রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ভঙ্গি এবং আমাদের করণীয়



মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী :
 রোহিঙ্গা সমস্যা চেচনিয়া, বসনিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির প্রভৃতি সমস্যার মতই একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও স্থায়ী মুসলিম জনগোষ্ঠির নাম রোহিঙ্গা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর যাবত আরাকান মোটামুটি একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।  {বিস্তারিত জানতে-ইফা কর্তৃক প্রকাশিত রোহিঙ্গা সমস্যা : বাংলাদেশের দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রন্থটি পড়ুন}
অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে রোহিঙ্গাদের, খুনের ধারা আর লেলিহান অগ্নিশিখায় একাকার রাখাইন রাজ্য। সেখানকার আকাশ-বাতাসে লাশের গন্ধ। নাফ নদীর তীরে আরেক কারবালার পটভূমি। ফুরাত নদীতে পানি ছিল, কিন্তু সে পানি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাফেলার জন্য ছিল আকাশ কুসুম। কিন্তু নাফ নদীরপানি রক্ত আর লাশের দুর্গন্ধে ক্রমেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীতে আজ মানবতা বড়ই অসহায়। ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কল্যাণে যেমন  জায়োনিস্ট ইসরাইলীদের করুণার উপর নির্ভরশীল করে দেয়া হয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্যও  তেমন উগ্র জঙ্গি রাখাইনদের মর্জির উপরই নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। অহিংসার ভেক ধরা বৌদ্ধরা মুসলমান যুবক-নারী-শিশুদের রক্তে সাঁতার কেটে উল্লাস করছে।  বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও ‘লুন্টিন' বাহিনী নির্মম হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে তুলেছে। সংবাদ পত্রে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন চিত্র দেখে এক সন্তানের জননি উম্মে তায়্যিবা অশ্রুসিক্ত হয়ে মহানবীর (সা.)-এর একটি হাদীসের এবারত স্মরণ করিয়ে দিলেন। আজকের এই লেখাটি সহধর্মীনীর অনুপ্রেরণারই ফসল। ঐ হাদিসে রাসুল (সা.) বলে গিয়েছেন, মুসলমান উম্মাহ একটিমাত্র দেহের মত। যার যেকোন অঙ্গে আঘাত লাগলে পুরো শরীর বেদনা অনুভব করবে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও বেপরোয়া লুটতরাজ চলছে। এই অবস্থায় বিশ্ব মুসলিমের নীরব দর্শকের ভূমিকায় প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক যে , আমরা হোসাইনী মুসলমান না ইয়াজিদী মুসলিম?
রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ওদের অপরাধ একটাই আর তা হলো ওরা মুসলমান! এই পরিচয়টাই তাদের অকল্যাণ ডেকে আনছে বলে আমরা মনে করি। আর না হয় (অমুসলিম) জাতি সংঘসহ বিশ্ব সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কেন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সামান্য অযুহাতে যারা ইরাক আফগানিস্তানে আক্রমণ করে হাজার বছরের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, যারা লাখো নিরীহ নারী শিশুদের হত্যা করে মুসলিম অধ্যুষিত প্রাচীন জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। তাদের চোখের সামনেই তো মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা। কিন্তু সেই সব বিশ্ব মোড়লরা আজ কোথায়? 
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানীর সিত্তুই থেকে রয়টার্স ও এএফপির খবরে বলা হয়, চলমান সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা এবং প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। এসব উদ্বাস্তু খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও নিরাপদ আশ্রয় মিলছে না রোহিঙ্গাদের।
রাখাইন রাজ্যে স্থাপিত ৩৭ টি আশ্রয় শিবিরে অন্তত ৩১,৯০০ জন আশ্রয় নিয়েছে। এ যেন নাফ নদীর তীরে আরেক কারবালা ! বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও ‘লুন্টিন' বাহিনী এই হত্যাকান্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে শুধু মংডুতেই নিহত হয়েছে ৪ শতাধিক। এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের পথও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অসংখ্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বুকফাটা কান্না যেন কারো কানে যাচ্ছে না। জাতিসংঘ নামক আড্ডা খানায় বসে বসে যারা মানবতার স্লোগান দেয়, তাদের চোখ-কান যেন আজ নিস্তেজ হয়ে গেছে। অচেতন এই জাতিসংঘের মতেই, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এই আহবান অনেকটা সতীনের আদর তুল্য নয় কী?
 এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, ‘আমরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসতে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের পুশব্যাক করছে।' গতবুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ কথা বলেন। এর আগে জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশকে একই আহবান জানায়। এক প্রশ্নে জবাবে নুল্যান্ড বলেন, ‘জাতিসংঘ শরণার্থী সনদের প্রতি আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।' তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার এ বিষয়টি বলার চেষ্টা করছি, মিয়ানমারের সব পক্ষকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে, সহিংসতার মাধ্যমে নয়। আমরা তাদের অস্ত্র রেখে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আহবান জানাচ্ছি।' ( সূত্র : দৈনিক আমার দেশ-১৫ জুন ২০১২)
মংডু ও আকিয়াবের কোনো মুসলমান যুবতি ঘরে থাকতে পারছে না। রাখাইন যুবকরা ‘লুন্টিন বাহিনী'র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলমান যুবতিদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে এরকম ৫ হাজারের অধিক মুসলমান তরুণী নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাদের আদৌ ফিরে পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস করছেন মিয়ানমারের ওইসব এলাকার বাসিন্দারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওয়েবসাইট কালাদান প্রেস ডটকম জানিয়েছে, মংডুতে পুলিশের একজন উগ্রপন্থী পুলিশ কর্মকর্তার উস্কানিতে রাখাইন, দাঙ্গা পুলিশ ও পুলিশ মুসলমানদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। ‘থান' নামের ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই আগুন দেয়ার কাজে জড়িত বলে ওয়েবসাইটটি দাবি করেছে। এতে বলা হয়, ১৪৪ ধারা মংডুতে কেবল রোহিঙ্গাদের ওপর প্রযোজ্য কিন্তু রাখাইনরা এটি মান্য করছে না এবং তারা সব জায়গায় চলাফেরা করছে। রাখাইনরা পুলিশের সাহায্যে রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে খাদ্যশস্য ও জিনিসপত্র লুণ্ঠন করছে। রোহিঙ্গারা এখন খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।'
মিয়ানমারের রাখাইন ও সরকারি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ থেকে বাঁচতে শত শত রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তারা কোনো রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। গত ৩ দিনে দেড় হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে ‘পুশব্যাক' করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে গতকাল ২৫ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। বিজিবি ৪২ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, বুধবার রাত ১২টার দিকে একটি নৌকায় করে ২৫ জন রোহিঙ্গার এ দলটি নাফনদী পার হয়ে জালিয়াপাড়া পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকলে বিজিবি তাদের আটক করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে অভুক্ত এবং অসুস্থ ছিল। তাদের শুকনো খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর মিয়ানমারের দিকে ফেরত পাঠানো হয়। অপরদিকে গত ১৩ জুন বুধবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি ও কোস্টগার্ড রোহিঙ্গা বোঝাই ৩টি ট্রলার গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে। সকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ উপকূল দিয়ে ৩৯ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চাইলে কোস্টগার্ডের টহলদল তাদের আটক করে। একই দিন সকালে শাহপরীর দ্বীপের অদূরে নাফনদীর ঘোলারচর মোহনা দিয়ে ৪৪ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি এবং ৩০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে আরও একটি ট্রলার কূলে ভিড়তে চেষ্টা করে। বিজিবি ও কোস্টগার্ড ৩টি ট্রলার আটক করে। এ সময় ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকেই অভুক্ত এবং আহত ছিল বলে জানান বিজিবি সদস্যরা। স্থানীয়দের সহয়তায় এসব রোহিঙ্গার কিছু শুকনো খাবার, খাবার সেলাইন ও পানি দেয়া হয়। দুপুর ১টার দিকে ৩টি ট্রলারকেই গভীর সাগরের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এ সময় সাগরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সেন্টমার্টিনের অদূরে রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক ট্রলার সাগরে ভাসছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেয়ার জন্য অব্যাহত বিদেশি চাপে বাংলাদেশ দারুণভাবে অসন্তুষ্ট। গত ১৪ জুন বিদেশি পক্ষগুলোকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে বিদেশিরা যেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে। রোহিঙ্গাদের নতুন করে গ্রহণ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে  রয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যুতে আলোচনা ছাড়া নতুন করে আসতে দেয়ার কোনো বিষয়ে আলোচনায় রাজি নয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি শরণার্থী শিবিরে ২৮ হাজার এবং তার বাইরে অনিবন্ধিত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। গত বৃহস্পতিবার ১৪ জুন ঢাকায় জাতিসংঘ উদ্বাস্তুসংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ক্রেইগ স্যান্ডার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। তিন পৃষ্ঠার এই চিঠিতে গত ৮ জুন থেকে রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে মানবিক কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই আহত। তাদের মধ্যে নারী এবং শিশুও রয়েছে। তারা অর্থনৈতিক কারণে নয়, বরং পরিস্থিতির শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) নিকোলাস ডিন পৃথকভাবে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এর আগে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার ফলে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তারা আহবান জানিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশনের বাধ্যবাধকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের ফিরিয়ে না দেয়ার নীতি মেনে চলার জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, শরণার্থী বিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশনে বাংলাদেশ সই করেনি। তাই এই কনভেশন মেনে চলা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এদিকে জাতীয় সংসদে আমাদের বহুদর্শী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহবান আবার প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। দাঙ্গার কারণে মিয়ানমার ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও রোহিঙ্গাদের দেশে ঢুকতে দিয়ে আরও সমস্যা বাড়ানোর পক্ষে নই আমরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নয় বরং মিয়ানমারকে অনুরোধ করে তাদের দেশে গিয়ে সেবা করার সুযোগ নিতে পারে এসব দেশ ও সংস্থা। এ সময় ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি আর বর্তমানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি এক নয়। '৭১-এ বাংলাদেশের ওপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর মিয়ানমারে বর্তমানে যা চলছে তা জাতিগত সংঘাত। এটি কোনো যুদ্ধাবস্থা নয়। এমন নয় যে, সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করছে। আমরা মনে করি এটি সমাধানের জন্য সে দেশের সরকার কাজ করছে।
অপরদিকে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে হলেও বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার আহবান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া। ১৫ জুন শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতার বিচারে তাদের আশ্রয় দেয়ার আহবান জানান তিনি। এব্যাপারে মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মুক্ত চিন্তা ফোরাম আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস' অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে সরকার তাদের ঢুকতে দিতে পারে না। কিন্তু মানবিকভাবে বিবেচনা করলে তাদের আশ্রয় দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কূটনৈতিকভাবে করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান। মওদুদ আহমদ বলেন, সরকার চাইলে সমস্যার শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারতো। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ায় বিষয়টি ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিজিবিকে যদি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, সেটা কখনই সুন্দর দেখাবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, সরকার দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
এক সময়ের স্বাধীন মুসলিম আরাকান রাজ্য আজ মুশরিক বৌদ্ধ মিয়ানমারের শিকারভূমিতে পরিণত হয়েছে। ‘মানুষে মানুষে  অহিংসা ও মৈত্রীর নীতিতে বিশ্বাসী' এমন স্লোগানের বাহক বৌদ্ধরাই আজ নিজেরাই হিংসার আগুণে জ্বলছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা আজ অসহায় হয়ে প্রাণ রক্ষায় প্রতিবেশী হিসেবে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আবাস ভূমি হিসেবেই হোক তারা নাফ নদী পাড়ী দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে ও জীবন বাঁচানোর অনুমতি দিচ্ছে না আমাদের সরকার। নৌকা ভর্তি অসহায় নারী শিশুকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদিকে আন্তর্জাতিক আইন অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আহবান, অপরদিকে মানবিক দৃষ্টিকোন, আমাদের সরকার কোনটি মানবে। মুসলমান হিসেবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী অসহায় রোহিঙ্গাদের বিপদে এগিয়ে আসা আমাদের ঈমানী দায়িত্বের আওতাভুক্ত কী না এটা বুঝাতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে।    
লেখক সম্পাদক : আস সিরাজ, সিলেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন