মাহমুদুর রহমান মান্না
বেগম জিয়া এবং বিএনপি বেশ ধীরগতিতে এগুচ্ছে এ কথা তাদের ১১ জুনের গণসমাবেশ দেখে বোঝা যায়। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমত আমি বলব, এ লেখা আমি যেদিন লিখছি সে সময়ের ভেতরে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেক নেতা মুক্তি পেয়েছেন। যদিও এটা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করি না। যারা মুক্তি পেয়েছেন তাদের অন্যতম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিকে ভাঙা যাবে না। গ্রেফতার-নির্যাতন দলকে আরও সংগঠিত করেছে। বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে। বিএনপি এখন আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কথার মধ্যে খানিকটা বিশ্বাস আনা যায় এ বিবেচনা থেকে যে, ১১ তারিখের গণসমাবেশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সেই কথাকে সত্য প্রমাণ করেছে। একটা প্রচণ্ড চাপের ভেতরে ছিল বিএনপি। একসঙ্গে ৩৩ জন নেতা গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রায় সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় রাতে লুকিয়ে থাকতেন। দিনে কাজকর্ম করতেন। আমরা বলি যাকে আত্দগোপন বা আধা আত্দগোপন করা। দেশব্যাপী তাদের প্রতি এ চাপ অব্যাহত ছিল। এর পরও যে ১১ তারিখে এ রকম একটা গণসমাবেশ করা যাবে বা তারা করতে পারবে সেটা ঠিক বোধগম্য হয়নি অনেকের। সে তুলনায় তাদের গণসমাবেশ সফলতা লাভ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সে সময় সবার ধারণা ছিল, এত নেতা গ্রেফতারের পর যেহেতু এখন পর্যন্ত তাদের মুক্তির আলামত দেখা যাচ্ছে না, তাই বেগম জিয়া কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন, এককথায় বলা যায়, তা ঠাণ্ডা মেজাজের এবং পরিমিত মাপের একটি কর্মসূচি। অনেকেই সমালোচনা করেছেন, বিএনপি আসলে আন্দোলন থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। তারা এত চাপ নিতে পারছে না এবং বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য আমি বলতে চাই, বিএনপি এবং তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেশ ধীরে-সুস্থে চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছেন।
আমার বন্ধু এবং সমালোচকদের অনেকে ভ্রু কোঁচকাবেন। ব্যাপার কি! মাহমুদুর রহমান মান্না বেগম জিয়ার প্রশংসা করতে লাগলেন কেন? ডাল মে কুচ কালা আছে না কি? আমি ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত প্রশ্ন_ এ সময়ের আন্দোলনের কর্মসূচি কি হতে পারত। আমাদের দেশে কঠোর কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে হরতাল। অথচ হরতালের বিরুদ্ধে এক ধরনের গণচেতনাই গড়ে উঠেছে বলা যেতে পারে। মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমর্থন করলেও হরতালকে সমর্থন করছে না। সে পরিস্থিতিতে হরতাল নয় অথচ কঠোর কর্মসূচির ধরন কি_ সংকটকালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে এ প্রশ্ন উঠেছিল। আমাদের দেশে যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা মনে করেন হরতাল হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম। এ জন্য এটা বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত ব্যবহার এর কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ আন্দোলনকে তার চূড়ান্ত বা যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মসূচিগুলোর বিন্যাস কেমন হবে, তার ধাপ কিরকম হবে, কিভাবে একধাপ থেকে আরেকটি উন্নত ধাপে সেই কর্মসূচি যাবে। বর্তমান ক্ষেত্রে মাঝখানে রোজার মাস, এর পর ঈদ। অতএব, এ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা যে রক্ষা করা যাবে সেটা বলার কোনো কারণ নেই। অতএব, বিএনপি যদি কর্মসূচি দিত বড়জোর রমজানের আগে একটি বা দুটি হরতাল দিতে পারত। এর পর তাদের আবার রোজার মধ্যেই যেতে হতো। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়া হরতাল পরিহার করেছেন এবং সমাবেশ-বিক্ষোভের ভেতরে তার কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আন্দোলনের আবহ বা মেজাজ ধরে রাখার জন্য তিনি খুব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে রোজার পর। এখানে বিএনপি বা বেগম জিয়াকে বোঝার ব্যাপার।
কিন্তু এর আগে আমি একটি কথা বলতে চাই_ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বা জোট হিসেবে ১৪ দল বা পরবর্তীতে মহাজোট আন্দোলন করে আসছিল, তখন মহাজোটের খুব শক্তিশালী লাগাতার কঠোর কর্মসূচি সত্ত্বেও বিএনপি বা চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল। পাঁচ বছরের টার্ম পূর্ণ করার পর তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল ইয়াজউদ্দিনের হাতে। এত বড় জোটের আন্দোলন তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারেনি। আমাদের এ এলাকায় সফল গণঅভ্যুত্থানের একটি মাত্র নজির, সেটি হচ্ছে '৬৯, যাতে আইয়ুবশাহী শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সেই আন্দোলনের পর আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে যে চলে গেছেন সেটা ঠিক উৎখাত করা বলা যায় কি? গণঅভ্যুত্থান পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি কিন্তু উভয় (পূর্ব-পশ্চিম) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও। '৬৯-পূর্ব পাকিস্তানে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেরকম কিছু পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি সেখানে এমন কোনো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক চাপ তৈরি হয়নি যে, আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতেই হতো। আমি বলতে চাচ্ছি, ওর চেয়ে অনেক বড় আন্দোলন বেগম জিয়ার আমলে মহাজোট করেছিল কিন্তু বেগম জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনকালকে একদিনের জন্যও কমিয়ে আনতে পারেনি। তার মানে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে সে জায়গায় কোনো বৈপ্লবিক সরকার বা জাতীয় সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনের ইতিহাস বা উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নেই।
বেগম জিয়ার যে আন্দোলন, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবেন তিনি। তিনি কি টার্গেট করছেন? যদিও বক্তৃতায় আমরা মাঝে মাঝে শুনছি সরকার পতনের আন্দোলন, কিন্তু সরকার যদি পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে কি তা থেকে তারা সরিয়ে দিতে পারবেন? পতন ঘটাতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই নির্বাচন দেবেন। আর এখন তিনি এক ধরনের বলা যেতে পারে যে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলছেন। পর্যবেক্ষকরা বোঝে, এটা যতখানি না তার দলকে প্রস্তুত করার কথা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি করে বোঝানো হচ্ছে, নির্বাচন কিন্তু আসছে। নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া আন্দোলন করে এ সরকারের পতন ঘটাবেন বা উৎখাত করে ফেলতে পারবেন_ এ রকম বিশ্বাস হয়তো তারা করেন না। আমার মনে হয়, বিএনপি সেরকম কোনো লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করছে না। তারা বলছে বটে। কিন্তু তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা এবং তার অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করা। বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসে বলছে অন্তর্বর্তী বা যে নামেই ডাকা হোক তা যেন দলীয় সরকার না হয়।
গত সাড়ে তিন বছরে স্থানীয় সরকারসহ জাতীয় সংসদের একটি দুটি উপনির্বাচনে জিতে বেগম জিয়া বা বিএনপির সম্ভবত এ ধারণা জন্মেছে যে, মোটামুটিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তার দল ক্ষমতায় যেতে পারবে। তা ছাড়া গত সাড়ে তিন বছরের শাসনে মহাজোট সরকার যে অনেক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, অনেক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গতবারের ২৩৩ আসনের তুলনায় এবার তার দল ১৭৫ আসনে জিতবে। প্রথম আলোর সোহরাব হাসান লিখেছেন সাড়ে তিন বছরে যদি এ অবস্থা হয় তবে বাকি দেড় বছরে আসন সংখ্যা ৭৫ হয়ে যাওয়া অসম্ভব কি? অতএব সবকিছু দেখেশুনে বিএনপি এমন কিছু করতে চাচ্ছে না, যাতে সেই নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে বা সুদূরপরাহত হতে পারে। আমি খুব দূরবর্তী হলেও এটা ইঙ্গিত করতে চাচ্ছি, যদি উভয় দল অনড়-অটল-অচল থেকে কেবল লড়াই করতে থাকে, তাহলে তার মধ্য থেকে যে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের, অভ্যুদয়ের এমনকি ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। সম্ভবত বিএনপি বা বেগম জিয়া সেরকম কোনো পরিস্থিতির জন্ম দিতে চান না। তারা মনে করছেন, সরকার এ ব্যাপারে যদি দায়িত্বশীল আচরণ নাও করে, তাদের সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। আমি বলছি না সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। আমি শুধু বলছি, একপক্ষীয়ভাবে হলেও বিএনপি এ রকম একটি কৌশল নিয়েছে। সেই কৌশল নেওয়ার পশ্চাতে এমনও হতে পারে, আসলে তারা সাংগঠনিকভাবে অত দৃঢ় নন, অত লড়াকু নন যে, কৌশল নেবে মারব অথবা মরব সরকারকে ফেলব অথবা পড়ে যাব। এ রকম কোনো কিছু ভাবছেন না। তারা মনে করছেন, গণতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচন আদায় করাই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাহলে তারা জিততে পারবেন। আমি বলব, সেই বিবেচনা থেকে বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন তার কিছু এদিক-ওদিক পার্থক্য হতে পারত কিন্তু দৃশ্যমান অনুভব করা এ রকম কোনো কঠোর কর্মসূচির মধ্যে তিনি যেতে পারতেন না। এ কৌশল কি তাদের ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারবে? সে কথা পরের একটি সংখ্যায়- ।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
বেগম জিয়া এবং বিএনপি বেশ ধীরগতিতে এগুচ্ছে এ কথা তাদের ১১ জুনের গণসমাবেশ দেখে বোঝা যায়। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমত আমি বলব, এ লেখা আমি যেদিন লিখছি সে সময়ের ভেতরে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেক নেতা মুক্তি পেয়েছেন। যদিও এটা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করি না। যারা মুক্তি পেয়েছেন তাদের অন্যতম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিকে ভাঙা যাবে না। গ্রেফতার-নির্যাতন দলকে আরও সংগঠিত করেছে। বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে। বিএনপি এখন আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কথার মধ্যে খানিকটা বিশ্বাস আনা যায় এ বিবেচনা থেকে যে, ১১ তারিখের গণসমাবেশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সেই কথাকে সত্য প্রমাণ করেছে। একটা প্রচণ্ড চাপের ভেতরে ছিল বিএনপি। একসঙ্গে ৩৩ জন নেতা গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রায় সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় রাতে লুকিয়ে থাকতেন। দিনে কাজকর্ম করতেন। আমরা বলি যাকে আত্দগোপন বা আধা আত্দগোপন করা। দেশব্যাপী তাদের প্রতি এ চাপ অব্যাহত ছিল। এর পরও যে ১১ তারিখে এ রকম একটা গণসমাবেশ করা যাবে বা তারা করতে পারবে সেটা ঠিক বোধগম্য হয়নি অনেকের। সে তুলনায় তাদের গণসমাবেশ সফলতা লাভ করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সে সময় সবার ধারণা ছিল, এত নেতা গ্রেফতারের পর যেহেতু এখন পর্যন্ত তাদের মুক্তির আলামত দেখা যাচ্ছে না, তাই বেগম জিয়া কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন, এককথায় বলা যায়, তা ঠাণ্ডা মেজাজের এবং পরিমিত মাপের একটি কর্মসূচি। অনেকেই সমালোচনা করেছেন, বিএনপি আসলে আন্দোলন থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। তারা এত চাপ নিতে পারছে না এবং বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য আমি বলতে চাই, বিএনপি এবং তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেশ ধীরে-সুস্থে চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছেন।
আমার বন্ধু এবং সমালোচকদের অনেকে ভ্রু কোঁচকাবেন। ব্যাপার কি! মাহমুদুর রহমান মান্না বেগম জিয়ার প্রশংসা করতে লাগলেন কেন? ডাল মে কুচ কালা আছে না কি? আমি ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত প্রশ্ন_ এ সময়ের আন্দোলনের কর্মসূচি কি হতে পারত। আমাদের দেশে কঠোর কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে হরতাল। অথচ হরতালের বিরুদ্ধে এক ধরনের গণচেতনাই গড়ে উঠেছে বলা যেতে পারে। মানুষ বিরোধী দলের আন্দোলনকে সমর্থন করলেও হরতালকে সমর্থন করছে না। সে পরিস্থিতিতে হরতাল নয় অথচ কঠোর কর্মসূচির ধরন কি_ সংকটকালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে এ প্রশ্ন উঠেছিল। আমাদের দেশে যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা মনে করেন হরতাল হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম। এ জন্য এটা বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত ব্যবহার এর কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ আন্দোলনকে তার চূড়ান্ত বা যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মসূচিগুলোর বিন্যাস কেমন হবে, তার ধাপ কিরকম হবে, কিভাবে একধাপ থেকে আরেকটি উন্নত ধাপে সেই কর্মসূচি যাবে। বর্তমান ক্ষেত্রে মাঝখানে রোজার মাস, এর পর ঈদ। অতএব, এ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা যে রক্ষা করা যাবে সেটা বলার কোনো কারণ নেই। অতএব, বিএনপি যদি কর্মসূচি দিত বড়জোর রমজানের আগে একটি বা দুটি হরতাল দিতে পারত। এর পর তাদের আবার রোজার মধ্যেই যেতে হতো। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়া হরতাল পরিহার করেছেন এবং সমাবেশ-বিক্ষোভের ভেতরে তার কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আন্দোলনের আবহ বা মেজাজ ধরে রাখার জন্য তিনি খুব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে রোজার পর। এখানে বিএনপি বা বেগম জিয়াকে বোঝার ব্যাপার।
কিন্তু এর আগে আমি একটি কথা বলতে চাই_ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বা জোট হিসেবে ১৪ দল বা পরবর্তীতে মহাজোট আন্দোলন করে আসছিল, তখন মহাজোটের খুব শক্তিশালী লাগাতার কঠোর কর্মসূচি সত্ত্বেও বিএনপি বা চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল। পাঁচ বছরের টার্ম পূর্ণ করার পর তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল ইয়াজউদ্দিনের হাতে। এত বড় জোটের আন্দোলন তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারেনি। আমাদের এ এলাকায় সফল গণঅভ্যুত্থানের একটি মাত্র নজির, সেটি হচ্ছে '৬৯, যাতে আইয়ুবশাহী শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সেই আন্দোলনের পর আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে যে চলে গেছেন সেটা ঠিক উৎখাত করা বলা যায় কি? গণঅভ্যুত্থান পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি কিন্তু উভয় (পূর্ব-পশ্চিম) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও। '৬৯-পূর্ব পাকিস্তানে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেরকম কিছু পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি সেখানে এমন কোনো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক চাপ তৈরি হয়নি যে, আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করতেই হতো। আমি বলতে চাচ্ছি, ওর চেয়ে অনেক বড় আন্দোলন বেগম জিয়ার আমলে মহাজোট করেছিল কিন্তু বেগম জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনকালকে একদিনের জন্যও কমিয়ে আনতে পারেনি। তার মানে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে সে জায়গায় কোনো বৈপ্লবিক সরকার বা জাতীয় সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনের ইতিহাস বা উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নেই।
বেগম জিয়ার যে আন্দোলন, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবেন তিনি। তিনি কি টার্গেট করছেন? যদিও বক্তৃতায় আমরা মাঝে মাঝে শুনছি সরকার পতনের আন্দোলন, কিন্তু সরকার যদি পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে কি তা থেকে তারা সরিয়ে দিতে পারবেন? পতন ঘটাতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, তিনি নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই নির্বাচন দেবেন। আর এখন তিনি এক ধরনের বলা যেতে পারে যে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলছেন। পর্যবেক্ষকরা বোঝে, এটা যতখানি না তার দলকে প্রস্তুত করার কথা বলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি করে বোঝানো হচ্ছে, নির্বাচন কিন্তু আসছে। নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া আন্দোলন করে এ সরকারের পতন ঘটাবেন বা উৎখাত করে ফেলতে পারবেন_ এ রকম বিশ্বাস হয়তো তারা করেন না। আমার মনে হয়, বিএনপি সেরকম কোনো লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করছে না। তারা বলছে বটে। কিন্তু তাদের মূল টার্গেট হচ্ছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা এবং তার অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করা। বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে সরে এসে বলছে অন্তর্বর্তী বা যে নামেই ডাকা হোক তা যেন দলীয় সরকার না হয়।
গত সাড়ে তিন বছরে স্থানীয় সরকারসহ জাতীয় সংসদের একটি দুটি উপনির্বাচনে জিতে বেগম জিয়া বা বিএনপির সম্ভবত এ ধারণা জন্মেছে যে, মোটামুটিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তার দল ক্ষমতায় যেতে পারবে। তা ছাড়া গত সাড়ে তিন বছরের শাসনে মহাজোট সরকার যে অনেক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, অনেক জনপ্রিয়তা হারিয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গতবারের ২৩৩ আসনের তুলনায় এবার তার দল ১৭৫ আসনে জিতবে। প্রথম আলোর সোহরাব হাসান লিখেছেন সাড়ে তিন বছরে যদি এ অবস্থা হয় তবে বাকি দেড় বছরে আসন সংখ্যা ৭৫ হয়ে যাওয়া অসম্ভব কি? অতএব সবকিছু দেখেশুনে বিএনপি এমন কিছু করতে চাচ্ছে না, যাতে সেই নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে বা সুদূরপরাহত হতে পারে। আমি খুব দূরবর্তী হলেও এটা ইঙ্গিত করতে চাচ্ছি, যদি উভয় দল অনড়-অটল-অচল থেকে কেবল লড়াই করতে থাকে, তাহলে তার মধ্য থেকে যে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের, অভ্যুদয়ের এমনকি ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। সম্ভবত বিএনপি বা বেগম জিয়া সেরকম কোনো পরিস্থিতির জন্ম দিতে চান না। তারা মনে করছেন, সরকার এ ব্যাপারে যদি দায়িত্বশীল আচরণ নাও করে, তাদের সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। আমি বলছি না সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। আমি শুধু বলছি, একপক্ষীয়ভাবে হলেও বিএনপি এ রকম একটি কৌশল নিয়েছে। সেই কৌশল নেওয়ার পশ্চাতে এমনও হতে পারে, আসলে তারা সাংগঠনিকভাবে অত দৃঢ় নন, অত লড়াকু নন যে, কৌশল নেবে মারব অথবা মরব সরকারকে ফেলব অথবা পড়ে যাব। এ রকম কোনো কিছু ভাবছেন না। তারা মনে করছেন, গণতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচন আদায় করাই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাহলে তারা জিততে পারবেন। আমি বলব, সেই বিবেচনা থেকে বেগম জিয়া যে কর্মসূচি দিয়েছেন তার কিছু এদিক-ওদিক পার্থক্য হতে পারত কিন্তু দৃশ্যমান অনুভব করা এ রকম কোনো কঠোর কর্মসূচির মধ্যে তিনি যেতে পারতেন না। এ কৌশল কি তাদের ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারবে? সে কথা পরের একটি সংখ্যায়- ।
লেখক : রাজনীতিক
ই-মেইল : mrmanna51@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন