বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আরব বসন্ত এবং দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলন

১.
২০১০ সালের শীতকালে তিউনিসিয়ার এক মফস্বল শহরে ২৬ বছরের এক ফেরিওয়ালা যুবক মুহাম্মদ বুয়াজিজি প্রশাসনের হয়রানির প্রতিবাদে যখন নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়, তখন কে জানত এ ঘটনার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের মাধ্যমে সূচনা হবে ‘আরব বসন্তের’। তিউনিসিয়ার পর মিসর। তাহরির স্কোয়ারের তিন সপ্তাহের আন্দোলনে ফেব্রুয়ারি মাসে বিদায় নেন তিন দশকের শক্তিশালী স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক। জুন মাসে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব পালিয়ে যান (বর্তমানে আছেন আমেরিকায়) এবং তার ৩৩ বছরের শাসন অবসানের জন্য একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। বাহরাইনের বিদ্রোহ দমনে ব্যবহূত হয়েছে সৌদি সেনাবাহিনী। মরক্কো ও জর্ডানে সংস্কার সাধিত হয়েছে। লিবিয়ার ৪২ বছরের শাসক গাদ্দাফির পতন ঘটেছে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন ঠেকাতে তার সরকার এ পর্যন- জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী ৫,৫০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। মুসলিম বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুবাতাস বইছে তা ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।


সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রায় ২০০টি বিকল্পের কথা ভেবেছিল। কিন্তু তাদের ওই বিকল্পের মধ্যে আরব বসন্ত ছিল না। অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু আমার ওই বন্ধু কোনো সাধারণ লোক নন। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্র সরকার মুসলিম বিশ্ব সমপর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছ থেকে মাঝে মধ্যে পরামর্শও নিয়ে থাকে। নীতিনির্ধারকদের সাথে তার যোগাযোগ আছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য, মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য, ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্য : সুয়েজখাল ও হরমুজ প্রণালী যদি কয়েক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো সারা বিশ্বের হূৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে; সেই অঞ্চল নিয়ে, পৃথিবীকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা চিন্তা না করে পারেন? ‘আরব বসন্ত’ পাশ্চাত্যের রাডারে ধরা না পড়ার কারণ হচ্ছে মানুষ সাধারণত কার্যকারণ এবং এর ফলাফল নিয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে; কিন্তু মানুষ জানে না সৃষ্টিকর্তা কার্যকারণ ও ফলাফল দুটোই নিয়ন্ত্রণ করেন।


আজ অবশ্য এ বিষয়টি সুনিশ্চিত, আরব বসন্তের সুদূরপ্রসারী ফলাফল শুধু আরব বিশ্বের রাজনীতিতেই পড়বে না। এর প্রভাব গোটা বিশ্ব-রাজনীতির ওপর পড়বে। তবে লক্ষণীয় যে, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এক কোটি চার লাখ জনগোষ্ঠীর উত্তর আফ্রিকার ছোট্ট দেশ তিউনিশিয়াই আরব বসন্তের নেতৃত্ব দেয়ার গৌরব অর্জন করল।
অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তিউনিসিয়ায়। ২১৭ আসনের গণপরিষদে রশিদ ঘানুশির ইসলামপন্থী দল আন্‌নাহদা ৮৯ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৯ আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সিপিআর (কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক), আর ২৬ আসন পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আরিধা। শেষোক্ত দু’টি দলই সেকুলার আদর্শে বিশ্বাসী। এরপর নভেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মরক্কোতে। ৩৯৫ আসনের পার্লামেন্টে ১০৭ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে মধ্যমপন্থী ইসলামি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি।


রশিদ ঘানুশির সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের। সর্বশেষ দেখা ইস্তাম্বুলে ২০০৯ সালের মে মাসে একটি ইসলামি সম্মেলনে। ইতঃপূর্বে ওই বছরের মার্চ মাসে লন্ডনে তার বাসায় গিয়েছিলাম। এককেন্দ্রিক বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে তার সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এর মাত্র কয়েক মাস আগে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। সূরা বনি ইসরাইলের ৭ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এতে করে ইসরাইলের চেহারাই বিকৃত হয়েছে।’ আলোচনার এক পর্যায়ে তার সব সময়ের হাসিমাখা মুখে আরো একটু হাসি নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান যখন তিউনিসিয়ার মতো হবে, তখন আপনিও আমার মতো আর নিজের দেশে থাকতে পারবেন না।’ কে জানত এ আলোচনার মাত্র ২২ মাসের মাথায়, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ বছরের অধিক সময়ের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ৭০ বছর বয়স্ক রশিদ ঘানুশি তিউনিসিয়া ফিরে যাবেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য। ভবিষ্যতের খবর একমাত্র আল্লাহর কাছেই থাকে (সূরা লোকমান ৩১:৩৪) এবং তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন (সূরা ইউসূফ ১২:১০০)। দেশে ফিরে ঘানুশি ঘোষণা দেন নিজে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। ক্ষমতায় গেলে তার দল ইসলামি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করবে না। তুরস্কের একে পার্টির আদলেই সরকার পরিচালনা করবে।


অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মিসরের নির্বাচনে ইখওয়ানের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) ৫০৮ আসনের পার্লামেন্টে সর্বমোট ২৩৫ আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১২৩টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সালাফিপন্থী নূর পার্টি। ৩৮টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে উদারপন্থী ওয়াফদ্ পার্টি। নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটলে ইখওয়ানই আগামীতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে। মোবারকের আমলে ইখওয়ান নিষিদ্ধ দল হলেও পার্লামেন্টে বিভিন্ন নামে এবং নির্দলীয়ভাবে ইখওয়ানের আসনসংখ্যা ছিল ৮০। ডাক্তার, প্রকৌশলী ও আইনজীবীদের সংগঠনের বেশির ভাগই ছিল ইখওয়ানের দখলে। সমাজসেবার কারণে তারা ছিলেন জনগণের খুব কাছাকাছি। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মতো তাদের কোনো রাজনৈতিক দুর্নামও ছিল না। তার পরও তারা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নামে আলাদা একটি প্লাটফর্ম সৃষ্টি করেছেন। ঘোষণা করেছেন একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানকেও মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।


২.
আমার তিনবার তুরস্ক সফরের সুযোগ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম সফরের সময় নাজমুদ্দিন আরবাকান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সফরে রেফাহ পার্টির এক যুবক সংসদ সদস্য আমাকে বলেছিলেন, ‘ইসলামের জন্য তুরস্কে কাজ করা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের চেয়ে হাজার গুণ কঠিন।’ স্মরণ করা যেতে পারে, একটি কবিতা লেখার কারণে রজব তৈয়ব এরদোগানকে জেলে যেতে হয়েছিল এবং তিনি নির্বাচন করার জন্য অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। সেই তুরস্ক আজ মুসলিম বিশ্বের অলিখিত নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার সম্মান অর্জন করেছে।


আতাতুর্কের ‘আধুনিক তুরস্কে’ সেকুলারিজমের শিকড়, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। এমনকি, সেকুলার ফ্রান্সের চেয়ে সেকুলার তুরস্ক অনেক বেশি সেকুলার। তুরস্কের সেনাবাহিনী নিজেদের সেকুলারিজমের রক্ষাকারী বলে মনে করে। তারা ১৯৬০, ১৯৮০ এবং সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯৯৮ সালে নাজমুদ্দিন আরবাকানকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখন রজব তৈয়ব এরদোগান ছিলেন তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলের মেয়র। ক্ষমতাচ্যুতির পর নীতিগত প্রশ্নে এরদোগানের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্কদের সাথে বর্ষীয়ান নেতা আরবাকানের মতবিরোধ হয়। আরবাকান সরাসরি ইসলামের কথা বলতেন এবং পাশ্চাত্যের সমালোচনা করতেন। তার এসব বক্তব্যকে সেনাবাহিনী চিত্রিত করে সেকুলারিজমের বিরোধিতা রূপে। এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুল ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ নামে নতুন দল গঠন করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সেকুলারিজমকে এ বলে সংজ্ঞায়িত করেন যে, সেকুলারিজমের অধীনে ইসলামসহ সব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে। তারা গুলেন মুভমেন্ট ও অন্যান্য উদারপন্থীদের সমর্থন লাভ করেন। তা ছাড়া তারা অর্থনৈতিক উন্নতির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন। ফলে ২০০২ সালের নির্বাচনে নবগঠিত একে পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। পরপর দু’টি নির্বাচনে তারা বিজয়ী হন। একে পার্টির নেতৃত্বে তুরস্ক অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে তুরস্ককে একটি ছোট্ট গ্রুপ শাসন করে আসছিল। এ কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীতে ছিল সেনাবাহিনীর একটা অংশ, উচ্চতর আদালতের বিচারপতিদের একটি অংশ, সুশীলসমাজ ও সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ। তারাই সিদ্ধান্ত নিত কারা ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না। এরদোগানের আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী এদের চ্যালেঞ্জ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে এরদোগান সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং সত্যিকার অর্থে তুরস্কে গণতন্ত্র কায়েম করেছেন।


তুরস্কই প্রমাণ করল : নেতৃত্বের কাজ হচ্ছে, একটি পথ বন্ধ হলে আরো তিনটি পথ খোলা। দ্বীনের পথে কোনো কাজে সঙ্কীর্ণতা নেই (সূরা হজ-২২:৭৮), যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, আল্লাহ তাদের পথ দেখিয়ে দেন (সূরা আনকাবুত ৬৯:২৯)।
তুরস্কের একে পার্টি এবং মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের পথ ধরে ৬০ বছরেরও অধিক সময় ধরে কার্যরত ভারতের জামায়াতে ইসলামী গত বছরের এপ্রিল মাসে ‘ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তাদের স্লোগান হচ্ছে- ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতা। পাশাপাশি জামায়াত তার আদর্শিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। ১৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি জামায়াতের দায়িত্বশীল হলেও তাতে পাঁচজন অমুসলমান রয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কেরালা রাজ্যের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ফাদার আব্রাহাম জোসেফ এবং কর্নাটকের সাবেক মন্ত্রী (অমুসলিম) ললিতা নায়ার। এরা দু’জনই সহসভাপতি। অনুরূপভাবে মালয়েশিয়ার ইসলামি আন্দোলন পিএএস (এক সময় যারা দু’টি রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন; এখন শুধু একটিতে, কিন্তু ফেডারেল পার্লামেন্টেও তাদের সদস্য রয়েছে) ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বাদ দিয়ে শুধু ন্যায়বিচারের কথাই বলছে। তুরস্ক, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর ও ভারতে ইসলামি আন্দোলনের এই কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনের আসল লক্ষ্য হচ্ছে দ্বীনের বাস্তবায়ন (সূরা সফ ৬১:৯)। কৌশলগত সঠিক সিদ্ধান্ত ছাড়া দ্বীনের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে চলা ছিল রাসূলগণের সবচেয়ে বড় সুন্নাত। সপ্তম হিজরির শুরুতে অর্থাৎ নবুওয়তের ২০ বছর পর মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয় (সূরা আল মায়িদা ৫:৯) এবং অষ্টম হিজরিতে অর্থাৎ নবুওয়তের ২১ বছর পর নিষিদ্ধ হয় সুদ (সূরা আল বাকারা ২:২৭৫)। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের তিন মাস পর অনুষ্ঠিত হজেও কাফেরদের জাহেলি প্রথা অনুসরণের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। (সূরা তওবা ৯:২৮)


৩.
রাসূল সা:-এর জীবনে সীমাহীন দুঃখকষ্ট ছিল, কিন্তু তেমন কোনো পরাজয় ছিল না। ‘রাসূলের জীবনে তোমাদের জন্য নিহিত আছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা আল আহযাব ৩৩:২১)। ওহুদের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে মুসলমানদের মনে সাহস সঞ্চয়ের জন্য পরদিনই তিনি আহত সাহাবিদের নিয়ে শত্রুসৈন্যের পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। এর আগে হিজরতের পর মক্কায় কাফেররা অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বলেছিল : ‘আপদ চলে গেছে; বাঁচা গেল।’ কিন্তু মদিনায় পৌঁছেই তিনি মক্কা থেকে সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন মক্কার ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য। প্রথম হিজরিতে তার গৃহীত এ কৌশলই ছিল দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পটভূমি। দ্বিতীয় হিজরিতে বদর যুদ্ধ না হলে তৃতীয় হিজরিতে ওহুদ, অতঃপর পঞ্চম হিজরিতে খন্দক, ষষ্ঠ হিজরিতে হুদাইবিয়া এবং অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় হতো না। হুদাইবিয়ার সন্ধি প্রমাণ করে রাসূল সা:-এর কর্মকৌশলের মোকাবেলায় মক্কার কাফেররা ছিল অসহায়। সন্দেহ নেই, রাসূলকে আল্লাহ পাক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করেছেন ওহির মাধ্যমে। (অবশ্য এটাও সত্য যে, সব ব্যাপারে ওহি নাজিল হতো না)। ওহির দরজা যখন বন্ধ, ইসলামি নেতৃত্বকেই সঠিক স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করলে আন্দোলন কোনো দিন সফলতার মুখ দেখবে না।


কুরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ ইতিহাসের আলোচনা করেছেন। জানা ইতিহাস (সূরা বাকারা ২:৪৭)। অজানা ইতিহাস (সূরা কাহাফ ১৮:৮৩-৮৬)। উদ্দেশ্য- মুসলমানেরা যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় (সূরা আল ইমরান ৩:১৩৭, আম্বিয়া ২১:১১)। সূরা আল ইমরানের ১৪০ নম্বর আয়াতের (এতকালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি) ওপর ভিত্তি করেই প্রখ্যাত দার্শনিক ইবনে খালদুন বলেছেন, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে’। আল্লাহ মানুষকে চিন্তাশীল হতে বলেছেন (সূরা আল ইমরান ৩:১৯০); বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন (সূরা আল রাদ ১৩:৪); নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন (সূরা হাশর ৫৯:২)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্বকে একটু দূরে দেখার চেষ্টা করতে হবে। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ইউরোপ শত চেষ্টা করেও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। ১ ট্রিলিয়ন (দশ হাজার কোটি) ডলার খরচ করে সাড়ে চার হাজার মার্কিন সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে ইরাকে প্রায় ১০ বছর যুদ্ধ চালিয়ে ১৩ ট্রিলিয়ন (১৩০ হাজার কোটি) ডলারের ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র আজ অনেকটা দুর্বল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের আমলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, David Roth Kopf অতি সমপ্রতি তার প্রকাশিত বই Running the World-এ লিখেছেন, “We can’t write checks the way that we once could; we can’t deploy troops in the way that we once did.” [অর্থাৎ ‘অতীতের মতো ইচ্ছা করলেই আমরা যেমন আর্থিক অনুদান দিতে পারছি না, তেমনি আমরা সামরিক অভিযানও পরিচালনা করতে পারছি না]।


একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। চীন ও ভারতের উত্থান ঘটছে। নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। যে জাতিকে আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়েছেন গোটা মানবতার কল্যাণের উদ্দেশ্যে নেতৃত্বদানের জন্য (সূরা আল ইমরান ৩:১১০); মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য (সূরা ইব্রাহিম ১৪:১); সেই মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানের জন্য (সূরা আল ফুরকান ২৫:৭৪) দেশে দেশে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বাস্তবধর্মী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে তুরস্কের একে পার্টি, মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, তিউনিসিয়ার আন্‌নাহাদা পার্টি এবং ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া থেকে অনেক অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। ছোট-বড় ইসলামি দলগুলোকে সব সঙ্কীর্ণতা ও আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বাড়ানোর জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআন নাজিল করেননি (সূরা তাহা ২০:১)।


আরব বসন্ত গোটা বিশ্বকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে এবং পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের অনেকটা অবাক করে দিয়ে ইসলামপন্থীরাই এর ফসল ঘরে তুলেছেন। সামপ্রতিক কালে আরব বিশ্বের নির্বাচনী ফলাফল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের গায়ে এই আরব বসন্তের বাতাস কখন লাগবে?


॥ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ॥লেখক : সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
www.facebook.com/barristerabdurrazzaq

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন