মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং অর্থনীতির গতি প্রবাহ



অলিউর রহমান ফিরোজ : 
বাংলাদেশ শীঘ্রই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। তবে কিভাবে এবং কোন সফলতার আলোকে প্রধানমন্ত্রী এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা তিনি বলেননি। দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যৎ অর্থনীতি কোন পথে ধাবিত হয় বলা মুশকিল। এমনিতেই দেশের মানুষের জীবনমান অনেক নীচে নেমে গেছে। দিন দিন অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে পড়ছে, সে পরিস্থিতিতে দেশ প্রধান মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছে তা কতোটা বাস্তববিবর্জিত তা-ই চিন্তার বিষয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিছু সফলতা যে নেই তা বলা যাবে না। মাতৃমৃত্যু হার কমানো, সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা, খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশ সামান্য এগিয়েছে। কিন্তু একটি দেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে দাঁড়াতে হলে প্রথমই দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় থাকতে হবে আইনের শাসন। আন্তর্জাতিক মহলের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক। দেশের উৎপাদনমুখী খাতের জয়-জয়কার। মূল্যস্ফীতির সহনীয়তা। বিনিয়োগের জন্য থাকতে হবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ। বিনিয়োগের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং আস্থা। বিদ্যুৎ-গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তা। দেশের ব্যাংকিং খাত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীলতা ধরে রাখা। কৃষি সেক্টরের ওপর বড় ধরনের জোর দিয়ে জিডিপিতে বড় অর্জন । কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী যে চিন্তা-চেতনা থেকে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে চাচ্ছেন তার দিকপাল এখনো ঠিক হয়নি। অর্থনীতিতে গতিশীলতা পায়নি। ব্যাংকিং সেক্টরে অরাজকতা। কৃষিতে সুখবর নেই। কৃষকরা এখন ফসল ফলিয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। নতুন বিনিয়োগের কোন খবর নেই। আগে যা ছিল এখন তাও বন্ধের পথে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করলেও তারা গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য উৎপাদনে যেতে পারছেন না। বসে বসে তাদের ব্যাংকের সুদ গুণতে হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সেক্টরে আশান্বিত হওয়ার মতো কোন খবর নেই। গার্মেন্ট সেক্টরে দেখা দিয়েছে অরাজকতা। এর জন্য অবশ্যই মালিকরাও কম দায়ী নয়। তাদের গাফিলতির কারণেই অর্থনীতির ক্ষেত্রে সফল গার্মেন্ট সেক্টর এখন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়েছে। দেশের বাজারে গার্মেন্ট সেক্টরে সস্তা শ্রমিক পাওয়ায় অনেক দেশের ক্রেতারা এখানে এসেছেন পোশাক খাতের অর্ডার নিয়ে। এখন মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পড়ে পোশাক শ্রমিকরা নাকাল হচ্ছেন। তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাদের জীবন-যাপন করতে। তার কারণেই তাদের বেতন বাড়ানোর জন্য তাদের আন্দোলন। অনেক বায়ার যখন অন্যান্য  দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মজুরি কম সে কারণেই তারা এখান থেকে পোশাক খাতে অর্ডার দিচ্ছেন। কিন্তু যখন শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাবে তখন গার্মেন্ট সেক্টরে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের প্রধানমন্ত্রী তাই যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ কিছু দিনের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে তার আগে তার অবকাঠামোগত দিক ঠিক করতে হবে। থাকতে হবে রাজনৈতিক সহনশীলতার অঙ্গীকার। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কোন বিকল্প নেই। বিনিয়োগে শ্লথগতি, অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃংখলা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা। বৈদেশিক সাহায্য কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ অনুসারে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হলে অর্থনীতি আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। রেন্টাল পাওয়ারের নামে জ্বালানি খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসা উচিত। ঘাটতি বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের ১৬০টি বাজেট ঘাটতি থাকছে। দেশে মোট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। এছাড়া বাজেটে এডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এখান থেকে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ শতাংশ। এটি উচ্চাভিলাষী কিছু নয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব আয় ভালো। কিন্তু বেসরকারি খাত হল প্রবৃদ্ধি অর্জনের বড় গতি। এ খাতে কিছু শ্লথগতি রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন দুরূহ। কারণ অর্থায়ন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে হিসাব করা হয়েছে তার দুটিই কষ্টসাধ্য।  অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিদেশী সাহায্যের পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের অভিজ্ঞতা বলছে এ পরিমাণ বিদেশী সাহায্য সম্ভব নয়। অন্যদিকে ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ বছর ঋণ পাওয়া গেছে মাত্র ৩৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ পরিমাণ টাকা ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে পাওয়া যাবে না। এ খাতের বাকি ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর ব্যাংকবহির্ভূত খাতের ঋণ যোগ হওয়ার মানে হল বাস্তবায়নে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে ২৯ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের বাজেটে যা ছিল সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সার্বিকভাবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়।  আগামীতে রফতানি ও বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেবে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে, কল মানির সুদের হার বাড়বে এবং বিনিয়োগ কমবে।
 দেশের বিচার বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ নয়। ২০ বছরে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাজেটীয় কাঠামো একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে চলে গিয়েছিল। বর্তমানে সেটি হুমকির সম্মুখীন। বিনিয়োগ এবং এর অর্থায়নের ওপর নির্ভর করছে প্রবৃদ্ধি অর্জন। মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগের পক্ষে নয়। এছাড়াও শিল্প উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছে না। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বিদ্যমান। ফলে যেটুকু ঋণ পাওয়া যাচ্ছে তার সুদের হার বেশি। এর ফলে বিনিয়োগের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।  আমাদের দেশে বিনিয়োগে দুটি দিক ইতিবাচক ছিল। তা হল- শ্রমের মূল্য কম এবং সস্তা জ্বালানি। কিন্তু এখন ওই সুযোগটি আর থাকছে না। কারণ জ্বালানির দাম বেড়ে যাচ্ছে।  একটি দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হল মূল্যস্ফীতি, সুদের হার এবং মুদ্রা বিনিময়ে হারের মধ্যে সমন্বয় করা। কিন্তু বর্তমানে সবগুলোই নাজুক অবস্থানে ।
জ্বালানির রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ারে নানা অনিয়ম রয়েছে। এটি কোন সমস্যার সমাধান নয়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রাথমিক জ্বালানিকে সামনে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। আইএমএফের ঋণ চুক্তি আমাদের জন্য বড় সমস্যা। কারণ এ চুক্তির জন্য আমাদের জ্বালানির মূল্য বাড়ানোসহ আর্থিক খাতে বড় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এ সময়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগে অর্থনীতির গতি প্রবাহে তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। এ বছর ৭টি খাতে বরাদ্দের হার কমানো হয়েছে। অর্থাৎ টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও মূল বাজেটের হিসাবে শতকরা হারে বরাদ্দ কমেছে। এসব খাতের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা, সামরিক, শিল্প ও আর্থিকসেবা, কৃষি এবং ধর্মীয় বিষয় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ খাতগুলোতে বাজেট বরাদ্দ কমানোর কারণে ভবিষ্যৎ সংকট তৈরি করবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন