ্চিকে গ্রেফতার করেছে। অথচ মূল আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবে কত হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতার ৪১ বছরে ঘটল। সরকার তদন্তের নামে আইওয়াশ করে কিন্তু বেশির ভাগ হত্যা মামলার রহস্য জাতির সামনে অস্পষ্ট থেকেই গেল। 
এখন শুরু হয়েছে নতুন সংস্কৃতি গুম করে ফেলা। এ সরকারের আমলে ৯ শতাধিক মানুষ গুম হয়েছে। এদের একটা অংশ ফিরছে লাশ হয়ে। আর একটা অংশের সন্ধান মেলেনি। এসব পরিবারের অর্তনাদে জাতি বাকরুদ্ধ। ঔপনিবেশিক কায়দায় নাগরিকদের যখন-তখন ধরে নিয়ে যাওয়া এবং অত্যাচার-নির্যাতন, হুমকি দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করে বিচারের আগেই অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণের এই চর্চা বড় ধরনের তি করবে। 
কার স্বার্থে এসব গুম, টর্চার? অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন তার জন্য আইন আছে, আছে আদালত। তার নাগরিক অধিকার যদি আমরা ুণœ করতে সানন্দে রাজি হই, সব নাগরিকের অধিকার রাষ্ট্র ুণœ করতে মোটেও দ্বিধা করবে না। 
কারো বিরুদ্ধে যেকোনো পরে অভিযোগ উঠলে পরীা-নিরীা না করে তাকে নাগরিকের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত করার প্র্যাকটিস মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে অন্যায়। একজন ব্যক্তি যত বড় অপরাধই করুক না কেন যদি তার নাগরিক অধিকার ুণœ করে আগেই অপরাধী বলে চিহ্নিত করি তাহলে আইন-আদালত-সংবিধানের কী দরকার? এতে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। নিরপরাধ কত জজ মিয়ার আর্তচিৎকার গুমরে মরবে কাল থেকে কালান্তরে। কিছু সুবিধাবাদী লোক মতার অপব্যবহার করতে সদা তৎপর। সরকার পুলিশ প্রশাসনকে অপব্যবহার করে আইনের রকদেরকে জনগণের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে ক্রসফায়ার, গুম, লুণ্ঠন ইত্যাদিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের। 
নিজদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বিরোধী দলকে জেল-জুলুম দিয়ে দমন করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বরং নিরপরাধ ব্যক্তিদের অকারণে হয়রানি সরকারের পতনকে ত্বরান্বি^ত করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দল একাত্ম হয়ে কাজ করা জরুরি। নচেৎ দেশের অভ্যন্তরে গোলমাল পাকাতে বহিঃশত্র“ সদা তৎপর থাকে। বর্তমানে র‌্যাবকে যত্রতত্র ব্যবহার করে তাদের বিশেষত্ব ম্লান হতে চলেছে। প্রতিনিয়ত সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশী হত্যা করছে। কিন্তু কোন অদৃশ্য ইশারায় বিজিবি জোরালো ভূমিকা রাখছে না?’
পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, তা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকে ভাবতে হবে। যাদের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা তাদের সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান বাড়ানো জরুরি।
অপর দিকে পুলিশের চিন্তা করা উচিত, এ দেশের ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলোর ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন দেয়া হয়। সুতরাং প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা-সম্ভ্রম রার দায়িত্ব তাদেরই। আর নয় মিথ্যা আর লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি, ভিন দেশের পদলেহন। সবাই নিজের কর্তব্য সচেতনতা ও জবাবদিহিতার দ্বারকে উন্মোচন করে শান্তির সোনালি দেশ গঠনে ব্রতী হই। 
zabbarics@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন