দ্বিতীয় চিন্তা
॥ আযম মীর ॥
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের সাথে আর কোনো কথা বলবে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গণমাধ্যমের কর্মীদেরও একই নীতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছে দুদক। গত রোববার দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া মাত্রই যে দুদক গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে তা প্রচারে অভ্যস্ত, সেই দুদকের এমন উল্টো সুর বিস্ময়কর বৈকি। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো কথা নয়।’ কেন? গোলাম রহমানের মতেÑ ‘দুদকের তদন্ত নিয়ে গণমাধ্যমে খণ্ড খণ্ড আকারে এমন সব সংবাদ আসছে, যার কারণে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর দুদক এ নিয়ে তদন্ত করেছে। বলেছে, এ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তখন কিন্তু দুদক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করেছে। তদন্তে কখন কী পাওয়া যাচ্ছে না যাচ্ছে তার খুঁটিনাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তকালে আমরা দেখেছি দুদককে প্রায় প্রতিদিন ব্রিফিং করতে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে স্বাধীনভাবে বহু প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। তখন দুদকের উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দুদকের এত রাখঢাক কেন? কেনই বা গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের চেষ্টা? দুদক চেয়ারম্যানের অভিযোগ, গণমাধ্যমে খণ্ড খণ্ড আকারে সব সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
দুদক চেয়ারম্যান ও সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেছেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যম বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করছে। দুদক চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রীর দাবিÑ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের সাথে প্রকাশিত সংবাদের কোনো মিল নেই। তা হলে কী আছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে? কেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না? সংবাদপত্র এ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তো দুদক কোনো কথাই বলেনি। আর এখন উল্টো সংবাদপত্রকেই দোষারোপ করা হচ্ছে।
২০ জুন প্রথম আলো, যুগান্তরসহ কয়েকটি দৈনিকে রিপোর্ট প্রকাশের পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিলোÑ ‘পদ্মা সেতু নিয়ে দুদকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন। ১০ শতাংশ ঘুষ চান মন্ত্রী-সচিব। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি সত্তর লাখ ডলার। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ তিনজন। তারা হলেনÑ সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। তাদের প্রতিনিধিরা এই অর্থ কমিশন হিসেবে চান। অর্থের অবৈধ লেনদেনের জন্য গ্রেফতার হওয়া এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে কানাডার পুলিশ। আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে দুদক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার তথ্যও রয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে তা তদন্ত করার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা সরকার তা আমলে নেয়নি। এরপর বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে দুর্নীতির তথ্যসমেত প্রতিবেদন দেয়। দুদক একপ্রকার গোপনে বিষয়টির তদন্ত করছিল। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও জাতীয় সংসদের হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরীকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এগুলো হলোÑ কানাডার এসএনসি-লাভালিন, যুক্তরাজ্যের হালকো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একন অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হাই পয়েন্ট রেন্ডাল। এর মধ্যে কানডার এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপরই এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মজার ব্যাপার হলো, কানাডিয়ান কোম্পানি পরামর্শক নিয়োগের জন্য মনোনীত হলেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই কানাডিয়ান পুলিশ দ্রুততার সাথে তদন্ত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। অথচ পরামর্শক নিয়োগের জন্য আবেদনকারীদের পক্ষে অন্যান্য দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা নানাভাবে তদবির করেছেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। তবে কানাডিয়ান সরকার কেন এত কঠোর হলো? কারণ আর কিছুই নয়Ñ কানাডার আইন ও সংস্কৃতিতে ঘুষ লেনদেন তো দূরের কথা, এ নিয়ে কথাবার্তা বলাই গর্হিত অপরাধ। কানাডা পুলিশের তদন্তদল প্রমাণ পেয়েছে, এসএনসি-লাভালিনের কাছে ঘুষ চাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অনেকের কথাবার্তা হয়েছে। আটককৃত ব্যক্তিরা সে দেশের পুলিশের কাছে তা স্বীকারও করেছে। দুদকের কাছে দেয়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দিন-ক্ষণসহ তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। আছে নামধামও। দুদক এসব যাচাই করতে গিয়ে মিল খুঁজে পাচ্ছে বটে। তবে ঘুষ-টুষের কথা কেউ স্বীকার করছে না।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দুদক যে আগে তদন্ত করে সব কিছু ঠিকঠাক আছে বলে রায় দিয়ে দিলো, তা কিসের ভিত্তিতে? বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে যাদের নামধাম আছে তাদেরকে কি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়া দূরে থাক, এখন দুদক যে তদন্ত চালাচ্ছে সে সম্পর্কেও গণমাধ্যমে আর কোনো তথ্য না দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দুদকের দাবি, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সঠিক নয়? তবে সঠিক তথ্যটি কী? দুদক নিজেই বলছে, বিশ্বব্যাংক দুদককে যে তথ্য দিয়েছে তাতে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে। পরামর্শক সংস্থার কাছ থেকে তারা ঘুষ দাবি করেছেন প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ উপসংহারে আসা সঠিক হবে না। দুদক বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটিপর্যায়ে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্নপর্যায়ে নানা অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিটি অভিযোগই গুরুত্বের সাথে অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কমিশন অঙ্গীকারবদ্ধ। যদি তাই হয়, তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্যসংবলিত পত্র প্রকাশে আপত্তি কেন দুদকের। দুদক তো অতীতে তদন্তের আগেই অভিযোগ জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। আর পদ্মা সেতুর মতো স্পর্শকাতর এবং অতীব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তো অনেক বড় কিছু। যে প্রকল্পে অর্থায়নই স্থগিত করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সাহায্যদাতারা। জনসাধারণের অধিকার আছে জানার, কাদের নাম বিশ্বব্যাংকের অভিযোগপত্রে রয়েছে। তাদের কার কী তৎপরতা ছিল। তারা যদি মন্ত্রী, সচিব বা অন্য কোনো সরকারি পদপদবিতে সমাসীন হন, তবে তাদের পদে রাখা কতটা সমীচীনÑ সে প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। গণমাধ্যম নয়, দুদকই এসব রাখঢাক করতে গিয়ে বরং জনগণকে বেশি বিভ্রান্ত করছে। সংবাদপত্রে যখন যার নাম প্রকাশিত হচ্ছে, তিনি তার প্রতিবাদ করছেন। মন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দু’জনই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। সচিব মোশাররফ হোসেন তো বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জই প্রদান করেছেন। এমনকি এ কথাও বলেছেন, ১০ শতাংশ ঘুষ গ্রহণের কোনো কথাই নাকি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে আগেও এই কলামে একাধিকবার লিখেছি। সে সব লেখায় বলেছি, সরকার দুর্নীতির অভিযোগটি খোলাসা না করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রথমে তো সরকার বিষয়টি আমলেই নিতে চায়নি। উল্টো বিশ্বব্যাংককেই চ্যালেঞ্জ করেছে। চুক্তি বাতিল করে বিকল্প সূত্রে অর্থ সংগ্রহ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা তখনই প্রমাদ গুনেছিলাম। যে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের বিরাট একটি অংশ সাহায্যদাতাদের ওপর নির্ভরশীল, যাদের অর্থনীতি বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়া সচল রাখা যায় না, তাদের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের সাথে লড়াই করতে যাওয়া কতটা আত্মঘাতী ব্যাপার, সরকার বোধ হয় বিলম্বে হলেও বুঝতে পারছে। তাই অন্তত একজনের কণ্ঠে কিছুটা বাস্তবতার সুর পাওয়া যাচ্ছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন বলছেন, বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি বাতিল নয়, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেই সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। এ নিয়ে তার সর্বশেষ বক্তব্য হলো, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যা করণীয় তাই করব।
পদ্মায় অনেক পানি ইতোমধ্যে ঘোলা হয়েছে। এ প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক খবর। সরকার বিষয়টি নিয়ে সোজা পথে না গিয়ে বিষয়টিকে যে জটিল করে ফেলেছে, তা এখন টের পাচ্ছে। তাই দুদকের মাধ্যমে এর কিনারা করতে চায়। কিন্তু এ মামলা সুরঞ্জিতের অর্থ কেলেঙ্কারি নয়। যেনতেন করে সব সাফ সুতরা ঘোষণা করা যাবে না। সঠিক পথে, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মানের তদন্তই করতে হবে দুদককে। নচেৎ তা গলার কাঁটা হয়েই থাকবে সরকারের জন্য।
azammir2003@yahoo.com
পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের সাথে আর কোনো কথা বলবে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গণমাধ্যমের কর্মীদেরও একই নীতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছে দুদক। গত রোববার দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া মাত্রই যে দুদক গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে তা প্রচারে অভ্যস্ত, সেই দুদকের এমন উল্টো সুর বিস্ময়কর বৈকি। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো কথা নয়।’ কেন? গোলাম রহমানের মতেÑ ‘দুদকের তদন্ত নিয়ে গণমাধ্যমে খণ্ড খণ্ড আকারে এমন সব সংবাদ আসছে, যার কারণে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর দুদক এ নিয়ে তদন্ত করেছে। বলেছে, এ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তখন কিন্তু দুদক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করেছে। তদন্তে কখন কী পাওয়া যাচ্ছে না যাচ্ছে তার খুঁটিনাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তকালে আমরা দেখেছি দুদককে প্রায় প্রতিদিন ব্রিফিং করতে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে স্বাধীনভাবে বহু প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। তখন দুদকের উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দুদকের এত রাখঢাক কেন? কেনই বা গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের চেষ্টা? দুদক চেয়ারম্যানের অভিযোগ, গণমাধ্যমে খণ্ড খণ্ড আকারে সব সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
দুদক চেয়ারম্যান ও সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেছেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যম বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করছে। দুদক চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রীর দাবিÑ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের সাথে প্রকাশিত সংবাদের কোনো মিল নেই। তা হলে কী আছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে? কেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না? সংবাদপত্র এ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তো দুদক কোনো কথাই বলেনি। আর এখন উল্টো সংবাদপত্রকেই দোষারোপ করা হচ্ছে।
২০ জুন প্রথম আলো, যুগান্তরসহ কয়েকটি দৈনিকে রিপোর্ট প্রকাশের পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিলোÑ ‘পদ্মা সেতু নিয়ে দুদকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন। ১০ শতাংশ ঘুষ চান মন্ত্রী-সচিব। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি সত্তর লাখ ডলার। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ তিনজন। তারা হলেনÑ সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। তাদের প্রতিনিধিরা এই অর্থ কমিশন হিসেবে চান। অর্থের অবৈধ লেনদেনের জন্য গ্রেফতার হওয়া এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে কানাডার পুলিশ। আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে দুদক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার তথ্যও রয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে তা তদন্ত করার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা সরকার তা আমলে নেয়নি। এরপর বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে দুর্নীতির তথ্যসমেত প্রতিবেদন দেয়। দুদক একপ্রকার গোপনে বিষয়টির তদন্ত করছিল। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও জাতীয় সংসদের হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরীকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এগুলো হলোÑ কানাডার এসএনসি-লাভালিন, যুক্তরাজ্যের হালকো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একন অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হাই পয়েন্ট রেন্ডাল। এর মধ্যে কানডার এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপরই এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মজার ব্যাপার হলো, কানাডিয়ান কোম্পানি পরামর্শক নিয়োগের জন্য মনোনীত হলেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই কানাডিয়ান পুলিশ দ্রুততার সাথে তদন্ত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। অথচ পরামর্শক নিয়োগের জন্য আবেদনকারীদের পক্ষে অন্যান্য দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা নানাভাবে তদবির করেছেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। তবে কানাডিয়ান সরকার কেন এত কঠোর হলো? কারণ আর কিছুই নয়Ñ কানাডার আইন ও সংস্কৃতিতে ঘুষ লেনদেন তো দূরের কথা, এ নিয়ে কথাবার্তা বলাই গর্হিত অপরাধ। কানাডা পুলিশের তদন্তদল প্রমাণ পেয়েছে, এসএনসি-লাভালিনের কাছে ঘুষ চাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অনেকের কথাবার্তা হয়েছে। আটককৃত ব্যক্তিরা সে দেশের পুলিশের কাছে তা স্বীকারও করেছে। দুদকের কাছে দেয়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দিন-ক্ষণসহ তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। আছে নামধামও। দুদক এসব যাচাই করতে গিয়ে মিল খুঁজে পাচ্ছে বটে। তবে ঘুষ-টুষের কথা কেউ স্বীকার করছে না।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দুদক যে আগে তদন্ত করে সব কিছু ঠিকঠাক আছে বলে রায় দিয়ে দিলো, তা কিসের ভিত্তিতে? বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে যাদের নামধাম আছে তাদেরকে কি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়া দূরে থাক, এখন দুদক যে তদন্ত চালাচ্ছে সে সম্পর্কেও গণমাধ্যমে আর কোনো তথ্য না দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দুদকের দাবি, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সঠিক নয়? তবে সঠিক তথ্যটি কী? দুদক নিজেই বলছে, বিশ্বব্যাংক দুদককে যে তথ্য দিয়েছে তাতে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে। পরামর্শক সংস্থার কাছ থেকে তারা ঘুষ দাবি করেছেন প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ উপসংহারে আসা সঠিক হবে না। দুদক বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটিপর্যায়ে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্নপর্যায়ে নানা অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিটি অভিযোগই গুরুত্বের সাথে অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কমিশন অঙ্গীকারবদ্ধ। যদি তাই হয়, তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্যসংবলিত পত্র প্রকাশে আপত্তি কেন দুদকের। দুদক তো অতীতে তদন্তের আগেই অভিযোগ জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। আর পদ্মা সেতুর মতো স্পর্শকাতর এবং অতীব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তো অনেক বড় কিছু। যে প্রকল্পে অর্থায়নই স্থগিত করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সাহায্যদাতারা। জনসাধারণের অধিকার আছে জানার, কাদের নাম বিশ্বব্যাংকের অভিযোগপত্রে রয়েছে। তাদের কার কী তৎপরতা ছিল। তারা যদি মন্ত্রী, সচিব বা অন্য কোনো সরকারি পদপদবিতে সমাসীন হন, তবে তাদের পদে রাখা কতটা সমীচীনÑ সে প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক। গণমাধ্যম নয়, দুদকই এসব রাখঢাক করতে গিয়ে বরং জনগণকে বেশি বিভ্রান্ত করছে। সংবাদপত্রে যখন যার নাম প্রকাশিত হচ্ছে, তিনি তার প্রতিবাদ করছেন। মন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দু’জনই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। সচিব মোশাররফ হোসেন তো বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জই প্রদান করেছেন। এমনকি এ কথাও বলেছেন, ১০ শতাংশ ঘুষ গ্রহণের কোনো কথাই নাকি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে আগেও এই কলামে একাধিকবার লিখেছি। সে সব লেখায় বলেছি, সরকার দুর্নীতির অভিযোগটি খোলাসা না করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রথমে তো সরকার বিষয়টি আমলেই নিতে চায়নি। উল্টো বিশ্বব্যাংককেই চ্যালেঞ্জ করেছে। চুক্তি বাতিল করে বিকল্প সূত্রে অর্থ সংগ্রহ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা তখনই প্রমাদ গুনেছিলাম। যে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের বিরাট একটি অংশ সাহায্যদাতাদের ওপর নির্ভরশীল, যাদের অর্থনীতি বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়া সচল রাখা যায় না, তাদের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের সাথে লড়াই করতে যাওয়া কতটা আত্মঘাতী ব্যাপার, সরকার বোধ হয় বিলম্বে হলেও বুঝতে পারছে। তাই অন্তত একজনের কণ্ঠে কিছুটা বাস্তবতার সুর পাওয়া যাচ্ছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন বলছেন, বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি বাতিল নয়, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেই সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। এ নিয়ে তার সর্বশেষ বক্তব্য হলো, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যা করণীয় তাই করব।
পদ্মায় অনেক পানি ইতোমধ্যে ঘোলা হয়েছে। এ প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক খবর। সরকার বিষয়টি নিয়ে সোজা পথে না গিয়ে বিষয়টিকে যে জটিল করে ফেলেছে, তা এখন টের পাচ্ছে। তাই দুদকের মাধ্যমে এর কিনারা করতে চায়। কিন্তু এ মামলা সুরঞ্জিতের অর্থ কেলেঙ্কারি নয়। যেনতেন করে সব সাফ সুতরা ঘোষণা করা যাবে না। সঠিক পথে, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মানের তদন্তই করতে হবে দুদককে। নচেৎ তা গলার কাঁটা হয়েই থাকবে সরকারের জন্য।
azammir2003@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন