॥ মীযানুল করীম ॥
গত কয়েক দিনের মধ্যে মিসরের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠায় মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশটির ভাগ্যও নিদারুণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিন দশক স্থায়ী একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের সূর্যের প্রত্যাশায় যখন জনগণ, প্রত্যুষের সে মুহূর্তে আবার স্বৈরতন্ত্রের মধ্যরজনীর অন্ধকার নেমে আসার আশঙ্কা জেগেছে। বাতিল করা হয়েছে মিসরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম পার্লামেন্ট। এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিফলিত জনগণের আকাক্সাকেও বানচালের সর্বাত্মক প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মিসরে আবর বসন্তের পুষ্পিত উদ্যান মত্তহস্তীর তাণ্ডবে দলিত-মথিত হওয়ার সমূহ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপ। গণতন্ত্র নস্যাতের চক্রান্ত অবিলম্বে যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বিুব্ধ জনগণ নব্যস্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মরুঝড়ের সূচনা করতে বাধ্য হবে।
স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর দীর্ঘ ১৬ মাস পরে গত ১৬ জুন সম্পন্ন হলো গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী মুহাম্মাদ মুরসি পরাজিত করেছেন মোবারক নিযুক্ত শেষ প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিককে। ড. মুরসি প্রায় সাড়ে আট লাখ ভোটের ব্যবধানে ‘আরব বসন্তের প্রথম প্রেসিডেন্ট’ নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোট এক কোটি ২৯ লাখ ১১ হাজার ৩৫০। শুধু মিসর নয়, উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থেই এই বিজয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে ব্রাদারহুড। বিজয়ী মোহাম্মদ মুরসি ঘোষণা করেন, ‘মুসলমানদের মতো খ্রিষ্টানদেরও আমার পরিবারের লোক মনে করব।’ কারো প্রতি প্রতিশোধ না নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
মিসরে গত বছর মাত্র দুই সপ্তাহের গণবিপ্লবে তিন দশক স্থায়ী একনায়কের মসনদই উল্টে যায়নি, দেশের ইতিহাসে পার্লামেন্টের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথও সুগম হয়। ৬০ বছর আগে রাজতন্ত্র উৎখাতের মাধ্যমে কাক্সিত গণতন্ত্র না এসে কায়েম হয়েছিল সামরিক বড় কর্তাদের স্বৈরতন্ত্র। ‘ওয়ান ম্যান শো’ রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা যুগ যুগ ধরে নির্বাচনের নামে মর্মান্তিক প্রহসন করে এসেছে। ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের অপশাসন প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের এসব নির্বাচনকে একই সাথে প্রহসন ও মর্মান্তিক বলা স্ববিরোধী মনে হলেও এটাই তিক্ত বাস্তবতা। পূর্বনির্ধারিত ফলাফলসহ এ ধরনের নির্বাচনে জালিয়াতি-কারচুপির যাবতীয় ডকট্রিন ও ইঞ্জিনিয়ারিং করা হতো নির্লজ্জের মতো। এটা বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস হলেও ক্ষমতাসীন চক্রের ভাগ্য খুলে যেত, আর জাতির ভাগ্যাকাশে ঘনাতো আরো কালো মেঘ। ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যুর অপনির্বাচন শাসকগোষ্ঠীর মুখে প্রহসন উপভোগের হাসি জোগাত। অথচ নির্যাতিত-শোষিত জনগণের কাছে তা ছিল ট্র্যাজেডির মতো মর্মান্তিক। যথাক্রমে নাসের, সাদাত, মোবারকের আমলের এই কলঙ্ককালিমা মুছে সম্প্রতি হয়ে গিয়েছে অভূতপূর্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ সংসদ নির্বাচন। কিন্তু কুচক্রীরা সে সংসদকে ‘অবৈধ’ ঘোষণার স্পর্ধা দেখিয়েছে।
মোবারক পতনের মাধ্যমে বিশেষ ব্যক্তির বিদায় ঘটলেও সিস্টেম বদলায়নি। একনায়কের স্বৈরতন্ত্র এখন কায়েম রয়েছে কয়েক ব্যক্তির মাধ্যমে। এরাও আগের শাসকদের মতো সামরিক বাহিনীর লোক। তারা সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস (এসসিএএফ) নামে পরিচিতই শুধু নয়, নিজেদের সুপ্রিম বা সর্বেসর্বা মনে করছে পতিত স্বৈরাচারীর মতো। তা না হলে গণতন্ত্রে উত্তরণের দায়িত্ব পালন না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত না কিংবা অন্তর্বর্তীকালের জন্য ক্ষমতা পেয়ে তা স্থায়ী করার ফন্দি আঁটত না। পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে এমন একপর্যায়ে নেয়া হয়েছে যে, বিগত আমলের বেনিফিশিয়ারি ও বশংবদরা মরণোন্মুখ মোবারকের কালো দিনগুলোকে মোবারকবাদ জানানোর পর্যন্ত সুযোগ পেয়ে গেছে।
মোবারকের পতনের পর যথাশিগগির সম্ভব সুষ্ঠু পার্লামেন্ট নির্বাচনই ছিল সংগ্রামী জনগণের কাম্য। জাতি নিশ্চিত ছিল, স্বৈরাচারীর বিদায়ের সাথে তার চাপিয়ে দেয়া প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটবে। না, তা আসলে হয়নি। স্বৈরশাসকের হাতিয়ার হয়ে মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ‘জেতা’ এবং শত্রু ইসরাইলের মোকাবেলায় যুদ্ধে হেরে যাওয়ার রেকর্ড গড়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় উর্দি ও বন্দুকধারীরা এখনো জনগণের রায়কে পদদলিত করার অপকর্মে লিপ্ত। পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করা এরই সর্বশেষ নজির মাত্র।
মোবারকের পতনকালীন বিশেষ পরিস্থিতিতে অস্থায়ীভাবে প্রশাসন চালনার দায়িত্ব দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনীকে। জনগণের বিশ্বাস ছিল, তারা জাতির ঐক্যের প্রতীকরূপে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথের বাধাগুলো সরানোই ছিল নবগঠিত সামরিক পরিষদের আশু কর্তব্য। এর বিপরীতে, তারা একটার পর একটা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছে গণতন্ত্র কায়েমের পথে।
১. প্রথমেই সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে অযৌক্তিক ইস্যুর জন্ম দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন বিলম্বিত করা হলো।
২. জন-আন্দোলনের চাপে যখন দেখল, এ নির্বাচন না দিয়ে উপায় নেই, তখন এমনভাবে নির্বাচনের সময়সীমা এবং ভোটাভুটির কার্যক্রম স্থির করা হলো, যাতে কৌশলে সময়ক্ষেপণ করা যায়। এতে নিজেদের ক্ষমতা যেমন দীর্ঘায়িত হয়, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদ ও সন্দেহ সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হতে পারে।
৩. ক্ষমতাসীন এসসিএএফ অহেতুক সামরিক আদালতে এমন অনেকের বিচার শুরু করে, যাদের জনগণ গণতন্ত্রের সপক্ষের লোক মনে করেছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের মাঝে এতে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়।
৪. স্মরণকালের সর্বাধিক নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামি শক্তি ৬০ ভাগের বেশি আসনে জয় পেল। স্বৈরাচারীদের হাতে দীর্ঘকাল নির্যাতন ও নিষেধাজ্ঞার শিকার, মুসলিম ব্রাদারহুড দল জয়ী হলো সবচেয়ে বেশি আসনে। আর সেই পার্লামেন্টকে এবার আদালতকে দিয়ে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করিয়ে জাতির স্বতঃস্ফূর্ত রায়ের চরম অমর্যাদা করা হয়েছে। এখন পার্লামেন্ট ভবন খোদ নির্বাচিত এমপিদের জন্যই নিষিদ্ধ।
৫. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ মূহূর্তে পার্লামেন্ট বাতিলের সাথে এটাও জানিয়ে দেয়া হলো, ক্ষমতাসীন সুপ্রিম কাউন্সিল আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভোগ করবেÑ এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও। অর্থাৎ নির্বাচিত সংসদ বা রাষ্ট্রপ্রধানের নয়, দেশ শাসনের অধিকার থাকবে অস্ত্রপুষ্ট কয়েক ব্যক্তির হাতে। এভাবেই মিসরের এই পাবলিক সার্ভেন্টরা পাবলিককেই উল্টো সার্ভেন্ট বানিয়ে রাখতে চায়।
৬. সব শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানসহ প্রকাশিত হওয়ার পরও তা সরকারিভাবে জানানো হচ্ছে না। অমেরুদণ্ডী নির্বাচন কমিশন শত শত অভিযোগ নিষ্পত্তির অজুহাতে তা স্থগিত রেখেছে। কখন ফল ঘোষণা করা হবে, সেটা না জানানো রহস্যজনক। ক্ষমতাসীনেরা জানে কে বিজয়ী হয়েছেন, জনগণের সামনে তা স্পষ্ট। এ অবস্থায় ফলাফল নিয়ে টালবাহানা ইতোমধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠা পরিস্থিতিকে নিয়ে যাবে চরমে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তেমন অবস্থার জন্ম দিয়ে গণতন্ত্রকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে চায় বলে জনমনে সন্দেহ বাড়ছে। কিন্তু এতে তারা নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারবে কি? তাদের গডফাদার মোবারকের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়াই তাদের এখন করণীয়।
মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমুন শুধু ইসলামপন্থীদের মধ্যেই নয়, দেশের গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনেই বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে জন্মের পর থেকেই এই সংগঠন সব সরকারের হাতেই ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হয়ে এসেছে। নিষিদ্ধ থেকেছে দশকের পর দশক। কিন্তু এর দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, নিবেদিত কর্মী বাহিনী আর বিশাল নেটওয়ার্কের গুণে বহুমুখী তৎপরতা সব সময়েই ছিল অব্যাহত। জনঘনিষ্ঠ হয়ে সমাজসেবাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে নিরাপস ভূমিকার কারণে ব্রাদারহুডের গণভিত্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর নেতাকর্মীদের সততা, প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠা মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছে। মোবারকের আমলে ব্রাদারহুড ‘ওপেন-সিক্রেট’ পার্টি হিসেবে পার্লামেন্টসহ জাতীয় রাজনীতিতে একটা বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। তারা এক দিকে সেকুলার ও বামপন্থীদের প্রধান প্রতিপক্ষ, অন্য দিকে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী সহিংসতা কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘোরবিরোধী। ফলে বরাবরই ব্রাদারহুড প্রবল বৈরী প্রচারণার টার্গেট। মিসরে মিলিটারি, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবীর বড় অংশ ব্রাদারহুডের প্রতি আক্রোশ বা বিদ্বেষ পোষণ করলেও তাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা রোধ করা যায়নি। এরই বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল।
আরব বিশ্বের দেশে দেশে নানা ‘তন্ত্র’ আর তত্ত্বের ছদ্মবেশে স্বৈরাচারের রাজত্ব দীর্ঘ দিন থেকে। অবশ্য কয়েকটি দেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের অপ্রতিরোধ্য অভিঘাতে জবরদখলদারদের গণবিরোধী শাসনের অবসান ঘটেছে। এর আগে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে বারবার। বুলেট দমিয়ে রেখেছিল ব্যালট। এর পেছনে সেনাপতিদের রাষ্ট্রপতি হওয়ার উদগ্র কামনাই প্রধান কারণ। আর প্রতিপক্ষ যদি তাদের মতো বহিঃশক্তির তাঁবেদার না হয় এবং বিশেষ করে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। এ জন্যই নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্নে আলজেরিয়ায় ইসলামী দল নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত হলেও তাদের সরকার গঠনের অধিকার দেয়া হয়নি। গণরায়কে হত্যা করে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া হলো, যা কয়েক বছর ধরে কারণ হয়েছে গণহত্যার। ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থী হামাস জয়ী হলেও তাদের সরকারকে টিকতে দেয়া হয়নি। সুদানে ইসলামি দল ও নেতৃত্ব যাতে মাথা তুলতে না পারে, সে জন্য যথাসাধ্য বাধা দেয়া হয়েছে। এমনকি তুরস্কেও ইসলামী শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সংবিধানকে হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। এখনো নানা ষড়যন্ত্র চলছে সেদেশে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাবান একটি সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে। এই প্রেক্ষাপটেই মিসরে ব্রাদারহুডের বিজয় নস্যাৎ করার সার্বিক প্রয়াস ও পরিকল্পনা বিবেচনা করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই জনতা আবার সমবেত হয়েছে বিখ্যাত তাহরির চত্বরে। তারা গণরায় ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেখানে অবস্থান নিয়েছে। মিসরীয় জাতি উপলব্ধি করছেÑ মানবাধিকার, সুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতায় সমৃদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ার পথে আরো অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তাহরির স্কোয়ার তাই হয়ে উঠেছে সত্যিকার ও সার্বিক তাহরির বা মুক্তির চেতনায় উজ্জীবনের প্রতীক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন