মাহমুদুর রহমান মান্না
গত সংখ্যায় বলেছিলাম_ আগামীতে বিএনপির আন্দোলন, আন্দোলনের কৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে লিখব। আজ এমন একটি দিনে লিখতে বসছি যেদিন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত সংখ্যায় লেখা প্রকাশ হওয়ার পর একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তার নাম মাসুদ। তিনি আমার চেয়ে দু'এক বছরের সিনিয়র হবেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি মোটামুটিভাবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি আমার একটি ভুল সংশোধন করেছেন বা তিনি যেটাকে ভুল মনে করেছেন সে সম্পর্কে বলেছেন। আমি বলেছিলাম আইয়ুব খানের যে পতন হলো ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন বড় আন্দোলন হয়নি, যার কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রধানত এখানকার আন্দোলনের কারণেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি ফোনে আমাকে বললেন, আপনার এ লেখা যেহেতু অনেকে পড়ে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, তাদের মধ্যে একটি ভুল তথ্য থেকে যেতে পারে। কারণ ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। তিনি বললেন, আমার মনে আছে, তখন আমি সেই আন্দোলনের মধ্যে ছিলাম। আর সারা পৃথিবীতেই তখন যুব আন্দোলন, যুব বিদ্রোহের একটি সময় চলেছে। ফ্রান্সে দ্যগলের মতো লৌহমানব যুব সমাজের আন্দোলনের মুখে প্রথম পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ফিরে এসে আবার নির্বাচনে জিতেছিলেন। সেটি এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাসুদ বললেন, আমরা সবসময় নিজেদের কাজ নিয়ে গর্ব এবং অহঙ্কার করি। তার জন্য হয়তো অন্যের বিষয়ে ভালো করে খোঁজও নেই না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানে তখন যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রধানত সে আন্দোলনের কারণে পাঞ্জাবি শাসকচক্রের ভিত নড়ে গিয়েছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে সে কারণে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পাঠক জ্ঞাতার্থে আমি এ বিষয়টি এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করলাম।
ক্ষমতার বিষয়টিকে অনেক দিক দিয়ে দেখা দরকার। বক্তৃতায় আমরা বলি '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এতবড় প্রচণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বুঝতে হবে ক্ষমতা একটি সর্ব ব্যাপক জিনিস। ক্ষমতার পরিবর্তন একটি বিরাট আলোড়ন-আন্দোলনের ফলে হয়। এর বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অনেক কারণ থাকে। সেগুলো পরিপূর্ণ ও পরিপক্ব না হলে ক্ষমতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে না। সেদিক থেকে মাসুদ সাহেব আমাকে যে সাহায্য করেছেন তার জন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ। আর সে বিবেচনা সামনে রেখে আমি এখন আমার বর্তমান লেখার প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখব।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বড় ধরনের গণআন্দোলনের উদাহরণ যদি দেওয়া যায় তাহলে সেটি এরশাদের বিরুদ্ধে। সামরিক ফরমান জারি করে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তখন দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দুটি দল ছিল। তারপরও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নয় বছর পর তিনি যে চলে গেলেন_ আমরা সবাই এরকম করে বলি তিনি একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি এ কথা বলব, যারা '৬৯ দেখেছেন তারা মানবেন বা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এরশাদ আমলের ছাত্র আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান '৬৯-এর মতো ছিল না। এ আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে করতে করতে শেষ পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করতে গিয়ে করা হয়েছিল জনতার মঞ্চ। সচিবালয় থেকে সবাই এসে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক অর্থে প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। প্রশাসনকে যদি এরকম ভেঙে তছনছ না করা যেত, তাহলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতেন কিনা এ কথা বলা এখন মুশকিল। কারণ সময় গেলে মানুষের কথার বদল হয়। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়। নিশ্চয় এমনকি খোদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই সময় যেরকম করে অবস্থা দেখতেন এখন সে রকম দেখেন না। তার বক্তব্য শোনলেও হয়তো তখনকার বাস্তব পরিস্থিতির চিত্র এখন পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা সত্যি রাজপথে লাখ লাখ মানুষের মিছিল উত্তাল গণজাগরণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ হয়নি। কারণ এরপরে যে নির্বাচন হয়েছিল সে নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বহুভাবে আইনের বিধানে আটকে রাখলেও জাতীয় পার্টি আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কিভাবে? আমি বলতে চাচ্ছি, এ ধরনের গণঅভ্যুত্থানের কথা আমরা মাঝে মাঝে বক্তৃতায় বলি। সেগুলোর অর্থ সবই এই অর্থে পরিচ্ছন্ন নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি_ আমাদের এ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নেতাদের বক্তৃতায় যতবেশি আবেগ থাকে ততবেশি যুক্তি ও বিশ্লেষণ থাকে না। অতএব শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা এবং সেখানে ক্ষমতা কিংবা রাজনীতির যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে সেটিতে পরিবর্তন ঘটে যায়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও শেষ পর্যন্ত সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঠক, এগুলো হলো ভূমিকা। ভূমিকায়ই অনেক কথা বলার চেষ্টা করছি আমি। আমি বলছি বিএনপি খুব একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল তা হয়তো বলা যাবে না। অনেকে যে রকম বলেন বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলই নয়, ওটা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে, সামরিক বাহিনীর লোকদের আবার বুদ্ধি কোথায়, তাদের বুদ্ধিতো হাঁটুতে থাকে। এ ধরনের কথাবার্তার কোনো মানেই নেই। কোনো কোনো সামরিক নায়ক দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছেন বা দেশ চালিয়েছেন। জনপ্রিয় হিরোর মতো মারা গেছেন। অনেকের কথা বলতে পারি। মিসরে কিংবা লিবিয়ায় আমাদের সময়কার এরকম কিছু বড় বড় ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমি এই প্রসঙ্গটি এ জন্য আনলাম যে, বিএনপি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে ধীরে ধীরে, আর এ কারণে আজ প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময় পার করার পরে বিএনপি রাজনীতিতে একেবারে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এগুলো যে কোনো বিবেচনায়ই আনা যাবে না এরকম ভাবার দরকার নেই। আমি আমার গত লেখায় যে রকম বলেছিলাম এখন সেই লেখারই প্রতিধ্বনি করছি। বিএনপি খুব হিসাব করছে। তারা মনে করছে নির্বাচনে জিতবে। যদি সেটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না। আমার কথার প্রমাণ দিয়েছেন সদ্য কারামুক্ত বিএপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আলোচনায় বলেছেন, বিএনপি যে কোনোভাবেই কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের বিরোধিতা করছে। তারা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব দেখতে চান না। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ব্যাপারটা যদি রাজনৈতিকভাবে হয়, তিনি তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। কিন্তু অরাজনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে যদি কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয় তাহলে বিএনপি সেটিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাবে। এই একটি মজার ব্যাপার। পাঠকদের অনেকের মনে থাকতে পারে, যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসেছিলেন তখনো আমাদের দেশে এই বড় দুটি রাজনৈতিক দল ছিল। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এই দুই দল যদি সজাগ, সচেতন ও রাজপথে থাকত তাহলে কি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসতে পারতেন? বিশ্লেষকরা বলেন, প্রধানত এ দুটি রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেরিয়ে এসেছেন।
আর এ প্রসঙ্গে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে যে, তারাই তখন সামরিক শাসন টেনে এনেছিলেন। তাদের দুর্বলতায় বা তাদের আশকারায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ঠিক এরকমভাবে আমি বলি_ যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে একটি সরকার তত্ত্বাবধায়কের নামে তিন মাসের জায়গায় দুই বছর ক্ষমতা দখল করেছে, তখনো কিন্তু একইরকম অভিযোগ করা হয়েছে। বেশি করে এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আসছে, কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সেই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও একজন আরেকজনকে অভিযোগ করার ব্যাপারে ছাড়ছেন না যে, সামরিক সরকার আসার সুযোগ তাদের কারণে হয়েছে।
এখনো একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি আমি দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুদিন খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা, আওয়ামী লীগের নেতারা এই কথা বলছেন যে, সামরিক বাহিনীকে আশকারা দিচ্ছে বিএনপি। তারা তাদের উস্কে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার উল্টো দিকে যেতে শুরু করেছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথা চালু করার চেষ্টা করছেন যে, আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে তারা জিততে পারবে না। এ জন্য তারা তৃতীয় কোনো শক্তির হাতে, অরাজনৈতিক কোনো শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে চায়। পঞ্চদশ সংশোধনী খুব দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করে বলা হলো কোনোভাবেই যেন এ দেশে আর কোনো সামরিক শাসন না আসতে পারে তার জন্য এ সংশোধনী। তখন মনে হয়েছে, অন্তত আওয়ামী লীগ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, বিএনপি সম্ভবত আওয়ামী লীগের বদলে সামরিক সরকারকে চাইছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক তখন এ রকম মত প্রকাশ করেছেন যে, এই দুই নেত্রী পরস্পর পরস্পরের ওপর এতই বিতৃষ্ণ যে, যদি নিজে থাকতে না পারেন তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে যাবেন তবু একে থাকতে দেবেন না। অনেকটা জেদের ভাত কুকুরকে খাইয়ে দেওয়ার মতো। মানুষ কি বুঝছে, কি বুঝবে তারা তার জবাব দেবে; কিন্তু মূল কথা দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলছে।
বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা আমাদের দেশের ক্ষমতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শক্তির একটা প্রভাব আছে এ কথা আমরা সবাই বলি। এ কথার মানে কি? আন্তর্জাতিক শক্তি, বৃহৎ শক্তি, প্রতিবেশী শক্তি তাদের ইচ্ছার দাস হিসেবে কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? এ রকম আসলে হয় না। দ্বন্দ্বতত্ত্ব যে রকম বলে বস্তুর বিকাশ হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে, ঠিক সেরকম করে দেশের মধ্যেই যদি সেই দুর্বলতা না থাকে তাহলে বাইরের কোনো শক্তি কিছু করতে পারে না। আমাদের দেশের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, যতটা বিস্তার লাভ করেছিল সেটা দমন করার প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। সবাই বলে জঙ্গিবাদ দমনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু পয়েন্ট অর্জন করেছে এবং বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই বাংলাভাইয়ের উত্থান, বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলা এসব ঘটনা থেকে তারা বহির্বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, বিএনপি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। আর তখন ক্ষমতায় ছিল যে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা এ ব্যাপারে অনেকটা চোখ-কান বন্ধ রেখেছিলেন। বলেছিলেন এসব বাংলা ভাই কিংবা জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি। বাস্তবে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই একটি কারণে বিএনপি এখনো বহির্বিশ্বের সমর্থনের জায়গায় প্রচণ্ড রকম দুর্বল রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে এক বিরাট আপেক্ষিক শূন্যতা বিরাজ করছে। আপেক্ষিক এ কারণেই বললাম, বেগম জিয়ার যথেষ্টই বয়স হয়েছে। তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, তিনি নতুন নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান। সবাই ভেবেছে নতুন নেতৃত্ব বলতে তিনি তার পুত্রকে বোঝাতে চাইছেন। তার পুত্ররা বিগত জোট সরকার আমলে এমন এমন কাজ করেছেন, যেগুলো নিয়ে বিরোধী দল প্রচার-প্রচারণায় নেমেছিল, যা মানুষ বিশ্বাস করেছিল। যার কারণে বিএনপি নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেছিল। এমনও প্রচার হয়েছিল যে, বেগম জিয়ার বড় ছেলে যিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তিনি তখন জঙ্গিবাদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। আমি কোনো বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না সত্যি কিংবা মিথ্যা নিয়ে। রাজনীতি এমন একটি জিনিস, আমি মাঝে মাঝে বলি, সত্য মিথ্যার বিচার পরে হয়। মানুষ কোনটাকে সত্য বলে জেনেছে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এটি বিএনপির জন্য একটি বিরাট মাইনাস পয়েন্ট। বিএনপি চাইলে আন্দোলন করে ক্ষমতায় চলে যাবে এরকম নয়। আমার কাছে কিছু কিছু ঘটনা এরকম মনে হয়েছে যে, বিএনপির পক্ষ থেকে এখন আন্তর্জাতিক এই লবিকে পক্ষে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি জানি না, মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটন যখন এলেন তখন তিনি যেরকম করে বেগম জিয়ার বাসায় গেলেন, দেখা করলেন, কথা বললেন, পাটি সাপটা গেলেন, সবমিলে সেই দৃষ্টির আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটছে কিনা। এটা কি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বার্তা দেয় নাকি সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। আর এদিকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যারা আমাদের এখানকার রাজনীতিতে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে সেই জায়গাতেও বিএনপি নিশ্চয় কিছু একটা করার চেষ্টা করছে, যাতে তারা তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন না থাকে। কিন্তু সে দিকে কতখানি সফলতা তারা অর্জন করেছে, সেটা বলতে পারব না। বিএনপি আন্তর্জাতিক এই সম্পর্কের ব্যাপারে এতদিন উদাসীন ছিল তার কারণ হচ্ছে, এখানে তাদের কোনো যোগ্য নেতৃত্ব ছিল না বা যারা ছিল অতীতে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শোনা যায়, বেগম জিয়া এ ব্যাপারে নিজের থেকে আগ্রহ নিয়ে এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। একই ঘটনা হয়তো আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলা যায়। বলা যায়, উভয় দল আগামীতে আন্দোলনের নামে যাই করুক না কেন, ক্ষমতার পালা বদলের জন্য যাদের যাদের সমর্থন দরকার, তাদেরকে সমর্থনে নেওয়ার জন্য, অন্তত নিরপেক্ষ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। বেগম জিয়া যদিও বলেছেন, ঈদের পর আরও বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন এবং জঙ্গি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। আমি মনে করি, সেটাও নির্ভর করবে কতটা এই শক্তি-সাম্য তিনি তার পক্ষে আনতে পারবেন।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
গত সংখ্যায় বলেছিলাম_ আগামীতে বিএনপির আন্দোলন, আন্দোলনের কৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে লিখব। আজ এমন একটি দিনে লিখতে বসছি যেদিন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত সংখ্যায় লেখা প্রকাশ হওয়ার পর একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তার নাম মাসুদ। তিনি আমার চেয়ে দু'এক বছরের সিনিয়র হবেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি মোটামুটিভাবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি আমার একটি ভুল সংশোধন করেছেন বা তিনি যেটাকে ভুল মনে করেছেন সে সম্পর্কে বলেছেন। আমি বলেছিলাম আইয়ুব খানের যে পতন হলো ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন বড় আন্দোলন হয়নি, যার কারণে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রধানত এখানকার আন্দোলনের কারণেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি ফোনে আমাকে বললেন, আপনার এ লেখা যেহেতু অনেকে পড়ে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, তাদের মধ্যে একটি ভুল তথ্য থেকে যেতে পারে। কারণ ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। তিনি বললেন, আমার মনে আছে, তখন আমি সেই আন্দোলনের মধ্যে ছিলাম। আর সারা পৃথিবীতেই তখন যুব আন্দোলন, যুব বিদ্রোহের একটি সময় চলেছে। ফ্রান্সে দ্যগলের মতো লৌহমানব যুব সমাজের আন্দোলনের মুখে প্রথম পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ফিরে এসে আবার নির্বাচনে জিতেছিলেন। সেটি এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাসুদ বললেন, আমরা সবসময় নিজেদের কাজ নিয়ে গর্ব এবং অহঙ্কার করি। তার জন্য হয়তো অন্যের বিষয়ে ভালো করে খোঁজও নেই না। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানে তখন যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রধানত সে আন্দোলনের কারণে পাঞ্জাবি শাসকচক্রের ভিত নড়ে গিয়েছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে সে কারণে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পাঠক জ্ঞাতার্থে আমি এ বিষয়টি এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করলাম।
ক্ষমতার বিষয়টিকে অনেক দিক দিয়ে দেখা দরকার। বক্তৃতায় আমরা বলি '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এতবড় প্রচণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বুঝতে হবে ক্ষমতা একটি সর্ব ব্যাপক জিনিস। ক্ষমতার পরিবর্তন একটি বিরাট আলোড়ন-আন্দোলনের ফলে হয়। এর বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অনেক কারণ থাকে। সেগুলো পরিপূর্ণ ও পরিপক্ব না হলে ক্ষমতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে না। সেদিক থেকে মাসুদ সাহেব আমাকে যে সাহায্য করেছেন তার জন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ। আর সে বিবেচনা সামনে রেখে আমি এখন আমার বর্তমান লেখার প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখব।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বড় ধরনের গণআন্দোলনের উদাহরণ যদি দেওয়া যায় তাহলে সেটি এরশাদের বিরুদ্ধে। সামরিক ফরমান জারি করে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তখন দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দুটি দল ছিল। তারপরও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নয় বছর পর তিনি যে চলে গেলেন_ আমরা সবাই এরকম করে বলি তিনি একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি এ কথা বলব, যারা '৬৯ দেখেছেন তারা মানবেন বা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এরশাদ আমলের ছাত্র আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান '৬৯-এর মতো ছিল না। এ আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে করতে করতে শেষ পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করতে গিয়ে করা হয়েছিল জনতার মঞ্চ। সচিবালয় থেকে সবাই এসে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক অর্থে প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। প্রশাসনকে যদি এরকম ভেঙে তছনছ না করা যেত, তাহলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতেন কিনা এ কথা বলা এখন মুশকিল। কারণ সময় গেলে মানুষের কথার বদল হয়। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়। নিশ্চয় এমনকি খোদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই সময় যেরকম করে অবস্থা দেখতেন এখন সে রকম দেখেন না। তার বক্তব্য শোনলেও হয়তো তখনকার বাস্তব পরিস্থিতির চিত্র এখন পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা সত্যি রাজপথে লাখ লাখ মানুষের মিছিল উত্তাল গণজাগরণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ হয়নি। কারণ এরপরে যে নির্বাচন হয়েছিল সে নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বহুভাবে আইনের বিধানে আটকে রাখলেও জাতীয় পার্টি আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কিভাবে? আমি বলতে চাচ্ছি, এ ধরনের গণঅভ্যুত্থানের কথা আমরা মাঝে মাঝে বক্তৃতায় বলি। সেগুলোর অর্থ সবই এই অর্থে পরিচ্ছন্ন নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি_ আমাদের এ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নেতাদের বক্তৃতায় যতবেশি আবেগ থাকে ততবেশি যুক্তি ও বিশ্লেষণ থাকে না। অতএব শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা এবং সেখানে ক্ষমতা কিংবা রাজনীতির যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে সেটিতে পরিবর্তন ঘটে যায়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও শেষ পর্যন্ত সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঠক, এগুলো হলো ভূমিকা। ভূমিকায়ই অনেক কথা বলার চেষ্টা করছি আমি। আমি বলছি বিএনপি খুব একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল তা হয়তো বলা যাবে না। অনেকে যে রকম বলেন বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলই নয়, ওটা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে, সামরিক বাহিনীর লোকদের আবার বুদ্ধি কোথায়, তাদের বুদ্ধিতো হাঁটুতে থাকে। এ ধরনের কথাবার্তার কোনো মানেই নেই। কোনো কোনো সামরিক নায়ক দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছেন বা দেশ চালিয়েছেন। জনপ্রিয় হিরোর মতো মারা গেছেন। অনেকের কথা বলতে পারি। মিসরে কিংবা লিবিয়ায় আমাদের সময়কার এরকম কিছু বড় বড় ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমি এই প্রসঙ্গটি এ জন্য আনলাম যে, বিএনপি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে ধীরে ধীরে, আর এ কারণে আজ প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময় পার করার পরে বিএনপি রাজনীতিতে একেবারে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এগুলো যে কোনো বিবেচনায়ই আনা যাবে না এরকম ভাবার দরকার নেই। আমি আমার গত লেখায় যে রকম বলেছিলাম এখন সেই লেখারই প্রতিধ্বনি করছি। বিএনপি খুব হিসাব করছে। তারা মনে করছে নির্বাচনে জিতবে। যদি সেটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না। আমার কথার প্রমাণ দিয়েছেন সদ্য কারামুক্ত বিএপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আলোচনায় বলেছেন, বিএনপি যে কোনোভাবেই কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের বিরোধিতা করছে। তারা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব দেখতে চান না। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ব্যাপারটা যদি রাজনৈতিকভাবে হয়, তিনি তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। কিন্তু অরাজনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে যদি কোনো তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হয় তাহলে বিএনপি সেটিকে সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকাবে। এই একটি মজার ব্যাপার। পাঠকদের অনেকের মনে থাকতে পারে, যখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসেছিলেন তখনো আমাদের দেশে এই বড় দুটি রাজনৈতিক দল ছিল। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এই দুই দল যদি সজাগ, সচেতন ও রাজপথে থাকত তাহলে কি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসতে পারতেন? বিশ্লেষকরা বলেন, প্রধানত এ দুটি রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেরিয়ে এসেছেন।
আর এ প্রসঙ্গে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে যে, তারাই তখন সামরিক শাসন টেনে এনেছিলেন। তাদের দুর্বলতায় বা তাদের আশকারায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ঠিক এরকমভাবে আমি বলি_ যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে একটি সরকার তত্ত্বাবধায়কের নামে তিন মাসের জায়গায় দুই বছর ক্ষমতা দখল করেছে, তখনো কিন্তু একইরকম অভিযোগ করা হয়েছে। বেশি করে এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আসছে, কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সেই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও একজন আরেকজনকে অভিযোগ করার ব্যাপারে ছাড়ছেন না যে, সামরিক সরকার আসার সুযোগ তাদের কারণে হয়েছে।
এখনো একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি আমি দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুদিন খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা, আওয়ামী লীগের নেতারা এই কথা বলছেন যে, সামরিক বাহিনীকে আশকারা দিচ্ছে বিএনপি। তারা তাদের উস্কে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার উল্টো দিকে যেতে শুরু করেছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির পক্ষ থেকে এ কথা চালু করার চেষ্টা করছেন যে, আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে তারা জিততে পারবে না। এ জন্য তারা তৃতীয় কোনো শক্তির হাতে, অরাজনৈতিক কোনো শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে চায়। পঞ্চদশ সংশোধনী খুব দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করে বলা হলো কোনোভাবেই যেন এ দেশে আর কোনো সামরিক শাসন না আসতে পারে তার জন্য এ সংশোধনী। তখন মনে হয়েছে, অন্তত আওয়ামী লীগ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, বিএনপি সম্ভবত আওয়ামী লীগের বদলে সামরিক সরকারকে চাইছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক তখন এ রকম মত প্রকাশ করেছেন যে, এই দুই নেত্রী পরস্পর পরস্পরের ওপর এতই বিতৃষ্ণ যে, যদি নিজে থাকতে না পারেন তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে যাবেন তবু একে থাকতে দেবেন না। অনেকটা জেদের ভাত কুকুরকে খাইয়ে দেওয়ার মতো। মানুষ কি বুঝছে, কি বুঝবে তারা তার জবাব দেবে; কিন্তু মূল কথা দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলছে।
বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা আমাদের দেশের ক্ষমতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শক্তির একটা প্রভাব আছে এ কথা আমরা সবাই বলি। এ কথার মানে কি? আন্তর্জাতিক শক্তি, বৃহৎ শক্তি, প্রতিবেশী শক্তি তাদের ইচ্ছার দাস হিসেবে কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? এ রকম আসলে হয় না। দ্বন্দ্বতত্ত্ব যে রকম বলে বস্তুর বিকাশ হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে, ঠিক সেরকম করে দেশের মধ্যেই যদি সেই দুর্বলতা না থাকে তাহলে বাইরের কোনো শক্তি কিছু করতে পারে না। আমাদের দেশের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, যতটা বিস্তার লাভ করেছিল সেটা দমন করার প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। সবাই বলে জঙ্গিবাদ দমনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু পয়েন্ট অর্জন করেছে এবং বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা জঙ্গিবাদকে মদদ দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই বাংলাভাইয়ের উত্থান, বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলা এসব ঘটনা থেকে তারা বহির্বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, বিএনপি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। আর তখন ক্ষমতায় ছিল যে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা এ ব্যাপারে অনেকটা চোখ-কান বন্ধ রেখেছিলেন। বলেছিলেন এসব বাংলা ভাই কিংবা জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি। বাস্তবে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই একটি কারণে বিএনপি এখনো বহির্বিশ্বের সমর্থনের জায়গায় প্রচণ্ড রকম দুর্বল রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে এক বিরাট আপেক্ষিক শূন্যতা বিরাজ করছে। আপেক্ষিক এ কারণেই বললাম, বেগম জিয়ার যথেষ্টই বয়স হয়েছে। তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, তিনি নতুন নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান। সবাই ভেবেছে নতুন নেতৃত্ব বলতে তিনি তার পুত্রকে বোঝাতে চাইছেন। তার পুত্ররা বিগত জোট সরকার আমলে এমন এমন কাজ করেছেন, যেগুলো নিয়ে বিরোধী দল প্রচার-প্রচারণায় নেমেছিল, যা মানুষ বিশ্বাস করেছিল। যার কারণে বিএনপি নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেছিল। এমনও প্রচার হয়েছিল যে, বেগম জিয়ার বড় ছেলে যিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তিনি তখন জঙ্গিবাদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। আমি কোনো বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না সত্যি কিংবা মিথ্যা নিয়ে। রাজনীতি এমন একটি জিনিস, আমি মাঝে মাঝে বলি, সত্য মিথ্যার বিচার পরে হয়। মানুষ কোনটাকে সত্য বলে জেনেছে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এটি বিএনপির জন্য একটি বিরাট মাইনাস পয়েন্ট। বিএনপি চাইলে আন্দোলন করে ক্ষমতায় চলে যাবে এরকম নয়। আমার কাছে কিছু কিছু ঘটনা এরকম মনে হয়েছে যে, বিএনপির পক্ষ থেকে এখন আন্তর্জাতিক এই লবিকে পক্ষে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি জানি না, মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটন যখন এলেন তখন তিনি যেরকম করে বেগম জিয়ার বাসায় গেলেন, দেখা করলেন, কথা বললেন, পাটি সাপটা গেলেন, সবমিলে সেই দৃষ্টির আদৌ কোনো পরিবর্তন ঘটছে কিনা। এটা কি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বার্তা দেয় নাকি সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। আর এদিকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যারা আমাদের এখানকার রাজনীতিতে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে সেই জায়গাতেও বিএনপি নিশ্চয় কিছু একটা করার চেষ্টা করছে, যাতে তারা তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন না থাকে। কিন্তু সে দিকে কতখানি সফলতা তারা অর্জন করেছে, সেটা বলতে পারব না। বিএনপি আন্তর্জাতিক এই সম্পর্কের ব্যাপারে এতদিন উদাসীন ছিল তার কারণ হচ্ছে, এখানে তাদের কোনো যোগ্য নেতৃত্ব ছিল না বা যারা ছিল অতীতে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শোনা যায়, বেগম জিয়া এ ব্যাপারে নিজের থেকে আগ্রহ নিয়ে এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। একই ঘটনা হয়তো আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলা যায়। বলা যায়, উভয় দল আগামীতে আন্দোলনের নামে যাই করুক না কেন, ক্ষমতার পালা বদলের জন্য যাদের যাদের সমর্থন দরকার, তাদেরকে সমর্থনে নেওয়ার জন্য, অন্তত নিরপেক্ষ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। বেগম জিয়া যদিও বলেছেন, ঈদের পর আরও বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন এবং জঙ্গি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। আমি মনে করি, সেটাও নির্ভর করবে কতটা এই শক্তি-সাম্য তিনি তার পক্ষে আনতে পারবেন।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন