নজরুল
রোজ
সকালে গলা সাধতে বসলে পুরোনো গানগুলো ফিরে আসে। এমন একটি: ‘হে চির সুদূর,
তোমার বিরহ আমারে করেছে কবি, এই মোর ভালো যাক চলে আর সবই’। চোখের পাতা আপনি
ভিজে আসে। ভেজা চোখে বইমেলায়, পুরোনো বন্ধু হাসি হাসি মুখে এবার প্রকাশিত
১০ খানা বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আগামী প্রকাশনীর স্টলে। ওকে দেখে আমার কত যে
পুরোনো কথা মনে হলো, কত দিনের হাসি-অশ্রুকণা মুহূর্তে চোখের সামনে হলো
উদ্ভাসিত। বললাম, তোর এতগুলো বই বেরিয়েছে, আর আমার মাত্র কখানি। কোনো
সাহিত্যিককে ধরতে পারব না, সময় এত কম। নজরুল সাড়ে তিন হাজার গান লেখা
সমাপ্ত করলে তাঁকে বলা হলো, গানগুলো তো ভক্তহূদয় থেকে টেনে এনেছে অশ্রু, আর
কত গান লিখবেন? নজরুল তখনই অনেক খানি অসুস্থ, ম্লান কণ্ঠে গাইলেন:
‘আমার আছে এই ক’খানি গান/ তা দিয়ে কি ভরবে তোমার প্রাণ/ অনেক বেশি তোমার দাবী/ শূণ্য হাতে তাই তো ভাবি/ কি দান দিয়ে ভাঙব তোমার গভীর অভিমান’।
হাসনাত হাই বলল, ‘তোকে দিলাম কামরুলের ওপর বই, তোর ভালো লাগবে।’ কানে কানে বলল, ‘তোকে সব বই উপহার দেব আরেক দিন।’ ড. আকিমুন রহমান, আইইউবিতে আমার কলিগ, ১৯২০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ঔপন্যাসিকদের ওপর করেছেন গবেষণা। পড়ে অনুপ্রেরণা পেলাম, কিছুটা দমেও। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ১৫ জন মনীষীর ১১০টি উপন্যাস নিয়ে সুদীর্ঘ থিসিসে উপস্থিত: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় [১২], বুদ্ধদেব বসু [১৬], অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত [৫], অন্নদাশঙ্কর রায় [৮], গোপাল হালদার [৬], জগদীশ গুপ্ত [৮], মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৮], তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় [১৪], বনফুল [৭], প্রেমেন্দ্র মিত্র [৫], নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় [৬], ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [৩], শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় [১], সতীনাথ ভাদুড়ী [২], সরোজ কুমার রায় চৌধুরী [১]।
তৈরি করেছি আরেকটি থিসিস, যেটি পড়া হবে সাহিত্যের এক বড় কনফারেন্সে। এখানে উপস্থিত ১৯৪৮ থেকে ২০১২-এর সাহিত্যিকেরা [৮১ জন], সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে তাহমিমা আনম থেকে শারমিনী আব্বাসী। আত্মজা, তাতে কী। তাহমিমা-শারমিনী ভালো লেখে, আমাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।
এদিকে নতুন কবিরা চিনে ফেলল শাল ও শ্মশ্রুধারীকে। বলল, মোড়ক উন্মোচন করে দিন। বললাম, এর যোগ্য নই আমি। অদূরে একটি টেলিভিশন ক্যামেরা ছেঁকে ধরেছে আনিসুজ্জামানকে, প্রায় শ দুয়েক লোক তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তাঁর মতো একজন ভালো মানুষ সংসারে বিরল, কাউকে না বলতে পারেন না। যেহেতু তাঁকে ভালোবাসি, গিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে পারতাম জনতার ব্যূহ থেকে, আবার এ-ও জানি, ওটিই তাঁর অসুখ এবং ওটাই তাঁর ওষুধ। মোড়ক উন্মোচন করে দিলাম আমিও।
কয়েকটি ছেলেমেয়ে বসে বাদাম খাচ্ছিল, সতৃষ্ণ নয়নে সেদিকে তাকালে ওরা আমাকে অফার করল। আর আমি কী করলাম, সেটি বলি। ওদের সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। বোঝালাম, তোমরা তো আমারই ছেলেমেয়ে। এমন কিছু সাহিত্য সৃষ্টি করো, যাতে সমস্ত পৃথিবী তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা তোমাদের দ্বারাই সম্ভব। কারণ, অতীতে তোমরাই অসম্ভবকে করেছ সম্ভব।
কোথায় যেন গান বাজছিল। একটু শুনতেই মনে হলো গানটি আমার অনেক চেনা, কিন্তু নানা মানুষের ভিড়ে কোলাহলে শিল্পীর সবটুকু দরদ পৌঁছানোর অবকাশ পায়নি। গানটি হলো: ‘আমি সুখী হলে দুঃখই যদি পাও, তবু সে সুখ আমি চাই না’। কেন যেন মনে হলো সমস্ত পৃথিবী চায় আমি হই দুঃখী। আমাকে কেউ সুখ দিতে চায় না। আমি দুঃখী হলেই তারা সুখী। হৈমন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত দুঃখ কীভাবে বহন করো একটি গানের কলিতে। ও যা বলল, তা বিস্ময়কর। বলল, ‘আব্বাসী দাদা, আমি চিরদিনের একা, কিন্তু এ গানগুলো আমার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। সবার দুঃখ আমি গানের মধ্যে বহন করি। তাই আমার গান সহজেই ওই হূদয়গুলোতে গিয়ে আঘাত হানে। এ আঘাত দুঃখকে সয়ে নেওয়ার আঘাত।’ আমার একখানি বই তার হাতে দিলাম—জীবন নদীর উজানে। হৈমন্তী বলল, গানের মতো গ্রন্থও মানুষকে দেয় বেদনা। সে বেদনাই আবার আনন্দ।
মেলা থেকে চলে আসার আগে বর্ধমান হাউসের তিন তলার একটি ঘরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম, ওইখানে দেখা হয়েছিল নজরুলের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার, সঙ্গে ছিলেন বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন। সে অনেক দিন আগের কথা। সেদিন আমি সেখানে ছিলাম না। অথচ আজ হঠাৎ মনে হলো, ওই কামরায় তিনজন কথা বলছেন। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছি। এই কামরাটি এখন ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ‘কে আর হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।
কিংবদন্তি সাহিত্যিক হতে হলে বলয় নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। স্তাবক দ্বারা তৈরি করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবদন্তির বলয় নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। বইমেলার বলয় একজনকে ঘিরেই। তিনিও নামদার, তাঁর নাম হুমায়ূন। অন্যপ্রকাশের স্টলে হুমায়ূনের অসংখ্য ভক্ত তাঁকে ভোলেনি। মাগরিবের নামাজের আজান ধ্বনিত হলো কোথাও। বললাম, হে প্রভু, তুমি কিংবদন্তি হুমায়ূনকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও, যত শিগগির সম্ভব। দেখে ভালো লাগল, তরুণ-তরুণীরা সাদরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে নতুন লেখকের ভালোবাসার সম্ভার পুড়িব একাকী। সকালে মনটা ছিল ভার ভার, আর এখন ফুরফুরে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
‘আমার আছে এই ক’খানি গান/ তা দিয়ে কি ভরবে তোমার প্রাণ/ অনেক বেশি তোমার দাবী/ শূণ্য হাতে তাই তো ভাবি/ কি দান দিয়ে ভাঙব তোমার গভীর অভিমান’।
হাসনাত হাই বলল, ‘তোকে দিলাম কামরুলের ওপর বই, তোর ভালো লাগবে।’ কানে কানে বলল, ‘তোকে সব বই উপহার দেব আরেক দিন।’ ড. আকিমুন রহমান, আইইউবিতে আমার কলিগ, ১৯২০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ঔপন্যাসিকদের ওপর করেছেন গবেষণা। পড়ে অনুপ্রেরণা পেলাম, কিছুটা দমেও। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ১৫ জন মনীষীর ১১০টি উপন্যাস নিয়ে সুদীর্ঘ থিসিসে উপস্থিত: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় [১২], বুদ্ধদেব বসু [১৬], অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত [৫], অন্নদাশঙ্কর রায় [৮], গোপাল হালদার [৬], জগদীশ গুপ্ত [৮], মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৮], তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় [১৪], বনফুল [৭], প্রেমেন্দ্র মিত্র [৫], নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় [৬], ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [৩], শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় [১], সতীনাথ ভাদুড়ী [২], সরোজ কুমার রায় চৌধুরী [১]।
তৈরি করেছি আরেকটি থিসিস, যেটি পড়া হবে সাহিত্যের এক বড় কনফারেন্সে। এখানে উপস্থিত ১৯৪৮ থেকে ২০১২-এর সাহিত্যিকেরা [৮১ জন], সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে তাহমিমা আনম থেকে শারমিনী আব্বাসী। আত্মজা, তাতে কী। তাহমিমা-শারমিনী ভালো লেখে, আমাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী।
এদিকে নতুন কবিরা চিনে ফেলল শাল ও শ্মশ্রুধারীকে। বলল, মোড়ক উন্মোচন করে দিন। বললাম, এর যোগ্য নই আমি। অদূরে একটি টেলিভিশন ক্যামেরা ছেঁকে ধরেছে আনিসুজ্জামানকে, প্রায় শ দুয়েক লোক তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তাঁর মতো একজন ভালো মানুষ সংসারে বিরল, কাউকে না বলতে পারেন না। যেহেতু তাঁকে ভালোবাসি, গিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে পারতাম জনতার ব্যূহ থেকে, আবার এ-ও জানি, ওটিই তাঁর অসুখ এবং ওটাই তাঁর ওষুধ। মোড়ক উন্মোচন করে দিলাম আমিও।
কয়েকটি ছেলেমেয়ে বসে বাদাম খাচ্ছিল, সতৃষ্ণ নয়নে সেদিকে তাকালে ওরা আমাকে অফার করল। আর আমি কী করলাম, সেটি বলি। ওদের সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। বোঝালাম, তোমরা তো আমারই ছেলেমেয়ে। এমন কিছু সাহিত্য সৃষ্টি করো, যাতে সমস্ত পৃথিবী তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা তোমাদের দ্বারাই সম্ভব। কারণ, অতীতে তোমরাই অসম্ভবকে করেছ সম্ভব।
কোথায় যেন গান বাজছিল। একটু শুনতেই মনে হলো গানটি আমার অনেক চেনা, কিন্তু নানা মানুষের ভিড়ে কোলাহলে শিল্পীর সবটুকু দরদ পৌঁছানোর অবকাশ পায়নি। গানটি হলো: ‘আমি সুখী হলে দুঃখই যদি পাও, তবু সে সুখ আমি চাই না’। কেন যেন মনে হলো সমস্ত পৃথিবী চায় আমি হই দুঃখী। আমাকে কেউ সুখ দিতে চায় না। আমি দুঃখী হলেই তারা সুখী। হৈমন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত দুঃখ কীভাবে বহন করো একটি গানের কলিতে। ও যা বলল, তা বিস্ময়কর। বলল, ‘আব্বাসী দাদা, আমি চিরদিনের একা, কিন্তু এ গানগুলো আমার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। সবার দুঃখ আমি গানের মধ্যে বহন করি। তাই আমার গান সহজেই ওই হূদয়গুলোতে গিয়ে আঘাত হানে। এ আঘাত দুঃখকে সয়ে নেওয়ার আঘাত।’ আমার একখানি বই তার হাতে দিলাম—জীবন নদীর উজানে। হৈমন্তী বলল, গানের মতো গ্রন্থও মানুষকে দেয় বেদনা। সে বেদনাই আবার আনন্দ।
মেলা থেকে চলে আসার আগে বর্ধমান হাউসের তিন তলার একটি ঘরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম, ওইখানে দেখা হয়েছিল নজরুলের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসার, সঙ্গে ছিলেন বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন। সে অনেক দিন আগের কথা। সেদিন আমি সেখানে ছিলাম না। অথচ আজ হঠাৎ মনে হলো, ওই কামরায় তিনজন কথা বলছেন। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছি। এই কামরাটি এখন ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’। ‘কে আর হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।
কিংবদন্তি সাহিত্যিক হতে হলে বলয় নিজেকেই সৃষ্টি করতে হয়। স্তাবক দ্বারা তৈরি করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবদন্তির বলয় নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। বইমেলার বলয় একজনকে ঘিরেই। তিনিও নামদার, তাঁর নাম হুমায়ূন। অন্যপ্রকাশের স্টলে হুমায়ূনের অসংখ্য ভক্ত তাঁকে ভোলেনি। মাগরিবের নামাজের আজান ধ্বনিত হলো কোথাও। বললাম, হে প্রভু, তুমি কিংবদন্তি হুমায়ূনকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও, যত শিগগির সম্ভব। দেখে ভালো লাগল, তরুণ-তরুণীরা সাদরে কিনে নিয়ে যাচ্ছে নতুন লেখকের ভালোবাসার সম্ভার পুড়িব একাকী। সকালে মনটা ছিল ভার ভার, আর এখন ফুরফুরে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন