আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ইতিহাস আমার প্রিয় সাবজেক্ট এবং আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই কি-না জানি না, ইতিহাসের অনেক ঘটনা ও তারিখের মধ্যে একটা কাকতালীয় সামঞ্জস্য যেন দেখতে পাই। প্রথম মহাযুদ্ধের পর একটি নদীর তীরে যে স্থানটিতে এবং যে তারিখে পরাজিত জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, কুড়ি বছর পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরাজিত ফরাসিরা ওই নদী তীরে একই তারিখে জার্মানির কাছেও আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসেও এ ধরনের একটি তারিখের বৈশিষ্ট্য আমার চোখে ধরা পড়ে। তারিখটি ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদৌল্লার পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ওই বছর ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের ছেলেবেলায় ব্রিটিশ আমলে স্কুলের ছাত্র থাকাকালে আমরা ২৩ জুন পলাশী দিবস এবং ৩ জুলাই শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা দিবস পালন করতাম।
এখন আড়াইশ' বছর পর বাংলাদেশে ২৩ জুন তারিখটি আমরা পালন করি অন্যভাবে। এ দিনটি এখন দেশের অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ের প্রাচীন এবং সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। ইতিহাসের কাকতালীয় ব্যাপার এই যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাঠে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ঠিক তার ১৯২ বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার হাটখোলা রোড সংলগ্ন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি গঠিত হয় এবং পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে সেই দলের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধেই বাংলাদেশে আবার স্বাধীনতা সূর্যের উদয় ঘটে।
আজ সেই ২৩ জুন। দলটির ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবস। এই ৬৩ বছরে আওয়ামী লীগ বহুবার খোলস পাল্টেছে। এই খোলস পাল্টানোর মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্ব ও চরিত্র পাল্টেছে। আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্ব ও চরিত্রের তিনটি যুগ অতিক্রম করে বর্তমানে চতুর্থ যুগ অতিক্রম করছে। নেতৃত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের চরিত্রেরও বদল ঘটেছে।
প্রতিষ্ঠাকালের আওয়ামী লীগের চরিত্র ছিল একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অবশ্য মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক দলের খোলস পাল্টে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মওলানা ভাসানীকে এ কাজে সাহায্য জোগান তার দলের তরুণ সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান এবং দলের প্রগতিশীল তরুণ অংশ।
আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় যুগের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি দলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মেনে নিলেও দলের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র বদলে ফেলেন। তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমর্থনে পার্লামেন্টে মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে সামরিক বাহিনীর দল রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে সমর্থন দেন। বাংলাদেশের (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ছিল আওয়ামী লীগের মূল দাবি। তিনি সেই দাবি থেকে সরে এসে বলতে থাকেন, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানেও অগণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া এক ইউনিট প্রথাকে তিনি সমর্থন দেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে তিনি দলের আরেকটি মূলনীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বর্জন করেন।
ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের একটা বড় চাঙ্ক দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এ সময় যদি শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে ন্যাপে চলে যেতেন, তাহলে আওয়ামী লীগের সম্ভবত তখনই মুসলিম লীগের পরিণতি ঘটত। দলটির পুনরায় মাথা তোলার কোনো সুযোগ থাকত না। শহীদ সোহরাওয়ার্দীও দলের মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। মাত্র ১৩ মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগপত্রে সই আদায় করেন।
এ সময়ের কথা পর্যালোচনা করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে আবু জাফর শামসুদ্দীন তার এক রাজনৈতিক নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'আল্লাহর অসীম মেহেরবানি, সাতান্ন সালে শেখ মুজিব ন্যাপে চলে যাননি। যদি যেতেন, তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরে যেত। আওয়ামী লীগ প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। ন্যাপ শক্তিশালী হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার কাছে প্রায়োরিটি পায়নি। ন্যাপের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রেখে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ। ন্যাপের দ্বারা তিনি প্রথমে ছয় দফা গ্রহণ করাতে পারতেন না এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্যও তিনি দলকে সংগঠিত অথবা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন না।
এই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রয়াত লেখকের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। নিজের আপসবাদী নীতির দরুন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনিতেই আওয়ামী লীগকে বিভক্ত ও দুর্বল করে ফেলেছিলেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান কোথাও তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারতেন না। তিনি এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করেও তা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
এখানে হয়তো প্রাসঙ্গিক নয়, তবু একটা কথা লিখছি। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে এক ভারতীয় কূটনীতিক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, '১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ দলটি গঠিত হয় এবং এর নামকরণ হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বারা।' কথাটি সঠিক নয়। ঢাকার রোজ গার্ডেনে দলটি গঠিত হওয়ার সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নামটি দেন মওলানা ভাসানী।
এ প্রসঙ্গে ভাসানী বলেছিলেন, মুসলিম লীগ দল জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নবাব খাজা গজাদের মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে। আমরা আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলাম। ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন করাচিতে। তিনি মাঝে মধ্যে লাহোরেও থাকতেন। সেখানে বসে তিনি জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন দল গঠন করেছিলেন। সেই দল টেকেনি। ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ দল গঠিত হওয়ার কিছু পর তিনি মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের পদ গ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি।
আইয়ুব আমলের প্রায় শেষ দিকে আইয়ুববিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনের নামে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘটান। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তার অনুরোধে তাকে অনুসরণ করে এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে একটি সর্বদলীয় মোর্চা গঠিত হয়। এনডিএফ জনপ্রিয় হয়নি। বরং অল্পদিনের মধ্যে নাথিং ডুয়িং ফ্রন্ট নামে পরিচিত হয়। সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে বিদেশে চলে যান এবং বিদেশেই মৃত্যুবরণ করেন।
আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হওয়ার পরও সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বের আপসবাদিতার জন্য দেশের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর পর দলের প্রবীণ নেতাদের প্রবল আপত্তি ও বাধাদানের নীতি অগ্রাহ্য করে শেখ মুজিব দলের পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও চরিত্রকে সম্পূর্ণ নতুন ধারায় পুনর্গঠন করেন। সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক চুক্তির বিরোধিতা এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আওয়ামী লীগের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার পূর্বপ্রস্তুতির কর্মসূচি হিসেবে 'বাংলায় ম্যাগনাকার্টা' ছয় দফা ঘোষণা করেন।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের এই তৃতীয় যুগকেই দলটির গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণযুগ বলা হয়। আওয়ামী লীগ দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল এবং শেখ মুজিব অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় রূপান্তরিত হন। এই তৃতীয় যুগে আওয়ামী লীগের শুধু নীতি ও নেতৃত্ব নয়, চরিত্রেরও সম্পূর্ণ বদল ঘটে। প্রথম যুগের আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক নিয়মতান্ত্রিক দল। দ্বিতীয় যুগে দলের সাম্প্রদায়িক চরিত্র বদল হলেও নেতৃত্ব ছিল আপসবাদী ও পশ্চাৎমুখী। তৃতীয় যুগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। দুর্বল, আপসবাদী নেতৃত্বের বদলে শেখ মুজিবের শক্তিশালী সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে। আপসবাদী নেতারা সোহরাওয়ার্দী-রাজনীতির লেগাসি বহন করে আইয়ুব আমলে পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ নাম দিয়ে দলটি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তারা পারেননি। মুজিব নেতৃত্বের শক্তিশালী জোয়ারের ধাক্কায় তারা ভেসে গেছেন।
প্রথম যুগে আওয়ামী লীগ ছিল একটি সাম্প্রদায়িক দল। দ্বিতীয় যুগে একটি অসাম্প্রদায়িক আধা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দল। তৃতীয় যুগে অর্থাৎ মুজিব নেতৃত্বের আমলে দলটির পূর্ণ উত্তরণ ঘটে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির রাজনীতিতে। দলটি একটি সোস্যাল ডেমোক্রেট দলে পরিণত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটির নামের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক কথাটি যোগ করে দলটিকে একটি সমাজবাদী মোর্চায় পরিণত করার এবং দেশকে একটি সোস্যাল ডেমোক্রেসিতে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তৎকালীন পশ্চিম ইউরোপীয় সোস্যাল ডেমোক্রেসির ধারা অনুসরণ না করে পূর্ব ইউরোপীয় ধারা অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব।
দলে এবং দেশের ভেতর বঙ্গবন্ধু এই বিপ্লব সফল করতে পারেননি। দেশের প্রতিবিপ্লবীরা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ, মস্ক এবং মিলিটারি হাত মিলিয়ে তাকে হত্যা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তিগুলোর ওপর তারা আঘাত হানতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী কয়েকটা বছর বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের জন্য এক অন্ধকার যুগ। আইয়ুব আমলে যেমন পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ গঠন করে প্রকৃত আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে লিটল আইয়ুব জিয়াউর রহমানের আমলে তেমনি মিজানুর রহমান চৌধুরী, ইউসুফ আলী প্রমুখ কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার দ্বারা সোহরাওয়ার্দী-আওয়ামী লীগ গঠন করে তখনকার সেনা শাসকরা আইয়ুবের মতো একই কায়দায় এই সংগ্রামী দলটিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। আইয়ুবের মতোই তারা ব্যর্থ হলেন।
আওয়ামী লীগের চতুর্থ যুগের শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গ্রহণের পর। আবু জাফর শামসুদ্দীনের কথাকে অনুকরণ করে বলতে হয়, আল্লাহ মেহেরবান, তাই বঙ্গবন্ধুর সকল পুত্র, এক ভাগ্নে, ভগি্নপতিসহ পরিবারের অনেক পুরুষ ও নারী সদস্য শহীদ হওয়ার পরও তার দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা বেঁচে গেছেন এবং দলের ও দেশের চরম দুর্দিনে সকল প্রতিকূলতার মধ্যে শেখ হাসিনা গৃহবধূর ভূমিকা থেকে রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায় উঠে আসার সাহস ও প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন।
এই সময় নেতৃত্বহীন এবং নেতৃত্বের কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগের নৌকার হাল যদি শেখ হাসিনা না ধরতেন, তাহলে দলটির অস্তিত্বই শুধু বিপন্ন হতো না, দেশে মুক্তিযুদ্ধের নিবু নিবু প্রদীপটিও একেবারেই নিভে যেত। সেনা শাসক এবং তাদের সিভিল ফেস বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ এমন অপ্রতিরোধ্যভাবে মাথা তুলত যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞের আগুন বাংলাদেশে এসে ছড়িয়ে পড়ত।
দেশে বামপন্থি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল এখন এতই দুর্বল যে, দেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এখনও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভগ্নপ্রায় ঘাঁটির শেষ ভরসা বলে মনে করেন। আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব হাসিনা-নেতৃত্ব যেমন দাবি করতে পারে, দলটিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার অসম্ভব কাজ সম্ভব করার সাফল্যেরও দাবি জানাতে পারে, তেমনি এই বাস্তবতাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চতুর্থ যুগের আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বর্ণযুগের মহিমা ধরে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সোস্যাল ডেমোক্রেট দলটি আবার একটি আধা পুঁজিবাদী ট্রাডিশনাল গণতান্ত্রিক দলের আপসবাদী চরিত্রে ফিরে এসেছে। এটা অগ্রসর হওয়া নয়, পশ্চাদপসারণ।
অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আমলের পরিস্থিতি এখন নেই এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলেও যুগোপযোগী সংস্কার ও পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু দলটি মূল লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আসতে পারে না। হাসিনা-নেতৃত্বের সাহস ও দেশপ্রেম অনস্বীকার্য। কিন্তু তার চরিত্রে আপস ও পিছিয়ে আসার প্রবণতাও লক্ষণীয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্রমশই তার মৌলিক চরিত্র হারাচ্ছে। সংগঠন দ্রুত শক্তি ও জনসম্পৃক্ততা হারাচ্ছে। দলে নতুন রক্ত সঞ্চালন নেই। যেসব নতুন মুখ দলে বা সরকারে দেখা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ, অযোগ্য ও চাটুকার ধরনের। ৬৩ বছর বয়সেই মনে হয় দলটিকে অকাল বার্ধক্যে ধরেছে। হাসিনা-নেতৃত্বের সাফল্য অনেক। কিন্তু ব্যর্থতাগুলোই এখন বেশি প্রকট। আওয়ামী লীগের ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসে তাই এই সতর্ক বাণীটি উচ্চারণ করা প্রয়োজন মনে করছি_ 'দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ।'
লন্ডন, ২২ জুন ২০১২, শুক্রবার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন