কাজী সিরাজ
দেশে আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, শান্তিপ্রিয় কোনো মানুষেরই কাম্য নয়; কাম্য নয় আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন বা সেই ধরনের অন্য কিছু। এটা প্রায় সবাই জানেন ও মানেন যে, দুই নেত্রীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট হিংসা আর হানাহানির রাজনীতি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, লগি-বৈঠার বেপরোয়া ব্যবহার, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হত্যা ও লাশের ওপর লাফালাফির অমানবিকতা এবং বলা চলে দেশে একটা প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থার মুখেই আসে ওয়ান-ইলেভেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই নেত্রীসহ অন্য বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল না। বিরোধ বেধেছিল প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে। তখনকার, অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব সাংবিধানিক নির্দেশ অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তখন সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান। হাসানের এক সময়কার বিএনপি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যাকে চায়, বিএনপি-জামায়াত জোট তা মানেনি। শেষ পর্যন্ত সংবিধানের বাতিলপূর্ব ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের অন্য অপশনগুলো কার্যকর করার ব্যাপারে আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ সুচতুরভাবে পরিহার করে এবং সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বা তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বা সংবিধানসম্মত আপিল বিভাগের অন্যান্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করে এ সংক্রান্ত সংবিধানের সর্বশেষ অপশন ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বও গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত ছিল, কিন্তু অসাংবিধানিক ছিল না। কিন্তু হাওয়া ভবনের অর্বাচীনদের মোটা বুদ্ধিতে বিএনপির সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ এনে সেই যে বেপরোয়া লড়াই ও ঘোষণা দিয়ে লগি-বৈঠার ব্যবহার শুরু হলো, তারই তো পরিণতি ওয়ান-ইলেভেন! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলখেল্লা পরে জাতির ঘাড়ে ৯০ দিনের জায়গায় দুই বছরের বেশি সময় চেপে থাকল একটি অসাংবিধানিক সরকার- কারও কারও মতে সেই সরকার ছিল অবৈধ। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন সেই সরকারের সমালোচনা করলেও এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে, তৎকালীন সেনাপতি মইন উ আহমেদের প্রকাশ্য সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত বিশ্বব্যাংকের সাবেক মাঝারি মানের কর্মচারী ড. ফখরুদ্দীন আহমদ যেদিন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, সেদিন বঙ্গভবনের সেই অনুষ্ঠানে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে উপস্থিত ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার মহাজোটের অন্য শীর্ষ নেতারা। শুধু তাই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'এই সরকার (মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার) আমাদের আন্দোলনের ফসল।' এটা ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। উল্লেখ্য, ফখরুদ্দীন সরকারের বিরোধিতা করে বেগম খালেদা জিয়া এবং চারদলীয় জোটের কোনো নেতা সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি। অর্থাৎ এবার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গোঁড়া সমর্থক। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের তারাই পাইওনিয়ার। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর (ঐতিহ্যগতভাবে আসনটি ছিল আওয়ামী লীগের) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন আগামী নির্বাচনে নতুন ভোটার হিসেবে যারা প্রথম ভোট দেবে তাদের জন্মই হয়নি। আর মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পথ সুগম করে দেওয়া এবং সেই সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণাকালে তাদের বয়স ছিল ১১-১২ বছর। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট তাদের অধিকাংশেরই অজানা থাকার কথা। তারা সব জেনে গেলে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতাদের এখনকার বক্তব্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য। তারা একে অবশ্যই ডবল স্ট্যান্ডার্ড বলবে_ রাজনীতিতে যা অভিপ্রেত নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এবারের বিরোধ কে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন বা কারা উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন তা নিয়ে নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও আন্দোলন আবার ১৯৯৪ সালে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১১ কার্যদিবসের স্বল্পকালীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ এবং তা কার্যকর হয় ৩০ মার্চ ১৯৯৬। এর আগে এ সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সহিংস আন্দোলনের চাপেই তৎকালীন বিএনপি সরকার এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয়। জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে লীগ সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে তা আবার ফিরে আসতে পারে, যেমন চাপের মুখে সংযোজিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দল বিএনপি ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বার বার বলেছিলেন সংবিধানবহিভর্ূত কোনো ব্যবস্থা তারা মানবেন না। ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর এক জনসভায় তিনি নির্দলীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দলের দাবি নাকচ করে বলেন, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, শাসক লীগ ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাও একই কথা বলছেন_ তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেত্রী একটি আপসরফায় পেঁৗছতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়। তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে তিনি ও তার দল স্পষ্টতই সরে এসেছে। তারা নির্দলীয় একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছেন এখন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট যখন অনড় ছিল তখন সরকারি মহল থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের আওতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়োজনে আবার সংবিধান সংশোধনের সুযোগ আছে বলে বলা হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারের নতুন প্রস্তাব দিলে শাসকমহল আবার তাদের পূর্বাবস্থানে ফিরে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী এই ইস্যুতে রাজনৈতিক সংঘাতকেই উস্কে দিচ্ছে। আপস-মীমাংসার কোনো পথই তারা খোলা রাখছে না। অথচ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছানোর সুযোগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ গত ২৫ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত এক লেখায় নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন। বর্তমান সরকারের পরিবর্তে চলতি সংসদের সদস্যদের নিয়ে তিনি যে সরকারের কাঠামো প্রস্তাব করেছেন তাও হবে দলীয় বা সর্বদলীয় সরকার বা সংস্থা। কিন্তু বিএনপি তো ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না, এমনকি নির্বাচনকালীন কোনো অন্তর্বর্তী সরকারেও তারা অংশ নেবে বলে মনে হয় না। অপরদিকে আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে নতুন একটি বিকল্প নিয়েও ভাবা যেতে পারে। প্রস্তাবটি হচ্ছে_ দুই দল নিরপেক্ষ (নির্দলীয়) ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন প্রধান উপদেষ্টা ও ১০-১২ জন উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর নাম সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। তাদের জন্য ১১টি বা ১৩টি আসন শূন্য করে দেওয়া হবে। ওইসব আসনের উপনির্বাচনে প্রধান দুই দল কোনো প্রার্থী দেবে না। প্রধান দুই দলের বাইরে যারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এটা নিশ্চিত যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও তারা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। সেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা যেদিন শপথ নেবেন, তার শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার বিলুপ্তি ঘটবে। অন্য মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট নবম জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করবেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ প্রায় এ ধরনের একটি ফর্মুলা দিয়েছিলেন। এ ধরনের একটি নির্বাচিত নির্দলীয় সরকার, যা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে না- উভয় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, যদি তারা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিক হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের সমঝোতার ভিত্তিতেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই।
কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এ ধরনের নির্বাচিত কোনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও সাহসী নয় বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সংবিধানের বাইরে যাবেন না। সংবিধানের আওতায়ও কোনো নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা যে তারা মানবেন না সে কথা ব্যাখ্যা করে বলেছেন শাসক লীগের মুখপাত্র লীগ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে এবং তাদের প্রস্তাব সংসদে অনুমোদন করাতে হবে অথবা আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। রেলমন্ত্রী হয়ে রেলের কালো বিড়াল ধরার লম্বা কথা বলে যিনি এখন নিজেই কালো বিড়াল ধরার জনগণের সন্দেহের 'কলে' ফেঁসে আছেন, রেল থেকে বিতাড়িত সেই দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একই ঢোল বাজিয়ে সরকারের ওপর জনগণের বিরক্তি বাড়াচ্ছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আবার কঠোর বলে মনে হচ্ছে। আর এতেই শঙ্কা বাড়ছে সংঘাতের। মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাবের আবরণে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টির একটি তৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন সংসদে বাজেট বক্তৃতায়। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, 'বিদ্যুতের ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। বিদ্যুতের ব্যাপারে বললে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন; আমার বন্ধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে যান। তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। তিনি হয়তো তার হারানো রাজ্য ফিরে পেতে চান।' প্রধানমন্ত্রী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমালোচনা থেকে ধারণা করা যায়, সংবিধান সংশোধনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস এবং প্রয়োজনে মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তার কোনো আপত্তি নেই তাতে। সংসদে প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময়-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'তার প্রস্তাবে বিএনপির খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই অনুষ্ঠানে তিনি এও বলেছেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির একজন বাদে অন্য সবাই আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ছিলেন। সুরঞ্জিত বাবুও বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে।' এ থেকে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়, তার সংশোধনী প্রস্তাবের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারেও সংশোধনী আনা যেতে পারে। একবার নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনীর প্রশ্ন এলে বিরোধী দলের দাবির বিষয়টিও আসতে পারে। কারণ এ ব্যাপারে একটা প্রবল জনমত আছে। এ ইস্যুতে অদূর ভবিষ্যতে গণআন্দোলনে নাকানি-চুবানি খাওয়ার হাত থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার একটি পথও প্রচ্ছন্নভাবে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তার এ অবস্থান চলমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন অনেকে। বোঝা যাচ্ছে, সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে লীগ সরকার দেশকে যে আবার একটা সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে, জোটের কোনো কোনো শরিক তার দায় কাঁধে নিতে চাইছে না।
সংসদে গিয়ে ফায়সালা বা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে পরবর্তী সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার যে 'ফতোয়া' সরকারপক্ষ দুই সপ্তাহ ধরে দিচ্ছে, বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট তা মানবে না_ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি বর্তমান ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে দল ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাঁচানোর আশায় জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ সমঝোতায় পেঁৗছে গেলেও (জামায়াতের পক্ষে এটা সম্ভব। ১৯৯১ সালে দুজন মহিলা সংসদ সদস্যের বিনিময়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সাহায্য করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনে তারা বিএনপিকে ছেড়ে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হয়) বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ বিএনপির আন্দোলন করার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তাত্তি্বক বিশ্লেষণ দিয়ে তারা সরকারবিরোধী শক্তিকে হতাশ করতে চাইছেন। কিন্তু আমরা জানি, একটি সরকার যখন তার অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, দলবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অজনপ্রিয় হয়ে যায়, জনগণই সেই সরকারের বিরুদ্ধে দ্রোহের পতাকা উড়ায়। জনগণের দ্রোহই বিএনপির পুঁজি হয়ে যেতে পারে। যদি অন্য কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠে। বর্তমান সরকার আর জনপ্রিয় সরকার নেই। সরকার পক্ষের আচরণ-উচ্চারণে মনে হচ্ছে, তারা গায়ের জোরেই শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার ভুল করছে। গভীর রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে না হাঁটলে তাদের অবশ্যই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। আবর্জনা পরিষ্কার করে সামনে থেকে জনগণের সাহসী নেতৃত্ব দিতে বিএনপি যদি ব্যর্থও হয়, জনগণ ব্যর্থ হবে না। প্রচলিত রাজনীতির ও সংগঠনের ব্যাকরণ পাল্টে দিয়ে প্রয়োজনে জনগণই গড়ে তুলবে তাদের আপন রাজনৈতিক শক্তি।
সংযুক্তি : বাহাত্তর সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) ধারা অনুযায়ী সংসদ বলবৎ থাকা অবস্থায়ই পরবর্তী নির্বাচন হবে। বর্তমান এমপিরা স্বপদে বহাল থেকেই নির্বাচন করবেন। এতে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না। আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে সন্ধিহান আওয়ামী লীগ এই সাংবিধানিক সুবিধাও ভোগ করতে চায়। অন্যরা তা মানবেন কেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
দেশে আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, শান্তিপ্রিয় কোনো মানুষেরই কাম্য নয়; কাম্য নয় আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন বা সেই ধরনের অন্য কিছু। এটা প্রায় সবাই জানেন ও মানেন যে, দুই নেত্রীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট হিংসা আর হানাহানির রাজনীতি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, লগি-বৈঠার বেপরোয়া ব্যবহার, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হত্যা ও লাশের ওপর লাফালাফির অমানবিকতা এবং বলা চলে দেশে একটা প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থার মুখেই আসে ওয়ান-ইলেভেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই নেত্রীসহ অন্য বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল না। বিরোধ বেধেছিল প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে। তখনকার, অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব সাংবিধানিক নির্দেশ অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তখন সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান। হাসানের এক সময়কার বিএনপি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যাকে চায়, বিএনপি-জামায়াত জোট তা মানেনি। শেষ পর্যন্ত সংবিধানের বাতিলপূর্ব ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের অন্য অপশনগুলো কার্যকর করার ব্যাপারে আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ সুচতুরভাবে পরিহার করে এবং সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বা তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বা সংবিধানসম্মত আপিল বিভাগের অন্যান্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করে এ সংক্রান্ত সংবিধানের সর্বশেষ অপশন ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বও গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত ছিল, কিন্তু অসাংবিধানিক ছিল না। কিন্তু হাওয়া ভবনের অর্বাচীনদের মোটা বুদ্ধিতে বিএনপির সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ এনে সেই যে বেপরোয়া লড়াই ও ঘোষণা দিয়ে লগি-বৈঠার ব্যবহার শুরু হলো, তারই তো পরিণতি ওয়ান-ইলেভেন! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলখেল্লা পরে জাতির ঘাড়ে ৯০ দিনের জায়গায় দুই বছরের বেশি সময় চেপে থাকল একটি অসাংবিধানিক সরকার- কারও কারও মতে সেই সরকার ছিল অবৈধ। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন সেই সরকারের সমালোচনা করলেও এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে, তৎকালীন সেনাপতি মইন উ আহমেদের প্রকাশ্য সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত বিশ্বব্যাংকের সাবেক মাঝারি মানের কর্মচারী ড. ফখরুদ্দীন আহমদ যেদিন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, সেদিন বঙ্গভবনের সেই অনুষ্ঠানে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে উপস্থিত ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার মহাজোটের অন্য শীর্ষ নেতারা। শুধু তাই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'এই সরকার (মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার) আমাদের আন্দোলনের ফসল।' এটা ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। উল্লেখ্য, ফখরুদ্দীন সরকারের বিরোধিতা করে বেগম খালেদা জিয়া এবং চারদলীয় জোটের কোনো নেতা সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি। অর্থাৎ এবার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গোঁড়া সমর্থক। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের তারাই পাইওনিয়ার। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর (ঐতিহ্যগতভাবে আসনটি ছিল আওয়ামী লীগের) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন আগামী নির্বাচনে নতুন ভোটার হিসেবে যারা প্রথম ভোট দেবে তাদের জন্মই হয়নি। আর মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পথ সুগম করে দেওয়া এবং সেই সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণাকালে তাদের বয়স ছিল ১১-১২ বছর। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট তাদের অধিকাংশেরই অজানা থাকার কথা। তারা সব জেনে গেলে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতাদের এখনকার বক্তব্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য। তারা একে অবশ্যই ডবল স্ট্যান্ডার্ড বলবে_ রাজনীতিতে যা অভিপ্রেত নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এবারের বিরোধ কে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন বা কারা উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন তা নিয়ে নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও আন্দোলন আবার ১৯৯৪ সালে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১১ কার্যদিবসের স্বল্পকালীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ এবং তা কার্যকর হয় ৩০ মার্চ ১৯৯৬। এর আগে এ সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সহিংস আন্দোলনের চাপেই তৎকালীন বিএনপি সরকার এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয়। জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে লীগ সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে তা আবার ফিরে আসতে পারে, যেমন চাপের মুখে সংযোজিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দল বিএনপি ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বার বার বলেছিলেন সংবিধানবহিভর্ূত কোনো ব্যবস্থা তারা মানবেন না। ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর এক জনসভায় তিনি নির্দলীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দলের দাবি নাকচ করে বলেন, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, শাসক লীগ ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাও একই কথা বলছেন_ তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেত্রী একটি আপসরফায় পেঁৗছতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়। তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে তিনি ও তার দল স্পষ্টতই সরে এসেছে। তারা নির্দলীয় একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছেন এখন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট যখন অনড় ছিল তখন সরকারি মহল থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের আওতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়োজনে আবার সংবিধান সংশোধনের সুযোগ আছে বলে বলা হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারের নতুন প্রস্তাব দিলে শাসকমহল আবার তাদের পূর্বাবস্থানে ফিরে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী এই ইস্যুতে রাজনৈতিক সংঘাতকেই উস্কে দিচ্ছে। আপস-মীমাংসার কোনো পথই তারা খোলা রাখছে না। অথচ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছানোর সুযোগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ গত ২৫ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত এক লেখায় নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন। বর্তমান সরকারের পরিবর্তে চলতি সংসদের সদস্যদের নিয়ে তিনি যে সরকারের কাঠামো প্রস্তাব করেছেন তাও হবে দলীয় বা সর্বদলীয় সরকার বা সংস্থা। কিন্তু বিএনপি তো ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না, এমনকি নির্বাচনকালীন কোনো অন্তর্বর্তী সরকারেও তারা অংশ নেবে বলে মনে হয় না। অপরদিকে আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে নতুন একটি বিকল্প নিয়েও ভাবা যেতে পারে। প্রস্তাবটি হচ্ছে_ দুই দল নিরপেক্ষ (নির্দলীয়) ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন প্রধান উপদেষ্টা ও ১০-১২ জন উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর নাম সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। তাদের জন্য ১১টি বা ১৩টি আসন শূন্য করে দেওয়া হবে। ওইসব আসনের উপনির্বাচনে প্রধান দুই দল কোনো প্রার্থী দেবে না। প্রধান দুই দলের বাইরে যারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এটা নিশ্চিত যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও তারা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। সেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা যেদিন শপথ নেবেন, তার শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার বিলুপ্তি ঘটবে। অন্য মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট নবম জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করবেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ প্রায় এ ধরনের একটি ফর্মুলা দিয়েছিলেন। এ ধরনের একটি নির্বাচিত নির্দলীয় সরকার, যা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে না- উভয় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, যদি তারা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিক হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের সমঝোতার ভিত্তিতেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই।
কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এ ধরনের নির্বাচিত কোনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও সাহসী নয় বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সংবিধানের বাইরে যাবেন না। সংবিধানের আওতায়ও কোনো নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা যে তারা মানবেন না সে কথা ব্যাখ্যা করে বলেছেন শাসক লীগের মুখপাত্র লীগ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে এবং তাদের প্রস্তাব সংসদে অনুমোদন করাতে হবে অথবা আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। রেলমন্ত্রী হয়ে রেলের কালো বিড়াল ধরার লম্বা কথা বলে যিনি এখন নিজেই কালো বিড়াল ধরার জনগণের সন্দেহের 'কলে' ফেঁসে আছেন, রেল থেকে বিতাড়িত সেই দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একই ঢোল বাজিয়ে সরকারের ওপর জনগণের বিরক্তি বাড়াচ্ছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আবার কঠোর বলে মনে হচ্ছে। আর এতেই শঙ্কা বাড়ছে সংঘাতের। মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাবের আবরণে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টির একটি তৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন সংসদে বাজেট বক্তৃতায়। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, 'বিদ্যুতের ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। বিদ্যুতের ব্যাপারে বললে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন; আমার বন্ধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে যান। তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। তিনি হয়তো তার হারানো রাজ্য ফিরে পেতে চান।' প্রধানমন্ত্রী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমালোচনা থেকে ধারণা করা যায়, সংবিধান সংশোধনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস এবং প্রয়োজনে মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তার কোনো আপত্তি নেই তাতে। সংসদে প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময়-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'তার প্রস্তাবে বিএনপির খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই অনুষ্ঠানে তিনি এও বলেছেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির একজন বাদে অন্য সবাই আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ছিলেন। সুরঞ্জিত বাবুও বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে।' এ থেকে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়, তার সংশোধনী প্রস্তাবের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারেও সংশোধনী আনা যেতে পারে। একবার নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনীর প্রশ্ন এলে বিরোধী দলের দাবির বিষয়টিও আসতে পারে। কারণ এ ব্যাপারে একটা প্রবল জনমত আছে। এ ইস্যুতে অদূর ভবিষ্যতে গণআন্দোলনে নাকানি-চুবানি খাওয়ার হাত থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার একটি পথও প্রচ্ছন্নভাবে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তার এ অবস্থান চলমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন অনেকে। বোঝা যাচ্ছে, সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে লীগ সরকার দেশকে যে আবার একটা সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে, জোটের কোনো কোনো শরিক তার দায় কাঁধে নিতে চাইছে না।
সংসদে গিয়ে ফায়সালা বা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে পরবর্তী সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার যে 'ফতোয়া' সরকারপক্ষ দুই সপ্তাহ ধরে দিচ্ছে, বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট তা মানবে না_ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি বর্তমান ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে দল ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাঁচানোর আশায় জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ সমঝোতায় পেঁৗছে গেলেও (জামায়াতের পক্ষে এটা সম্ভব। ১৯৯১ সালে দুজন মহিলা সংসদ সদস্যের বিনিময়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সাহায্য করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনে তারা বিএনপিকে ছেড়ে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হয়) বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ বিএনপির আন্দোলন করার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তাত্তি্বক বিশ্লেষণ দিয়ে তারা সরকারবিরোধী শক্তিকে হতাশ করতে চাইছেন। কিন্তু আমরা জানি, একটি সরকার যখন তার অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, দলবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অজনপ্রিয় হয়ে যায়, জনগণই সেই সরকারের বিরুদ্ধে দ্রোহের পতাকা উড়ায়। জনগণের দ্রোহই বিএনপির পুঁজি হয়ে যেতে পারে। যদি অন্য কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠে। বর্তমান সরকার আর জনপ্রিয় সরকার নেই। সরকার পক্ষের আচরণ-উচ্চারণে মনে হচ্ছে, তারা গায়ের জোরেই শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার ভুল করছে। গভীর রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে না হাঁটলে তাদের অবশ্যই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। আবর্জনা পরিষ্কার করে সামনে থেকে জনগণের সাহসী নেতৃত্ব দিতে বিএনপি যদি ব্যর্থও হয়, জনগণ ব্যর্থ হবে না। প্রচলিত রাজনীতির ও সংগঠনের ব্যাকরণ পাল্টে দিয়ে প্রয়োজনে জনগণই গড়ে তুলবে তাদের আপন রাজনৈতিক শক্তি।
সংযুক্তি : বাহাত্তর সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) ধারা অনুযায়ী সংসদ বলবৎ থাকা অবস্থায়ই পরবর্তী নির্বাচন হবে। বর্তমান এমপিরা স্বপদে বহাল থেকেই নির্বাচন করবেন। এতে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না। আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে সন্ধিহান আওয়ামী লীগ এই সাংবিধানিক সুবিধাও ভোগ করতে চায়। অন্যরা তা মানবেন কেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন