হাসান ফেরদৌস
জর্জ ক্লুনি পরিচালিত গুড নাইট, অ্যান্ড গুড লাক ছবিটি নতুন করে দেখে একটা প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় তথ্যমাধ্যমের ভূমিকা প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা বা আইন পরিষদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এরা প্রত্যেকেই গণতন্ত্রের খুঁটি। যেকোনো একটি খুঁটি সরিয়ে নিলেই গণতন্ত্র হুমড়ি খেয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু প্রথম তিনটি খুঁটির তুলনায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কিঞ্চিৎ ভিন্ন। সংবাদমাধ্যমের একটা বড় কাজ গণতন্ত্রের বাকি তিন খুঁটি কে কেমন করছে, তার ওপর নজরদারি করা। তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ সরু চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দেখার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম দেশের মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে, দেশটা কোন পথে চলছে; কে ঠিক, কে ভুল।
অন্য কথায়, সংবাদমাধ্যম হলো গণতন্ত্রের স্বনিয়োজিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার ওপর নজরদারি রাখবে কে?
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গুড নাইট, অ্যান্ড গুড লাক ছবির মূল বিষয় সিবিএস টেলিভিশনের সাংবাদিক ও ভাষ্যকার এডওয়ার্ড আর মারো এবং দক্ষিণপন্থী মার্কিন সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। পঞ্চাশের দশকে শীতলযুদ্ধের তুঙ্গাবস্থায় ম্যাকার্থি উদারনৈতিক লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী—যাঁকে নিয়েই তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ জেগেছে, তাঁকেই ‘কমিউনিস্ট’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। সেনাবাহিনীর ভেতরে, এমনকি কংগ্রেসেও কমিউনিস্টরা আস্তানা গেড়েছে, এমন অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। কোনো প্রমাণ নেই, কেউ একজন তাঁকে এ নিয়ে কিছু একটা লাগালে বা কাউকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলে ম্যাকার্থি তাঁকে কমিউনিস্ট বলে গাল দিয়ে সিনেটের শুনানিতে ডেকে এনেছেন। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বা মিথ্যা প্রচারণায় চাকরি খুইয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ একঘরে হয়েছেন, এমনকি আত্মহত্যা করে অপমান থেকে নিষ্কৃতি খুঁজেছেন কেউ কেউ। যে হাতেগোনা দু-চারজন ম্যাকার্থির নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন এডওয়ার্ড মারো। শেষ পর্যন্ত যে ম্যাকার্থিকে অপমানিত হয়ে সিনেট ত্যাগ করতে হয়, তার পেছনে মারোর বড় ভূমিকা রয়েছে।
ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বড় রকমের ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েছিলেন মারো। সিবিএস কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়ে খুশি ছিল না। মালিকপক্ষ কখনোই শক্তিশালী রাজনীতিকদের চটাতে চায় না। মারোকেও তাই শেষ পর্যন্ত সিবিএস ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৬১ সালে যাওয়ার আগে তিনি একটি স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে সাংবাদিকদের এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন, নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ভার তাঁদেরই বহন করতে হবে। টেলিভিশন যে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘টিভির ক্ষমতা আছে আমাদের শিক্ষিত করার, আমাদের আলোকিত করার অথবা অনুপ্রাণিত করার। কিন্তু এসবই সম্ভব যদি এই শক্তিশালী মাধ্যমকে আমরা, অর্থাৎ সাংবাদিকেরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। অন্যথায় টিভি কিছু বৈদ্যুতিক তার, চকচকে কাচের পর্দার একটি বাক্স মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।’
শুধু টিভি নয়, তথ্যমাধ্যমের অন্য সব শাখা সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়। প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকেরা কি কথাটা জানেন? যাঁরা জানেন, তাঁরা কি সব সময় সচেতনভাবে সংবাদমাধ্যমকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের শিক্ষিত ও আলোকিত করতে নিষ্ঠাবান? সম্প্রতি পাকিস্তানে সে দেশের টিভির সাংবাদিকদের নিয়ে একটি ঘটনা ঘটেছে, যা এই বাক্সটির প্রতি দেশের মানুষের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি আমাদের দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক, সে জন্য এই আলোচনার সূত্রপাত।
গত দুই সপ্তাহে পাকিস্তানে তুমুল তর্ক চলছে সে দেশের মারকুটে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে। মালিক রিয়াজ হাসান নামের একজন রিয়েল এস্টেট মালিক—আসলে ভূমিদস্যু—অভিযোগ করেছেন, ইফতিখার চৌধুরীর ছেলে আরসালান ইফতিখারকে তিনি ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, ছেলের মাধ্যমে বাবার কাছে পৌঁছানো, তাঁর বিরুদ্ধে জমি হাতানোর যেসব মামলা উঠেছে, সেসবের রায় যেন তাঁর পক্ষে যায়, তা নিশ্চিত করা। প্রথমে বিচারপতি চৌধুরী নিজে ছেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মামলা পরিচালনার কথা বলেছিলেন, পরে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি সে মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাখ্যান করে নেন।
ঘটনাটি তাঁকে নিয়ে নয়। রিয়াজ হাসান ‘দুনিয়া টিভি’ নামের একটি ভুঁইফোড় টিভি স্টেশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আরসালান ইফতিখারকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগটি তুলেছিলেন। তাতেও সমস্যা ছিল না, আরসালানের এই অভিযোগ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে বিচার উঠেছে, ফলে এ আর নতুন কী কথা। সমস্যা হলো, রিয়াজ হাসানের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর ইন্টারনেটে একটি উড়ো ভিডিও প্রকাশ হয়, যাতে রিয়াজ ও দুনিয়া টিভির দুই সাংবাদিকের খোলামেলা আলাপ-আলোচনা বেফাঁস হয়ে যায়। সাক্ষাৎকার শুরুর আগে ও বিরতির সময় তাঁদের সে কথোপকথনে সাংবাদিকদ্বয় কোনোরকম লাজলজ্জা ছাড়াই হাসানকে পরামর্শ দিয়েছেন কী বলতে হবে, কীভাবে বলতে হবে। এঁদের একজন বলছেন, ‘(ঘুষের) প্রসঙ্গটা আপনি নিজে থেকেই তুলবেন, তা না হলে মনে হবে আমরা বুঝি ব্যাপারটা নিজেরা ঢুকিয়েছি। অবশ্য আমরা যে ঢুকিয়েছি, তা তো ঠিকই।’ একই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এই আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী গিলানির পুত্র সরাসরি স্টুডিওতে টেলিফোন করেছেন। হাত ঘুরে সে ফোন দেওয়া হয় রিয়াজ হাসানকে। ঘুষঘুষ ফুসফুস করে তাঁরা কী বললেন, আমরা জানি না। তবে অনুমান করতে পারি, টিভির পর্দায় কী বলবেন, তা নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শই গিলানিপুত্র দিয়েছেন। বিচারপতি চৌধুরী তাঁর পিতাকে কম হেনস্থা করেননি। এবার একটা মওকা পাওয়া গেছে বদলা নেওয়ার।
ইউটিউবের কল্যাণে সে ভিডিও এখন আপনারাও দেখতে পারেন এখানে: http://www.youtube.com/watch?v=XDUgEL5sLMw
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মালিক রিয়াজের সাক্ষাৎকারের এই ভিডিও বাজারে আসতে না আসতে আরেক ভিডিও এসে হাজির। যার বিষয়বস্তু, মালিক রিয়াজের বাহিয়া টাউন কোম্পানির কাছ থেকে সাংবাদিকদের মধ্য থেকে কে কী পরিমাণ রেস্ত কামিয়েছেন। সেই তালিকা দেখে মনে হবে, এ হচ্ছে পাকিস্তানি তথ্যমাধ্যমের হুজ হু। কে নেই সেখানে? এদিকে দুনিয়া টিভির দুই সংবাদদাতা একে অন্যকে দোষারোপ করে এক বিচ্ছিরি কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েছেন। দুনিয়া টিভির মালিকপক্ষ অবশ্য সব দোষের দায়ভার চাপিয়েছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জিও টিভির ওপর।
সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক, একটা ব্যাপার স্পষ্ট, পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক তথ্যমাধ্যম তাদের ওপর ন্যস্ত দায়দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে তাদের কাছে সে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তারা সে আশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাহীন সাধারণ নাগরিক আশা করে, তারা কণ্ঠহীন হলেও তথ্যমাধ্যম তাদের কণ্ঠ তুলে ধরবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তথ্যমাধ্যম একদিকে ক্ষমতাধর (যেমন, প্রধানমন্ত্রী গিলানির পুত্র) ও অন্যদিকে দুষ্কৃতকারী ও অসৎ ব্যবসায়ীর (যেমন মালিক রিয়াজ হাসান) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁরা কেবল এক পেয়ালার বন্ধু নন, এক শয্যারও।
গত ২০-২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে এক তথ্যবিপ্লব ঘটে গেছে। প্রধানত, প্রযুক্তিনির্ভর এই বিপ্লবের বড় সুবিধা, অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী সরকার চাইলেও এর টুঁটি চেপে রাখা সোজা নয়। দেশের ভেতরে সরকার যদি তাদের কাজে বাধা দেয়, বিদেশে বসে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। পাকিস্তানে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটেছে। তথ্যমাধ্যমের এই নতুন ও জোরালো ভূমিকা গণতন্ত্রের জন্য লাভজনক। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি, তথ্যমাধ্যমের সম্প্রসারিত ভূমিকার ফলে রাজনৈতিক সংলাপে নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে সংলাপ তৈরির দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর, তাদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে তথ্যমাধ্যমের তৎপরতায়। এই সংলাপে নাগরিক অংশগ্রহণ নিষ্ক্রিয় বা অসাড় মনে হতে পারে, কিন্তু তথ্যমাধ্যমের কারণেই নির্বাচনী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেশের মানুষ এখন অনেক বেশি শিক্ষিত, অনেক বেশি সচেতন, তাতেও তো কোনো ভুল নেই।
নতুন প্রযুক্তিনির্ভর এই তথ্যমাধ্যমে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক ক্ষমতাধর, অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা তার করায়ত্ত। ঠিক সে কারণে তার দায়িত্বও বেশি। বিপদের কথা হলো, সে দায়িত্ব সম্বন্ধে ইলেকট্রনিক তথ্যমাধ্যম হয় অজ্ঞ, নয়তো জেনেশুনে সচেতনভাবেই সে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে ব্যক্তিগত লাভের জন্য বা দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তথ্যমাধ্যম যদি নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, পাঠক-দর্শক হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী হবে?
আমেরিকায় তথ্যমাধ্যমের নজরদারির জন্য অনেক নাগরিক বা গবেষণা সংগঠন রয়েছে। মিডিয়া ম্যাটারস (http://mediamatters.org) নামের সংগঠনটি প্রধানত প্রগতিশীল ধারার, যার প্রধান কাজ দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যমের ওপর নজরদারি করা। অন্যদিকে ‘অ্যাকুরেসি ইন মিডিয়া’ (http://www.aim.org) এই নামের গ্রুপটির কাজ বামপন্থী ও উদারনৈতিক তথ্যমাধ্যমের ওপর নজর রাখা। বাম-ডানের বাইরেও একাধিক ‘মিডিয়া মনিটর’ আছে, যেমন: গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘এক্সসেলেন্স ইন জার্নালিজম’ প্রকল্প। তথ্যমাধ্যমে অথবা রাজনীতিকদের ভেতর কে কখন মিথ্যাচার করছে, তার হিসাব রাখার জন্য গঠিত ‘ফ্যাক্ট চেকার’ ও ‘স্পিন ডিটেকটার’। আমেরিকার দুই প্রধান দলের সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত করায় উভয় পক্ষের ভুল ও মিথ্যা বক্তব্য যাচাইয়ের কাজে এই সংগঠনের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে (http://www.factcheck.org)।
আমাদের দেশে এমন কোনো মিডিয়া মনিটর নেই। নাগরিক উদ্যোগে তো নয়ই, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও নয়। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়, তাঁরাও তাঁদের অধ্যয়নের অংশ হিসেবে এ কাজে হাত দিতে পারেন, কিন্তু কোথাও কেউ কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে শুনিনি। অথচ ব্যাঙের ছাতার মতো নিত্যনতুন টিভি গজাচ্ছে, পত্রিকা গজাচ্ছে। ভালো করতে পারুক বা না পারুক, এরা যে ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিড়ালের কাজ ইঁদুর ধরা। কখনো কখনো সে বিড়ালের ওপরেও নজর রাখতে হয় এবং দেখতে হয় ইঁদুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গৃহস্থের ভাঁড়ার ঘর সে সাবাড় করে দিচ্ছে কি না।
নিউইয়র্ক, ১৯ জুন ২০১২
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অন্য কথায়, সংবাদমাধ্যম হলো গণতন্ত্রের স্বনিয়োজিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার ওপর নজরদারি রাখবে কে?
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গুড নাইট, অ্যান্ড গুড লাক ছবির মূল বিষয় সিবিএস টেলিভিশনের সাংবাদিক ও ভাষ্যকার এডওয়ার্ড আর মারো এবং দক্ষিণপন্থী মার্কিন সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। পঞ্চাশের দশকে শীতলযুদ্ধের তুঙ্গাবস্থায় ম্যাকার্থি উদারনৈতিক লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী—যাঁকে নিয়েই তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ জেগেছে, তাঁকেই ‘কমিউনিস্ট’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। সেনাবাহিনীর ভেতরে, এমনকি কংগ্রেসেও কমিউনিস্টরা আস্তানা গেড়েছে, এমন অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। কোনো প্রমাণ নেই, কেউ একজন তাঁকে এ নিয়ে কিছু একটা লাগালে বা কাউকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলে ম্যাকার্থি তাঁকে কমিউনিস্ট বলে গাল দিয়ে সিনেটের শুনানিতে ডেকে এনেছেন। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বা মিথ্যা প্রচারণায় চাকরি খুইয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ একঘরে হয়েছেন, এমনকি আত্মহত্যা করে অপমান থেকে নিষ্কৃতি খুঁজেছেন কেউ কেউ। যে হাতেগোনা দু-চারজন ম্যাকার্থির নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন এডওয়ার্ড মারো। শেষ পর্যন্ত যে ম্যাকার্থিকে অপমানিত হয়ে সিনেট ত্যাগ করতে হয়, তার পেছনে মারোর বড় ভূমিকা রয়েছে।
ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বড় রকমের ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েছিলেন মারো। সিবিএস কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়ে খুশি ছিল না। মালিকপক্ষ কখনোই শক্তিশালী রাজনীতিকদের চটাতে চায় না। মারোকেও তাই শেষ পর্যন্ত সিবিএস ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৬১ সালে যাওয়ার আগে তিনি একটি স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে সাংবাদিকদের এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন, নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ভার তাঁদেরই বহন করতে হবে। টেলিভিশন যে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘টিভির ক্ষমতা আছে আমাদের শিক্ষিত করার, আমাদের আলোকিত করার অথবা অনুপ্রাণিত করার। কিন্তু এসবই সম্ভব যদি এই শক্তিশালী মাধ্যমকে আমরা, অর্থাৎ সাংবাদিকেরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। অন্যথায় টিভি কিছু বৈদ্যুতিক তার, চকচকে কাচের পর্দার একটি বাক্স মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।’
শুধু টিভি নয়, তথ্যমাধ্যমের অন্য সব শাখা সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়। প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকেরা কি কথাটা জানেন? যাঁরা জানেন, তাঁরা কি সব সময় সচেতনভাবে সংবাদমাধ্যমকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের শিক্ষিত ও আলোকিত করতে নিষ্ঠাবান? সম্প্রতি পাকিস্তানে সে দেশের টিভির সাংবাদিকদের নিয়ে একটি ঘটনা ঘটেছে, যা এই বাক্সটির প্রতি দেশের মানুষের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি আমাদের দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক, সে জন্য এই আলোচনার সূত্রপাত।
গত দুই সপ্তাহে পাকিস্তানে তুমুল তর্ক চলছে সে দেশের মারকুটে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী ও তাঁর ছেলেকে নিয়ে। মালিক রিয়াজ হাসান নামের একজন রিয়েল এস্টেট মালিক—আসলে ভূমিদস্যু—অভিযোগ করেছেন, ইফতিখার চৌধুরীর ছেলে আরসালান ইফতিখারকে তিনি ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, ছেলের মাধ্যমে বাবার কাছে পৌঁছানো, তাঁর বিরুদ্ধে জমি হাতানোর যেসব মামলা উঠেছে, সেসবের রায় যেন তাঁর পক্ষে যায়, তা নিশ্চিত করা। প্রথমে বিচারপতি চৌধুরী নিজে ছেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মামলা পরিচালনার কথা বলেছিলেন, পরে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি সে মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাখ্যান করে নেন।
ঘটনাটি তাঁকে নিয়ে নয়। রিয়াজ হাসান ‘দুনিয়া টিভি’ নামের একটি ভুঁইফোড় টিভি স্টেশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আরসালান ইফতিখারকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগটি তুলেছিলেন। তাতেও সমস্যা ছিল না, আরসালানের এই অভিযোগ নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে বিচার উঠেছে, ফলে এ আর নতুন কী কথা। সমস্যা হলো, রিয়াজ হাসানের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর ইন্টারনেটে একটি উড়ো ভিডিও প্রকাশ হয়, যাতে রিয়াজ ও দুনিয়া টিভির দুই সাংবাদিকের খোলামেলা আলাপ-আলোচনা বেফাঁস হয়ে যায়। সাক্ষাৎকার শুরুর আগে ও বিরতির সময় তাঁদের সে কথোপকথনে সাংবাদিকদ্বয় কোনোরকম লাজলজ্জা ছাড়াই হাসানকে পরামর্শ দিয়েছেন কী বলতে হবে, কীভাবে বলতে হবে। এঁদের একজন বলছেন, ‘(ঘুষের) প্রসঙ্গটা আপনি নিজে থেকেই তুলবেন, তা না হলে মনে হবে আমরা বুঝি ব্যাপারটা নিজেরা ঢুকিয়েছি। অবশ্য আমরা যে ঢুকিয়েছি, তা তো ঠিকই।’ একই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এই আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী গিলানির পুত্র সরাসরি স্টুডিওতে টেলিফোন করেছেন। হাত ঘুরে সে ফোন দেওয়া হয় রিয়াজ হাসানকে। ঘুষঘুষ ফুসফুস করে তাঁরা কী বললেন, আমরা জানি না। তবে অনুমান করতে পারি, টিভির পর্দায় কী বলবেন, তা নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শই গিলানিপুত্র দিয়েছেন। বিচারপতি চৌধুরী তাঁর পিতাকে কম হেনস্থা করেননি। এবার একটা মওকা পাওয়া গেছে বদলা নেওয়ার।
ইউটিউবের কল্যাণে সে ভিডিও এখন আপনারাও দেখতে পারেন এখানে: http://www.youtube.com/watch?v=XDUgEL5sLMw
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মালিক রিয়াজের সাক্ষাৎকারের এই ভিডিও বাজারে আসতে না আসতে আরেক ভিডিও এসে হাজির। যার বিষয়বস্তু, মালিক রিয়াজের বাহিয়া টাউন কোম্পানির কাছ থেকে সাংবাদিকদের মধ্য থেকে কে কী পরিমাণ রেস্ত কামিয়েছেন। সেই তালিকা দেখে মনে হবে, এ হচ্ছে পাকিস্তানি তথ্যমাধ্যমের হুজ হু। কে নেই সেখানে? এদিকে দুনিয়া টিভির দুই সংবাদদাতা একে অন্যকে দোষারোপ করে এক বিচ্ছিরি কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েছেন। দুনিয়া টিভির মালিকপক্ষ অবশ্য সব দোষের দায়ভার চাপিয়েছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জিও টিভির ওপর।
সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক, একটা ব্যাপার স্পষ্ট, পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক তথ্যমাধ্যম তাদের ওপর ন্যস্ত দায়দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে তাদের কাছে সে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তারা সে আশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাহীন সাধারণ নাগরিক আশা করে, তারা কণ্ঠহীন হলেও তথ্যমাধ্যম তাদের কণ্ঠ তুলে ধরবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তথ্যমাধ্যম একদিকে ক্ষমতাধর (যেমন, প্রধানমন্ত্রী গিলানির পুত্র) ও অন্যদিকে দুষ্কৃতকারী ও অসৎ ব্যবসায়ীর (যেমন মালিক রিয়াজ হাসান) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁরা কেবল এক পেয়ালার বন্ধু নন, এক শয্যারও।
গত ২০-২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে এক তথ্যবিপ্লব ঘটে গেছে। প্রধানত, প্রযুক্তিনির্ভর এই বিপ্লবের বড় সুবিধা, অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী সরকার চাইলেও এর টুঁটি চেপে রাখা সোজা নয়। দেশের ভেতরে সরকার যদি তাদের কাজে বাধা দেয়, বিদেশে বসে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। পাকিস্তানে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটেছে। তথ্যমাধ্যমের এই নতুন ও জোরালো ভূমিকা গণতন্ত্রের জন্য লাভজনক। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি, তথ্যমাধ্যমের সম্প্রসারিত ভূমিকার ফলে রাজনৈতিক সংলাপে নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে সংলাপ তৈরির দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর, তাদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে তথ্যমাধ্যমের তৎপরতায়। এই সংলাপে নাগরিক অংশগ্রহণ নিষ্ক্রিয় বা অসাড় মনে হতে পারে, কিন্তু তথ্যমাধ্যমের কারণেই নির্বাচনী সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেশের মানুষ এখন অনেক বেশি শিক্ষিত, অনেক বেশি সচেতন, তাতেও তো কোনো ভুল নেই।
নতুন প্রযুক্তিনির্ভর এই তথ্যমাধ্যমে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক ক্ষমতাধর, অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা তার করায়ত্ত। ঠিক সে কারণে তার দায়িত্বও বেশি। বিপদের কথা হলো, সে দায়িত্ব সম্বন্ধে ইলেকট্রনিক তথ্যমাধ্যম হয় অজ্ঞ, নয়তো জেনেশুনে সচেতনভাবেই সে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে ব্যক্তিগত লাভের জন্য বা দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তথ্যমাধ্যম যদি নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, পাঠক-দর্শক হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী হবে?
আমেরিকায় তথ্যমাধ্যমের নজরদারির জন্য অনেক নাগরিক বা গবেষণা সংগঠন রয়েছে। মিডিয়া ম্যাটারস (http://mediamatters.org) নামের সংগঠনটি প্রধানত প্রগতিশীল ধারার, যার প্রধান কাজ দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যমের ওপর নজরদারি করা। অন্যদিকে ‘অ্যাকুরেসি ইন মিডিয়া’ (http://www.aim.org) এই নামের গ্রুপটির কাজ বামপন্থী ও উদারনৈতিক তথ্যমাধ্যমের ওপর নজর রাখা। বাম-ডানের বাইরেও একাধিক ‘মিডিয়া মনিটর’ আছে, যেমন: গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘এক্সসেলেন্স ইন জার্নালিজম’ প্রকল্প। তথ্যমাধ্যমে অথবা রাজনীতিকদের ভেতর কে কখন মিথ্যাচার করছে, তার হিসাব রাখার জন্য গঠিত ‘ফ্যাক্ট চেকার’ ও ‘স্পিন ডিটেকটার’। আমেরিকার দুই প্রধান দলের সমর্থকদের অন্তর্ভুক্ত করায় উভয় পক্ষের ভুল ও মিথ্যা বক্তব্য যাচাইয়ের কাজে এই সংগঠনের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে (http://www.factcheck.org)।
আমাদের দেশে এমন কোনো মিডিয়া মনিটর নেই। নাগরিক উদ্যোগে তো নয়ই, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও নয়। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়, তাঁরাও তাঁদের অধ্যয়নের অংশ হিসেবে এ কাজে হাত দিতে পারেন, কিন্তু কোথাও কেউ কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে শুনিনি। অথচ ব্যাঙের ছাতার মতো নিত্যনতুন টিভি গজাচ্ছে, পত্রিকা গজাচ্ছে। ভালো করতে পারুক বা না পারুক, এরা যে ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিড়ালের কাজ ইঁদুর ধরা। কখনো কখনো সে বিড়ালের ওপরেও নজর রাখতে হয় এবং দেখতে হয় ইঁদুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গৃহস্থের ভাঁড়ার ঘর সে সাবাড় করে দিচ্ছে কি না।
নিউইয়র্ক, ১৯ জুন ২০১২
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন