আবদুল মান্নান | তারিখ: ২৮-১১-২০১২
একই
দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৩
জন মানবসন্তান প্রাণ হারালেন। প্রথম দুর্ঘটনাটির অকুস্থল ঢাকার অদূরে
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে, যেখানে সন্ধ্যায় আগুন
লেগে এই পর্যন্ত ১১১ জন গার্মেন্টস-কর্মী পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে
নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সংখ্যা বাড়তেও পারে। এটি দেশের গার্মেন্টস কারখানায়
সংঘটিত এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে
চট্টগ্রামের ব্যস্ততম ও জনবহুল এলাকা বহদ্দারহাটে সন্ধ্যা সাতটার কিছু পরে,
যখন সেখানে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের দুটি কংক্রিট নির্মিত গার্ডার ধসে পড়ে
১২ জন পথচারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে মুহূর্তেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। এই
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এখনো বেশ কয়েকজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর
প্রহর গুনছেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশংসাসূচক ইতিবাচক সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচারিত হচ্ছিল এবং এতে সরকার তো বটেই, দেশের মানুষও বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দুটির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারকেও বেশ বিব্রত করেছে। যদিও প্রথম ঘটনাটির জন্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করা সমীচীন হবে না। এ দুটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সরকারের আহ্বানে দেশের মানুষ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। এই দুই ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্ম এবং তার বিস্ময়কর উত্থান রূপকথার মতো। ১৯৭৬ সালে একজন ডাকসাইটে আমলা এবং একাত্তরের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের খানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই শিল্প এখন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অনেক সফলতার একটি অসাধারণ কাহিনি। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত নুরুল কাদের খানের ‘দেশ’ গার্মেন্টস থেকে প্রথম চালানে আনুমানিক ১২ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। এই খাতে আমাদের এখন রপ্তানি ১৯ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পে চীনকে বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ। মাঝখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, তবে এই ইউনিয়নে ২৭টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। দেশের ৭৮ ভাগ রপ্তানি খাতের আয় এই শিল্প জোগান দেয়, আর এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক, তাঁদের ৯০ ভাগই হচ্ছেন নারী শ্রমিক। দেশে এখন প্রায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চালু আছে, যার বেশির ভাগই বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে আরও অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাকশিল্প এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে দেশও এখন সীমিত আকারে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি শুরু করেছে, আর অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা চীন বা অন্যান্য দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে তাদের ক্রয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, মজুরি কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পোশাক আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। বলতে দ্বিধা নেই, তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা সঠিকভাবে লালন করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। যার অন্যতম হচ্ছে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা। অথচ কোনো সরকারই এই খাতকে সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি।
নব্বইয়ের দশকে প্রথম বাংলাদেশের এই শিল্প ধাক্কা খায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মর্মে তাদের দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে যেহেতু বাংলাদেশ এই শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার করে, সেহেতু তাদের উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খরচ থেকে কম। অতএব, সে দেশ থেকে পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। এই মর্মে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিলও উত্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সতর্ক হলে সেটি আর কার্যকর হয়নি। নির্ধারিত ও প্রত্যাশিত নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আগে বিদেশি ক্রেতার এই দায়িত্বটা দিয়েছিল তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। ক্রমে তারা এখন নিজেরাই বাংলাদেশে পরিদর্শকের দপ্তর খুলে বসেছে। কারণ, তারা আর আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব পরিদর্শক যেকোনো সময় তাঁদের অর্ডারের পোশাক তৈরি করছে তেমন যেকোনো কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, করণীয় কর্তব্যেও ব্যত্যয় ঘটলে বাতিল করে দিতে পারেন চালান। এত সব কারণের পরও ঘটে যেতে পারে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ঘটনার মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই দেশে গত দুই দশকে এমন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের মতো মানুষ, বিচার হয়নি কারও। কারণ, যাঁরা এসব কারখানার মালিক, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁদের অনেকের আনুগত্যও বদলে যায়। সরকারের সঙ্গে থাকলে অনেক পাপ করেও পার পাওয়া যায়।
গত রোববার রাতে বিজিএমইএর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা একাধিক টিভি চ্যানেলে এসে এ ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন এবং বললেন, যে কারখানাটিতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, তারা সব নিয়মকানুন মেনেই চলে। তাঁর ভাষায়, ওই কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল। নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক থাকলে কেমন করে ঘটল এমন একটি দেশ কাঁপানো ঘটনা? গলদটা কোথায় ছিল? এখন দেখা যাচ্ছে, এই কারখানাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ক্রেতা ‘উচ্চপর্যায়ের’ ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছিল। আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থার সংজ্ঞার মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটি আছে। একসময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতাম। আমাদের ছাত্রাবাসটি ছিল ১২ তলা। প্রতি চার মাস অন্তর সেখানে কোনো নোটিশ না দিয়ে দমকল বাহিনী এসে মধ্যরাতের কোনো এক সময় ভবনের আগুন সতর্কীকরণ অ্যালার্ম বাজিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, সবাই তাদের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসবে। এক ঘণ্টা সময়। তারপর তারা প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তল্লাশি চালাত, কেউ ঘুমিয়ে আছে কি না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা আবার নিজ কক্ষে ফিরতে পারতাম। তখন হয়তো ভোর হয় হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসে সেদিন সময়মতো অ্যালার্ম বেজেছিল। শ্রমিকেরা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে সবাইকে বলা হলো, ওই অ্যালার্ম কিছু না। ওটি এমনি এমনি বাজছে। একটু পরে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই বলে তাঁরা ভবন থেকে বের হওয়ার গেটে তালা লাগিয়ে দেন, যা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। নিরাপত্তাব্যবস্থা ৩৬০ ডিগ্রি হওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো একটি ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে চলবে না। একটি কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে সবার যথেষ্ট ধারণা না থাকলে ঘটে যেতে পারে তাজরীন ট্র্যাজেডি। শিল্পকারখানায় আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার অন্যতম প্রযুক্তি হচ্ছে, যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকে অথবা যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করে সেখানকার সিলিংয়ে পানির স্প্রিংক্লারের ব্যবস্থা থাকা। অনেক হোটেলকক্ষেও এই ব্যবস্থা থাকে। এই স্প্রিংক্লারের মুখে একধরনের মোম থাকে। রুমের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে সেই মোম আপনাআপনি গলে যায় এবং সিপ্রংক্লার থেকে পানি ছিটানো শুরু হয়। এবং একই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। প্রতি ফ্লোরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। শুধু তা থাকলে হবে না, তা প্রতিনিয়ত মনিটর করতে হবে। এসব ব্যবস্থা চালু করা খুব ব্যয়বহুল বিষয় নয়, শুধু মালিকদের একটু সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কারও কারও দ্বিমত থাকতে পারে, গার্মেন্টস কারখানা পুড়লে, মানুষ মারা গেলে মালিকদের ক্ষতি নেই। তাঁদের কারখানার বিমা আছে। একটি কারখানায় লগ্নি করা পুঁজি তুলে আনতে বেশি হলে সাত বছর সময় লাগে। আগুনে পুড়লে ব্যাংক থেকে ধার করা ঋণ মওকুফ পাওয়া যায়, তা না হলে ঋণের সুদ মাফ পাওয়া যায়। ক্ষতি হয় দেশের আর সেই সব শ্রমিকের, যাঁরা নিজেদের সবকিছু উজাড় করে মালিকদের মালয়েশিয়া আর দুবাইতে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের অর্থ জোগান। এসবের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে। বছর কয়েক আগে আমি আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের একটি বড় কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকজন বিদেশি অতিথিকে। তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এই মানের কারখানা খোদ ইউরোপেও খুব বেশি নেই।
পুলিশ ধারণা করছে, আশুলিয়ার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। রোববার আশুলিয়ার ‘ডেভোনিয়ার’ গার্মেন্টসে আগুন দেওয়ার চেষ্টাকালে সুমি বেগম নামের একজনকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সহকর্মী জাকির হোসেন তাঁকে ২০ হাজার টাকায় এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তেমনটি হলে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিচার হচ্ছে, তা বানচাল করার জন্য বেশ কিছু বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা। সোমবার উত্তরার দক্ষিণখানে আরও একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগল। আশুলিয়া দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দেশের মানুষ আশা করে, তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে।
চট্টগ্রামের ঘটনা আমার নিজ শহরের ঘটনা। স্বল্প পরিসরে এটির সঠিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এখানে শুধু এতটুক বলতে পারি, কেবল দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের হাতে পড়লে সিডিএর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কী দশা হতে পারে চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি তার একটি বড় উদাহারণ। একই কথা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বেলায়ও সত্য। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারই রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। তাঁর অনেক গুণ আছে। তবে তাঁর বড় দুর্বলতা, তিনি সব সময় সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। এই বিষয়ে অন্য আরেক দিন লেখার ইচ্ছা রইল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশংসাসূচক ইতিবাচক সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচারিত হচ্ছিল এবং এতে সরকার তো বটেই, দেশের মানুষও বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দুটির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারকেও বেশ বিব্রত করেছে। যদিও প্রথম ঘটনাটির জন্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করা সমীচীন হবে না। এ দুটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সরকারের আহ্বানে দেশের মানুষ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। এই দুই ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্ম এবং তার বিস্ময়কর উত্থান রূপকথার মতো। ১৯৭৬ সালে একজন ডাকসাইটে আমলা এবং একাত্তরের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের খানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই শিল্প এখন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অনেক সফলতার একটি অসাধারণ কাহিনি। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত নুরুল কাদের খানের ‘দেশ’ গার্মেন্টস থেকে প্রথম চালানে আনুমানিক ১২ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। এই খাতে আমাদের এখন রপ্তানি ১৯ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পে চীনকে বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ। মাঝখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, তবে এই ইউনিয়নে ২৭টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। দেশের ৭৮ ভাগ রপ্তানি খাতের আয় এই শিল্প জোগান দেয়, আর এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক, তাঁদের ৯০ ভাগই হচ্ছেন নারী শ্রমিক। দেশে এখন প্রায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চালু আছে, যার বেশির ভাগই বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে আরও অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাকশিল্প এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে দেশও এখন সীমিত আকারে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি শুরু করেছে, আর অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা চীন বা অন্যান্য দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে তাদের ক্রয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, মজুরি কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পোশাক আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। বলতে দ্বিধা নেই, তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা সঠিকভাবে লালন করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। যার অন্যতম হচ্ছে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা। অথচ কোনো সরকারই এই খাতকে সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি।
নব্বইয়ের দশকে প্রথম বাংলাদেশের এই শিল্প ধাক্কা খায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মর্মে তাদের দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে যেহেতু বাংলাদেশ এই শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার করে, সেহেতু তাদের উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খরচ থেকে কম। অতএব, সে দেশ থেকে পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। এই মর্মে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিলও উত্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সতর্ক হলে সেটি আর কার্যকর হয়নি। নির্ধারিত ও প্রত্যাশিত নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আগে বিদেশি ক্রেতার এই দায়িত্বটা দিয়েছিল তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। ক্রমে তারা এখন নিজেরাই বাংলাদেশে পরিদর্শকের দপ্তর খুলে বসেছে। কারণ, তারা আর আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব পরিদর্শক যেকোনো সময় তাঁদের অর্ডারের পোশাক তৈরি করছে তেমন যেকোনো কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, করণীয় কর্তব্যেও ব্যত্যয় ঘটলে বাতিল করে দিতে পারেন চালান। এত সব কারণের পরও ঘটে যেতে পারে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ঘটনার মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই দেশে গত দুই দশকে এমন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের মতো মানুষ, বিচার হয়নি কারও। কারণ, যাঁরা এসব কারখানার মালিক, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁদের অনেকের আনুগত্যও বদলে যায়। সরকারের সঙ্গে থাকলে অনেক পাপ করেও পার পাওয়া যায়।
গত রোববার রাতে বিজিএমইএর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা একাধিক টিভি চ্যানেলে এসে এ ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন এবং বললেন, যে কারখানাটিতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, তারা সব নিয়মকানুন মেনেই চলে। তাঁর ভাষায়, ওই কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল। নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক থাকলে কেমন করে ঘটল এমন একটি দেশ কাঁপানো ঘটনা? গলদটা কোথায় ছিল? এখন দেখা যাচ্ছে, এই কারখানাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ক্রেতা ‘উচ্চপর্যায়ের’ ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছিল। আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থার সংজ্ঞার মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটি আছে। একসময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতাম। আমাদের ছাত্রাবাসটি ছিল ১২ তলা। প্রতি চার মাস অন্তর সেখানে কোনো নোটিশ না দিয়ে দমকল বাহিনী এসে মধ্যরাতের কোনো এক সময় ভবনের আগুন সতর্কীকরণ অ্যালার্ম বাজিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, সবাই তাদের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসবে। এক ঘণ্টা সময়। তারপর তারা প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তল্লাশি চালাত, কেউ ঘুমিয়ে আছে কি না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা আবার নিজ কক্ষে ফিরতে পারতাম। তখন হয়তো ভোর হয় হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসে সেদিন সময়মতো অ্যালার্ম বেজেছিল। শ্রমিকেরা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে সবাইকে বলা হলো, ওই অ্যালার্ম কিছু না। ওটি এমনি এমনি বাজছে। একটু পরে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই বলে তাঁরা ভবন থেকে বের হওয়ার গেটে তালা লাগিয়ে দেন, যা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। নিরাপত্তাব্যবস্থা ৩৬০ ডিগ্রি হওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো একটি ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে চলবে না। একটি কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে সবার যথেষ্ট ধারণা না থাকলে ঘটে যেতে পারে তাজরীন ট্র্যাজেডি। শিল্পকারখানায় আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার অন্যতম প্রযুক্তি হচ্ছে, যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকে অথবা যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করে সেখানকার সিলিংয়ে পানির স্প্রিংক্লারের ব্যবস্থা থাকা। অনেক হোটেলকক্ষেও এই ব্যবস্থা থাকে। এই স্প্রিংক্লারের মুখে একধরনের মোম থাকে। রুমের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে সেই মোম আপনাআপনি গলে যায় এবং সিপ্রংক্লার থেকে পানি ছিটানো শুরু হয়। এবং একই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। প্রতি ফ্লোরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। শুধু তা থাকলে হবে না, তা প্রতিনিয়ত মনিটর করতে হবে। এসব ব্যবস্থা চালু করা খুব ব্যয়বহুল বিষয় নয়, শুধু মালিকদের একটু সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কারও কারও দ্বিমত থাকতে পারে, গার্মেন্টস কারখানা পুড়লে, মানুষ মারা গেলে মালিকদের ক্ষতি নেই। তাঁদের কারখানার বিমা আছে। একটি কারখানায় লগ্নি করা পুঁজি তুলে আনতে বেশি হলে সাত বছর সময় লাগে। আগুনে পুড়লে ব্যাংক থেকে ধার করা ঋণ মওকুফ পাওয়া যায়, তা না হলে ঋণের সুদ মাফ পাওয়া যায়। ক্ষতি হয় দেশের আর সেই সব শ্রমিকের, যাঁরা নিজেদের সবকিছু উজাড় করে মালিকদের মালয়েশিয়া আর দুবাইতে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের অর্থ জোগান। এসবের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে। বছর কয়েক আগে আমি আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের একটি বড় কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকজন বিদেশি অতিথিকে। তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এই মানের কারখানা খোদ ইউরোপেও খুব বেশি নেই।
পুলিশ ধারণা করছে, আশুলিয়ার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। রোববার আশুলিয়ার ‘ডেভোনিয়ার’ গার্মেন্টসে আগুন দেওয়ার চেষ্টাকালে সুমি বেগম নামের একজনকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সহকর্মী জাকির হোসেন তাঁকে ২০ হাজার টাকায় এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তেমনটি হলে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিচার হচ্ছে, তা বানচাল করার জন্য বেশ কিছু বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা। সোমবার উত্তরার দক্ষিণখানে আরও একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগল। আশুলিয়া দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দেশের মানুষ আশা করে, তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে।
চট্টগ্রামের ঘটনা আমার নিজ শহরের ঘটনা। স্বল্প পরিসরে এটির সঠিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এখানে শুধু এতটুক বলতে পারি, কেবল দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের হাতে পড়লে সিডিএর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কী দশা হতে পারে চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি তার একটি বড় উদাহারণ। একই কথা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বেলায়ও সত্য। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারই রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। তাঁর অনেক গুণ আছে। তবে তাঁর বড় দুর্বলতা, তিনি সব সময় সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। এই বিষয়ে অন্য আরেক দিন লেখার ইচ্ছা রইল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন