সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাহবাগ ধর্ম-অধর্মের নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ


মাসুদা ভাট্টি
শাহবাগের আন্দোলনকে এখন বহুধাবিভক্ত করে এর ভেতর থেকে ‘ফায়দা লুটেরাশ্রেণী’ এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিশেষ করে শাহবাগের আন্দোলনে ধর্মকে ব্যবহারের যে নগ্নতা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এদেশে বহু পুরনো ও বহু ব্যবহৃত একটি কৌশল। মজার ব্যাপার হলো, দেশে দেশে এই কৌশল পুরনো হলেও বার বার ব্যবহৃত হয় এবং জনগণকে উস্কানি দিতে এর চেয়ে চরম কোন পথ আর নেই বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তান আমলে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে কলকাতার ৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় হাত রাঙানো ও অভিজ্ঞ মিনা পেশোয়ারীকে ঢাকায় ভাড়া করে এনেছিল পাকিস্তানী শাসককুল এবং তারই হাতে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আজকে হয়ত পাকিস্তানী শাসককুল নেই, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা রয়েছে; রয়েছে তাদের বেতনভুক কিছু রাজনৈতিক দলও, আজকে যাদের মিনা পেশোয়ারীকে ভাড়া করার নেই। কারণ এ দেশের ভেতরই রয়ে গেছে মিনা পেশোয়ারীর মতো ভয়াবহ দজ্জালের বংশধর, যারা পত্রিকার পাতায় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম ও অ-ধর্মের আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। আমরা এ রকম ঘটনা দেখেছি ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে, যখন ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ নামে টিভি-অনুষ্ঠান নির্মাণ করে এক হাতে কোরান শরীফ আরেক হাতে গীতা নিয়ে মানুষের সামনে দেখানো হয়েছে কারা ক্ষমতায় গেলে কোন্্ ধর্মগ্রন্থ প্রাধান্য লাভ করবে এবং মানুষকে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলু ধ্বনি শোনা যাবে। আজও তারাই নেমেছে শাহবাগ থেকে ইসলাম-আক্রান্ত হচ্ছে বলে ন্যক্কারজনক প্রচারণায়। বিশেষ করে গত শুক্রবার থেকে এই প্রচারণার ফলেই শাহবাগ আন্দোলন এখন বলতে গেলে বেশ বড় ধরনের হুমকির মুখোমুখি। গত সপ্তাহে আমার কলামের পাঠকদের আমি এই ভয়ের কথাটিই বলতে চেয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা এত তাড়াতাড়িই ফলে যাচ্ছে দেখে আমি রীতিমতো শঙ্কা বোধ করছি।
শাহবাগ কোন দীর্ঘ প্রস্তুতিময় আন্দোলন নয়, বরং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি বহুত্ববাদী আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই এ রকম আন্দোলনে ‘নানা মুনি নানা মত’ থাকে এবং এখানেও রয়েছে। কিন্তু একটি জায়গায় এই আন্দোলন তীব্র ও সংগঠিত আর তা হলো, দেশে যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের মতো ইসলাম-ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিষিদ্ধ করা। এই দুই শক্তিশালী দাবি এখন সময়ের, এবং শাহবাগ তা প্রমাণ করেছে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এই দাবি জনগণের এবং জনগণ এই শাহবাগে এসে রাজনৈতিক অবস্থান বা বিশ্বাস থেকে নয়, বরং আত্মার দাবি হিসেবে এই দু’টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং এই দাবি কেবল সরকারের কাছে নয়, বরং দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির কাছেই। জনগণ প্রতিনিয়ত বলছে যে, আপনি যে দলের রাজনীতিই করুন না কেন, আপনি যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারবেন না; আপনাকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবির সঙ্গে একমত হতে হবে। অপরদিকে তারা সরকারকে বলছে যে, এই দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার কিন্তু শাহবাগের এই প্রাণের দাবিটি ঠিকই বুঝেছে এবং সে অনুযায়ী কাজও করছে বলে মনে হয়। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে যে, আসলে সরকার কতটা আন্তরিক? আমরা জানি যে, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও আমরা বহু সময় পার করেছি কিছুই না করে; এমনকি বিচার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়েও আমরা অযতœ-অবহেলা লক্ষ্য করেছি। শুধুমাত্র বিচার প্রক্রিয়া শুরু করাই মুখ্য নয়, এই বিচার থেকে যেন যুদ্ধাপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পায় তাও নিশ্চিত করাটা সরকারেরই দায়িত্ব। কারণ এই সরকার তো কেবল একটি ‘সরকার’ নয়, বরং এই সরকার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার; এই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। মানুষ তাই এই সরকারের কাছে অনেক বেশি কিছুই আশা করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে তা হলো, শেখ হাসিনা সরকারের অন্য অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতিও মানুষ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে রাজি, যদি এই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইস্যুর চিরস্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হয়। যে কারণে মানুষ শাহবাগ আন্দোলনকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, অহিংস এবং দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ধরে নিয়ে এতে অকাতরে অংশগ্রহণ করেছে। এখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই রয়েছে এবং গত সপ্তাহেই বলেছি যে, এই আন্দোলনের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে; এটি কেবলমাত্র ব্লগারদের আন্দোলন নয়। গত সপ্তাহের লেখায় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামটি উল্লেখ করতে ভুলে যাওয়ায় আজকের লেখায় আমি সে ভুল স্বীকার করছি এবং একথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই যে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এই আন্দোলন সর্বজনীন রূপ লাভ করেছিল এবং এই শাহাবাগেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিন্তু কথা হলো, আমরা আন্দোলন করছি ঠিকই; তবে আমাদের শত্রুপক্ষের ক্ষমতাকেও আমরা কোনভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না এবং দেখা উচিতও হবে না। কারণ আমাদের শত্রুরা আসলে কেবলমাত্র মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরুদ্ধবাদী, তাই-ই নয়; তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বেরও শত্রু। সুতরাং তারা তাদের অবস্থানকে নিশ্চিত রাখার জন্য প্রয়োজনে যে কোন পথ গ্রহণ করবে; এখানে রগকাটা, গলাকাটা কিংবা বোমা হামলা তুচ্ছ ঘটনা মাত্রÑ এসব সবই এতদিন তারা ঘটিয়েছে অনায়াসে। এখন তারা আরও শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ়। সুতরাং তাদের নতুন পথ ও কৌশল ধরতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না, হচ্ছেও না। মজার বিষয়টি হচ্ছে, তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করেছে ঠিকই, কিন্তু যখনই শাহবাগের আন্দোলন তাদের দেশব্যাপী বিপদে ফেলেছে তারা ঠিকই বিএনপিকে পুরোপুরি নিজেদের করে ফেলতে চাইছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে, বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আদৌ থাকবে কি না? যদি সরকার আসলেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সেক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক অপশক্তিটি কোন্্ প্ল্যাটফরমে গিয়ে ঠাঁই নেবে? স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র কথাটি এসে যায়। কেউ কেউ একথাও বলতে শুরু করেছেন যে, আজকে যে বিএনপি আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা আসলে খোলশ মাত্র, এই খোলশের ভেতর আসলে পুরোটাই জামায়াতি রাজনীতির শক্তিটি বোঝাই হয়ে আছে। কথাটি খুব যে অসত্য তাই-ই বা বলি কি করে? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, দেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো বা ছিঁড়ে ফেলা কিংবা শহীদ মিনার ভাঙার মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের নিন্দা না জানিয়ে তারা জামায়াতের হরতালে সমর্থন দিচ্ছে নির্দ্বিধায়। শাহবাগের আন্দোলনকে তারা নাটক বলে যাচ্ছে কোন রকম রাখঢাক না রেখেই। এর পর আসলে আমাদের তো আর অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকেই না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায় যে, এত বড় গণজাগরণকে অস্বীকার করে বিএনপির মতো ভোটের রাজনীতি করা রাজনৈতিক দল যে ভুল করছে সেটা কি দলটির নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না? নিশ্চয়ই পারছেন। কিন্তু তারা হয়ত স্ট্রাটিজি ঠিক করে উঠতে পারছেন না, যা এই মুহূর্তে খুবই জরুরী।
শুরুতেই যে কথা বলছিলাম যে, শাহবাগের আন্দোলনকে ধর্ম-বিরোধী বলে আজকে যে চক্রান্ত চলছে তাতে অনেকেই পা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেনও। কারণ ধর্ম হচ্ছে এমনি একটি স্পর্শকাতর বিষয় যার অপব্যাখ্যা-অপব্যবহার করে সুস্থ বিবেককে অসুস্থ আর অস্থির করে তোলা যায়। এ কারণে আমি মনে করি যে, আজকে যারা এই নিন্দার্হ উস্কানি দিয়ে চলছে তাদের অবিলম্বে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং শাহবাগও এই দাবিটিই সরকারের কাছে বিগত সপ্তাহভর করে আসছে। ব্লগার রাজীবকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে চক্রান্তের উদ্বোধন হয়েছে তা শেষ হবে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দিয়ে এবং তা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিন্দনীয় করে তুলবে, সন্দেহ নেই। অনেক বিশ্লেষকই একথা বলতে চাইছেন যে, সরকারের জন্য শাহবাগ আন্দোলন একটি বড় সহায়ক-সিগন্যাল। কারণ মানুষ সরকারের চাওয়াটাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু এটাকে যদি ঠিকভাবে সমাপ্তির দিকে টেনে নেয়া না যায় তাহলে এই সিগন্যালই জনগণকে ভুল সংকেত দেখাতে শুরু করবে। জাহাজ যেমন ঝড়ের রাতে বাতিঘরের দেখানো আলোয় কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই পোতাশ্রয়ে স্থান করে নেয় তেমনই শাহবাগ নামক বাতিঘর থেকে দেখানো আলোয় সরকার যদি নিরাপদে আশ্রয় খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশ নামক এই নৌকোই পড়বে এক তীব্র ঝড়ের মুখে, আসলে আমরা এখনই এই ঝড়ের ভেতর অবস্থান করছি বটে। এই ঝড়কে আরো জোরদার করে তুলছে ধর্মীয় উস্কানি, অপরাজনীতির নোংরামি, স্বাধীনতা-বিরোধীদের অপকৌশল, লোক দেখানো মুক্তিযুদ্ধবাদীদের মিথ্যাচার ইত্যাদি নেতিবাচক প্রপঞ্চসমূহ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এর সঙ্গে যদি রাষ্ট্রের কোন কোন চালিকাশক্তির সরকারবিরোধী অংশ যোগ দেয় (ইতোমধ্যেই আমরা তাদের যোগ দেয়ার বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি) তাহলে যে ভয়ঙ্কর দানবীয় শক্তির উত্থান ঘটবে তার সঙ্গে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। এখনই যে যুদ্ধটিকে শাহবাগপন্থীরা বলছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ, সুরের বিরুদ্ধে অসুরের যুদ্ধ, অপরপক্ষ তাই-ই দমাতে চাইছে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার এই ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষটিকেই আরও শক্তিশালী করতে না পারলে নিরস্ত্র শাহবাগপন্থীরা তো রাজীবের মতো বলি হতেই থাকবে, নয় কি? সত্য প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে সত্যের পথকে নির্বিঘœ করার পুরস্কার সরকার নিশ্চিতভাবেই পাবে কিন্তু পুরস্কার লাভের জন্য সব সময়ই যে কঠিন পথ পার হতে হয়, প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের সেই সত্যটা জানা আছে তো?
ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ॥ সোমবার ॥ ২০১৩ ॥
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ।
সধংঁফধ.নযধঃঃর@মসধরষ.পড়স

1 টি মন্তব্য: