শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থায় বিপন্ন মেধাবীরা


আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ১২-০৭-২০১৩

স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সব বেসামরিক সরকারি চাকরির নিয়োগস্তরে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের পর সরকার এসেছে আর গেছে। কিন্তু কোনো না কোনো পরিবর্তিত রূপে তা রয়েই গেছে। বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে এ কোটাগুলোর অনুপাত। বর্তমান সরকারের আমলে আরও একটি নির্মম নিয়ম চালু করা হয়েছে যে এ ধরনের প্রাধিকার কোটায় কোনো প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো খালি থেকে যাবে। আর তা থাকছেও। মেধাবী প্রার্থী প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেধাতালিকায় ওপরের দিকে স্থান পেয়েও চাকরি পাবে না। অধিক হারে চাকরি পাবে কম মেধাবীরা, প্রাধিকার কোটার বদৌলতে। আর তাদেরও খুঁজে না পাওয়া গেলে পদ খালি রাখা হবে। প্রশাসনব্যবস্থায় এটাকে একটা নির্দয় প্রহসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তবে ৩৪তম বিসিএসে কোটাব্যবস্থার প্রয়োগে আরেকটি নতুন মাত্রা দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি হচ্ছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় অতি নিম্নে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটাভুক্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। পক্ষান্তরে মেধাতালিকার অনেক ওপরে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটা-বহির্ভূত প্রার্থীরাও লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়নি। জানা গেল, সরকারি কর্মকমিশনের যুক্তি, প্রাধিকার কোটা পূরণ নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। তবে চতুর্মুখী ব্যাপক সমালোচনা ও পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে এ ফলাফল আপাতত বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। বোধোদয় দেরিতে হলেও না হওয়ার চেয়ে ভালো। ধন্যবাদ, সরকারি কর্মকমিশনকে। প্রকৃতপক্ষে নিয়োগ পর্যায়েই কোটা প্রয়োগ হওয়া স্বাভাবিক। আর বিসিএস পরীক্ষায় সে পর্যায়টি আসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকা তৈরির পর। সুতরাং আকস্মিকভাবে প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকে এটাকে প্রয়োগ করা হলে বঞ্চিত ব্যক্তিরা সংক্ষুব্ধ হবেই। তবে এই ক্ষোভের নামে বিশৃঙ্খলা কিংবা জনদুর্ভোগ কাম্য নয়।
এখন কোটাব্যবস্থার বিন্যাসটা একটু আলোচনা করা যাক। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য, জেলা, মহিলা ও উপজাতি কোটার অনুপাত যথাক্রমে ৩০, ১০, ১০ ও ৫। অর্থাৎ একুনে ৫৫। তাহলে মেধা কোটায় রইল শতকরা ৪৫ শতাংশ। চার দশকের অধিককাল এভাবে সরকারি চাকরিতে কোটার জোরে অধিক সংখ্যায় কম মেধাবীদের চাকরি পাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ আর কলেজশিক্ষকসহ সব ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ। প্রয়োগ করা হয়েছে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও। ফলে এসব পদে মেধাশূন্যতার অভিযোগ আসা অমূলক বলা যাবে না।
এবার দেখা যাক এ কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা। স্বীকার করতেই হবে, এর একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যেমন—ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে উচ্চতর পদে প্রথমে ভারতীয়দের জন্য, পরে মুসলমানদের জন্য আর পাকিস্তান সময়কালে কিছুটা পশ্চাৎপদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত কোটা ছিল। তবে তা সীমিত ছিল উচ্চতর পদেই আর সীমিত আকারেই। তাঁরাও চাকরি পাওয়ার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করার পরেই তা পেতেন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সবার সমান সুযোগ লাভের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে একই অনুচ্ছেদের তিন উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান রাখার কথাও রয়েছে। ওপরে যে প্রাধিকার কোটাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই কি এ অনগ্রসর নাগরিকদের পর্যায়ে পড়ে? তাহলে কোন যুক্তিতে অধিকাংশ প্রার্থীকে ‘সকলের সমান সুযোগ লাভের’ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? আর সুবিধাভোগী কারা, তাও কিন্তু দেখার বিষয়। এ বিষয়ে অনেক আলোচনা, সেমিনার, গোলটেবিল আর লেখালেখি হয়েছে। এগুলোর পক্ষে জোরালো কেন, দুর্বল কোনো যুক্তি নিয়ে কেউ অবস্থান নিতে পারে না। নেওয়া হয় আবেগের আশ্রয়। মনে হচ্ছে যুক্তি-তর্ক সবই অরণ্যে রোদন।
এবার প্রাধিকার কোটার সংখ্যাটি বিশ্লেষণ করার থাকে। মহিলা ও উপজাতিরা সমাজে এখনো অনগ্রসর। আরও কিছুদিন যেকোনো অনুপাতে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জেলা কোটাটির বিভাজন একটি জটিল ব্যবস্থা। আর্থসামাজিক বিবেচনায় অনুন্নত জেলাগুলোকে গোটা তিনেক গুচ্ছে বিভক্ত করে শুধু তাদের জন্যই প্রাধিকার থাকতে পারে। উন্নত জেলার জন্য তা থাকার কোনো যুক্তি নেই। সবশেষে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যের কোটাটি। প্রথমে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল। এখন তা তাঁদের পোষ্যদের জন্য রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের অবদান বৈষয়িকভাবে কোনো দিন শোধ করা যাবে না। তবে তাঁদের সবাইকে সমাজের অনগ্রসর অংশ বলে চিহ্নিত করা যায়? আর এ ৩০ শতাংশ প্রাধিকার কোটার সুফলভোগীর সংখ্যাও খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের নাম গেজেটভুক্ত করেছে, দিয়েছে প্রত্যয়নপত্র, তাঁদের পোষ্যরাই এর সুফলভোগী। এখন পর্যন্ত এর সংখ্যা দুই লাখের কিছু ওপরে। আবেদন বিবেচনাধীন আছে কয়েক হাজার। সব মিলিয়ে তিন লাখও হয় না। তাদের পোষ্য এর পাঁচ গুণই হতে পারে। তাহলে এ প্রাধিকার কোটাটি যৌক্তিক বলে ধরে নিলেও বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার অনুপাতে শুধু তাঁদের জন্য সব বেসামরিক চাকরির নিয়োগস্তরে ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত রাখাকে কোনো বিবেচনাতেই যৌক্তিক বলা যাবে না। আর এ প্রাধিকার কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ খালি রাখাকেও নির্মমই বলতে হবে। আর প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে এ প্রাধিকার কোটা বারবার খালিই থাকবে? এমনিতেই প্রাধিকার দেওয়া হলো অর্ধেকের বেশি পদে। আবার নিয়োগের নিয়মনীতি থেকে বিচ্যুতির ফাঁকফোকরও খোঁজা হচ্ছে।
পাশাপাশি আমরা দেখি, সামরিক বাহিনীতে সিপাহি পদে নিয়োগে জেলা কোটা অনুসরণ করা হয়। আর অফিসার নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাইয়ে শুধুই মেধা। আর এটাই যথার্থ। সুতরাং তারা কর্মক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতার ছাপ রাখবেই। গোটা জাতি চায় তারা তা রাখুক। পাশাপাশি বেসামরিক চাকরির সব প্রথম শ্রেণীর পদ ও বিচার বিভাগীয় কর্মে একই ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া যৌক্তিক। তবে উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু প্রাধিকার কোটা রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা অনধিক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা সংগত হবে। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার জন্য ছেড়ে দিলে এক দশকের মধ্যে দেশের বেসামরিক চাকরিগুলোতে ইতিবাচক চাপ পড়তে থাকবে।
আমরা কথায় কথায় ভারতের নজির দেখাই। ভারত ব্রিটিশ থেকে প্রাপ্ত তার চাকরি কাঠামোগুলোকে বিবেচনাহীনভাবে বিপন্ন করেনি। অনুন্নত সমপ্রদায়ের জীবনযাত্রার মানকে তারা উন্নত করে চলছে। পাশাপাশি অতি সীমিত সংখ্যায় সর্বভারতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীর চাকরির ভিত্তি পদে নিয়োগে তাদের টেনে আনার কিছু ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু সেসব পদ এ ধরনের সর্বগ্রাসী কোটার বিপরীতে ছেড়ে দেয়নি। ১৯৭৯ সালে অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোকে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি ও সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনার জন্য একজন সাংসদ বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতের ৫৪ শতাংশ মানুষ অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত। মণ্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে প্রদত্ত তাদের প্রতিবেদনে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা আর একই অনুপাতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব করে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এ সুপারিশ বাস্তবায়নের একটি প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। দেশের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় সচেতন ভারতবাসী, এ রিপোর্টটির বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছিল। আর সে অবস্থান ছিল ভারতকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। এর সুফল আজ তারা ভোগ করছে।
অপ্রতুল বেতনাদি ও যুগবাহিত মর্যাদার হ্রাস বিবেচনায় এমনিতেই মেধাবীরা সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। তাঁদের প্রধানত আকর্ষণ করছে পাশ্চাত্যের সুযোগ-সুবিধা। এর পরেই রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিসহ বেসরকারি খাত। তাও পুরোনো ধারাবাহিকতায় কিছু মেধাবী তরুণ-তরুণী চলে আসে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। কিন্তু এখানেও তাদের জন্য তৈরি হয়ে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। শুধু নিয়োগ পর্যায়ে নয়, পদোন্নতি পর্যায়ও তুলনামূলক কম মেধাবীরা (সরকারি কর্মকমিশনের সম্মিলিত মেধাতালিকা বিবেচনায়) রাজনৈতিক আনুকূল্যে টপকে যায় অধিক মেধাবীদের। এমন চিত্র দেখা গেছে সামপ্রতিক কালে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিকালে। সম্মিলিত মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারীদের চেয়ে নিচের দিকে অবস্থানকারীরা প্রাধান্য পেয়েছেন সে পদোন্নতি তালিকায়।
নেতাদের অনেকেই সময়ে সময়ে গণমাধ্যমে সংবিধানের চেতনা সম্পর্কে বলে থাকেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার শুধু চেতনা নয়, সরাসরি আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহের একটি। জেনেশুনে এটাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে দীর্ঘকাল। শুধু বর্তমান সরকার নয়, এর আগের সরকারগুলোও বিষয়টিতে হাত দেয়নি। বর্তমান সরকার দিনবদলের সনদে অঙ্গীকার করেছিল দেশবাসীকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম একটি প্রশাসন উপহার দেওয়ার। সেই প্রশাসন হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ, গতিশীল, আধুনিক ও যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সেই অঙ্গীকারের তেমন কোনো প্রতিফলন জনপ্রশাসনে দেখা যায়নি, বরং বিপরীতটাই দৃশ্যমান হচ্ছে। নিয়োগ পর্যায়ে মেধাবীদের দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাধিকার কোটার নিয়মনীতিকে আরও কঠোর ও সম্প্রসারণ করে কম মেধাবীদের টেনে আনতে সচেষ্ট প্রয়াসই লক্ষণীয় হচ্ছে। তাতে তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশাসন গড়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

মেধাবীদের সামনে অন্ধকার

কোটায় খেয়ে ফেলছে চাকরি



শফিকুল ইসলাম

চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন : নয়া দিগন্ত
সরকারি চাকরি েেত্র কোটাব্যবস্থা তুলে দেয়া অথবা তার সংস্কার করে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে আসার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। প্রায় সব কয়টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ অভিযানে রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, সারা দেশেই বিুব্ধ শিার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। এ আন্দোলন দল ও মতের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেছে। দল ও মতের পরিচয় ঠিকানাবিহীন খেটে খাওয়া প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরাই কোটাব্যবস্থার নির্মম শিকার। নিছক মেধার জোরে উচ্চশিার আঙিনা পেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীায় অবতীর্ণ হতে গিয়েই এসব তরুণ হোঁচট খাচ্ছেন। চাকরি নামের সোনার হরিণ তাদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। মেধা আর কাজে আসছে না। ফলে মেধাবীদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। কোটায় কোটায় ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে সব পদ। বিুব্ধ, হতাশ, ক্রুদ্ধ তরুণেরা তাই রাজপথে নেমে এসেছেন। কী কারণে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও কোটার বি¯তৃতি বাড়ছে; সে এক অজানা রহস্য। সাদা চোখে দেখলে মনে হয় এসবই রাজনীতির কূটকৌশলের ফল। প্রশ্ন উঠেছে, মেধাবীরা যাবেন কোথায়? শ্রম ঘামে অধ্যবসায়ে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার কাজে না লাগলে তারা কী করবেন? যোগ্যরা স্থান না পেলে অযোগ্যরাই দখল করবেন সারা দেশ, যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে সরকারি চাকরি েেত্র ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ৫৬ শতাংশ কোটার সুবিধাভোগী। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধার বাইরে। প্রশাসনে ভারসাম্য রার জন্য কোটার প্রচলন করা হলেও এ ব্যবস্থা এখন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিতি তরুণেরা। আবার কোটার সুবিধাভোগ নিয়ে দুর্নীতিরও শেষ নেই। দেদার অপব্যবহার হচ্ছে এ ব্যবস্থার। এখানে ভারসাম্য রার কোনো বন্দোবস্ত নেই। দেশে শিল্পের বিকাশ নেই। কর্মমুখী শিাব্যবস্থা সঙ্কুচিত। উচ্চশিিিত তরুণদের নিছক শ্রমিক হয়ে প্রবাসে পাড়ি দেয়ার ঘটনা ভূরি ভূরি। এসএসসি কিংবা এইচএসসি উত্তীর্ণ পদের বিপরীতে মাস্টার্স উত্তীর্ণদের দরখাস্ত দেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সরকারি চাকরির েেত্র একটি পদের বিপরীতে প্রার্থী থাকেন কয়েক হাজার। প্রতিটি স্তরেই মেধা ও যোগ্যতার স্বার রাখতে হয়। প্রাথমিক বাছাইয়েই যদি কোটার আগ্রাসন শুরু হয় তাহলে সেসব প্রতিযোগীর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। শিার্থীরা এটাকে রাষ্ট্রের নির্মম আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে এ বিষয়গুলো নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি উচ্চ পদে চাকরিতে নিয়োগকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যদের বাছাই করে নিয়োগ দেয়া। কিন্তু গত কয়েক বছরে পিএসসির কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিরপেতা বজায় রাখতে পারেনি বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি পরীার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় কর্তৃপ তা বাতিলও করে দেয়। এসব ঘটনা মেধাবী শিার্থীদের উদ্যম নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়েছে। এর ওপর কোটার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। বর্তমানে বিসিএস পরীার মাধ্যমে উত্তীর্ণরা নিয়োগের জন্য যেসব কোটার মুখে পড়েন সেগুলো হচ্ছেÑ মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা ৩০ ভাগ, মহিলা ১০ ভাগ, জেলা ১০ ভাগ, উপজাতি ৫ ভাগ ও প্রতিবন্ধী ১ ভাগ। জেলা কোটার মধ্যে আবার সব জায়গা একরকম অগ্রসর না হওয়ায় সুষম বণ্টন নেই। বেশ কয়েকটি জেলা আছে যেখানকার অধিবাসীরা উত্তীর্ণ হয়েও ছিটকে পড়ছেন। জেলার কোনো কোটা না থাকায় মেধাবী হয়েও তারা চাকরি পাচ্ছেন না। আগে সনাতন ক্যাডার সার্ভিসে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদে কোটাপদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি শিকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, প্রাণিসম্পদ সার্ভিসেও কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে কঠোরভাবে। অধস্তন বিচার বিভাগ বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে কিছুদিন আগেও মেধাবীরাই চাকরি পেতেন। সম্প্রতি এখানেও কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিচার বিভাগেও এখন কোটার ভিত্তিতে চাকরি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩১তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৭৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়। অথচ সম্মিলিত মেধা তালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেক প্রতিযোগীই চাকরি পাননি। কারণ মেধা থাকা সত্ত্বেও কোনো কোটার মধ্যে না পড়ায় তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। ২৯তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে ৪১২ জনের মধ্যে ২১১ জন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। আর মাত্র ২০১ জন নিয়োগ পেয়েছেন মেধার ভিত্তিতে। ২৮তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডার সার্ভিসে ৬৫৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এর মধ্যে ৩৪৭ জনই বিভিন্ন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি রাখা হয়। ৩২তম স্পেশাল বিসিএসে শুধু মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও উপজাতি কোটাধারীরাই চাকরি পেয়েছেন। অবাক করা ঘটনা ঘটেছে ৩৪তম বিসিএসে। পিএসসির এ পরীায় প্রিলিমিনারিতেই কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ কোটার বাইরে কোনো শিার্থী প্রাথমিক যোগ্যতা যাচাইয়েরও সুযোগ পাননি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই শিাবিদ। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরই এসব নিয়োগ দেয়া হতো। কখনো কখনো পদস্থ আমলা এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ক্যাডারের প্রার্থী বাছাইয়ে ওইসব ক্যাডার সার্ভিসে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ বোর্ডে সমন্বয় করা হয়েছিল। কিন্তু এবারই প্রথম পুলিশ সার্ভিস থেকে এনে একজনকে পিএসসির সর্বোচ্চ পদে বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশনে বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ নিযুক্ত ১৪ জনের ১৩ জনই সরকারি দলের কট্টর সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ অতীতে কখনো হয়নি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীার পর কোটাব্যবস্থার সমন্বয় করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হতো। কিন্তু এবার যে বিষয়টি করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে এখন যে আন্দোলন শুরু হচ্ছেÑ এ বিষয়ে ড. ফায়েজ বলেন, চাকরিতে কোটাব্যবস্থা থাকবে কি না এ ব্যাপারে সরকার এবং পিএসসিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসির এক সাবেক চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেন, পিএসসি এবার যেভাবে ফল প্রকাশ করেছে তা ঠিক হয়নি। প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ একেবারেই অযৌক্তিক। তিনি বলেন, পিএসসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এখন আর চাকরি পাওয়ার মতো নেই। অনেকের ছেলেমেয়েও বয়স্ক হয়ে গেছেন। তাদের নাতি-নাতনীদের কোটায় চাকরি দেয়া অযৌক্তিক। সুতরাং এখন এ কোটা সীমিত করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত। তবে রাজনৈতিক কারণে কোটাব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা প্রশাসনের সবচেয়ে ভালো ক্যাডারগুলোতে কোটায় চাকরি পান। ফলে মেধাবীরা বঞ্চিত হন। যদি এক হাজার পরীার্থী হয় এর মধ্যে ৩০০ জন হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। কিন্তু সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই শ’ কোটায় পাওয়া যায়। আর বাকি পদগুলো শূন্য থেকে যায়। ফলে প্রকৃত মেধাবীরা আসেন না। তবে ওই সরকারের আমলে তিনি কোটাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন বলে জানান সাবেক ওই চেয়ারম্যান। অন্য দিকে কোটার কারণে পড়ে থাকা শূন্য পদগুলো মেধাবীদের থেকে ‘বিশেষ মেধা‘ দিয়ে পূরণ করার কথা বলেন তিনি।