শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজনের খেলা আর কতকাল?




ইকতেদার আহমেদ
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার অর্জন করলেও তৎকালীন সামরিক শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে নানারূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে এ দেশে ১৯৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের মাধ্যমে অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। 
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-পরবর্তী সর্বাÍক অসহযোগ আন্দোলন শুর“ হলে কার্যত রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলা শহরের সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন জেলা শহরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ¯’ানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে যুবকদের গেরিলা যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের মধ্য প্রহরে অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলে ঢাকায় কেন্দ্রীভূত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে সচেষ্ট হয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝে সর্বাÍকভাবে এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তাদের এপ্রিল থেকে জুন অবধি লেগে যায়। এ সময়ে বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে অব¯’ানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতার প্রতিরোধে প্রাণ হারায়। বিভিন্ন জেলা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগমন পূর্ববর্তী গেরিলা যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। 
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ-পরবর্তী সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতার একটি অংশ ভারতে পাড়ি জমায়। ভারতে অব¯’ানকালীন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা সবাইকে অনধিক দু’মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে পাঠানো অব্যাহত থাকে। 
গেরিলা যুদ্ধ বলতে বোঝায় অনিয়মিত খণ্ডযুদ্ধ। আর গেরিলা যোদ্ধা হ”েছন খণ্ডযুদ্ধে নিযুক্ত ব্যক্তি অথবা নিয়মিত বাহিনীর বির“দ্ধে অনিয়মিত খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত রাজনৈতিক দলের সদস্য। নিয়মিত বা প্রচলিত যুদ্ধের (ঈড়হাবহঃরড়হধষ ধিৎভধৎব) সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধের (ঁেবৎরষষধ ধিৎভধৎব) পার্থক্য হ”েছ, প্রথমোক্ত যুদ্ধটি এক বা একাধিক স্বাধীন ও স্বীকৃত রাষ্ট্রের সরাসরি ও নিয়মিত যুদ্ধ। অপরদিকে শেষোক্ত যুদ্ধটি হ”েছ স্বাধীন ও স্বীকৃত রাষ্ট্রের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতা বা মুক্তিসংগ্রামরত অনিয়মিত বাহিনীর খণ্ডিত যুদ্ধ। তাছাড়া নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর পার্থক্য হ”েছ, নিয়মিত বাহিনীর সব সদস্যই পেশাদার এবং জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিয়মিত বাহিনীতে তাদের অন্তর্ভুক্তি, পক্ষান্তরে বিভিন্ন পেশা ও কর্মজীবীর সমন্বয়ে একটি বিশেষ লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে অনিয়মিত বাহিনীর গঠন এবং লক্ষ্য অর্জন সমাপ্ত হলে এর বিলুপ্তির মাধ্যমে কার্যক্রমের অবসান। 
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অনন্য, অম্লান ও অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সর্বাÍক সমর্থন ছিল। এ সমর্থনকে অবলম্বন করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতিটি বেছে নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশের গ্রামীণ জনসাধারণ অকৃত্রিম ও হƒদয় নিংড়ানো øেহ ও ভালোবাসায় আবদ্ধ রাখতে গিয়ে নিজেদের জানমালের নিরাপত্তাকে তু”ছ ভেবে সম্মিলিতভাবে সব ধরনের সাহায্যের হাত প্রশস্ত করেছিল। তারা যে শুধু খাদ্য, পথ্য, তথ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল তা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে নিজেদের ঘুম ও আরাম বিসর্জন দিয়ে রাতভর মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা দিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এমন হাজারও দুঃখজনক ও বিয়োগান্তক ঘটনা আজও আমাদের বিবেকবোধকে তাড়িত করে চলছে, যখন আমরা জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধাদের প্র¯’ান পরবর্তী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে ক্রোধের জ্বালা নিবারণার্থে নৃশংসভাবে আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীকে হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে পরিবারগুলোকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করেছিল। 
১৯৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের ৯৫ শতাংশের অধিক ভোটপ্রাপ্ত হওয়ায় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে বলতে গেলে এ দেশের আপামর জনগণের সমর্থন ছিল। যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল তাদের মধ্যে জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের নেতৃ¯’ানীয় অনেকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের সন্ধিক্ষণে প্রাণ হারান। মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত এমন কিছু ব্যক্তির পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার ঘটনাও বিরল নয়। তবে স্বাধীনতাবিরোধী নেতৃ¯’ানীয় অনেকেই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনে প্রাণ রক্ষায় সমর্থ হন। 
মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশের আপামর জনগণের সমর্থন থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলা ও খণ্ডযুদ্ধ প্রতিরোধে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমন্বয়ে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনে ব্রতী হয়। কিš‘ মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি এ দেশের আপামর জনগণের অকুণ্ঠ ও সর্বাÍক সমর্থন থাকায় তাদের সে প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। 
যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ছাড়া সবার নিরব”িছন্ন সমর্থন ছিল; কিš‘ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, যারা জেনারেল এমএজি ওসমানী, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান স্বাক্ষরিত সনদ সংগ্রহ করতে পেরেছেন, একমাত্র তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এইচএম এরশাদের শাসনামলে সনদপ্রাপ্ত সব মুক্তিযোদ্ধার সনদ জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদানপূর্বক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নানাবিধ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনঃপ্র¯‘তের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ তালিকায় অনেক সংযোজন ও বিয়োজন হয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব তালিকা প্র¯‘ত হয় তাতেও অনেক সংযোজন ও বিয়োজন লক্ষ্য করা যায়। এ সংযোজন ও বিয়োজন প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত আছে। সংযোজন-বিয়োজনের এ খেলায় একশ্রেণীর ব্যক্তির যে পকেট ভারি হ”েছ তা এখন আর গোপন কিছু নয়। ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স দু’বছর বৃদ্ধি করে সাতান্ন থেকে ঊনষাটে উন্নীত করা হলে একশ্রেণীর কর্মকর্তার মধ্যে যে কোন কিছুর বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের উš§ত্ত প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স ঊনষাটে উন্নীত করায় মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স একষট্টি বা বাষট্টিতে উন্নীত হবেÑ এ আশায় অনেক কর্মকর্তাই বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্তিতে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করছেন না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী অন্তত একজন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এ অবৈধ সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্তরা হয়তো ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে নিজেদের এহেন হীন কার্য থেকে বিরত রাখতেন।
দেশমাতৃকার ডাকে আÍত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেদিন যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন। আবার এমন অনেক ব্যক্তি সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন যাদের তৎকালীন বয়স বিবেচনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তাকারী দেশের এক ব্যাপক জনগোষ্ঠী অদ্যাবধি মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের জন্য কোন ধরনের স্বীকৃতি না পেলেও মুক্তিযুদ্ধের বির“দ্ধে অব¯’ানকারী কেউ যদি সনদ পেয়ে থাকেন তাতে অবাক না হয়ে উপায় কী! 
আমরা জš§দাত্রী মা’কে যেমন ‘মা’ বলে সম্বোধন করি, ঠিক তেমন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকেও ‘মা’ বলে সম্বোধন করি। জš§দাত্রী মায়ের ঋণ যেমন অপরিশোধযোগ্য, তেমনি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার ঋণও অপরিশোধযোগ্য। মায়ের আÍত্যাগের মতো মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য আÍত্যাগও অতুলনীয়। তাই জš§দাত্রী মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার কাছে কোন বিনিময় প্রত্যাশার সুযোগ আছে কি?
মুক্তিযুদ্ধকালীন এ দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল আওয়ামী লীগ যে হারে ভোটপ্রাপ্ত হয়েছিল, সে বিবেচনায় এ দেশের ৭ কোটি বিশ থেকে ত্রিশ লাখ লোক সক্রিয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এ বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের এ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবদান মূল্যায়নে আমরা যদি ব্যর্থ হই এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পদবি দ্বারা অলংকৃত করি, তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও আÍদান ম্লান হয়ে পড়ে। 
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ বছর অতিক্রান্ত হলেও অদ্যাবধি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি কোন আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় এর বহুবিধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অনেকের মতে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্ত্র ধারণ করে শত্র“র মোকাবেলা করেছিলেন একমাত্র তারাই মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকে বলেন, অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যারা যুদ্ধকালীন তাদের খাদ্য, পথ্য, তথ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে হয়রানি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। অনেকে বলেন, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তা করেছেন তারা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। 
অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশেরই বয়স ছিল ১৮ থেকে ৪৫ বছর। ১৮ বছরের নিচের বয়সের অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। সে নিরিখে ১৮ বছর বয়সে যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছিলেন, বর্তমানে তার বয়স ৫৮ বা ৫৯-এর ঘরে। কিš‘ বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির আইনের দ্বারা নির্ধারিত সংজ্ঞার অনুপ¯ি’তিতে সংযোজন ও বিয়োজন কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটি সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে সম্প্রসারিত হ”েছ। এ প্রক্রিয়ায় তালিকাটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের কেউ অন্তর্ভুক্ত হলে অবাক বিস্ময়ে বলতে হয়Ñ এটা বাংলাদেশ, এখানে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। 
দেশপ্রেম ও আÍত্যাগ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের আবালবৃদ্ধবণিতা মহান মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে। এতে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের বিষয়টি গৌণ। তাই মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা কী পেলাম সে হিসাবের পরিবর্তে আমরা দেশকে কী দিতে পারলাম এ হিসাবটি সঠিকভাবে করতে পারলে একদিকে পাওয়া না পাওয়ার সব দুঃখ-বেদনা ঘুচে যাবে, অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংযোজন-বিয়োজন খেলার অবসান ঘটবে। 
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট
রশঃবফবৎধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স 

এ আমরা কেমন সমাজ নির্মাণ করে চলেছি?

এ আমরা কেমন সমাজ নির্মাণ করে চলেছি?



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

এখন আমরা যে যার যেমন খুশি, তাই বলছি। যে যার যেমন খুশি, তাই করছি। এই যেমন খুশির কাতার থেকে ব্যক্তি, আইন, প্রশাসন, বিচার কেউই বাদ পড়ছে না। বিগত ৪১ বছরে বাংলাদেশ সম্ভবত এত বিপন্ন কখনো হয়নি। এ রাষ্ট্রে অর্থনীতি গেছে, কূটনীতি গেছে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার গেছে, যে কেউ যখন যাকে খুশি গুম-খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন করতে পারছে। বিচার হলো এই যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা সরকারের প্রকাশ্য মায় বুক ফুলিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসছে। মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে ডেকে তাদের ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। মাদক নিয়ে এখন আর রাষ্ট্রের কেউ চিন্তিত নয়। প্রশাসনের কেউ চিন্তিত নয়। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, হাজার হাজার বোতল আটককৃত ফেনসিডিল পুলিশ বুলডোজার দিয়ে ডলে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু তা এ দেশে আসার পথ রুদ্ধ করার কোনো পদপে কেউ নিচ্ছে না। অস্ত্র আসছে। মাদক আসছে। আমদানিকৃত পণ্যের বদলে দুই নম্বরি বিলাসসামগ্রী আসছে। সরকার কেবলই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। কিংবা একে উৎসাহিত করছে।
বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লিখে কেবল প্যানডোরার বাক্সের শেষ দুর্বল মৌমাছিটির মতো আশার আলো জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই। কেউ কেউ স্যাটেলাইট টেলিভিশনে গিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সবাই এখন প্রায় চ্যানেলে নিষিদ্ধ হতে বসেছেন। সরকার অমুক লোকদের আনতে হবে বলে যে আদেশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরে মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের টিভিতে আগমন বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সংবাদপত্রের মতোই শক্তিশালী। কারণ গ্রামগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। এবং নিরর সাধারণ মানুষও গভীর রাত পর্যন্ত ডিস লাইনের পাশে বসে থাকে। সেটিও বড় বেশি নিয়ন্ত্রিত।
সরকার আইন করেছে, কোন দেশের সাথে, কার সাথে তারা কী চুক্তি করবে, এটি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ দেশের নাগরিকদের জানার অধিকার নেই। সে অধিকার আইন করে রহিত করা হয়েছে। যে সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ বলে রায় দিয়েছেন, তারা কি ভেবে দেখেছিলেন যে, এর মাধ্যমে তার দেশ তার নির্বাচনী এলাকায় তার সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে ুণœ হতে পারে। সম্ভবত সেটি বিবেচনা করার কথা তারা চিন্তাও করেননি। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সংসদে একটা ইস্যুতেই কেবল তারা মুখ তুলতে সাহস করেছেন যে, বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ দিতে হবে। এর বাইরে রাষ্ট্র যে যায়, এমন সব আইন তারা শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে পাস করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা এরকম ‘হ্যাঁ’ বলায় ভারত তিতাস নদীর ওপর দিয়ে একেবারে নদী বন্ধ করে পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছিল, তাদের শত শত টন ওজনের ট্রেইলার পার করার জন্য। সেটা প্রায় মাস ছয়েক চালু ছিল। নদী হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, পানির প্রবাহ সব বন্ধ হয়ে গেছে। যে নৌকা সরাসরি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত পণ্য নিয়ে, তারা আর যেতে পারেনি। সরকার আশ্চর্য কথা বলল। বলল, তারা জানে না কারা এই নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, আপনারা কি জানেন কারা বাঁধ দিয়েছিল? গোটা এলাকার লাখ লাখ মানুষ জীবন-জীবিকায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল? সম্ভবত মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্যই এর জবাব দিতে পারবেন না। দিতে পারলে অনেক আগেই তারা মুখ খুলতেন। 
তার অর্থ হলো, যেকোনো কারণেই হোক সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও সংসদ সদস্যরা বোধ করি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন। তাদের কিছুই করার নেই। বলার নেই। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে দ্রুত পণ্য চাহিদা মেটাতে ওজিএল বলে এক লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছিল। তার নাম ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। এখন বাংলাদেশে সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স, যার যা খুশি, তাই বলে যেতে পারছেন। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই কিংবা জবাবদিহিতার প্রয়োজনও নেই। সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। খুন করতে চাও করো। নিজে করলেও তি নেই। না হলে হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করে একজন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করো। যে কাউকে খুন করো। কোনো অসুবিধা নেই।
সরকারও বলতে গেলে সে ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সব মহল থেকে অভিযোগ উঠছে, র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়ে কাউকে কাউকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তারপর তাদের আর হদিস মিলছে না। এটা শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। স্কুলছাত্র, কলেজছাত্র, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাই নির্বিঘেœ গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের সন্ধান দাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ধান তো করতে পারছি না, কী করব? এ রকমই চলছে সবকিছু। প্রতি েেত্রই সন্দেহ হচ্ছে, এসব গুম, খুন, সন্ত্রাসের সাথে সরকার জড়িত। তারা যে পারছে না, তা নিয়ে সরকারে যেহেতু কোনো মাথাব্যথা নেই, ফলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সরকার সত্যি সত্যি জড়িত। 
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা প্রতি পদে পদে ভয়ের সাথে চলি। ভীত হয়ে থাকি। এই যে বাসায় রওনা হলাম, বাসে কিংবা গাড়িতে। ফিরতে পারব তো? বাসে যদি যাই, তাহলে মনে হয়, বাস থামিয়ে কেউ একদিন বাসের ভেতরে জিজ্ঞেস করবে যে, এই বাসে রেজোয়ান সিদ্দিকী বলে কোনো যাত্রী আছে কি? খুব স্বাভাবিক যে, সৎ মানুষ হিসেবে আমি সাড়া দেবো। তারপর হারিয়ে যাবো। কেউ আর কোনো দিন আমার সন্ধান পাবে না। গাড়িতে যদি যাই, ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, কেউ যদি পেছন থেকে গাড়িতে আঘাত করে তাহলে ট্রাফিক সিগন্যাল-টিগন্যাল ভঙ্গ করে যেভাবে পারো দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করে যেখানে মানুষ বেশি সেখানে থামাবে। ড্রাইভার বলল, স্যার, থানার কাছে গিয়ে থামাব? আমি বললাম, কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ থানা এখন আর কোনো ভরসার স্থল নয়। জনগণই ভরসাস্থল। মহান আল্লাহ তায়ালার অপরিসীম রহমতে এখন পর্যন্ত বাসে বা গাড়িতে তেমন বিপদে পড়িনি। 
কিন্তু আমি বিপদে পড়িনি, এ দেশে শত শত মানুষ এভাবে বিপদে পড়ে গুম হয়ে গেছে। তাদের পরিবারের আর্তকান্না সরকারের হৃদয় স্পর্শ করেনি। এখন সম্ভবত দেশে কোনো সরকার নেই। ঘাতক আছে। লুটেরা আছে। সরকারের মদদে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের বন্দোবস্ত আছে। এবং সংসদে মাননীয় সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলে এমন এক বিধান পাস করেছেন যে, বিদ্যুৎ বিষয়ে কোনো যুক্তি বা কোনো বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আপনারা এমন আইন পাস করেছেন বটে, কিন্তু আপনারা সম্ভবত এই ধারণা করেন যে, শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন আপনার রাজনৈতিক পরিণতি এবং এলাকার জনগণের সাথে আপনাদের থাকতে হবে এবং এ দেশেই থাকতে হবে। এমনকি শেখ হাসিনা যদি নাও থাকেন, তাহলে আপনাদের জনগণের সাথে থাকতেই হবে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কেউ নেই। তার ছেলে মার্কিন নাগরিক। মেয়ে কানাডিয়ান। বোন ব্রিটিশ। তাদের নাতিনাতকুরেরা বিদেশিনীদেরই বিয়ে করছেন। ফলে শেখ হাসিনার এ দেশে কী আছে? কার্যত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার। আর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি। এ ছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আর কিছুই নেই। এবং তিনি সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। হয়তো সেখানেই অভিবাসী হবেন। 
কিন্তু তার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মসীলিপ্ত এক অধ্যায়। চতুর্দিকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। শুধুই সর্বনাশের খেলা। সবচেয়ে বড় তি রাষ্ট্রের তিনি যা করেছেন তা হলোÑ এই সমাজ সংস্কৃতির কাঠামো তিনি যেন একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া, প্রকৃতি, পরিবেশ, এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ নির্দিষ্ট করেছিল। তার ফলে প্রায় দুই হাজার বছরের অবিরাম প্রচেষ্টায় যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তাকে তিনি একেবারে তছনছ করে ফেলেছেন। এ যে কী বিশাল সুদূরপ্রসারী ধ্বংসকারী প্রভাব এই সমাজের ওপর পড়বে, সেটা বোঝার মতা সম্ভবত তারও নেই এবং তার পরামর্শকদেরও কারো নেই। আর যদি থাকেও, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য একটি জাতিসত্তা গঠন করে এবং সে জাতিসত্তায় স্বাধীনতার আগ্রহ প্রবল করে। তারই জের ধরে এ দেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের বসবাসের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। গোটা দণি এশিয়ায় কোনো দেশই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সবাই স্বাধীনতা অর্জন করেছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসকদের সাথে আলোচনা করেই কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এসব দেশ ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। সে েেত্র দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ ও তার মানুষ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 
এই যুদ্ধকে গৌরবান্বিত করার জন্য জিয়াউর রহমান প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি গৌরবময় মর্যাদা দেয়ার জন্য একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন মাইলফলক নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এ দেশের জনগণের মুক্তির জন্য তার নীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। সেখানেই জিয়া অনন্যসাধারণ। তার নীতি যদি এ দেশে পরবর্তী শাসনকালে সঠিকভাবে অনুসৃত হতো, তাহলে বাংলাদেশ এখন ধারণা করি মালয়েশিয়ার চেয়েও অনেক ওপরে থাকত। 
শেখ হাসিনার সরকার সে পথ পরিহার করেছেন। সেই সাথে এ দেশের ইতিহাস থেকে জিয়াউর রহমানের নাম একেবারে বোধ করি মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে কে বোঝাবে যে, এভাবে কারো কৃতি বা কীর্তি কিছুই মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস আপন গতিধারায় চলতে থাকে।
যে ইসলাম এই রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেই ইসলামকে একেবারে মুছে ফেলার জন্য শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এখনো অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার নামে যা কিছু করার বিধান সংবিধানে ছিল, তার সবই ইতোমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বত্রই বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রবল প্রতাপ, যারা মুসলমান নয়। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিবেচনায় এখন মুসলমান তার যোগ্যতা সম্পূর্ণই হারিয়েছে। প্রশাসনের চেহারা দেখলে মনে হয়, মুসলমানদের ফের এ দেশে অচ্ছুৎ করে তোলা হয়েছে। মুসলমানের দেশে মুসলমানরাই এখন যেন নিজ ভূমে পরবাসীতে পরিণত হচ্ছে। শিাব্যবস্থা থেকে ধর্মের নিশানা উধাও করা হয়েছে। এমনকি মাদ্রাসা শিাব্যবস্থায়ও আলেম তৈরির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেশ সম্পূর্ণরূপে ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। একদিকে ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপ, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিলোপ, অন্যদিকে ভারতের সীমাহীন আগ্রাসন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। 
নতুন প্রজন্ম যেমন শিাদীায় পিছিয়ে পড়ছে, জ্ঞান-গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি তাদেরকে ধর্মীয় বোধগুলো থেকে কেবলই বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার বিপরীত চিত্রও সমাজে একেবারে অনুপস্থিত নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে শেখ হাসিনা নিজেও তা দেখতে পেতেন, এটুকুই আশার কথা। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন : গৌরবের দিনলিপি : বই নয় আর্কাইভস



আ ব দু ল হা ই শি ক দা র
এক.
কথাশিল্পী আবু রুশদের একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ২২ জুন ১৯৯০-এ দৈনিক বাংলায় (দৈনিক বাংলা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যা করেছেন। সেজন্য বলতে হবে অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত সেই সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আরেকটি জিনিস ঘটে, হয়তো একজন লেখক সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকটি উচ্ছ্বসিত ধরনের আলোচনা বা নিবন্ধ বের হয়ে গেল। অথচ সেই লেখক শক্তিশালী কেউ নয়। তাই—পাঠকরা এ ধরনের অতি উত্সাহী আলোচনা দেখে সেই লেখককে যখন যাচাই করতে যায়, দেখে বেশ ফাঁক রয়ে গেছে। তখন সামগ্রিকভাবে আমাদের লেখকদের সম্পর্কে নিরুত্সাহী হয়ে পড়ে তারা। হতাশ হয়ে যায়।’
এই অভিজ্ঞতাটা আমার ঝুলিতে আছে। অনেক অতি প্রগলভ, উচ্ছ্বাসের ফেনায় ভেসে যাওয়া গ্রন্থালোচনা পাঠ করে মূল বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়েছি। মনে হয়েছে গ্রন্থালোচক আমাকে প্রতারিত করেছেন।
দলবাজি, গ্রুপবাজি, অশিক্ষা ও অপুষ্টির শিকার আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ঘাড়ে চেপে বসেছে এক ধরনের প্যারাসাইট। এই পরান্নভোগীরা ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চায় চোখ। স্রেফ ব্যক্তিগত সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে এদের বিচারবুদ্ধি হয় বিলুপ্ত। বড় হয়ে ওঠে উচ্চাভিলাষ। এজন্য কারণে-অকারণে নিজেদের এই নোংরা টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত লেখক যত জগামগাই হোক, কল্কি পেয়ে যান। যদুর চরকায় তেল দেয় জব্বার, জব্বারের চরকায় তেল দেয় মধু। মধু আবার যদুকে বড় করে তোলে। এই চক্রে এখন পচা পাগাড়ে আবদ্ধ শুয়োরের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্য।
এই চক্র নিজেদের লেখক ও লেখকের বইকে নিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। আর তাদের হিসাবের বাইরের লেখক ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে থাকে নিঃশব্দ। এখন আবার এই প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে চটকদার বিজ্ঞাপন। নতুন আরেকটি ফ্যাশন এখন আমাদের সাহিত্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো টাটাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বইয়ের মার্কিং করে এ বছরের সেরা ১০ বই, বছরের সেরা ৭ বই ইত্যাদি নামে। এসব ভাগ্যবান বই বা লেখক তাই বলে বাইরের কেউ নয়, সংশ্লিষ্ট পত্রিকার খোঁয়াড়েই লালিত-পালিত বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন বাচাল লেখক।
কখনও কখনও বড় কিংবা আলোচিত হওয়ার জন্য লেখকদের মধ্যেও কাজ করে নানা ধান্ধাবাজি। এই ধান্ধাবাজির একদিকে থাকে চালাকি, শ্রমবিমুখতা ও তাস্কর্যবৃত্তি। অন্যদিকে থাকে ক্ষমতাসীনদের পা চেটে, তাদের স্তাবক বা নিশানবরদার সেজে ইহলৌকিক তরক্কি অর্জন।
এই জাতীয় লেখক দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবিচারের শিকার হয়েছেন আমাদের দুই জাতীয় নেতা শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান। একই বই শত শত নামে বেরিয়েছে এ দুজনের জন্য।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক তোলপাড় করা বই ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’র স্রষ্টা ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার আরেকটি বহুল পঠিত বই ‘কত ছবি কত গান’। সেই ইলিয়াস ভাই ’৭১-এর পরে মুজিব বন্দনার সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন ‘মুজিববাদ’ বই দিয়ে। ইলিয়াসের পাঠকরা এতে দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। আর বিরক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তারা। কারণ তাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, তাদের বাড়া ভাত যেন কেউ কেড়ে দিতে চাচ্ছে। মুজিববাদের জন্যই ডুবলেন তিনি শেষ পর্যন্ত।
ড. মাযহারুল ইসলামের বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পড়ে স্বয়ং শেখ মুজিব নাকি রুষ্ট হয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বইটির তথ্যগত ভ্রান্তি এবং বল্গাহারা বিশেষণ প্রয়োগের তাণ্ডব ধরিয়ে দিলে চুপসে যান গ্রন্থকার।
জিয়াউর রহমানকে নিয়েও একই কাণ্ড চলছে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের দ্বারা। এখানে আছে নানা সাইজ ও আয়তনের মাত্রাছাড়া বাড়াবাড়ি। বিভিন্ন লেখকের লেখা কালেকশন করে এক একজন এক একটা বই বের করেছেন। নিজের নাম ফাটানোর জন্য আছে নানা কায়দা। আবার এই একটি সংগ্রহ থেকেই লেখা নিয়ে আরও চল্লিশজন চল্লিশ নামে বের করেছেন বই। এর কোনো কোনোটির ওজন পাঁচ কেজি পর্যন্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নির্যাস নেই পাঁচ ফোঁটাও।
দুই.
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বিরচিত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনয়িন : গৌরবের দিনলিপি’। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন অ্যাডর্নেরই স্বত্বাধিকারী বন্ধুবর সৈয়দ জাকির হোসাইন। কাউকে ভড়কে দেয়ার জন্য এ ধরনের বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণ গড়পড়তা সাইজ নয়, রয়াল সাইজের এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৭৪। ওজন আনুমানিক ৩ কেজিরও বেশি। বৃদ্ধ এবং শিশুদের পক্ষে এ ধরনের বিশাল গ্রন্থ পড়া তো দূরের কথা, নাড়াচাড়া করাও দুঃসাধ্য।
যে কেউ এরকম জলহস্তির মতো বিরাট কলেবরের বই দেখে সত্যি সত্যি ভিরমি খেতে পারেন।
কিন্তু আমি বা আমার মতো অনেকেই যেহেতু ঘর পোড়া গরু, সেহেতু ভয় না পেয়ে উল্টে-পাল্টে দেখা শুরু করলাম। যাকে বলে আগাগোড়া স্কানিং করা, সে রকম পাঠ সমাপ্ত করতে মাসখানিক লাগার কথা। আমি বইটি ঘাঁটার (পড়ার জন্য নয়) জন্য সময় নিয়েছি মাত্র দুদিন। সে জন্য এ লেখাকে পাঠ-পরবর্তী নিবেদিত কোনো প্রবন্ধ হিসেবে না দেখে একটা দ্রুতরেখ মানচিত্র বলে ধরে নিলেই বাধিত হবো।
তিন.
ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রাচীন প্রবাদে আছে, ‘ইতিহাস এমনি একটি বিষয়, যা কখনও ঘটেনি এবং এমন লোকের দ্বারা লিখিত হয়েছে, যে কখনও সেখানে ছিল না।’ প্রথমেই বলে নিই, এ বই সে রকম কোনো ইতিহাসবিদের রচনা নয়। এ বইয়ের লেখক মাহফুজউল্লাহ ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক। কখনও তিনি নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা, কখনওবা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে আসা সচেতন মানুষ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী, কখনওবা নেতা। সঙ্গত কারণেই ছাত্র ইউনিয়নের বিচারে তিনি ইতিহাস-মানুষ। ফলে অন্য দশটি তথাকথিত ইতিহাস গ্রন্থের সঙ্গে এই গ্রন্থকার ও গ্রন্থের ফারাক সুস্পষ্ট, দূরত্বও অনেকখানি। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য মানুষের মতো ‘নিজেরে করিতে গৌরব দান’-এর মতো রুচিহীন কাজ এ গ্রন্থে কোথাও করেননি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনার স্তূপ তিনি খাড়া করেননি। অথচ এর সুযোগ ছিল। এই যে মাত্রাবোধ ও কাণ্ডজ্ঞান, সে জন্যই মাহফুজ উল্লাহ তার এই গ্রন্থের জন্য নন্দিত হবেন। পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখার জন্য এ বই যেমন পাবে পাঠকপ্রিয়তা, তেমনি অর্জন করবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মর্যাদা। এই সমাজ, রাষ্ট্র তথা জাতীয় জীবনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ জোগাবে উপকরণ ও অনুপ্রেরণা। সে বিচারে এ বই জাতীয় ইতিহাসের অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমি মাহফুজ উল্লাহর এই সময়োপযোগী প্রকাশনাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এ ঠিক গ্রন্থ নয়, এ হলো একটা আর্কাইভস। একটি বিশাল আর্কাইভসের অক্ষরবন্দি রূপ। এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, আছে অনুধাবনের নানা জিনিসপত্র। কেবল যেন পাঠের জন্য নয়, এ বই রচিত হয়েছে বিচরণের জন্য। উদ্যানের মধ্যে যেমন আমরা হেঁটে বেড়াই, এগাছ-ওগাছের কাছে যাই, এফুল-ওফুলের গন্ধ নেই, বর্ণ দেখে চমত্কৃত হই, কখনও হই বিচলিত—এ হলো সে রকম একটি আয়োজন।
আবার আমাদের ইতিহাসের অনেক হারিয়ে যাওয়া ভূভাগ, বিলুপ্ত অনেক অলিগলি, অনেক মানুষের অপরিসীম ত্যাগের কাহিনী পাঠক এর মধ্যে পাবেন। পাবেন একটি জাতির উত্থান এবং কিছু মানুষের পতনের বেদনাহত সূত্র। এজন্য এ বই আমাদের নিজেদের দেখার আয়নাও বটে। হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। এই পাঠে আমরা বিস্মিত হই, শিহরিত হই, ব্যথিত হই। কিন্তু আয়না থাকে নির্বিকার। এই নির্বিকারত্বই এ গ্রন্থকে মানোত্তীর্ণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যদি গ্রন্থ বিচারে বসি আমরা, তাহলে যে কেউ স্বীকার করবেন এই গ্রন্থ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশেরও ইতিহাস। এ গ্রন্থ শুধু ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের দিনলিপি নয়, জাতীয় গৌরবেরও দিনলিপি।
চার.
বইয়ের শুরুতেই সবিনয় নিবেদনে লেখক বলেছেন, ‘আট বছরের পরিশ্রমের ফসল যে বইটি এখন হাতে নিয়েছেন তা প্রথাসিদ্ধ কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়। তবে ইতিহাস রচনার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের ভাণ্ডার।’ আসলেই এ গ্রন্থ একটা উপাত্তের ভাণ্ডার। ১২৭৪ পৃষ্ঠা বিস্তৃত এ বই ধারণ করেছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৯ বছর।
ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই চারটি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত সংগঠনটির জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাবান মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হন। এ ছাত্ররাই কর্মজীবনে দিয়েছেন প্রভূত সাফল্যের পরিচয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের অনেকেই জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যে সময়সীমার কথা নিয়ে এ গ্রন্থ, সে সময় বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ছাত্র ইউনিয়নই ছিল সবচেয়ে প্রাগ্রসর সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সদস্যদের দিয়েছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস। করেছিল গভীরভাবে আত্মপ্রত্যয়ী। দিয়েছিল গৌরবময় জীবনের সন্ধান। যে গৌরবের সৌরভ আমাদের মতো অভাজনের গায়ে এখনও লেগে আছে।
মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ১৯টি পরিশিষ্টে সৃষ্টি হয়েছে এই বই। প্রতিটি অধ্যায় চিহ্নিত হয়েছে এক-একটি বছরের নামে। এই অধ্যায়গুলোর শুরুতেই আছে মূল বিষয়ের ওপর লেখকের কিঞ্চিত্ আলোকপাত। এরপর আছে ঘটনা প্রবাহ, যা গড়ে উঠেছে কেবল সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কাটিং নিয়ে। তারপর সংযুক্ত হয়েছে তথ্য নির্দেশ, যা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এভাবেই সাজানো হয়েছে ১৮টি অধ্যায়।
আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর আলোকপাত, যা লেখকের নিজের লেখা, খুবই সংক্ষিপ্ত, একই সঙ্গে সংযমী ও পরিমিত। বাচালতাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেননি মাহফুজ উল্লাহ।
পরিশিষ্টের ১৯টি অধ্যায় আসলে ছাত্র ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্টস, যা ইতিহাস গবেষকদের জন্য খুলে দেবে এক শস্যভারানত দিগন্ত।
আরও দিকের উল্লেখ করতে চাই। আমাদের আত্মবিশ্বাসহীন লেখককুলের অনেকেই বইয়ের ‘দাম’ বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট কেউকেটাদের দিয়ে ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। তারপর শুরু করে তার বাণিজ্যিক ব্যবহার। মাহফুজ উল্লাহ এই কদর্য কাজটি করেননি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই, এই ফাঁকে একটা ধন্যবাদ কি আপনাকে দেব?
আর একটা প্রশ্ন, বর্তমানকার অন্তঃসারশূন্য, দলবাজ ছাত্র সংগঠনগুলো এই বই থেকে কি কিছু শিক্ষা নেবে?
পাঁচ.
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন মাঝেমধ্যেই ভারি ভারি কিতাব প্রকাশ করে। সেগুলো কতটুকু খাদ্য আর অখাদ্য তা বলতে পারবো না। কিন্তু সেসব দেখে চোখ জুড়িয়েছে। বিশেষ করে আনোয়ার দিল অ্যান্ড আফিয়া দিল প্রণীত ‘বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ সম্পাদিত ‘মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ : বাংলাভাষা স্মারক’-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ড. মাহবুব উল্লাহর গ্রন্থটি যখন বের হয় তার বহু আগে থেকেই তার সঙ্গে আমি অষ্টপ্রহর জড়িত। কিন্তু ভুলেও তিনি এ গ্রন্থ সম্পর্কে কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তিনি আমার মতো অনেক আমজনতার কাছে পুরো বিষয়টি চেপে রাখেন।
হয়তো তিনি আমাদের চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রকাশের পর ১০ কেজি ওজনের ঢাউস বইটি তিনি যখন আমার হাতে দেন, আমি আঁেক উঠি এবং হতবাক হই। আরও হতবাক হই, দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানে যেখানে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তার মোটামুটি জীবনপঞ্জি আছে বইটিতে। কিন্তু তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিয়ে যে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী—তার উল্লেখ নেই। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের হাতে এমনটা হয়েছে হয়তো তথ্য সংকটের কারণে। তো এই হতবাক দশা এখনও কাটেনি বলে মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের শত গালাগাল শুনেও বইটি নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা হয়ে ওঠেনি।
শেষ করার আগে মাহফুজ উল্লাহ ভাইকে আবারও ধন্যবাদ। কারণ তিনি জানেন ‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ সেজন্যই সেই নারী, তার গৃহের জিম্মাদার দিনারজাদী বেগমকে তিনি ভোলেননি। তার সবিনয় নিবেদন শেষ হয় তার নাতি-নাতনীদের জন্য আশাবাদে—‘আমার তিন নবীন প্রজন্ম আরমান রাকিন হক, দিয়ান জাকারিয়া ও জাহরান হাবীব যদি বড় হয়ে আমার যৌবনে লালিত বিশ্বাসকে ধারণ করে, তাহলে এই বই লেখা সার্থক হবে।’
আমি এর সঙ্গে যুক্ত করি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ যদি এই বই পাঠ করে উপকৃত হয়, উজ্জীবিত হয়, বাংলাদেশের দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে আসে—তাহলেই হলো।
a_hyesikder@yahoo.com

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য



॥ এহসানুল হক জসীম ॥

জাতির এক সঙ্কট মুহূর্তে আশাহীন-দিশাহীন জাতিকে মুক্তির নেশায় উজ্জীবিত করতে এবং পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে শিার আলো পৌঁছে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের তির প্রেক্ষাপটে সান্ত্বনাস্বরূপ যে বিশ্ববিদ্যালয়; সময়ের ব্যবধানে এ সংগ্রামী ভূমিকায় ’৪৭-এর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক বেশি। 
সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ’বঙ্গভঙ্গ’ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশই ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করেন। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মর্মাহত হয়ে পড়েন। বঙ্গভঙ্গের ফলে কয়েক বছরের মুসলিমসমাজে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা উবে যায়। তারা বিুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি তার সাথে দেখা করেন। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা সব দিক থেকে দারুণভাবে তিগ্রস্ত হবে। বঙ্গভঙ্গ আবার চালু করা হোক, না হয় এর ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেনÑ
"The Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca."
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলেও আবারো বাধার সৃষ্টি করেন হিন্দু নেতারা। তাদের কাছে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা করতে থাকেন প্রচণ্ড বিরোধিতা। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার বঙ্গভঙ্গ: তৎপরর্তী সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। 
লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অম্বিকা চরণ মজুমদার, কিশোরী মোহন চৌধুরী প্রমুখ। তারা স্মারকলিপি পেশ করেন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, "The Muslim of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a University."
এ ক্ষেত্রে অন্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ এবং হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাস আলী তার সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রƒপ শুরু করেন।
বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা যথাসময়ে লন্ডনের ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক গৃহীত হয়। ফলে সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা গভর্নরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কিম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করে। এই পত্রে বাংলার মুসলিমদের স্বার্থ ও প্রয়োজন মেটানোর দিকে ল রাখার বিশেষ নির্দেশ ছিল। পত্রে এ মর্মে একটি নির্দেশও ছিল, যাতে শিা েেত্র মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় সভ্যতা সংস্কৃতি রায় সফল হয়। সেই ল্েয বলা হয় : "There might be a faculty of Arabic and Islamic Studies in the University."
ভারত সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের ল্েয বাংলা সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার আর নাথানের নামে এর নাম হয় ’নাথান কমিটি’। কমিটি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাংলা সরকারের কাছে পেশ করেছিল।
নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জমিবিশিষ্ট একটি মনোরম এলাকারও সুপারিশ করে। জনমত যাচাইয়ের ল্েয ১৯১৩ সালে এ কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সচিব কর্তৃক রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে স্কিমটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে সংপ্তিভাবে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার জন্য আবারো প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১৯১৬ সালে ভারত সরকার বাংলা সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয সর্বনিম্নœ খরচের সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেয়। 
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে থাকায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব পেশের পর আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আশ্বাস দেয়া হয়, "The promise Lord Hardinge made that the University would be founded in Dacca."
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে নাÑ এমন অজুহাতেও কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তার জমিদারির বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেন। জমি অধিগ্রহণের পাশাপশি আর্র্থিক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি টাঙ্গাইলে তার জমিদারির একটি বিরাট অংশ বিক্রি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে এগিয়ে আসেন। ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড চেমসফোর্ড চ্যান্সেলরের ভাষণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ অসুবিধা পরীা-নিরীার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পইে রিপোর্ট প্রদান করে। এটা কি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, না ‘টিচিং’ এবং ‘এফিলিয়েটেড’ থাকবে? জনমত যাচাইয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন একবার রাজশাহীতে আসে। তখন একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল তাদের সাথে দেখা করে এই দাবি করে যে, পূর্ব বাংলার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এফিলিয়েটেড বা সংযুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে টিচিং কাম এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে সে জন্য হিন্দু নেতারা বিরোধিতা করতে থাকেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতা এর পে অভিমত ব্যক্ত করেন। নাথান কমিটির সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত ও সুপারিশ সাপেে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল প্রণীত হয়, যা ১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুসলমানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশে সম হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয়, তা আজ ফুলে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সব জাতি ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি আরবি ও ইসলামি শিা বিভাগ খোলা হবে। এ পরিপ্রেেিত কমিশন যে বক্তব্য তুলে ধরে, তা স্মরণীয়Ñ "We do not forget that the creation of the University was largely due to the demand of Muslim community of Eastern Bengal for greater facilities for higher education."
বঙ্গভঙ্গের আগে এবং তা রদে পূর্ব বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উচ্চশিার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। বেশির ভাগ কলেজ কলকাতা বা তার আশপাশেই অবস্থিত ছিল। পূর্ব বাংলায় কলেজ খুব কম ছিল। উচ্চশিার জন্য গোটা আসামে মাত্র দু’টি কলেজ ছিল সিলেটের এমসি কলেজ এবং গৌহাটির কটন কলেজ। গৌহাটিতে তখন একটি ল কলেজও ছিল। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ দরিদ্র মুসলমান কৃষকসন্তানদের জন্য উচ্চশিার সুযোগ সৃষ্টি করে সম্ভাবনাময় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থানের বছর কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই এই প্রধান শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। অভ্যুত্থানে শিতি মধ্যবিত্তরা যোগ দেয়নি। ইংরেজরা এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তারা চেয়েছিল ভারতীয়দের একাংশকে সভ্যতা ও ভব্যতার শিা দিয়ে ’মহৎ বর্বরে’ রূপান্তরিত করতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু ছাত্ররা স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবে না, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। ইংরেজদের সে উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকে। জাতি মাতৃভাষাকে রার জন্য শুধু রক্ত ঝরায়নি; পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এ জাতিকে স্বাধীনতার সোনালি সকালটিও উপহার দিয়েছে। 
লেখক : গবেষক ও মিডিয়াকর্মী 
ehsan.jasim@yahoo.com

পাঁচ নেতার শেষ জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা



 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী  
বেশ কিছুকাল আগে এক বন্ধু আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম “লাস্ট ডেজ অব লেনিন” (লেনিনের শেষের দিনগুলো)। নানা কারণে বইটি তখন পড়া হয়নি। সম্প্রতি এক অবকাশ মুহূর্তে বইটি পড়া শুরু করে আর শেষ না করে পারিনি। বইটিতে লেনিনের শেষ জীবনের এমন অনেক ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা হয়েছে, যা আগে জানতে পারিনি। আর এখনতো জানার উপায়ই নেই। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ব্যান্ড-বাদকেরা এমন একতরফাভাবে লেনিন, স্ট্যালিন, মাও প্রমুখ বিশ্ব কম্যুনিস্ট নেতার চরিত্র হনন শুরু করেছেন যে, এখন তাদের সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্যই জানা মুশকিল।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইটি পশ্চিমা ধনবাদী শিবিরের বর্তমান প্রোপাগান্ডা শুরু করার আগের লেখা। ফলে লেনিনের শেষ জীবনের ইচ্ছা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এমন কিছু তথ্যভিত্তিক বিবরণ পাওয়া যায়, যা কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। একটি সোস্যালিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পরই লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন, কঠোর তত্ত্বভিত্তিক প্লোরেতারিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্লোরেতারিয়েতরা (সর্বহারা) চিরকাল প্লোয়েতারিয়েত বা সর্বহারা থাকে না। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর তারাও শাসক শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং তাদেরও চরিত্র বদল হয়।
এই চরিত্র বদলের ফলে তারাও যাতে আগের ধনবাদী শাসকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন না করে, সেজন্য তিনি কঠোর সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও হিউম্যানিজমের কিছু কিছু জানালা খুলে দিতে চেয়েছিলেন। হিউম্যানিজমের বৈশিষ্ট্যবর্জিত কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দানব-চেহারা ধারণ করতে পারে এটা গোড়াতেই উপলব্ধি করে লেনিনের ভারতীয় সহকর্মী এম.এন রায় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে ভারতে এসে মেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন।
লেনিনের মৃত্যু-পূর্ববর্তী চিন্তাচেতনায় যে পরিবর্তন এসেছিলো, তা তিনি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে তিনি অবশ হয়ে পড়েন, তার বাকশক্তিও হ্রাস পায়। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় ইঙ্গিতে অথবা কাউকে ডিকটেশন দিয়ে তার নির্দেশগুলো দিতেন। লেনিনের অসুস্থতার সময় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী স্ট্যালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। স্ট্যালিনই পলিটবু্যুরোতে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন।
‘লাস্ট ডেজ অব লেনিন’ বইতে লেখা হয়েছে, লেনিন মৃত্যুর আগে যা চেয়েছিলেন, তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি স্টেট ক্যাপিটালিজম ভিত্তিক কঠোর একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র হওয়ার বদলে ধীরে ধীরে এক ধরনের প্লুরালিস্টিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগুতো এবং তার হিউম্যান ফেস বা মানসিক চেহারা হারাতো না।
কিন্তু স্ট্যালিন পরে লেনিনের অসুস্থতার সুযোগে এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি লেনিনের নির্দেশের পরোয়া করতেন না। তিনি পার্টি ও সরকারের অন্যান্য সদস্যের কাছে লেনিনের নির্দেশগুলো গোপন করে নিজের ইচ্ছাকেই লেনিনের নির্দেশ বলে চালাতেন। বাকশক্তি রহিত লেনিন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে স্ট্যালিনের সব কার্যকলাপ লক্ষ্য করতেন। কিন্তু স্ট্যালিনের অনুচরদের দ্বারা সর্বসময় পরিবেষ্টিত অবস্থায় তার কিছুই করার ছিলো না। তিনি স্ট্যালিনের কার্যকলাপে বাধাদানের উপায় খুঁজেছেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাননি।
এই বইটি পাঠের পর কম্যুনিস্ট চীনের নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মাও জে দুংয়ের শেষ জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো জানারও আমার ইচ্ছে হয়। শুনেছি এ সম্পর্কে কয়েকটি বই বেরিয়েছে, কিন্তু আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। মাও জে দুংয়ের জীবিতকালে লন্ডনের ‘দি ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকা মাও জে দুংকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কভার স্টোরি প্রকাশ করে, সেটি এবং পরবর্তীকালে চীন-বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিকের লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিলো। এগুলো পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, মাও তার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। চীনে তার পরবর্তী কম্যুনিস্ট নেতারা মাওকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু মাওবাদকে বর্জন করেছে।
 ‘দি ইকোনমিস্টের’ মাও সংক্রান্ত কভার স্টোরিতে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার ও কম্যুনিস্ট পার্টিতে মাও বিরোধীদের সাথে মাওবাদীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আভাস দেওয়া হয়েছিল। মাও তখনো জীবিত আছেন। তার অভিনেত্রী স্ত্রীকে ঘিরে তখনকার ‘গ্যাঙ অব ফোর’ (চারের চক্র) গড়ে ওঠে। মাওয়ের বিশ্বস্ত সহচর লিন পিয়াও খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, মাওয়ের পর লিন পিয়াও হবেন তার ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। ‘দি ইকোনমিস্ট’ এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তাদের কভার স্টোরির শিরোনামটি কভারেই বড় করে ছেপেছিলো। মুসলমানদের কলেমা তৈয়বের অনুকরণে তাতে নেয়া হয়েছিল ‘There is no Mao but Mao and lin piao is his prophet’ (মাও নেই, কিন্তু মাও আছেন এবং লিন পিয়াও তার পয়গম্বর)।
লেনিনের মতো মাও জে দুংও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় দানব ব্যবস্থা দ্বারা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রও টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘let hundred flowers blossom বা শত ফুল ফুটতে দাও শীর্ষক তত্ত্বে সমাজতন্ত্রী সমাজে ভিন্ন মতের অবস্থানকেও মেনে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো মজবুত হয়নি এবং এই ব্যবস্থায় দুর্বলতার ফাঁকে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ থিয়োরির সুযোগ নিয়ে অধিক শক্তিশালী-ধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কম্যুনিস্ট চীনকে ধ্বংস করতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে থিয়োরিটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেন।
কিন্তু শেষ জীবনে মাও জে দুং আরেকটি সত্য অনুধাবন করেন।  যে কৃষক ও শ্রমিক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ করে তিনি চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সফল করেছেন, সেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণী বা তাদের  প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসার পর অল্পদিনে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরের ফলে অতীতের শাসকদের শ্রেণীচরিত্র অর্জন করতে শুরু করেছে। এই বিপদ ও তার প্রতিকারের কথাতো কার্ল সার্কস তার কোনো কেতাবে লিখে যাননি।
মাও কালচারাল রেভ্যুলিউশনের পন্থা উদ্ভাবন করেন। এই রেভ্যুলিউশন কার্যকর করার ব্যাপারে তার পার্টিতে মতভেদ ছিলো।  কিন্তু তার স্ত্রী ও তিন ঘনিষ্ঠ অনুসারীর দ্বারা গঠিত ‘গ্যাঙ অব ফোর’ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়। এই বিপ্লবের মূল কথা ছিলো, কম্যুনিস্ট-শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পরও সমাজ পরিবর্তনের ধারাতে সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়ে, প্রত্যেক পেশায় এমনকি সরকারের পরিচালকদের মধ্যেও যে এলিট শ্রেণীর উদ্ভব ঘটছে এবং পূর্বতন এলিট ও ক্ষমতাসীন শ্রেণীর অভ্যাস, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা ও আভিজাত্যবোধ ফিরে আসছে, তাকে অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ধনবাদী সমাজের পেশাগত বৈষম্য ও কায়েমী আভিজাত্যবোধ বিলুপ্ত করে সমাজতন্ত্রী সমাজ গড়ার ব্যবস্থাটি যাতে ধনবাদী বিচ্যুতির পথে না গড়ায় তার শেষ চেষ্টা করা।
বয়স এবং বার্ধক্যের জন্য মাও জে দুং তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তার পার্টির নতুন গজিয়ে ওঠা এলিট শ্রেণীর বাধাদানের ফলেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ হয় এবং এই বিপ্লবকে এক বিমূর্ত চেহারায় দাঁড় করিয়ে সারা বিশ্বে তাকে নিন্দিত করে তোলা হয়। সেই সঙ্গে মাওকেও। কালচারাল রেভ্যুলিউশনকে পাগলামি, তোগলকি কাণ্ড, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা ও নির্যাতন ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট এলিট ক্লাস ও মিডিয়া বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় সৃষ্টি করে। চীনের কম্যুনিস্ট এলিট ক্লাসের একটা অংশকেও মাওয়ের মৃত্যুর পর সেই ঝড়ে গা ভাসাতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রবর্তিত বাকশাল পদ্ধতি সম্পর্কে পশ্চিমা জগতে এবং আমাদের নব্যধনী ও এলিট ক্লাসের কায়েমী স্বার্থভোগী অংশের মধ্যেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করবো।
মাও জে দুংয়ের জীবিতকালেই কালচারাল রেভ্যুলিউশন ব্যর্থ করা হয়। তার মৃত্যুর আগেই লিন পিয়াওর পতন ঘটে। প্রচার করা হয়, তিনি দেশ থেকে পলায়নকালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু পশ্চিমা সূত্রই খবর প্রকাশ করে যে, তাকে বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং গ্যাঙ অব ফোরের অন্য তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। চীনে কম্যুনিস্ট পার্টি ও সরকারের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পুরনো শ্রেণী কাঠামোয় বিশ্বাসী তথাকথিত এলিট শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে। আমেরিকা তাদের ‘Most favoured trade partner’ (সবচাইতে প্রিয় ব্যবসা-সঙ্গী) হিসেবে ঘোষণা করে দ্রুত ট্রেড পার্টনারশিপ মিলিটারি পার্টনারশি‘পে পরিণত হয়। এখন অবশ্য চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব স্বার্থ ও আধিপত্যের, আদর্শের নয়। মাওয়ের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। মাওবাদ-বর্জিত মাওয়ের চীন নতুনভাবে গড়ে উঠেছে।
কেবল লেনিন ও মাওয়ের বেলাতে নয়, আমাদের উপমহাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, আমাদের তিনজন প্রধান নেতার জীবনের শেষ ইচ্ছাই পূর্ণ হয়নি। শেষ জীবনে তাদেরও চিন্তা- চেতনায় রূপান্তর ঘটেছিল এবং তারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। এরা হলেন, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্না এবং শেখ মুজিবুর রহমান। গান্ধী ও জিন্নার শেষ জীবনের ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, অনেক বই বেরিয়েছে। শেখ মুজিবের মৃত্যুপূর্ববর্তী শেষ জীবনের ইচ্ছা এবং তা পূর্ণ না হওয়া সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো বই বেরোয়নি। (শেষাংশ আগামী শুক্রবার)
লন্ডন, ৩০ জুন, শনিবার, ২০১২

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অজ্ঞতা এবং মাহমুদুর রহমানের জবাব



হা সা ন শা ন্ত নু
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তথা নব্য আর পুরনো আওয়ামী লীগাররা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ছকের বাইরে পা ফেলবেন না নিশ্চিত। ফেলা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাদের যে কণ্ঠ আমরা শুনছি, সেটা রিহার্সেল করা। দীপু মনিরা ভারতীয় রাজনৈতিক দাদাদের শব্দ প্রতিধ্বনি করবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের মতো সর্বোচ্চ অঙ্গনে দাঁড়িয়ে তাদের মিথ্যাচার, তাঁবেদারিত্ব, সংসদীয় রীতিকে আওয়ামী কায়দায় নির্যাতিত করা নতুন বিস্ময়ের জন্ম দেয় না। যে কোনো অঙ্গনে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার, নষ্টামি আওয়ামী রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মিশে আছে দীর্ঘকাল ধরে। তবে গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে দীপু মনি সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা, আমার দেশ সম্পাদক, পাঠকনন্দিত কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান প্রসঙ্গে মিথ্যাচার করে বলেছেন, ‘উপদেষ্টার আগ্রাসী সিদ্ধান্ত ছিল গ্যাস ব্লক’। সংসদের মতো অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দীপু মনির এ মিথ্যাচার নতুন বিস্ময়ের জন্ম না দিলেও নতুন দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়।
মাহমুদুর রহমানের প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা ভারত ও মিয়ানমারের দখলের প্রতিবাদ সম্পর্কে দীপু মনিদের জানা থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তারা তো ইংরেজি কবিতার সেই বালকের মতো। এক বালককে নৌকার গলুইয়ের মধ্যে বসিয়ে রেখে নৌকা তীরে লাগিয়ে বাবা গেলেন হাঁটে। যাওয়ার আগে বালককে বলে গেলেন, ‘আমি না বললে নৌকা থেকে নামবি না।’ এর মধ্যে নৌকায় আগুন লেগেছে। বালক চিত্কার করছে—‘বাবা আমি কি তীরে আসব?’ বাবা শুনতে পাচ্ছেন না। এক পর্যায়ে আগুন নৌকার গলুইয়ে চলে এলো। বালক পুড়ে মরে গেল। দীপু মনিরাও ওই বালকের মতো বলেন আর করেন ভারতীয়দের নির্দেশে। মাহমুদুর রহমানের বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা দখলের প্রতিবাদ সম্পর্কে জানা থাকলেও দীপু মনিরা মিথ্যাচার করবেনই। তবে সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো একজন ব্যক্তিকে পড়াশোনা করে কথা বলা উচিত। সংসদ তো চূড়ান্ত মূর্খতা চর্চার জায়গা নয়। সেদিন সংসদে ডা. দীপু মনি গঙ্গা চুক্তি নিয়ে ‘আওয়ামী লীগের আগে কোনো চুক্তি হয়নি’ বলে যে মিথ্যাচার করেছেন, তাতে আপাতদৃষ্টিতে তার অজ্ঞতার পাশাপাশি মিথ্যাচারের উদ্দেশ্যও প্রকট হয়ে উঠেছে।
ডা. দীপু মনি সংসদে মাহমুদুর রহমানের নাম উল্লেখ করেননি। নাম উল্লেখ না করলেও জোট সরকারের সময় মাহমুদুর রহমান ছাড়া আর কেউ জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদীয় রীতি উপক্ষো করে সংসদে উপস্থিত নেই, এমন একজনকে নিয়ে কথা বলেছেন, ভেতরে গিয়ে যার জবাব দেয়ার সুযোগ নেই। দীপু মনি বলেছেন, ‘তিনি আবার উপদেষ্টা ছিলেন। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাত্ সেই লোক দিয়ে দিল ব্লক। কিসের ব্লক, সে ব্লক কোথায় দিয়েছিলেন। কার বাড়ি, কার ঘর, কে দেয় ব্লক। আমার সীমানা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত আমরা যেতে পারি। মিয়ানমারেরও সেই অধিকার রয়েছে। কিন্তু তিনি যে ব্লক চিহ্নিত করলেন তার দূরত্ব মিয়ানমারের কোস্টলাইন থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল। আমি মিয়ানমারের এলাকায় গিয়ে আমার ব্লক দিলাম। এর চাইতে আগ্রাসী অসত্ প্রতিবেশীসুলভ কাজ তো আর হতে পারে না। আর এটা করে আমাদের দেশকে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় জড়িয়ে ফেলেছিলেন তারা’। (আমার দেশ ২৯.০৬.১২)
অথচ সত্য হচ্ছে, ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত বাংলাদেশের স্থলভাগ, সমুদ্রবক্ষে নতুন অনুসন্ধান কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ সুযোগে দীপু মনিদের তথাকথিত ‘বন্ধুপ্রতিম দেশ’ ভারত ও মিয়ানমার (ছোট দাদাদের দেশ) সমুদ্রবক্ষে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান কার্যক্রম বেগবান করে। দু’দেশই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবিকৃত অংশকে তাদের ব্লকভুক্ত করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। মাহমুদুর রহমান জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দু’দেশের দখলি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো আপত্তি উত্থাপন ও প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদ করলে দীপু মনিদের ‘বন্ধুরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায় মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু হয়। ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ্তুঝড়ঁঃয অংরধ অহধষুংরং এত্ড়ঁঢ়্থ-এ ড. আনন্দ কুমার ২০০৬ সালের জুলাইয়ে ্তুঙরষ চড়ধপযরহম ঈড়হঃত্ড়াবত্ংু রহ ইধু ড়ভ ইবহমধষ্থ শিরোনামের নিবন্ধে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। নিবন্ধটির একাংশ এরকম—‘এ যাবত ভারত-বাংলাদেশের হাইড্রো-কার্বন সংক্রান্ত বিরোধ ট্রানজিট, বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এ বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এবার বাংলাদেশ অভিযোগ করছে, ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে সেখানে গ্যাস অনুসন্ধান চালাচ্ছে।... বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান দাবি করেছেন, ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমার অভ্যন্তরে যথাক্রমে ১৯০০০ এবং ১৮০০০ বর্গমাইল এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এ অংশে হাইড্রো-কার্বন অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে।’
তখন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রক্ষার জন্য গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে মন্ত্রণালয় আদালতে আবেদন করে। গ্যাসক্ষেত্র সন্ধান ও রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আদালত ২০০৬ সালের ১৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। মাহমুদুর রহমানের দৃঢ়তায় ২০০৫ সালে ওই সময়ের সরকার ভারতের হাইকমিশনার ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানায়। সে সময় ভারতীয় অনেক মিডিয়া মাহমুদুর রহমানের ‘শত্রুতা-সৃষ্টিকারী’ ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছিল। দীপু মনি তাঁবেদারিত্বের অবস্থান থেকে বলতে গিয়ে দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমানের প্রশংসা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বদলে ভারতীয়দেরই প্রতিধ্বনি করেছেন।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বুঝে গেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালের (ইটলস) গত ১৪ মার্চের প্রশ্নসাপেক্ষ রায়ে সমুদ্র জয়ের দাবি করার পর সেটা প্রমাণ করতে না পেরে ব্লক হারানোর ব্যর্থতায় দীপু মনিরা এখন এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। কেননা, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালতে তারা বাংলাদেশের দাবি ও স্বার্থে ছাড় দিয়ে এসেছেন।
সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘তাঁবেদারদের স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত ভালো লাগে না। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে কঠোর অবস্থান, দেশের স্বার্থ রক্ষা করে ব্লক চিহ্নিত করার ফলেই সমুদ্রে আজ আমরা আমাদের এতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। অন্যথায় তাও পেতাম না। ... আমরা তখন সমুদ্রসীমা ও ব্লক নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে সিদ্ধান্ত না নিলে বর্তমান দুর্বল ও তাঁবেদার সরকার বন্ধুত্ব আর সুসম্পর্কের কথা বলে মিয়ানমার ও ভারতের কাছে আমাদের সমুদ্রসীমা হয়তো তুলে দিত। দীপু মনির মতো রাজনীতিবিদ, যারা বিদেশের তাঁবেদারি করতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক। ... আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব সময়ই জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেছি। বর্তমান সরকারের মতো তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি করে সম্পদ আহরণের চিন্তা মাথায় ছিল না।’
২৮ জুন সংসদে দীপু মনি গঙ্গা চুক্তি নিয়েও মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের আগে কোনো চুক্তি হয়নি।’ অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তিটি হয়েছিল পাঁচ বছর মেয়াদি এবং গ্যারান্টি ক্লজসহ। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৬ সালে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা চেয়ে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া



ইমরান রহমান
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিতি মিট দ্য প্রেসে ব্রিটেনের পক্ষে তা প্রকাশ করেন দেশটির হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। এদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এখানকার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে তার কণ্ঠে দেশবাসীর হতাশাই পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা এবং বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তার মন্তব্য ছিল সাধারণ মানুষের অভিন্ন বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশ যে ক্রমেই একটা ‘ডাকাতদের গ্রাম’-এ পরিণত হচ্ছে তা সরকারের ঘুম না ভাঙালেও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে নিয়মিতই। দেশে হত্যা-গুমের যে মহোত্সব শুরু হয়েছে তাতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক উদ্বেগজনক মুল্যায়নে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সন্ধান চেয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইলিয়াস আলীর মতো নেতা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বিরাট রহস্য। এর আগে বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলমও নিখোঁজ হয়েছেন। সে রহস্য আজও অনাবৃত রয়ে গেল। পত্রপত্রিকা খুললে দেখা যায়, দু’একজন গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এখন প্রধান সমস্যা হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন। বিষয়টি যৌক্তিকভাবেই তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তাদের এসব বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তাই শুধু ওষ্ঠাগত নয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়ে চলেছে সোত্সাহে। খোদ পুলিশ দফতর থেকেই বলা হয়েছে এবছর ছয় মাসেই যত্রতত্র দুই হাজার লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কথা। এদিকে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও আমাদের মাঝেমধ্যে শুনতে হচ্ছে। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত, মানবতার ঝাণ্ডা তুলে ধরবেন—তাদের বুটের নিচেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এটি দলিত হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগ কখনোই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার অন্যান্য সেক্টরের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগে যে নির্লজ্জ দলীয়করণ ঘটিয়েছে, তা নজিরবিহীন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ দুটির পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে ও রাজনীতিকীকরণের কুফলে যে দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, তা সংক্রমিত করে বহির্বিশ্বের বাতাসকেও। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এখানেও প্রেসিডেন্টর ক্ষমা পেয়ে যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, সাংবাদিক নির্যাতন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতাও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ন্যুব্জ মানবধিকার পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে সরকার যেখানে শপথাবদ্ধ সেখানে এই সঙ্কটময় মুহূর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠে প্রায়ই ভাঙা রেকর্ড বাজে যে, গত ১০ বছরের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা এখনই নাকি সবচেয়ে ভালো। এটা জননিরাপত্তা নিয়ে নির্মম তামাশাই শুধু তাই নয়, একটা দয়িত্বহীন সরকারের আচরণিক ত্রুটিও।
বাংলাদেশ বিদেশনির্ভর দেশ। সম্প্রতি পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার চরম মাশুল গুনছে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে নিরুত্সাহিত বোধ করছে। বোঝা যাচ্ছে, সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে হত্যা-গুম জাতীয় কল্যাণের কত বড় কবর রচনা করতে পারে। উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বাংলাদেশের প্রধান ক্ষেত্র পোশাক শিল্প।
মানুষ নিরাপত্তা চায়। অনিশ্চিত জীবন মানুষের স্বাভাবিক মানবিক বিকাশে অন্তরায়। সুস্থ-স্বাভাবিক রাজনীতির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন সময়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের বিকল্প নেই। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ যেসব গুমের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর দায় সরকার এড়াতে পারবে না। চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার রহস্য সরকারকেই উদঘাটন করতে হবে। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান রহস্য থেকে সাগর-রুনি হত

সাড়ে ৩ বছরে সাড়ে ৩ টাকার বিদ্যুৎ পৌনে ১৩ টাকা : সাবাস আওয়ামী লীগ!


 আসিফ আরসালান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছেন যে, বাংলাদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে কম। তিনি সঠিক না বেঠিক সেটি আজকের আলোচনার প্রধান উপজীব্য নয়। তার এই উক্তি সঠিক না বেঠিক সেটি জানা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কারণ ইন্টারনেটের এই যুগে আপনি যদি বিভিন্ন ওয়েব সাইট ঘাঁটাঘাটি করেন তাহলে যে কোনো তথ্য মুহূর্তের মধ্যে আপনার নখ দর্পনে এসে যায়। কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় আমাদের রেট কম কি বেশি সেটি এখানে মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, তাঁর সরকারের আমলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যতগুণ বেড়েছে সেই অনুপাতে জনগণের আয় বৃদ্ধি হয়েছে কি না। প্রথমে স্পষ্ট বলতে চাই যে, যে হারে বা অনুপাতে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে জনগণের আয় বা ইনকাম সেই অনুপাতে তো দূরের কথা, তার অর্ধেকও বাড়েনি। আমার এই বক্তব্য কিছুক্ষণ পর আমি পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করব। তার আগে বলে রাখছি যে, আজকের এই লেখা আমি খুব সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করব। এমন সহজ ভাষা, যেন ক্লাশ এইট নাইন পাশ করা একজন মানুষও বুঝতে পারেন। আরেকটি কথা বলা দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ একটি হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। এখানে অনেক টেকনিক্যাল পরিভাষা আছে। আমি সেগুলি পরিহারের চেষ্টা করব। আমার মূল কথা হলো, আমরা দৈনন্দিন কতখানি বিদ্যুৎ পাচ্ছি এবং সেটা কি দামে পাচ্ছি।
কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তার সরকার নাকি সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তখন আমি একটি লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম যে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যদি উৎপাদিত হয়ে থাকে তাহলে সেই বিদ্যুৎ গেলো কোথায়? সেই মার্চ মাস  থেকে এই জুন মাস পর্যন্ত ভয়াবহ গরমে যে ভয়াবহ লোডশেডিং হলো সেটি আমার মতো আপনারাও, অর্থাৎ পাঠক পাঠিকা ভাই বোনেরাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আমার এই বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় এতো লোডশেডিং আর দেখিনি। কাজেই কি হবে আমার বা আপনার ঐসব মেগাওয়াট বা কিলোওয়াটের হিসাব রেখে? আমার আপনার যেটি দরকার সেটি হলো বিরতিহীন বিদ্যুৎ এবং সেই বিদ্যুতটিই আমি পেতে চাই আমার সাধ্যের মধ্যে। অর্থাৎ আমার যে ইনকাম সেই ইনকাম দিয়ে আমি বিদ্যুৎ পেতে চাই। সরকার যদি বিদ্যুতের দাম ৫ গুণ বাড়ায় এবং বলে যে এই দামে তুমি বিদ্যুৎ নাও, তাহলে সেই বিদ্যুতের সুবিধা আমি আপনি কি এ্যাফোর্ড করতে পারি? সোজা কথা হলো, সরকার যে জিনিসটি আমাদেরকে দেবে সেটি যেন এ্যাফোর্ড্যাবল প্রাইসে দেয়া হয়। অর্থাৎ সেটি যেন আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। সুতরাং সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো এই যে, কথায় কথায় বিদেশের বিভিন্ন পণ্যের মূল্যের সাথে বাংলাদেশের সেই পণ্যমূল্যের তুলনা করবেন কেন?
\ দুই \
এখানে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। তাহলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ২০০৮ সালে নিউইয়র্কের এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক এক ডজন মুরগীর ডিম কেনে। দাম পড়ে এক ডলার। এখন তার দাম ২ ডলার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১ ডজন ডিমের দাম ১২০ টাকা। সাধারণ মানুষের বেতন বা আয় মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ২০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে তাকে এক ডজন ডিম কিনতে হয় ১২০ টাকায়। কিন্তু নিউইয়র্কে সেই লোকটির সর্বনিম্ন ইনকাম ২৬০০ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ  ২০ হাজার টাকা। তো ২৬০০ ডলার ইনকামে ১ ডজন ডিমের জন্য তাকে দিতে হয় মাত্র ২ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে যার ইনকাম ২০ হাজার টাকা তার ১ ডজন ডিম কিনতে ব্যয় হয় তার আয়ের ১৬৬ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু নিউইয়র্কে যার আয় ২৬০০ ডলার তার ১ ডজন ডিম কিনতে ব্যয় হয় তার আয়ের ১৩০০ ভাগের ১ ভাগ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী বিদেশের সাথে তুলনা করেন কোন্ যুক্তিতে?
এদেশে মোটামুটি মানসম্পন্ন একটি এ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটের দাম কম করে হলেও ৫০ টাকা। কাউকে যদি এক সপ্তাহ এ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয় তাহলেও তার খরচ হবে এক হাজার টাকা। এছাড়া ডাক্তারের ফি গড়ে ৭০০ টাকা। কিন্তু নিউইয়র্কে যিনি মার্কিন নাগরিক (বাংলাদেশী মার্কিন নাগরিক হলেও) তার স্বাস্থ্য সেবা ফ্রী। এমন কি যিনি গ্রীণ কার্ডধারী তার স্বাস্থ্য সেবাও ফ্রী। আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় ভার্জিনিয়া থাকে। এক দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে তার অপারেশন হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় তার চিকিৎসার খরচ পড়েছে ১ কোটি টাকার ওপর। তার নিজ থেকে দিতে হয় ৮ লাখ  টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার। অবশিষ্ট ৯২ লাখ  টাকার ওপর ব্যয় করেছে সরকার। এই ধরনের অনেক সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা রয়েছে বিদেশে। বাংলাদেশ থেকে যারা যায় তারা কেউ বেকার থাকে না। প্রথম দিকে কিছু না জুটলেও দোকান পাটে সেলস ম্যান বা সেলস গার্লের চাকুরি পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এসব জানেন। একমাত্র তিনি ছাড়া তার সকলেই তো বিদেশ আছে। দেশে তো তাঁর কেউ নাই। যারা বিদেশে আছে তাদের কেউবা আমেরিকায়, কেউবা কানাডায়, কেউবা ইংল্যান্ডে অথবা কেউবা ফিনল্যান্ডে। তাই বলছি যে প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ টানেন কেন? বিদেশের উদাহরণ টানতে গেলে তো সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কে আনতে হবে।
\ তিন \
ফিরে আসছি বিদ্যুতের কথায়। ২০০৯ সালের মে মাসে একটি বাসা বাড়ীর ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ মূল্য ছিলো ৩ টাকা ৪২ পয়সা। পরের বছর ২০১০ সালে কিঞ্চিত বৃদ্ধি পেয়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ মূল্য হয় ৩ টাকা ৬১ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১৩ পয়সা। ২০১১ সালে প্রতি ইউনিটের মূল্য হয় ৩ টাকা ৯৩ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি মূল্য বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩২ পয়সা। কিন্তু ২০১২ সালে এই মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ টাকা ৫৩ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি মূল্য বৃদ্ধি পায় ৪ টাকা ৬ পয়সা। প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করবেন যে, ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে বিদ্যুতের গৃহস্থালী মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। অথচ ২০১১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১ বছর ২ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। ৩ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে উল্লম্ফন গতিতে ৮ টাকা ৫৩ পয়সায় উন্নীত করেই তারা  ক্ষান্ত হননি। চলতি মাসে অর্থাৎ জুন মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে আরো ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র দেড় বছরে ইউনিট প্রতি মূল্য ৮ টাকা ৫৩ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১২ টাকা ৭৫ পয়সা হতে যাচ্ছে। পাঠক লক্ষ্য করে দেখবেন যে, মাত্র দেড় বছরে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ৮ টাকা ৮২ পয়সা। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে বৃদ্ধি প্রায় ৩০০ শতাংশ। এখানেও তারা ক্ষান্ত হচ্ছেন না। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা বেসরকারি খাতের রেন্টাল প্ল্যান্টের নিকট থেকে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছে ১৪ টাকা ৫০ পয়সায়। এনার্জী রেগুলেটরী কমিশন বলে দিয়েছে যে, কয়েক দিন পর যে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো হবে সেটাই শেষ নয়। পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না সেটি কুইক রেন্টালের সাড়ে ১৪ টাকার সমান  হয়।
রেন্টাল বা কুইক রেন্টালওয়ালারা সরকারের সাথে যোগসাজস করে দুই হাতে টাকা কামাই করছে। তারা দেশটাকে লুটেপুটে খাবে, আর জনগণ নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে ঐ সব শোষকের পকেট ভারী করবে কেন?
\ চার \
কুইক রেন্টালের পক্ষে  সর্ব প্রথম কথা শোনা গেলো জনাব আনিসুল হকের কন্ঠে। ভদ্রলোক বলেছেন যে, দেশে কুইক রেন্টাল না হলে নাকি দেশের অর্থনীতিতে ১০ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হতো। তিনি আরো বলেছেন যে, কুইক রেন্টাল না থাকলে নাকি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম হতো। অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা কম হতো। এমন বিশাল অংকের একটি পরিসংখ্যান এই ভদ্রলোক কোত্থেকে আবিস্কার করলেন? আজ রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল নিয়ে আমি বিশদ আলোচনায় যাবো না। কিন্তু এই ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকার আলোচনায় না গেলে দেশে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই এটি নিয়ে দু'টি কথা বলতেই হচ্ছে।
 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, তার আমলে নাকি অতিরিক্ত ৩ হাজার ৩ শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। সাথে সাথে সচেতন মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, ঐ ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গেলো কোথায়? পরে সরকার বলল যে, তারা নাকি নতুন সংযোগ দিয়েছে ২১ লাখ । আর সেই সংযোগ দিতে গিয়েই নাকি এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টিকারী বিদ্যুৎ কোত্থেকে এলো? যদি ২১ লাখ  নতুন সংযোগের কথা সত্যি হয় তাহলে ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকা জিডিপিতে সংযুক্ত হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আর যদি ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকা জিডিপিতে যুক্ত হওয়ার দাবি সঠিক হয় তাহলে ২১ লাখ  নতুন সংযোগ দেয়ার দাবিটি বানোয়াট। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো যে, এই ভদ্রলোক একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আগে তিনি বিটিভির অনুষ্ঠানের একজন উপস্থাপক ছিলেন। গার্মেন্টস ব্যবসাতে তিনি সফল হন এবং বিজিএমই-এর প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ‘দেশ এনার্জী' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ৪৮ মেগাওয়াট করে ৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দুইটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স পান। দেশের যে ২৬ ব্যক্তি রেন্টাল প্ল্যান্ট স্থাপন করে শত শত কোটি টাকা কামাই তথা লুন্ঠনের বিরাট  মওকা পেয়েছেন এই ভদ্রলোক সেই ২৬ জন ভাগ্যবানের একজন। সারাদেশ যেখানে কুইক রেন্টালের সর্বনাশা ফলাফলের বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেখানে এই ভদ্রলোকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী হিসাবে নেমক হালালী করার জন্য কুইক রেন্টালের স্বপক্ষে সোচ্চার দালালী করছেন। হতে পারে যে এই দালালীর বিনিময়ে এরা হয়ত আরো কিছু এনাম পাবেন।
জনগণের ২ টাকা মূল্যের বিদ্যুৎকে এই ভদ্রলোকেরা ১২ টাকায় উন্নীত করেছেন। এখন এদের পৌষমাস আর জনগণের সর্বনাশ।
Email: asifarsalan15@gmail.com

মীমাংসার পথ খোলা রাখছে না সরকার

কাজী সিরাজ
দেশে আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, শান্তিপ্রিয় কোনো মানুষেরই কাম্য নয়; কাম্য নয় আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন বা সেই ধরনের অন্য কিছু। এটা প্রায় সবাই জানেন ও মানেন যে, দুই নেত্রীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট হিংসা আর হানাহানির রাজনীতি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, লগি-বৈঠার বেপরোয়া ব্যবহার, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হত্যা ও লাশের ওপর লাফালাফির অমানবিকতা এবং বলা চলে দেশে একটা প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থার মুখেই আসে ওয়ান-ইলেভেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই নেত্রীসহ অন্য বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল না। বিরোধ বেধেছিল প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে। তখনকার, অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব সাংবিধানিক নির্দেশ অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তখন সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি কেএম হাসান। হাসানের এক সময়কার বিএনপি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যাকে চায়, বিএনপি-জামায়াত জোট তা মানেনি। শেষ পর্যন্ত সংবিধানের বাতিলপূর্ব ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের অন্য অপশনগুলো কার্যকর করার ব্যাপারে আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ সুচতুরভাবে পরিহার করে এবং সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বা তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বা সংবিধানসম্মত আপিল বিভাগের অন্যান্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করে এ সংক্রান্ত সংবিধানের সর্বশেষ অপশন ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বও গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত ছিল, কিন্তু অসাংবিধানিক ছিল না। কিন্তু হাওয়া ভবনের অর্বাচীনদের মোটা বুদ্ধিতে বিএনপির সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ এনে সেই যে বেপরোয়া লড়াই ও ঘোষণা দিয়ে লগি-বৈঠার ব্যবহার শুরু হলো, তারই তো পরিণতি ওয়ান-ইলেভেন! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলখেল্লা পরে জাতির ঘাড়ে ৯০ দিনের জায়গায় দুই বছরের বেশি সময় চেপে থাকল একটি অসাংবিধানিক সরকার- কারও কারও মতে সেই সরকার ছিল অবৈধ। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন সেই সরকারের সমালোচনা করলেও এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে, তৎকালীন সেনাপতি মইন উ আহমেদের প্রকাশ্য সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত বিশ্বব্যাংকের সাবেক মাঝারি মানের কর্মচারী ড. ফখরুদ্দীন আহমদ যেদিন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, সেদিন বঙ্গভবনের সেই অনুষ্ঠানে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে উপস্থিত ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার মহাজোটের অন্য শীর্ষ নেতারা। শুধু তাই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'এই সরকার (মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার) আমাদের আন্দোলনের ফসল।' এটা ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। উল্লেখ্য, ফখরুদ্দীন সরকারের বিরোধিতা করে বেগম খালেদা জিয়া এবং চারদলীয় জোটের কোনো নেতা সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি। অর্থাৎ এবার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ আগাগোড়াই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গোঁড়া সমর্থক। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের তারাই পাইওনিয়ার। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর (ঐতিহ্যগতভাবে আসনটি ছিল আওয়ামী লীগের) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন আগামী নির্বাচনে নতুন ভোটার হিসেবে যারা প্রথম ভোট দেবে তাদের জন্মই হয়নি। আর মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পথ সুগম করে দেওয়া এবং সেই সরকারের প্রতি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণাকালে তাদের বয়স ছিল ১১-১২ বছর। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট তাদের অধিকাংশেরই অজানা থাকার কথা। তারা সব জেনে গেলে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট নেতাদের এখনকার বক্তব্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য। তারা একে অবশ্যই ডবল স্ট্যান্ডার্ড বলবে_ রাজনীতিতে যা অভিপ্রেত নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এবারের বিরোধ কে প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন বা কারা উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন তা নিয়ে নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও আন্দোলন আবার ১৯৯৪ সালে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১১ কার্যদিবসের স্বল্পকালীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ এবং তা কার্যকর হয় ৩০ মার্চ ১৯৯৬। এর আগে এ সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সহিংস আন্দোলনের চাপেই তৎকালীন বিএনপি সরকার এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয়। জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে লীগ সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে তা আবার ফিরে আসতে পারে, যেমন চাপের মুখে সংযোজিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দল বিএনপি ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বার বার বলেছিলেন সংবিধানবহিভর্ূত কোনো ব্যবস্থা তারা মানবেন না। ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর এক জনসভায় তিনি নির্দলীয় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দলের দাবি নাকচ করে বলেন, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, শাসক লীগ ও সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররাও একই কথা বলছেন_ তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেত্রী একটি আপসরফায় পেঁৗছতে চাচ্ছেন বলে মনে হয়। তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে তিনি ও তার দল স্পষ্টতই সরে এসেছে। তারা নির্দলীয় একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছেন এখন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট যখন অনড় ছিল তখন সরকারি মহল থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের আওতায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়োজনে আবার সংবিধান সংশোধনের সুযোগ আছে বলে বলা হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারের নতুন প্রস্তাব দিলে শাসকমহল আবার তাদের পূর্বাবস্থানে ফিরে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী এই ইস্যুতে রাজনৈতিক সংঘাতকেই উস্কে দিচ্ছে। আপস-মীমাংসার কোনো পথই তারা খোলা রাখছে না। অথচ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছানোর সুযোগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ গত ২৫ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত এক লেখায় নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন। বর্তমান সরকারের পরিবর্তে চলতি সংসদের সদস্যদের নিয়ে তিনি যে সরকারের কাঠামো প্রস্তাব করেছেন তাও হবে দলীয় বা সর্বদলীয় সরকার বা সংস্থা। কিন্তু বিএনপি তো ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না, এমনকি নির্বাচনকালীন কোনো অন্তর্বর্তী সরকারেও তারা অংশ নেবে বলে মনে হয় না। অপরদিকে আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে নতুন একটি বিকল্প নিয়েও ভাবা যেতে পারে। প্রস্তাবটি হচ্ছে_ দুই দল নিরপেক্ষ (নির্দলীয়) ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন প্রধান উপদেষ্টা ও ১০-১২ জন উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর নাম সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। তাদের জন্য ১১টি বা ১৩টি আসন শূন্য করে দেওয়া হবে। ওইসব আসনের উপনির্বাচনে প্রধান দুই দল কোনো প্রার্থী দেবে না। প্রধান দুই দলের বাইরে যারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এটা নিশ্চিত যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও তারা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। সেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা যেদিন শপথ নেবেন, তার শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার বিলুপ্তি ঘটবে। অন্য মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট নবম জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করবেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ প্রায় এ ধরনের একটি ফর্মুলা দিয়েছিলেন। এ ধরনের একটি নির্বাচিত নির্দলীয় সরকার, যা বর্তমান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে না- উভয় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, যদি তারা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিক হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের সমঝোতার ভিত্তিতেই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই।

কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এ ধরনের নির্বাচিত কোনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও সাহসী নয় বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সংবিধানের বাইরে যাবেন না। সংবিধানের আওতায়ও কোনো নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা যে তারা মানবেন না সে কথা ব্যাখ্যা করে বলেছেন শাসক লীগের মুখপাত্র লীগ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে বিএনপিকে সংসদে আসতে হবে এবং তাদের প্রস্তাব সংসদে অনুমোদন করাতে হবে অথবা আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। রেলমন্ত্রী হয়ে রেলের কালো বিড়াল ধরার লম্বা কথা বলে যিনি এখন নিজেই কালো বিড়াল ধরার জনগণের সন্দেহের 'কলে' ফেঁসে আছেন, রেল থেকে বিতাড়িত সেই দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একই ঢোল বাজিয়ে সরকারের ওপর জনগণের বিরক্তি বাড়াচ্ছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান আবার কঠোর বলে মনে হচ্ছে। আর এতেই শঙ্কা বাড়ছে সংঘাতের। মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাবের আবরণে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টির একটি তৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন সংসদে বাজেট বক্তৃতায়। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, 'বিদ্যুতের ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। বিদ্যুতের ব্যাপারে বললে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হন; আমার বন্ধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে যান। তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। তিনি হয়তো তার হারানো রাজ্য ফিরে পেতে চান।' প্রধানমন্ত্রী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমালোচনা থেকে ধারণা করা যায়, সংবিধান সংশোধনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস এবং প্রয়োজনে মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও তার কোনো আপত্তি নেই তাতে। সংসদে প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সময়-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'তার প্রস্তাবে বিএনপির খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই অনুষ্ঠানে তিনি এও বলেছেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির একজন বাদে অন্য সবাই আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে ছিলেন। সুরঞ্জিত বাবুও বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে।' এ থেকে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়, তার সংশোধনী প্রস্তাবের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারেও সংশোধনী আনা যেতে পারে। একবার নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনীর প্রশ্ন এলে বিরোধী দলের দাবির বিষয়টিও আসতে পারে। কারণ এ ব্যাপারে একটা প্রবল জনমত আছে। এ ইস্যুতে অদূর ভবিষ্যতে গণআন্দোলনে নাকানি-চুবানি খাওয়ার হাত থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসার একটি পথও প্রচ্ছন্নভাবে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তার এ অবস্থান চলমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন অনেকে। বোঝা যাচ্ছে, সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে লীগ সরকার দেশকে যে আবার একটা সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে, জোটের কোনো কোনো শরিক তার দায় কাঁধে নিতে চাইছে না।

সংসদে গিয়ে ফায়সালা বা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে পরবর্তী সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার যে 'ফতোয়া' সরকারপক্ষ দুই সপ্তাহ ধরে দিচ্ছে, বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট তা মানবে না_ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি বর্তমান ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে দল ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাঁচানোর আশায় জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে কোনোরূপ সমঝোতায় পেঁৗছে গেলেও (জামায়াতের পক্ষে এটা সম্ভব। ১৯৯১ সালে দুজন মহিলা সংসদ সদস্যের বিনিময়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সাহায্য করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনে তারা বিএনপিকে ছেড়ে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী হয়) বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ বিএনপির আন্দোলন করার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তাত্তি্বক বিশ্লেষণ দিয়ে তারা সরকারবিরোধী শক্তিকে হতাশ করতে চাইছেন। কিন্তু আমরা জানি, একটি সরকার যখন তার অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, দলবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অজনপ্রিয় হয়ে যায়, জনগণই সেই সরকারের বিরুদ্ধে দ্রোহের পতাকা উড়ায়। জনগণের দ্রোহই বিএনপির পুঁজি হয়ে যেতে পারে। যদি অন্য কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে না ওঠে। বর্তমান সরকার আর জনপ্রিয় সরকার নেই। সরকার পক্ষের আচরণ-উচ্চারণে মনে হচ্ছে, তারা গায়ের জোরেই শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার ভুল করছে। গভীর রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে না হাঁটলে তাদের অবশ্যই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। আবর্জনা পরিষ্কার করে সামনে থেকে জনগণের সাহসী নেতৃত্ব দিতে বিএনপি যদি ব্যর্থও হয়, জনগণ ব্যর্থ হবে না। প্রচলিত রাজনীতির ও সংগঠনের ব্যাকরণ পাল্টে দিয়ে প্রয়োজনে জনগণই গড়ে তুলবে তাদের আপন রাজনৈতিক শক্তি।

সংযুক্তি : বাহাত্তর সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) ধারা অনুযায়ী সংসদ বলবৎ থাকা অবস্থায়ই পরবর্তী নির্বাচন হবে। বর্তমান এমপিরা স্বপদে বহাল থেকেই নির্বাচন করবেন। এতে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না। আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে সন্ধিহান আওয়ামী লীগ এই সাংবিধানিক সুবিধাও ভোগ করতে চায়। অন্যরা তা মানবেন কেন?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com

দুর্গম যাত্রাপথে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত


এপিজে আবদুল কালাম
নির্ধারিত রাত ৮টা ১৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ভবনে এলেন সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিং। সে সময় তিনি আমাকে বিভিন্ন দল ও সংসদ সদস্যের সমর্থনসূচক সম্মতিপত্র দেখান। আমি তখন তাকে স্বাগত জানাই। তার পছন্দমতো রাষ্ট্রপতি ভবন শপথবাক্য পাঠ করার জন্য প্রস্তুত বলে জানালাম। সোনিয়া গান্ধী বললেন, তিনি মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চান। এটা ছিল নিশ্চিতভাবেই আমার কাছে বিস্ময়ের। রাষ্ট্রপতি ভবন তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের কাছে সরকার গঠনের জন্য চিঠি পাঠানোর কাজ নতুন করে শুরু করে


এপিজে আবদুল কালাম ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালের অনেক স্মৃতি তার মনে উঁকি দেয়। সেসব নিয়ে তিনি রচনা করেন স্মৃতিকথা। ওই স্মৃতিকথা থেকে চুম্বক অংশ প্রকাশ করে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা। তার থেকে সংক্ষেপিত
ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা


অন্যান্য দিনের মতো আমি চেন্নাইয়ের আন্না বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলাম। 'ভিশন টু মিশন'-এর ওপর একটি লেকচার দিয়েছিলাম। ওই লেকচার সেশনটা এক ঘণ্টা থেকে দু'ঘণ্টা অব্দি গড়িয়েছিল। দুপুরে একদল ছাত্র গবেষকের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করার পর আবার ক্লাসে গেলাম। বিকেলের দিকে আমি যখন আমার রুমে ফিরছিলাম তখন উপাচার্য অধ্যাপক এ. কালানিধিও আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কেউ একজন দিনভর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আমি যখন কক্ষে প্রবেশ করছিলাম তখনও টেলিফোন বেজে চলছিল। আমি যখন টেলিফোনে পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম তখন প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান বলে অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়। কয়েক মাস আগে আমি শিক্ষকতা করব বলে ভারত সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ক্যাবিনেট পদমর্যাদার পদ ছেড়ে আসি। এখন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির সঙ্গে কথা বলার পর আমার জীবনে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটে গেল।
গুজরাট সফর : আমার ভাবনায় উন্নয়নের অন্যতম পিলার ছিল দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা দূর করা। এরসঙ্গে এমন এক সমাজ নির্মাণ আমার চিন্তায় ছিল, যেখানে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ থাকবে না এবং কেউই নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করবে না। ২০০২ সালের আগস্টে গুজরাট সফরের সময় এসব চিন্তাই আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর এটাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আমি আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেছি।
মাত্র কয়েক মাস আগে রাজ্যটিতে দাঙ্গা হয়েছিল এবং এর প্রভাবে হাজার হাজার মানুষ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছিল। এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কাজ। কারণ এটা রাজনৈতিকভাবে একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। আমি মনে করেছি, সেখানে কী ঘটেছে বা কী ঘটছে সেটা দেখা আমার মিশন নয়। বরং কী করা যেতে পারে সেটাই আমার কাজ। কী ঘটেছিল সেটা নিয়ে বিচার বিভাগে, সংসদে আলোচনা হয়েছে এবং এখনও আলোচনা চলছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো রাষ্টপতির ওই এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার নজির নেই। ওই সময় গুজরাট যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন। মন্ত্রণালয় ও আমলাতান্ত্রিক পর্যায়ে বলা হয়, এ সময় আমার গুজরাটে যাওয়া উচিত নয়। এর প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু আমি গুজরাট সফরের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলি এবং গুজরাটেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার সফরের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ভবনে জোর প্রস্তুতি চলে।
প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি আমাকে এ ব্যাপারে মাত্র একটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আপনি কি মনে করেন এ সময় আপনার গুজরাট যাওয়া প্রয়োজন?' আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলি, আমি মনে করি আমার সফর সেখানকার জনগণের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও লাঘব করবে এবং সেটাকেই আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমার সফরের ফলে সেখানে ত্রাণ তৎপরতা ত্বরান্বিত হবে, মানুষের মধ্যে মানসিক ঐক্য গড়ে উঠবে, আর এটাই আমার মিশন, যেটা আমি আমার শপথ গ্রহণের সময় উচ্চারণ করেছি...।
আমি গুজরাটে ১২টি এলাকা পরিদর্শন করি। এগুলোর মধ্যে ছিল তিনটি ত্রাণ শিবির এবং নয়টি দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকা, যেগুলোতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল বেশি। একটি ত্রাণ শিবির পরিদর্শনের দৃশ্য আমার স্মরণে আসছে। একটি শিশু হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে বলল, 'রাষ্ট্রপতিজি, আমি আমার পিতা-মাতাকে ফেরত পেতে চাই।' আমি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এরপর আমি জেলা প্রশাসনকে এ শিশুর শিক্ষাসহ যাবতীয় দেখভালের জন্য বলি। মুখ্যমন্ত্রীও আমাকে এ ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন।
আমার গোটা সফর পর্বে কেবলই মনে হয়েছে আমাদের একমাত্র এজেন্ডা কী হওয়া উচিত? যে কোনো ধর্মমতে বিশ্বাসী নাগরিকের তার ধর্মমত পালনের মৌলিক অধিকার থাকা উচিত, যাতে সে তার বিশ্বাসে অটল থেকেই সুখী হতে পারে। মানুষের মনের ঐক্যবোধকে বিপদাপন্ন করার অধিকার কারও নেই। কারণ মনের এই ঐক্যই আমাদের দেশের জীবনপ্রবাহ।
আর এটাই আমাদের দেশকে অদ্বিতীয় করেছে।
ন্যায়বিচার কী আর গণতন্ত্রই বা কী? প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে সম্মানের সঙ্গে বাঁচার; প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে স্বাতন্ত্র্যের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার। ন্যায্য ও যথাযথ উপায়ে সম্মান ও স্বাতন্ত্র্য অর্জনের সুযোগ করে দেয় গণতন্ত্র। আমাদের সংবিধানও সে গ্যারান্টি দেয়। প্রকৃত গণতন্ত্রে মানুষের বিশ্বাস পদ্ধতি ও লাইফস্টাইলের প্রতি সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।
অপরের মতামতের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসহনশীলতা ও অপরের জীবনাচার বা ধর্ম বা মতামতের প্রতি ক্রমবর্ধমান ঘৃণা বা অবজ্ঞা কোনো অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গ : একজন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হলো প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের পর একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা বা কোনো ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা করা। এ সময় কোন দল বা জোটের সরকার গঠনের মতো অবস্থা রয়েছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি নিজে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর এটা একটা স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন। এখানে সিলেকশন প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল হয়ে পড়ে যখন হাউসে কোনো এক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না এবং যখন সরকার গঠনের একাধিক দাবিদার থাকে। এদিক থেকে ২০০৪ সালের নির্বাচন ছিল একটা আগ্রহোদ্দীপক ঘটনা। নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল কোনো দল সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
নির্বাচিতদের মধ্যে কংগ্রেস সবচেয়ে বড় দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ সত্ত্বেও তিনদিন পার হয়ে গেলেও কোনো দল সরকার গঠনের দাবি জানায়নি। এটা আমার জন্য ছিল উদ্বেগের বিষয়। আমি আমার সচিবালয়কে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিলাম। চিঠি নিয়ে সবচেয়ে বড় দলের কাছে তারা গেল। কংগ্রেসকে সরকার গঠনের দাবি জানানোর জন্য বলা হলো।
১৮ মে আমার সঙ্গে সোনিয়া গান্ধী বৈঠক করবেন বলা হলো। তিনি নির্ধারিত সময়েই এলেন। তবে তিনি একা না এসে সঙ্গে মনমোহন সিংকে নিয়ে এলেন। তাদের সঙ্গে আমার কথা হলো। তিনি তার দলের পক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করলেন। তবে অন্যান্য দলের কর্মকর্তাদের অনুমোদনপত্র দেখাতে পারেননি। এরপর ১৯ তারিখে তিনি সমর্থনপত্র সঙ্গে নিয়ে এলেন। তিনি কেন বিষয়টি স্থগিত রাখছেন, আমরা বিষয়টি আজ সন্ধ্যার মধ্যেই ফয়সালা করতে পারি। তিনি চলে গেলেন। এরপর বার্তা পাঠালেন, তিনি আমার সঙ্গে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে সাক্ষাৎ করবেন।
এসব যোগাযোগ যখন এগুচ্ছিল তখন আমার কাছে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির কাছ থেকে ই-মেইল আসতে লাগল, আমি যাতে সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ না দিই। আমি কোনো মন্তব্য না করে এসব ই-মেইল ও চিঠি সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির কাছে পাঠিয়ে দিই। সে সময় অনেক দলের নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করে সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার জন্য অনুরোধ জানান। কারণ সেটা তাদের মতে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তবে মিসেস গান্ধী সরকার গঠনের দাবি জানালে আমার তাকে নিয়োগ দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না।
নির্ধারিত রাত ৮টা ১৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ভবনে এলেন সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিং। সে সময় তিনি আমাকে বিভিন্ন দল ও সংসদ সদস্যের সমর্থনসূচক সম্মতিপত্র দেখান। আমি তখন তাকে স্বাগত জানাই। তার পছন্দমতো রাষ্ট্রপতি ভবন শপথবাক্য পাঠ করার জন্য প্রস্তুত বলে জানালাম। সোনিয়া গান্ধী বললেন, তিনি মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চান। এটা ছিল নিশ্চিতভাবেই আমার কাছে বিস্ময়ের। রাষ্ট্রপতি ভবন তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের কাছে সরকার গঠনের জন্য চিঠি পাঠানোর কাজ নতুন করে শুরু করে।
তবে তিন দিন ধরে কেন কোনো দল সরকার গঠনের দাবি করেনি সে ঘোর কিন্তু আমার কাটেনি।

নিজের সঙ্গেই যুদ্ধে লিপ্ত


 এম আবদুল হাফিজ
পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে অথর্ব সরকারগুলোর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই উসকে দেয় এমন যুদ্ধকে। তারা এমনও ভাবে যে, প্রতিপক্ষকে এক হাত দেখিয়ে দিতে পেরেছে সরকার। কিন্তু সত্বরই তাদের এই আত্মপ্রসাদ উবে যায় যখন তারা দেখে যে ওই সন্ত্রাসের আগুন গণরোষানলের সঙ্গে একাকার হয়ে তাদের নিভৃত নিরাপদ বাসকেও গ্রাস করতে চলেছে। বিএনপির অপশাসন, অপকৌশল এবং স্ব-আরোপিত শাস্তি নিয়ে এন্তার লেখা হয়েছে, যদিও সেসব থেকে দলটি বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি। একই পথে হাঁটছে আরেক দাম্ভিক নেতৃত্বের অধীন ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ, যার গণবিরোধী সব নীতি ও পদক্ষেপকে মনে হবে যেন দলটি দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যা প্রকারান্তরে জাতির নিজের সঙ্গে নিজেরই যুদ্ধের শামিল। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৮ সালের প্রদোষলগ্নে ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশ করেছিল। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী সরকারের সিংহভাগ মন্ত্রী-আমলার অনেক স্বপ্ন-সাধ পূর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন, যদিও নিন্দুকরা বলে যে কোটি টাকা তো মন্ত্রীর একজন পিএস/এপিএসও রোজগার করে বা ফেনসিডিল-ইয়াবা ফেরি করেও রোজগার হয়। মন্ত্রী-আমলাদের রোজগারের ওই ছকে ফেলা যায় না, সেটি তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর।
কথা তো ছিল একটি দারিদ্র্যমুক্ত-বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের। প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিও সভা-সেমিনার-টক শোতে বিভিন্ন খাতে অগ্রগতির কথা বলেন। আরও বলেন, আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকের ঊর্ধ্বগামিতার কথা। আমারও ওইসব শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যা যে বাস্তবে তার কোনোটাই খুঁজে পাই না।
পবিত্র রমজান মাসের প্রাক্কালে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি পদক্ষেপগুলোর দীর্ঘ খতিয়ান সংবাদপত্রে আসতে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলোতেও তা আসত, কিন্তু কখনোই আমরা বাজারে তার প্রভাব ঘটতে দেখিনি। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ভেতর দিয়ে একই রকম মহার্ঘতার বোঝা ঘাড়ে চাপিয়েই আমাদের পবিত্র মাসটি অতিক্রান্ত হতো। এই চিত্র সমাজের ও দেশের সব ক্ষেত্রেই। কৃচ্ছ্র সাধনের নামে পবিত্র ঈদেও সন্তান-সন্ততির সঙ্গে প্রতারণা ও বঞ্চনার খেলা খেলতে হয়েছে সীমাবদ্ধ আয়ের মানুষকে।
বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজিত এ দেশে কর্তৃপক্ষ প্রকারান্তরে জনগণকে বুঝিয়েই দেয় যে_ ঈদ, ইফতার পার্টিসহ রমজান এবং এহেন অনুষ্ঠান উদযাপন মূলত এলিট শ্রেণীর, যাদের ট্যাঁকে আছে ছিনতাই-মুক্তিপণের, উৎকোচ-টেন্ডার বাণিজ্যের বা হাজারো কিসিমের অসদুপায়ে অর্জিত অগুনতি টাকা। এমন বিভাজন ও বিভক্তির একটি জাতি বড়জোর নিজেদের মধ্যেই উচ্ছিষ্ট নিয়ে কলহ করতে পারে, কিন্তু বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে কোনো দুর্ভেদ্য প্রাকার গড়ে তুলতে পারে না। তার জন্য চাই ইস্পাত ঐক্যের একটি জাতি, যার জীবন-দর্শন অভিন্ন এবং কট্টর সমাজতান্ত্রিক সাম্য না থাকলেও যাদের মধ্যে থাকবে আর্থ-সামাজিক সমতা। সেই অবস্থায় আর নেই এই জাতি। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতাসহ সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদেশ অস্তিত্বে এলেও, ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ছুড়ে ফেলা হয়েছে সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শকে এবং তার সঙ্গে উদ্ভব ঘটেছে নব্য ধনিক, নব্য রক্ষণশীলদের। তারা রাষ্ট্রের শেষ সম্বলটুকুও হস্তগত করতে ক্ষমতাসীন বনাম ক্ষমতাসীন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। অভিবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ এবং আমাদের সুদক্ষ পোশাক শিল্পীদের শোষণ করে বা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে এ নব্য ধনিকরা নির্লজ্জ ভোগবাদ ও কনজ্যুমারিজমে লিপ্ত হয়। এই অস্থিতিশীল বিশৃঙ্খল দেশে তারা নিজেরাই তাদের উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে চায় না। এও এক প্রকার যুদ্ধ, যা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।
জাতি নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু জাতি তা উপলব্ধি করতে অক্ষম। জনগণ একটি ঘোরের মধ্যে বাস করছে। স্রেফ টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষ নিরন্তর ছুটছে। তার মহৎ কল্যাণকর বা অধিবিদ্যামূলক কিছু ভাবার অবকাশ নেই, যদিও এই প্রচণ্ড গতির যুদ্ধে সে নিজেই বারবার পরাজিত হচ্ছে। দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়মের নিগড় ভেঙে যে চলার পথ বেছে নিয়েছে, নিয়মের অভাবেই তা তার সাবলীলতাকে ধ্বংস করে তার সৃজনশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এখনও এ দেশের ভাণ্ডারে যা আছে বা যা উৎপাদিত হতে পারে, যদি নব্য ধনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের লাগামকে টেনে ধরতে পারি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে ফিরিয়ে আনতে পারি এবং দেশটাকে প্রাণভরে ভালোবাসতে পারি তাহলে সম্ভাবনার সীমা নভোমণ্ডলকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঞযবহ ংশু রিষষ নব ড়ঁৎ ড়হষু ষরসরঃ.


ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক