বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৩

চোখের পানি আটকাতে পারলামনা


old 

এসব কুলাঙ্গার সন্তানের জন্যই মনে হয় জাহান্নাম! বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটলো স্বজনহারাদের রোজার মাস
অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে- প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না। চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
অন্যরকম কষ্টকর ও ভাবনার একটি চিত্র- বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে কাটে স্বজনহারাদের রোজার মাস- চার বৃদ্ধার মৃত্যু, দাফনেও আসল না আপনরা- আমরাও কি পাশ্চাত্যের অমানবিক জীবনের দিকে?
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই ইহার চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভূবনে নাই।” কাজী কাদের নেওয়াজ
স্বার্থের জুয়াখেলায় মত্ত এই বিচিত্র পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে জীবনের জন্য ধ্রুব মৃত্যুর কথাটাই ভুলে গেছি। এমনি সামনে দিয়ে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে গেলেও মনে হয় না মরব। অথচ ঠিক আগামী কালই আমাদের সবাইকে নিম্ন মানের সেলাই বিহীন কাপড় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এর পরও মানুষ পিতা-মাতার খোঁজ-খবর রাখে না, মিথ্যা বলে কিংবা ঘুষ খায়।
সন্তান, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনহারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুরো রমজান মাস কাটলো চোখের জলে। কেউ কেউ ভুলতে পারেননি তাদের পুরানো স্মৃতি। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে রমজান মাসে এক সঙ্গে ঘরে বসে ইফতার করতেন। এতে কতই আনন্দ উপভোগ করতেন। কয়েকজন বৃদ্ধ বলেন, চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা মনে পড়ে যায়। কখন তাদের সঙ্গে একত্রে ইফতার করবেন। তখন চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের কাজ রেখে অথবা দ্রুত শেষ করে বাড়ি ফিরে যান। এমন কি স্ত্রী ও সন্তানরা পিতা কখন আসবে? ইফতারি প্রস্তুত করে বসে থাকতো। কোন কারণে ইফতারিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে ঐ দিন বাসায় আপনজনদের ইফতার ঠিকমত হতো না। কিন্তু বয়সের ভারে পরিবারের সবার প্রিয় ব্যক্তি এক সময় আয়-উপার্জন করতে অক্ষম হওয়ায় সবার বোঝা হয়ে যান। বৃদ্ধের প্রতি মানসিক ও শারীরিকসহ কতই নির্যাতন নেমে আসে। অবশেষে নাড়ি ছেড়া ধন ও কলিজার টুকরা সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা পিতা-মাতা সইতে পারেননি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে পাড়ি দেন অচেনা পথে। অবশেষে ঠাঁই নেন হূদয়বান ব্যক্তি ও শিল্পপতি খতীব আব্দুল জাহিদ মুকুলের প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর মনিপুরের বিশিয়া কুড়িবাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। মাদারীপুরের মতিজান (৭৪), নারায়ণগঞ্জের নাসিমা বেগম (৮০), বীর মুক্তিযোদ্ধা কুলসুম বিবি (৮১), ময়মনসিংহের ওসমান গনি (৭০), গফরগাঁও-এর আব্দুল খালেক (৭০), পিডব্লিউডির সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম (১০৫) এ সব কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বৃদ্ধাশ্রমে পহেলা রমজানে ইফতারের সময় তাদের সেই স্মৃতি মনে পড়ে। ঐ দিন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন দ্বারা বিতাড়িত হয়ে একাকী ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে। অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। প্রতিদিন রমজানে ইফতার ঘনিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক আগে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে তারা একে অপরের পুরনো স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন। অনেকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো এখনি সন্তান এসে আব্বা আম্মা বলে ডাকবে, আসেন ইফতারের সময় হয়েছে, এক সঙ্গে ইফতার করি। প্রতিদিন ঐ সময় এই স্মৃতি বুকে ধরে শুধু চোখের পানি ছাড়েন। আসলে কেউ আসবে না, চোখের জলেই হবে তাদের চির বিদায় বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
গত রমজানে চারজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা গেছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের দাফন বৃদ্ধাশ্রমে হয়েছে। অপরজনের লাশ স্বজনরা নিয়ে যায়। তাও খবর দেয়ার পর স্বজনরা এসেছেন। যেভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন, লালশটি নিয়ে আপজনরা এর দায় মুক্ত হতে চেয়েছে বলে কয়েক বৃদ্ধ জানান। এ যেন, কাটা ঘায়ে লবণ দেয়ার মত কাজ বলেও কোন কোন বৃদ্ধ অভিমত ব্যক্ত করেন।
বৃদ্ধাশ্রমে ১৯০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে রমজান মাস কাটিয়েছেন। বাকি ১৫০ জনের মধ্যে ৪৫ জন বৃদ্ধ ও ৫৫ জন বৃদ্ধা বৃদ্ধাশ্রমে রোজা রেখেছিলেন। ৫০ জন অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারেননি বলে বৃদ্ধাশ্রমের সুপার মোহাম্মদ শরীফ জানান।
তখনো শেষ বিকালের লালচে আলোর খেলা চলছে দিগন্তে। নতুন আরেকটি সন্ধ্যার আগমনী সংকেত বাজছে। কেন যেন পুরোনো মানুষদের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো। কিভাবেই যে টুপটাপ ঝড়ে গেছে চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো। যে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে রাস্তাটা কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রাস্তাও বোধ হয় পথ হারায় কখনো কখনো।
এই জায়গাটাতেই প্রায়ই দেখা হতো এক প্রবীণের সাথে। অশীতিপর এই মানুষটির সাথে আলাপও হতো বটে। এই ভদ্রলোকের হাঁটাটাকে সব সময়ই মনে হতো উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন। আসলে এ রকম অনেক নুয়েপড়া কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধরা এখানে ওখানে ঘরছাড়া বালকের মত ঘুরে বেড়ায়।
বয়স ৬০-৬৫ পেরুলেই খুব ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের শিতি-অশিতি সব শ্রেণীর মানুষেরা মনে করে পশ্চিমা দেশের তুলনায় আমরা আমাদের বাবা মাকে বেশি সম্মান করি, ভালবাসি। কিন্তু আমার কাছে তুলনা করার ব্যাপারটি খুব হাস্যস্পদ মনে হয়।
oldhomeআমরা আমাদের প্রবীণ বাবা মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতার কতটা মূল্য দেই? আমাদের দেশের বেশীর ভাগ ছেলে মেয়ে; বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেলে মনে করি ওরা বুড়ো হয়েছে। ওদের আবার কি মতামত। ওরা তো সেকেলে। অনেকেতো নিজের কারণেই হোক কিংবা পরিস্থিতির কারণেই হোক বাবা-মাকে বোঝা মনে করে থাকে। এসব বাবা-মা এমন এক পরিস্থিতির শিকার হন যে পরিবার যদি তাদের না দেখে তাহলে তাদের দেখ-ভালের কেউ থাকে না। কারণ আমাদের সমাজে সামান্য হলেও একজন বৃদ্ধের মূল্য শুধু পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
দেশপ্রেমের জোয়ারে এদেশের মানুষ শুধু ভাসতে শিখছে, মানুষের জীবনের দাম দিতে শিখেনি। একজন বৃদ্ধ লোকের প্রতি কোন রকমের সহানুভূতি আমরা দেখাই না। অথচ পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন স্তরের সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া যায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় ডাক্তারের টাকা, হাসপাতালের টাকা, এমনকি ওষুধের টাকাও আসে সরকারি তহবিল থেকে। তারপর পয়ষট্টির পর থেকে বাসের ভাড়া, প্লেনের ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া, কাপড় চোপড়ের দাম, জুতোর দাম সবকিছুতে ছাড় দেওয়া হয়। সময় সময় সরকার তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য ভ্রমনভাতাও দেয়। অথচ আমাদের দেশে এসবের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নেই একজন বৃদ্ধলোকের। সঙ্গত কারনেই বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব সন্তানের।
যেহেতু আমাদের ‘পারিবারিক বন্ধন’ হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। সেহেতু এই বন্ধন অটুট রাখার জন্যেই বৃদ্ধ বাবা-মা’র সকল প্রকার দায়িত্ব সন্তানের। পাশ্চাত্যে কথা ভেবে আজকাল অনেকেই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। তারা মনে করে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য নিয়ে চলাফেরা যায়না। অথচ এই বাবা-মার সন্তান হিসাবে যখন আমরা বড় হয়ে উঠি তখন কোনো বাবা মা কি তার সন্তানকে বোঝা মনে করে ? ছেলে যে বড় হবে মস্ত বড় চাকরি করবে। আমাদের সব কষ্ট পুষিয়ে দেবে। এই ভালবাসার কতটুকু মূল্য ছেলে মেয়েরা দেয় ? খুব বেশী অধিকার সচেতনা আমাদের মন মানসিকতাকে হীন করে দিয়েছে। সুখ অন্বেষণে জীবনটাকে আমরা বারবার ওলট পালট করে দেখি ঠিক, কিন্তু ক’জন সুখী হতে পারছি?
পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও বাবা মা’রা সস্তানকে যথেষ্ট যত্নে লালন পালন করে। সন্তানরাও তাদের বাবা মাকে অনেক বেশী ভালবাসে। তবে তাদের ক্ষেত্র ব্যতিক্রম এটুকুই যে, সেইসব বাবা মায়েরা নিজেদের জীবনকেই সব চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়। যার ফলে তাদের পারিবারিক কোন বন্ধন থাকে না।
কিন্তু আমাদের বাবা মারা তো সন্তানের জন্যেই সব কিছু করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন কোন বাবা মা কি আছে যারা সন্তানের জন্য নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দেননি। যে বাবা মা জীবনের ধন ভেবে সন্তান সংসার আঁকড়ে ধরে রাখে, সেই সন্তানই একদিন বড় হয়ে সেই বাবা মা যে জীবন ধারাতে অভ্যস্ত সে জীবন ধারাটা পালটে দিতে চায়। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য দিতে চায় না। তাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে বরং আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই।
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি একটি বয়সে আমরাও বুড়ো হব। যাদের আমরা বলি বুড়ো হয়েছে, বেশী কথা বললে বলি; ভিমরতিতে ধরেছে, ভেবে কি দেখি আমিও বুড়ো হবো, কানে শুনবো না হয়তো, স্মৃতিভ্রম হবে, হাত-পা কাঁপবে। এমনও তো হতে পারে রাতের আধাঁরে হঠাৎ বেড়িয়ে পড়তে পারি অতীতের খোঁজে।
এখন যারা বলি আমি সন্তানের বোঝা হবো না, তাদের দয়া ওপর নির্ভর করবো না, আমি তাদের এই ধারনার সাথে কখনোই একমত হতে পারি না। আমার সন্তান আমাকে দেখবে না তো কাকে দেখবে? আমার সব কিছুইতো সন্তানের জন্য, সন্তানতো আমার। আমার সাথেতো সন্তানের রক্তের বন্ধন।
আসলে এই যে বন্ধন এই বন্ধন রার দায়িত্ব বাবা মা আর সন্তানেরই। এই বন্ধন অটুট থাকলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়না।
আমি তো মনে করি আমাদের সবার সুস্থ মন মানসিকতাই আমাদের সকল প্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতা রার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সম। যে বাবা মা তিলে তিলে একটি সাজানো সংসার গড়ে তুলেছেন কি করে এই সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা যায়! কি করে সম্ভব এই সংসার গড়ার কারিগরদের উপো করা?
আমরা যদি মনে করতাম গুরুজন রাগ করেছেন, না হয় অন্যায়ই করেছে; আমরা কি পারিনা তাদের সবকিছু ভালবাসার গুনে মেনে নিতে। একটাইতো জীবন। বাবা-মা-সন্তান সবাই মিলে সেই জীবনের পুরোটাকে আনন্দে ভরপুর রাখতে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলে কি এমন ক্ষতি হবে?
তবে একথা অনস্বীকার্য সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বয়স্ক মানুষদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। যে মানুষ দেশের জন্যে কাজ করেছে, দেশের মানুষের জন্য সারাজীবন স্ব স্ব অবস্থান থেকে শ্রম দিয়েছেন। তাদেরকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে সকল সুবিধা দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
কেমন আছেন প্রবীণ নিবাসে নির্বাসিত দুখিনী মায়েরা
‘মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাইরে/ মায়ের মতো আপন কেহ নাই।
মা কথাটি ছোট্ট অতি/ কিন্তু জেন ভাই/ তাহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’
মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপস বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা… জীবনমুখী এ বাংলা গানের সুর অনেকের মোবাইল টিউন, ওয়েলকাম টিউনে শোনা যায়।
মায়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে বলেই হয়তো এসব গান তারা ডাউনলোড করছেন। শুধু গান লোড কেন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এদেশে এখনও বহু সন্তান রয়েছেন, যারা মায়ের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে পারেন। কিন্তু তার বিপরীতে মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমসহ সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত। প্রবীণ মায়েরা কেমন রয়েছেন—তা জানার জন্য বিভিন্ন আশ্রম ঘুরে জানা গেছে, মৃত্যু মুহূর্তে সংসারবিচ্ছিন্ন লোকচক্ষুর আড়ালে পরবাসে থাকা মায়েদের ভিড় বাড়ছে!
নিষ্প্রাণ, বোধশূন্য, গতানুগতিক জীবনযাত্রার বাইরে থাকা ওইসব মায়ের সঙ্গে কথা হয়। কেমন আছেন তারা জানতে চাইলে অনেকেরই চোখে পানি এসে যায়! কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, ভাষা খুঁজে পান না। আবার কেউ পাছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মানহানি হয় কিংবা ছেলের রক্তচক্ষু দেখতে হয়—সে ভয়েও গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি। কেউ আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন—‘চোখের সামনে না থাকুক, তবুও আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আশ্রমে এখন শুধু রাজধানী থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মায়েদের ঠাঁই হয়। কেমন আছেন? জানতে চাইলে জবাব আসে—কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালার মতো অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক! আর্থিক সচ্ছলতায় ভরা সংসারে প্রার্থিব সুখ পেয়ে এবং স্বজনদের কাছ থেকে ছিন্ন হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সংযোগের সেতুবন্ধন। অনিশ্চয়তা, উত্কণ্ঠা, শঙ্কায় নিজের ঘরও হয়ে উঠেছে পরবাস। চারপাশটা কেবলই ফাঁকি আর মমতার ফাঁদ! মন তখন খুঁজে বেড়ায় একটা আশ্বাস—আশ্রয়, নির্ভরতা আর শুশ্রূষা। সারাজীবন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সব সহায়-সম্পত্তি, ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে শেষ আশ্রয় হয় রাজধানীর আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমে—আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলেন নার্গিস সুফিয়া আক্তার। রংপুরের বাসিন্দা সুফিয়ার (৫৫) স্বামী বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন (নাম প্রকাশ করতে চাননি)। এক ছেলে লেখাপড়া শেষে বাবা-মাকে ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হলেন; তিন মেয়ে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রতাপশালী স্বামীর আত্মম্ভরিতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় দেখে মন বলে ওঠে বিকল্প পথ খুঁজি! পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল মানুষ দুটি রিক্ত জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নির্জনে একাকীত্ব বেছে নিলেন। বিস্তৃত ও নিজস্ব পরিধি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন সুফিয়া। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ছাদের নিচে। কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা ইট-পাথরের দেয়াল। কথাগুলো বলতে বলতে তার বুকের ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ওঠে। চোখের পানি আড়াল করতেই দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ সুফিয়া খাট থেকে নেমে সামনের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ান। শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘গভীর রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন ছেলেমেয়ের মুখ মনে পড়ে; কিন্তু মনে করতে চাই না! কারও কাছে তো হাত পাততে হয় না। তবুও জোর করেই মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনা উঁকি দেয়। সব ভুলতে চাই। কাউকে চাই না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের হোমিও (অবসরপ্রাপ্ত) ডাক্তার ছেলেমেয়ের রক্তচক্ষুর ভয়ে নাম বলতে চাননি অশীতিপর ওই বৃদ্ধা। সংসারে দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের অভ্যস্ততা তার সংসারে কাল হলো। তার দায়িত্বশীলতা ছেলেবউয়ের কাছে একরকম নাক গলানোর মতো! যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সংসার জীবনে টুকটাক অশান্তিতে তার জন্য প্রায় ৫০ বছর বয়সী ছেলে জায়গা করে দিল বৃদ্ধাশ্রমে। অভিমানী স্বরে বললেন, ‘ছেলে যেখানেই আমায় ফেলে রাখুক, আমার সামনে এলে সব কষ্ট ভুলে যাই। শুধু অপেক্ষায় থাকি ও কখন আমার সামনে আসবে!’ চোখ ছলছল করে ওঠে। নীরব থাকেন কিছুক্ষণ। কোনো সমস্যা নেই বললেও কথায় কথায় অনেক কিছুই বললেন। তার কষ্টটা বুকে চেপে রেখেছেন একরকম জোর করেই। এ প্রতিনিধি চলে আসতে গেলে হাত বাড়ান। তার চোখের ভাষা বলে দেয়—আরও একটু থাকো পাশে, সময় যেন কাটে না! স্বামীহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত পল্লবীর নার্গিস জাহানের মলিন পোশাক। ‘তবুও এই বেশে ভালো আছি। সংসারে একটা মেয়ে। কিছুদিন ছিলাম। তারপর মায়ের আর জায়গা হলো না মেয়ের কাছে’—বললেন তিনি। ভাগ্যপীড়িত করুণ নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গে মোকাবিলায় মানসিক দৃঢ়তা তার মধ্যে। আবুজর গিফারি কলেজের প্রাক্তন এক প্রভাষকের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিমানে সংযত আবেগ—‘এইতো এখানে রেখে খাওয়া-পরার খরচ দিচ্ছে। প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। ভালো না বাসলে কী আর এত খরচ ছেলেমেয়েরা দেয়? তারা দেশে নেই। ভালো হয়েছে, দেশে তো এখন স্বাভাবিক মৃত্যুরও গ্যারান্টি নেই। দু’বছর আগেও তাদের কথা মনে করে কষ্ট হতো। এখন হয় না। যে যেখানেই থাকুক, তারা যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ তবে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বৃদ্ধাশ্রমের মায়েরা জানান, এখানে এত লোক আসে। তারা প্রত্যেকই অনেক বয়সী এবং অসুস্থ। এখানে এটাস্টড বাথরুম না থাকায় কষ্ট হয়। রাতে কেউ কেউ অন্ধকারে পড়ে যান। একজন জানান, ক’দিন আগে অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তারা এটাস্টড বাথরুম এবং খাবারের মানটা আরও একটু ভালো করার আহ্বান জানান।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে থাকা বৃদ্ধ নারগিস জাহানের (৭০) মুখোমুখি হতেই তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অবুঝ অসহায় শিশু সন্তানটির ঊনিশ থেকে বিশ হলে যে মায়ের খানাদানা, ঘুম হারাম হয়ে যেত, সেই মাকে ৭ বছর ধরে দেখতে আসেনি তার হতভাগ্য সন্তান। শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ২৯ বছর। ছেলেমেয়েদের নাম পরিচয় অথবা তারা কে কি করছেন তা না জানিয়ে শুধু বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের দেখতে চান। ৪০৬ নম্বর রুমে নিবাস তার। ভীষণ অসুস্থ, বিছানায় শুইয়ে আছেন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। সন্তানরা যেমন দেখছেন না, তেমনি কোন স্বজন অথবা সহৃদয় সুজনের সাহায্যও মিলছে না।
নারগিস সুফিয়া (৬৬) আর এক মা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে কি যেন বলছিলেন। দু’পায়ে পানি জমে ফুলে রয়েছে। কোমরে দারুণ ব্যথা। স্বামী পুলিশের এসপি ফজলুল হক বসুনিয়া ১৯৯৮ সালে মারা যান। ৫ বছর ধরে প্রবীণ নিবাসে আছেন। একমাত্র ছেলে সাইফুল হক বসুনিয়া ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়ায় জীবনযাপন করে সম্প্রতি সস্ত্রীক দেশে ফিরেছেন। মাকে দু’বার দেখতে এসেছিলেন ফলমূল নিয়ে। নারগিস সুফিয়া জানান, ভয় পান চোখের পানি ফেলতে গিয়ে, শুনেছি চোখের পানি নাকি সন্তানদের অমঙ্গল ডেকে আনে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। তিনি চান তার সন্তানের মঙ্গল। ফলমূল নয়, শেষ বয়সে ছেলের সঙ্গে থাকতে চান তিনি।
মীরা চৌধুরী জানালার গ্রিল ধরে বাইরের সবুজ চত্বরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তার বয়স ৭৭ বছর, মা, কেমন আছেন বলতেই মুখ ঘুরিয়ে নির্বাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ব্যথিত কণ্ঠে জানালেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্বামী জোসেফ চৌধুরী প্রায় ৮ বছর আগে মারা গেছেন। জীবনে যা কিছু গড়েছেন সবই একমাত্র সন্তানকে দিয়েছেন। এখন তিনি একা। তার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই। থাকছেন এ প্রবীণ নিবাসে। ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী আমেরিকায় থাকেন। ছেলের মুখখানা দেখতে বড়ই ইচ্ছে করে তার। ভাতের লোকমা মুখের কাছে নিতেই সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গলা দিয়ে খাবার নামে না।
দিলরুবা মাসুদ নামে এক মা চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এ নিবাসেই মারা যান। ৭ বছর এ নিবাসে ছিলেন। ছেলে সৌদ আল মাসুদ আমেরিকা প্রবাসী। নিবাসে থাকা অবস্থায় ছেলে কোনদিনই মাকে দেখতে আসেননি। খোঁজও নেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিবাসে কর্মরত একজন বলেছেন, দিলরুবা মাসুদ অনেক দিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। ছেলেকে দেখার জন্য শুধুই কাঁদতেন। এভাবেই কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। নিবাসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জানান, সন্তান সব সময় সন্তান। তাই তাদের নাম বলছি না। তারা অসম্মানিত হলে বড়ই কষ্ট পাব। তারা ভালো থাকুক এটাই খোদার কাছে দোয়া করি। সাংবাদিকদের জন্য তাদের বকা শুনতে হয়। সন্তানরা রাগ করেন। সন্তানরা নিষেধ করে দিয়েছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। কোনভাবেই যেন তারা তাদের ছবি তুলতে না পারে তাও বলে দিয়েছে। মলিন মুখে তিনি বলেন, বেশ ভালোই আছি বাবা। সন্তানরা ভালো থাকুক, প্রত্যেক মা-ই তো তাই চান।
লেখক : এম ইউ আলম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
 http://studentbd24.com/?p=9645

শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থায় বিপন্ন মেধাবীরা


আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ১২-০৭-২০১৩

স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সব বেসামরিক সরকারি চাকরির নিয়োগস্তরে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের পর সরকার এসেছে আর গেছে। কিন্তু কোনো না কোনো পরিবর্তিত রূপে তা রয়েই গেছে। বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে এ কোটাগুলোর অনুপাত। বর্তমান সরকারের আমলে আরও একটি নির্মম নিয়ম চালু করা হয়েছে যে এ ধরনের প্রাধিকার কোটায় কোনো প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো খালি থেকে যাবে। আর তা থাকছেও। মেধাবী প্রার্থী প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেধাতালিকায় ওপরের দিকে স্থান পেয়েও চাকরি পাবে না। অধিক হারে চাকরি পাবে কম মেধাবীরা, প্রাধিকার কোটার বদৌলতে। আর তাদেরও খুঁজে না পাওয়া গেলে পদ খালি রাখা হবে। প্রশাসনব্যবস্থায় এটাকে একটা নির্দয় প্রহসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তবে ৩৪তম বিসিএসে কোটাব্যবস্থার প্রয়োগে আরেকটি নতুন মাত্রা দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি হচ্ছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় অতি নিম্নে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটাভুক্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। পক্ষান্তরে মেধাতালিকার অনেক ওপরে অবস্থানকারী প্রাধিকার কোটা-বহির্ভূত প্রার্থীরাও লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়নি। জানা গেল, সরকারি কর্মকমিশনের যুক্তি, প্রাধিকার কোটা পূরণ নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। তবে চতুর্মুখী ব্যাপক সমালোচনা ও পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে এ ফলাফল আপাতত বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। বোধোদয় দেরিতে হলেও না হওয়ার চেয়ে ভালো। ধন্যবাদ, সরকারি কর্মকমিশনকে। প্রকৃতপক্ষে নিয়োগ পর্যায়েই কোটা প্রয়োগ হওয়া স্বাভাবিক। আর বিসিএস পরীক্ষায় সে পর্যায়টি আসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকা তৈরির পর। সুতরাং আকস্মিকভাবে প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকে এটাকে প্রয়োগ করা হলে বঞ্চিত ব্যক্তিরা সংক্ষুব্ধ হবেই। তবে এই ক্ষোভের নামে বিশৃঙ্খলা কিংবা জনদুর্ভোগ কাম্য নয়।
এখন কোটাব্যবস্থার বিন্যাসটা একটু আলোচনা করা যাক। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য, জেলা, মহিলা ও উপজাতি কোটার অনুপাত যথাক্রমে ৩০, ১০, ১০ ও ৫। অর্থাৎ একুনে ৫৫। তাহলে মেধা কোটায় রইল শতকরা ৪৫ শতাংশ। চার দশকের অধিককাল এভাবে সরকারি চাকরিতে কোটার জোরে অধিক সংখ্যায় কম মেধাবীদের চাকরি পাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ আর কলেজশিক্ষকসহ সব ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ। প্রয়োগ করা হয়েছে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও। ফলে এসব পদে মেধাশূন্যতার অভিযোগ আসা অমূলক বলা যাবে না।
এবার দেখা যাক এ কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা। স্বীকার করতেই হবে, এর একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যেমন—ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে উচ্চতর পদে প্রথমে ভারতীয়দের জন্য, পরে মুসলমানদের জন্য আর পাকিস্তান সময়কালে কিছুটা পশ্চাৎপদ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত কোটা ছিল। তবে তা সীমিত ছিল উচ্চতর পদেই আর সীমিত আকারেই। তাঁরাও চাকরি পাওয়ার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করার পরেই তা পেতেন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সবার সমান সুযোগ লাভের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে একই অনুচ্ছেদের তিন উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান রাখার কথাও রয়েছে। ওপরে যে প্রাধিকার কোটাগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই কি এ অনগ্রসর নাগরিকদের পর্যায়ে পড়ে? তাহলে কোন যুক্তিতে অধিকাংশ প্রার্থীকে ‘সকলের সমান সুযোগ লাভের’ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? আর সুবিধাভোগী কারা, তাও কিন্তু দেখার বিষয়। এ বিষয়ে অনেক আলোচনা, সেমিনার, গোলটেবিল আর লেখালেখি হয়েছে। এগুলোর পক্ষে জোরালো কেন, দুর্বল কোনো যুক্তি নিয়ে কেউ অবস্থান নিতে পারে না। নেওয়া হয় আবেগের আশ্রয়। মনে হচ্ছে যুক্তি-তর্ক সবই অরণ্যে রোদন।
এবার প্রাধিকার কোটার সংখ্যাটি বিশ্লেষণ করার থাকে। মহিলা ও উপজাতিরা সমাজে এখনো অনগ্রসর। আরও কিছুদিন যেকোনো অনুপাতে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জেলা কোটাটির বিভাজন একটি জটিল ব্যবস্থা। আর্থসামাজিক বিবেচনায় অনুন্নত জেলাগুলোকে গোটা তিনেক গুচ্ছে বিভক্ত করে শুধু তাদের জন্যই প্রাধিকার থাকতে পারে। উন্নত জেলার জন্য তা থাকার কোনো যুক্তি নেই। সবশেষে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যের কোটাটি। প্রথমে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল। এখন তা তাঁদের পোষ্যদের জন্য রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের অবদান বৈষয়িকভাবে কোনো দিন শোধ করা যাবে না। তবে তাঁদের সবাইকে সমাজের অনগ্রসর অংশ বলে চিহ্নিত করা যায়? আর এ ৩০ শতাংশ প্রাধিকার কোটার সুফলভোগীর সংখ্যাও খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের নাম গেজেটভুক্ত করেছে, দিয়েছে প্রত্যয়নপত্র, তাঁদের পোষ্যরাই এর সুফলভোগী। এখন পর্যন্ত এর সংখ্যা দুই লাখের কিছু ওপরে। আবেদন বিবেচনাধীন আছে কয়েক হাজার। সব মিলিয়ে তিন লাখও হয় না। তাদের পোষ্য এর পাঁচ গুণই হতে পারে। তাহলে এ প্রাধিকার কোটাটি যৌক্তিক বলে ধরে নিলেও বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার অনুপাতে শুধু তাঁদের জন্য সব বেসামরিক চাকরির নিয়োগস্তরে ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত রাখাকে কোনো বিবেচনাতেই যৌক্তিক বলা যাবে না। আর এ প্রাধিকার কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ খালি রাখাকেও নির্মমই বলতে হবে। আর প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে এ প্রাধিকার কোটা বারবার খালিই থাকবে? এমনিতেই প্রাধিকার দেওয়া হলো অর্ধেকের বেশি পদে। আবার নিয়োগের নিয়মনীতি থেকে বিচ্যুতির ফাঁকফোকরও খোঁজা হচ্ছে।
পাশাপাশি আমরা দেখি, সামরিক বাহিনীতে সিপাহি পদে নিয়োগে জেলা কোটা অনুসরণ করা হয়। আর অফিসার নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাইয়ে শুধুই মেধা। আর এটাই যথার্থ। সুতরাং তারা কর্মক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতার ছাপ রাখবেই। গোটা জাতি চায় তারা তা রাখুক। পাশাপাশি বেসামরিক চাকরির সব প্রথম শ্রেণীর পদ ও বিচার বিভাগীয় কর্মে একই ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া যৌক্তিক। তবে উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা ও সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু প্রাধিকার কোটা রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা অনধিক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা সংগত হবে। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার জন্য ছেড়ে দিলে এক দশকের মধ্যে দেশের বেসামরিক চাকরিগুলোতে ইতিবাচক চাপ পড়তে থাকবে।
আমরা কথায় কথায় ভারতের নজির দেখাই। ভারত ব্রিটিশ থেকে প্রাপ্ত তার চাকরি কাঠামোগুলোকে বিবেচনাহীনভাবে বিপন্ন করেনি। অনুন্নত সমপ্রদায়ের জীবনযাত্রার মানকে তারা উন্নত করে চলছে। পাশাপাশি অতি সীমিত সংখ্যায় সর্বভারতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীর চাকরির ভিত্তি পদে নিয়োগে তাদের টেনে আনার কিছু ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু সেসব পদ এ ধরনের সর্বগ্রাসী কোটার বিপরীতে ছেড়ে দেয়নি। ১৯৭৯ সালে অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোকে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি ও সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনার জন্য একজন সাংসদ বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতের ৫৪ শতাংশ মানুষ অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত। মণ্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে প্রদত্ত তাদের প্রতিবেদনে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা আর একই অনুপাতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব করে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এ সুপারিশ বাস্তবায়নের একটি প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। দেশের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় সচেতন ভারতবাসী, এ রিপোর্টটির বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছিল। আর সে অবস্থান ছিল ভারতকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। এর সুফল আজ তারা ভোগ করছে।
অপ্রতুল বেতনাদি ও যুগবাহিত মর্যাদার হ্রাস বিবেচনায় এমনিতেই মেধাবীরা সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। তাঁদের প্রধানত আকর্ষণ করছে পাশ্চাত্যের সুযোগ-সুবিধা। এর পরেই রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিসহ বেসরকারি খাত। তাও পুরোনো ধারাবাহিকতায় কিছু মেধাবী তরুণ-তরুণী চলে আসে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। কিন্তু এখানেও তাদের জন্য তৈরি হয়ে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। শুধু নিয়োগ পর্যায়ে নয়, পদোন্নতি পর্যায়ও তুলনামূলক কম মেধাবীরা (সরকারি কর্মকমিশনের সম্মিলিত মেধাতালিকা বিবেচনায়) রাজনৈতিক আনুকূল্যে টপকে যায় অধিক মেধাবীদের। এমন চিত্র দেখা গেছে সামপ্রতিক কালে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিকালে। সম্মিলিত মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারীদের চেয়ে নিচের দিকে অবস্থানকারীরা প্রাধান্য পেয়েছেন সে পদোন্নতি তালিকায়।
নেতাদের অনেকেই সময়ে সময়ে গণমাধ্যমে সংবিধানের চেতনা সম্পর্কে বলে থাকেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার শুধু চেতনা নয়, সরাসরি আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহের একটি। জেনেশুনে এটাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে দীর্ঘকাল। শুধু বর্তমান সরকার নয়, এর আগের সরকারগুলোও বিষয়টিতে হাত দেয়নি। বর্তমান সরকার দিনবদলের সনদে অঙ্গীকার করেছিল দেশবাসীকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম একটি প্রশাসন উপহার দেওয়ার। সেই প্রশাসন হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ, গতিশীল, আধুনিক ও যুগোপযোগী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সেই অঙ্গীকারের তেমন কোনো প্রতিফলন জনপ্রশাসনে দেখা যায়নি, বরং বিপরীতটাই দৃশ্যমান হচ্ছে। নিয়োগ পর্যায়ে মেধাবীদের দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাধিকার কোটার নিয়মনীতিকে আরও কঠোর ও সম্প্রসারণ করে কম মেধাবীদের টেনে আনতে সচেষ্ট প্রয়াসই লক্ষণীয় হচ্ছে। তাতে তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশাসন গড়া যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

মেধাবীদের সামনে অন্ধকার

কোটায় খেয়ে ফেলছে চাকরি



শফিকুল ইসলাম

চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন : নয়া দিগন্ত
সরকারি চাকরি েেত্র কোটাব্যবস্থা তুলে দেয়া অথবা তার সংস্কার করে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে আসার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। প্রায় সব কয়টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছেন। পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ অভিযানে রক্তাক্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, সারা দেশেই বিুব্ধ শিার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। এ আন্দোলন দল ও মতের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেছে। দল ও মতের পরিচয় ঠিকানাবিহীন খেটে খাওয়া প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরাই কোটাব্যবস্থার নির্মম শিকার। নিছক মেধার জোরে উচ্চশিার আঙিনা পেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীায় অবতীর্ণ হতে গিয়েই এসব তরুণ হোঁচট খাচ্ছেন। চাকরি নামের সোনার হরিণ তাদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। মেধা আর কাজে আসছে না। ফলে মেধাবীদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। কোটায় কোটায় ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে সব পদ। বিুব্ধ, হতাশ, ক্রুদ্ধ তরুণেরা তাই রাজপথে নেমে এসেছেন। কী কারণে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও কোটার বি¯তৃতি বাড়ছে; সে এক অজানা রহস্য। সাদা চোখে দেখলে মনে হয় এসবই রাজনীতির কূটকৌশলের ফল। প্রশ্ন উঠেছে, মেধাবীরা যাবেন কোথায়? শ্রম ঘামে অধ্যবসায়ে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার কাজে না লাগলে তারা কী করবেন? যোগ্যরা স্থান না পেলে অযোগ্যরাই দখল করবেন সারা দেশ, যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে সরকারি চাকরি েেত্র ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ৫৬ শতাংশ কোটার সুবিধাভোগী। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধার বাইরে। প্রশাসনে ভারসাম্য রার জন্য কোটার প্রচলন করা হলেও এ ব্যবস্থা এখন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই ুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিতি তরুণেরা। আবার কোটার সুবিধাভোগ নিয়ে দুর্নীতিরও শেষ নেই। দেদার অপব্যবহার হচ্ছে এ ব্যবস্থার। এখানে ভারসাম্য রার কোনো বন্দোবস্ত নেই। দেশে শিল্পের বিকাশ নেই। কর্মমুখী শিাব্যবস্থা সঙ্কুচিত। উচ্চশিিিত তরুণদের নিছক শ্রমিক হয়ে প্রবাসে পাড়ি দেয়ার ঘটনা ভূরি ভূরি। এসএসসি কিংবা এইচএসসি উত্তীর্ণ পদের বিপরীতে মাস্টার্স উত্তীর্ণদের দরখাস্ত দেয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সরকারি চাকরির েেত্র একটি পদের বিপরীতে প্রার্থী থাকেন কয়েক হাজার। প্রতিটি স্তরেই মেধা ও যোগ্যতার স্বার রাখতে হয়। প্রাথমিক বাছাইয়েই যদি কোটার আগ্রাসন শুরু হয় তাহলে সেসব প্রতিযোগীর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। শিার্থীরা এটাকে রাষ্ট্রের নির্মম আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনে এ বিষয়গুলো নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি উচ্চ পদে চাকরিতে নিয়োগকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্যদের বাছাই করে নিয়োগ দেয়া। কিন্তু গত কয়েক বছরে পিএসসির কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিরপেতা বজায় রাখতে পারেনি বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি পরীার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় কর্তৃপ তা বাতিলও করে দেয়। এসব ঘটনা মেধাবী শিার্থীদের উদ্যম নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়েছে। এর ওপর কোটার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। বর্তমানে বিসিএস পরীার মাধ্যমে উত্তীর্ণরা নিয়োগের জন্য যেসব কোটার মুখে পড়েন সেগুলো হচ্ছেÑ মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা ৩০ ভাগ, মহিলা ১০ ভাগ, জেলা ১০ ভাগ, উপজাতি ৫ ভাগ ও প্রতিবন্ধী ১ ভাগ। জেলা কোটার মধ্যে আবার সব জায়গা একরকম অগ্রসর না হওয়ায় সুষম বণ্টন নেই। বেশ কয়েকটি জেলা আছে যেখানকার অধিবাসীরা উত্তীর্ণ হয়েও ছিটকে পড়ছেন। জেলার কোনো কোটা না থাকায় মেধাবী হয়েও তারা চাকরি পাচ্ছেন না। আগে সনাতন ক্যাডার সার্ভিসে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদে কোটাপদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি শিকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, প্রাণিসম্পদ সার্ভিসেও কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে কঠোরভাবে। অধস্তন বিচার বিভাগ বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে কিছুদিন আগেও মেধাবীরাই চাকরি পেতেন। সম্প্রতি এখানেও কোটাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিচার বিভাগেও এখন কোটার ভিত্তিতে চাকরি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩১তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৭৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়। অথচ সম্মিলিত মেধা তালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেক প্রতিযোগীই চাকরি পাননি। কারণ মেধা থাকা সত্ত্বেও কোনো কোটার মধ্যে না পড়ায় তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। ২৯তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে ৪১২ জনের মধ্যে ২১১ জন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। আর মাত্র ২০১ জন নিয়োগ পেয়েছেন মেধার ভিত্তিতে। ২৮তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডার সার্ভিসে ৬৫৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এর মধ্যে ৩৪৭ জনই বিভিন্ন কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি রাখা হয়। ৩২তম স্পেশাল বিসিএসে শুধু মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও উপজাতি কোটাধারীরাই চাকরি পেয়েছেন। অবাক করা ঘটনা ঘটেছে ৩৪তম বিসিএসে। পিএসসির এ পরীায় প্রিলিমিনারিতেই কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ কোটার বাইরে কোনো শিার্থী প্রাথমিক যোগ্যতা যাচাইয়েরও সুযোগ পাননি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই শিাবিদ। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরই এসব নিয়োগ দেয়া হতো। কখনো কখনো পদস্থ আমলা এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ক্যাডারের প্রার্থী বাছাইয়ে ওইসব ক্যাডার সার্ভিসে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ বোর্ডে সমন্বয় করা হয়েছিল। কিন্তু এবারই প্রথম পুলিশ সার্ভিস থেকে এনে একজনকে পিএসসির সর্বোচ্চ পদে বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশনে বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ নিযুক্ত ১৪ জনের ১৩ জনই সরকারি দলের কট্টর সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ অতীতে কখনো হয়নি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীার পর কোটাব্যবস্থার সমন্বয় করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হতো। কিন্তু এবার যে বিষয়টি করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে এখন যে আন্দোলন শুরু হচ্ছেÑ এ বিষয়ে ড. ফায়েজ বলেন, চাকরিতে কোটাব্যবস্থা থাকবে কি না এ ব্যাপারে সরকার এবং পিএসসিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসির এক সাবেক চেয়ারম্যান নয়া দিগন্তকে বলেন, পিএসসি এবার যেভাবে ফল প্রকাশ করেছে তা ঠিক হয়নি। প্রিলিমিনারি পরীায় কোটাব্যবস্থার প্রয়োগ একেবারেই অযৌক্তিক। তিনি বলেন, পিএসসি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এখন আর চাকরি পাওয়ার মতো নেই। অনেকের ছেলেমেয়েও বয়স্ক হয়ে গেছেন। তাদের নাতি-নাতনীদের কোটায় চাকরি দেয়া অযৌক্তিক। সুতরাং এখন এ কোটা সীমিত করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত। তবে রাজনৈতিক কারণে কোটাব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা প্রশাসনের সবচেয়ে ভালো ক্যাডারগুলোতে কোটায় চাকরি পান। ফলে মেধাবীরা বঞ্চিত হন। যদি এক হাজার পরীার্থী হয় এর মধ্যে ৩০০ জন হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। কিন্তু সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই শ’ কোটায় পাওয়া যায়। আর বাকি পদগুলো শূন্য থেকে যায়। ফলে প্রকৃত মেধাবীরা আসেন না। তবে ওই সরকারের আমলে তিনি কোটাব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন বলে জানান সাবেক ওই চেয়ারম্যান। অন্য দিকে কোটার কারণে পড়ে থাকা শূন্য পদগুলো মেধাবীদের থেকে ‘বিশেষ মেধা‘ দিয়ে পূরণ করার কথা বলেন তিনি।

সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ ধর্ম-অধর্মের নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ


মাসুদা ভাট্টি
শাহবাগের আন্দোলনকে এখন বহুধাবিভক্ত করে এর ভেতর থেকে ‘ফায়দা লুটেরাশ্রেণী’ এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিশেষ করে শাহবাগের আন্দোলনে ধর্মকে ব্যবহারের যে নগ্নতা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এদেশে বহু পুরনো ও বহু ব্যবহৃত একটি কৌশল। মজার ব্যাপার হলো, দেশে দেশে এই কৌশল পুরনো হলেও বার বার ব্যবহৃত হয় এবং জনগণকে উস্কানি দিতে এর চেয়ে চরম কোন পথ আর নেই বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তান আমলে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে কলকাতার ৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় হাত রাঙানো ও অভিজ্ঞ মিনা পেশোয়ারীকে ঢাকায় ভাড়া করে এনেছিল পাকিস্তানী শাসককুল এবং তারই হাতে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আজকে হয়ত পাকিস্তানী শাসককুল নেই, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা রয়েছে; রয়েছে তাদের বেতনভুক কিছু রাজনৈতিক দলও, আজকে যাদের মিনা পেশোয়ারীকে ভাড়া করার নেই। কারণ এ দেশের ভেতরই রয়ে গেছে মিনা পেশোয়ারীর মতো ভয়াবহ দজ্জালের বংশধর, যারা পত্রিকার পাতায় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম ও অ-ধর্মের আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। আমরা এ রকম ঘটনা দেখেছি ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে, যখন ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ নামে টিভি-অনুষ্ঠান নির্মাণ করে এক হাতে কোরান শরীফ আরেক হাতে গীতা নিয়ে মানুষের সামনে দেখানো হয়েছে কারা ক্ষমতায় গেলে কোন্্ ধর্মগ্রন্থ প্রাধান্য লাভ করবে এবং মানুষকে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলু ধ্বনি শোনা যাবে। আজও তারাই নেমেছে শাহবাগ থেকে ইসলাম-আক্রান্ত হচ্ছে বলে ন্যক্কারজনক প্রচারণায়। বিশেষ করে গত শুক্রবার থেকে এই প্রচারণার ফলেই শাহবাগ আন্দোলন এখন বলতে গেলে বেশ বড় ধরনের হুমকির মুখোমুখি। গত সপ্তাহে আমার কলামের পাঠকদের আমি এই ভয়ের কথাটিই বলতে চেয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা এত তাড়াতাড়িই ফলে যাচ্ছে দেখে আমি রীতিমতো শঙ্কা বোধ করছি।
শাহবাগ কোন দীর্ঘ প্রস্তুতিময় আন্দোলন নয়, বরং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি বহুত্ববাদী আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই এ রকম আন্দোলনে ‘নানা মুনি নানা মত’ থাকে এবং এখানেও রয়েছে। কিন্তু একটি জায়গায় এই আন্দোলন তীব্র ও সংগঠিত আর তা হলো, দেশে যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের মতো ইসলাম-ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিষিদ্ধ করা। এই দুই শক্তিশালী দাবি এখন সময়ের, এবং শাহবাগ তা প্রমাণ করেছে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এই দাবি জনগণের এবং জনগণ এই শাহবাগে এসে রাজনৈতিক অবস্থান বা বিশ্বাস থেকে নয়, বরং আত্মার দাবি হিসেবে এই দু’টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং এই দাবি কেবল সরকারের কাছে নয়, বরং দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির কাছেই। জনগণ প্রতিনিয়ত বলছে যে, আপনি যে দলের রাজনীতিই করুন না কেন, আপনি যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারবেন না; আপনাকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবির সঙ্গে একমত হতে হবে। অপরদিকে তারা সরকারকে বলছে যে, এই দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার কিন্তু শাহবাগের এই প্রাণের দাবিটি ঠিকই বুঝেছে এবং সে অনুযায়ী কাজও করছে বলে মনে হয়। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে যে, আসলে সরকার কতটা আন্তরিক? আমরা জানি যে, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও আমরা বহু সময় পার করেছি কিছুই না করে; এমনকি বিচার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়েও আমরা অযতœ-অবহেলা লক্ষ্য করেছি। শুধুমাত্র বিচার প্রক্রিয়া শুরু করাই মুখ্য নয়, এই বিচার থেকে যেন যুদ্ধাপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পায় তাও নিশ্চিত করাটা সরকারেরই দায়িত্ব। কারণ এই সরকার তো কেবল একটি ‘সরকার’ নয়, বরং এই সরকার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার; এই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। মানুষ তাই এই সরকারের কাছে অনেক বেশি কিছুই আশা করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো, শেখ হাসিনা সরকারের অন্য অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিও মানুষ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে রাজি, যদি এই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইস্যুর চিরস্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হয়। যে কারণে মানুষ শাহবাগ আন্দোলনকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, অহিংস এবং দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ধরে নিয়ে এতে অকাতরে অংশগ্রহণ করেছে। এখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই রয়েছে এবং গত সপ্তাহেই বলেছি যে, এই আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে; এটি কেবলমাত্র ব্লগারদের আন্দোলন নয়। গত সপ্তাহের লেখায় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামটি উল্লেখ করতে ভুলে যাওয়ায় আজকের লেখায় আমি সে ভুল স্বীকার করছি এবং একথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই যে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এই আন্দোলন সর্বজনীন রূপ লাভ করেছিল এবং এই শাহাবাগেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিন্তু কথা হলো, আমরা আন্দোলন করছি ঠিকই; তবে আমাদের শত্রুপক্ষের ক্ষমতাকেও আমরা কোনভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না এবং দেখা উচিতও হবে না। কারণ আমাদের শত্রুরা আসলে কেবলমাত্র মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরুদ্ধবাদী, তাই-ই নয়; তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেরও শত্রু। সুতরাং তারা তাদের অবস্থানকে নিশ্চিত রাখার জন্য প্রয়োজনে যে কোন পথ গ্রহণ করবে; এখানে রগকাটা, গলাকাটা কিংবা বোমা হামলা তুচ্ছ ঘটনা মাত্রÑ এসব সবই এতদিন তারা ঘটিয়েছে অনায়াসে। এখন তারা আরও শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ়। সুতরাং তাদের নতুন পথ ও কৌশল ধরতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না, হচ্ছেও না। মজার বিষয়টি হচ্ছে, তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করেছে ঠিকই, কিন্তু যখনই শাহবাগের আন্দোলন তাদের দেশব্যাপী বিপদে ফেলেছে তারা ঠিকই বিএনপিকে পুরোপুরি নিজেদের করে ফেলতে চাইছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আদৌ থাকবে কি না? যদি সরকার আসলেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সেক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক অপশক্তিটি কোন্্ প্ল্যাটফরমে গিয়ে ঠাঁই নেবে? স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র কথাটি এসে যায়। কেউ কেউ একথাও বলতে শুরু করেছেন যে, আজকে যে বিএনপি আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা আসলে খোলশ মাত্র, এই খোলশের ভেতর আসলে পুরোটাই জামায়াতি রাজনীতির শক্তিটি বোঝাই হয়ে আছে। কথাটি খুব যে অসত্য তাই-ই বা বলি কি করে? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো বা ছিঁড়ে ফেলা কিংবা শহীদ মিনার ভাঙার মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের নিন্দা না জানিয়ে তারা জামায়াতের হরতালে সমর্থন দিচ্ছে নির্দ্বিধায়। শাহবাগের আন্দোলনকে তারা নাটক বলে যাচ্ছে কোন রকম রাখঢাক না রেখেই। এর পর আসলে আমাদের তো আর অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকেই না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় যে, এত বড় গণজাগরণকে অস্বীকার করে বিএনপির মতো ভোটের রাজনীতি করা রাজনৈতিক দল যে ভুল করছে সেটা কি দলটির নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না? নিশ্চয়ই পারছেন। কিন্তু তারা হয়ত স্ট্রাটিজি ঠিক করে উঠতে পারছেন না, যা এই মুহূর্তে খুবই জরুরী।
শুরুতেই যে কথা বলছিলাম যে, শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম-বিরোধী বলে আজকে যে চক্রান্ত চলছে তাতে অনেকেই পা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেনও। কারণ ধর্ম হচ্ছে এমনি একটি স্পর্শকাতর বিষয় যার অপব্যাখ্যা-অপব্যবহার করে সুস্থ বিবেককে অসুস্থ আর অস্থির করে তোলা যায়। এ কারণে আমি মনে করি যে, আজকে যারা এই নিন্দার্হ উস্কানি দিয়ে চলছে তাদের অবিলম্বে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং শাহবাগও এই দাবিটিই সরকারের কাছে বিগত সপ্তাহভর করে আসছে। ব্লগার রাজীবকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে চক্রান্তের উদ্বোধন হয়েছে তা শেষ হবে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দিয়ে এবং তা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিন্দনীয় করে তুলবে, সন্দেহ নেই। অনেক বিশ্লেষকই একথা বলতে চাইছেন যে, সরকারের জন্য শাহবাগ আন্দোলন একটি বড় সহায়ক-সিগন্যাল। কারণ মানুষ সরকারের চাওয়াটাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু এটাকে যদি ঠিকভাবে সমাপ্তির দিকে টেনে নেয়া না যায় তাহলে এই সিগন্যালই জনগণকে ভুল সংকেত দেখাতে শুরু করবে। জাহাজ যেমন ঝড়ের রাতে বাতিঘরের দেখানো আলোয় কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই পোতাশ্রয়ে স্থান করে নেয় তেমনই শাহবাগ নামক বাতিঘর থেকে দেখানো আলোয় সরকার যদি নিরাপদে আশ্রয় খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশ নামক এই নৌকোই পড়বে এক তীব্র ঝড়ের মুখে, আসলে আমরা এখনই এই ঝড়ের ভেতর অবস্থান করছি বটে। এই ঝড়কে আরো জোরদার করে তুলছে ধর্মীয় উস্কানি, অপরাজনীতির নোংরামি, স্বাধীনতা-বিরোধীদের অপকৌশল, লোক দেখানো মুক্তিযুদ্ধবাদীদের মিথ্যাচার ইত্যাদি নেতিবাচক প্রপঞ্চসমূহ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এর সঙ্গে যদি রাষ্ট্রের কোন কোন চালিকাশক্তির সরকারবিরোধী অংশ যোগ দেয় (ইতোমধ্যেই আমরা তাদের যোগ দেয়ার বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি) তাহলে যে ভয়ঙ্কর দানবীয় শক্তির উত্থান ঘটবে তার সঙ্গে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। এখনই যে যুদ্ধটিকে শাহবাগপন্থীরা বলছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, সুরের বিরুদ্ধে অসুরের যুদ্ধ, অপরপক্ষ তাই-ই দমাতে চাইছে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার এই ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষটিকেই আরও শক্তিশালী করতে না পারলে নিরস্ত্র শাহবাগপন্থীরা তো রাজীবের মতো বলি হতেই থাকবে, নয় কি? সত্য প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে সত্যের পথকে নির্বিঘœ করার পুরস্কার সরকার নিশ্চিতভাবেই পাবে কিন্তু পুরস্কার লাভের জন্য সব সময়ই যে কঠিন পথ পার হতে হয়, প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের সেই সত্যটা জানা আছে তো?
ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ॥ সোমবার ॥ ২০১৩ ॥
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ।
সধংঁফধ.নযধঃঃর@মসধরষ.পড়স

নাস্তিকতার আবরণে ইসলামবিদ্বেষ

মাহমুদুর রহমান




আমাদের ছাত্রজীবনে কেউ নাস্তিক শুনলে তার দিকে কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাতাম। মনে হতো ভিন গ্রহের বাসিন্দা বুঝি। তখন ডিজিটাল যুগ আসেনি, পত্রিকায় লিখেও কেউ তার নাস্তিকতার সবিস্তার জানান দিতেন না। সবকিছুই ছিল লোকমুখে শোনা। মাত্র গুটিকয়েক বিখ্যাত নাস্তিক ছিলেন। মুসলমান পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ এবং জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের কথাই আমাদের ছাত্রজীবনের আড্ডায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতো। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম কেন, কোনো ধর্ম নিয়েই অযথা নিন্দা করতেন বলে শুনিনি, আজকের তরুণ নাস্তিকদের মতো অশ্লীল বাক্য ব্যবহার তো দূরের কথা।
তরুণ বয়সে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের মধ্যেও যে এক ধরনের নির্বিকার মনোভাব ছিল না, এমন দাবি করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। লেনিন বলেছেন, ধর্ম নাকি আফিম—এসব কথা নিয়ে তুমুল তর্ক বেধে যেত। ইসলামের ইতিহাস চর্চার চেয়ে সেই বয়সে বিপ্লবী চে-গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন কাহিনী পড়তেই বরঞ্চ বেশি উত্সাহ পেতাম। তবে, যে যতই বাম ঘরানার হোক না কেন, আমাদের মহানবী (সা.) সম্পর্কে ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধাপোষণ করত না, এমন কোনো সহপাঠী কিংবা পাড়াতুতো বন্ধুর অস্তিত্ব ছিল না। শাহবাগের দুর্বিনীত, ইসলাম-বিদ্বেষী, বেপরোয়া ব্লগারচক্র সরকারের প্রকাশ্য মদতে ১৭ দিনব্যাপী একটানা নাটক মঞ্চস্থ করে দৃশ্যপট থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে বটে; কিন্তু যাওয়ার আগে বাংলাদেশের বর্তমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধ সম্পর্কে আমার আস্থায় বড়সড় ফাটল তৈরি করে দিয়ে গেছে।
নাস্তিকতা বা অঃযবরংস শব্দটি গ্রিক ভাষার ধঃযবড়ং থেকে এসেছে। এর অর্থ—ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা (ঘড়হ-বীরংঃবহপব ড়ত্ রিঃযড়ঁঃ এড়ফ)। ইউরোপ ও এশিয়ায় দার্শনিক আলোচনায় এই তত্ত্বের উত্পত্তিকাল যদিও খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধারণা করা হয়, কিন্তু পশ্চিমে আধুনিককালে আঠারো শতকেই এর সর্বাধিক বিস্তারলাভ ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানের অনেক পণ্ডিত ধারণা করেন যে প্রধানত মূর্তিপূজার বিরুদ্ধেই এথিজমের দার্শনিকতার উত্পত্তি। বাংলাদেশের নাস্তিকরা অবশ্য মূর্তিপূজার প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে ইসলামকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বপ্রথম এথিজম গ্রহণ করা হলেও ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পর ১৭৯৩ সালে ঈঁষঃ ড়ভ জবধংড়হ নামে নাস্তিক্যবাদী আইন স্বল্প সময়ের জন্য জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঋত্ধহপব গ্রহণ করেছিল। সে বছর ১০ নভেম্বর বিলটি গৃহীত হলেও মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ১৭৯৪ সালের ৭ মে সেটি বাতিল করে ধর্মভিত্তিক ঈঁষঃ ড়ভ ঃযব ঝঁঢ়ত্বসব ইবরহম গ্রহণ করা হয়। আশা করি, পাঠক এথিজম এর সঙ্গে সেক্যুলারিজমকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সেক্যুলারিজম আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের বিষয়-বহির্ভূত বিধায় ভবিষ্যতে অন্য কোনো লেখায় এ বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে।
পৃথিবীতে এথিস্টদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ২০১২ সালে ডওঘ/এওঅ পরিচালিত সমীক্ষায় ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নিজেদেরকে এথিস্টরূপে পরিচয় দিয়েছেন। আবার অন্য এক সমীক্ষায় ২.৩ শতাংশ এথিস্ট এবং ১১.৯ শতাংশ ধর্মহীন (ঘড়হ-ত্বষরমরড়ঁং) মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে এথিস্টদের সংখ্যা নিম্নরূপ :
ফ্রান্স ৩২%
জার্মানি ২০%
গ্রেট ব্রিটেন ১৭%
স্পেন ১১%
ইটালি ৭%
যুক্তরাষ্ট্র ৪%
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রকে যতই বাধা-বন্ধনহীন সমাজ মনে করুক না কেন, সমীক্ষা বলছে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিটি ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল।
বাংলাদেশের সমাজে নাস্তিকতা কতখানি বিস্তার লাভ করেছে, তার কোনো সমীক্ষা কোথাও পাওয়া সম্ভব বলে আমার অন্তত জানা নেই। কেউ এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে উপকৃত হব। তবে এদের সংখ্যা নিয়ে আমি মোটেও উদ্বেগ পোষণ করি না। কেউ যদি আল্লাহ, ঈশ্বরে কিংবা ভগবানে বিশ্বাস করতে না চায়, সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। শাহবাগ পিকনিক দেখার পর এদেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার জায়গাটা অন্যত্র তৈরি হয়েছে। সে বিষয়ে লেখার আগে আমাদের প্রজন্মের বাল্য, কৈশোর ও প্রাকযৌবনকাল নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করছি।
আগের অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে, আমার বাল্যকাল কেটেছে পুরনো ঢাকার নানার বাড়িতে। তিনি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি করতেন। প্রতিদিন সকালে ক্লিন শেভ্ড হয়ে অফিসে যেতেন। পোশাক-আশাকে যথেষ্ট সৌখিন ছিলেন। হৃদরোগ ধরা না পড়া পর্যন্ত ধূমপানের প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। বলতে গেলে চেইন স্মোকারই ছিলেন। নানার বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল। গেন্ডারিয়াতে সীমান্ত গ্রন্থাগার নামে একটি লাইব্রেরি ছিল। সদস্যরা মাসিক চাঁদার বিনিময়ে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তেন। আমার দায়িত্ব ছিল নানার জন্য সপ্তাহে অন্তত দুটি গল্পের বই নিয়ে যাওয়া। আমার পড়াশোনার নেশাও সীমান্ত গ্রন্থাগারে সেই বই ঘাঁটাঘাঁটি থেকেই। আমার যথেষ্ট স্মার্ট সেই নানাকে জ্ঞান হওয়া অবধি কোনোদিন নামাজ রোজা কাজা করতে দেখিনি। তিনি আরবি ভাষায় তেমন দক্ষ ছিলেন না। বরং আমার নানী কোরআনে হাফেজ ছিলেন। নানার ভুল উচ্চারণে সুরা পাঠ নিয়ে নানী প্রায়ই ঠাট্টা-তামাশা করতেন। কোরআন তেলাওয়াতে ভুল-শুদ্ধ বোঝার মতো বিদ্যা আমার ছিল না। তবে প্রতি সুবেহ্ সাদেকে আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে শোনা নানার নামাজ পড়ার শব্দ এখনও কানে বাজে। তিনি ধার্মিক, উদার ও নীতিবান মানুষ ছিলেন।
আমাদের বাসার কাছে দুটি মসজিদ ছিল। কিন্তু একটা মসজিদে নানা কখনও নামাজ পড়তে যেতেন না। কারণ, যে জমির ওপর মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল, তার একটি অংশ নাকি একজন হিন্দু বিধবার ছিল। সম্ভবত তার কাছ থেকে জমি নেয়ার সময় উপযুক্ত দাম দেয়া হয়নি। নানা বলতেন, ওখানে নামাজ পড়লে নাকি শুদ্ধ হবে না। ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আমার এক শিক্ষক সপরিবারে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। যাই হোক, নানার শাসন খুব কড়া ছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে সূর্যাস্তের আগে বাড়িতে ফেরার কঠোর আইন ভাঙার সাহস আমাদের কোনোদিন হয়নি। সেই ষাটের দশকের একেবারে প্রথম দিকে আমার মা এবং মামা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের কাউকেই নানার সামনে কথা বলার খুব একটা সাহস করতে দেখিনি। সেই সময়কার শিক্ষিত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পরিবেশ বোঝানোর জন্যই এত কথার অবতারণা করেছি। আর একটি ঘটনার কথা বলেই মূল প্রসঙ্গে ফিরব।
আমি তখন ঢাকা কলেজে এইচএসসি পড়ি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বড় বোনের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গেছি। সঙ্গে অন্যান্য বন্ধুও ছিল। মা বলে দিয়েছিলেন, অবশ্যই রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু, ফিরতে এগারোটা হয়ে গেল। অপরাধটা আমার ছিল না। আমাদের সব বন্ধুকে একসঙ্গে সবার শেষে খেতে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী, বন্ধু রফিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখতে পেলাম, মা রাগে আগুন হয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। সিঁড়ি বেয়ে দু’ পা এগোতেই তিনি আমাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেলেন। দেরির কারণ ব্যাখ্যা করার আর সুযোগ মিললো না। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমার গালে সপাটে চড়। বন্ধুর সামনে মায়ের হাতে মার, ব্যথা যত না লাগলো তার চেয়ে বেশি অপমানে চোখে পানি চলে এলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বন্ধু পেছন ফিরেই দৌড়।
রাগে-দুঃখে রাতে আর ঘুম এলো না। সারারাত জেগে পরিকল্পনা করলাম, ভোরের আগেই কেমন করে বাড়ি ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। এমন নিষ্ঠুর, অবিবেচক মায়ের সঙ্গে আর থাকব না। যে বন্ধুর বোনের বিয়ে খেতে গিয়ে এই বিপত্তি এবং যার সঙ্গে বাসায় ফিরেছিলাম, দুজনই পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে বোটানি এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছে। একজন দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছে। অপরজন বোধহয় এখনও বিদেশে পড়ায়। কারও সঙ্গেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। আমারও অবশ্য বাড়ি ছেড়ে পালানো হয়নি। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার সেই কঠিন মা এখনও আমার সঙ্গেই আছেন। দীর্ঘ তিন যুগ শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন, তাও এক দশক হয়ে গেল। বয়স হয়েছে, আগের সেই তেজ আর নেই। পাকিস্তানি আমলে আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। কিন্তু, অন্যের বাসায় তিনি কোনোদিন টেলিভিশন দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেননি। আজকের শাহবাগ প্রজন্মকে দেখে পুরনো সব স্মৃতি ভিড় করে আসছে।
শাহবাগের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে অধিকাংশই হয়তো আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই এসেছে। আমাদের যেখানে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না, এরা কী করে শাহবাগ চত্বরে ছেলেমেয়ে মিলে সব একসঙ্গে রাতের পর রাত কাটায়, সেটা বুঝতে পারি না। নতুন প্রজন্মের এইসব তরুণ-তরুণীর পিতা-মাতার চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ কি তাহলে আমাদের পিতা-মাতার চেয়ে আলাদা? ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টি বিবেচনা না করলেও বাঙালি সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে এই আচরণ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি যুগ একেবারেই পাল্টে গেছে? এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। নিহত ব্লগার রাজীব যদি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে খুব আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, এককালের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী একবাক্যে তাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ প্রথম শহীদের সম্মান দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষায়, সে নাকি জাতীয় বীর। এই যদি ডিজিটাল তরুণের পরিণতি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এনালগ জামানাই বোধহয় অনেক ভালো ছিল। যে ছেলে ব্লগে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে এমন কুিসত বাক্য অনায়াসে লিখতে পারে, নানা প্রকার মাদকে অভ্যস্ত হয়, সংসার জীবনে অনাচার করে বেড়ায় তাকে ডিজিটাল প্রজন্ম কীভাবে নেতার আসনে বসায় সেটা আমাদের মতো প্রাচীনপন্থীরা হয়তো বুঝতে পারব না। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আধুনিক ছেলে-মেয়েদের স্বাধীনতার মাত্রার গল্প শুনে আতঙ্কবোধ করি।
আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও কষ্ট করে তার অভিভাবক পিসি এবং ল্যাপটপ দুটোই তাকে কিনে দিয়েছে। সেই ছেলে পড়াশোনার অজুহাতে ঘরের দরজা বন্ধ করলে নাকি বাবা-মায়ের দরজায় টোকা দেয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই। ঝঃঁফু ঃরসব শেষ হলে তবেই নাকি তিনি দরজা খোলেন। রাজীব এবং তার সমগোত্রীয়দের অপকর্ম সম্পর্কে জানার পর থেকে আমার সেই ভাগ্নেকেও আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছি। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনলো কিনা সেটা নিয়ে ইদানীং আমি উদ্বেগ বোধ করি।
কয়েকদিন আগে আমার অফিসে গল্প করার সময় অগ্রজপ্রতিম জনপ্রিয় সম্পাদক শফিক রেহমান সমাজ পরিবর্তনের একটা চমত্কার ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, ল্যাপটপ প্রযুক্তির বয়স খুব বেশি নয়। তাই যথেষ্ট পরিণত বয়সে পৌঁছেই কেবল আমরা প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। তার আগে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় নানা ধরনের বই পড়াটাই আমাদের জ্ঞানার্জন ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। তারা প্রযুক্তির সঙ্গে আগে পরিচিত হচ্ছে, তারপর পড়াশোনা। এর ফলে তাদের মননে চিরায়ত মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের বিকাশ ঘটছে না। অনেকে হয়তো শফিক ভাইয়ের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমি সেখানে চিন্তার খোরাক পেয়েছি।
লেখার শুরুতেই পশ্চিমা বিশ্বে নাস্তিকের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে সেই সংখ্যা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হলেও সে সব দেশে নাস্তিকরা খ্রিস্টধর্ম কিংবা যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে ফেসবুকে ঠঁষমধত্ কোনো পোস্ট দিচ্ছে না। মৌলবাদী ইহুদি ও খ্রিস্টানদের একাংশের তীব্র ইসলাম বিদ্বেষের কারণে কখনও কখনও আমাদের ধর্ম এবং রসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে আক্রমণের নিশানা বানানো হলেও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে স্বীকার করতে হবে যে, তার অসভ্যতা অথবা ব্যাপকতা এখনও কথিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশে নাস্তিকতার আবরণে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার সুযোগ নিয়ে একটি গোষ্ঠী ইসলামের সব প্রতীককে অনবরত আক্রমণ করে চলেছে। রাজাকারের ছবি আঁকতে গেলেই তাবত্ আওয়ামীপন্থী এবং সুশীল(?) মিডিয়ায় বীভত্স মুখ এঁকে মাথায় চাঁদ-তারা খচিত টুপি এবং থুতনিতে দাড়ি দেখানো হচ্ছে। অথচ ইসলামের আগমনকাল থেকেই চাঁদ-তারা আমাদের পূর্বপুরুষের পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দাড়ি এবং টুপি আমাদের মহানবী (সা.)’র সুন্নত। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মুখেই দাড়ি এবং মাথায় টুপি রয়েছে। অনেক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার মুখেও দাড়ি রয়েছে। নামাজ পড়ার সময় তারাও টুপি ব্যবহার করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একই ধরনের ভয়াবহ ইসলামবিরোধী পরিবেশ বিরাজ করছে। নাটক ও সিনেমায় অবলীলাক্রমে রাজাকার দেখাতে গিয়ে অহরহ মুসল্লিদের অপমান করা হচ্ছে। এ দেশের নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই ভারত-প্রেমে বুঁদ হয়ে আছেন। সেই ভারতের নাটক, সোপ অপেরা ও সিনেমায় সাধারণভাবে হিন্দু ধর্মকে মহত্ভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নাস্তিক ভারতপ্রেমীদের মতো তাদের বিখ্যাত সব মেগাস্টাররা কখনোই ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন না।
শাহবাগ থেকে আমার সহকর্মী ফটোসাংবাদিক মোস্তফা এক ভয়াবহ ছবি তুলে নিয়ে এসেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, টুপি মাথায় এক তরুণ রাজাকার সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর হাস্যোজ্জ্বল এক বালিকা তার মাথায় জুতো দিয়ে পেটাচ্ছে! ছবিটা দেখে অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে নিজের চেয়ারে বসে থাকলাম। ধর্মের প্রতি এ কেমন ঘৃণার বীজ শিশুর কোমল মনে রোপণ করা হচ্ছে? কাদের ইশারায় হচ্ছে এসব? শাহবাগের নাস্তিকদের বিষয়ে আমার অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। এদের যত আক্রোশ কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতি কেন? বিতর্কিত ব্লগগুলোতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মকে আক্রমণ করে কোনো পোস্ট তো লেখা হচ্ছে না। আজান, নামাজ এদের চক্ষুশূল হলে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোতে এত উত্সাহ কেন? ইসলাম নিয়ে সমালোচনার ভাষাই-বা এত অশ্লীল, এত কুরুচিপূর্ণ হয় কী করে? যে সব ব্লগার এই অপকর্ম করছে, তারা কি সব মানুষরূপী শয়তান? এদের পিতা-মাতার পরিচয়ই-বা কী? সেসব পিতা-মাতা পুত্র-কন্যাদের এই বিকৃত মানসিকতা সম্পর্কে কি অবহিত? তরুণ প্রজন্মের মগজ ধোলাইয়ের কাজে কোনো বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ আছে কিনা, সেই রহস্যের উদ্ঘাটনই-বা কে করবে? ঝড়সবযিবত্ব রহ নষড়ম নামে যে ব্লগে অশ্লীল ইসলামবিরোধী প্রচারণা চলছে, তার মালিকানায় বিদেশি অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে এখনই বিশদভাবে তদন্ত করা দরকার। কিন্তু, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
কাকতালীয়ভাবে মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশে এজাতীয় চরম ইসলাম-বিদ্বেষী গোষ্ঠীর তত্পরতা শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকারের দ্বৈত বেঞ্চ অবিলম্বে ওয়েবসাইট ও ব্লগ বন্ধ এবং অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, “Pending hearing of the Rule, the respondents are hereby directed to take all necessary steps to block the above noted facebooks/websites/webpages and URL and/or any other similar internet sites and also to initiate investigation to identify the perpetrators of all such offensive websites, at once and submit a report along with compliance within 2 weeks from the date of receipt of this order.” (রুল নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া চলাকালে, বিবাদী পক্ষকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে যে তারা যেন এই মুহূর্তে আপত্তিকর সকল ফেসবুক/ওয়েবসাইট/ওয়েব এবং ইউআরএল এবং/অথবা অন্যান্য ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এই সকল ওয়েবসাইটের হোতাদের খুঁজে বের করে। এই আদেশ প্রাপ্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্দেশ প্রতিপালন ও প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো।)
আদালতের নির্দেশের পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চরম ইসলাম-বিদ্বেষী ও অশ্লীল ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ এবং তাদের হোতাদের চিহ্নিত করে শাস্তিবিধান করেনি। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে মহাজোট সরকারের সব মন্ত্রী ও এমপি অপরাধীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। শাহবাগের এক ধর্মদ্রোহী, নষ্ট তরুণ অজানা ঘাতকের হাতে নিহত হলে তাকে শহীদের খেতাব দিয়ে প্রকৃত শহীদদের অবমাননা করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সিধারীদের বাধেনি। স্বয়ং এটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের রুলের বিষয়ে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের বখে যাওয়া স্বঘোষিত নেতাকে জাতীয় বীর আখ্যা দিয়েছেন।
আদালত যাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য উল্টো প্রশাসন থেকে গানম্যান দেয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল কেবল ইসলামের বিরুদ্ধেই সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করেননি, তারা একইসঙ্গে আদালতেরও অবমাননা করেছেন। কথিত শাহবাগ গণজাগরণের প্রথম থেকেই আমার দেশ এটিকে সরকারের রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত রাজনৈতিক চালরূপে বিবেচনা করছে। গত ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালীন বিচিত্র কর্মকাণ্ডে আমাদের বিশ্লেষণের সত্যতা সর্বাংশে প্রমাণিত হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া বাকি রয়েছে। কথিত গণজাগরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে ঢাকার কোন্ কোন্ বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস জড়িত ছিল এবং খাদ্য, পানীয়, ফুর্তির বিপুল অর্থায়ন কোথা থেকে হয়েছে সে তথ্যটি পাওয়া গেলেই সব রহস্যের অবসান ঘটবে। পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে তিনিই সর্বোত্তম কৌশলী। অতএব, এসব প্রশ্নের জবাবও ইনশাআল্লাহ্, একদিন মিলবে।
মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করে রাজাকারবিরোধী প্রচারণার আড়ালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই ঘৃণা ছড়াচ্ছে। অথচ আজ তারাই ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের কার্যকলাপ আমার দেশ এবং আরও কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হলে তাকে ঐধঃব ঈধসঢ়ধরমহ বলে গাল-মন্দ করছেন। এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও হাতে-গোনা দুই-একটি মাত্র পত্রিকায় ইসলামের পক্ষে লেখালেখিও তারা সহ্য করতে পারছেন না। সুশীলত্বের আবরণে ঢাকা এই ফ্যাসিবাদী চিন্তা-চেতনা ক্রমেই দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। কয়েকজন তথাকথিত পেশাদার আওয়ামীপন্থী সম্পাদক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমার গ্রেফতারের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে অনবরত দেন-দরবার চালাচ্ছেন। এদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি বিশেষভাবে অবহিত আছি। এদের পেছনে যে একটি বিশেষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় রয়েছে, সে তথ্যও আমার জানা। প্রায় আড়াই মাস পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনেক অসুবিধার মধ্যে অফিসে দিনযাপন করছি। শাহবাগ চত্বর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন চিহ্নিত খুনি প্রকাশ্যে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে দেখে নেয়ার হুঙ্কার ছাড়ছেন। সরকার সমর্থক সম্পাদকদের ষড়যন্ত্রের গল্প খানিক আগেই বলেছি। এত প্রতিকূলতাও আমাদের মনোবল ভাঙতে সক্ষম হয়নি। সম্পাদকীয় নীতি হিসেবে আমার দেশ দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকরা ধর্মবিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার দেশ পত্রিকার পাঠক ও দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর অভাবনীয় ভালোবাসায় আমরা ধন্য হয়েছি। সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং তাদের তল্পিবাহকদের নির্যাতন থেকে দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ জনগণের দোয়ার বরকতে আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন।

আবার তোরা মানুষ হ


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র




‘তোমার চোখের মতো স্নিগ্ধ চোখ পৃথিবীতে নেই,
এবং কোন মাতা এমন সুন্দর পুত্র
আর প্রসব করেনি এই পৃথিবীর বুকে’
—কবি হাসান বিন সাবিত।
[রসুলের সাহাবী]

‘বালাগাল উলা বে কামালিহি

কাশাফাদুজা বে জামালিহি
হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’
—শেখ সা’দী।

‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়,

রূপ-কাঠের নৌকা খানি
নাহি ডোবার ভয়।

নবী না চেনে যারা

মুয়াহেদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার তাই মজুরী
দলিলে সাফ দেখা যায়।’
—লালন ফকির।

‘দেখ ঐ গিরি প্রস্রবণ আনন্দে উজ্জ্বল

যেন তারার এক চমক, মেঘের উপরে
পালে তারে তরুণ বয়সে সদয় আত্মিকগণ
চূড়াগণ মধ্যবর্তী ঝোপের মাঝারে।’
—গ্যাটে।
[হজরত মুহম্মদ গীতি]।

“My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some reader’s and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular level.”

ÑMichael H Hart
[The 100 : A Ranking of the most influential persons in history]

[ বশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় আমি যে মোহাম্মদকে প্রথমে রেখেছি তাতে কিছু পাঠক বিস্মিত হতে পারেন, কেউ কেউ প্রশ্নও তুলতে পারেন; কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ইহজাগতিক উভয় স্তরে সর্বাত্মকভাবে সফল হয়েছেন।’


—মাইকেল এইচ হার্ট। [দি ১০০ : এ র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পার্সনস ইন হিস্টরি]


‘আমি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিশ্চিত হয়েছি যে, সেই কঠিন সময়ে ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল তরবারির মাধ্যমে নয়, বরং তার সরলতা ও ইসলামের নবীর নম্রতার মাধ্যমে। তাঁর অঙ্গীকার পূরণের দৃঢ়তা, তার বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য তাঁর মমতা, তাঁর নির্ভীকতা, সাহস, সৃষ্টিকর্তা এবং নিজের কাজের ওপর আস্থা। তরবারি নয় বরং এসবই ছিল আসল কারণ। যার দ্বারা তিনি প্রতিহত করছিলেন সকল ধরনের বিপদ।’

—মহাত্মা গান্ধী।
[Young India, 1924]|

‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ,

সেই পথে মোর চলে যেতেন নূরনবী হযরত।

পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,

আমি, ঝরনা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে,
সেথা, দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত\’
—কাজী নজরুল ইসলাম।

ওপরের উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করলাম ইচ্ছে করে। কারণ আমার হৃদয় বেদনায় জর্জরিত। আমার বোধশক্তি তিরোহিত। আমি হতবাক, আমি স্তম্ভিত। আমি আতঙ্কিত। এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাসে রাসুলের (সা.) চরম শত্রুরা যা কখনও কল্পনাও করেনি, সালমান রুশদির মতো সাম্রাজ্যবাদের গৃহপালিত লেখকও যে ভাষা ব্যবহার করতে সাহস পায়নি, এমনকি ধর্মান্ধ ক্রুসেডাররাও যে ভাষা ব্যবহার করতে লজ্জাবোধ করেছে, তার চাইতেও নোংরা, জঘন্য, অশ্লীল, হিংস্র ও অসভ্য ভাষা ব্যবহার করেছে রাজীবসহ আরও কয়েকজন ব্লগার। যারা ব্লগার নামেরও কলঙ্ক। ডধত্ ডড়ষভ-এর মতো জিঘাংসা নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাসুলের পবিত্র নামের ওপর। আশ্চর্যের বিষয় এদের কেউ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নয়, সবাই মুসলমান অথবা মুসলিম পরিবারের সন্তান। এদের কেউই এলিয়েন নয়, কোনো জন্তু-জানোয়ার নয়। এরাও মানুষ! কোনো না কোনো নারীর জঠরে এদের জন্ম।

এরা যদি মানুষ হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষ শব্দটি তার তাত্পর্য হারিয়ে ফেলেছে। এরা যদি নাস্তিক হয় তাহলেও বুঝতে হবে এরা ভণ্ড নাস্তিক। এরা নাস্তিক হওয়ারও অযোগ্য। কারণ নাস্তিক্যবাদও এক ধরনের বিশ্বাস। একটা বিশ্বাস কখনোই অন্য একটি বিশ্বাসকে আহত করে না, অপমান করে না। এ প্রসঙ্গে মনীষী আহমদ শরীফের (যিনি একজন খাঁটি নাস্তিক ছিলেন) উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না—‘নাস্তিক হওয়া সহজ নয়।...তাই প্রাচীন ও আধুনিক দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত নাস্তিকই ছিলেন সুজন, সুনাগরিক ও মনীষী।’ রাজীব এবং তার সহচররা তো এই কথার ধারে-কাছেরও কেউ নয়। ওরা তো বন্য বরাহের চাইতেও দাঁতাল এবং কুিসত। চ্যানি বলেছেন, যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারাই যুবক। যারা ধর্মে অবিশ্বাসী তারাই বৃদ্ধ। তাহলে এরা যুবকও নয়, বৃদ্ধও নয়, এরা কদর্য-কোনো প্রাণী। যাদের উদ্দেশ্য হলো দেশে নৈরাজ্য ডেকে আনা। হানাহানি ডেকে আনা। রক্তপাত ডেকে আনা।
ধর্ম হলো মানুষের গভীরতম, নিবিড়তম এক বিশ্বাস। তার সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান। সেই জায়গায় যেমন অন্যের প্রবেশাধিকার নেই, তেমনি তাকে অসম্মান করার অধিকারও কারও নেই। এজন্যই রবার্ট বার্টন বলেছেন, ‘ধর্ম মানব মনীষা আর উপলব্ধির এক দুর্লভ কৃতিত্ব আর সম্পদ। ধর্মের কাছে মানুষ পায় আত্মজ্ঞান, অতীন্দ্রিয় জিজ্ঞাসার প্রেরণা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধার শান্তি ও সান্ত্বনা। ধর্ম মানুষকে দেখিয়েছে বিশ্বাস, ভক্তি, বিনয়, ক্ষমা, করুণা আর আত্মনিবেদনের পথ, দিয়েছে শৃঙ্খলা আর সংযত জীবনের দীক্ষা।’ সেই স্থানে ড্রাকুলার মতো, শয়তানের মতো, গোঁয়ারের মতো আঘাত করেছে সরকারের নিয়োজিত হাতে-গোনা কয়েকজন ব্লগার।
আসলে এরা ব্লগার নয়, ব্লগারের ছদ্মবেশ পরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী।
পৃথিবীর দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের রাসুলকে করেছে চরম অপমান এবং তা এমন একসময় যখন সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র, রক্তপিপাসু ইসরাইল এবং আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাস, ভীতি এবং আতঙ্ক। উদ্দেশ্য ইসলাম নির্মূল।
সঙ্গত কারণেই এইসব তথাকথিত ব্লগারদের কর্মকাণ্ডকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এরা এদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছে সম্প্রীতি, সমঝোতা ও শান্তির বিরুদ্ধে। উস্কে দিতে চেয়েছে আগুন। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে বাংলাদেশকে। আর এদের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে একটি ব্যর্থ, অযোগ্য, অপদার্থ সরকার ও তাদের পা-চাটা গণমাধ্যম। যারা হারিয়ে ফেলেছে পেশাদারি সততা। সরকারের মতোই এরাও সাইকোপ্যাথ। যারা অন্ধের মতো সবকিছুর মধ্যে জামায়াত-শিবির খুঁজে বেড়ায়। আর চেপে যাচ্ছে সত্যকে।

দুই

আমাদের নেতা তখন আতিকুর রহমান সালু। পূর্ব পাকিস্তান বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের তিনি তখন সাধারণ সম্পাদক। সালু ভাই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির স্থপতি। আর আমি বলছি ষাটের দশকের শেষ দিককার কথা। সুদূর ভূরুঙ্গামারী থেকে রংপুর এসেছি তার এক জনসভায় যোগ দিতে। ফেরার পথে জড়িয়ে গেলাম হাঙ্গামায়। তখন তো বাহন বলতে কেবল ট্রেন। সেই ট্রেনে আমাদের কামরায় উঠলো ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা প্রথম থেকেই মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ সম্পর্কে আজেবাজে ভাষায় আক্রমণ শুরু করে দিল। আর মওলানা ভাসানী এবং মাও সে তুঙ তখন আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা। আমরা অনুরোধ করলাম বাজে কথা না বলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা অশ্লীল ভাষার ব্যবহার থেকে বিরত হলো না। শুরু হলো প্রতিআক্রমণ। তারপর যা হয়। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। হাতাহাতি থেকে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। ট্রেনের যাত্রীরা ভয়ে চিত্কার শুরু করে দিল। থেমে গেল ট্রেন। ছুটে এলো গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ। তারাও থামাতে পারে না। এর মধ্যে ছাত্রলীগের দুই-তিন জনের মাথা ফেটে গেল। আমাদেরও কেউ কেউ রক্তাক্ত।
রাজনৈতিক নেতাদের গালাগাল করার জন্য যদি এত বড় কাণ্ড ঘটতে পারে, তাহলে ধর্মকে অপমান করলে, নবী, অবতারদের অপমান করলে কী ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
শুধু মুসলমান বলে কথা নয়, হিন্দুদের দেবদেবী, খ্রিস্টানদের যিশু কিংবা বৌদ্ধদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেও তারা একই রকমভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হতে পারে। এই হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, যত ক্রুসেড হয়েছে অন্য কোনোকিছু নিয়ে এত নয়। ভারতে এখনও দাঙ্গাহাঙ্গামা নৈমিত্তিক ব্যাপার। এজন্যই অন্য ধর্মের লোকদের গালমন্দ করার ব্যাপারে কোরআন শরীফে নিষেধাজ্ঞা আছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ করো না। তাহলে তারাও ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে।’ [সুরা আল-আনয়াম]।
বলা হয়েছে ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ [ধর্মের বিষয়ে জোর-জবরদস্তি নেই]। হাদিসে আছে রাসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করবে, তার অধিকার ক্ষুণ্ন করবে, কিংবা তাকে সাধ্যাতিত পরিশ্রম করাবে, তার অমতে তার কিছু ছিনতাই করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার প্রতিপক্ষ হবো।’
ইসলাম বলে, ‘অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করবে না। যদি তর্কবিতর্ক করতেই হয়, তাহলে তা করো উত্তম পন্থায়।’
আমি পরিষ্কার ভাষায় জানাতে চাই আমি কোনো ধর্মবেত্তা নই। ইসলামী চিন্তাবিদ নই। সেই অর্থে প্র্যাকটিসিং মুসলিমও নই। তারপরও ইসলামের বিশ্বজনীন বাণীর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ প্রগাঢ়। সেজন্যই পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতি, ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি সম্মানবোধ লালন করি অন্তরে। বিশ্বাস করি কোনো ধর্মই বিদ্বেষ ও হানাহানি নয়, মানুষে মানুষে প্রেম ও শান্তিকেই দিয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব।
ব্লগার রাজীবের অন্যায় ও অন্যায্য কাজ এবং তার সহচরদের সহযোগিতা, বাংলাদেশের মানুষের মতো আমাকেও ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত করেছে। বিশেষ করে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তারা যা লিখেছে তা এককথায় ক্ষমাহীন। সেজন্যই দেশজুড়ে জ্বলে উঠেছে প্রতিরোধের আগুন। ধর্মপ্রাণ মানুষজন পথে নেমেছে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে নয়, তারা পথে নেমেছে অপমানের বিরুদ্ধে, তাদের দাবি একটাই—এই ঔদ্ধত্য অবশ্যই দেশ, জাতি, ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থে, কল্যাণ ও মঙ্গলের স্বার্থে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সময় ক্ষমতাসীন আছে এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার, যারা এই ধর্মবিদ্বেষীদের পক্ষ অবলম্বন করে ধর্মপ্রাণ মানুষদের শায়েস্তা করার জন্য নামিয়ে দিয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ তাদের দলীয় ঠাঙ্গারেদের। হামলা মামলায় জেরবার করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পাশাপাশি শাহবাগের চত্বরের জমায়েতকে সামনে নিয়ে বিরোধী গণমাধ্যম বিশেষ করে আমার দেশ ও তার সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভির বিরুদ্ধে একের পর এক ছাড়ছে রণহুঙ্কার। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে জটিল কুটিল আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র। নতুন করে দেয়া হয়েছে মামলা। তিনি নাকি উস্কানি দিচ্ছেন। মাহমুদুর রহমান তো খবর ছাপিয়েছেন মাত্র। যারা উস্কানিদাতা তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। কিন্তু উস্কানিদাতাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে এখন উল্টো অভিযোগ চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের ওপর। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই রকম বিষোদগার ১৯৭৫ সালের পর আর এদেশে দেখা যায়নি। এখন দেয়া হচ্ছে আল্টিমেটাম, গ্রেফতারের হুমকি। শাহবাগের নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগের ক্যাডারদের পাশাপাশি এখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরাও স্বমূর্তি ধারণ করে বকছেন আবোল-তাবোল।
সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললে যে কাউকে পেতে হচ্ছে কঠিন দণ্ড। ঘটছে চাকরিচ্যুতি। এখন বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়ে পড়ছে ফালতু বিষয়। আর মহানবী (সা.)কে অপমান করলে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করলে পাওয়া যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। মহানবীর গালমন্দকারীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী উপাধি দেন দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’। তড়িঘড়ি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান দেড়শ’ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাতকারীর বাসায়। জানান সহানুভূতি। আর যারা ধর্মের অপমানের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। তাদের হত্যা করা হচ্ছে। কুকুর ও সাপের মতো তাদের পেটানো হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসাগুলো।
আধিপত্যবাদের তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলোও সরকারের পাপিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে কোরাস। তারা সাংবাদিকতা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীদের মতো জুলুমকারীকে বানাচ্ছে বীর। আর নির্যাতিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে অপপ্রচার। তাদেরকেই করছে দোষারোপ। সরকার এবং এই গণমাধ্যম পরিস্থিতিকে শান্ত করার বদলে উল্টো অপরাধীদের উস্কে দিচ্ছে আরও সহিংস হওয়ার জন্য। ধর্ম এবং আদালত দুটোরই এখন লাঞ্ছনার শেষ নেই এদেশে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমার দেশ যে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে, তার প্রশংসা করার বদলে তারা এখন পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর তাদের কর্কশ কণ্ঠকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
সঙ্গত কারণেই যে কারও পক্ষেই এই ধারণায় উপনীত হওয়া সহজ যে, সরকার ইসলাম ধর্ম এবং বিরোধী গণমাধ্যমকে পিষে মারার জন্য অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরকে দমন করার উসিলায় তারা আসলে দমন করতে চাচ্ছে সব বিরোধিতাকে। জামায়াত-শিবির দমন হলো তাদের উপলক্ষ, লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়া। দেশকে ভেতর থেকে অকার্যকর করে দেয়া। সে জন্যই তাদের কাছে এ বিষয় স্পষ্ট যে শাহবাগ চত্বরের জমায়েত হচ্ছে তাদেরই ইচ্ছায়। তাদেরই নির্দেশে। সরকারি নানামাত্রিক ষড়যন্ত্রেরই একটি পর্যায় হলো শাহবাগ। সেজন্যই আজ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছে কুত্সা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বলা হচ্ছে রাজাকার। শাহবাগ চত্বরের এমরান জাতীয় দলীয় লোকদের হম্বিতম্বি, নাসিরউদ্দিন ইউসুফদের আস্ফাালন ছাড়িয়ে গেছে মাত্রা। আর প্যান্ট খুলে গেছে সরকারের। সরকার ও শাহবাগ এখন একাকার।
সরকার ব্লগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু তরুণকে বিভ্রান্ত করে তাদের লেলিয়ে দিয়েছে দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সব ধর্মবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে ডেকে আনছে সহিংসতা। ডেকে আনছে রক্তপাত।
সেজন্যই তাদের দলবাজ বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক লাঠিয়াল এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় হয়েছে অবতীর্ণ। ফলে নিজেদের বেলায় গণতন্ত্র, ১৭ দিন ধরে শাহবাগ দখল করে রাখলেও তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ একদিন মিছিল করলেই তা কবিরা গুনাহ হয়ে যায়। চমত্কার বাকশালী গণতন্ত্র!

তিন

ব্লগার রাজীব কিংবা তার দুষ্কর্মের দোসরদের দোষ দিয়ে সস্তা হাততালি পেতে চাই না আমি। দোষ তো বীজের। দোষ তো পরিবারের। দোষ তো বাবা-মা’র। দোষ তো সমাজের। দোষ রাষ্ট্রের। দোষ রাজনীতির। দোষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। দোষ আমাদের পরিবেশের।
আমরা তো আমাদের সন্তানদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। যথার্থ শিক্ষা দেইনি। ব্যর্থ পিতামাতার ব্যর্থ শিক্ষা এবং ব্যর্থ রাজনীতির জরায়ু থেকে তো ভালো মানুষ জন্মানোর কোনো পথ নেই। ভালো মানুষ জন্মাতে পারে না। পারে না বলেই জন্ম হচ্ছে রাজীবের মতো, বাপ্পাদিত্যের মতো বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন সন্তানদের।
সেজন্যই অনুরোধ করি, আসুন জাতীয় জীবনের এই চরম দুর্যোগের দিনে, আমরা আমাদের সন্তানদের আবার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেই। ফিরিয়ে আনি হারিয়ে যাওয়া নীতি ও নৈতিক শিক্ষায়। তাদের স্বর্ণগর্ভ অতীত সম্পর্কে জ্ঞাত করাই। বর্তমানের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করি। নিশ্চিত করি অনাগত ভবিষ্যত্। রাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করি দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন দেশপ্রেম বর্জিত অসত্, ভণ্ড, প্রতারক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের। তাদেরকেও মাও সেতুঙের মতো, স্টালিনের মতো সংশোধনাগারে পাঠিয়ে আবার মানুষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেই। জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরের মতো এই দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সরকারের লোকজনদেরও ধরে ধরে শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেখতে বাধ্য করি খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছায়াছবি।
কেবল তাহলেই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে শ্রেয়বোধগুলো। ফিরে আসবে মহত্ত্ব। নইলে নব্য বাকশালীদের জিঘাংসা গিলে খাবে আমাদের সব অর্জন। গিলে খাবে দেশটাকে।
a_hyesikder@yahoo.com

বাংলাদেশে নৈরাজ্যের প্রত্যাবর্তন


শ ফি ক রে হ মা ন




মঞ্চে উপস্থিত গুণীজন এবং সামনে উপস্থিত সুধীজন, সাংবাদিকজন ও ক্যামেরাজন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিনের কয়েকদিন পরে হলেও, আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে গভীর ভালোবাসা এবং সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা।
এখন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সাম্প্রতিক বহিঃপ্রকাশে সমাজের একাংশের কালেকটিভ সহিংসতা, নির্মমতা ও রূঢ়তার প্রতিফলন ঘটছে।
কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, ঘৃণার চাইতে ভালোবাসার বাণী ভালো। হিংসার চাইতে অহিংসার আন্দোলন কাম্য। নির্মমের চাইতে মমতাময় আচরণ কাঙ্ক্ষিত। রূঢ়তার চাইতে নম্র ব্যবহারই সভ্য। এবং আরও ইম্পোরট্যান্ট হলো প্রতিশোধের চাইতে ক্ষমা এবং প্রতিহিংসার চাইতে দয়া—মানব সভ্যতার এই দুটি ধাপ পেরুনো। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই সভ্যতার অস্তিত্ব বজায় রাখতে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দরকার যুদ্ধ নয়, দরকার শান্তি। যুদ্ধের কুিসত হুঙ্কার-স্লোগান মানুষ শুনতে চায় না—মানুষ শুনতে চায় শান্তির ললিত বাণী।
তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি বেছে নিয়েছি ঘৃণা দিবস উদযাপনের পরিবর্তে ভালোবাসা দিন উদযাপনের বিভিন্ন পথ ও পন্থা।
গোলাপ ও চকলেট ভালোবাসার প্রকাশ
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিনে আমার এই অনুভূতি প্রচারের জন্য আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুটছিলাম এক টিভি স্টুডিও থেকে আরেক টিভি স্টুডিওতে। আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাভিশন, আরটিভি, এশিয়াটিভি, দিগন্ত টিভি, এটিএন বাংলা, মোহনা টিভি প্রভৃতির কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদের, যারা আমাকে ভালোবাসা তথা শান্তির বাণী প্রচারের সুযোগ দিয়েছেন। থ্যাংকস এ লট।
আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আমার হাতের গোলাপ ও চকলেট হচ্ছে মানুষের কোমল অনুভূতির সুন্দর প্রকাশ। কিন্তু আমি যদি আজ এখানে উপস্থিত হই রক্তাক্ত ছুরি চাপাতি নিয়ে, তাহলে সেটা হবে মানুষের নিষ্ঠুর অনুভূতির অসুন্দর প্রকাশ। একই সঙ্গে আমি বলতে পারি, ফাঁসিও মানুষের বর্বর আচরণের অসভ্য প্রকাশ।
রাজাদের আমলে প্রাণদণ্ড
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে ফাঁসি চাই আন্দোলন চলছে, তার প্রেক্ষিতে আমি জানার চেষ্টা করেছি আমাদের এই ভূখণ্ডে অতীতে মানুষের প্রাণদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হতো।
যখন এই দেশে রাজাদের রাজত্ব ছিল, অর্থাত্ ১৮৫৮-তে ব্রিটিশরাজ শুরু হওয়ার আগে, তখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে রাখা একটা পিঁড়িতে মাথা পাততে হতো। তারপর একটি হাতি তার শুঁড় দিয়ে ওই ব্যক্তির হাত-পা ছিঁড়ে ফেলতো। সবশেষে ব্যক্তির মাথা পিষ্ট করতো হাতির পা। কী বিতিকিচ্ছি দৃশ্য ছিল ভেবে দেখুন আপনারা। নিহত মানুষটির রক্ত, ঘিলু চারদিকে ছিটকে পড়ছে।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরাজ এ ধরনের মৃত্যুদণ্ড এখানে নিষিদ্ধ করে দেয়।
রাজাদের রাজত্বে আরেকটা পদ্ধতি ছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শূলে চড়ানো। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল ভেবে দেখুন। নিহত মানুষের গুহ্যদ্বার থেকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে একটি লোহার শলাকা। আপনারা কি চিন্তা করতে পারেন, সেই সময়ে ওই ব্যক্তিটির মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন ছিল? কেমন ছিল তার আর্তচিত্কার?
আরও আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এসব মৃত্যু দেখতে বহু মানুষ জড়ো হতো, যেমনটা এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ জড়ো হয় সউদি আরব, ইরান, আফগানিস্তানে শিরশ্ছেদ দেখতে। অর্থাত্, এখনও মানুষ কালেকটেড হয় মৃত্যু দেখতে এবং কালেকটিভলি মানুষ দেখে মৃত্যু। এটাকে যদি আপনারা অসভ্য বা বর্বর বলেন, তাহলে বর্তমান সময়ে কিছু ব্যক্তি বিচারবহির্ভূতভাবে কালেকটিভলি অপর কিছু ব্যক্তির ফাঁসি চাইছে, সেই দাবিকে আপনারা কি সভ্য অথবা মানবিক বলতে পারবেন?
ফাঁসিতে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা আমি আজ আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ইরাকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসন আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন আওয়াদ হামেদ আল-বন্দর। সাদ্দাম সরকারের পতনের পর তার বিচার হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তখন তার বয়স ছিল ৬২। ১৫ জানুয়ারি ২০০৭-এ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়ার পরপরই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আল-বন্দরের মাথা এবং সেটা মেঝেতে গড়িয়ে কিছুটা দূরে চলে যায়।
এখন ধরুন, এই বয়সের এক ব্যক্তিকে যদি শাহবাগে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত মুণ্ডুটা ছিটকে এসে আপনার কোলে পড়ে, তাহলে কি আপনি আনন্দিত হবেন? নাকি আতঙ্কিত হবেন? উল্লসিত হবেন? নাকি ভীত হবেন? উত্তরটা আপনিই জানেন।
ব্রিটিশ আমলে প্রাণদণ্ড
ফিরে যাই অতীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা সভ্য হওয়ার চেষ্টা করছিল। অতীতে নিজেদের দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের শিরশ্ছেদ করা হতো কুড়াল দিয়ে টাওয়ার অফ লন্ডনে। কালক্রমে ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে এবং তাদের উপনিবেশ ইনডিয়াতে, ফাঁসির ব্যবস্থা চালু করে। ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে দণ্ডিত ব্যক্তির মাথায় যমটুপি বা কালো টুপি পরিয়ে দেয়া হতো যেন তার মৃত্যুযন্ত্রণার বীভত্স চেহারা উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখতে না হয়। এসব ফাঁসি দেয়া হতো জেলখানায়, যেখানে সাধারণ মানুষ বা দর্শকের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে উপস্থিত থাকতেন শুধু জেল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার প্রমুখ সরকারি লোকজন। অর্থাত্ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো, লোকচোখের আড়ালে।
একদিকে ব্রিটিশরা আইন প্রয়োগ করে ফাঁসি দিলেও অন্যদিকে তারা আইনবহির্ভূত ফাঁসি বন্ধ করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সারা ইনডিয়াতে ঠগী দস্যুরা নিরীহ মানুষকে রুমাল দিয়ে ফাঁসি দিত। ১৮৩৬ থেকে ১৮৪২-এর মধ্যে ব্রিটিশরা দি ঠাগিস অ্যান্ড ড্যাকোইটি সাপ্রেশন (ঠগী ও ডাকাতি দমন) আইনগুলো পাস করেছিল।
এই ছিল ব্রিটিশরাজের সময়ে ফাঁসির ব্যবস্থা। তখন প্রকাশ্যে ফাঁসি হতো না। প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবিও উঠতো না।
আমি এতক্ষণ অতীতের কথা বললাম, এই কারণে যে আমরা বর্তমানে কোন ধরনের রাজ্যে বসবাস করছি, সে বিষয়ে আপনাদের সচেতন করতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, বর্তমানে ৯৭টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছে। ৫৮টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আর বাদবাকি দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন থাকলেও সেটা খুব কমই কার্যকর করা হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হত্যার রেকর্ডধারী নরওয়ের ৩৪ বছর বয়স্ক অ্যানডার্স বেহরিং ব্রেভিক ২২ জুলাই ২০১১-তে নরওয়ের অসলো এবং উলেয়া-তে একদিনে, গাড়িবোমা ফাটিয়ে এবং গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে নিহত এবং ২৪২ জনকে আহত করে। বিচারের পর তাকে ২১ বছরের জেলদণ্ড দেয়া হয়। ফাঁসি নয়। তবে এই জেলদণ্ডের সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে।
চান্স এডিটরের অবস্থান ও দুরবস্থা
সিরামিকস ইনডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ, ইনভেস্টমেন্ট বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বর্তমানে লেখক ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মি. মাহমুদুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত বই গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে আমাকে কিছু বলার অনুরোধ করা হয়েছিল। ধন্যবাদ এই বইয়ের লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে। কারণ এই চান্সে আমি একজন চান্স এডিটরের, সাবেক বিচারপতি খায়রুল হকের ভাষায়, বর্তমান অবস্থান ও দুরবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
প্রথমত, আপনারা জানেন মাহমুদুর রহমান বর্তমানে অবরুদ্ধ অবস্থায় তার পত্রিকা অফিসে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও, এটা বলা যায়, একই অফিসে দিনের পর দিন কাটানো তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হতে পারে না। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং মাহমুদুর রহমান ও তার পরিবারের সার্বিক ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন নিরাপদে তাদের বাড়িতে থাকতে পারেন এবং অফিসে যাতায়াত করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সরকারকে। আপনারা জানেন, শাহবাগ-জনতার উগ্র ঘোষণার পরপরই সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছিল, আমার দেশ পত্রিকার অফিস ভবনের নিচতলায়।
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়
দ্বিতীয়ত, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো জানেন মাহমুদুর রহমানের চরিত্র হননের ব্যর্থ চেষ্টায় কে বা কারা মাহমুদুর রহমানের কিছু টেলিফোন কথোপকথন ফেসবুকে তুলে দিয়েছেন। এসব কথা তিনি বলেছেন তার স্ত্রী পারভীন এবং তার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে পারভীন বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ফটোশপ পদ্ধতিতে শাহবাগের অতিরঞ্জিত ছবি দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশ করেছে এবং সেটা শুনে মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে একটা গালি দিয়েছেন। এতে মাহমুদুর রহমানের বিন্দুমাত্র বিব্রত বা লজ্জিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, এসব কথোপকথন বা ফোন কনভারসেশন শুনলেই বোঝা যাবে, মাহমুদুর রহমানের কোনো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিমুখী আচরণ নেই। তিনি যা প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে বলেন, সেসব তিনি টেলিফোনেও বলেছেন।
আর এখানেই ফাঁস করা এই টেলি কনভারসেশনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে ব্রাসেলস প্রবাসী জনৈক বাঙালি আইনবিদের সঙ্গে তার স্কাইপ কনভারসেশন ফাঁস হয়ে যাওয়ার মৌলিক তফাত্। স্কাইপ কনভারসেশনে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে তিনি প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির ভূমিকায় অভিনয় করছেন; অন্যদিকে তিনি গোপনে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে সরকারের পক্ষে কীভাবে রায় দেয়া যায়, সেই বিষয়ে ব্রাসেলস নিবাসীর সঙ্গে আলোচনা করছেন। আপনারা জানেন, এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ধরা পড়ে যাওয়ার পর ওই বিচারপতিকে ওই ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদায় নিতে হয়। মাহমুদুর রহমান একই জায়গাতেই ছিলেন এবং আছেন। সুতরাং তাকে তার পদ ত্যাগ করতে হয়নি।
মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে বহু বিষয়ে আমার মতপার্থক্য আছে। তার রাজনৈতিক দর্শন আমার চাইতে ভিন্ন। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, মন্ত্রী থাকাকালে তার দুর্নীতি-ঊর্ধ্ব ভূমিকা এবং চান্স এডিটর, আবারও সেই বিচারপতি খায়রুল হকের ভাষায়, মাহমুদুর রহমানের সাহস অনুকরণীয়।
বেঠিক শিরোনাম
তৃতীয়ত, মাহমুদুর রহমানের বইয়ের শিরোনামটি আমার কাছে মনে হয়েছে বেঠিক। বাংলাদেশ কি গুমরাজ্যে ফিরে গিয়েছে? না। বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছে নৈরাজ্যে। ব্রিটিশরাজ নয়, ইনডিয়ান রাজা-বাদশাহদের রাজ্যে নয়, একেবারে সেই আদিম অন্ধকার যুগের নৈরাজ্যে। যেখানে সমাজ ছিল না, রাজ্যও ছিল না। যেখানে নিয়ম ছিল না, আইন ছিল না। আজকের এই নৈরাজ্যের পরিণতি হতে পারে আরও অসভ্যতা, বর্বরতা এবং আরও নৈরাজ্য।
তাই কখনোই যেন মাহমুদুর রহমানকে নৈরাজ্যে প্রত্যাবর্তন শিরোনামে কোনো বই লিখতে না হয়, সেই কামনা করছি। আরেকটি কথা, মাত্র কয়েকদিন আগে মাহমুদুর রহমান বাধ্য হয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার দাম বাড়াতে। পত্রিকাটির দাম এখন হয়েছে বারো টাকা। আপনারা অনেকেই জানেন পত্রিকার সার্কুলেশন বেশি হলে পত্রিকার ক্ষতি হয়, যদি না যথেষ্ট পরিমাণে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। তখন প্রতি কপির দাম না বাড়িয়ে উপায় থাকে না। দৈনিক আমার দেশ-এ সরকারি বিজ্ঞাপন, সরকার সমর্থক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন এবং সরকারের ভয়ে ভীত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন আসছে না অথবা খুব কমে গেছে—সেহেতু শুধু সার্কুলেশনের ওপর বেঁচে থাকতে হলে কপির দাম তাকে বাড়াতেই হবে। অন্যথায় বর্ধিত জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্ধিত পরিমাণ নিউজপৃন্ট কেনা সম্ভব হবে না। আর সেক্ষেত্রে আমার দেশ যে বার্তা ও মতামত প্রচার করছে, সেটা সীমিত হয়ে যাবে। তাই মাহমুদুর রহমানের গুণগ্রাহীদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা আমার দেশ পত্রিকায় যেন বিজ্ঞাপন আসে সেদিকে প্রভাব খাটান। অন্তত এই দায়িত্বটুকু আপনারা পালন করুন। বিজ্ঞাপনদাতাদের আপনারা জানিয়ে দিন, ঢাকা ও সিলেটে আমার দেশ-এর সার্কুলেশন এখন মৃত্যুদণ্ডকামীদের পৃষ্ঠপোষক পত্রিকাগুলোর চাইতে বেশি। আর হ্যাঁ, আপনারা সবাইকে অনুরোধ করবেন মাহমুদুর রহমানের বইগুলো কিনতে। তা না হলে আজকের এই সমাবেশের লক্ষ্য ব্যর্থ হবে।
লন্ডনে ৩৫ বছরের অবস্থান আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-তে শাহবাগ স্কোয়ারে তরুণ-কিশোর-মাঝবয়সী এবং কিছু শিশুর যে সম্মিলন ঘটেছে, সেটা দেখে আমার মনে পড়েছে লন্ডনে ট্রাফালগার স্কোয়ারের পাশে অবস্থিত সাউথ আফৃকা ভবনের সামনে নেলসন ম্যানডেলার মুক্তির এবং সাউথ আফৃকাতে অ্যাপারথেইড বা বর্ণবাদ অবসানের জন্য ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত্ একটানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জনসমাবেশ। শীত বরফ বৃষ্টি গরম উপেক্ষা করে এই জনসমাবেশে কখনো বা একটা ছোট তাঁবুর নিচে বিশ-পঁচিশজন আন্দোলনকারী, আবার কখনো বা ভালো আবহাওয়ার সময়ে কয়েকশ’ মানুষ সমবেত হতেন। আমি সেই সময়ে লন্ডনে ছিলাম এবং কাছেই বিবিসিতে মধ্যরাতে নাইট ডিউটি সেরে ফেরার পথে একাধিক রাতে সাউথ আফৃকা ভবনের সামনে গিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হয়। রোবেন আইল্যান্ড ও পলসমুর পৃজনে সুদীর্ঘ সাতাশ বছর সশ্রম জেল খাটার পর ১৯৯০-এ নেলসন ম্যানডেলা মুক্তি পান। এবং ১৯৯৪-এ সাউথ আফৃকাতে বর্ণবাদের অবসান ঘটে। আন্দোলনকারীরা বাড়ি ফিরে যান লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর। পক্ষান্তরে শাহবাগ আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ি ফিরে যাবেন না; কিন্তু তারা ফিরে যান। শুধু তা-ই নয়, ১৭ দিন ফাঁসির দাবি তুলে বাড়ি ফেরার সময়ে যে ছয়টি দাবি তারা পেশ করেন, সেখানে ফাঁসির দাবি ছিল না।
সাউথ আফ্রিকার ওই আন্দোলন সফল হওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ ছিল—
এক. এটি ছিল নির্যাতনকারী একটি সরকারের বিপক্ষে।
দুই. এক বন্দি রাজনৈতিক নেতার মুক্তির লক্ষ্যে। এবং
তিন. ঘৃণিত বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
বাংলাদেশে ব্যর্থ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা
কিন্তু বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন চলেছে একটি ব্যর্থ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর লক্ষ্য কারও মুক্তি নয়—লক্ষ্য কারও ফাঁসি এবং তাও বিচারবহির্ভূতভাবে। এর লক্ষ্য মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা নয়—ঘৃণাবাদ প্রচার করা। এ সবই অশুভ এবং তাই এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সাউথ আফৃকার আন্দোলন সফল হয়েছিল কারণ সেটা ছিল অশুভর বিপক্ষে, শুভর পক্ষে। বন্দিত্বের বিপক্ষে, মুক্তির পক্ষে। মৃত্যুর বিপক্ষে, জীবনের পক্ষে।
তাই আশ্চর্য নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে শাহবাগ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা হয়েছে। তারা লক্ষ্য করেছে একটি পর্যায় থেকে শাহবাগ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থকরা। আর সেজন্যই এই জনসমাবেশ থেকে আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা বিষয়ে কোনো দাবি ওঠেনি। এসব ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু দুর্নীতি, ডেসটিনি এবং ইউনিপেটুইউসহ প্রায় ত্রিশটি মালটি লেভেল মার্কেটিং কম্পানি দ্বারা আধা কোটির বেশি মানুষকে প্রতারণা করা, হলমার্ক এবং অন্যান্য কম্পানির মাধ্যমে বিশেষত সরকারি ব্যাংক লুটপাট করা, গ্রামীণ ব্যাংকে অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপ, কুইক রেন্টাল দ্বারা বিদ্যুতের দাম কুইক বাড়িয়ে আওয়ামী সমর্থকদের কুইক ধনী করা, শেয়ারবাজারে প্রায় তেত্রিশ লক্ষ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করা, মিডল ইস্ট থেকে চাকরি হারিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিকের দেশে ফেরা, গার্মেন্ট শিল্পে যথার্থ নিরাপত্তা বিধানে অসমর্থ হওয়া এবং নৌ ও স্থলপথে দুর্ঘটনা রোধে বিফল হওয়া।
আজই দৈনিক মানবজমিনের একটি রিপোর্ট বলেছে, চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়ায় বারো বছরে বারোটি লঞ্চডুবিতে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শাহবাগ স্কোয়ারে সমাবেশের সময়েও লঞ্চডুবিতে বহু যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এই বারো বছরে গার্মেন্ট শিল্পে কতোজনের মৃত্যু ঘটেছে? রোড অ্যাকসিডেন্টে কতোজনের মৃত্যু ঘটেছে? কতো মানুষ পঙ্গু হয়েছে? এসব তথ্য জানার জন্য এবং প্রতিকার বিধানের জন্য শাহবাগ স্কোয়ার থেকে দাবি ওঠা উচিত ছিল। একজন মানুষের ফাঁসি দাবির পরিবর্তে হাজার হাজার মানুষের প্রাণরক্ষার আওয়াজ ওঠা উচিত ছিল। একজন জল্লাদের চাকরির পরিবর্তে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের দাবি করা উচিত ছিল। শাহবাগ আন্দোলনকারীরা এখনও তা-ই করতে পারেন এবং একইসঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি বন্ধ করতে। এ সবই বর্তমান সময়ের সাধারণ মানুষের দাবি।
শাহবাগ আন্দোলনকারীরা বলতে পারেন, শাহবাগের জনসংখ্যাই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের পরিচায়ক। কিন্তু এই ধারণা ভুল। তারা হয়তো সাধারণ মানুষের একাংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, বৃহত্ অংশের নয়। আমার এই কথাটি যে ভুল, সেটা প্রমাণের জন্য তারা দুটি চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন।
দুটি চ্যালেঞ্জ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি
এক. অভিযুক্ত বন্দি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে একদিনের জন্য প্যারলে একটি জনসমাবেশ করার অনুমতি দিলে সেই সমাবেশে জনসংখ্যা কতো হয়, সেটা তারা দেখতে পারেন।
দুই. যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দিনে শুধু কিছু নির্দিষ্ট স্থানে জনসমাবেশ ঘটানো সম্ভব, সেহেতু এই চ্যালেঞ্জে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিজয়ী হলেও সামগ্রিকভাবে দেশে কোন পক্ষে কতো মানুষ আছে, সেটা জানার জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একই দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিন।
সুকুমারবৃত্তির নয়, নিষ্ঠুরতার প্রকাশ
বস্তুত বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি তুলেছে সেখান থেকে এবং আওয়ামী সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের চোখ সরানোর লক্ষ্যেই আওয়ামী সরকার শাহবাগ সমাবেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, আইন ও আদালতবিরোধী এই জনসমাবেশকে সরকারি অনুমোদন দিয়েছে।
শাহবাগ আন্দোলনের কিছু বৈপরীত্য কল্পনাকে হার মানিয়েছে। মোমবাতি, আলপনা ও গান মানুষের সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু সেখানে শোনা গেছে মোমবাতির নরম আলোর বিপরীতে আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো গরম স্লোগান। আলপনার সৌন্দর্যের বিপরীতে দেখা গেছে ফাঁসিকাঠের পুতুল ও ফাঁসির দড়ির নিষ্ঠুরতা। সারল্য ও নিষ্পাপতার প্রতীক শিশুদের মাথায় দেখা গেছে ফাঁসির নির্মম বাণীর হেডক্যাপ, তাদের হাতে দেখা গেছে ফাঁসি চাই লেখা কেক-পেসটৃ।
এই শিশুরা কি বোঝে ফাঁসি চাই কী? তাদের সুকুমারবৃত্তি এভাবে নষ্ট করে দেয়ার অধিকার কোনো পিতামাতার আছে কি?
প্রসঙ্গত আমি শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ব্লগার রাজীবকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানাতে চাই। এ ধরনের নিষ্ঠুর অকাল মৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না। মানুষের মৃত্যু নয়—জীবনই কাম্য।
রাজীব নয়, দায়ী তার সমর্থকরা
আমরা কেউ জানি না রাজীব কেন খুন হয়েছেন। তবে আমি বলতে চাই লেখার উত্তর লেখাতেই কাম্য। রাজীব তার ব্লগে যা লিখেছিলেন, তাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতি আহত হয়েছে। বিশ্বে এখন প্রায় সাতশ’ কোটি মানুষ আছে, এদের মধ্যে যে কেউ ইন্টারনেটে ইসলামবিরোধী লেখা পোস্ট করতে পারে। তাতে বিচলিত হয়ে উগ্রমূর্তি ধারণ করলে ক্ষতি বই লাভ হবে না। এখানে যেটা বিবেচ্য সেটা হলো, রাজীবের আদর্শের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন এই দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও কিছু ব্যক্তি। রাজীব ব্যক্তি হিসেবে যা করেছেন, তাকে দলগত সমর্থন জানিয়েছেন তারা এবং সেভাবেই তারা দেশগত ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করেছেন। এটা নিন্দনীয় এবং বিপজ্জনক। গোটা দেশকে আজ নাস্তিক বনাম আস্তিকের গৃহযুদ্ধের দিকে পরিকল্পিতভাবে ঠেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুসারীরা।
যারা সুস্থ মানুষ, যারা শান্তি ও অহিংসায় বিশ্বাস করেন, যারা মমত্ব ও ভালোবাসায় আস্থা রাখেন, তাদের ওপর আজ গুরুদায়িত্ব পড়েছে বর্তমান নৈরাজ্য থেকে দেশের মানুষকে মঙ্গলের দিকে, নিয়মের দিকে, আইনের দিকে ফিরিয়ে আনার।
যুদ্ধাপরাধীরূপে সন্দেহভাজনদের বিচার চাইতে পারেন শাহবাগ আন্দোলনকারীরা, কিন্তু বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের দাবি তারা তুলতে পারেন না। আশা করবো, ফাঁসির দাবি, তা-ও বিচারবহির্ভূত এবং সম্মিলিতভাবে তোলাটা যে কতো অসভ্যতা ও বর্বরতা, সেটা সবাই অচিরেই বুঝবেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করা থেকে বিরত হবেন।
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে লেখা ও ম্যানিফেস্টো
আমি নিউজপেপার ও টেলিভিশনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করবো তারা যেন একটু কষ্ট করে, পড়াশোনা করে জানার চেষ্টা করেন কেন এবং কখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
এপৃল ১৯৮০-তে সউদি আরবের একজন পৃন্সেস প্রেমে পড়েছিলেন এক সাধারণ সউদি যুবকের। সউদি রাজপরিবার এই বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওই প্রেমিকযুগল দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ধরা পড়েন এবং উভয়েরই শিরশ্ছেদ করা হয়। ওই ঘটনায় বিশ্ববাসীর বিবেক তাড়িত হয় এবং বিবিসি তখন ডেথ অফ এ পৃন্সেস নামে একটি ডকুমুভি প্রচার করে। ওই ঘটনা ও মুভি আমাকে খুব আলোড়িত করে এবং আমি যায়যায়দিন নামে একটি ধারাবাহিক কলাম লেখা শুরু করি সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে। এ ঘটনাই আমাকে রাজনৈতিক লেখকরূপে নিয়ে আসে। ওই লেখার সূচনাতেই আমি ওই মুভির ক্লিপ দেখে প্রাণদণ্ডের তীব্র সমালোচনা করি এবং এখনো করে যাচ্ছি।
আমি এটাও আশা করবো, যদি ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয় এবং আজ যারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছেন, তারা যদি ক্ষমতায় আসেন, তখন যেন তারা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফাঁসির দাবি না তোলেন। ফাঁসি যেন তারা বাংলাদেশে চিরনিষিদ্ধ করেন। আমি আশা করি বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধকরণের অঙ্গীকার করবে।
মৃত্যু নয় জীবনে, ঘৃণায় নয় ভালোবাসায়
গৃহযুদ্ধে নয় শান্তিতে
আমি মৃত্যুতে নয়, জীবনে বিশ্বাসী।
আমি ঘৃণায় নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী।
আমি গৃহযুদ্ধে নয়, শান্তিতে বিশ্বাসী।
আমি ফাঁসির মঞ্চ ও দড়িতে নয়, গোলাপ ও চকলেটে বিশ্বাসী।
সবাইকে চকলেট উপহার দিচ্ছি।
সবাই এখন চকলেট খেলে খুশি হবো।
এতক্ষণ আমার কথা শোনার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
থ্যাংক ইউ।

গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন বই প্রকাশনা উপলক্ষে ভাষণ


জাতীয় প্রেস ক্লাব

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের হাতে



 এম আবদুল হাফিজ
স্বদেশের কোনো 'সাকসেস স্টোরি' শুনতে কার না ভালো লাগে! টিভির পর্দা এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় সেসব সফলতার কথা আমরা অহরহ শুনছি ও দেখছি। যে কোনো ভূখণ্ডের স্বাধীন সত্তাই সাফল্যের মহাসড়কে তুলে দেয় একটি জাতিকে। এক সময় আমাদের পরিসর ছিল বড়জোর করাচি-লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের দুর্দমনীয় তরুণদের জন্য সামনে এগোনোয় কোনো সীমারেখা নেই আজ। শুধু কর্মজীবী অভিবাসীই নাকি আমাদের রয়েছে এক কোটির মতো, যারা বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স পাঠায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কেউ কি কখনও এই পরিমাণ রেমিট্যান্সের কথা ভাবতে পেরেছিল! অথচ তাদের অভিবাসনের জন্য রাষ্ট্রের আদৌ কোনো অবদান থেকে থাকলেও তা সামান্যই।
কী করে সারাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে টিকে আছে! ওই একটি মন্ত্র স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ তাদের সেই প্রতিযোগিতায় উজ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যদিও তাদের অভিবাসনের প্রক্রিয়া অবশ্যই কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি। আমাদেরই জনশক্তি দালালরা তাদের পদে পদে প্রতারণা করেছে, এগোনোর পথে হোঁচট খাইয়েছে। আজ যখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে 'না' করে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলেন, তার নেপথ্য শক্তি ওইসব নাম-পরিচয়হীন, খেটে খাওয়া মানুষ; এ দেশের কোনো বিড়লা বা টাটারা নয়।
এই শক্তির আরও উৎস আমাদের কৃষককুল, যারা একটুখানি প্রণোদনা পেলে একই মাটি থেকে অন্তত তিনগুণ অধিক ফসল ফলাতে সক্ষম। ১৯৭২-এ বাংলাদেশের বিপুল খাদ্য ঘাটতি ছিল, যা সদ্যস্বাধীন দেশটি উত্তরাধিকারসূত্রেই সংযুক্ত পাকিস্তান থেকে পেয়েছিল। আজ ওই মাটি থেকেই খাদ্য উৎপাদন করে প্রয়োজনীয় আরও কয়েখ লাখ টন খাদ্য আমদানি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাদের কৃষকরা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছেন।
স্বাধীনতা এক অমূল্য সঞ্জীবনী শক্তি, যার স্পর্শে আমাদের ছেলেমেয়েরা অবলীলায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠে। ক্ষেতে-খামারে খাটে। দায়িত্বশীল পদ অলঙ্কৃত করে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার কারণে, যেখানে যোগ্যতা থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা উতরানো যায়। আমাদের নারী কর্মজীবীরা মানবসম্পদ সূচকে এই অঞ্চলে একটি ঈর্ষণীয় অবস্থান দখল করে আছে। অজপাড়াগাঁর ছমিরন-করিমনরা আজ পরনির্ভর না থেকে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে সূচিশিল্পে যোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করেছে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজারে। শোনা যায়, বিশ্ব গার্মেন্ট বাজারে এদেরই একাধিপত্য ভাঙতে বড় বড় প্রতিযোগী মাঠে নেমেও সাফল্য কুড়োতে পারেনি।
একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দেশে আমরা যে একেবারে খারাপ নেই বা আমরা যে নেহাত ব্যর্থ নই_ দেশটির চেহারা দেখলেও কি তা বিশ্বাস হয় না? আজ এ দেশে কাজের বুয়ারাও সেলফোন ব্যবহার করে। নিম্ন বেতনভোগী মেয়েরাও জিন্স পরে। আমি আমার বসবাসের এলাকায় ঠিকা ঝিদেরও নগ্ন পায়ে দেখি না। একটি সাফল্যের চিত্র আমাদের মতো দেশেও সুদূরপরাহত নয়। প্রান্তিক জনগণও এখন আশাবাদী এবং তারা কষ্ট-দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও সে আশাবাদ পোষণ করে এবং নগদ নগদ জীবনকে উপভোগ করতে চায়। সরকারি আনুকূল্যের অযথা প্রতীক্ষায় না থেকে তারা নিজেরাই তাদের সমস্যার জট খুলতে চেষ্টা করে। এটাই হলো এ দেশের ইতিবাচক দিক এবং সাফল্যের চালিকাশক্তি।
তবে হরিষে বিষাদও আছে। যখন দেশের অমিত সম্ভাবনার স্বপ্নে আবিষ্ট কোনো এক সংবাদপত্রে পড়লাম একটি প্রচণ্ড নেতিবাচক সংবাদ, যার কিয়দংশ সত্য হলেও বুঝতে হবে যে, আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনা এখনও চোরাবালিতে আটকে আছে। এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নাকি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর অর্থ এক বিশাল সংখ্যার মানুষ, যার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ বা ছয় কোটির মতো, এরা পেটপুরে খেতে পায় না। এরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত। এদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন বা বিনোদন কল্পনার বস্তু।
মনে সংশয় জাগে যে, এত সম্ভাবনা ও অর্জন সত্ত্বেও এত মানুষ বঞ্চিত হবে কেন? তাহলে এদের প্রাপ্য অংশ কোথায়, কার হাতে যায়? জানি, যে যখন দেশ শাসন করে সেই ক্ষমতাসীনরা এক প্রকার বিধিপ্রদত্ত নিয়মেই শাসিতদের অংশে ভাগ বসায়। দেশের সব সম্পদেই থাকে তাদের অলিখিত অংশ ও অগ্রাধিকার। তাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত হলেও আমাদের প্রশাসন নামক শ্বেতহস্তীর পাওনা তো গুনতেই হবে, যদিও দেশের অর্জনে তাদের দৃশ্যমান কোনো অবদানই নেই।
আরও আছে অনেক পাওনাদার। আছে দলীয় ক্যাডার, আছে ছাত্রলীগের হাতবদল হয়ে অনেক কষ্টে ও স্ফীতোদর; তাদের কাছ থেকে পাওয়া অতি মহার্ঘ টেন্ডার, মন্ত্রী-আমলাদের 'আখের গোছানোর' বিশাল ব্যয়ের বহর। আরও আছে মোসাহেব-চাটুকারদের পাওনা। সরকারকেই বা দোষ দেব কী করে? আমাদের দেশে সরকার পরিচালনার ঝক্কি-ঝামেলা কি কম? মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সামলাতে দরিদ্র পিতার বিপন্ন অবস্থার মতো।
দুঃখ হয়, যে অর্জন বা দেশের সম্পদগুলো ঠিক হাতে কদাচিৎ পেঁৗছতে পারে! তার পরিবর্তে সেগুলো অবধারিতভাবে চলে যায় নষ্টদের হাতে। নষ্টরা তা দিয়ে ভোগবাদে লিপ্ত হয়, ইয়াবা সেবন করে। পচে বখে যায় তাদের চরিত্র-নৈতিকতা। কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন কিছুতেই ভাঙা যায় না। আমাদের কোনো প্রতিবাদ বা পর্যবেক্ষণ এমনকি তা সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ক্ষমতাধরদের দৃষ্টিসীমানা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। মূল্যায়ন হয় না কোনো মহৎ উদ্দেশ্যেরও। কেননা, এখানে যে সবকিছু চলে গেছে নষ্টদের হাতে।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক

বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

শাহবাগ নাটক


আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

ছাত্রশিবিরের আন্দোলন মোকাবিলায় বেসামাল সরকার যখন হিটলার কিংবা চেঙ্গিস খানের মতো নৃশংসতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করছে ছেলেদের, তুলে নিচ্ছে চোখ, পশুর মতো পিটিয়ে করে দিচ্ছে বিকলাঙ্গ, তখন সেসব নিয়ে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না শাসকরা। তারা বাংলাদেশের মানুষের গণদাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পদ্মা সেতু কিংবা হলমার্কের মতো পাহাড় সমান ইস্যুগুলোকে পাথরচাপা দিয়ে, নিজেদের দূষিত মুখ ডিসটিলড ওয়াটারে ধুয়ে ফের বীর হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য একাত্তরের শত্রু উচ্ছেদের নামে নয়া এজেন্ডা সামনে ঠেলে দিয়েছে। এ কাজে ব্যবহার করছে ডাণ্ডাবাজ ছাত্রলীগ, পেটোয়া যুবলীগ এবং নিজ গৃহে পালিত সাংস্কৃতিক কর্মীদের। আর জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আবরণ হিসেবে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে কিছু আবেগাক্রান্ত তরুণকে। কারণ তাদের বয়সটাই এ রকম যে যুক্তির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে হৃদয়। এই হৃদয়কে বুদ্ধিমান যে কারও পক্ষে আবেগের স্রোতে ভাসিয়ে নেয়া সম্ভব। এই আবেগের স্রোতে বাংলাদেশের তরুণদের ব্যবহার করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সস্তা বুলিসর্বস্ব স্লোগান তুলে বাংলাদেশের তরুণদের ঠেলে দিয়েছিল শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনীসহ নানা ঘাতকদের মুখে। গঠন করেছিল গণবাহিনী। হাজার হাজার তরুণ সে সময় একটি আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে ভুল নেতৃত্বের চোরাবালিতে আটকে অকাতরে প্রাণ হারায়। সেসব নিহত তরুণের রক্তের ওপর পা দিয়ে, তাদের আত্মাহুতির সঙ্গে বেঈমানি করে ইনু সাহেবরা এখন মজাছে মন্ত্রিত্ব করছেন। সেজন্যই তাদের কাছে আমার আবেদন, সস্তা চটকদারি কথায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। দেশের ভেতরকার বিভাজন রেখাকে উত্পাটন করে সমন্বয়ের পথে তাদের এগোতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যারা বেশি বেশি বলে বেড়ায় তাদের সন্দেহ করতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, শহীদ মুনির চৌধুরী, কবির চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিমের মতো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরাও কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আজকের শাহরিয়ার কবির কিংবা মুনতাসির মামুনরাও কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেননি। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে বিভেদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হননি। যারা এই চেতনাকে হরদম দলীয় সম্পত্তি বানিয়ে ফেরি করে ফেরে, তাদের সত্যিকার মতলব চিনতে হবে। যদি এই শক্তির স্বরূপ উদঘাটন করতে আমাদের তরুণরা ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা থাকবে না। বাংলাদেশ পরিণত হবে আরেকটি হায়দারাবাদ কিংবা সিকিমে। আরেকটি বাকশালী ফ্যাসিবাদে জর্জরিত হবে দেশ। এই বাকশালের পদধ্বনি শাসকদল তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে দেশময়। নইলে যুদ্ধাপরাধীদের নাম করে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেসব ভয়াবহ উচ্চারণ করানো হয়েছে তা দেশে ডেকে আনবে নৈরাজ্য, বিপর্যয় ও গৃহযুদ্ধ। জামায়াত-শিবির দমনের ছদ্মবেশে তারা আসলে চাচ্ছে দেশপ্রেমিক শক্তির সমূলে উত্পাটন।

দুই.

গিরিশ কনরাডের ‘তুঘলক’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র যদি হন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাহলে বলতে হবে তার চাহিদা মোতাবেক রচিত নাটকের এখন চতুর্থ অংকের অভিনয় হচ্ছে। সর্বত্র এই অভিনয়ের প্রযোজক, পরিচালক, কুশীলব সবকিছুর জোগানদাতা তার সরকার ও শাসক দল। বাদবাকিরা হয়তো তার অদৃশ্য ইশারার ‘বড়ে’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চতুর্থ অংকের চূড়ান্ত দৃশ্য এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি শাহবাগে।
যারা এর মূল আয়োজক ছিলেন, যারা কাজটি শুরু করেছিলেন এরা এখন পার্শ্বচরিত্র। তারা সূচনা করে দিয়ে মাইক্রোফোন ও মঞ্চ তুলে দিয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি ছক অনুযায়ী শাহবাগ স্কোয়ারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন সরকার অনুগতদের দখলে। আমাদের মহামহিম সরকার এখানে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার কাজটা করেছে।
এই পাখি মারার কৌশল হিসেবেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের জন্ম দিয়েছিল। তারপর জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হলো। সমস্যা দেখা দিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যে ১৯৫ জনকে স্বয়ং শেখ মুজিব চিহ্নিত করেছিলেন তারা তো আওয়ামী লীগকে ‘টা টা’ দেখিয়ে কবেই পগারপার হয়ে গেছে। সে তালিকায় তো বর্তমান অভিযুক্তদের নাম ছিল না। তো কী করা। এবার ট্রাইব্যুনালকে কিঞ্চিত্ প্রলেপ মাখিয়ে বলা হলো একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবে তারা। তারপর অনুগ্রহভাজন লোকদের এনে বানানো হলো কাঠামো। দলীয় উকিল-মোকতারদের নিয়োগ দিয়ে দাবি করা হলো ‘আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। সাক্ষী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে চললো কৃত্রিম প্রমাণ উপস্থাপনের মচ্ছব। অর্থাত্ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। যদি তা না হতো, তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের নাম দিয়ে দলীয় আইনজীবী, দলীয় তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশীয় বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হতো না। ট্রাইব্যুনালের ‘পদত্যাগী’ চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে নিয়ে তো শুরুতেই বিতর্ক দানা বাঁধে। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনিই একবার এর বিচার করেছেন। এ ধরনের বিতর্কিত লোক দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকারই সৃষ্টি করে চরম বিতর্ক। এখানে আন্তর্জাতিক শব্দটি ছাড়া আর কিছুই আন্তর্জাতিক মানের নেই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন :
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাধা প্রদানকারীরাও সমান অপরাধী’—এই বক্তব্যকে সমর্থন করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে যে আইনে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের বিচার হচ্ছে, এই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তান আর্মির ৪৫ হাজার সেনাসদস্যের ভেতর থেকে গুরুতর অপরাধী হিসেবে ওই ১৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শেখ মুজিবেরও মরণোত্তর বিচার দাবি করতে পারে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে নিয়ে শাসক দল দেশজুড়ে যে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে, সে সম্পর্কেও খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
আমি ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ছিলাম। ওই সময় দালাল আইনে বিচারের জন্য পাকিস্তান আর্মির এদেশীয় ২৮ হাজার সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের আটক করা হয়েছে, ওই ২৮ হাজার বন্দীর মধ্যে এরা কেউ ছিলেন না। এরা যদি এতই ভয়ঙ্কর অপরাধী হতেন, তাহলে এদের একজনকেও ওই সময় গ্রেফতার তো দূরের কথা, এদের কারও বিরুদ্ধে দেশের কোনো একটি থানায় একটি জিডিও করা হলো না কেন? তিনি বলেন, যে কাদের মোল্লাকে এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তিনিই স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি যদি ‘কসাই কাদের কিংবা জল্লাদ কাদের’ হন, তাহলে আজ যারা তার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা কেন তাকে ওই সময় আটক করে পুলিশে দিলেন না? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আজ সাধারণ জনগণের মাঝে। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দালাল আইনে আটক করা হয়েছে। এখন তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই সময় তার বাবার সঙ্গে তাকেও কেন গ্রেফতার করা হলো না কিংবা তার নামে একটি মামলা বা জিডি করা হলো না? মূলত সরকারের কিছু লোক তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নেই। মানুষ চায় এখন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হোক।

তিন.

সারা পৃথিবী বললো এই আদালত গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিধি মোতাবেক হয়ইনি। কিন্তু সরকারপ্রধান থেকে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী কর্মীরা পর্যন্ত বললেন, এরকম অনন্যসাধারণ আদালত এদেশে আর হয়নি। এটা পুরোপুরি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ।
এর মধ্যে বোমা ফাটালো দ্য ইকনোমিস্ট। বিস্ফোরণ ঘটালো দৈনিক আমার দেশ। স্কাইপ কথোপকথনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো এর অন্তঃসারশূন্যতা। প্রমাণিত হলো এ কোনো আদালত নয়—এটা হলো কিছু মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য আইনি লেবেল লাগানোর একটা পদ্ধতি।
বাধ্য হয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করে একে আরও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণিত করে দিলেন। তারপরও সরকারের মন্ত্রীরা গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে বলে বেড়াতে লাগলেন, এই আদালত সুন্দর, এই আদালত স্বচ্ছ। আর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব ক’জন অভিযুক্তকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।
আশ্চর্য, বিচারের আগেই মন্ত্রীরা রায় ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন। রায় বেরুলো মওলানা আবুল কালাম আজাদের ফাঁসি। মহাখুশি আওয়ামী মহল। ধন্য ধন্য করে উঠলো আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রাঙ্গণ। তাদের জোটের ছাগল-পাগলগুলোও তিড়িং বিড়িং করে বাড়ি মাথায় তুললো।
এই আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেই রায় বের হলো আবদুল কাদের মোল্লার। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল তাদেরই আদালত। এবার উল্টো প্রতিক্রিয়া। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, পাতি নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত সবাই চিত্কার শুরু করে দিলেন এই রায় মানি না। এই বিচার মানি না। জামায়াত তো আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারাও এই রায় মানে না।
জামায়াতের আস্থা, আন্তর্জাতিক বিশ্বের আস্থা তো আগে থেকেই ছিল না। এবার সরকার এবং তাদের অনুগ্রহপ্রাপ্তদের আস্থাও গোল্লায় গেল। দেখা যাচ্ছে এই আদালতের ওপর কারও কোনো ভরসা নেই, আস্থা নেই, গ্রহণযোগ্যতাও নেই।
আওয়ামী লীগের লেগেছে ইজ্জতে। নাকি এটাও নতুন কোনো চাল? কে জানে? তারা আদালতকে বাধ্য করার জন্য ছাড়তে লাগলো হুঙ্কার। পাশাপাশি গগণবিদারী স্লোগান। অনুগত দু’একটি বাম দল এই হুঙ্কারে উদ্বেলিত হয়ে জায়গা নিল শাহবাগ মোড়ে। তাদের গান-বাজনা, বক্তৃতা-বিবৃতির পথ ধরে মাঠে নামলো ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর কিছু তরুণ যারা নিজেদের ব্লগার পরিচয় দিতে পছন্দ করে। আসলে এরাও আওয়ামী লীগের অন্য ধরনের ক্যাডার। তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে—আদালতকে বাধ্য করার জন্য জড়ো হলো। শাহবাগ স্কোয়ার ভরে উঠলো জনসমাগমে। বুঝতে বাকি রইলো না, যারা জড়ো হলেন তাদের ৯৫ ভাগই আওয়ামী লীগের লোকজন। সবার একটাই ‘স্বপ্ন’—শাহবাগ স্কোয়ারকে ‘তাহরির স্কোয়ার’ বানাবেন। এই জনসমাগমকে জনসমুদ্র বানানোর কাজটিও অবশ্য সরকারই করে দিয়েছে।
শাহবাগ স্কোয়ারের আওয়াজকে আরও বুলন্দ করে দেশময়, বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কৃতজ্ঞতাভাজন মিডিয়া উঠলো কলকাকলীমুখর হয়ে।
তাহরির স্কোয়ারে মহাসমাবেশ হয়েছিল স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে। জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের শাহবাগের দাবিতে সেসব কিছু নেই। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড, গুম, ধর্ষণ, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, টিপাইমুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিধ্বস্ত বিচার ব্যবস্থা, মরণোন্মুখ শিক্ষাঙ্গন এখানকার এজেন্ডায় ঠাঁই পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়।
শাহবাগের এক দফা এক দাবি। ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত বিচারাধীন সবাইকে ফাঁসি দিতে হবে। তাদের বক্তব্যে, আদালত মানি, বিচারও মানি। কিন্তু রায় হতে হবে আমাদের দাবি মোতাবেক। যে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে, তাকেও রায় বাতিল করে ফাঁসি দিতে হবে। অর্থাত্ এক ধরনের জুডিশিয়াল কিলিং শুরু করতে হবে। এই প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন : আইন ও আদালতকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। আন্দোলন, বিক্ষোভ ও সংগ্রাম করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে। সরকারি দল এখন তার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করছে। ওই বিক্ষোভে কেন্দ্রীয় নেতারা এমনকি মন্ত্রীরাও গিয়ে ফাঁসির দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে আরও মামলার রায় অপেক্ষমাণ। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে একটি মেসেজ যাচ্ছে। সামনে যদি কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক হবে যে, বিচারকরা সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ভয়ে এই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বিচারকদের ঘাড়ে ক’টি মাথা যে তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় দেবেন? কাজেই আমি বলব, ফাঁসির দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন এমনকি ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতেও যারা আন্দোলন করছেন, তারা ঠিক কাজটি করছেন না। এতে করে দেশ ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যেই আদালত গঠন করুক না কেন, বিচারকরা ‘নিউট্রাল’ বিচার করবেন—এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। আদালত রায় দিয়েছেন। সংসদে সরকারি দলের এমপিরাও এ নিয়ে কথা বলছেন। এটা বড়ই দুঃখজনক। তিনি বলেন, আদালত বা রায় নিয়ে হরতাল ও অবরোধ করা উচিত হচ্ছে না। হরতাল বা অবরোধ করে ফাঁসি দেয়া যাবে না। এতে দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিচারকরা সব সময় ভয়ে থাকবেন। এসব করে যদি আদালতের কাছ থেকে ফাঁসি আদায় করা হয়, সেটা হবে দুঃখজনক। ব্যারিস্টার হক বলেন, রায়ের পর পুলিশ প্রটেকশনে বিক্ষোভ হচ্ছে। মন্ত্রীরা সেখানে গিয়ে বলেছেন—এ রায় মানি না। তাহলে বিচারকরা কী করে তাদের রায় দেবেন? যেভাবে ফাঁসির দাবি উঠেছে, বিচারকদের তো ফাঁসি না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে যে রায় দেবেন তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফাঁসির আদেশ না দিলে, যে বিচারক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি তার কী অবস্থা হবে! তার ফ্যামিলির কী অবস্থা! কে তাদের প্রটেকশন দেবে?
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশকে একটা আইডিয়াল সিচুয়েশনে আসতে হবে। অ্যাবনরমাল সিচুয়েশনে থাকবে তা কিন্তু কেউ চায় না।
দেশ যখন আদালত ও তাদের রায় নিয়ে সরকারের কাণ্ড-কারখানা দেখে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় অধীর, আদালত যখন পরিষ্কার হুমকি ও ধমকের মুখে, সেই সময় শাহবাগ চত্বরের উদ্যোক্তাদের একজন আরিফ জেবতিক্ বলেছেন, ‘আমরা চাই ট্রাইব্যুনাল মাথা উঁচু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করুন।’ আস্থাহীন, গ্রহণযোগ্যতাহীন, স্বচ্ছতাহীন একটি আদালত রীতিমত ভীতির মুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে মাথা উঁচু করে রায় দেবে আল্লাহ মালুম।
আবার মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, আইন ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা যার প্রধান কাজ— তিনি বলেছেন, সব সময় আইনই বড় কথা নয়। মানুষ কী চায় সেটাই বড়। এসব কথা বা বক্তব্য যে তাদের মূল এজেন্ডা নয় তা বোঝা গেল গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার থেকে। ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির মুণ্ডুপাত করা থেকে। একই সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্মূল করার জন্য আড়াই হাত লাঠি ব্যবহারের নির্দেশ থেকে। বোঝাই যাচ্ছে দেশ ধ্বংস করে, দেশের মানুষকে হত্যা করে হলেও এই অপশক্তি আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে মসনদ। মনে হচ্ছে এজন্য বাইরের হস্তক্ষেপ চাইতেও তারা ইতস্তত করবে না।

চার.

আমি আগেই বলেছি, এখনও বলি, শাহবাগ চত্বরে যে তরুণরা জড়ো হয়েছে তাদের আমি ছোট করে দেখতে চাই না। মমতা দিয়েই দেখতে চাই। কারণ তারা আমারই মতো কোনো না কোনো পিতার আদরের সন্তান। কিন্তু তাদের আচরণ-উচ্চারণ আমাকে স্তম্ভিত করেছে। তাদের জন্য আমার একটাই কথা, আমাদের রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে পচিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের শাসকদের ভূমিকা অগ্রণী। তারা তোমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে, দেশের সব সমস্যা ও সঙ্কট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, নিজেদের কৃত পাপকে ধামাচাপা দিয়ে, জনগণকে বোকা বানিয়ে আবারও ক্ষমতায় থাকার ষড়যন্ত্র করছে। তোমাদের আবেগের সমুদ্রে ভাসিয়ে গোছাতে চাচ্ছে নিজেদের আখের। সেজন্য তোমাদের সতর্ক থাকাটা জরুরি। সরকারি লোকজনের দেশের বাইরে বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু তোমাদের আছে শুধু এই দেশটি। এই বাংলাদেশ। সেই একমাত্র থাকার জায়গাটি যাতে নষ্ট না হয়, যাতে এর অস্তিত্ব বিলীন না হয় সেজন্য তোমাদেরকেই তো লড়তে হবে। দেশ রক্ষার সেই লড়াইয়ের ময়দান থেকে কেউ যাতে তোমাদের সরাতে না পারে সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। বিভেদ আর হানাহানির ভেদবুদ্ধি নিয়ে নানা রঙে, নানা পোশাকে অনেকেই আজ তত্পর। সেই তত্পরতা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান তোমাদের থাকতে হবে। যদি তা অনুধাবনে ব্যর্থ হও তাহলে ইতিহাস তোমাদেরও ক্ষমা করবে না।
তরুণদের জাগরণ চাই, সমস্ত অন্তর দিয়ে চাই। কারণ তারাই পলাশীর মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা রক্ষার। তাদেরই পূর্বসূরি তিতুমীর সামান্য বাঁশের কেল্লা বানিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সবই সংঘটিত হয়েছিল তরুণদের জন্য। তরুণরা না জাগলে দেশ জাগে না। এখন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের কর্তব্য হবে তারুণ্যকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। তারা কেন বিশেষ দলের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হবে?

পাঁচ.

শাহবাগে সরকার প্রযোজিত, পরিচালিত ও অভিনীত যা কিছু হচ্ছে তার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছি। তারপরও দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের উদ্দেশ্যে বলতে চাই—কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকবেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ কখনও যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে না। পারে না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও পাবেন না। পারবেন না এই সরকারকে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে বিতাড়িত করতে।
শাহবাগের চতুর্থ অংকের ফসল শেখ হাসিনা ঘরে তুলতে পারবেন কি-না জানি না। তবে পঞ্চম অংকের দৃশ্যগুলো যে দেশকে টালমাটাল করে দেবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সেই দুঃসময় যদি আসে, তাহলে দেশপ্রেমিকরা যেন সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতির মধ্য দিয়ে দেশ রক্ষার কাজটি ঠিকমত সম্পাদন করতে পারেন সেই আশায় ব্যাকুল হয়ে রইলাম।
a_hyesekder@yahoo.com