ড. ন জ রু ল ই স লা ম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, দলের প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শ ও দর্শন আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের দর্শন ও আদর্শ আলোচনায় আনতে হবে। বিএনপি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে একটি দল বলে এই দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা দাবি করেন। আমাদের জানা নেই, জিয়াউর রহমানের আদর্শের দাবিদাররা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কতটুকু জানেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ বা দর্শন কী ছিল এবং এই দর্শন জিয়াউর রহমানের জীবনে কীভাবে প্রতিফলন হয়েছিল। এরা হয়তো আরও জানেন না, জিয়াউর রহমানের আদর্শের অনুসারী হিসেবে নিজেরা দাবি করে বর্তমান বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকরা যা করছেন তার সঙ্গে জিয়াউর রহমনের জীবনদর্শন, আদর্শ, রাজনৈতিক ও ব্যক্তি আচরণের কতটুকু মিল আছে।
প্রথমেই বলে নিই, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা খুব সহজ নয়। কারণ প্রথমত তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, যে অর্থে আমরা রাজনীতিবিদদের চিনি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন খুব স্বল্প সময়ের। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সফলতা এখানেই, মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি দেশের মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্য ও অনুকরণীয় অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যার ফল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতা। বিএনপি যে একটি শক্তিশালী ও প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত, তা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, এর বড় প্রমাণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিশেষ করে এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রতিপক্ষ কর্তৃক আক্রমণের ঘটনা। যিনি যত বেশি আলোচিত বা সমালোচিত হবেন, যিনি প্রতিপক্ষ দ্বারা যত বেশি আক্রান্ত হবেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের নেতা। এটাই ইতিহাসের প্রমাণ। আমরা শক্তিশালীদের সমালোচনা করি, তাদের আক্রমণ করি। কারণ আমরা তাদের ভয় পাই অথবা তাদের অস্তিত্ব আমাদের চেতনায় জাগৃত থাকে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দ্বারা জিয়াউর রহমান যেভাবে সমালোচিত ও আক্রান্ত, এমন অন্য আর কেউ নন।
যা হোক, এ প্রসঙ্গ এবার থাক। আমরা উল্লেখ করেছিলাম সাধারণ অর্থে একজন রাজনীতিককে আমরা যেভাবে চিনি, জিয়াউর রহমানকে আমরা সেভাবে চিনি না। সেই অর্থে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অতীত নেই। তিনি রাজনীতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। একজন সাহসী সৈনিক। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, তাকে চিনতে হলে প্রথমে জিয়াউর রহমানের সৈনিকজীবন জানা প্রয়োজন। একজন রাজনীতিবিদ যেমন রাজনৈতিক জীবনে জনগণের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা সমর্থন, পরিচিতি পান-একজন সৈনিকের তেমন সুযোগ নেই। সেই অর্থে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন অপরিচিত সৈনিক-অন্যান্য সৈনিকের জীবনের মতোই ছিল তার জীবন। তবে তিনি বোধহয় ব্যতিক্রম ছিলেন এবং এই ব্যতিক্রম থাকার কারণেই তিনি হাজারো সৈনিকের মতো হারিয়ে যাননি। তিনি একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাকে দেশের সবাই চেনে-তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। তার আদর্শে লক্ষ-কোটি মানুষ অনুপ্রাণিত। এটাই ব্যতিক্রম। একজন সাধারণ সৈনিক থেকে জিয়াউর রহমানের পার্থক্য এখানেই।
জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের কাছে প্রথম পরিচিত হন ১৯৭১ সালের মার্চের ২৬ ও ২৭ তারিখে। বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, দেশি-বিদেশি ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে এবং ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তবে জিয়াউর রহমানের আগে আরও দু’একজন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন বলে জানা যায়। এবং এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক। আমার মনে হয় এ বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ ইতিহাস একটি প্রবহমান ধারা। ইতিহাস তার নিজের পথেই ইতিহাসকে খুঁজে বের করে।
আমরা এবার ফিরতে চাই জিয়াউর রহমানের সৈনিক জীবনে। সৈনিক জীবনের আগে তার বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।
জিয়াউর রহমান ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মনসুর রহমান সরকারি বিভাগে রসায়নবিদ ছিলেন এবং তার কর্মস্থল ছিল কলকাতা। বাল্যকালে জিয়াউর রহমান গ্রামে ও শহরে উভয় স্থানে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় তার পিতা মনসুর রহমান পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে জিয়া পিতা ও পরিবারের সঙ্গে করাচিতে তার পিতার নতুন কর্মস্থলে চলে যান। তখন করাচি ছিল পাকিস্তানের রাজধানী। জিয়াউর রহমান করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। জিয়ার কৈশোরকাল কাটে করাচিতে এবং ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি করাচির ডি জে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হন এবং কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে একজন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন। দু’বছর করাচিতে সৈনিক জীবন শেষে ১৯৫৭ সালে তাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। এরপর তিনি জার্মানি ও যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। জিয়াউর রহমানের সৈনিক জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্লাটুন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য, এই সেক্টরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ স্থলযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও তার প্লাটুন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং জিয়াউর রহমানের প্লাটুন বীরত্বপূর্ণ ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার স্বীকৃতি হিসেবে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি পায়। জিয়াউর রহমান নিজেও সেনাবাহিনীর জন্য সম্মানিত হেলাল-ই-জুররাত মেডাল পান। তার ইউনিট সর্বমোট ১১টি মেডাল পায়। এর মধ্যে দুটি সিতারা-ই-জুররাত ও নয়টি তমঘা-ই-জরাত।
১৯৬৬ সালে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি কোয়েটায় কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে কমান্ডো ও টেকনিক্যাল ওয়ারফেয়ারের ওপর কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আরও বেশি করে বাঙালি সেনা আফিসার নিয়োগের চেষ্টা করেন এবং কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে থাকার সময় দুটি বাঙালি ব্যাটালিয়ন গঠনে সহায়তা করেন। ১৯৬৯ সালে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে) পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর উচ্চতর পদে দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়।
১৯৭০ সালে জিয়াউর রহমান জার্মানিতে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭০ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে অনেক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও তত্কালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিক রায়কে মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না-করে বাঙালিদের ওপর ২৫ মার্চ রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের জঘন্যতম মানবহত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রামে অবস্থিত ৮ম রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় ২৫ মার্চের কালরাতে।
বিভিন্ন লেখালেখি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় ২৫ মার্চ রাতে জিয়াউর রহমানকে তার পাকিস্তানি কমান্ড চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অস্ত্র খালাস করতে নির্দেশ দেয়। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে খবর পান ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার অফিসে ফিরে গিয়ে তার কমান্ডিং অফিসার পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন। কোনো কোনো সূত্রমতে জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ, আবার কোনো কোনো সূত্রমতে ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি ইংরেজিতে যা বলেন তার প্রধান অংশ হল : ‘This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I Major Zia, the provisional head of the Government of sovereign state of Bangladesh, on behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangladesh.’ (Wikipedia)
(চলবে)
nazrul.islam.psy@gmail.comএই প্রবন্ধের বেশিরভাগ তথ্য ডরশরঢ়বফরধ থেকে নেওয়া।
প্রথমেই বলে নিই, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা খুব সহজ নয়। কারণ প্রথমত তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, যে অর্থে আমরা রাজনীতিবিদদের চিনি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন খুব স্বল্প সময়ের। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সফলতা এখানেই, মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি দেশের মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্য ও অনুকরণীয় অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যার ফল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতা। বিএনপি যে একটি শক্তিশালী ও প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত, তা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, এর বড় প্রমাণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিশেষ করে এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রতিপক্ষ কর্তৃক আক্রমণের ঘটনা। যিনি যত বেশি আলোচিত বা সমালোচিত হবেন, যিনি প্রতিপক্ষ দ্বারা যত বেশি আক্রান্ত হবেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের নেতা। এটাই ইতিহাসের প্রমাণ। আমরা শক্তিশালীদের সমালোচনা করি, তাদের আক্রমণ করি। কারণ আমরা তাদের ভয় পাই অথবা তাদের অস্তিত্ব আমাদের চেতনায় জাগৃত থাকে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দ্বারা জিয়াউর রহমান যেভাবে সমালোচিত ও আক্রান্ত, এমন অন্য আর কেউ নন।
যা হোক, এ প্রসঙ্গ এবার থাক। আমরা উল্লেখ করেছিলাম সাধারণ অর্থে একজন রাজনীতিককে আমরা যেভাবে চিনি, জিয়াউর রহমানকে আমরা সেভাবে চিনি না। সেই অর্থে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক অতীত নেই। তিনি রাজনীতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। একজন সাহসী সৈনিক। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, তাকে চিনতে হলে প্রথমে জিয়াউর রহমানের সৈনিকজীবন জানা প্রয়োজন। একজন রাজনীতিবিদ যেমন রাজনৈতিক জীবনে জনগণের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা সমর্থন, পরিচিতি পান-একজন সৈনিকের তেমন সুযোগ নেই। সেই অর্থে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন অপরিচিত সৈনিক-অন্যান্য সৈনিকের জীবনের মতোই ছিল তার জীবন। তবে তিনি বোধহয় ব্যতিক্রম ছিলেন এবং এই ব্যতিক্রম থাকার কারণেই তিনি হাজারো সৈনিকের মতো হারিয়ে যাননি। তিনি একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাকে দেশের সবাই চেনে-তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। তার আদর্শে লক্ষ-কোটি মানুষ অনুপ্রাণিত। এটাই ব্যতিক্রম। একজন সাধারণ সৈনিক থেকে জিয়াউর রহমানের পার্থক্য এখানেই।
জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের কাছে প্রথম পরিচিত হন ১৯৭১ সালের মার্চের ২৬ ও ২৭ তারিখে। বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, দেশি-বিদেশি ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের নামে এবং ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তবে জিয়াউর রহমানের আগে আরও দু’একজন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন বলে জানা যায়। এবং এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক। আমার মনে হয় এ বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ ইতিহাস একটি প্রবহমান ধারা। ইতিহাস তার নিজের পথেই ইতিহাসকে খুঁজে বের করে।
আমরা এবার ফিরতে চাই জিয়াউর রহমানের সৈনিক জীবনে। সৈনিক জীবনের আগে তার বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।
জিয়াউর রহমান ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মনসুর রহমান সরকারি বিভাগে রসায়নবিদ ছিলেন এবং তার কর্মস্থল ছিল কলকাতা। বাল্যকালে জিয়াউর রহমান গ্রামে ও শহরে উভয় স্থানে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় তার পিতা মনসুর রহমান পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে জিয়া পিতা ও পরিবারের সঙ্গে করাচিতে তার পিতার নতুন কর্মস্থলে চলে যান। তখন করাচি ছিল পাকিস্তানের রাজধানী। জিয়াউর রহমান করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। জিয়ার কৈশোরকাল কাটে করাচিতে এবং ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি করাচির ডি জে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হন এবং কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে একজন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন। দু’বছর করাচিতে সৈনিক জীবন শেষে ১৯৫৭ সালে তাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। এরপর তিনি জার্মানি ও যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। জিয়াউর রহমানের সৈনিক জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্লাটুন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধ করেন। উল্লেখ্য, এই সেক্টরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ স্থলযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও তার প্লাটুন সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং জিয়াউর রহমানের প্লাটুন বীরত্বপূর্ণ ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার স্বীকৃতি হিসেবে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি পায়। জিয়াউর রহমান নিজেও সেনাবাহিনীর জন্য সম্মানিত হেলাল-ই-জুররাত মেডাল পান। তার ইউনিট সর্বমোট ১১টি মেডাল পায়। এর মধ্যে দুটি সিতারা-ই-জুররাত ও নয়টি তমঘা-ই-জরাত।
১৯৬৬ সালে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি কোয়েটায় কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে কমান্ডো ও টেকনিক্যাল ওয়ারফেয়ারের ওপর কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আরও বেশি করে বাঙালি সেনা আফিসার নিয়োগের চেষ্টা করেন এবং কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে থাকার সময় দুটি বাঙালি ব্যাটালিয়ন গঠনে সহায়তা করেন। ১৯৬৯ সালে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে) পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর উচ্চতর পদে দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়।
১৯৭০ সালে জিয়াউর রহমান জার্মানিতে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭০ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে অনেক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও তত্কালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিক রায়কে মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না-করে বাঙালিদের ওপর ২৫ মার্চ রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের জঘন্যতম মানবহত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। জিয়াউর রহমান তখন চট্টগ্রামে অবস্থিত ৮ম রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় ২৫ মার্চের কালরাতে।
বিভিন্ন লেখালেখি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় ২৫ মার্চ রাতে জিয়াউর রহমানকে তার পাকিস্তানি কমান্ড চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অস্ত্র খালাস করতে নির্দেশ দেয়। জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে খবর পান ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার অফিসে ফিরে গিয়ে তার কমান্ডিং অফিসার পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন। কোনো কোনো সূত্রমতে জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ, আবার কোনো কোনো সূত্রমতে ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণায় তিনি ইংরেজিতে যা বলেন তার প্রধান অংশ হল : ‘This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I Major Zia, the provisional head of the Government of sovereign state of Bangladesh, on behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangladesh.’ (Wikipedia)
(চলবে)
nazrul.islam.psy@gmail.comএই প্রবন্ধের বেশিরভাগ তথ্য ডরশরঢ়বফরধ থেকে নেওয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন