মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

জামায়াতের হামলা : দেশ কোন দিকে যাচ্ছে?


মাহমুদুর রহমান মান্না

 
কিছু দিন ধরে জামায়াত-শিবিরের তৎপরতা বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা সারা দেশে বেশ আলোড়ন তুলেছে। বিষয়টি শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এই প্রথম জামায়াতে ইসলামী সরাসরি পুলিশের ওপর হামলা করে। এর পর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে রাজশাহীতে, যেখানে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই রাইফেল দিয়ে তারা পুলিশ সদস্যকে পিটিয়েছে। রাস্তার মধ্যে একজন পুলিশকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে, যে রকম সাধারণত আন্দোলনকারীরা পুলিশের হাতে মার খেয়ে পড়ে থাকে।

প্রথম যেদিন পত্রিকায় পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার খবর-ছবি প্রকাশ পায় সেদিন একটি চমৎকারিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের দেশে সাধারণত এমন ঘটনা ঘটে না। পুলিশ মার খায় রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে, এ রকম ঘটনা বা দৃশ্য আমরা কমই দেখি। মাঝে-মধ্যে ছিনতাইকারীদের হাতে, ঘাতকদের হাতে পুলিশ নির্যাতিত হয়, গোলাগুলি হয়_ তাতে মারাও যায় কেউ কেউ। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা আক্রান্ত হলেও পুলিশের ওপর পাল্টা হামলা চালায়, তাও সশস্ত্রভাবে বা বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে, এমন ঘটনা আমরা দেখি না। কখনো কখনো রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের খণ্ড যুদ্ধ বাধে, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ হয়। সেই ঢিলের আঘাতে হয়তো পুলিশ আহত হয়। কিন্তু এভাবে পড়ে পড়ে পুলিশ মার খায়_ এমন ঘটনা এর আগে সাধারণত মানুষ দেখেনি। আর দেখেনি বলেই মানুষের মধ্যে একটা বিচিত্র অনুভূতির জন্ম হয়েছিল। বিচিত্র অনুভূতি বলছি এ কারণে যে, পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা গত কিছু দিন থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে। পুলিশ ঘুষ খায়। পুলিশ জনগণের কথা ঠিকমতো শোনার বদলে যাদের অর্থকড়ি আছে তাদের পক্ষে যায়, ঠিকমতো মামলা নেয় না_ এ ধরনের অভিযোগ আছে বা আগে থেকে ছিল। কিন্তু ছাত্র হত্যাকারী বা জনগণের ওপর রীতিমতো নির্যাতনকারী, এ রকম ইমেজ পুলিশের আগে কখনো ছিল না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মনে মনে কষ্ট পাবেন, কিন্তু এটি সত্যি গত কয়েক বছরে পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠেছে। এখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহল। তাহলে পুলিশকে পেটানোর লোক আছে, পুলিশও অসহায়ের মতো মার খায় এবং নীরব দর্শকের মতো অন্য পুলিশ তা তাকিয়ে দেখে।

এ রকম ভাববে মানুষ। কারণ আমরা তো দেখেছি পুলিশের কি ক্ষমতা। ওরা যাকে-তাকে পেটাতে পারে, যাকে-তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এমনকি যারা ক্ষমতায় যায় সেই রাজনৈতিক দলের নেতাদের কলারে কিংবা দুই হাতে চেপে ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে ভ্যানে তোলে। অফিসগুলোকে ঘেরাও করে রাখে। কাউকে বের হতে দেয় না, সেই পুলিশ জামায়াত-শিবিরের হাতে মার খায় অসহায়ের মতো, এটা মানুষের মধ্যে এক ধরনের মজা তৈরি করেছিল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

কিন্তু এই বোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। দ্বিতীয় দিন, পরদিন অথবা তারপরের দিন বা আজ পর্যন্ত জামায়াত-শিবির যেভাবে লাগাতার পুলিশের ওপর হামলা করছে তাতে এটি একটি নতুন রাজনৈতিক প্রপঞ্চ তৈরি করেছে, যা নিয়ে ভাবিত না হয়ে মানুষ পারছে না। একটি ভয়ও তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। রাস্তায় যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এগুলো তো রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধের দৃশ্য। এটাকেই যদি কখনো বড় মাপের দেখতে পাই, তাহলে তার অর্থ কি দাঁড়াবে? এরকম করে সবাই ভাবছে। সবাই শংকিত কিংবা আতঙ্কিত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মহাজোটের কেউ কেউ এ ব্যাপারে খুব ত্বরিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তারা জামায়াতের সেই পুরনো দিনের সন্ত্রাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা বলেছে এবং তারা স্পষ্টতই বলেছে এ ঘটনা কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, পুলিশের ওপর জামায়াতের এই ঘৃণ্য-বর্বর হামলার পর মানুষ যে প্রতিবাদ করছে না, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না, এটাই ভাবার বিষয়।

আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিয়েছে। এ ঘটনার রোধকল্পে তারা তাদের মূল কিংবা অঙ্গ সহযোগী সংগঠনকে রাজপথে নামার জন্য আহ্বানও জানিয়েছে এবং সেভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, তারা বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ করছে। বিভিন্ন জায়গা বলতে আমি অবশ্য কেবল ঢাকা মহানগরের কথা বলছি। আওয়ামী লীগ এত বছরের সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বা অসাম্প্রদায়িক একটি সংগঠন বলে যে পরিচিতি দিন দিন লাভ করেছিল এবং তার জামায়াতবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, রগকাটা রাজনীতি বা স্বাধীনতাবিরোধী এসব চক্রের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা ছিল তাতে যে রকম হওয়ার কথা দেশব্যাপী সে রকম করে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। জনগণকে সংঘবদ্ধ করার মতো কিছু হয়নি এবং মহাজোটের মধ্যে এর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। মহাজোটের কোনো শরিক দল এই মর্মে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য যে রাজপথে নেমেছে এ রকম কিন্তু দেখাই যায়নি। জামায়াত-শিবির হঠাৎ করে এমন তৎপরতা শুরু করল কেন? হতে পারে যেভাবে আওয়ামী লীগ জবাব দিয়েছে_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধ করার জন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো সেই বহুদিন আগেই শুরু হয়েছে। তখন না করে এখন করল কেন? তার মানে কি এ সময় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে? আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা, কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অতিশীঘ্রই তাদের বিচার হয়ে যাবে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর হয়ে যাবে। পত্রিকায় খবর অনুযায়ী বিশেষ করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এখন যুক্তি, পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ পালা শেষ হলেই তো রায় ঘোষণার কথা। যেহেতু এটা নভেম্বর মাস। অনেকে মনে করছেন ডিসেম্বর মাসেই কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হয়ে যাবে এবং যেভাবে মন্ত্রীরা কথা বলছেন তাতে মনে করা হচ্ছে এর শাস্তি হতে পারে কেবল মৃত্যুদণ্ড। আর সেই হিসেবে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ চার-পাঁচজন নেতা_ হয়তো গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ কয়েকজনের ফাঁসি হয়ে যাবে এবং তা ডিসেম্বরের মধ্যেই কার্যকর হবে।

এটা ধরেই নেওয়া যায়, জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি দল কি করবে? কিছু দিন আগ পর্যন্ত এ রকম একটি কথা খুব চাউর ছিল, জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিরাট ধরনের একটি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে জামায়াতের তরুণ প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার মতো ব্যাপারে ছিল না, অংশগ্রহণ করার মতো বয়স হয়নি, তারা মনে করছে একটি বিরাট অন্যায় জামায়াত সেই সময় করেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। অতএব তাদের বিচার হওয়া উচিত। তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়ের দায় তারা বইবে কেন? দল বইবে কেন? বিচারে যদি তাদের ফাঁসি হয়ে যায়, তারপর জামায়াত মুক্তভাবে কাজ করতে পারবে, গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করতে পারবে। তাতে আর বাধা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকবে না।

জামায়াত-শিবিরের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে আজ আর সে রকম মনে হচ্ছে না। তারা নীরবে মেনে নেবে এ রকম নয়। তারা বরঞ্চ এর প্রতিবাদ করছে। তারা যদি পারে তাহলে এই বিচার ভণ্ডুল করার চেষ্টা করবে। যারা অন্যরকম প্রচারে বাতাস দিয়েছিলেন তারা ভুল করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে এটা বলা যায়। বিএনপিও এ ব্যাপারে খুব সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় বিএনপিও বলতে পারছে না, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যারা জামায়াতের ব্যাপারে খনিকটা নমনীয় তারাও এ কথা বলতে পারছে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা অন্যায়। তারা এটা বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ থাকে। এ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অথবা এ পটভূমি তৈরি হওয়ার অল্প আগেই মূল বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফর করেছেন। গত ২১ নভেম্বর বেগম জিয়ার ভারত সফরের ওপর আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছি। এ জন্য এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন মনে করছি না। শুধু এটুকু লিখছি যে, আমার বক্তব্যের প্রতিপাদ্য ছিল ভারতের জাতীয় স্বার্থ যতখানি বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত তা রক্ষা করার জন্য ভারত যদি মনে করে বিএনপিকে তার প্রয়োজন হতে পারে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে তারা তার বিরোধিতা করবে না। তাহলে তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? বিএনপি কি একা একা ক্ষমতায় যাবে, নাকি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? যদি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে যায় তখন ভারত কি করবে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে আমি মনে করি, গত লেখায়ও লিখেছি, বাংলাদেশের রাজনীতির পট অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের ভারতনীতির কথা ভাবব ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে মনোযোগী হতে হবে এবং এর চতুর্দিক দেখেই মন্তব্য করতে হবে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বেগম জিয়া ভারত সফরের সময় ভারত বলেছিল, তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে চায়। তার মানে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। বেগম জিয়া ভারতকে সেই ভিত্তিতে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশে যেসব ধর্মভিত্তিক দল আছে তাদের সঙ্গেও যেন ভারত সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। পাঠক, খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। যদি বেগম জিয়া এটা বলে থাকেন (যেহেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাই লিখছি) তাহলে তার অর্থ কি দাঁড়ায়? অর্থ যা দাঁড়ায় তা স্পষ্ট। বিএনপি-জামায়াতকে ছাড়ছে না। তারা স্পষ্টই বলছে, জামায়াত তাদের মিত্র। এ জন্য তারা চাচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে ভারতেরও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক। তবে জামায়াত যে সশস্ত্র হামলা পুলিশের ওপর চালিয়েছে বিএনপি তা সমর্থন করেনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বরঞ্চ সাংবাদিকদের সামনে বিফ্রিংয়ে বলেছেন, বিএনপি এ ধরনের হিংসাত্দক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তারা এ রকম কাজ কখনো করেনি। তিনি এ কথাও বলেছেন, জামায়াত যা করছে তার দায় বিএনপি নেবে না। যে আন্দোলন সাধারণ ছিল, যে আন্দোলন গণতান্ত্রিক ছিল, শান্তিপূর্ণ ছিল, সেই আন্দোলনের মধ্যে ধীরে ধীরে অশান্তি এবং আক্রমণ ঢুকে যাচ্ছে। বিএনপি সতর্ক থাকার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, আমাদের আন্দোলনের মধ্যে আমরা এ ধরনের কোনো কিছুকে প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু আন্দোলন যদি জমে ওঠে, যদি আন্দোলন ব্যাপক হয়ে ওঠে তাহলে তা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা এ মাপের নেতার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না তখন। আন্দোলন হিংস্র এবং সশস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। আমরা একটা খারাপ সম্ভাবনার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখন বোঝা উচিত, এক বছর পর নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা ধীরে ধীরে জটিল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। একটা জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা।

মানুষ প্রধানত সুশাসন চায়, সুনীতি চায়, সুস্থতা চায়। রাজনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়ন না হোক, চাঁদাবাজি না হোক, মস্তানি না হোক, পরিবারতন্ত্র না হোক_ এগুলো মানুষের চাওয়া। মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ শিবিরের ওপর হামলা করবে আর পুলিশ নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে দেখবে, তা মানুষ সমর্থন করবে না। উদাহরণস্বরূপ দুই নেত্রীর প্রতি সম্মান জানিয়ে লিখছি, যখনই সংগ্রাম জয়ের পথে যায় তখনই তারা পেছনের ইতিহাস ভুলে যান। তখনই তাদের মনে হয় একে ছাড়া চলবে না, ওকে ছাড়া চলবে না। অথচ বিজয়ের সোপানটা তৈরি করে মূলত জনগণ। সেই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, বরিশালের এতবড় জনসভা করে এসে বেগম জিয়া বলতে শুরু করেছেন, তার দুই পুত্র দুর্নীতিমুক্ত, তার কথা শুনে মানুষের ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

জামায়াত রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত দল, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বৈধ দল। জামায়াত বার বার যে অভিযোগ করছে তাদের কোনো জায়গায় সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না, মিছিল করতে দেওয়া হয় না, কথা বলতে দেওয়া হয় না, এটা নিশ্চয় অন্যায়। আমাদের প্রথম সংবিধানে রাজনীতির ভিত্তিতে ইসলামী দল করা নিষিদ্ধ ছিল। পঁচাত্তরের পর সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবলীগকে দায়িত্ব দিলেন যেখানে জামায়াত পাওয়া যাবে সেখানেই প্রতিহত করতে হবে। সর্বশেষ তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, পাড়া-মহল্লা থেকে জামায়াত-শিবিরকে পিটিয়ে বের করে দিতে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে সরকার কিংবা তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এ রকম আহ্বান জানাতে পারেন? তিনি কি দেশে একটি গৃহযুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন না?

উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি এখনো মনে করি, পুরো পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির একটা রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। না হলে পরিস্থিতি যে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে_ তা একমাত্র আল্লাহ বলতে পারেন। লেখক : রাজনীতিক

ই-মেইল : mrmamma51@yahoo.com

দমন-পীড়নের রাজনীতি


আলফাজ আনাম
তারিখ: ২৮ নভেম্বর, ২০১২
শিবির কর্মী : পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়ে তাণ্ডবকারী ; ছাত্রলীগ নেতা : অস্ত্রধারীর পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী


বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কঠোরভাবে দমনের অভিলাষ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নেমে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্ত্রীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী রাজনৈতিক দলের অফিসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিপ্রস্তুতির জন্য সেরা একটি কোচিং সেন্টারের অনেকগুলো শাখা অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ এই কোচিং সেন্টারটি ছাত্রশিবিরের ছেলেরা পরিচালনা করে থাকে। অস্ত্রবাজিতে লিপ্ত লেখাপড়াবিমুখ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই জ্বালাও-পোড়াও কাজটি বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করছে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল জলিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব আহ্বানকে উসকানিমূলক বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে মার্কিন দূতাবাস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল …শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে জড়িত হওয়া একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, সংলাপই যেকোনো মতপার্থক্য দূরীকরণের উত্তম পন্থা। এই বিবৃতির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিলÑ আগে তাদের দমন করি। চোর-ডাকাতদের সাথে আবার কিসের সংলাপ?
বিরোধী রাজনৈতিক দলকে চোর-ডাকাত, বিপথগামী ও সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার এই প্রবণতা দুনিয়ার বহু দেশে ঘটেছে। এ দেশেও পাকিস্তানি শাসক থেকে এরশাদের স্বৈরশাসনামলেও বিরোধী দলকে এভাবে চোর-ডাকাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। গাদ্দাফি আর হোসনি মোবারক সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বলেছিলেন ইঁদুরদের লাফালাফি। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানি সেনাশাসক থেকে এরশাদের সেনাশাসনামলেও কীর্তিমান আমলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সব সামরিক শাসকের সেবা করেছেন। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা পুরোমাত্রায় তার মধ্যে বহাল রয়েছে। আবার রাজনীতিতে তার আবির্ভাব ঘটেছে ’৯৬ সালে আমলা বিদ্রোহের মধ্য দিয়েইÑ যা ছিল আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী। সরকারের শেষ সময়ে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তার বক্তব্য ও শারীরিক ভাষায় যে কঠোরতা দেখাচ্ছেন, তার শেষ পরণতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে মন্ত্রিত্বের উষ্ণ পরিবেশে সম্ভবত তা অনুধাবন করতে পারছেন না। দীর্ঘ রাজনীতির অভিজ্ঞতায় আবদুল জলিল ঠিকই বুঝতে পেরেছেন গদিনসীন মন্ত্রীদের উসকানিমূলক বক্তব্যের শেষ পরিণতি কী ঘটতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধানীর মিরপুরে এক জনসভায় প্রতিটি ওয়ার্ড ও শহর থেকে জামায়াতের নেতাকর্মীদের খুঁজে পিটিয়ে বের করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ধরনের নির্দেশ শুধু আইন হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান নয়, স্পষ্টত রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির নির্দেশনা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শারীরিক ভাষায় স্পষ্টত প্রতিহিংসার ছাপ। তার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ঘড়ি চুড়ি, মুরগি চুড়ি আর ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় মিলন দীর্ঘ দিন জেলেও ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কিভাবে দমন করতে পারেন তার নমুনা এ দেশের মানুষ অবশ্য আগেই দেখেছে।
দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে বা সে পথে না গিয়ে পুলিশকে যেভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে এই বাহিনীর শৃঙ্খলা এখন ভেঙে পড়ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পুলিশ আবির্ভূত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা পুলিশের একটি অনুষ্ঠানের খবর জেনে নিই। নবনিযুক্ত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি (ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেছেন, রাস্তায় পুলিশ মার খাচ্ছে। পুলিশ আর বসে বসে মার খাবে না। এখন থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আমাদের একটা পা ভাঙলে আমরা ১০টা পা ভাঙব। জামায়াতের হামলার বিরুদ্ধে পুলিশ এখন থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তিনি বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টে যদি কেউ জামায়াত-শিবিরের শুভাকাক্সী থাকেন, তাহলে এখনই অন্যত্র চলে যান। আমার রেঞ্জে কোনো জামায়াত-শিবিরের সমর্থক থাকতে পারবে না। তিনি বলেনÑ দেশকে ভালোবাসুন, সর্বশক্তি নিয়োগ করে জামায়াত-শিবিরের মূলোৎপাটন করতে হবে। ওদের শিকড় তুলে ফেলতে হবে।
পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ বলেন, আগামীতে যদি মুক্তিযুদ্ধের সপরে শক্তি মতায় না আসে তাহলে দেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জ সফরে এসে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডিআইজি এসব কথা বলেন। সভায় জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম (পিপিএম বার) বলেন, আমরা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ঈমানের সাথে পালন করব। ডিআইজি মহোদয় যেসব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তা অরে অরে পালন করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য জেলা পুলিশের সব কর্মকর্তা ও সদস্যকে নির্দেশ দেন জেলা পুলিশ সুপার। (আমার দেশ ২৫ নভেম্বর ২০১২)।
আমরা এ খবর থেকে বুঝলাম পুলিশকে এখন প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলা হচ্ছে, একটা পা ভাঙলে ১০টি পা ভাঙার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ এখন জামায়াত-শিবির মূলোৎপাটনের কাজে নেমে পড়েছে। পুলিশে জামায়াত-শিবিরের শুভাকাক্সী থাকলে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। পুলিশে তো কোনো দলের শুভাকাক্সী থাকার কথা নয়। পুলিশ তো কোনো দলের চাকরি করে না। পুলিশ চাকরি করে রাষ্ট্রের। পুলিশে জামায়াতের শুভাকাক্সী থাকলে তাদের চলে যেতে বলা হচ্ছে; তাহলে পুলিশে কি শুধুই আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সী থাকবে? কিংবা বিএনপির শুভাকাক্সী কি থাকতে পারবে? এই পুলিশ কর্মকর্তার পুরো বক্তব্যটি যদি আমরা দেখি তাহলে হাইব্রিড কোনো আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্য ও এই পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য আমরা দেখছি না।
বাংলাদেশে জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতি হঠাৎ করে এই নভেম্বর মাসে শুরু হয়নি। আগেও রাস্তায় জামায়াত-শিবির মিছিল সমাবেশ করেছে। ’৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাজপথে এক পাশে জামায়াতের অপর পাশে আওয়ামী লীগের মিছিল সমাবেশ হয়েছে। আগে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ হয়নি, এখন কেন হচ্ছে? এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? জামায়াত-শিবিরের নেতারা বারবার বলছেন, তাদের শান্তিপূর্ণ সভাসমাবেশ করার অধিকার দেয়া হলে পুলিশের ওপর একটি ঢিলও ছোড়া হবে না। জামায়াত-শিবিরের সভাসমাবেশ করার এই অধিকার হরণ করার ফলে পুলিশের সাথে সঙ্ঘাত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরের সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা রয়েছে। সমাবেশ করা বা সংগঠন করার অধিকারহরণ করার চেষ্টা সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন। সেই অধিকার যখন হরণ করা হয় তখন পুলিশের সাথে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ হয়। আগেও এ ধরনের সঙ্ঘাত বাংলাদেশে হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
রাজধানীর ফার্মগেটে গত ১৩ নভেম্বর শিবিরের সাথে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের যেখানে সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এক পুলিশের আঙুল কামড়ে দিয়েছিলেন। আবদুল গনি রোডে এক পুলিশকে উলঙ্গ করে ফেলা হয়েছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও পুলিশের অস্ত্র নিয়ে টানাটানির ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলাও হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক আন্দোলনে এ ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এ কথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না নিরাপত্তাবাহিনী দিয়ে বল প্রয়োগ করে যখন স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হবে তখন তার প্রতিক্রিয়া কম-বেশি হবে। সারা দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অফিসে আগুন জ্বালালে যদি তাণ্ডব না হয়, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বা পুলিশের বাধার কারণে ইটপাটকেল নিক্ষেপ তাণ্ডব হয় কী করে? সরকারি প্রপাগান্ডায় নিয়োজিত গণমাধ্যমে এসব খবর যখন প্রচার করা হয়, সাধারণ মানুষের সামনে গণমাধ্যমের একচুনীতি উদোম হয়ে যায়।
পুঁজিতান্ত্রিক রাজনীতির দাশে পরিণত হওয়া সাবেক বামরা এখন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন বলছে, জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধান ও আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি সাংঘর্ষিক হয় তা অবশ্যই জামায়াতকে সংশোধন করতে হবে। কারণ, বিদ্যমান সংবিধান মেনেই জামায়াতকে রাজনীতি করতে হবে। যেমন করতে হবে অপরাপর রাজনৈতিক দলকে। কিন্তু এই অজুহাতে দমন-পীড়ন বা নিষিদ্ধের দাবি তোলা শুধু অগণতান্ত্রিকই  নয়, অসাংবিধানিকও।
ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক দিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকারীদের চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসী বলছেন, অপর দিকে ছাত্রলীগের একজন অস্ত্রধারী চিহ্নিত সন্ত্রাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। সন্ত্রাসীরা পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সমর্থন। সম্প্রতি আখেরুজ্জামান তাকিম নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ ক্যাডারের হাত ও পায়ের রগ কেটে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। ২০০৭-০৮ শিাবর্ষে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন আখেরুজ্জামান তাকিম। কাসে উপস্থিতি না থাকার কারণে  প্রথম বর্ষের পরীা দেয়ার সুযোগ পাননি। পরের বছর ২০০৯ সালেও তিনি প্রথম বর্ষ পরীার ফরম পূরণ করেননি। ২০১০ সালেও করেননি। তখন থেকেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। গত জুন মাসে গঠিত ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সহসভাপতির পদ পান। গত ১৫ জুলাই পদ্মা সেতুর জন্য টাকা তোলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তুহিন গ্রুপের সাথে আখেরুজ্জামান গ্রুপের সংঘর্ষ বাধে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান। ওই ঘটনায় আখেরুজ্জামানসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই সাথে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। তার পরও তিনি ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। সর্বশেষ গত ২ অক্টোবর ছাত্রশিবিরের সাথে সংঘর্ষের সময় পুলিশের সামনেই আখেরুজ্জামানকে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশিত হয়। সেই আখেরুজ্জামান এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিণে। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। (প্রথম আলো ২৪ নভেম্বর ২০১২)। এই ছাত্রত্বহীন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
আখেরুজ্জামানের ওপর হামলার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও শিবির তার ওপর হামলা করেছে তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। দীর্ঘ দিন ধরে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-ছাড়া। ছাত্রশিবিরের ওপর হামলার দায় চাপানোর পর আখেরুজ্জামানের সব অপরাধ এখন মাফ হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রলীগ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ছাত্রলীগের রাজনীতির আদর্শ এখন তাকিম। এখন ছাত্রলীগের স্লোগান হতে পারেÑ আমরা সবাই তাকিম হবো, জাময়াত-শিবির নির্মূল করব। কারণ জামায়াত-শিবির নির্মূলের জন্য যে তাকিমের মতো নেতার প্রয়োজন তা মন্ত্রী নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। এভাবে সন্ত্রাসীদের পক্ষে মন্ত্রীরা যখন দাঁড়ান, তখন তাণ্ডবের রাজনীতিকে আরো উসকে দেয়া হয়।
সহিংস রাজনীতি কোনো অবস্থাতেই কাম্য না হলেও জামায়াত-শিবিরের সাথে সংঘর্ষ বা সঙ্ঘাতকে রাজনীতি দমনে পুলিশের বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হবে। অপর দিকে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে বা আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে যেভাবে জ্বালাও-পোড়াও এবং মারধরের কর্মসূচি নিয়েছে তা ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত অর্থেই রাজনৈতিক তাণ্ডব। এই রাজনৈতিক তাণ্ডব আর সন্ত্রাসকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমর্থন দিয়ে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
alfazanambd@yahoo.com

সেই সময় এই সময়


মঈনুল আলম
তারিখ: ২৮ নভেম্বর, ২০১২


১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে যখন আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন মধ্যস্থতা করার জন্য শেখ হাসিনা বিদেশী কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, অন্যান্য কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের বক্তব্য প্রদানকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা তীব্র ভাষায় সমালোচনা করছেন!
প্রধানত, শেখ হাসিনার আবেদনের পরিপ্রেেিত মতাসীন সরকার এবং আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান বের করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। বস্তুত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশীদের হস্তেেপর সূচনা হয়, যখন ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা স্বয়ং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ পাঠালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করে সন্তোষজনক সমাধান করে দেয়ার জন্য।
নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর থেকে শেখ হাসিনা যে জোরদার আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে দাবি আদায় করেছিলেন, বর্তমানে সেই একই দাবি আদায়ে আন্দোলনরত, বিএনপির জন্য তা একটি ‘রেডিমেড’ কর্মসূচি হতে পারে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ৩০ নভেম্বর এক জনসভায় ভাষণে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ৭ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে একটানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সহযোগিতা নিয়ে আন্দোলন করার কারণে পাঁচদলীয় ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ আওয়ামী লীগের আন্দোলনে শামিল হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে পৃথক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ইতঃপূর্বে ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের রূপরেখা দেয়ার জন্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ২২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদ বর্জনের ফলে সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বারা শূন্য হয়ে যাওয়া ১৪৫টি আসনে ১৫ ডিসেম্বর উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণা করে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো উপনির্বাচন প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বেতার-টেলিভিশনে জাতির প্রতি ভাষণ দেন। সে দিনই তার অনুরোধে প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস জাতীয় সংসদ অবলুপ্ত করে দিয়েছিলেন।
একই দিন বিরোধী দলগুলো পৃথকভাবে সপ্তাহব্যাপী র‌্যালি, মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে ২৮ নভেম্বর সব থানাপর্যায়ে এবং ২৯ নভেম্বর সব জেলাপর্যায়ে এ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিরোধী দল ৭ ডিসেম্বর রেল, সড়ক ও নদীপথ অবরোধ করার পর ৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দফতর অভিমুখে মহামিছিল পরিচালনার ঘোষণা দেয়।
২৬ নভেম্বর বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে টেলিফোন সংলাপ হয়। সংলাপে হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুরোধ জানান। সে সংলাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম অভিমুখে ‘ট্রেন মিছিলে’ রওনা দেন।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বাণিজ্য ও শেয়ারবাজার সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সে সময় ‘এফবিসিসিআই’য়ের সভাপতি ছিলেন। প্রধানত তিনি কলকাঠি নাড়ানোয় ৮ নভেম্বর ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিবাদে ১৫ মিনিট কর্মবিরতি পালন করে। ১৯ নভেম্বর সালমান ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন ঘোষণা করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। অনেকেই এ তৎপরতাকে তার নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস বলেই ধরে নেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশীদের হস্তেেপর সূচনা হয় যখন ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা স্বয়ং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ পাঠান মধ্যস্থতা করে একটি সন্তোষজনক সমাধান করে দেয়ার জন্য। সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়েন স্টেফান ঢাকায় পৌঁছলে শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলগুলোর নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। নিনিয়েনের মধ্যস্থতা করার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
অতঃপর ৪ সেপ্টেম্বর (১৯৯৫) মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রসচিব রবিন রাফায়েল তার নির্ধারিত সফরসূচিতে ঢাকা এসে মতাসীন এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রয়াস পান। কিছুকাল আগে শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন রাফায়েলের সাথে তার বৈঠক হয়। ঢাকায় তার সম্মানে মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে আমন্ত্রিতদের মধ্যে বিরোধী দলগুলোর ১১ নেতা-প্রতিনিধি আন-অফিসিয়ালি বৈঠক করে রবিন রাফায়েলের কাছে তাদের দাবি পয়েন্টগুলো তুলে ধরে আলোচনা করেন। কিন্তু এতেও কোনো নিষ্পত্তি হলো না।
মতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী প্রয়াস চালায়। এই পরিপ্রেেিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মেরিল সর্বাধিক তৎপর থাকেন। মেরিল একাধিকবার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সাথে এবং উভয় দলের  নেতার সাথে বৈঠক করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে যুক্তরাজ্য, ভারত ও জাপানের দূতাবাস থেকেও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু বিদেশী কূটনীতিকদের কোনো প্রয়াস কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
ডিসেম্বরে বিদেশী কূটনীতিকদের সব প্রচেষ্টা চূড়ান্ত নিষ্ফলতার দিকে যেতে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরিল সরকার পে বাণিজ্য ও তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলাম এবং বিরোধী পে আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর সাথে একাধিকবার বৈঠক করেন। কিন্তু তাদের সমঝোতায় আনতে ব্যর্থ হন।
সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হওয়া নিশ্চিত ছিল। ১৯৯৬ সালের প্রারম্ভ থেকে শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে তার আন্দোলনকে সরকারের পতনের ল্েয ধাবিত করে চূড়ান্তপর্যায়ের আন্দোলন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা আদায় করে ছাড়েন।
এর ১৪ বছর পরে পুনরায় দেশের শাসনমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনা সর্বপ্রথমেই সংসদকে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করালেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারার পরিপ্রেেিত এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার আন্দোলন তার রাজনৈতিক জীবনের উজ্জ্বলতম কীর্তি হতে পারত।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : দেয়াললিখন পড়ুন

মাহমুদুর রহমান



দিন দশেক আগে ঘাটাইলে (টাঙ্গাইল-৩) উপনির্বাচন হয়ে গেল। বিরোধী দলবিহীন সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এক প্রার্থীর মধ্যে। বহিষ্কৃত প্রার্থী রানা দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে নৌকার প্রার্থী লেবুকে নির্বাচনে পরাজিত করেছেন। সেই রানা অবশ্য নির্বাচনের দু’দিন পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে ধন্য হয়েছেন। শেখ হাসিনাও নিশ্চয়ই সাক্ষাত্কারে আর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে খামোকা বিব্রত হতে চাননি।
তবে, গত দু’বছরে যতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার অধিকাংশেই জয় পেয়েছে বিরোধীদলীয় অথবা বিদ্রোহী প্রার্থী। ইলেকশন কমিশনে দলীয় লোক বসানো হয়েছে, পুলিশসহ প্রশাসনের ভূমিকা আওয়ামী ক্যাডারের মতো, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে, শেয়ার বাজার-হলমার্ক-ডেসটিনির লুট করা টাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পকেট স্ফীত হয়েছে, একতরফা সংসদে মহাজোটের গলাবাজিতে টেকা যাচ্ছে না। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ২০০৮ সালের প্রতারিত জনগণ সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের রাগ ও ঘৃণা সুদসমেত উগরে দিচ্ছে। নৌকার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াচ্ছে, সেটা আর কোনো বিবেচ্য বিষয় থাকছে না। দুর্নীতি আর জুলুমের প্রতীককে ডুবিয়ে দেয়াই সাধারণ ভোটারদের কাছে এখন বড় কথা। চার বছর আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে দেশ-বিদেশের প্রভাবশালীরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। মইন-মাসুদের নিরাপদ প্রস্থান নির্ভর করছিল শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ওপর। সুতরাং, বিএনপিকে হারাতে
তত্কালীন সামরিক জান্তা সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে ব্যবহার করেছে। হুদা’র নির্বাচন কমিশন গঠিতই হয়েছিল বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার মন্দ অভিপ্রায়ে। তিন নির্বাচন কমিশনার চোখ বুজে মইন-মাসুদের তাবত্ নির্দেশ পালন করেছেন। করিত্কর্মা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ‘সুচারুরূপে’ পালন করে সুশীল(?) সংগঠন টিআইবিতে ঢুকেছেন। তিনি এখন প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সম্মানিত সদস্য। এই পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনের কারণ দেশের জনগণ বুঝতে পারে।
অপর নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) সাখাওয়াত কিছুদিন নিভৃতচারী থাকার পর দৃশ্যমান হয়েছেন। প্রথম আলো ক্যাম্পের সুশীল(?) এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাকে আজকাল বিভিন্ন টক শোতে দেখা যাচ্ছে, জাতিকে নানা বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পৃক্ত হওয়ার সময় তার ভূমিকা কী ছিল, সে প্রশ্নের জবাব তাকেও একদিন দিতে হবে। এখন বাতাস বুঝে সাধু সাজার প্রচেষ্টা দেখে জনগণ অবশ্য আমোদ পাচ্ছে। এই শ্রেণীর সুবিধাবাদী সুশীলদের(?) চরিত্র দেশবাসীর চেনা হয়ে গেছে। জরুরি সরকারের বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের তৃতীয় কর্তা ছহুল হোসাইনকে তুলনামূলকভাবে মিডিয়াতে কম দেখা যাচ্ছে। মহাজোটের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদ প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই তিনি মোটামুটি পারিবারিক জীবনের গণ্ডিতেই আটকে আছেন। কালেভদ্রে দুই-একটি পত্রিকায় তার মন্তব্য চোখে পড়লেও সেগুলো সম্ভবত অতিউত্সাহী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব মাত্র।
২০০৫ সাল থেকেই ‘বিএনপি ঠেকাও’ প্রজেক্ট নিয়ে বিদেশিরা মাঠে নেমেছিলেন। ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের ‘টিউজ ডে গ্রুপ’ নিয়ে সে সময় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই কথিত ‘মঙ্গলবার গোষ্ঠীর’ সুশাসন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার চেষ্টা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনীহায় তখন ভণ্ডুলও হয়েছিল। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদ দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। জেনারেল সাদিক হাসান রুমীর নেতৃত্বাধীন ডিজিএফআই’র সঙ্গে তখন থেকে দেশি ও বিদেশি চারদলীয় জোট সরকারবিরোধীদের বিশেষ সম্পর্ক থাকার বিষয়টি দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তার সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
সাক্ষ্য প্রদানকালে মেজর জেনারেল (অব.) রুমী অন্তত দুটি তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। প্রথমত তিনি স্বীকার করেছেন যে মইন-মাসুদের ‘মাইনাস-টু’ প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। এ মাসের ১৮ তারিখে বিশেষ আদালতে জেনারেল রুমী বলেছেন, জেনারেল মইনের নির্দেশে ২০০৭ সালের ১৭ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গিয়ে তাকে দেশত্যাগের জন্য তিনি চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সময় তিনি ডিজিএফআই’র আর এক বিতর্কিত কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফ জোয়ারদারসহ যুক্তরাজ্যে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এক বানোয়াট চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করে ডিজিএফআই সদর দফতরে নিয়ে নির্যাতন করার বিষয়ে লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ, মেজর জেনারেল (অব.) আমিন, ব্রি. জে. (অব.) বারীর সঙ্গে এই লে. কর্নেল (অব.) সাইফ জোয়ারদারের বিরুদ্ধেও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং, ক্যুদেতা সংঘটিত হওয়ার কালে জেনারেল রুমী এবং লে. কর্নেল সাইফের একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারটি কেবল কাকতালীয় হিসেবে মেনে নেয়া কষ্টকর। জেনারেল রুমী সম্পর্কে এক পুরনো ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া তখন ক্যান্টনমেন্টের বাসগৃহে বসবাস করছেন। এক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মইনুল রোডের বাড়ির বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম। যতদূর স্মরণে পড়ে শফিক রেহমান, মারুফ কামাল খান, শিমুল বিশ্বাস এবং আরও দুই-একজনও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় ভেতর থেকে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে যে লোকটি বেরিয়ে এলেন, তাকে দেখে রাগ সংবরণ করতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে বললাম, পাঁচ বছর ডিজিএফআই’র প্রধানের দায়িত্ব পালনের নামে নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে এখানে আবার কোন সর্বনাশ সাধনের উদ্দেশ্যে এসেছেন? জেনারেল রুমী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বিব্রত মুখে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিলেন।
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সেই রুমীকে আজ রাজসাক্ষীর ভূমিকায় দেখে আমি অন্তত আশ্চর্য হই না। আসলে, এক-এগারোর রহস্যের পুরোটা কোনোদিনই হয়তো জনগণের জানা হবে না। যাই হোক, ২০০৭ এর জানুয়ারি মাসের প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিবিদদের যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানুয়ারির ৬ এবং ৭ তারিখে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে যথাক্রমে পিএসও জেনারেল জাহাঙ্গীর এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেন। এরপর কানাডীয় হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসনের বাসভবনে কূটনীতিকদের বৈঠক এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের নামে ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা ডেসালিয়েনের বিতর্কিত পত্র প্রকাশের পটভূমিতে ১১ তারিখের ক্যুদেতা’র ঘটনা দেশবাসী জানেন। পরবর্তী বছরখানেকের মধ্যে ‘মাইনাস টু’ নানারকম কৌশল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘মাইনাস ওয়ান’-এ পরিণত হয়।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দীর্ঘ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে ইন্ডিয়া লবির সহায়তাক্রমে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা সাপেক্ষে নির্বাচনের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই তাকে সম্ভবত নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, তিনিই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তার সেক্যুলার রাজনীতির প্রচারণা ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত ৯/১১ পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বে যথেষ্ট কাজে এসেছিল। নির্বাচনের একতরফা ফলাফল ঘোষণার পর তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেম্স্ মরিয়ার্টি এবং ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকবৃন্দ তাদের সন্তুষ্টি গোপন করেননি। কত তাড়াতাড়ি বিএনপি পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের ভাগ্য বরণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে চলেছে, কূটনীতিকমহলে তার চর্চা হতে থাকে। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণ ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চরিত্র বুঝতে কূটনীতিকদের ভুল হয়েছিল। মহাজোট সরকারের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন করেও তারা ঠকেছেন। তথাকথিত জঙ্গিবাদ নিয়েও তাদের বিশ্লেষণে বড় রকম গলদ ছিল।
সর্বোপরি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী মনমানসিকতা তারা চিনতে পারেননি। সম্ভবত এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বিশদভাবে লেখাপড়া না করাতেই এই বিপত্তি হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জেনারেল খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল কারণ দেশপ্রেমিক সৈনিক-জনতা তাকে ভারতপন্থী সাব্যস্ত করেছিল। জেনারেল মইনের বিএনপি দখলের দুরাশা পূর্ণ না হওয়ার পেছনেও ভারত ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কমপক্ষে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে তিনি অবশেষে দেশান্তরী হয়েছেন। ভারতের সেনাপ্রধানের ছয় ঘোড়া উপহার তাকে জনরোষ থেকে ব+াঁচাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান জনবিচ্ছিন্নতার পেছনেও ভারতপ্রীতি অন্যতম কারণ। দিল্লির বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষের হাজার বছরের সংগ্রামের গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। বিএনপির ভারতপন্থীরাও সেই ইতিহাস ভুলে গেলে অন্যান্য দালালের মতোই মাশুল দেয়া থেকে মুক্তি পাবেন না।
এবার জঙ্গিবাদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা শেখ হাসিনার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মেয়াদকালেই আরম্ভ হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে যে গুটিকয় বাংলাদেশী নাগরিক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তারাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে ভ্রান্ত উগ্রবাদের বীজ বহন করে এনেছিলেন। জেএমবি, হুজি, ইত্যাকার সংগঠন আওয়ামী সরকারের মেয়াদকালেই জন্ম নিয়েছিল। একমাত্র বাংলাভাইয়ের উত্থানের জন্য বিএনপি সরকারকে দোষারোপ করা যেতে পারে। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় ওইসব ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান আরম্ভ হলে মুফতি হান্নান, শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাই এবং তাদের সহযোগীরা গ্রেফতার হয়। জঙ্গিগোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার এড়াতে সপরিবারে আত্মাহুতিও দেন।
গ্রেফতারকৃতদের বিচার বিএনপি আমলেই সম্পন্ন হয় এবং মইন-ফখরুদ্দীন সরকার দ্রুততার সঙ্গে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড কার্যকর করে। অর্থাত্ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল, বেগম খালেদা জিয়া তার মেয়াদের মধ্যেই তাদেরকে দমন করতে সক্ষম হন।। এই সাফল্য সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিদের সহায়তা প্রদানের আওয়ামী প্রচারণাকে বিএনপি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি।
ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং ব্রাসেলসের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সমর্থকবৃন্দ ওইসব রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং আইন প্রণেতাদের কাছে বিএনপিকে একটি পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলরূপে চিত্রিত করে। এসব কর্মকাণ্ডের বিপরীতে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতগণ (এদের মধ্যে অনেকেই এখন বেগম খালেদা জিয়ার প্রভাবশালী উপদেষ্টা) এবং বিএনপির নেতা-কর্মীরা যথাক্রমে সরকার ও দলের পক্ষে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিতে আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করলে আওয়ামী লীগের প্রতি বিদেশি সমর্থকদের সন্তোষের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাদের কাছ থেকে বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ব্যাপক দুর্নীতি এবং ভিন্নমতের ওপর নির্যাতন চালানোর অলিখিত, একতরফা লাইসেন্স গ্রহণ করেন।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে। কী কারণে জানি না, ওয়াশিংটন এবং দিল্লির যৌথ সমর্থনে বলীয়ান শেখ হাসিনার মনে এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয় যে তার ২০২১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার স্বপ্ন পূরণে একমাত্র বাধা ড. ইউনূস। অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিতের মতো তিনিও হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে বেগম খালেদা জিয়া আর কখনও প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরূপে আবির্ভূত হতে পারবেন না। আত্মঘাতী ইউনূস বধ প্রকল্পই শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজকের এই বন্ধুহীন অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
এদিকে দেশের অভ্যন্তরে চার বছর মোটামুটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করলেও বিগত এক মাসে জামায়াত-শিবিরের প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি সরকারি নীতিনির্ধারকদের দৃশ্যত বিচলিত করে তুলেছে। এতদিন ধরে দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ বেপরোয়া পুলিশ বাহিনী হঠাত্ করেই ময়দানে নিজ দলের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী লড়াকু তরুণদের মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে দেখে হতচকিত হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে অধিকাংশেরই ধারণা ছিল, চার বছর ধরে একতরফা মার খেয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের মনোবল নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু, রাজনীতির মাঠের পরিস্থিতির এই দ্রুত, অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন সমাজের সব অংশকে বিস্মিত করেছে। ঘাবড়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে তাই জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার অগণতান্ত্রিক দাবি উঠেছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীও তার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের শরিয়া আইনে বিচারের হুমকি দিয়ে দেশবাসীকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর হুমকি এবং মহাজোটের সংসদ সদস্যদের জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি, উভয়ই বাস্তবতাবিবর্জিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি দল। এ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তারা সংবিধান থেকে আল্লাহ্র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনরায় আমদানি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং মহাজোটের সঙ্গী-সাথীরা যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন। শরিয়া আইন চালু করার হুমকি প্রধানমন্ত্রীর মনের কথা যে নয়, সেটা আওয়ামী নেতারাই সর্বাগ্রে কবুল করেছেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন জামায়াত এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দকে সম্ভব হলে বিনাবিচারে হত্যা করার অবচেতন মনের অসুস্থ আকাঙ্ক্ষাই প্রধানমন্ত্রীর শরিয়া আইন ও কিসাস সংক্রান্ত বেফাঁস মন্তব্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। কাজেই সে প্রসঙ্গ থাক। বরঞ্চ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবির প্রসঙ্গে আসি।
ভোটের হিসাবে দলটির সারাদেশে ৭-৮ শতাংশ সমর্থন আছে। অর্থাত্ জনসংখ্যার বিচারে জামায়াতে ইসলামী দলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এক কোটির ঊর্ধ্বে। এমন একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার অর্থ হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে অবধারিত জঙ্গিবাদের দিকে উত্সাহিত করা। বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কায় সর্বদা অস্থির পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মহাজোট সরকারের এ ধরনের হঠকারী উদ্যোগ প্রতিহত করতে এগিয়ে আসবে বলেই আমার ধারণা। এমনকি আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতও এজাতীয় মনোভাবকে উত্সাহিত করবে বলে আমার মনে হয় না। খোদ ভারতেই বহু ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে। ক’দিন আগে মহারাষ্ট্রের উগ্র, সাম্প্রদায়িক নেতা বাল থ্যাকারে মৃত্যুবরণ করলে ভারতজুড়ে শোকের মাতম বয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইস্যুতে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি কোনো বিবেচনাতেই ভারতের স্বার্থের অনুকূলে যেতে পারে না। এই বাস্তবতার আলোকেই বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতে ইসলাম এবং সরকারের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা নিরসনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। যেহেতু হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করার পেছনে মার্কিনিদের সমর্থন ছিল তাই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেও সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে সরকারের এমন চিন্তা-ভাবনা ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনোক্রমেই বিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে না।
স্মরণে রাখা দরকার, আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামী দলই লাভবান হয়েছে। মিসরে ছয় দশকেরও অধিক সময় ধরে অব্যাহত সংগ্রামের পরিণতিতেই ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা ইসলামিক ব্রাদারহুড রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে। জামাল আবদেল নাসের থেকে হোসনি মোবারক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে এই ইসলামপন্থী দলটিকে মিসরে যে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বিশ্বে তার তুলনা মেলা কঠিন। হাসান-আল-বান্না ও সৈয়দ কুতুবের মতো বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা এবং ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। জয়নাব গাজ্জালীর মতো অসীম সাহসী নারী নেত্রীকে কারাগারে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সে তুলনায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী, ভ্রান্ত রাজনীতি অনুসরণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী তেমন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়নি। সেই মিসরে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র হোসনি মোবারকের ক্ষমতা থেকে অপসারণ মেনে নিতে পশ্চিমা দেশগুলো বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা উপলব্ধি করেছে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো পুতুল সরকারকে অনন্তকাল রক্ষা করা যায় না।
বাংলাদেশে বিগত চার বছরে সুশাসন শিকেয় তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে ভিন্নমত শায়েস্তার যে কৌশল ক্ষমতাসীনরা নিয়েছিল, তা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেই আঘাত করছে। সর্বব্যাপী অপশাসনের ফলে সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতাসীন মহলের এই চরম অজনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়েই জামায়াত-শিবির দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস অর্জন করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সেই পাকিস্তান জামানা থেকেই সংগ্রাম করে চলেছে। কোনো অত্যাচারী স্বৈরশাসকই এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় স্থায়ী হতে পারেনি। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল শাসন মাত্র ছয় মাস টিকেছিল। জেনারেল এরশাদ আওয়ামী লীগের সহায়তাক্রমে নয় বছরের কাছাকাছি সময় রাষ্ট্রপতির পদ ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। বৃদ্ধ বয়সে আবারও জেলে যাওয়ার ভয়ে পেন্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দোল খেয়ে সকাল-বিকাল ভিন্ন কথা বলছেন। বর্তমান সরকারের বৈধ মেয়াদ পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হবে। চতুর্থ সংশোধনীর মতো অগণতান্ত্রিক কোনো কৌশল প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাইলে তার পরিণতি সবার জন্যই দুঃখবহ হতে বাধ্য। কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ক শক্তি ব্যবহার করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বপ্নও মরীচিকা হয়েই থাকবে। অতএব, জনসমর্থন পুরোপুরি হারিয়ে কেবল কোনো বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তাক্রমে ক্ষমতায় টিকে থাকার আকাশকুসুম কল্পনা পরিত্যাগ করাই ক্ষমতাসীনদের জন্য শ্রেয়। সরকারের যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণ ক্রমেই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। তারা সামান্যতম সুযোগ পেলেই যে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করছে, ঘাটাইল উপনির্বাচন তার সর্বশেষ উদাহরণ।
অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের জনসভায় সাধারণ জনগণের ক্রমেই বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ এ দেশেও সঠিক নির্দেশনা পেলে গণবিপ্লবের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত সপ্তাহে দক্ষিণের বিভাগীয় সদর বরিশালের বিশাল জনসভা, শাসক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যে উত্তাল সমুদ্রের রূপ পরিগ্রহ করেছিল সে সংবাদটি আশা করি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছে। দেয়ালের লিখন ঠিকমত পড়তে পারলে নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করা উচিত যে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবার এবং দলের মঙ্গল নিহিত রয়েছে। জনমত উপেক্ষা করে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করার শিশুসুলভ জিদ ধরে বসে থাকলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

সত্ পরামর্শে কেন ওদের গায়ে জ্বালা ধরে

সি রা জু র র হ মা ন
     
সেনাবাহিনী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন উভয় নেত্রী। একজন প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যজন বিরোধী দলের নেতা। দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তাকে তিন বার প্রধানমন্ত্রী করেছিল। সবারই ধারণা মাস্টারপ্ল্যান ও নীল নকশা না হলে আগামী নির্বাচনেও তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তারা দু’জনেই সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন। দেখা হয়েছে, কিন্তু কথা হয়নি তাদের। বাংলাদেশের মিডিয়ায় এটা আপাতত একটা বড় খবর।
বাংলাদেশের সব মানুষেরই এটা জানা আছে। এক নেত্রী মনে করেন, তার বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন, তাই তিনি সে দেশের রাজকন্যা ও রাজরানী। অন্যজনকে তিনি সাধারণ মানুষ, একজন সামন্তের বৌ-মাত্র মনে করেন। ঘুঁটে কুড়োনির সঙ্গে সামন্তের বৌয়ের তফাত এমন আর কী? তার সঙ্গে কথা বললে রাজরানীর মান বাঁচে না।
বিগত ৩০ বছরে অনেকে তাদের সামনা-সামনি বৈঠকে বসতে বলেছেন। আশির দশকে আরেকজন সামন্ত ডাকাতি করে দেশটাকে লুফে নিয়েছিল। পূর্বোক্ত সামন্তের বৌ এই ডাকাত সামন্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের মানুষ কাতারবন্দী হয়েছিল তার পেছনে। সবাই বলেছিল, রাজার মেয়েও যদি আন্দোলনে যোগ দেন ডাকাতের দেশছাড়া হতে তাহলে আর বেশি দেরি হবে না। কিন্তু সেই যে বলছিলাম রাজকন্যার দেমাগের কথা! এক সামন্তের বৌয়ের সঙ্গে সামনা-সামনি বৈঠকের পরিবর্তে অন্য সামন্তের সঙ্গে গলাগলির পথই তিনি বেছে নিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল লড়াকু সামন্তের বৌয়েরই। দেশের মানুষ তার হুশিয়ারি শুনেছিল। নিজেদের অধিকার আর দেশের স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ডাকাত তখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ বলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আর রাজার মেয়ে তখন করছিলেন কী? নাক সিঁটকিয়ে তিনি দেশের মানুষের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ডাকাতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।
দেশের মানুষ যে সামন্তের বৌয়ের দয়া-দাক্ষিণ্যের সমাদর করেছিল, সেটা পরিষ্কার। তা না হলে তারা ভোট দিয়ে তাকে তিন বার প্রধানমন্ত্রী করত না। তবে বাংলাদেশের মানুষের দয়ার শরীর। রাজকন্যাকেও তারা তখন দেশত্যাগী করেনি। তারা ভেবেছিল, আহা, বাপ-মরা মেয়েটা! সত্যি যে সে দেমাগি। কিন্তু বয়েসকালে দেমাগটা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, নিজের দেশ আর দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে। দুই দুই দফায় ক্ষমা দেখিয়ে তারা বুঝে গেছে যে তারা ঠকেছে। এই রাজকন্যার শুধুই গরব সার।
আরও তারা বুঝে গেছে, রাজার মেয়ে হলে কী হবে, স্বভাবটা আসলে মেছুনীর মতো। সুযোগ পেলে কলাটা-মুলাটা শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলাই তার স্বভাব। নিজের বিরুদ্ধে আগেকার দুর্নীতির মামলাগুলো নিজেই তিনি তুলে নিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এখন হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে হাটের একেবারে মধ্যিখানে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখন বিশ্বচোরের খেতাব পেয়েছে। দেশের মানুষের এখন আর সায় কিংবা সমর্থন নেই এই রাজকন্যের জন্য। এই রাজকন্যেকে বিদায় করাই তারা এখন ভালো মনে করছে। রাজকন্যের তখন মনে পড়ে যায়, একসময় এক সামন্ত ডাকাতকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। এখন তিনি সে ঋণের উসুল চান। সে সামন্তের সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি সিংহাসন দখল করে থাকতে চান। ক্রুদ্ধ প্রজারা যাতে প্রাসাদে হামলা করতে না পারে সেজন্য প্রাসাদের ফটক তিনি আগল দিয়ে বন্ধ রাখতে চান। পটভূমিটা সামন্ত-যুগীয় হলেও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে নাকি?
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইতিহাসের দুশমন
সাড়ে চারশ’ বছর আগে প্রথম চার্লস নামে ইংল্যান্ডে এক রাজা ছিলেন। শেখ হাসিনার মতো তিনিও মনে করতেন, পিতৃপুরুষের সিংহাসনের ওপর তার জন্মগত অধিকার। হাসিনার মতো তিনিও সংবিধানের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়ে সিংহাসন আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, এমনকি সেনা-সামন্ত নিয়ে পার্লামেন্ট দখল করতেও গিয়েছিলেন, কিন্তু চার্লসের শেষ রক্ষা হয়নি। পার্লামেন্টের হুকুমে তার মাথা কাটা গিয়েছিল। শেখ হাসিনা সে ইতিহাস পড়েছেন কিনা কে জানে?
বাংলাদেশের মানুষ কাকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চায় ১৯ নভেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার বরিশালের জনসভায় আরও একবার তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দেশের যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, জনতা তাকে দেখতে, তার মুখে দুটো কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। আর রাজকন্যা? গায়ে গণতন্ত্রের নামাবলি এবং গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে থাকলেও তিনি যে গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাকশালী স্বৈরতন্ত্রী পন্থায় গদি আঁকড়ে থাকতে চান, দেশের মানুষ এখন সেটা বুঝে গেছে।
বাংলাদেশ এখন একটা গভীর সঙ্কটে আছে। শেখ হাসিনার পেশিশক্তি গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়েছে। বিগত প্রায় চার বছর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলেছে। শাসক দলের ক্যাডাররাও তাতে শরিক হয়েছে। তারা হাজারে হাজারে বিএনপি ও অন্য গণতন্ত্রী দলগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে, গুম, খুন এবং জখমও করেছে অনেককে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আর সিলেট বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীকে তারা এখনও ছেড়ে দিয়েছে কি? শুনেছি, সিলেটের মানুষ এখন শপথ নিয়েছে, সবাই তারা ইলিয়াস আলী হয়ে যাবে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা এখন আর মুখ বুজে মার খেতে রাজি নয়। তারা ঠিক করেছে, মার খেতে হয় খাবে, প্রাণ দিতে হয় দেবে, কিন্তু পাল্টা মারও তারা দেবে, মরতে হয় দু-চারজন শত্রুকে সঙ্গে নিয়েই তারা মরবে। তাত্পর্যপূর্ণ এই যে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেখানে হচ্ছে, সাধারণ মানুষ, এমনকি পথচারীরাও সেখানে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসছে। এখন তারা জামায়াতের কর্মীদের সঙ্গেও যোগ দিয়ে পুলিশ আর শাসক দলের গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। পরিস্থিতি এখন সত্যি খুবই বিস্ফোরক। যে কোনো মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
ইস্যু খুবই সহজ
যে কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষই বলবে, দুই পক্ষের নেত্রীরা মুখোমুখি বসে আলোচনার মাধ্যমে অতি সহজেই এ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন। এক্ষেত্রে ইস্যুও মোটেই জটিল নয়। উভয় পক্ষই মুখে বলছে, তারা গণতন্ত্র চায়। জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অভিমত কীভাবে প্রকাশ পাবে, সেটাই হচ্ছে ইস্যু। কিন্তু ওই যে বলছিলাম! রাজার মেয়ের শুধুই গরব সার! তার কথাই ওপরে থাকতে হবে। প্রাসাদের ফটক তিনি কিছুতেই খুলতে রাজি নন।
বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই বহু চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক, কলামিস্ট শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সংলাপের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। খালেদা জিয়া কখনও অসম্মত হননি। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা রাজি হলে তিনি সংলাপে বসতে রাজি আছেন। কিন্তু হাসিনা হিমালয়ের মতো স্থবির হয়ে তার অবস্থানে অনড় থাকছেন। সেনাপতির বৌয়ের সঙ্গে তিনি সংলাপে বসবেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এখনও হাল ছাড়েননি। তারা এখনও সংলাপের পরামর্শে অটল আছেন। ড. কামাল হোসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবেত্তা। শেখ মুজিবুর রহমানের আইন উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সংবিধানের খসড়া প্রণেতা এবং তারপর মুজিব সরকারের বিদেশমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা যখন শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় তখন ড. কামাল হোসেন তার সঙ্গে গিয়েছিলেন। সাংগঠনিক দিক থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বাংলা প্রবাদে বলে, বাপে যারে ভরম (সম্ভ্রম) করে পুতে (সন্তানে) তারে নরোম (অপদস্থ) করে। এ প্রবাদটির সত্যতা শেখ হাসিনা বহুবার প্রমাণ করেছেন। নানাভাবে অপদস্থ করে ড. কামাল হোসেনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তা সত্ত্বে সম্প্রতি তিনি উভয় নেত্রীকে দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের লক্ষ্যে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অন্য একজন নেতৃস্থানীয় এবং শ্রদ্ধেয় আইনবেত্তা ব্যারিস্টার রফিকুল হকও সম্প্রতি সংলাপের কথা বলেছিলেন। হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান রফিকুল হককে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাদের বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শ শোনার পরিবর্তে হাসিনা তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, রফিকুল হকের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন।
গুরু-লঘু এবং হিতাহিত জ্ঞানও বিদায় নিয়েছে
যে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী শেখ হাসিনা চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সে প্ল্যানের দুই কারিগর ছিল দিল্লি আর ওয়াশিংটন। ছোট তরফ ওয়াশিংটন পরে পস্তেছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তান নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপমান না করা আর তার বিশ্ববিদিত গ্রমীণ ব্যাংকটি ধ্বংস না করার অনুরোধ ওয়াশিংটন নানাভাবে করেছে। সে অনুরোধ জানাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কয়েকবার টেলিফোন করেছিলেন শেখ হাসিনাকে, দু’বার তো সশরীরে ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন তিনি। কিন্তু হেঁদিপেঁচি বিদেশিদের কথায় রাজার মেয়ের দেমাগ কি ভাঙে?
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ওয়াশিংটনের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখন। কিন্তু রক্তারক্তি আর গৃহযুদ্ধের আগুনে ভস্মীভূত হলে বাংলাদেশ তাদেরও বিশেষ কোনো কাজে লাগবে না। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকার ও শাসক দলের সন্ত্রাস যে কোনো সময় গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা সেটা বোঝেন বলেই একটা মূল্যবান সত্ পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, রক্তারক্তি আর খুনাখুনি না করে সংলাপে বসলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ব্যস! আর যায় কোথায়! রাজবাড়ির পাইক-পেয়াদা আর হুকুম-বরদারদের মহলে সঙ্গে সঙ্গেই কিচিরমিচির শুরু হয়ে যায়। মতিয়া চৌধুরী বুঝতে পারছেন না যে, যতই তিনি মুখ খুলছেন, ততই তার অন্তঃসারশূন্যতা জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। সংসদে অনুপস্থিত একটি বন্ধু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে সংসদে সেদিন যেসব উক্তি করা হয়েছে, সেটা বাকি বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের মুখে গোবর লেপে দেয়ারই শামিল।
বাংলাদেশের মানুষ এখন করবে কী? ভালো কথা যাদের ভালো লাগে না তাদের বেলায় যা করতে হয় সেটাই করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে। রাজপ্রাসাদের ফটক খুলতে যদি রাজকন্যা রাজি না হন তাহলে ফটক ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় কী? চোরা যেমন ধর্মের কাহিনী শুনতে চায় না, গণতন্ত্রবিরোধী বর্তমান সরকারও কোনো সত্ পরামর্শ শুনতে নারাজ।
তবু সরকার স্বীকার করছে, জামায়াতকে নিয়ে মহা সমস্যায় পড়েছে তারা। খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন সে কথা। কী সমাধানের কথা সরকার ভাবছে, তারও কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের কথাবার্তায়। রেলওয়েতে নিয়োগ বাণিজ্য আর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আবার পেছনের দরোজা দিয়ে তাকে স্মাগল করে মন্ত্রিসভায় ঢোকানো হয়। কিছুদিন তার গলা নিচু ছিল। এখন আবার বড়গলায় কথা বলতে শুরু করেছেন তিনি। সুরঞ্জিত বলেছেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কী সে আইনি ব্যবস্থা? ইঙ্গিত দিয়েছেন মাহাবুবুল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, সবাই চাইলে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা বিবেচনা করবে।
সুখে থাকতে ভূতে কিলায়
সুখে থাকতে এদের ভূতে কিলায়। তারা সরকারে আছে। তাদের হাতে একদলীয় সংসদ আছে। যা খুশি তারা তা-ই করে। সংবিধান নিয়ে কী সব কাণ্ডকারখানা আর কেলেঙ্কারি তারা করেছে ভেবেই দেখুন। ইচ্ছা করলে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করতে তাদের তিন মিনিটও লাগবে না। কিন্তু পরে কী হবে ভেবে দেখার মতো বিজ্ঞতা কিংবা দূরদৃষ্টি সুরঞ্জিত-হানিফদের আছে কি? এখন তারা পুলিশ আর গুণ্ডা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে পেটাচ্ছে, ধরে ধরে জেলে পুরছে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। সামনা-সামনি সংঘাতে আসবে না, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করবে। হুট করে কখন কোথা থেকে এসে যে পিঠে ছুরি মারবে কিংবা বোমার ঘায়ে উড়িয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে টেরই পাবেন না সুরঞ্জিত-হানিফরা। এমনকি কার সঙ্গে সংলাপ করতে হবে তাও খুঁজে পাবেন না তারা।
ষাট বছরের বেশি দিন হলো সাংবাদিকতা করছি। লক্ষ্য করেছি এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশে জনসমর্থনহীন সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছে। সেসব দল গা-ঢাকা দিয়ে সন্ত্রাসী হয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে অস্ত্রবলে তাদের দলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বুদ্ধিহীন শাসকরা। ড্যান মজীনা সেসব জানেন। হয়তো দেখেওছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সেজন্যই জামায়াতের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন সরকারকে। ইসলাম ধর্মের নায়করা বলে গেছেন, ‘নির্বোধ বন্ধুর চেয়ে বিজ্ঞ শত্রুও শ্রেয়তর।’ মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা অবশ্যই সেসব হিত কথায় কখনো কান দেন না। (লন্ডন, ২৫.১১.১২)
serajurrahman34@gmail.com

আশুলিয়া ও চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি: সতর্ক না হলে আরও লাশ গুনতে হবে

আবদুল মান্নান | তারিখ: ২৮-১১-২০১২

একই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৩ জন মানবসন্তান প্রাণ হারালেন। প্রথম দুর্ঘটনাটির অকুস্থল ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে, যেখানে সন্ধ্যায় আগুন লেগে এই পর্যন্ত ১১১ জন গার্মেন্টস-কর্মী পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সংখ্যা বাড়তেও পারে। এটি দেশের গার্মেন্টস কারখানায় সংঘটিত এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের ব্যস্ততম ও জনবহুল এলাকা বহদ্দারহাটে সন্ধ্যা সাতটার কিছু পরে, যখন সেখানে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের দুটি কংক্রিট নির্মিত গার্ডার ধসে পড়ে ১২ জন পথচারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে মুহূর্তেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এখনো বেশ কয়েকজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশংসাসূচক ইতিবাচক সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচারিত হচ্ছিল এবং এতে সরকার তো বটেই, দেশের মানুষও বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দুটির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারকেও বেশ বিব্রত করেছে। যদিও প্রথম ঘটনাটির জন্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করা সমীচীন হবে না। এ দুটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সরকারের আহ্বানে দেশের মানুষ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। এই দুই ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্ম এবং তার বিস্ময়কর উত্থান রূপকথার মতো। ১৯৭৬ সালে একজন ডাকসাইটে আমলা এবং একাত্তরের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের খানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই শিল্প এখন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অনেক সফলতার একটি অসাধারণ কাহিনি। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত নুরুল কাদের খানের ‘দেশ’ গার্মেন্টস থেকে প্রথম চালানে আনুমানিক ১২ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। এই খাতে আমাদের এখন রপ্তানি ১৯ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পে চীনকে বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ। মাঝখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, তবে এই ইউনিয়নে ২৭টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। দেশের ৭৮ ভাগ রপ্তানি খাতের আয় এই শিল্প জোগান দেয়, আর এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক, তাঁদের ৯০ ভাগই হচ্ছেন নারী শ্রমিক। দেশে এখন প্রায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চালু আছে, যার বেশির ভাগই বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে আরও অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাকশিল্প এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে দেশও এখন সীমিত আকারে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি শুরু করেছে, আর অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা চীন বা অন্যান্য দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে তাদের ক্রয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, মজুরি কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পোশাক আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। বলতে দ্বিধা নেই, তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা সঠিকভাবে লালন করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। যার অন্যতম হচ্ছে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা। অথচ কোনো সরকারই এই খাতকে সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি।
নব্বইয়ের দশকে প্রথম বাংলাদেশের এই শিল্প ধাক্কা খায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মর্মে তাদের দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে যেহেতু বাংলাদেশ এই শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার করে, সেহেতু তাদের উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খরচ থেকে কম। অতএব, সে দেশ থেকে পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। এই মর্মে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিলও উত্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সতর্ক হলে সেটি আর কার্যকর হয়নি। নির্ধারিত ও প্রত্যাশিত নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আগে বিদেশি ক্রেতার এই দায়িত্বটা দিয়েছিল তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। ক্রমে তারা এখন নিজেরাই বাংলাদেশে পরিদর্শকের দপ্তর খুলে বসেছে। কারণ, তারা আর আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব পরিদর্শক যেকোনো সময় তাঁদের অর্ডারের পোশাক তৈরি করছে তেমন যেকোনো কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, করণীয় কর্তব্যেও ব্যত্যয় ঘটলে বাতিল করে দিতে পারেন চালান। এত সব কারণের পরও ঘটে যেতে পারে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ঘটনার মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই দেশে গত দুই দশকে এমন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের মতো মানুষ, বিচার হয়নি কারও। কারণ, যাঁরা এসব কারখানার মালিক, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁদের অনেকের আনুগত্যও বদলে যায়। সরকারের সঙ্গে থাকলে অনেক পাপ করেও পার পাওয়া যায়।
গত রোববার রাতে বিজিএমইএর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা একাধিক টিভি চ্যানেলে এসে এ ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন এবং বললেন, যে কারখানাটিতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, তারা সব নিয়মকানুন মেনেই চলে। তাঁর ভাষায়, ওই কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল। নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক থাকলে কেমন করে ঘটল এমন একটি দেশ কাঁপানো ঘটনা? গলদটা কোথায় ছিল? এখন দেখা যাচ্ছে, এই কারখানাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ক্রেতা ‘উচ্চপর্যায়ের’ ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছিল। আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থার সংজ্ঞার মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটি আছে। একসময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতাম। আমাদের ছাত্রাবাসটি ছিল ১২ তলা। প্রতি চার মাস অন্তর সেখানে কোনো নোটিশ না দিয়ে দমকল বাহিনী এসে মধ্যরাতের কোনো এক সময় ভবনের আগুন সতর্কীকরণ অ্যালার্ম বাজিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, সবাই তাদের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসবে। এক ঘণ্টা সময়। তারপর তারা প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তল্লাশি চালাত, কেউ ঘুমিয়ে আছে কি না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা আবার নিজ কক্ষে ফিরতে পারতাম। তখন হয়তো ভোর হয় হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসে সেদিন সময়মতো অ্যালার্ম বেজেছিল। শ্রমিকেরা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে সবাইকে বলা হলো, ওই অ্যালার্ম কিছু না। ওটি এমনি এমনি বাজছে। একটু পরে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই বলে তাঁরা ভবন থেকে বের হওয়ার গেটে তালা লাগিয়ে দেন, যা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। নিরাপত্তাব্যবস্থা ৩৬০ ডিগ্রি হওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো একটি ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে চলবে না। একটি কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে সবার যথেষ্ট ধারণা না থাকলে ঘটে যেতে পারে তাজরীন ট্র্যাজেডি। শিল্পকারখানায় আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার অন্যতম প্রযুক্তি হচ্ছে, যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকে অথবা যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করে সেখানকার সিলিংয়ে পানির স্প্রিংক্লারের ব্যবস্থা থাকা। অনেক হোটেলকক্ষেও এই ব্যবস্থা থাকে। এই স্প্রিংক্লারের মুখে একধরনের মোম থাকে। রুমের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে সেই মোম আপনাআপনি গলে যায় এবং সিপ্রংক্লার থেকে পানি ছিটানো শুরু হয়। এবং একই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। প্রতি ফ্লোরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। শুধু তা থাকলে হবে না, তা প্রতিনিয়ত মনিটর করতে হবে। এসব ব্যবস্থা চালু করা খুব ব্যয়বহুল বিষয় নয়, শুধু মালিকদের একটু সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কারও কারও দ্বিমত থাকতে পারে, গার্মেন্টস কারখানা পুড়লে, মানুষ মারা গেলে মালিকদের ক্ষতি নেই। তাঁদের কারখানার বিমা আছে। একটি কারখানায় লগ্নি করা পুঁজি তুলে আনতে বেশি হলে সাত বছর সময় লাগে। আগুনে পুড়লে ব্যাংক থেকে ধার করা ঋণ মওকুফ পাওয়া যায়, তা না হলে ঋণের সুদ মাফ পাওয়া যায়। ক্ষতি হয় দেশের আর সেই সব শ্রমিকের, যাঁরা নিজেদের সবকিছু উজাড় করে মালিকদের মালয়েশিয়া আর দুবাইতে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের অর্থ জোগান। এসবের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে। বছর কয়েক আগে আমি আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের একটি বড় কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকজন বিদেশি অতিথিকে। তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এই মানের কারখানা খোদ ইউরোপেও খুব বেশি নেই।
পুলিশ ধারণা করছে, আশুলিয়ার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। রোববার আশুলিয়ার ‘ডেভোনিয়ার’ গার্মেন্টসে আগুন দেওয়ার চেষ্টাকালে সুমি বেগম নামের একজনকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সহকর্মী জাকির হোসেন তাঁকে ২০ হাজার টাকায় এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তেমনটি হলে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিচার হচ্ছে, তা বানচাল করার জন্য বেশ কিছু বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা। সোমবার উত্তরার দক্ষিণখানে আরও একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগল। আশুলিয়া দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দেশের মানুষ আশা করে, তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে।
চট্টগ্রামের ঘটনা আমার নিজ শহরের ঘটনা। স্বল্প পরিসরে এটির সঠিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এখানে শুধু এতটুক বলতে পারি, কেবল দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের হাতে পড়লে সিডিএর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কী দশা হতে পারে চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি তার একটি বড় উদাহারণ। একই কথা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বেলায়ও সত্য। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারই রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। তাঁর অনেক গুণ আছে। তবে তাঁর বড় দুর্বলতা, তিনি সব সময় সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। এই বিষয়ে অন্য আরেক দিন লেখার ইচ্ছা রইল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চিকিৎসকেরা মিছিল-মিটিংয়ে, রোগীরা অপেক্ষায়



আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ২৮-১১-২০১২

এই শিরোনামটি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের। আবার কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম ‘নির্বাচন করছেন চিকিৎসকেরা-পরিবেশ নষ্ট হাসপাতালের’। এ শিরোনামে খবরগুলো এসেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন উপলক্ষে। কোনো পেশাজীবী সংস্থা গঠিত হয় তার সদস্যদের পেশাগত সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবারের জন্য। আর এ নেতৃত্ব নির্ধারণ বা বদল হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। এটাই স্বাভাবিক। তবে গত দুই দশকের অধিক কাল ধরে এ সংগঠন ও নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
চিকিৎসা সেবাধর্মী ও মর্যাদাকর একটি পেশা। রোগকাতর মানুষ চিকিৎসকের সান্নিধ্যে এলেই ভালো হতে শুরু করেন বলে একটি কথা রয়েছে। রোগ নিরাময়ের অন্যতম সহায়ক রোগীর মনোবল। চিকিৎসকের সান্নিধ্য তাকে তা দেয়। চিকিৎসক আমাদের সবার দরকার। সন্দেহ নেই চেম্বার, বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসকেরা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন গভীর মমত্ববোধ ও নিষ্ঠা নিয়ে। রোগী ভালো হয়ে উঠলে চিকিৎসক পরিতৃপ্ত হন—এটাও লক্ষ করেছি অনেক ক্ষেত্রে।
সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসক সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, যা সংক্ষেপে বিএমএ নামে পরিচিত। সরকারি চিকিৎসকও সরকারি চাকরিজীবী বটে। সরকারি চাকরির সব বিধিবিধান তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারি চাকরিজীবীদের কোনো সংগঠনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবিদাওয়া জানাতে পারার কথা নয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা কীভাবে তা চালিয়ে যাচ্ছেন, এ প্রশ্ন অনেকবার উঠলেও অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
বিএমএ নেতৃত্বের জন্য মূলত দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর একটি হচ্ছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, যা সংক্ষেপে স্বাচিপ আর অন্যটি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে ড্যাব নামে পরিচিত। স্বাচিপ ও ড্যাব দুটি সংস্থাই অত্যন্ত খোলামেলাভাবে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কার্যত অঙ্গসংগঠন হিসেবেই পরিচিত হয়। তাদের কার্যক্রমে রাখঢাক নেই। মূল দলের সভা-সমিতিতেও তারা প্রকাশ্যে যোগ দেয়। তাহলে দেখা যায়, সরকারি চাকরি করে সরাসরি করছেন রাজনীতি। এটা বিধিসম্মত নয় বলে সবারই জানা। এমনকি তাদেরও। তবে তারা তা উপভোগ করছে যখন যারা ক্ষমতায় থাকছে তাদের প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতায়।
আরেকটি অস্বাভাবিক বিষয় হলো, হাসপাতালগুলো শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশেও সাইলেন্স জোন বলে পরিচিত। এর ধার দিয়ে গাড়ি চলাচলেও কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার নির্দেশনা রয়েছে। আর এ হাসপাতালে চিকিৎসকেরা করছেন মিছিল, দিচ্ছেন স্লোগান। এর আঙিনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশেও ভাষণ দিচ্ছেন বক্তা-শ্রোতারা (তাঁরাও চিকিৎসক) দিচ্ছেন করতালি। তাহলে দেখা যায়, গুরুতর অসুস্থ রোগীর জন্য পরিবেশদূষণে পিছিয়ে নেই আমাদের চিকিৎসকেরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ হাসপাতালগুলো অবশ্যই সরকারি। যাদের জন্য রাষ্ট্রের এত টাকা ব্যয়, তারা রোগী। আর করদাতাও তারাই। তারা অপেক্ষায় থাকছে কখন মিটিং-মিছিল শেষ করে চিকিৎসকেরা এসে তাদের দেখবেন।
এ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিজয়ী হয়ে বিএমএ নেতৃত্ব লাভ করতে পারলে সেই নেতাদের বহুমাত্রিক স্ফীতি বেশ কিছুকাল ধরে আমরা দেখছি। ষোলোকলা পূর্ণ করতে অবশ্য সরকারি দলের সমর্থনপুষ্ট দল হতে হবে। সরকারি সব চিকিৎসকের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে তাদের প্রভাব অপরিসীম। আর যে চিকিৎসক তাঁর এ ধরনের কোনো প্রয়োজনে বিএমএ নেতাদের সহায়তা চান, তা জোটে ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় কঠোর আনুগত্য আর অনেক ক্ষেত্রেই মণিকাঞ্চনের প্রভাবে—এ জনশ্রুতি প্রবল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ তাঁর সহকর্মীরা হয়ে যান এঁদেরই অংশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও যে এ ধরনের ক্ষেত্রে এসব নেতার অঙ্গুলি হেলনেই ব্যবস্থা নেয়, এটাও অজানা নয়। অবশ্য সরকারি সমর্থনপুষ্ট দলের বাইরে থেকে বিএমএ নেতৃত্ব এলে হয়তো বা একটা সহাবস্থানের নীতি নিয়ে নেবে উভয় পক্ষ।
বেশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের সুযোগ পান। সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় হয় বিশাল অঙ্কের টাকা। তেমনি বিশাল এগুলোর পরিচালনা ব্যয় চিকিৎসক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রোগীদের পথ্য-খাবার, ওষুধ ইত্যাদির জন্য। এর বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত বলে অনেকে মনে করেন। পল্লি অঞ্চল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকার সামর্থ্যের মধ্যে প্রভূত ব্যয় করে চলছে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ে ব্যয় হয়ে গেছে বহু টাকা। নিয়োগ পেয়েছেন কয়েক হাজার চিকিৎসক ও কর্মচারী। এর আবশ্যকতাও রয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও নিয়োগ দেওয়া হোক। কিন্তু এ দুর্ভাগা জাতি খুব কম ক্ষেত্রেই পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র কেন, উপজেলায়ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পান না। প্রায়শই দোষ দেওয়া হয় চিকিৎসাসামগ্রী, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ ইত্যাদির অপ্রতুলতার। কিন্তু মূল সমস্যা, চিকিৎসকেরা কর্মস্থলে থাকেন না; থাকতে চান ঢাকায়।
এটা সম্প্রতি আমাদের জাতীয় সংসদেও আলোচিত হয়েছে। জবাব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্যত তাঁর অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করে দায়ী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। শুধু ঢাকা বা বড় শহরের চাহিদার হিসেবে নিয়োগ দিলে তো এত চিকিৎসক নিয়োগের আবশ্যকতা থাকে না। নির্মাণ করতে হয় না শত শত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু এগুলো আমরা করেছি জনস্বার্থে এবং আরও করার দাবি আছে। চিকিৎসক কর্মস্থলে না থাকলে সেগুলো ঠিকমতো চলার কোনো সুযোগই নেই। তবে ঢাকা বা কতিপয় বড় শহরের বাইরে চাকরি করবেন না তো সরকারি চাকরিতে এলেন কেন—এ সহজ প্রশ্নটা কেউ তাঁদের কখনো করেছেন কি না জানি না। আর সে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কীভাবে চলবে আর কে চালাবে, এটা অচিরেই মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। কেন্দ্রীভূত প্রশাসন এ সমস্যার মুখে অসহায় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ওই পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকসহ অন্য কর্মচারীদের নিয়োগ থেকে বরখাস্ত করার সব ক্ষমতা জেলা বা উপজেলা পরিষদকে দেওয়া যায় কি না, এটা ভাবার বিষয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ সরকারি নিয়মে বেতন-ভাতা, পেনশন, পদোন্নতি ইত্যাদি পাবেন এবং সরকার এসব কেন্দ্র পরিচালনার সব ব্যয়ই বহন করবে। এ ধরনের ব্যবস্থা দেশের আরও কতিপয় বিভাগের জন্যও চালু করার আবশ্যকতা রয়েছে।
দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ হয়েছে। সরকারি চাকরিতে দলীয়করণের বিষয়টি নিয়ে সীমাহীন লেখালেখিও হয়েছে। আর এটা নিশ্চিত, সবচেয়ে বেশি দলীয়করণ হয়েছে চিকিৎসকদের চাকরিতে। দুঃখজনকভাবে এ দলীয়করণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরই সহকর্মীরা এবং অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই। বিশালসংখ্যক চিকিৎসকের কাছে এ ধরনের দলাদলি অপছন্দনীয় হলেও শুধু নিজের পদ-পদবি আর পছন্দের কর্মস্থল বেছে নিতে বা টিকিয়ে রাখতে এ দলাদলিতে তাঁরা জড়িয়ে পড়ছেন। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় আনে আমূল পরিবর্তন। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞ অধ্যাপকদের হটিয়ে সে স্থানে বসে যান স্রেফ দলবাজি করা কিছু চিকিৎসক।
আবার গণেশ ওল্টালে ঘটে ঠিক তার বিপরীতটা। এতে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজবঞ্চিত হচ্ছে মেধাবী, দক্ষ ও উপযুক্ত চিকিৎসকের সেবা থেকে। ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কি আমরা শুধু সরকারি চিকিৎসাসেবা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটগুলোর মেরুদণ্ডই ভেঙে দিচ্ছি না? অন্য বেসামরিক চাকরিগুলোর মতো এখানেও দলাদলির ফলে চেইন অব কমান্ড আজ বিপন্ন। হয়তো বা কিছু বেশি দলাদলিই হয় চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে। জ্ঞানীগুণী অধ্যাপক তাঁর কনিষ্ঠ সহকারী অধ্যাপককে অনেক ক্ষেত্রে সমঝে চলতে হয় শেষোক্ত জন, নেতা বা তাদের সহচর বলে। এর কুফল দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। অবশ্য চিরস্থায়ীই হবে—যদি এটা চলতেই থাকে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং এর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই, তবে অবশ্যই প্রশ্ন থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মূল প্যানেল দুটির প্রকাশ্য রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে। আরও প্রশ্ন থাকবে বিএমএ কোন যুক্তিতে চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও শীর্ষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করা নিয়ে। পাশাপাশি প্রশ্ন থাকে, এসব সাইলেন্স জোন বলে চিহ্নিত স্থাপনায় চিকিৎসকেরা কীভাবে মিছিল-মিটিং করতে পারেন? কীভাবেই বা দিতে পারেন স্লোগান? বিএমএ সদস্য, ভোটদাতা এমনকি দু-একজন প্রার্থীও থাকতে পারেন দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে। এসব খ্যাতনামা হাসপাতাল যেমন: ইউনাইটেড, স্কয়ার, বারডেম, ল্যাবএইড, অ্যাপোলোর মতো বেসরকারি হাসপাতালে ভোটপ্রার্থী দলের নেতা-কর্মীরা কি এমনতর স্লোগানসহ একটি মিছিল কিংবা হাসপাতাল আঙিনায় কোনো সভা করতে পারবেন? জবাব হবে অত্যন্ত সোজা। আর তা হচ্ছে ‘অবশ্যই নয়’।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন



শিক্ষাঙ্গন
 আবু সাঈদ খান
নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হলে এবং সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে তা কার্যকর থাকলে দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়ে যায় বলে একটি ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল রয়েছে। এ কথা ঠিক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ অপরিহার্য। তবে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়নের বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, রাজনৈতিক ও গণসংগঠন সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ণতা পায় না। দেশে অগণতান্ত্রিক-আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন বহাল রেখে কেবল নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কায়েম করে গণতন্ত্র ধরে রাখাও যায় না। এমন ব্যবস্থা যে কোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন না হওয়ায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত সংসদ পরিণত হয়েছে গণতন্ত্রের সাইনবোর্ডে। একে সামনে রেখে চলছে ক্ষমতাবাজি, দলবাজি ও স্বেচ্ছাচারিতা।
সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উৎস হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক আবহ দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। কারণ, শিক্ষাঙ্গনগুলোতেই তৈরি হচ্ছে আগামী দিনের নেতৃত্ব। শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে নির্বাচিত প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন নির্বাচন থেকে শুরু করে ছাত্র সংসদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি। যারা আজ কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারাই আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যদি যোগ্য ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে গড়ে না ওঠে, তাহলে কী করে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে নেবে?
আশার কথা_ শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশনসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসুসহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়ক আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, 'গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর রীতিনীতি চর্চার অভাবে শিক্ষার্থী-শিক্ষক নির্বিশেষ সবার ভেতর বেশকিছু নেতিবাচক প্রবণতা গাঢ় হয়ে উঠছে। শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বৈরতান্ত্রিক ও তোষামোদে মনোভাব, একচ্ছত্র ও যথেচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহার, শিক্ষার্থীদের একটা অংশের স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় দলীয় (বিশেষত সরকারদলীয়) লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হল দখল, শিক্ষাঙ্গনে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের সংকটের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মূল দলের পোষ্য গুণ্ডা বাহিনীতে পরিণত হওয়া_ এসবই আজ শিক্ষাঙ্গনগুলোয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে।'
এ লেখায় শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের নির্বাচনের কথা না-ইবা বললাম, ছাত্ররাজনীতির অবস্থা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা সমগ্র জাতির জন্যই উদ্বেগজনক। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে মত্ত। ছাত্রসমাজের অতীত গৌরবগাথা আজ ম্লান। একদা ছাত্রসমাজ হয়ে উঠেছিল জনগণের আশা-ভরসার স্থল। ষাটের দশকের কথা। কৃষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে দেখা করতেন। বলতেন, বাবারা, কত কষ্ট করে পাট ফলিয়েছি। কিন্তু ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদন খরচও উঠবে না। তখন সব সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা বসে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নিতেন। সেই প্রতিবাদ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতো না, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রসমাজের প্রতি আস্থা এত বেড়ে যায় যে, গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে দিতে ছাত্রদের অনুরোধ করা হতো। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রামের দীর্ঘদিনের দুটি বিরোধ আমাদের মিটিয়ে দিতে হয়েছিল। ছাত্রসমাজের প্রতি সেই আস্থা আর নেই। জনগণ এখন কথিত ছাত্রনেতাদের দেখে ভয় পায়। আতঙ্কিত হয়। কারও অজানা নেই যে, তারা কত কিসিমের অপরাধকর্মে লিপ্ত। কখনও দুই দলের মধ্যে, কখনও দলের ভেতরেই তারা অস্ত্র হাতে লড়াই করছে। সতীর্থের রক্তে হাত রঞ্জিত করছে। এটি সত্য, এরা সংখ্যায় অতি সামান্য। কিন্তু এসব ঘটনাই সমগ্র ছাত্রসমাজের মুখে কালিমা লেপন করছে। ছাত্ররাজনীতির গৌরব ম্লান করেছে। এভাবে ছাত্রসমাজের মর্যাদা ধুলায় লুটিয়ে পড়ছে। যে ছাত্ররা ছিল দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের চোখের মণি, আজ তারাই জনগণের উৎকণ্ঠার কারণ।
ছাত্র নেতৃত্ব ছিল রাজনৈতিক দলের চেয়ে অগ্রসর ও সাহসী। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতারা বলেছিলেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করো না। ছাত্ররা তা অগ্রাহ্য করে গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। গড়ে তোলে প্রতিরোধ। এভাবে ছাত্রদের সাহসী রক্তদানে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ইতিহাস বলে, ছাত্র ও যুব নেতাদের ঐক্যবদ্ধ চাপের মুখে ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একমঞ্চে আসীন হন। এভাবেই যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হয়। ছাত্রসমাজই ষাটের দশকজুড়ে সংগ্রামের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছিল। সব দল মিলে ১১ দফা রচনা করে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। একাত্তরের মার্চে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অগণিত ছাত্র একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। সর্বশেষ '৯০-এ সব মত-পথের ছাত্র সংগঠন একত্র হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গণজাগরণ তৈরি করেছে। যে ছাত্ররা সর্বদাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগে হেঁটেছে, জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সেই ছাত্রসমাজ আজ রাজনৈতিক দলের অন্ধ সেবাদাস ও লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ জনগণের ঘাম ও রক্তে ভেজা অর্থে চলে। সেই জনগণ শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি দেখতে চায় না। বন্দুকযুদ্ধ দেখতে চায় না, দেখতে চায় না সন্তানের রক্তাক্ত নিথর দেহ। অথচ এখানে দরকার মেধার প্রতিযোগিতা, গবেষণা, উন্নত জীবনবোধের চর্চা, মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।
শিক্ষাঙ্গনে এখন একটি প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে যে, কীভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করা হবে। একাত্তরে পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের রাজত্ব
কায়েম করেছে। এই অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কি খালি হাতে মোকাবেলা করা সম্ভব?
অস্ত্রবাজদের যে সম্মিলিত প্রতিরোধ বূ্যহ রচনা করে মোকাবেলা করা যায়, তার নজির নিকট অতীতেই আছে। নব্বইয়ে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের অস্ত্রবাজরা ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে শিক্ষাঙ্গন ছেড়েছিল। ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে অপশক্তি বরাবরই পরাস্ত হয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরে নিই_ গুটিকতক যুবক যদি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েও অস্ত্র হাতে শিবির মোকাবেলা করে, তবে সেটি জনগণের কাছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলেই বিবেচিত হবে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধকে জনগণ অস্ত্রবাজি হিসেবেই দেখে, শান্তিপ্রিয় মানুষ তা সমর্থন করে না। সঙ্গত কারণে জাতি আশা করে, শিক্ষাঙ্গন থেকে দেশ গড়ার কারিগর আগামী দিনের সৎ ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গবেষক, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী জন্ম নেবে, যারা জাতির হাল ধরবে। দেশকে সমৃদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত দেশে পরিণত করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে তা সম্ভব? ছাত্রসমাজের মধ্যে নানা অশুভ উপাদান ঢুকে পড়েছে। বিপথগামীরা ছাত্রসমাজের মুখে কলঙ্ক কালিমা লেপন করেছে, তা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ মিলবে?
এসব অপতৎপরতা রুখতে চাই আদর্শবাদী ছাত্র নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। কিন্তু নির্বাচন না দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, খুনোখুনি হবে, শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনেও এমন আশঙ্কা আছে, তাই বলে কি তা বন্ধ রাখা উচিত? কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন কিছু নয়। তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর তো বটেই, কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক অবস্থান জরুরি। বলাবাহুল্য, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে। অথচ গণতন্ত্রের দাবিদার দুই দল বা দুই জোটের শাসনামলে তা অনুষ্ঠিত হলো না। একে আমরা কীভাবে দেখব?
আজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেই শুধু ইতিবাচক অগ্রগতি হতো না, বেরিয়ে আসত নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতাও, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঋদ্ধ করত।
১৯৫০-৬০-৭০ দশকের ছাত্রনেতারা আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। কিন্তু এখন আর শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনৈতিক কর্মী মূল রাজনীতিতে আসছে না। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এতে অবারিত হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াবহির্ভূত নব্য ধনী, কালো টাকার মালিকদের আগমনের পথ। এসব অরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীদের কাছে রাজনীতি আত্মপ্রতিষ্ঠার উপায়। তাই তারা সংসদ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকে তদবিরবাজিতে নিবেদিতপ্রাণ!
গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন গণতন্ত্রমনস্ক প্রজন্ম। আর সেই নতুন প্রজন্ম যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে না ওঠে, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে_ যা কিছুতেই কাম্য নয়।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক

ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

দমননীতি নয় রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োজন


  ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ  |  বুধবার, ২৮ নভেম্বর ২০১২



বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামপ্রতিক সময়ে জামায়েতি ইসলামী ও এর সহযোগী সংগঠনের সহিংস হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ সময়ে জামায়াত, ছাত্র শিবিরের তত্পরতায় অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং দেশজুড়ে পুলিশের ওপর হামলে পড়া নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পরে না। এর একটি জঙ্গি রূপ রয়েছে। বর্তমানে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। আসামিদের অধিকাংশই জামায়েতি ইসলামির নেতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা বাংলাদেশের মানুষ কারো সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির সংশ্লিষ্টতা কামনা করে না। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধায় দলটির ভেতরেও এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। ইত্যকার বাস্তব অবস্থার কারণে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাব তেমন আগ্রহ জাগায়নি মানুষের মধ্যে।
রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতেই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, আলোচনা নয় অপতত্পরতায় লিপ্ত জামায়াত ও তার অনুগামীদের দমন করা হবে। আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যেখানে জামায়াত শিবির সেখানেই প্রতিহত করা হবে। আরেক মন্ত্রী রাজপথে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করতে যুব ও ছাত্রলীগের কর্মীদের আহবান জানিয়েছেন। গত ২৫ নভেম্বর বিএনপি মহাসচিব জানান, ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জনসভা থেকে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হবে। প্রতিক্রিয়ায় দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে জানান।
অর্থাত্ কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা নয়—সরকার একধরনের দমননীতি আরোপের কথা বলতে চাচ্ছে। তবে কার্যত তেমন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-শিবির কর্মীদের প্রকাশ্য বা চোরাগোপ্তা মিছিল থেকে পরিকল্পনা মাফিক প্রধানত পুলিশের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে। অনেক স্থানেই পুলিশ সদস্যরা আহত হচ্ছেন। গাড়ি প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে। তারপরও পুলিশ বেপোরোয়া হচ্ছে না। দমনের বদলে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত থাকছে।
এ অবস্থায় জনমনে তৈরি হচ্ছে মিশ্র ধারণা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দমন করার ঘোষণার সাথে বাস্তবতা মিলছে না। হামলাকারীরা যেন আরো বেশি দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। কেউ কেউ মনে করছে, সরকার আর পুলিশ বাহিনী সতর্কতার সাথে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। হয়তো এ ধরনের সন্ত্রাসী তত্পরতার প্রতিক্রিয়ায় পুলিশি এ্যাকশন আশা করছে জামায়াতি পরিকল্পনাকারীগণ। সংঘাতে পুলিশের গুলিতে দু/চারটে লাশ পরে গেলে একে পুঁজি করে একটি বড় অরাজকতা তৈরি করবে জামায়াত। সে সুযোগ না দিয়ে বরঞ্চ পিঠ পেতে দিচ্ছে পুলিশ।
কিন্তু এতে আবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। কোনো কোনো সমালোচনায় বলা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতে অনেক জামায়েতি সমর্থক আছেন। তাদের তত্পরতার কারণে পুলিশ অনেকটা নিষ্ক্রিয়। আমাদের মনে হয়, এধরনের সমালোচনা অনেক বেশি সরলীকরণকৃত। আবার জঙ্গি আক্রমণকারীদের কৌশলের কাছে পুলিশের পরাস্ত হওয়ার কথাও কোনো কোনো সমলোচনায় বলা হচ্ছে। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিচারে এসব ধারণা খুব স্বস্তি দায়ক নয়। প্রাসঙ্গিকভাবে জামায়াতসহ নানা ধর্মভিত্তিক দলকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও কোনো কোনো মহল থেকে উঠেছে।
আমাদের মনে হয় বর্তমান সংকট সামনে রেখে সরকারকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের দিকে হাঁটতে হবে। কোনো ধরনের একপেশে সিদ্ধান্ত হঠকারী হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে জমায়েতি ইসলামী একটি সুসংগঠিত দল। দলের নীতি আদর্শ আর প্রেক্ষাপট যাই থাক না কেন তারা তাদের আদর্শের পতাকা তলে একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেছে। অনুসারীদের জামায়াত নেতারা মুক্তচিন্তা ও বিচারবুদ্ধির জায়গায় রাখেনি। এরা মগজ ধোলাইকৃত মনোজগতে বন্দি সত্তা। একারণে ঐক্যবদ্ধ শক্তি। অনেকেই ‘বাঁচলে গাজী মরলে শহীদে’র আফিম খেয়ে এখন বুঁদ। অমন শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যুব ও ছাত্রলীগ কর্মীরা মোটেও সমকক্ষ নয়। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই আওয়ামী লীগ দলীয় আদর্শে নিজ দলকে সুসংগঠিত রাখতে পারেনি। নব্বইয়ের পর থেকে স্খলন অনেক বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-এ সরকার গঠন করলেও তৃণমূল পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পারিবারিক বলয় ও অর্থমূল্যে সাংসদ বানাতে গিয়ে ছিটকে ফেলা হয়েছে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের। তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বা যথাযোগ্য জায়গা দেয়া হয়নি। ফলে দলের ভেতর এক ধরনের হতাশা ছড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ এবং মনস্তাত্ত্বিক ভাঙ্গন চলতে থাকে কোনো আদর্শিক দলে।
অন্যদিকে যুব ও ছাত্রলীগের আদর্শিক জায়গাটিকে একেবারেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে যুব-ছাত্র দল ও এরশাদের ছাত্র সমাজের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে। দলের ভেতর কোনো পর্যায়েই গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় জবাবদিহিতার জায়গাটি আর অবশিষ্ট থাকেনি। তাই আওয়ামী লীগের এই যুব ও তরুণ সংগঠনের নেতা-কর্মীর ভেতরে একটি সন্ত্রাসী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। অর্থ আর অস্ত্র শক্তির বলয়ে বন্দি হয়ে যায় তারা। এ কারণে অমন বাস্তব দশায় ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্মীদের জামায়াত-শিবির দমনে মাঠে নামিয়ে কোনো কাজ হবে না। একজন শিবির জঙ্গিকে আওয়ামী লীগের কিনে নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অন্যদিকে নষ্ট রাজনীতিতে পরাজিত যুব ও ছাত্রলীগের তরুণ সহজেই অন্যের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে। ফলে এই পন্থায় দমন পদক্ষেপ সরকারের অনুকূলে যাবে না।
আওয়ামী লীগের জন্য জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়া তারুণ্যকে অনেক আগেই নির্বাসন দিয়েছেন আওয়ামী নীতি নির্ধারকগণ। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার মত জাতীয় নেতৃত্ব কি এখন রাজনীতি সচেতন মানুষের আস্থায় রয়েছেন? সকল কিছুই যে আত্মীয়করণ বা বিশেষ কোটায় সম্পন্ন করা যায় না তা এ যুগের আওয়ামী নীতি নির্ধারকগণ বুঝতে চান না।
মুক্তিযুদ্ধের পর জামায়াতকে নির্বংশ করার একটি পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চালিকাশক্তিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছিল মূল নীতির অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পন্ন মানুষের কাছে এই নীতির সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাই স্বাধীনতার পর পর সুযোগ ছিল ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার। এখন ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি সকলেরই আনুকূল্য পেয়েছে জামায়াত। আর বিএনপিতো নিজ শক্তির ভাগ দিয়ে নিজেকে অনেকটা নিঃশেষিত করেও জামায়াতকে শক্তিশালী করেছে। তাই এই বাস্তবতায় দল নিষিদ্ধ করে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও জনবল শক্তিতে জামায়াত এখন অগণ্য নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরিতে দলটি অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। তাই এমন সংগঠন নিষিদ্ধ হলে এর আন্ডারগ্রাউন্ড শক্তি যে কতটা প্রবল হতে পারে তা ইতিহাস পাঠক মাত্রই জানেন। একারণে জামায়াত নিষিদ্ধ করার চিন্তা কোনো দূরদর্শী ভাবনা থেকে এসেছে বলে আমাদের মনে হয় না।
আমরা মনে করি, বর্তমান বাস্তবতা আমলে এনে রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে জামায়াতকে প্রতিহত করতে হবে। দেশজুড়ে জামায়াত প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী তৈরি করতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু জনগণের মধ্যে দলীয় সমর্থক বাড়াতে পারেনি। তাই একক নির্বাচনে দাঁড়ালে জামায়েতের অবস্থা কি হয় তা সকলেরই জানা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই অসামপ্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ। তাই প্রায় ৬০০ বছর সুলতানি ও মোগল যুগে মুসলিম শাসন অতিবাহিত হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে অসামপ্রদায়িক চেতনাই লালিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন যুগে ইংরেজ শাসকরা তাদের ‘ভাগকর শাসনকর’ নীতি প্রয়োগ করে অসামপ্রদায়িক চেতনায় কিছুটা বিষবাষ্প ছড়াতে পারলেও তেমন দুষিত করতে পারেনি সাধারণ মানুষকে। তাই একটি আদর্শিক চেতনা থাকার পরও হাজী শরিয়ত উল্লাহ উনিশ শতকে তার ফরায়েজি আন্দোলনকে তেমন জনপ্রিয় করে তুলতে পারেননি।
আজ আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের জামায়াত প্রতিরোধ করতে হলে নিজেদের গড়া অচলায়তন ভেঙ্গে এই সাধারণ মানুষর কাছে ফিরে যেতে হবে। দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা ও সততা ফিরিয়ে আনতে না পারলে এ কাজটি খুব সহজ হবে না। জামায়াত যে আরোপিত ইসলামের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে প্রকৃত ইসলামের সৌন্দর্য ও আদর্শের কথা ছড়িয়ে দিয়ে এদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। নিজেদের দলীয় গণ্ডির ভেতর আটকে রেখে এই জনমত তৈরি কঠিন। তাই দলীয় পরিচয়ের বাইরে থাকা মুক্তমনের মানুষদের মূল্য দিয়ে কাছে টানতে হবে। জনমত গঠনে তাদের সহযোগিতা নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের অপকীর্তি প্রামাণ্যভাবে তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের ভূমিকা রাজনৈতিকভাবে কতটা ভ্রান্ত ছিল এবং ধর্মীয়ভাবে ইসলামের সাথে কতটা সাংঘর্ষিক সেই বিষয়টি সবধরনের ধোঁয়াশা কাটিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট করে তুলতে হবে।
আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে। তবে অর্থ ও পেশি শক্তির মোহগ্রস্ত নেতা-কর্মী যাদের রক্তে দূষিত প্রবাহ রয়েছে তাদের নেতৃত্বে এ ধরনের মহতী কর্ম সম্পাদন কঠিন। অবশ্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগে সত্ ও নিবেদিত মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয় বলে আমাদের ধারেণা। যাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে তাদেরই নিয়ে আসতে হবে আলোতে। দল ও দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে ক্ষমতা ও অর্থপ্রিয় লোভী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে অপশক্তির মোকাবেলা সম্ভব নয়।
নিবন্ধন প্রাপ্ত কোনো রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে না দেয়াটা প্রতিরোধের হাতিয়ার হতে পারে না। বরঞ্চ গোয়েন্দা সক্ষমতা বাড়িয়ে জঙ্গি আচরণ, অবৈধ অর্থ ও অস্ত্র শক্তির মূলোত্পাটনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জামায়াতকে শক্তিহীন করে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জামায়াতের অমানবিক ও জঙ্গিরূপ উন্মোচন করে করে তুলতে হবে বন্ধুহীন। রাজনৈতিকভাবে মাঠে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনী ও প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে জামায়াতকে গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলাটা খুব কঠিন নয়। আমরা বিশ্বাস করি, যৌক্তিক নীতি নির্ধারণ করে আওয়ামী লীগ অগ্রসর হতে পারলে বিএনপি নিজ স্বার্থেই পক্ষপুট থেকে জামায়াতকে বিসর্জন দেবে। বিএনপির ভেতর এই দাবি ক্রমে প্রবল হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের হতাশার কিছু নেই। তারা ভাবতে পারেন নির্বাচনের অল্প দিন বাকি এসব দীর্ঘ মেয়াদি কাজে কি ফল দেবে! বাহ্যিকভাবে কথাটি সত্য। কিন্তু তাই বলে বালুতে মুখ লুকিয়ে তো ঝড় এড়ানো যাবে না। মানুষ যদি বুঝতে পারে আওয়ামী লীগ আত্মশুদ্ধির পথে এগুচ্ছে এবং অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে তবেই গণআস্থায় ফিরতে পারবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটি। দেশের স্বার্থে মানুষের স্বার্থে আমরা আওয়ামী নেতৃত্বকে জরাগ্রস্ততা থেকে মুক্ত দেখতে চাই।
n লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের প্রতিক্রিয়া


ব দ রু দ্দী ন উ ম র



ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের আর্থিক এবং অর্থনৈতিক আচরণের ওপর এক তদন্ত রিপোর্টে বলেছে যে, তাদের শতকরা ৯৭ ভাগই নেতিবাচক কাজ ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাত্ তারা দুর্নীতিবাজ। তাদেরকে ধোয়া তুলসীপাতা না বলে এই রিপোর্টে দুর্নীতিবাজ বলায় জাতীয় সংসদ সদস্যরা ও সেই সঙ্গে সংসদের স্পিকার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হতে পারে যে, তারা নিজেরাও নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত সাধু-সন্ত মনে করেন! এ কারণে তারা টিআইবির এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে শুধু ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, টিআইবিকে বন্ধ করে দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে রাখলে মানুষের দৃষ্টি অন্ধকারাছন্ন হয়, কিন্তু বাইরের জগতের আলো এর ফলে নির্বাপিত হয় না। সেভাবে টিআইবি রিপোর্ট দিক আর নাই দিক, টিআইবিকে বন্ধ করা হোক আর নাই হোক, জাতীয় সংসদ সদস্যরা যে দুর্নীতিবাজ এটা জানার জন্য এখন বাংলাদেশে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যদি জনগণের কোনো যোগসম্পর্ক থাকত তাহলে ট্রেন বাস লঞ্চ ও রাস্তাঘাটে লোকজন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের দুর্নীতির যেসব কথা অহরহ বলছেন, তার থেকেই তারা তাদের সম্পর্কে দেশের লোকের ধারণা বিষয়ে অবহিত হতে পারতেন। কিন্তু তাদের অবস্থা এদিক দিয়ে একেবারে ভিন্ন। তারা সরকারি ও শ্রেণীগত ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে পরম নিশ্চিন্তে এবং অপরাধের জন্য কোনো শাস্তির ভয়ে ভীত না হয়ে চুরি, ঘুষখোরি, জমি দখল ইত্যাদি দুর্নীতি করে গেলেও জনগণ তাদেরকে সততার পরাকাষ্ঠা মনে করে তাদের জয়গান করছে—এটাই মনে হয় তাদের ধারণা! হয়তো তাদের ধারণা, তারা যত বিচিত্র গর্হিত কাজই করে চলুন, সর্বাবস্থায় জনগণের কর্তব্য হলো ‘দেশপ্রেমিক’ দল হিসেবে তাদেরকে দুর্নীতিমুক্ত মনে করা, কৃতজ্ঞচিত্তে তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসানো!!
আসলে টিআইবি সংসদ সদস্যদের ওপর তার তদন্ত রিপোর্টে যা বলেছে তাতে দেশের কোনো একজন লোকও বিস্মিত হয়েছে অথবা এ রিপোর্টের বক্তব্য অসত্য মনে করেছে, এটা আওয়ামী লীগের লোক ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য কেউ মনে করে না। কাজেই টিআইবি তদন্ত করে সংসদ সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে কী বলেছে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ বসে নেই। সংসদ সদস্যদের লাগামহীন চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগী হিসেবে টিআইবি রিপোর্টে যা আছে তার থেকে অনেক বেশি তারা জানেন।
সম্প্রতি নিযুক্ত তথ্যমন্ত্রী এ রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন যে, এ রিপোর্ট যে তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে তাতে পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি আছে এটা বলাই যেতে পারে। কারণ এসব ক্ষেত্রে পদ্ধতি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখানে কথা হলো, পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি যদি থাকেও, তাহলে সে ত্রুটিমুক্ত হয়ে তদন্ত ও গবেষণা করলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যদের বিষয়ে আলোচ্য টিআইবি রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার থেকে ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে মনে করার কারণ নেই।
জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ সংসদ সদস্যরা টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে যেভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তার থেকে মনে হয় তারা নিজেদের জনগণের কাছে সত্ হিসেবে, সততার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতে বড়ই পছন্দ করেন! এর জন্য সহজ উপায় হচ্ছে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ইত্যাদি না করা। এসব না করলে তদন্ত যে পদ্ধতিতেই হোক, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু নিজেরা এসব গর্হিত কাজ নিয়মিতভাবে এবং লোকের নাকের ডগায় ও চোখের সামনে করে যাবেন এবং জনগণ ও সেই সঙ্গে এ বিষয়ে তদন্ত কাজে নিয়োজিত যে কোনো সংস্থা তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাদের জয়গান করবে এটা এক অস্বাভাবিক প্রত্যাশা।
শুধু সংসদ সদস্যরাই নন, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং উপদেষ্টারা পর্যন্ত যে চুরি, ঘুষখোরি, সব ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—এটা এখন এক প্রকাশ্য সত্য। রেলওয়ে, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, পদ্মা ব্রিজ, ডেসটিনি ইত্যাদিতে সম্প্রতি যে সব দুর্নীতি কেলেঙ্কারি হয়েছে সেটা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অনেক আওয়ামী সমর্থকেরও চোখ খুলে দিয়েছে। এ দেশে বর্তমান সরকারের আমলে চুরি-ঘুষখোরি করলে যে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই, উপরন্তু পুরস্কৃত হওয়ার ব্যাপার আছে, আওয়ামী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রেলে চাকরি বাণিজ্য করতে গিয়ে পাহাড়প্রমাণ ঘুষের টাকা ধরা পড়ার পর চারদিকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত সুরঞ্জিতকে রেলের মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হলেও পরদিনই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে দুর্নীতির গৌরব অর্জনের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছে। এর ফলে মন্ত্রী হিসেবে কিছু কাজ করে তাকে আগে বেতন-ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে হলেও এখন তিনি কোনো কাজ না করেই সেসব সুবিধা পাচ্ছেন! অর্থাত্ জনগণের ট্যাক্সের টাকার খেয়ানত করেই এভাবে একজন দুর্নীতিবাজ দলীয় লোককে প্রতিপালন করা হচ্ছে!! সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এ কাজ কি দুর্নীতি নয়? এ কাজ যে দলের প্রধানমন্ত্রী করেন, সে দলের সংসদ সদস্যরা সবাই নিরামিষভোজী পরম ধার্মিক—এটা মনে করাও এক অবাস্তব চিন্তা।
শুধু আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরাই নয়, বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্য ‘বিপ্লবী’ সদস্যরাও একই কাতারে থেকে একইভাবে নিজেদের সত্চরিত্র টিআইবি রিপোর্টে কলঙ্কিত হতে দেখে চিত্কার করেছেন। ১৩ জন বিরোধীদলীয় সদস্যের ওপর দেয়া টিআইবি রিপোর্টে ১২ জনকেই দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে। বিএনপি যদি সংসদ বর্জন না করে সংসদে থাকত, তাহলে তারাও যে একইভাবে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চিত্কার করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে শাসক শ্রেণী ও শাসক দলভুক্ত লোকদের এই দুর্নীতি যদি শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে তা এতখানি বিপজ্জনক হতো না, যতখানি বিপজ্জনক আজ হয়েছে। এর মূল কারণ এই শাসক শ্রেণী এবং এদের একের পর এক সরকার প্রথম থেকেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত তো করেই নি, উপরন্তু অপরাধ করলে শাস্তি যাতে না হয় সেই শর্তই শাসন ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট যেভাবে লক্ষ্মীপুরের ক্রিমিনাল তাহেরের বেটাসহ ২১ জনের মৃত্যুদণ্ড মাফ করেছেন, সেটা থেকে নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তার দুর্নীতির জন্য পুরস্কৃত করা পর্যন্ত অসংখ্য দৃষ্টান্ত এ বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজে অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়েছে, তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অপরাধের বৈচিত্র্যও দেখা যাচ্ছে অবাক হওয়ার, সেই সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার মতো ব্যাপার। প্রধানত রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের দ্বারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলেও সাধারণভাবে সমাজে এর বিস্তৃতি ঘটে এক ভয়ঙ্কর সামাজিক নৈরাজ্য আজ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে টিআইবি রিপোর্টের বিরোধিতা এবং টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কিন্তু এ বিষয়টি উপলব্ধি করার মতো অবস্থা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, তাদের তথাকথিত মহাজোটের শরিকবৃন্দ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবীদের নেই।
২১.১১.২০১২
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল