বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

বৈরী বাস্তবতায় তিক্ত সংলাপ



॥ সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন ॥

কেউ বংশপরম্পরায় কিংবা ভাগ্যগুণে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন বলে গরিবদের ওপর দোষ চাপানো অন্যয়ভাবে শক্তি প্রদর্শনের শামিল। ‘আমাকে কিছু বলার সাহস কার আছে’ ভাবটা যেন এমনই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। ভূমিহীন, কর্মহীন আর শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে আছে। সমাজে তাদের তেমন গুরুত্ব নেই। বিত্তশালীরা ভালো ব্যবহার করে না। ন্যায়বিচার বা সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষেরা বেঁচে থাকার তাগিদে দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে লিপ্ত। তাই তাদের সম্বন্ধে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে দেশবাসী আঘাত পাওয়া বা অবাক হওয়ারই কথা। ‘গরিবের অপচয়’ দেখলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী আর বিদ্যুৎ অপচয়ের দোষটা চাপল কৃষকের ঘাড়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের কল্যাণে। যারা রাজধানীর মিন্টো রোড, বেইলি রোডের বাসিন্দা অথবা গুলশান-বনানীতে থাকেন, তারা মিতব্যয়ী হিসেবে কি প্রশংসিত? সেই কৃষক-শ্রমিক গরিবের পয়সাতেই বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন তারা। আজকের জাতীয় সংসদে নেতৃবন্দনা আর অশ্লীল বাক্য বিনিময় পর্যন্ত হচ্ছে। সুরুচির পরিবর্তে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেখে সাধারণ মানুষ লজ্জিত। এই তো সেদিন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে কতিপয় এমপি আক্রমণাত্মক ভাষায়, অতি নিম্ন মানের ভঙ্গীতে অপমান করেন। অথচ হতদরিদ্র মানুষ টাকা দেয় এই সংসদ চালাতে। প্রতি মিনিটে ৪২ হাজার টাকা খরচ করে যেখানে এমনি অবস্থা, সেখানে কি ঘোর অপচয় নেই? ১৯৯৯ সালের ২৪ জুন তৎকালীন স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী রুলিং দিয়ে বলেছিলেনÑ ‘এখন থেকে House of the Nation -এ অশালীন ও আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহারকারী এমপিদের বক্তব্য বন্ধ করে দেয়া হবে।’ বর্তমান স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটও (তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার) অসংসদীয় ভাষা পরিহার করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে এসব ছেড়ে দিন।
যে দেশে বিদ্যুতের অভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারে না, জনজীবন দুর্বিষহ লোডশেডিংয়ের কারণে, হাসপাতালগুলোতে ওষুধসহ চিকিৎসাসেবার অভাবে মানুষ মারা যায়, আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করা যায় না প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ নেই বলেÑ সে দেশের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দর অথবা হাজার কোটি টাকার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন করার খায়েশ কতটা দরকারি? আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, তা তো মারাত্মক অপচয়। এমডিজি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে যেখানে নেপালের পক্ষে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত তাদের স্থায়ী প্রতিনিধি যথেষ্ট, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ১০৩ জনের বিরাট প্রতিনিধিদল নিয়ে নিউ ইয়র্কে গমন কোন ধরনের সাশ্রয়? ৭৩ জন সফরসঙ্গী নিয়ে ভারত আর ৮৯ জনের বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে চীন সফর কি রাষ্ট্রীয় খাতের সদ্ব্যবহার?
কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের বাংলাদেশ; যাদের প্রতি মাসে আয় মাত্র দুই হাজার ৪০০ টাকার মতো। এই মানুষেরাই মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার। ইটভাটায় দিনের বেলা কাজ শেষে রাত কাটায় শেকলবাঁধা অবস্থায়, ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারির ঘটনা এটা। ৭ মার্চ, ২০১১ সালে রাজধানী ঢাকার দোয়েল চত্বরের দৃশ্য কী বলে? সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে কাকের সাথে ভাগাভাগি করে। এরা কি অপচয় করছে? গরিব দেশের উচুঁ কর্তারা ল্যান্ড ক্রুজার হাঁকাতে দেখা গেলে, নেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ডিজিটাল পোস্টারে আচ্ছাদিত শহর দেখলে, সোনার নৌকা বা মুকুট উপহার এলে, সর্বোপরি স্বয়ং সরকার যখন ২০০ ভরি ওজনের সোনার তৈরি জাতীয় পুরস্কার দেয় তখন অপচয় তো ঘটেই; বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করিÑ ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী ৫০ হাজার বাংলাদেশী কিশোরী পাকিস্তানের নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের গলায় বিজয়ের মালা পরাবে কে? 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন