মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প শুনুন

শোনেন শোনেন প্রিয় পাঠক, শোনেন দিয়া মন, খুনি বিপ্লব-বাবরের খুনের গল্প এখন করিব বর্ণন। তবে তার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা!
গত বছরের জুলাইতে আলোচিত আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের ‘অবিসংবাদিত’ নেতা আবু তাহেরের পুত্র বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মাফ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও নামটা পড়েছিল রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের। আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ তখন বলেছিলেন, আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছু জানে না। এই কথিত না জানার খবরটি যিনি প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তিনি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছিলেন, এ বিষয়ে নিয়ম মানা হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই ক্ষমার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
২৫ জুলাই ২০১১ আমার ‘প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমা বৈধ নয়’ শীর্ষক লেখায় আইনমন্ত্রীর ওই না জানার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদ জানতেন না, এই কথা অন্তত দালিলিকভাবে ঠিক নয়। কারণ, যে চিঠির ভিত্তিতে নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ড মওকুফ হয়, সেটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিল। আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত আইন সচিবসহ (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক) পাঁচজনের সই করা চিঠি। এই চিঠিতে ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনা’ শব্দটি আছে। এর মানে, আইন মন্ত্রণালয় ক্ষমা করে দেওয়ার দায়ভার সরাসরি নেয়নি। এমনকি এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাঁধে বন্দুক রেখে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করার একটা সূক্ষ্ম চেষ্টাও থাকতে পারে। তবে তারা তাহেরপুত্র ও তাঁর বন্ধু বাবরের ক্ষমা ‘রাষ্ট্রপতির স্বীয় বিবেচনায়’ ছাড়লেও এটাই তাদের অবস্থান নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ক্ষমা না করার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। খুনি পুত্রের জন্য আবু তাহের তাঁর দলীয় পরিচয় পুঁজি করেন। তিনি আওয়ামী লীগার, সে কারণেই তাঁর পুত্রকে জড়ানো এবং সেই কারণেই তাঁর ঘাতক পুত্র ক্ষমাপ্রার্থী, সে বিষয়টি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক ছিল না। গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের নেতারা বৈঠক করেন। এ সময় মেয়র আবু তাহের উপস্থিত ছিলেন। বিটিভি এ নিয়ে সচিত্র খবর সম্প্রচার করেছিল। ওই বৈঠকে শিবিরকর্মী মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা যে ‘নির্দোষ’ এবং তাঁদের সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়। লক্ষ্মীপুরের একজন সাংবাদিক সোমবার এ কথা বলেছেন এই নিবন্ধকারকে।
এবার আমরা দেখব, খুনি বিপ্লব কাকে, কেন ও কীভাবে খুন করেছিলেন। নির্দলীয় ও দক্ষ বিচারপতি হিসেবে মো. ইমান আলীর সুনাম সুবিদিত। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি আপিল বিভাগে উন্নীত হন। রাষ্ট্র বনাম এ এইচ এম বিপ্লব মামলার মূল রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. ইমান আলী। ৬০ পৃষ্ঠার সুলিখিত এই রায় সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত করেছে যে মহসিন হত্যাকাণ্ডের মূলনায়ক তাহেরপুত্র বিপ্লব। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০০। আওয়ামী লীগের জমানা। লক্ষ্মীপুর শহরের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। এদিন মহসিন খুন হন। ২০০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত রায়ের বিবরণ থেকে দেখা যায়, পলাতক বিপ্লবের পক্ষে রাষ্ট্র আইনজীবী দিয়েছিল।
মহসিন হত্যা মামলায় বিপ্লব ও বাবরসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ৬ জুলাই লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রেফারেন্স পাঠান। এ সময় বিপ্লব ও আবু তাহেরের পালকপুত্রখ্যাত লাবু বাদে অন্য তিনজন কারাগারে ছিলেন। বাবরসহ তিনজনই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য তৈরি করা যন্ত্রণাদায়ক সেলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে যেমন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষও বলেছিল, ‘রাজনৈতিক শত্রুতার কারণেই মহসিনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মহসিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরা স্বীকৃতমতে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী ছিলেন।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, যাঁদের মধ্যে এখন একজন সাংবিধানিক পদে আছেন, বিপ্লব, বাবর বা লাবু ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন, তা দাবি করতে ভরসা পাননি। তাঁরা বলেছেন, মহসিনকে খুন করাই যদি লক্ষ্য হতো, তাহলে বিপ্লবরা মহসিনের হাত-পায়ে গুলি ছুড়তেন না। তাই ৩০২ ধারায় না হয়ে ৩২৬ ধারায় তাঁদের শাস্তি হতে পারে।
উভয় পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্ক শ্রবণ শেষে আদালত কিন্তু তাঁদের যুক্তি একেবারে অগ্রাহ্য করেননি। খুন ও খুনিদের কাণ্ড আদালত সাব্যস্ত করেন এভাবে: ‘ওই কক্ষ থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে অভিযুক্ত লাবু, বাবর ও বিপ্লব মহসিনকে টেনেহিঁচড়ে আবদুল আউয়াল এমপির সুপারির বাগানে নিয়ে যায়। বাবর ও লাবু নিহত মহসিনের দুই হাত চেপে ধরে। এ সময় তাহেরপুত্র বিপ্লব মহসিনের দুই পায়ে গুলি করলে সে লুটিয়ে পড়ে। এরপর তাহেরের পালকপুত্র লাবুও গুলি করে এবং তাঁর কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে বিপ্লব-বন্ধু বাবর মহসিনের বগলে গুলি করে। এই হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটেছে। এটা বলা যায় না যে, আসামিরা কোনোভাবেই জনতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।’
বাবর ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মার্জু ও মেহেদী ছিলেন যুবলীগের কর্মী।
বিচারপতি মো. ইমান আলী তাঁর রায়ের উপসংহারে লিখেছেন, ‘ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। তারা একটি রাজনৈতিক সভা করছিল বলেই অভিযুক্তদের সন্দেহ ছিল। তারা তাদের কাছে চাঁদা চায়নি। তাদের কাছ থেকে মূল্যবান কিছু ছিনিয়েও নেয়নি। আসামিরা তাদের দেহ তল্লাশি করেছিল। তবে নিহত এবং অন্যরা যদি কোনো রাজনৈতিক সভায়ও মিলিত হয়, তাহলেও তাদের সভা পণ্ড করে দেওয়ার কোনো অধিকার আসামিদের ছিল না। মহসিন এই জঘন্য অপরাধের টার্গেট হয়েছিল।’
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ‘এ এইচ এম বিপ্লব, সৈয়দ নুরুল আজিম বাবর এবং আবদুল জব্বার লাবু ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃশ্যপটে ছিল। তারাই যে মহসিনকে অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করেছিল, তা অবিশ্বাসের কোনো কারণ আমরা দেখি না।’
আমরাও আদালতের সঙ্গে একমত। আইন মন্ত্রণালয়ও ‘স্বীয় বিবেচনায়’ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আদালতের ওই রায়কে অবিশ্বাস করার পরামর্শ দেয়নি। তাঁরা প্রত্যেকে তাঁদের চাকরি বাঁচিয়েছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, তাঁরা কেন ক্ষমা বা অনুকম্পা পাচ্ছেন?
হাইকোর্ট কেন তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন, তার বিবরণ এ রকম: ‘বিপ্লব-বাবর ও লাবু যেভাবে গুলি করেছে, তা ময়নাতদন্তের চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার পালের সাক্ষ্যেও প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের পক্ষে যদিও যুক্তি দেওয়া হয়েছে, মহসিনকে তারা হত্যা করতে চায়নি। সেটা চাইলে তারা ঘটনাস্থলেই হত্যা করতে পারত। রিকশা ডেকে হাসপাতালে নিত না।’ আদালত তা মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মহসিনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার গুলি চালানো হয়। এ কারণে আহত ব্যক্তি মারা যেতে পারে—এটা তাদের জানা ছিল না। সে কারণেই তারা খুনের দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না।’ আদালত দুটি কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লব ও অন্যদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছিলেন। আদালত বলেছেন, ‘শরীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গুলি না করা এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করার কারণে বিপ্লব, বাবর ও লাবুর শাস্তি লঘু করা হলো। তাদের যাবজ্জীবন বহাল থাকবে। মার্জু ওরফে নুরুল্লা এবং মেহেদী হাসানকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হলো।’
মহসিনের তিন ঘাতকের মধ্যে বিপ্লব ও বাবরের দণ্ড কমেছে বলে প্রথম আলো খবর দিয়েছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, তাহেরের পালিত পুত্র লাবুরটাও কমবে। সুশাসিত এই রাষ্ট্রে এক যাত্রায় তিন ফল হয় না! লক্ষ্মীপুর জেলে সহযোগীদের নিয়ে ‘বড়মিয়ার (বিপ্লব) বিলাসীজীবন’ কারও অজানা নয়। কিন্তু এসব ঘটছে কিসের মানদণ্ডে? এক অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদ ধরে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নাম ভাঙাবেন, কিন্তু সেটা ধোপে টিকবে না। কারণ, এমন অনেক ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগারের দেখা মিলবে, যাঁরা সংগত কারণ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায্য অনুকম্পা থেকে বঞ্চিত।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এটা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন যে মহসিনের ঘাতকেরা হাইকোর্ট থেকেও একবার অনুকম্পা নিয়েছিলেন। সুতরাং, ঘাতকেরা দুবার অনুকম্পা নিলেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে তাই অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উচ্চ আদালতে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জযোগ্য। সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত এই ক্ষমায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে


বদরুদ্দীন উমর


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজন ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীর দল যেভাবে ও যেসব আওয়াজ তুলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, খাজনার থেকে এদের বাজনা অনেক বেশি। এর থেকে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে এরা সত্যি সত্যিই ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় কি না। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বিচার প্রক্রিয়ার শ্লথগতি এবং এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা সরকারি লোকজন বলতে থাকায় আওয়ামী ঘরানার কোনো কোনো মহলও এ বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রথমেই বলা দরকার, বিচার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার চক্রান্তের কথা বলে 'ওই গেল ওই গেল' রব তুলে আওয়ামী লীগ মহলের নেতৃস্থানীয় লোকজন কর্তৃক যেসব কথা প্রায় প্রতিদিন বলা হচ্ছে, তাতে এদের এসব বক্তব্য পরিণত হয়েছে এক হাস্যকর ব্যাপারে। বিএনপি ২৭ জুন হরতাল আহ্বান করেছিল। সে হরতালের সমালোচনা তাদের পক্ষ থেকে করা কোনো দোষের ব্যাপার নয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার জন্যই হরতাল ডাকা হয়েছে বলে তারা যে আওয়াজ তুলেছিল, তার ফাঁকা চরিত্র খুব স্বচ্ছ। কোনো লোকই এ আওয়াজকে পাত্তা দেননি। কারণ, হরতালের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়কে যুক্ত করা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলেই তাঁরা মনে করেছেন। শুধু হরতালই নয়, দেখা যাচ্ছে বিএনপির যেকোনো কাজ, সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচির সমালোচনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সব সময়ই তাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার চক্রান্ত বলে অভিহিত করছে। এতে নিজেদের জনগণের কাছে খেলো করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়কে খেলো করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই হচ্ছে না। অবস্থা এ রকম দাঁড়াচ্ছে এ কারণে যে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের কথা যত জোরেশোরে বলছে, এ বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত ও ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে সরকারিভাবে তেমন কিছুই করছে না।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু কোনো নতুন ইস্যু নয়। বাস্তবত ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও তৎকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করলেও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি। শুধু তাই নয়, এর তালিকা প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তালিকাভুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের বিচার না করে তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছিল। যদিও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। সে বিচার হয়নি, তার পরও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের আটক করা হয়েছিল তাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে। এ কাজ শেখ মুজিব তাদের মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে করেননি। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমা ঘোষণা ছিল রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারভুক্ত, তবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তিনি এ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন নিজে এই কাজের কৃতিত্ব গ্রহণের জন্য। এ ক্ষেত্রে সব থেকে 'চমৎকৃত' হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কর্তৃক ১৯৭১ সালের সব থেকে বড় ও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে শুধু মাফ করে দেওয়া নয়, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ইসলামী সম্মেলনের সময় তাঁকে পরম বন্ধু হিসেবে আলিঙ্গন করে তাঁর গালে চুমু খাওয়া এবং পরে তাঁকে মহাসম্মানিত রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা। এর পর বাস্তবত আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো নৈতিক অথবা আইনগত ভিত্তি থাকেনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তারা জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। এসব কিছুর প্রমাণই সংবাদপত্রের পাতায় ছড়িয়ে আছে, কাজেই কারো কিছু বানিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।


১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নিলেও এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে যেভাবে অগ্রসর হওয়া দরকার সেটা এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে এরা নিজেরা ইতিবাচক কাজ করার পরিবর্তে নেতিবাচকভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক এই বিচার ভণ্ডুল ও বানচাল করার ষড়যন্ত্রের কথাই বেশি বলছে।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সততার জন্য বিখ্যাত নন। কাজেই সুযোগ বুঝে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে অনেক গালভরা কথা বললেও আওয়ামী লীগ সরকারের এই নেতিবাচক কার্যকলাপের বিরোধিতা না করে নিজেরাও এর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক ফালতু কথাই তাঁদের বলতে হচ্ছে।


এবার অন্য এক প্রসঙ্গে আসা দরকার। এ প্রসঙ্গে এবং এ বিষয়ে কোনো কথা আওয়ামী মহলে তো শোনাই যায় না, উপরন্তু কেউ সে কথা বললে তাকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। প্রসঙ্গটি হলো, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ শুধু অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থীরাই করেনি। বাঙালিরাও তখন যুদ্ধাপরাধ করেছে। যুদ্ধাপরাধের অর্থ শুধু স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা নয়। যুদ্ধের সময় নিরপরাধ ব্যক্তি এবং আত্দসমর্পণকারী ব্যক্তিদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করাও অপরাধ। এ কাজ তখন দুই পক্ষেই হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অনেক অবাঙালি নিরাপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধ ব্যক্তি বাঙালিদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে। আমি নিজের চোখে এ হত্যাকাণ্ড দেখেছি মার্চ মাসের শেষদিকে। আমার আত্দজীবনী 'আমার জীবন'-এর তৃতীয় খণ্ডে আমি এর বর্ণনা দিয়েছি (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩)। এটা এমন ব্যাপার ছিল, যা গোপন বা অস্বীকার করার উপায় নেই।
'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর' নামে একটি বই ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে 'প্রথমা' প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। গোলাম মুরশিদ লিখিত বইটিতে এ বিষয়ের কিছু উল্লেখ আছে। এর থেকেও মনে হয়, অবাঙালিদেরও যে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার এবং তাদেরও যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে_এ চিন্তা মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত লোকদের ছিল না। এ জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সময় বাঙালিরা এমনভাবে অনেক অবাঙালি নিধন করেছিল, ঠিক যেভাবে বাঙালি নিধন করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, "আইন হাতে তুলে নেওয়ার একটি বড় রকমের দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৮ তারিখ মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে। এই সমাবেশে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা দেশ গড়ার ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহ দেন।...কিন্তু এই সমাবেশের পরেই হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধারা চারজন 'দালাল'কে পেটাতে আরম্ভ করেন। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে নিয়ে গর্ব করতাম আমরা সবাই। সত্যিকার অর্থে তিনি যেভাবে নিজে একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। যেভাবে যুদ্ধ করে তিনি টাঙ্গাইল অঞ্চল দখল করে রাখেন, তাও অবিশ্বাস্য। বস্তুত তিনি সবারই শ্রদ্ধা অর্জন করেন। কিন্তু ১৮ তারিখে 'দালাল' পেটানোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদেশি টেলিভিশনের সামনে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে এই দালালদের হত্যা করেন" (মাঈদুল, ১৯৯২)। বলাবাহুল্য, আইন হাতে তুলে নেওয়ার এ দৃষ্টান্ত শ্রদ্ধার বস্তু ছিল না। বহু দেশেই এই ঘটনার ছবি দেখানো হয়। ফলে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বসমাজের যে শুভেচ্ছা ও সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল, তখন থেকেই তাতে ভাটা পড়তে আরম্ভ করে (পৃষ্ঠা: ১৭৬-'৭৭)। 'কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে এক দালালকে হত্যা করতে যাচ্ছেন'_এই শিরোনামে একটি ছবিও এতে ছাপানো হয়েছে; যাতে দেখা যাচ্ছে কাদের সিদ্দিকী বেয়োনেট দিয়ে একজনকে হত্যা করে আর একজনকে হত্যা করছেন।


এই অবাঙালি নিধনের জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাঙালিদের কারো কোনো বিচার হবে এমন চিন্তা বাংলাদেশে দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে এর মধ্যে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশের উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে, যে চরিত্র কোনো মতেই প্রশংসাযোগ্য নয়।
(সুত্র, কালের কন্ঠ, ০১/০৭/২০১০)

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সংবিধান বিতর্ক: আহমেদ বনাম আহমদ

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জনগণের সামনে সত্য আড়াল করছে। তারা অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় আছে। এভাবে তারা জনগণকে কার্যত ভাঁওতা দিচ্ছে। সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ইসি পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক।’ তাঁর কথায়, গত ৪০ বছরে এই প্রথম অসাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ‘সংবিধানের কোথাও অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিধান নেই।’ অন্যদিকে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, প্রজ্ঞাপনে ১১৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইনের উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে এটা সাংবিধানিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি, গত ৪০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ‘উদারতার’ সঙ্গে এটা করা হয়েছে। এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
উভয় পক্ষের বক্তব্যের চেতনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে বলা যায়, উভয় পক্ষ জেনে বা না জেনে অর্ধসত্য উচ্চারণ করছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অর্ধসত্য মিথ্যা অপেক্ষা ভয়ংকর। এতে আমজনতা তো বটেই, শিক্ষিতজনেরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
১১৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’ সরকার আইন না করে চালাকি করে বলেছে, ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রজ্ঞাপন করা হলো। একটি আইন হলে তার বিধান থাকে। এর আওতায় প্রজ্ঞাপন হয়। অথচ এখন আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘এই মুহূর্তে স্থায়ী আইন করার দরকার নেই। প্রজ্ঞাপনই আইনের কাজ সেরেছে।’ এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত ধরে নিলে সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তার উপায় নেই।
১১৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটনে আমাদের সাংবিধানিক বিবর্তন ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৫৬ সালের অবিভক্ত পাকিস্তানের সংবিধানে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ১৩৭ অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে না হয়। সে কারণে লেখা হয়েছিল, এদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ‘ডিসক্রিশন’ বা একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে। ১৯৬২ সালের ১৪৭ অনুচ্ছেদে এই ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা হয়। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদটি আমরা সম্ভবত ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ থেকে গ্রহণ করেছিলাম। তাহলে এখন আমরা দেখব, ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্কের বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছিল। প্রথম যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন।’ এ প্রসঙ্গে এটা বলা আবশ্যক যে, বর্তমান সরকার একটা ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের রেওয়াজ ভেঙে দিয়েছে। কেন তিনজনের পরিবর্তে পাঁচজনের দরকার পড়ল, সেই ব্যাখ্যা সরকারের কোনো মহল থেকে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলও অন্তত এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে নজরে পড়েনি। ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তনে ভারতের অনেক রাজ্য বাংলাদেশের তুলনায় বড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এক সদস্যের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর তারা শুধু একজন সিইসি দিয়ে চলেছে। এরপর তারা দুজন কমিশনার বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাও আইন দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তারা স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেনি। আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার পরও মাত্র দুজনকে দিয়ে ইসি পুনর্গঠন করা সম্ভব ছিল। যাক এ প্রসঙ্গ। কী করে ‘আইন’ এল, সে কথাই বলি। ১৫ জুন ১৯৪৯। ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্ক চলছে। অধ্যাপক সাক্সেনা সংশোধনী এনেছেন। এতে তিনি বলেছেন, সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগ এতে হস্তক্ষেপ করবে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা যেমন চাইবেন, তেমনটা হবে। তাই তিনি বললেন, যাঁর নাম সিইসি হিসেবে প্রস্তাব করা হবে, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মতো সংসদে শুনানির মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন ড. আম্বেদকার। তিনি একটি মধ্যপন্থা উদ্ভাবন করলেন। বললেন, সিইসি নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে সংসদ যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য একটি আইন তৈরি করার বিধান রাখা হোক। অতঃপর ৩২৪ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হলো সংসদের ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন। এই কথাটি আমরা ধার করেছি ১৯৭২ সালে। এবং এ কথা এখন রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে, গত ৪০ বছরে এই আইনটি তৈরি করা হয়নি।
এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শফিক আহমেদ ও মওদুদ আহমদ কীভাবে আইন তৈরি করাসংক্রান্ত ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রেক্ষাপট আড়াল করে আমজনতাকে ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন। সরকারি মহল থেকে আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের’ ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘“আইন” অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ আবার ‘প্রচলিত আইন’ নামেও সেখানে একটি সংজ্ঞা আছে। এতে বলা আছে, ‘প্রচলিত আইন মানে সংবিধান তৈরির আগে এই ভূখণ্ডে যে আইন বহাল ছিল।’ এখানে একটি খটকা আছে। আমাদের সংবিধানে ভুল বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘আইন’ সংজ্ঞায়িত হয়েছে কি না, সেটা বিচার্য। কারণ, আমাদের সংবিধানে যা উক্তরূপ ‘আইন’ ব্যাখ্যা, ১৯৪৯ সালের ভারতের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদ ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের ২১৮ অনুচ্ছেদে তা-ই হলো ‘প্রচলিত আইন’। ভারত ও পাকিস্তানের মূল সংবিধানে (পাকিস্তান কিন্তু ১৯৬২ সালে এই ব্যাখ্যাটি ফেলে দেয়) শুধু ব্রিটিশ ভারতে কার্যকর থাকা আইন, উপ-আইন, আদেশ ইত্যাদিকেই ‘প্রচলিত আইন’ হিসেবে নিয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯২ ধারায় ‘প্রচলিত আইন’ একই লক্ষ্যে লেখা হয়েছিল। সুতরাং, আইন ও প্রচলিত আইন নামে দুটি দফা ’৭২-এর সংবিধানে কেন লেখা হলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষ-এ ‘প্রচলিত আইন’ বলতে ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দুটি বিষয়কেই (আইন ও প্রচলিত আইন) কিন্তু একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এবং সেটাই সঠিক। সুতরাং, সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আইনমন্ত্রীর বর্ণিত ‘আইন’ আসলে সংবিধান প্রণয়নের আগের যেকোনো আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের অন্যত্র বর্ণিত ‘আইন’কে প্রজ্ঞাপন অর্থে ব্যবহার করা যাবে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের ১৫২ অনুচ্ছেদের মতো তাদের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমার জানামতে ভারতের মন্ত্রিসভা বিভাগের কোনো প্রজ্ঞাপনকে তারা সংসদের প্রণীত আইনের মর্যাদা দেয়নি, এক করে দেখেনি।
তবে মওদুদ আহমদের দাবি অনুযায়ী, সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে অনুসন্ধান কমিটির কথা না বলা থাকলেও তাকে অসাংবিধানিক বলা যাবে না। কারণ, প্রজ্ঞাপনটি ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ না করলেও সেটা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের চেতনানাশক নয়। সুতরাং, একটি অনুসন্ধান কমিটি (যার সদস্যরা তাঁদের মূলসাংবিধানিক পদেও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না) গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু যে ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তারা এটা করেছে, সেটা ছিল দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রশ্নেও একটা ফাঁকি আছে। সেটা হলো সিইসি ও ইসি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছিল। সুতরাং যা হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই হয়েছে। দুই দলের একটি বিষয়ে মিল, তারা কেউ ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদে আইন পাস করতে চায় না। সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কার্যকরভাবে খর্বনা করতে তাদের মধ্যে এত কিছুর পরও অশুভ আঁতাত অটুট। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আর্থার কোয়েসলারের একটি উক্তি হচ্ছে, ‘দুটো অর্ধসত্য থেকে একটি পূর্ণসত্য তৈরি হয় না।’
দুই বড় দলের অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে সত্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

শুধু গান নয়, বইও চাঙা করে

নজরুল নজরুল
রোজ সকালে গলা সাধতে বসলে পুরোনো গানগুলো ফিরে আসে। এমন একটি: ‘হে চির সুদূর, তোমার বিরহ আমারে করেছে কবি, এই মোর ভালো যাক চলে আর সবই’। চোখের পাতা আপনি ভিজে আসে। ভেজা চোখে বইমেলায়, পুরোনো বন্ধু হাসি হাসি মুখে এবার প্রকাশিত ১০ খানা বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আগামী প্রকাশনীর স্টলে। ওকে দেখে আমার কত যে পুরোনো কথা মনে হলো, কত দিনের হাসি-অশ্রুকণা মুহূর্তে চোখের সামনে হলো উদ্ভাসিত। বললাম, তোর এতগুলো বই বেরিয়েছে, আর আমার মাত্র কখানি। কোনো সাহিত্যিককে ধরতে পারব না, সময় এত কম। নজরুল সাড়ে তিন হাজার গান লেখা সমাপ্ত করলে তাঁকে বলা হলো, গানগুলো তো ভক্তহূদয় থেকে টেনে এনেছে অশ্রু, আর কত গান লিখবেন? নজরুল তখনই অনেক খানি অসুস্থ, ম্লান কণ্ঠে গাইলেন:
‘আমার আছে এই ক’খানি গান/ তা দিয়ে কি ভরবে তোমার প্রাণ/ অনেক বেশি তোমার দাবী/ শূণ্য হাতে তাই তো ভাবি/ কি দান দিয়ে ভাঙব তোমার গভীর অভিমান’।
হাসনাত হাই বলল, ‘তোকে দিলাম কামরুলের ওপর বই, তোর ভালো লাগবে।’ কানে কানে বলল, ‘তোকে সব বই উপহার দেব আরেক দিন।’ ড. আকিমুন রহমান, আইইউবিতে আমার কলিগ, ১৯২০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ঔপন্যাসিকদের ওপর করেছেন গবেষণা। পড়ে অনুপ্রেরণা পেলাম, কিছুটা দমেও। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ১৫ জন মনীষীর ১১০টি উপন্যাস নিয়ে সুদীর্ঘ থিসিসে উপস্থিত: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় [১২], বুদ্ধদেব বসু [১৬], অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত [৫], অন্নদাশঙ্কর রায় [৮], গোপাল হালদার [৬], জগদীশ গুপ্ত [৮], মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৮], তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় [১৪], বনফুল [৭], প্রেমেন্দ্র মিত্র [৫], নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় [৬], ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [৩], শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় [১], সতীনাথ ভাদুড়ী [২], সরোজ কুমার রায় চৌধুরী [১]।
তৈরি করেছি আরেকটি থিসিস, যেটি পড়া হবে সাহিত্যের এক বড় কনফারেন্সে। এখানে উপস্থিত ১৯৪৮ থেকে ২০১২-এর সাহিত্যিকেরা [৮১ জন], সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে তাহমিমা আনম থেকে শারমিনী আব্বাসী। আত্মজা, তাতে কী। তাহমিমা-শারমিনী ভালো লেখে, আমাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।
এদিকে নতুন কবিরা চিনে ফেলল শাল ও শ্মশ্রুধারীকে। বলল, মোড়ক উন্মোচন করে দিন। বললাম, এর যোগ্য নই আমি। অদূরে একটি টেলিভিশন ক্যামেরা ছেঁকে ধরেছে আনিসুজ্জামানকে, প্রায় শ দুয়েক লোক তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তাঁর মতো একজন ভালো মানুষ সংসারে বিরল, কাউকে না বলতে পারেন না। যেহেতু তাঁকে ভালোবাসি, গিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে পারতাম জনতার ব্যূহ থেকে, আবার এ-ও জানি, ওটিই তাঁর অসুখ এবং ওটাই তাঁর ওষুধ। মোড়ক উন্মোচন করে দিলাম আমিও।
কয়েকটি ছেলেমেয়ে বসে বাদাম খাচ্ছিল, সতৃষ্ণ নয়নে সেদিকে তাকালে ওরা আমাকে অফার করল। আর আমি কী করলাম, সেটি বলি। ওদের সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। বোঝালাম, তোমরা তো আমারই ছেলেমেয়ে। এমন কিছু সাহিত্য সৃষ্টি করো, যাতে সমস্ত পৃথিবী তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা তোমাদের দ্বারাই সম্ভব। কারণ, অতীতে তোমরাই অসম্ভবকে করেছ সম্ভব।
কোথায় যেন গান বাজছিল। একটু শুনতেই মনে হলো গানটি আমার অনেক চেনা, কিন্তু নানা মানুষের ভিড়ে কোলাহলে শিল্পীর সবটুকু দরদ পৌঁছানোর অবকাশ পায়নি। গানটি হলো: ‘আমি সুখী হলে দুঃখই যদি পাও, তবু সে সুখ আমি চাই না’। কেন যেন মনে হলো সমস্ত পৃথিবী চায় আমি হই দুঃখী। আমাকে কেউ সুখ দিতে চায় না। আমি দুঃখী হলেই তারা সুখী। হৈমন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত দুঃখ কীভাবে বহন করো একটি গানের কলিতে। ও যা বলল, তা বিস্ময়কর। বলল, ‘আব্বাসী দাদা, আমি চিরদিনের একা, কিন্তু এ গানগুলো আমার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। সবার দুঃখ আমি গানের মধ্যে বহন করি। তাই আমার গান সহজেই ওই হূদয়গুলোতে গিয়ে আঘাত হানে। এ আঘাত দুঃখকে সয়ে নেওয়ার আঘাত।’ আমার একখানি বই তার হাতে দিলাম—জীবন নদীর উজানে। হৈমন্তী বলল, গানের মতো গ্রন্থও মানুষকে দেয় বেদনা। সে বেদনাই আবার আনন্দ।
মেলা থেকে চলে আসার আগে বর্ধমান হাউসের তিন তলার একটি ঘরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম, ওইখানে দেখা হয়েছিল নজরুলের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার, সঙ্গে ছিলেন বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন। সে অনেক দিন আগের কথা। সেদিন আমি সেখানে ছিলাম না। অথচ আজ হঠাৎ মনে হলো, ওই কামরায় তিনজন কথা বলছেন। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছি। এই কামরাটি এখন ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ‘কে আর হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।
কিংবদন্তি সাহিত্যিক হতে হলে বলয় নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। স্তাবক দ্বারা তৈরি করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবদন্তির বলয় নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। বইমেলার বলয় একজনকে ঘিরেই। তিনিও নামদার, তাঁর নাম হুমায়ূন। অন্যপ্রকাশের স্টলে হুমায়ূনের অসংখ্য ভক্ত তাঁকে ভোলেনি। মাগরিবের নামাজের আজান ধ্বনিত হলো কোথাও। বললাম, হে প্রভু, তুমি কিংবদন্তি হুমায়ূনকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও, যত শিগগির সম্ভব। দেখে ভালো লাগল, তরুণ-তরুণীরা সাদরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে নতুন লেখকের ভালোবাসার সম্ভার পুড়িব একাকী। সকালে মনটা ছিল ভার ভার, আর এখন ফুরফুরে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ছাত্রলীগের ‘হ্যাঁ’, খালেদা জিয়ার ‘না’

মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাণঢালা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছাত্রলীগকে। কেননা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অগ্রপথিক বলে পরিচিত ছাত্রলীগ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর চট্টগ্রামে হরতাল পালনের সুযোগ করে দিয়েছে তাদের। এই ছাত্রসংগঠনটি এত দিন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আড়ালে-আবডালে কাজ করলেও এখন প্রকাশ্যে হরতাল পালন করছে, গাড়ি ভাঙচুর করছে; শিক্ষক ও প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ঢাকায় সমাবেশ ডেকে শিবিরের নেতারা এই বলে হুমকি দিয়েছেন, ছাত্রলীগের বেপরোয়া সন্ত্রাস বন্ধ না হলে তাঁরা প্রয়োজনে দেশের সব ক্যাম্পাসে ধর্মঘট ও ক্লাস বর্জন করবেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভরাডুবির পর শিবির অনেকটা আড়ালে চলে গিয়েছিল। তাদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে সাহস পায়নি। এবার ছাত্রলীগ দুজন শিবিরকর্মীকে হত্যা করে শিবিরকে সেই ‘সাহস জুগিয়েছে’।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষের পেছনে কোনো আদর্শগত দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়নি। ঘটনার সূত্রপাত খেলার মাঠের হাঙ্গামা নিয়ে। খেলার মাঠের বিরোধ শ্রেণীকক্ষে গড়ায় এবং সেখান থেকে দুই পক্ষ লাঠিসোঁটা, চাপাতি ও রামদা নিয়ে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবির কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মীর মাথা ফাটিয়েছে, কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। তারা কত দিন ধরে ক্যাম্পাসে মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে, তার সবকিছুই চাপা পড়ে গেছে দুজন শিবিরকর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনায়। যেকোনো মৃত্যুই শোকের। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আরও কয়েক দফা বন্ধ ছিল—কখনো ছাত্রলীগের সঙ্গে উপাচার্যের বিরোধের কারণে, কখনো ছাত্রলীগ-শিবির দ্বন্দ্বের কারণে। কয়েক মাস ধরে যখন ক্যাম্পাসে মোটামুটি সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছিল, তখনই এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। পরিণতিতে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় এক মাস শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা-ক্লাস হবে না। গতকাল কয়েকটি পত্রিকায় চিরাচরিত সেই ছবি ছাপা হয়েছে: শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এই যে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি মাস হারিয়ে গেল, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে—বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, সরকার, ছাত্রলীগ না শিবির? ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এতটাই আদর্শবান যে শিবিরের কর্মীকেও তাঁদের কর্মী বলে দাবি করেছেন। রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর কাকে বলে?
এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কখনো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, কখনো প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস মানেই ছাত্রলীগ। গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংগঠনটির পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগকে চরিত্র বদলানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, ছাত্রলীগের চরিত্র ঠিক নেই। একবার তিনি রাগ করে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্রলীগের চরিত্র এতটাই অনড় যে এ ধরনের রাগ-অভিমানে তা বদলাবে না। এ জন্য চাই কঠিন শাস্তি। প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের নেতারা যতই ছাত্রলীগের গায়ে হাত বোলান না কেন, তাঁরা একটার পর একটা ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরিয়ে চলেছেন। এখন ছাত্রলীগ মানেই আতঙ্ক। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে যে বই তুলে দিয়েছিলেন, তাতে ধুলো জমলেও চাপাতি-কিরিচগুলো চকচক করছে। ছাত্রলীগের কর্মীরা পড়াশোনার ব্যাপারে ‘না’ বললেও সন্ত্রাসকে ‘হ্যাঁ’ বলছেন, হল দখলকে ‘হ্যাঁ’ বলছেন; ‘হ্যাঁ’ বলছেন টেন্ডারবাজি-দখলবাজিকেও।
যে ছাত্রলীগ এখন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মহাপ্রতাপ দেখাচ্ছে, মারামারি করছে, সেই ছাত্রলীগ কিন্তু ২০০৭-০৮ সালে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিপদের দিনে গর্তে লুকিয়ে ছিল। শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে তখন মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে নারীকর্মীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরনা দিলেও ছাত্রলীগের ‘দুঃসাহসী নেতা-কর্মীদের’ দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের প্রচণ্ড প্রতাপের সময়ও। ছাত্রলীগের এই ‘বসন্তের কোকিলেরা’ সরকার ও প্রশাসনের ওপর ভর করে দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে।
শিবির ও ছাত্রদল এই বলে আশ্বস্ত হতে পারে যে ছাত্রলীগের হাতে তাদের যতজন নেতা-কর্মী মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি ছাত্রলীগের কর্মী মরেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ যত শেষ হয়ে আসছে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
ছাত্রলীগ কতটা জনপ্রিয় সংগঠন, তা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন দিয়ে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারে। সামরিক শাসনামলে সর্বশেষ ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। এরপর কোনো সরকারই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেয়নি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কী আশ্চর্য মিল!

২.
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সমাবেশে বলেছেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন তাঁরা মানবেন না, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন তাঁরা করবেন না। এর বিরুদ্ধে তাঁর দল আন্দোলন করবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তাঁর দল আওয়ামী লীগের মতো লগি-বৈঠা নিয়ে সহিংস আন্দোলন করবে না, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবেন।’(প্রথম আলো, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২)
বিএনপির নেত্রী নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেবেন না। সার্চ কমিটি মানেননি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকালে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তাহলে কি তিনি চান, দেশ নির্বাচন কমিশনশূন্য থাকবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে বিএনপি কি একটি উপনির্বাচনেও অংশ নেবে না? নির্বাচন বর্জনের অধিকার তাদের আছে। এর আগে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনিরুল হককে অব্যাহতি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে পরে তাঁকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। নির্বাচনে জয়ী হলে সবকিছু জায়েজ হয়ে যায়, আর পরাজিত হলে নির্বাচন কমিশনের দোষ। এই স্ববিরোধী রাজনীতি কি চলতেই থাকবে?
সাংবাদিক সমাবেশে খালেদা জিয়া সরকারকে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বলেছেন। অন্যথায় পালানোর পথ পাবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। একে আমরা তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে ধরে নিতে পারি। কিন্তু বিএনপির নেত্রী যখন সরকারের উদ্দেশে ‘আমাদের দাবি না মানলে আমরা আমাদের পথ বেছে নেব, তোমরা তোমাদের পথ বেছে নিয়ো’ (ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২) বলে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন, তখন ধন্ধে পড়ে যাই। কী ভয়াবহ কথা! এর মাধ্যমে তিনি কি সরকারকে সরাসরি যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছেন, না ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের ফাঁদে ফেলতে চাইছেন? ১৯৭১ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানে সংখ্যালঘু দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘এধার হাম, ওধার তোম।’ অর্থাৎ তুমি তোমার অংশ শাসন করো, আমি আমার অংশ শাসন করব। খালেদা জিয়াও কি ‘আমাদের’ ও ‘তোমাদের’ কথা বলে দেশটাকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শিবিরে ভাগ করতে চাইছেন?
আমরা জানি না, সরকার তাঁর এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে নেবে।
বিএনপির নেত্রী যেসব যুক্তিতে এখন সরকারের সবকিছুতে ‘না’ বলছেন, সেসব যুক্তিতে একসময় শেখ হাসিনাও ‘না’ বলতেন। ২০৫ দিনের বেশি সংসদ বসেছে, খালেদা জিয়া গেছেন মাত্র পাঁচ দিন। বাকি ২০০ দিন তিনি সংসদকে ‘না’ বলেছেন। কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠককে ‘না’ বলেছেন।
আমাদের দেশে বিরোধী দল ‘না’ ছাড়া কিছু বোঝে না। সরকার যা কিছু করে, বিরোধী দল তাতে ভেটো দেয়, প্রত্যাখ্যান করে। এর আগে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে জাতীয় সংসদে যে কমিটি হয়েছিল, বিরোধী দল তাতেও ‘না’ বলেছে; কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঠিকই খালেদা জিয়া দেখা করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার কথা বলেছেন। তাহলে ঝগড়াটা আসলে ভারতের সঙ্গে নয়, শেখ হাসিনার সঙ্গে?
বাংলাদেশে যারাই বিরোধী দলে থাকে, তারা মনে করে যে এই পাঁচ বছর ‘বর্জন’ করে কাটিয়ে যাবে এবং পরের পাঁচ বছর ‘গর্জন’ দিয়ে তা পুষিয়ে নেবে। আবার সরকারি দলও মনে করে, দেশটা জনগণ পাঁচ বছরের জন্য তাদের ইজারা দিয়েছে। অতএব, যা খুশি তা করার অধিকারও আছে। দুই দলের বর্জন ও গর্জনে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অনেকেই মনে করেন, সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রকাশ্যে যত বিরোধই থাক না কেন, ভেতরে ভেতরে একটা সমঝোতা আছে। ‘তৃতীয় পক্ষ’কে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না। একজন প্রধানমন্ত্রী হলে আরেকজন বিরোধীদলীয় নেতা। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিরোধী দলকে ‘তৃতীয় পক্ষে’র বিপদ সম্পর্কে হরহামেশা নসিহত করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ‘তৃতীয় পক্ষ’ এলে কাউকেই ছাড় দেবে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে বিএনপি সব ক্ষেত্রে ‘না’ বলে আসছে। এই ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ করাবে কে?
বিরোধী দলের নেত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এগুলো করা ভালো নয়। কিন্তু তারা তো আমাদের শিখিয়েছে। এখন তারা যে কাজগুলো করছে, তা যদি ভবিষ্যতে আমরা করি, তখন তো আওয়ামী লীগ এটা নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারবে না।’ (ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২)
এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া দলীয় লোককে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ দিয়ে সরকার ব্যাপক দুর্নীতি করেছে বলে আমাদের জানিয়েছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু তাঁর পরের কথাটিতেই আমরা বিস্মিত হই। আওয়ামী লীগ যেহেতু দুর্নীতি করেছে এবং বিএনপিকে সেই দুর্নীতি শেখাচ্ছে, সেহেতু ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা প্রতিবাদ করতে পারবে না।
এর মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেত্রী কি ভবিষ্যতে তাঁরা ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের শেখানো দুর্নীতির অনুশীলন করার আগাম বৈধতা নিয়ে রাখলেন? তাহলে তো দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইন-আদালত, থানা-পুলিশ কিছুরই প্রয়োজন হবে না।

  সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আরব বসন্ত এবং দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলন

১.
২০১০ সালের শীতকালে তিউনিসিয়ার এক মফস্বল শহরে ২৬ বছরের এক ফেরিওয়ালা যুবক মুহাম্মদ বুয়াজিজি প্রশাসনের হয়রানির প্রতিবাদে যখন নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়, তখন কে জানত এ ঘটনার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের মাধ্যমে সূচনা হবে ‘আরব বসন্তের’। তিউনিসিয়ার পর মিসর। তাহরির স্কোয়ারের তিন সপ্তাহের আন্দোলনে ফেব্রুয়ারি মাসে বিদায় নেন তিন দশকের শক্তিশালী স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক। জুন মাসে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব পালিয়ে যান (বর্তমানে আছেন আমেরিকায়) এবং তার ৩৩ বছরের শাসন অবসানের জন্য একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। বাহরাইনের বিদ্রোহ দমনে ব্যবহূত হয়েছে সৌদি সেনাবাহিনী। মরক্কো ও জর্ডানে সংস্কার সাধিত হয়েছে। লিবিয়ার ৪২ বছরের শাসক গাদ্দাফির পতন ঘটেছে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন ঠেকাতে তার সরকার এ পর্যন- জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী ৫,৫০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। মুসলিম বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুবাতাস বইছে তা ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।


সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রায় ২০০টি বিকল্পের কথা ভেবেছিল। কিন্তু তাদের ওই বিকল্পের মধ্যে আরব বসন্ত ছিল না। অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু আমার ওই বন্ধু কোনো সাধারণ লোক নন। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্র সরকার মুসলিম বিশ্ব সমপর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছ থেকে মাঝে মধ্যে পরামর্শও নিয়ে থাকে। নীতিনির্ধারকদের সাথে তার যোগাযোগ আছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য, মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য, ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্য : সুয়েজখাল ও হরমুজ প্রণালী যদি কয়েক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো সারা বিশ্বের হূৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে; সেই অঞ্চল নিয়ে, পৃথিবীকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা চিন্তা না করে পারেন? ‘আরব বসন্ত’ পাশ্চাত্যের রাডারে ধরা না পড়ার কারণ হচ্ছে মানুষ সাধারণত কার্যকারণ এবং এর ফলাফল নিয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে; কিন্তু মানুষ জানে না সৃষ্টিকর্তা কার্যকারণ ও ফলাফল দুটোই নিয়ন্ত্রণ করেন।


আজ অবশ্য এ বিষয়টি সুনিশ্চিত, আরব বসন্তের সুদূরপ্রসারী ফলাফল শুধু আরব বিশ্বের রাজনীতিতেই পড়বে না। এর প্রভাব গোটা বিশ্ব-রাজনীতির ওপর পড়বে। তবে লক্ষণীয় যে, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এক কোটি চার লাখ জনগোষ্ঠীর উত্তর আফ্রিকার ছোট্ট দেশ তিউনিশিয়াই আরব বসন্তের নেতৃত্ব দেয়ার গৌরব অর্জন করল।
অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তিউনিসিয়ায়। ২১৭ আসনের গণপরিষদে রশিদ ঘানুশির ইসলামপন্থী দল আন্‌নাহদা ৮৯ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৯ আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সিপিআর (কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক), আর ২৬ আসন পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আরিধা। শেষোক্ত দু’টি দলই সেকুলার আদর্শে বিশ্বাসী। এরপর নভেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মরক্কোতে। ৩৯৫ আসনের পার্লামেন্টে ১০৭ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে মধ্যমপন্থী ইসলামি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি।


রশিদ ঘানুশির সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের। সর্বশেষ দেখা ইস্তাম্বুলে ২০০৯ সালের মে মাসে একটি ইসলামি সম্মেলনে। ইতঃপূর্বে ওই বছরের মার্চ মাসে লন্ডনে তার বাসায় গিয়েছিলাম। এককেন্দ্রিক বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এর মাত্র কয়েক মাস আগে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। সূরা বনি ইসরাইলের ৭ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এতে করে ইসরাইলের চেহারাই বিকৃত হয়েছে।’ আলোচনার এক পর্যায়ে তার সব সময়ের হাসিমাখা মুখে আরো একটু হাসি নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান যখন তিউনিসিয়ার মতো হবে, তখন আপনিও আমার মতো আর নিজের দেশে থাকতে পারবেন না।’ কে জানত এ আলোচনার মাত্র ২২ মাসের মাথায়, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ বছরের অধিক সময়ের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ৭০ বছর বয়স্ক রশিদ ঘানুশি তিউনিসিয়া ফিরে যাবেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য। ভবিষ্যতের খবর একমাত্র আল্লাহর কাছেই থাকে (সূরা লোকমান ৩১:৩৪) এবং তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন (সূরা ইউসূফ ১২:১০০)। দেশে ফিরে ঘানুশি ঘোষণা দেন নিজে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। ক্ষমতায় গেলে তার দল ইসলামি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করবে না। তুরস্কের একে পার্টির আদলেই সরকার পরিচালনা করবে।


অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মিসরের নির্বাচনে ইখওয়ানের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) ৫০৮ আসনের পার্লামেন্টে সর্বমোট ২৩৫ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১২৩টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সালাফিপন্থী নূর পার্টি। ৩৮টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে উদারপন্থী ওয়াফদ্ পার্টি। নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটলে ইখওয়ানই আগামীতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে। মোবারকের আমলে ইখওয়ান নিষিদ্ধ দল হলেও পার্লামেন্টে বিভিন্ন নামে এবং নির্দলীয়ভাবে ইখওয়ানের আসনসংখ্যা ছিল ৮০। ডাক্তার, প্রকৌশলী ও আইনজীবীদের সংগঠনের বেশির ভাগই ছিল ইখওয়ানের দখলে। সমাজসেবার কারণে তারা ছিলেন জনগণের খুব কাছাকাছি। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মতো তাদের কোনো রাজনৈতিক দুর্নামও ছিল না। তার পরও তারা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নামে আলাদা একটি প্লাটফর্ম সৃষ্টি করেছেন। ঘোষণা করেছেন একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানকেও মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।


২.
আমার তিনবার তুরস্ক সফরের সুযোগ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম সফরের সময় নাজমুদ্দিন আরবাকান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সফরে রেফাহ পার্টির এক যুবক সংসদ সদস্য আমাকে বলেছিলেন, ‘ইসলামের জন্য তুরস্কে কাজ করা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চেয়ে হাজার গুণ কঠিন।’ স্মরণ করা যেতে পারে, একটি কবিতা লেখার কারণে রজব তৈয়ব এরদোগানকে জেলে যেতে হয়েছিল এবং তিনি নির্বাচন করার জন্য অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। সেই তুরস্ক আজ মুসলিম বিশ্বের অলিখিত নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার সম্মান অর্জন করেছে।


আতাতুর্কের ‘আধুনিক তুরস্কে’ সেকুলারিজমের শিকড়, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। এমনকি, সেকুলার ফ্রান্সের চেয়ে সেকুলার তুরস্ক অনেক বেশি সেকুলার। তুরস্কের সেনাবাহিনী নিজেদের সেকুলারিজমের রক্ষাকারী বলে মনে করে। তারা ১৯৬০, ১৯৮০ এবং সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯৯৮ সালে নাজমুদ্দিন আরবাকানকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখন রজব তৈয়ব এরদোগান ছিলেন তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের মেয়র। ক্ষমতাচ্যুতির পর নীতিগত প্রশ্নে এরদোগানের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্কদের সাথে বর্ষীয়ান নেতা আরবাকানের মতবিরোধ হয়। আরবাকান সরাসরি ইসলামের কথা বলতেন এবং পাশ্চাত্যের সমালোচনা করতেন। তার এসব বক্তব্যকে সেনাবাহিনী চিত্রিত করে সেকুলারিজমের বিরোধিতা রূপে। এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুল ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ নামে নতুন দল গঠন করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সেকুলারিজমকে এ বলে সংজ্ঞায়িত করেন যে, সেকুলারিজমের অধীনে ইসলামসহ সব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে। তারা গুলেন মুভমেন্ট ও অন্যান্য উদারপন্থীদের সমর্থন লাভ করেন। তা ছাড়া তারা অর্থনৈতিক উন্নতির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন। ফলে ২০০২ সালের নির্বাচনে নবগঠিত একে পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। পরপর দু’টি নির্বাচনে তারা বিজয়ী হন। একে পার্টির নেতৃত্বে তুরস্ক অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে তুরস্ককে একটি ছোট্ট গ্রুপ শাসন করে আসছিল। এ কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীতে ছিল সেনাবাহিনীর একটা অংশ, উচ্চতর আদালতের বিচারপতিদের একটি অংশ, সুশীলসমাজ ও সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ। তারাই সিদ্ধান্ত নিত কারা ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না। এরদোগানের আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী এদের চ্যালেঞ্জ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে এরদোগান সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং সত্যিকার অর্থে তুরস্কে গণতন্ত্র কায়েম করেছেন।


তুরস্কই প্রমাণ করল : নেতৃত্বের কাজ হচ্ছে, একটি পথ বন্ধ হলে আরো তিনটি পথ খোলা। দ্বীনের পথে কোনো কাজে সঙ্কীর্ণতা নেই (সূরা হজ-২২:৭৮), যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, আল্লাহ তাদের পথ দেখিয়ে দেন (সূরা আনকাবুত ৬৯:২৯)।
তুরস্কের একে পার্টি এবং মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের পথ ধরে ৬০ বছরেরও অধিক সময় ধরে কার্যরত ভারতের জামায়াতে ইসলামী গত বছরের এপ্রিল মাসে ‘ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তাদের স্লোগান হচ্ছে- ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা। পাশাপাশি জামায়াত তার আদর্শিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। ১৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি জামায়াতের দায়িত্বশীল হলেও তাতে পাঁচজন অমুসলমান রয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কেরালা রাজ্যের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ফাদার আব্রাহাম জোসেফ এবং কর্নাটকের সাবেক মন্ত্রী (অমুসলিম) ললিতা নায়ার। এরা দু’জনই সহসভাপতি। অনুরূপভাবে মালয়েশিয়ার ইসলামি আন্দোলন পিএএস (এক সময় যারা দু’টি রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন; এখন শুধু একটিতে, কিন্তু ফেডারেল পার্লামেন্টেও তাদের সদস্য রয়েছে) ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বাদ দিয়ে শুধু ন্যায়বিচারের কথাই বলছে। তুরস্ক, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর ও ভারতে ইসলামি আন্দোলনের এই কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনের আসল লক্ষ্য হচ্ছে দ্বীনের বাস্তবায়ন (সূরা সফ ৬১:৯)। কৌশলগত সঠিক সিদ্ধান্ত ছাড়া দ্বীনের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে চলা ছিল রাসূলগণের সবচেয়ে বড় সুন্নাত। সপ্তম হিজরির শুরুতে অর্থাৎ নবুওয়তের ২০ বছর পর মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয় (সূরা আল মায়িদা ৫:৯) এবং অষ্টম হিজরিতে অর্থাৎ নবুওয়তের ২১ বছর পর নিষিদ্ধ হয় সুদ (সূরা আল বাকারা ২:২৭৫)। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের তিন মাস পর অনুষ্ঠিত হজেও কাফেরদের জাহেলি প্রথা অনুসরণের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। (সূরা তওবা ৯:২৮)


৩.
রাসূল সা:-এর জীবনে সীমাহীন দুঃখকষ্ট ছিল, কিন্তু তেমন কোনো পরাজয় ছিল না। ‘রাসূলের জীবনে তোমাদের জন্য নিহিত আছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল আহযাব ৩৩:২১)। ওহুদের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে মুসলমানদের মনে সাহস সঞ্চয়ের জন্য পরদিনই তিনি আহত সাহাবিদের নিয়ে শত্রুসৈন্যের পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। এর আগে হিজরতের পর মক্কায় কাফেররা অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বলেছিল : ‘আপদ চলে গেছে; বাঁচা গেল।’ কিন্তু মদিনায় পৌঁছেই তিনি মক্কা থেকে সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন মক্কার ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য। প্রথম হিজরিতে তার গৃহীত এ কৌশলই ছিল দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পটভূমি। দ্বিতীয় হিজরিতে বদর যুদ্ধ না হলে তৃতীয় হিজরিতে ওহুদ, অতঃপর পঞ্চম হিজরিতে খন্দক, ষষ্ঠ হিজরিতে হুদাইবিয়া এবং অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় হতো না। হুদাইবিয়ার সন্ধি প্রমাণ করে রাসূল সা:-এর কর্মকৌশলের মোকাবেলায় মক্কার কাফেররা ছিল অসহায়। সন্দেহ নেই, রাসূলকে আল্লাহ পাক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করেছেন ওহির মাধ্যমে। (অবশ্য এটাও সত্য যে, সব ব্যাপারে ওহি নাজিল হতো না)। ওহির দরজা যখন বন্ধ, ইসলামি নেতৃত্বকেই সঠিক স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করলে আন্দোলন কোনো দিন সফলতার মুখ দেখবে না।


কুরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ ইতিহাসের আলোচনা করেছেন। জানা ইতিহাস (সূরা বাকারা ২:৪৭)। অজানা ইতিহাস (সূরা কাহাফ ১৮:৮৩-৮৬)। উদ্দেশ্য- মুসলমানেরা যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় (সূরা আল ইমরান ৩:১৩৭, আম্বিয়া ২১:১১)। সূরা আল ইমরানের ১৪০ নম্বর আয়াতের (এতকালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি) ওপর ভিত্তি করেই প্রখ্যাত দার্শনিক ইবনে খালদুন বলেছেন, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে’। আল্লাহ মানুষকে চিন্তাশীল হতে বলেছেন (সূরা আল ইমরান ৩:১৯০); বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন (সূরা আল রাদ ১৩:৪); নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন (সূরা হাশর ৫৯:২)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্বকে একটু দূরে দেখার চেষ্টা করতে হবে। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ইউরোপ শত চেষ্টা করেও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ১ ট্রিলিয়ন (দশ হাজার কোটি) ডলার খরচ করে সাড়ে চার হাজার মার্কিন সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে ইরাকে প্রায় ১০ বছর যুদ্ধ চালিয়ে ১৩ ট্রিলিয়ন (১৩০ হাজার কোটি) ডলারের ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র আজ অনেকটা দুর্বল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের আমলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, David Roth Kopf অতি সমপ্রতি তার প্রকাশিত বই Running the World-এ লিখেছেন, “We can’t write checks the way that we once could; we can’t deploy troops in the way that we once did.” [অর্থাৎ ‘অতীতের মতো ইচ্ছা করলেই আমরা যেমন আর্থিক অনুদান দিতে পারছি না, তেমনি আমরা সামরিক অভিযানও পরিচালনা করতে পারছি না]।


একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। চীন ও ভারতের উত্থান ঘটছে। নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। যে জাতিকে আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছেন গোটা মানবতার কল্যাণের উদ্দেশ্যে নেতৃত্বদানের জন্য (সূরা আল ইমরান ৩:১১০); মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য (সূরা ইব্রাহিম ১৪:১); সেই মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানের জন্য (সূরা আল ফুরকান ২৫:৭৪) দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বাস্তবধর্মী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে তুরস্কের একে পার্টি, মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, তিউনিসিয়ার আন্‌নাহাদা পার্টি এবং ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া থেকে অনেক অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। ছোট-বড় ইসলামি দলগুলোকে সব সঙ্কীর্ণতা ও আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বাড়ানোর জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআন নাজিল করেননি (সূরা তাহা ২০:১)।


আরব বসন্ত গোটা বিশ্বকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে এবং পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের অনেকটা অবাক করে দিয়ে ইসলামপন্থীরাই এর ফসল ঘরে তুলেছেন। সামপ্রতিক কালে আরব বিশ্বের নির্বাচনী ফলাফল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের গায়ে এই আরব বসন্তের বাতাস কখন লাগবে?


॥ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ॥লেখক : সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
www.facebook.com/barristerabdurrazzaq

সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি

আগের দিনে বহু স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেত হাতে নিয়ে ঘুরতেন। অমনোযোগী অথবা দুষ্টু ছেলেমেয়েদের হাতের নাগালে পেলে সপাং সপাং কয়েক ঘাই বসিয়ে দিতেন। একালের বহু গণতান্ত্রিক দেশের সরকারও সেকালের হেডমাস্টারদের মতো। যখন খুশি সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজকে বেত্রাঘাত করে তাদের আনন্দ। কারও গালাগাল হজম করা যায়, কিন্তু অপবাদ নয়। আমরা গত বুধবার জানতে পারলাম, সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজ দেশের অর্থনীতির সংকটের জন্য দায়ী। অর্থাৎ দেশে আদৌ যদি কোনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে থাকে, তা সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সৃষ্টি। অন্য কেউ নয়, সরকার তো নয়ই।
অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। কতটা বেহাল তা আমার মতো অর্থ-বিত্তে দুর্বল ও অর্থশাস্ত্রে অজ্ঞ মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এইটুকু বুঝি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতি ঘণ্টায় লাফিয়ে বাড়ছে। সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তা নিয়ন্ত্রণ করার সময় পাচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে ডলারের দাম ৮৫ টাকা। প্রতিদিনই যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী নির্বাচনের প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগের নেতারা সগর্বে বলতে পারবেন: ‘বাংলার মাটিতে ডলারের দাম আমরাই ১০০ টাকা করেছি।’ এই যে বঙ্গীয় মুদ্রার দাম কমতে কমতে এই পর্যায়ে পৌঁছাল, তার জন্য সংবাদপত্র কি ক্ষতিকর ভূমিকাটা পালন করছে, তা আমার জানা নেই। তারল্যসংকট অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, তার জন্য সংবাদমাধ্যম কীভাবে দায়ী? পুঁজিবাজারের অবস্থার কথা দেশের যেকোনো নিঃস্ব মানুষও জানে। সে ব্যাপারেও দোষারোপ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমকে, কিছুদিন আগেই। সংবাদপত্রের দোষ নেই তা আমরা বলব না। পুঁজিবাজারে গিয়ে ফতুর হয়ে বাংলার মাটিতে আত্মহত্যা করছেন যাঁরা, তাঁদের মর্মবেদনার কথা খবরের কাগজ লিখে থাকে। সেটা না করলে পুঁজিবাজার যদি চাঙা হয়, তাহলে আমরা করজোড়ে সম্পাদকদের অনুরোধ করব: পুঁজিবাজার নিয়ে লেখালেখি বাদ দিন। শেয়ারবাজারে যা খুশি হোক।
আমাদের প্রকাণ্ড পণ্ডিত ও বিদ্বানরা ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে বড় বড় পদে চাকরি করে প্রচুর ডলার কামাই করেন। তাঁদের উপার্জিত ডলার, পাউন্ড, ইউরো তাঁরা খুব কমই দেশে পাঠান। সেখানেই রাখেন। বাড়ি করেন। ব্যবসা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোহার আলমারিতে যত বৈদেশিক মুদ্রা আছে, এর বিরাট অংশ অদক্ষ গরিব শ্রমিকদের অমানুষিক কষ্টে অর্জিত। প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের উদাসীনতার কথা আর কেউ না জানলেও পেটের দায়ে যাঁরা বিদেশে গিয়ে জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাঁরা জানেন। বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নাকি ১১ মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে নয় মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে খবরের কাগজ ও নাগরিক সমাজের দোষটা কী?
দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে আসামি কবার মাত্র ১৬ ঘণ্টা আগে সংসদ থেকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ঘোষণা করেন: অর্থনীতিতে কালো ছায়া বিরাজ করছে। ছায়াটা গোলাপি নয়, সবুজ নয়, ফিরোজাও নয়—কালো। কালো রংটি শুভ নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন কালো হরফে লেখা হলেও অর্থনীতির মাথার ওপরে অশুভ কালো ছায়া বিস্তারে তার ভূমিকাটা কী, তা আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ কোমর বেঁধে দেশের কী সর্বনাশটা করছে, তা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলে আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধি হতো। আধুনিক গণতন্ত্র গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থহীন। আমাদের শাসকশ্রেণী মনে করছেন, এই দুটি উপদ্রববিশেষ। তাঁরা সেই গণমাধ্যম চান, যেখানে সরকারের প্রতিটি কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হবে। সরকারি দলের নেতা, কর্মী ও ক্যাডারদের সব কথা ও কাজকে অন্ধের মতো সমর্থন দেওয়া হবে। তাঁদের যাবতীয় অপকর্মকে করা হবে আড়াল। আমাদের নেতারা চান তেমন একটি পোষমানা নাগরিক সমাজ, যাঁর নেতারা সরকারের যেকোনো কাজ দেখে বলবেন: আহা বেশ বেশ!
দুনিয়ার সব মানুষের কথার গুরুত্ব না দিলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কথা হিসাবে না-ধরা সুবুদ্ধির কাজ নয়। গোটা বিশ্বের নাড়িনক্ষত্রের খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নখদর্পণে। বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা অতি ওয়াকিবহাল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিস্টার ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে গত বছর মিস্টার মরিয়ার্টির উত্তরাধিকারী হিসেবে ঢাকায় নিয়োগ দেন। সে দেশের রীতি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিলে সেই দেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা কতটা, তার প্রমাণ দিতে হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর মি. মজিনাকেও মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে শুনানি দিতে হয়েছে। সেই শুনানিতে তিনি বলেন, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি ও সিভিল সোসাইটির প্রতি সরকারের অস্পষ্ট আচরণই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা।’ (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)
ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে এবং ঢাকায় পৌঁছেও মি. মজিনা যে বিবৃত্তি দিয়েছেন, তাতে নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অসন্তুষ্ট মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। গত মাস দুয়েক তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন উপলক্ষে দেখা হয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কাজ করেছেন, তখনো তাঁকে চিনতাম। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির প্রতি, বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিক সমাজের নেতাদের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণকে যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন করে না। তবে আমেরিকা অনুমোদন করুক বা না করুক, নাগরিক সমাজের মতামতের মূল্য না দেওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যে দুর্বলতর হচ্ছে, তা যেকোনো মানুষই বোঝে। বোঝেন না শুধু সরকারের নেতা ও নীতিনির্ধারকেরা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নাগরিক সমাজও দুই বা আড়াই শিবিরে বিভক্ত। যেমন—নাগরিক সমাজ (আওয়ামী), নাগরিক সমাজ (বিএনপি-জামায়াত) এবং নাগরিক সমাজ (স্বতন্ত্র)। এক নম্বর ও দুই নম্বর নাগরিক সমাজ দুটি তাদের নিজ নিজ দলের একনিষ্ঠ সেবক ও ক্যাডারের ভূমিকা পালন করছে। তাঁরা তাঁদের দলেরই অংশ, যেমন প্রাণীর শরীরের লোম। মনে হয় আলাদা, আসলে এক। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ তাঁদের কাছে বড় নয়। যেমন, এক পক্ষের কাছে ফালানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, আরেক পক্ষের কাছে ওই লাশটি তাঁদের রাজনীতির জন্য দরকার।
ভারতে গণতন্ত্র একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে সেখানকার গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কারণে। পাকিস্তানে শাসকেরা সংবাদপত্রকে শুরু থেকেই টুঁটি চেপে ধরেছিলেন। শক্ত নাগরিক সমাজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাই সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারেনি। ৬৫ বছর যাবৎ সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসন পাকিস্তানি জনগণকে পদানত করে রেখেছে। কিন্তু ভারতে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রের ওপর কোনোরকম আঘাত মেনে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘায়িত হতে দেয়নি; বরং চরম মূল্য দিতে হয়েছে মিসেস গান্ধীকেই। বাংলাদেশের দশা ভারত ও পাকিস্তানের মাঝামাঝি।
জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। নাগরিক সমাজের যে গোত্রটি সুবিধাবাদী, তাদের পক্ষে জনগণের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। আমরা যাঁরা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করি, তাঁরা কেউ লেখক, কেউ শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কেউ সাংবাদিক, অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, কেউ এনজিও-কর্তা। নাগরিক নেতাদেরও চাওয়া-পাওয়ার আছে। বড় বড় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চাই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের আনুকূল্য চাই। এনজিও চালালে মোটা অঙ্কের ফান্ড চাই। উত্তরাতে না পাওয়া গেলে পূর্বাচল প্রভৃতি আবাসিক এলাকায় প্লট চাই। সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে খুব বড় বড় স্যুটকেস নিয়ে বিদেশ সফর করতে চাই। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের কোনো রকম সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকি। কারণ, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রভৃতির প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ পড়লে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানো সম্ভব হয় না। সুতরাং গা-বাঁচিয়ে সব রকম হিসাব ও যোগ-বিয়োগ করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া সবচেয়ে ভালো। তাতে সরকারও স্বস্তিতে থাকে, নাগরিক নেতারাও ভালো থাকেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তা-ই। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার মধ্যে যে নির্মল আনন্দ রয়েছে তা থেকে কে বঞ্চিত হতে চায়?
কিন্তু তৃতীয় যে নাগরিক সমাজটির কথা বলেছি, সেটিকে নিয়েই সমস্যা। তাঁরা সরকারের ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করেন, অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেন, প্রয়োজনে সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অর্থাৎ জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে তাঁদের তৎপরতায়। এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ওপরই সরকারের যত ক্ষোভ। তাঁদের সমালোচনা করা হয় অসৌজন্যমূলক ভাষায়। গণমাধ্যমেরও সেই অংশটির ওপরই সরকার চটা, যা সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন। জনগণ ও জাতীয় স্বার্থের কথা লিখলেই সরকারি নেতারা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মহোদয়রা অপ্রসন্ন হন। বলেন যে তাঁরা দেশের ক্ষতি করছেন।
জাতীয় অর্থনীতিতে কালো ছায়া নেমে এসেছে কি না জানি না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি জাতীয় জীবনে নেমে এসেছে এক গভীর কালো ছায়া। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা গেছে বদলে। স্বাধীনতার সংজ্ঞাও গেছে বদলে। সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাই আজ ভারতবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকরা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলেও কিছু বলা যাবে না। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা চাওয়া দোষ। হাত কচলানো কূটনীতির সমালোচনা করলে অপরাধ। সীমান্ত-হত্যার প্রতিবাদ করলে দোষ। টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ করা ভারতবিরোধিতা।
এনএসআইয়ের মতো জাতীয় স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সংস্থায় সরকারি ছাত্র সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের গণহারে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে লিখলে গণমাধ্যমের দোষ। মন্ত্রী-সাংসদের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি নিয়ে লিখলে দোষ। অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলা হচ্ছে, অথচ মাননীয়রা ১৫ মাসে এনেছেন ২৫৫টি গাড়ি, যার কোনো কোনোটির দাম পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা। দুর্নীতির কথা তো বলাই যাবে না। বললে প্রমাণ দিতে হবে। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে লোকজনের সামনে সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কেউ দুর্নীতি করেছে বলে শোনা যায় না। সাংসদ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চড়-থাপড় দিলে সে সম্পর্কে গণমাধ্যম লিখলে অপরাধ। রাষ্ট্রের সম্পত্তি অবলীলায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে লেখালেখি বা প্রতিবাদ করলে দোষ। বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচাল করতে পাল্টা কর্মসূচি পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। তা নিয়ে সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কিছু বললে তার নাম সরকারবিরোধিতা।
সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দূর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক। কিন্তু গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইলে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইলে তা সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের নিয়েই করতে হবে। ভিন্নমতের ও সমালোচনার মূল্য দিতেই হবে। সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে অসহিষ্ণু আচরণ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সিইসি শুধু ‘কিছু মন্ত্রণালয়’ চান কেন?

আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার সরকারি মনোভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট করা হবে। এ পর্যন্ত এটাই সরকারি অবস্থান। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের বিরোধী দল (গত ২০ বছরের) এমন কোনো ব্যবস্থায় ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন দেখতে চায় না, যা ক্ষমতাসীনদের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত করার প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারে।
সেদিক থেকে বিদায়বেলায় ‘কিছু মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে দিলে সুুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব’ বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদার উক্তিকে যে বিএনপি গুরুত্ব দেবে না তা হলফ করে বলা যায়। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই চলবে না, সঙ্গে বিরোধী দলের একটা বিজয় মিছিল লাগবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত মেয়াদের সরকার যখন সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করল, তখন বিরোধী দল সারা দেশে ‘সরকারের পতন’ ঘটানোর কৃতিত্ব দাবি করে বিজয় মিছিল করেছে। স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের ৫+৫+১ ফর্মুলাটি আওয়ামী লীগ প্রায় মেনে নিতে বসেছিল। কিন্তু ঠুনকো অজুহাতে তা ভেঙে যায়। এবারও তেমন ঘরানার একটি সংলাপ অনুষ্ঠানের উদ্যোগের আলামত দেখতে পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ খুশি হতে পারেন যে আওয়ামী লীগ সেদিন যা প্রত্যাখ্যান করেছিল, বিএনপি যদি আজ তা গ্রহণ করতে পারে।
বর্তমান ইসি দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার স্তরের নির্বাচন অনেকটাই অবাধ ও সুষ্ঠু করেছে। কিন্তু তার ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন করতে পারার দাবি যৌক্তিক নয় বলেই অনেকে মনে করেন। এখন সিইসি বলছেন, ‘কতিপয় শর্ত’ পূরণ করা হলে তা সম্ভব। সেই শর্তের একটি তিনি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করেছেন, সেটি হলো, ‘কিছু মন্ত্রণালয়কে’ ইসির অধীনস্থ করতে হবে। ২৭ জানুয়ারি ২০১২ সুরঞ্জিত-মঈনের বাহাস বা ‘তত্ত্বাবধায়কের’ নতুন ফর্মুলাবিষয়ক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। রেলমন্ত্রী কিছু মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে নেওয়ার ধারণাটি বাংলাভিশনের আলোচনায় উল্লেখ করেছিলেন ২৩ জানুয়ারি। এর সপ্তাহ না ঘুরতেই ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের কাছে তাঁরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, মানে নির্বাচনী আইন সংশোধনে একটি প্রস্তাব দিচ্ছেন। এতে নির্বাচনকালে ‘দলীয় বা যে ধরনের সরকারই’ থাকুক না কেন, তিনটি মন্ত্রণালয়—স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন এবং মন্ত্রিসভা বিভাগকে ‘অবশ্যই ইসির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘মাস্ট কনসাল্ট’ শব্দটি উল্লেখ করেন। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনকালে কী সরকার থাকবে, সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। তবে যে সরকারই থাকুক, নির্বাচনকালে সচিবালয়ের ফাইল চলে আসবে ইসিতে। এ বিষয়ে ঠিক কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তা আইন হলে তার আওতায় বিধি করে নেবে ইসি। সিইসির জবানিতে ২ ফেব্রুয়ারি কিছু মন্ত্রণালয় ‘অধীনে’ কথাটি এসেছে। আমরা জানি না, এই অবস্থাটি আইনগতভাবে কীভাবে নিশ্চিত করা হবে। তবে একটা সারকথা বুঝি এবং সেটা বোঝাই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি যে ‘কানসাল্টেশনের’ কথা বলেছেন, সেটা সভ্য সমাজে স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জটিলতা দেখা দেয়। প্রশ্ন হলো, আইনে থাকলেই দলীয় সরকার তা মানতে বাধ্য থাকবে কি না।
ভাতের চেয়ে ডাল উঁচু হতে পারে না। বিধির চেয়ে আইন বড়, আইনের চেয়ে সংবিধান বড়। আর এমন কোনো আইন বা বিধি আমরা কল্পনা করতে পারি না, যা সংবিধানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেই সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁর কর্তৃত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে।’ এখন যদি কেউ বেমক্কা বলেন যে আইন বা বিধি দিয়ে এই সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করবেন, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই। আর কনসাল্টেশন? সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে, এটা মানতে প্রধানমন্ত্রী বাধ্য নন। উপরন্তু আমাদের দাস্য মানসিকতাও স্মরণে রাখতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে না। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় অভ্যাস ছাড়তে পারে না।
তবে সিইসির এই কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বিএনপি বলছে, তা তো আগামী দুই মেয়াদের জন্য। তাহলে তারপর কী হবে? এর উত্তর হলো, সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। অন্যান্য সভ্য সমাজের মতো নির্বাহী ক্ষমতার কার্যকর অনুশীলন লিখিতভাবে দিতে হবে মন্ত্রিসভার কাছে। এটা যদি সম্ভব হতো, তাহলে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীকে রেখে এতটা মারাত্মক উত্তেজনা সৃষ্টি হতো না। এটা বললে অনেকে গোস্বা করেন। তাঁদের মনে মাইনাস টু ফর্মুলা উদিত হয়। অথচ তাঁরা কিছুতেই সংবিধানের এমন সৃষ্টিছাড়া বিধান শোধরানোর কথা মুখে আনবেন না।
সিইসি ও ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতের বক্তব্য অন্তসারশূন্য বলে প্রতীয়মান হয়। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে বিরোধী দলের স্বপ্নের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি শর্তহীনভাবে সমর্থন দেওয়া।
আমরা সব সময় মনে রাখব, দুই প্রধান দলই সব অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার পক্ষে সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু তাঁদের আশপাশে যাঁরা আছেন, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁরা যখন পালিশ করার রাজনীতি করেন, তখনই দুঃখ হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনেক ভালো কাজের প্রশংসা করি। কিছুই জুটত না, যদি না তারা সেনা সমর্থনে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনটি না করতে পারত। সুতরাং একই অঙ্গে তাদের অনেক রূপ থাকতে পারে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে কয়েকটি নির্বাচন করে তাদের বলা উচিত নয় যে সংবিধানের বিধিব্যবস্থা না বদলে দিয়ে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না দিয়ে ‘কতিপয় পরিবর্তন আনলেই’ দলীয় সরকারের অধীনে ধরেই নেওয়া যাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। অবশ্য কেউ যদি গণক ঠাকুর হতে চান এবং তাতে সফলও হন, তাতে আমরা অবাক হব না। কেউ বলতে পারেন, সত্তর সালের নির্বাচন কি সেনা সরকারের অধীনে হয়নি। তখন যদি সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে এখন হবে না কেন। যদি কেউ বলেন, আগামী দুই বছরে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা এতটাই কমে যাবে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেও তাতে বিরোধী দলই ফিরে আসবে। এমনকি বিএনপি তার সব অপশাসনের কলঙ্ক ও দেউলিয়াত্ব নিয়েও তিন- চতুর্থাংশ নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে! তাই তারা আওয়ামী লীগকে তাদের ১৯৯৬ সালের মডেলে নির্বাচন করতে দেবে না। জেনারেল এরশাদকে ‘গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা’ কিংবা তাঁকে খালি মাঠে গোল করতে দেওয়া হবে না।
ক্ষমতাসীন দল এখনো বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারে রেখেই তারা নির্বাচন করবে এবং সেখানে সব রকম উসকানি থাকবে, যাতে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনও বয়কট করে! এ ধরনের কল্পনাশ্রয়ী ঘটনা ধরে যুক্তিসংগত মন্তব্য করা চলে না। বেগম খালেদা জিয়া এমন কিছুই মেনে নেবেন না, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাতে ফ্রিস্টাইলে সরকার চালাতে তার অসুবিধা ঠেকে। তবে ক্ষমতার বৈতরণী পার হতে প্রয়োজনে তিনি অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার ওপরে ক্ষমতা কাটছাঁট করার একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেন। দুই নেত্রী এমন কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চান না, যাতে দুই দলের নেতৃত্ব দিতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয়। এই লেখকের স্থির বিশ্বাস দুই দল এমন কিছুই করবে না, যাতে তৃতীয় কোনো পক্ষ ঢুকে পড়ে। তৃতীয় পক্ষ নিয়ে তারা সাময়িক খেলতে পারে কিন্তু স্থায়ী হতে দেবে না।
তাই বলছি, সিইসি যখন কথাটা বলেছেনই, তখন তাঁর বা ইসির দায়িত্ব বিকল্প ব্যবস্থাটা বিস্তারিত খুলে বলা। শুক্রবার প্রথম আলোতে পড়লাম, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘অসম্ভব নয়। তবে কাজটা কঠিন। এটা করতে হলে শর্তহীনভাবে কিছু কাজ ইসির ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এসব শর্ত না মানলে সুষ্ঠু নির্বাচন কঠিন হবে।’ আমরা কিছু কাজের তালিকাটা চাই। তিনি এটা এমন এক প্রেক্ষাপটে বলেছেন, যখন ক্ষমতাসীন দল অনুসন্ধান কমিটিতে নতুন সিইসির জন্য তাঁর নাম পাঠিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পর সেনা মোতায়েন প্রশ্নে তিনি প্রথমে সংবিধান লঙ্ঘনের কথা বলে পরক্ষণেই অবস্থান পাল্টিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেনা চাওয়াটা তাঁদের হঠকারি সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি সরকারের মুখ রক্ষা করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে সার্চ কমিটির ধারণা ইসিই প্রথমে দিয়েছিল। তারা যেভাবে বলেছিল, সেটি বর্তমান কমিটির চেয়ে অনেক উন্নত প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু সেটা সরকারি দল নেয়নি। শুধু কাঠামোটা নিয়েছে এবং ফাঁকিটা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
একইভাবে আমরা হয়তো দেখব, কিছু মন্ত্রণালয় হয়তো ইসির ‘অধীনে’ এসেছে। কিন্তু তা কাজ করছে না। মূল কথা হলো, নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কী হবে। এই একটি প্রশ্নের জবাব পেলেই অন্য সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া সহজ হবে।
সরকারি দল চাইলে পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায় নির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও করা সম্ভব। তিন মাস আগে সংসদ ভেঙে যাবে। রাষ্ট্রপতি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। তার আগে নির্বাচন কমিশন একাধিক আসনে উপনির্বাচন করে ‘অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কের’ স্থলে নির্বাচিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ পথ সুগম করতে পারে। এবং তাতে সাপও মরবে, আবার লাঠিও ভাঙবে না। কিন্তু আমাদের রাজনীতি সম্ভবত সেদিকে যাবে না। যাবে একতরফা নির্বাচন কিংবা জ্বালাও-পোড়াওনির্ভর কথিত ‘গণ-অভ্যুত্থানের’ দিকে।
তাই বলি, ‘কিছু মন্ত্রণালয়ের দরকার কী। মন্ত্রিসভা বিভাগকে দরকার কী। শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সমঝোতার মাধ্যমে যে ইসি গঠিত হবে, তাকে দিন, কিংবা সমঝোতার তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর হাতে ইসির ক্ষমতা দিন, তাহলে ‘ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’!

 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com