স্বজন
রাজনৈতিক আলোচনা আজকাল 'Benevolent Dictator' প্রসঙ্গটিও উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু কেন এই উচ্চারণ? Benevolent Dictator-এর বাংলা করলে দাঁড়ায়-প্রজাহিতৈষী একনায়ক কিংবা দয়াল স্বৈরশাসক। আমাদের এই জনপদের রাজনৈতিক ইতিহাসতো একনায়ক কিংবা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা প্রিয় এবং একনায়কত্বের বদলে গণতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাসী। এই জন্যই তারা দিল্লীর দাসত্ব মেনে নেয়নি, মেনে নেয়নি পিন্ডির প্রভুত্বও। বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান আমলে যেমন আইয়ুব শাহীর একনায়কত্ব মেনে নেয়নি, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও মেনে নেয়নি এরশাদ শাহীর স্বৈরশাসন। তাই এই জনপদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার লক্ষ্য করা গেছে গণঅভ্যুত্থান। তারপরও বর্তমান সময়ে চায়ের টেবিলে, বৈঠকি আলাপে প্রজাহিতৈষী একনায়ক কিংবা একনায়কত্বের প্রসঙ্গটি মৃদুভাবে হলেও কেন উঠে আসছে? বিষয়টি নিয়ে বোধহয় ভাবা প্রয়োজন।
একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মত বিষয়গুলোতো ইতিহাসের পুরানো বিষয়। এইসব শাসনের অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। রাজারা কিংবা একনায়করা শাসনামলের শুরুতে অনেক ভাল ভাল কথা বললেও ক্রমেই তারা স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন। জবাবদিহিতা ছাড়া মানুষ যখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়, তখন ভুল করে। এই ভুলের আছে নানা কারণ। ইতিহাসে প্রজাহিতৈষী রাজা-বাদশাহ্ কিংবা একনায়ক যে ছিলেন না তা নয়, তবে মানুষ তার অন্তর্গত চাহিদার কারণেই নিজেদের মতামতের প্রতিফলনকেই পছন্দ করেছে, অর্থাৎ বেছে নিয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকেই। ইতিহাসের এই সত্যকে মেনে নিলে আমাদের মুখোমুখি হতে হয় আর এক সত্যের।
বর্তমান সময়েতো পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই গণতান্ত্রিক শাসনের ঢাক বাজছে। কিন্তু কোনো বিষয়ে ঢাক-ঢোল পেটানো এক কথা, আর তার বাস্তবায়ন ভিন্ন কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন গণতন্ত্রের নামে প্রহসন ও চাতুর্যের নানা চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও এখন স্বৈরশাসনের মতো প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক সরকার যেন নির্বাচনী ইশতেহারের কথা ভুলে যায়। অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে দেশ শাসন না করার অঙ্গীকারের কথাও ভুলে যায়। ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনগণের না হয়ে বিশেষ দলের বা জোটের সরকার হয়ে যায়। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মাস্তানী ও দাপটে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে সংকট বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় সরকার। যেখানে সুশাসন থাকে না সেখানে দিনবদলও আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর দিনবদল না হওয়ার কারণে মানুষের প্রয়োজনগুলো পূরণ হয় না। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংকট দূর হয় না, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চাবুক মারতেই থাকে, আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, নিরাপত্তাহীনতার যাতনায় ভোগে দেশের জনগণ। এ কারণেই স্বৈরতন্ত্রবিরোধী মানুষ বড়ই দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হয় যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না।
গণতন্ত্রের পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সুশাসন ও দিনবদলের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে দিনবদলের চিত্রটা কীভাবে অঙ্কিত হয়েছে? ক্যানভাসে জনগণ কতটা আছে, সেই হিসেবটা সরকার নিলে ভাল হতো। ক্যানভাসে দলীয় লোকজন মোটাতাজা হলে, বর্ণিল হলে জনগণ তথা গণতন্ত্রের লাভ কী? এই হিসেবটা কিন্তু জনগণ নানাভাবেই করছে। ক্যানভাসে জনগণের জীর্ণদশা আসলে গণতন্ত্রের জীর্ণদশাকেই ব্যক্ত করছে এখন।
জানি না বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দেয়ালের লিখন পড়তে ভুলে গেছেন কি না! পত্রিকার খবরগুলোকে তাঁরা কতটা গুরুত্ব দেন তাও জানি না। তবে জনগুরুত্বপূর্ণ খবরকে জনগণ গুরুত্ব দেয়। জনগণ চায়, সরকারও বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিক এবং গণআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুপ্রষ্ঠিত করুক। কিন্তু গণতন্ত্রের এমন চর্চা সরকার কতটা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সরকারের হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। সরকার যদি আত্মসমালোচনার মাধ্যমে গণআকাঙ্ক্ষার অনুকূলে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেদের লোকজনের গণবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন তাহলে ইমেজ সংকট থেকে সরকার কিছুটা হলেও উদ্ধার পাবেন। আসলে কাজ বড় বিষয়। কাজের মাধ্যমেই সরকারের দুর্নাম কমে, সুনাম বাড়ে। সরকারের সুনাম বাড়লে দেশের মঙ্গল হয়, জনগণেরও কল্যাণ হয়। এমন লক্ষ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
ইজারার নানা রকমফেরের কথা আমরা জানি। এবার জানা গেল নদী ইজারার কথা। সারাদেশে খাল-বিল, জলমহাল ও খাস জমিসহ সরকারি জায়গা বরাদ্দের পর এবার দলীয় লোকদের মধ্যে নদী ইজারা দেওয়া শুরু করেছে মহাজোট সরকার। এরই অংশ হিসেবে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত কুমারখালি নদী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে ইজারা দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। নদী ইজারা দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, এর আগে নদীর তীর কিংবা নদীতে জেগে ওঠা চর ইজারা দেয়া হলেও পুরো নদী ইজারা দেয়া নজিরবিহীন। নদী ইজারা দেয়া প্রসঙ্গে জারি করা চিঠিতে ভূমি মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, এ মরা নদীতে ইজারাদার চিংড়ির ঘের করবেন। বিনিময়ে তিনি সরকারের রাজস্ব খাতে বছরে ২ হাজার টাকা জমা দেবেন। অপরদিকে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে দেয়া মতামত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহ্যবাহী এ নদীটি ইজারা দেয়া হলে হাজার হাজার কৃষকের সেচ কাজে বিঘ্ন ঘটবে এবং জেলেরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। নদী ইজারা দেয়ার আগে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক নদী শাসন আইন, পানি আইন, পরিবেশ আইন ও ভূমি আইনসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব আইন ও বিধিবিধান উল্লেখ করে নদী ইজারা না দেয়ার জন্য লিখিতভাবে মতামত ভূমি মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়েছিল। নদী ইজারা দেয়া হলে ঐতিহ্যবাহী এ নদীতে শত শত মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হবে বলেও মতামতে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাদের এ মতামত এবং স্থানীয় নাগরিক ও পরিবেশবিদদের আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করেই ভূমি মন্ত্রণালয় গত ১২ এপ্রিল কুমারখালি নদী ইজারা দেয়ার বিধি জারি করে। এখন সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন এবং পরিবেশবিদদের মতামত উপেক্ষা করে বছরে মাত্র ২ হাজার টাকার বিনিময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে কুমারখালি নদীটি ইজারা দেয়া কতটা সমীচিন হয়েছে? আমরা এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক চেতনা সম্মত পদক্ষেপ আশা করছি।
প্রকৃতির সাথে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের আচরণের একটি চিত্র আমরা উল্লেখ করলাম। আর এ চিত্রটি সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি মিডিয়ার কল্যাণে। কিন্তু সেই মিডিয়ার সাথে এখন সরকারের আচরণ কেমন? মিডিয়ার সাথে সরকারের আচরণ যৌক্তিক ও যথাযথ হলে দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়, আর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে হয় দেশ ও জাতির অকল্যাণ। আমরা জানি, বর্তমান সময়ে মিডিয়া জগতের গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো টেলিভিশন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে সরকারের প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া এক ধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই বেচাকেনার কারণে অনেক লাইসেন্সই বিভিন্নভাবে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে চলে যাচ্ছে। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার ভাষায়, ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার লাইসেন্স ব্যবসায়ী সরকার।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুলের মতে, ‘এর ফলে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও নির্মল বিনোদন থেকে।' গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক রুবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, টিভি লাইসেন্স মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া ও দালালদের হাতে চলে যাচ্ছে। এতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা চাইছেন সুষ্ঠু নীতিমালা ও কর্মকৌশল।
দেশের নদী নিয়ে, টিভি লাইসেন্স নিয়ে দেশে যা চলছে তা মোটেও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্মত নয়। অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক চেতনার এসব কর্মকান্ড চলছে সরকার ও সরকারি দলের প্রশ্রয়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব কর্মকান্ডে দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। যারা এসব কর্মকান্ডে জড়িত তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন। এরা কেউ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, কেউ প্রশাসনের প্রতিনিধি, কেউবা আবার সংস্কৃতিসেবী। এক সময় শিক্ষাঙ্গনেও ছিল তাদের পদচারণা। তাই প্রশ্ন জাগে, শিক্ষাঙ্গন থেকে কি তারা কোন আলোই পাননি? আলো পেলে তো তারা হতেন আলোকিত নাগরিক। আলোকিত নাগরিকরা রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসন, সংস্কৃতি তথা যে অঙ্গনেই যুক্ত হবেন সেখানে তো কোন অন্যায় কিংবা অবিবেচনা প্রসূত কাজ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তেমন আলোকিত মানুষের এখন বড়ই অভাব। ভবিষ্যতে আলোকিত মানুষ পাব তেমন আয়োজন আমাদের আছে কী? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতো আলোকিত মানুষ উপহার দেয়ার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। কিন্তু সেখানকার অবস্থাটা কেমন? দেশে বর্তমানে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভিসি এখন সরকার দলীয়। তাদের মধ্যে সিংহভাগ ভিসি'র বিরুদ্ধেই উঠেছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। দলবাজ এই ভিসিরা ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। প্রশাসনিক ও একাডেমিক কোন ক্ষেত্রেই তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না। নিজ মতাদর্শের প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও বিরোধপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন তারা। অভিযুক্ত ভিসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন গড়িয়েছে মাঠের আন্দোলনে। তাদের পদত্যাগ, পদচ্যুতির দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অনশন, কর্মবিরতি, কুশপুত্তলিকা দাহ করার মত কঠোর কর্মসূচি এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেয়া হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমাও। এমন পরিবেশে শিক্ষার লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে? আলোকিত মানুষ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি অর্জিত হবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে? জন গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ের মধ্যে আমরা শুধু নদী ইজারা, টেলিভিশন-লাইসেন্স ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের কিছুটা চিত্র তুলে ধরলাম। বিষয়গুলো দেশ ও জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার গণতান্ত্রিক চেতনায় এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনমনে গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে কিছুটা আশাবাদ জাগতে পারে। নইলে মনের অজান্তেই তাদের আলোচনার টেবিলেই চলে আসতে পারে Benevolent Dictatorship-এর কথা- যা গণতন্ত্রসম্মত নয় এবং দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন