ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখি। বাংলাদেশে কী তার বিপুল সাফল্য। উনি অনর্গল বলে যাচ্ছেন। আমরা পাবলিক শুনে যাচ্ছি। ভাগ্য ভাল যখন বিদ্যুৎ থাকে না, তখন তার এইসব সাফল্যগাথা আমরা শুনতে পারি না। তা না হলে সম্ভবত মহাসম্মানিত মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা আরও অনেক মূল্যবান বক্তব্য শুনতে পারতাম। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না বলে আমরা সেইসব অমৃতবচন থেকে এতটাই বিরত থাকি যে, সম্মানিত, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী কি বলছেন, সেটা শুনতে পাই না। আমাদের মনোবেদনা কেউ বুঝতে পারবে না। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বিবি- গোলামের বাকশো বিটিভিতে মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর আদ্যপ্রান্ত দেখা যায়। শুধু তিনি কেন, তার অমাত্যবর্গ, অনুচরবর্গ সবার কৌতুকাভিনয় আমরা অম্লানবদনে দেখি। কিন্তু সেটিও দারুণ মিস্ করি। কেননা যখন ঐ অনুষ্ঠানটি চলে, হুট করে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে এই স্যাবোটাজের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
কে এখন বিটিভির নিজস্ব অনুষ্ঠান দেখে, সেরকম লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। যেখানে ডিস নেই, সেখানে লোকেরা নিশ্চয় বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেন। এখন গ্রামেগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। ফলে হয় অন্যান্য স্যাটেলাইট টেলিভিশন তারা দেখেন, অথবা ভারতীয় হিন্দী সিরিয়াল দেখেন। স্যাটেলাইট টেলিভিশনও সরকারের কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত। তারপরেও ছিটেফোঁটা অনেক কিছু বেরিয়ে পড়ে। সংসদে আইনকানুন যা প্রণয়ন করা হচ্ছে তা রহস্যময়। বিরোধীদলবিহীন সংসদে সরকারের ইচ্ছামতো যেকোনো আইনের বিল উত্থাপিত হওয়া মাত্র তা অনুমোদিত হয়ে যাচ্ছে। তর্ক নেই, বিতর্ক নেই, পূর্বাপর ভাবনা নেই। এতে তার এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে কী প্রভাব পড়বে সেটা সেই মুহূর্তে তারা ভাবেন না। তারা মনে করেন, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মাননীয় মন্ত্রীদের দ্বারা যে প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করছেন, তা নিশ্চয়ই খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, পাস হয়ে যায়।
জাতীয় সংসদের সদস্যরাই অনুমোদন করেছেন যে, সরকারের কোনো গোপন চুক্তি বিষয়ে তাদের জানার দরকার নেই। কিংবা তার নির্বাচনী এলাকার লোকদেরও জানানোর দরকার নেই। সে বিবেচনা থেকেই সরকার বিধান করেছে যে, বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত কোনো চুক্তি এমনকি তা যদি আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্র বিক্রির চুক্তি পর্যন্ত হয়, তাহলেও সেটা তাদের জানার দরকার নেই। কিংবা তার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে জানানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। কখনও কখনও ভাবতে অবাক লাগে এরা জনপ্রতিনিধি। জনপ্রতিনিধি কোনো কোনো লোক আবার তার নিজস্ব এলাকার ভোটারদের লক্ষ্য করে গুলী বর্ষণেও দ্বিধা করেন না। এর ফলে কেউ কেউ যখন জনগণ দ্বারা প্রতিহত হন, তখন আবার নিজের ভোটারদের বিরুদ্ধেই মামলা রজু করতে কসুর করেন না। হাজার হাজার লোক তাদের প্রতিনিধিদের ভয়ে গ্রামশূন্য করে জনান্তিকে চলে যান।
বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। বিদ্যুৎ ছাড়া দেশ অচল। কিন্তু রেন্টাল বিদ্যুতের নামে যখন চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়, তখন জনপ্রতিনিধিরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু কতদিন তাকিয়ে থাকবেন। মন্ত্রীদের বাসায় হয়তো সারা বছরে একদিনও বিদ্যুৎ যায় না। প্রধানমন্ত্রীর বাসায় তো যায়ই না। ফলে বিদ্যুতের কষ্ট কী সেটা ঐ পর্যায়ের লোকেরা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন না। এখন তো এটা ওপেন সিক্রেট যে, বিদ্যুৎ এক ভয়াবহ সংকট। যেসব মহাজোট এমপি এলাকায় যান, তাদের যদি এখনও জনগণের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা থেকে থাকে, তবে তারা উপলব্ধি করেন যে, বিদ্যুৎ কী ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করেছে। জনগণ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, বিশ-চল্লিশ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেলো। বিদ্যুতের দাম বাড়লো। কিন্তু বিদ্যুৎ তো এলো না। এদের মধ্যে কেউ কেউ সংসদে সেই নিষিদ্ধ কথা উচ্চারণও করে ফেলেছেন। এবারের জাতীয় সংসদে মঈন-ফখর-এটিএম শামসুল হুদা-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনার মহাজোট অগণিত আসন পেয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তার দল ১৭৫ আসন পাবে। তাহলে বাকি পঞ্চাশ-পঁচাত্তর আসনে আওয়ামী লীগের যে ভরাডুবি হবে, এটা তিনিও সম্যক উপলব্ধি করেছেন। যেসব এমপি সংসদে বিদ্যুতের অবস্থা বিষয়ে কথা বলেছেন, তারা এখন শঙ্কিত আছেন। হয়তো তারা ভবিষ্যতে আর আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না।
কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের উপায় কী? তারা জনগণের কথা বললে বড় বেশি অপ্রিয় হয়ে যান। সরকার সন্দেহের চোখে দেখে। সবাই তো আর গুলী করতে পারে না। এখন অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে গুলী করা ছাড়া এমপিদের ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই। লোকে ঘিরে ধরে। মারে। কিন্তু মার তারা কেন সহ্য করবে? তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমপি হয়েছেন জনগণের মার খাওয়ার জন্য? বরং তারা জনগণকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। কেন তারা প্রতিবাদ করে? কেন জনগণের জন্য সংসদে তাদের কথা বলতে হয়? আর সে কারণেই তারা মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হবেন? এটা তো হয় না। এ হতে পারে না। ফলে তারাও পিস্তল দিয়ে নিজ ভোটারদের রুখে দাঁড়াচ্ছে। খবরদার। আর এক পা এগুলে মৃত্যু নিশ্চিত। গুলী করে বুকের রক্ত ফুলকি দিয়ে তুলব। প্রধানমন্ত্রীও বলবেন, শাবাশ। এমন নেতাই আমার চাই।
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক জীবনে বারবার এভাবে লাশের জন্য তার কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোথায়ও যদি একটা লাশ পড়ে, তবে সেখানে যেন দশটা লাশ ফেলে দেওয়া হয়। এখন লাশ ফেলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। গত সোমবার বরিশালে এক যুবদল নেতার হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা শেখ হাসিনার কৃপায় ছাড়া পেয়ে মন্ত্রীদের দ্বারা ফুলের মালায় সংবর্ধিত হয়েছে। এখনও প্রতিদিন খুনকে জায়েয করা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে চলছে নরহত্যার উৎসব। অভিযোগ উঠেছে যে, র্যাব-পুলিশ সন্ত্রাসের বাণিজ্য করছে। অর্থাৎ, অকারণে কাউকে গ্রেফতার করা, তারপর সেই পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা, অর্থ না পেলে তাকে খুন করা- এইসব অভিযোগে তারা আক্রান্ত।
এখন পুলিশের আশ্রয় প্রার্থনায়ও ভয় ভয় লাগে। আশ্রয় নিতে গিয়ে কোন বিপদে না পড়ি। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ এক তরুণীকে শত শত মানুষের সামনে ছিনিয়ে থানায় নিয়ে যায়। একটি মোটরসাইকেলে করে তার বাবা, মাও সে আদালতে এসেছিল বিচার প্রার্থনায়। কিন্তু আদালতে ঢোকার আগেই পুলিশ তার জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনল। একথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, সাংবাদিক-উকিলদের শত বাধার মুখেও পুলিশ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে থানা-হাজতে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করবে। তরুণী ও তার মাকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল। তরুণীর মা বলেছেন, ওরা আমাকে কি নির্যাতন করেছে, তা আমি বলতে পারব না। তরুণী বলেছেন, গোঁফওয়ালা এক পুলিশ তার শরীরে স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিয়েছে। তার ঘাড়ে-গালে চুমু খেয়েছে। যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে।
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা তাহলে কোথায় যাবো? যদি বিপদাপন্ন হই, শৈশব থেকে জেনে এসেছি যে, পুলিশের সহায়তা নিবে। আমি আমার সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছি যে, পথেঘাটে কোনো বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে চলে যাবে। এখন পুলিশ বিপদের অাঁকড়। পুলিশ মানেই বিপদ। কিন্তু পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে যে, বিভিন্ন এলাকা, গ্রাম, জনপদে জনগণ নিজেরাই প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছে। রাতভর পালা করে ডাকাত ঠেকাতে পাহারা দিচ্ছে। সেসব এলাকায় ডাকাতেরই রাজত্ব। ডাকাতেরা যদি দেখে যে, পাহারাদারের সংখ্যা তাদের চাইতে কম, তখন তারা পাহারাদারের উপরই আক্রমণ করে বসছে। এগুলো এখন বাংলাদেশে ওপেন জেনারেল লাইসেন্সে (ওজিএল) পরিণত হয়েছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যা খুশি তাই করতে পারবে। পুলিশ যা খুশি তাই করতে পারবে। র্যাব যা খুশি তাই করতে পারবে। এতে যদি কারো মৃত্যুদন্ড হয়ও তাহলে সরকার তাদের মুক্ত করে এনে সার্কিট হাউজে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিবে। ভাবটা যেন এমন যে, জয় বাংলা, খুনিদের জয় হোক।
শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন, তখন বিবিসিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে এমন একটি ঐহিত্যবাহী দলের প্রধান হওয়ায় তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি রাজনীতি ঘৃণা করেন। তাহলে কেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। যার রাজনীতির লক্ষ্য প্রতিশোধ, তার কাছ থেকে সম্ভবত এর চাইতে বেশি কিছু আশা করা যায় না। শেখ হাসিনা এ বিষয়টি কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, তার পিতার হত্যাকান্ডে এদেশে একটি লোকও চোখের পানি ফেলেনি। বরং সম্ভবত তারা খুশি হয়েছিল।
সেটা এদেশের মানুষের কাল হয়েছে। কিন্তু তিনি ইতিহাস বিবেচনায় নিতে চাননি। ইতিহাস বিবেচনায় নিলে তিনি শুধুমাত্র পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনীতি করছেন, এমন কথা কস্মিনকালেও বলতে পারতেন না।
দলীয় বিবেচনা এখনও এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে যে, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিরা লঙ্কাকান্ডও ঘটিয়ে দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘কি যেনো হনু রে' ভাবটা ত্যাগ করা উচিত। সোমবার জাতীয় সংসদে এক রুলিংয়ে তিনি বলেছেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক তার সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব মন্তব্য করার আগে তার বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা এখন এমনই এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার-প্রশাসন-বিচার বিভাগ- সংবাদপত্র সবকিছু আজ বিপন্ন। মনে হচ্ছে, যে গণতন্ত্রের স্বপ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা এখন উধাও। এখন মনে হচ্ছে, গণতন্ত্র? এদেশে সে কি কেবলই সোনার হরিণ? নাকি কেবলই ছবি? এখন গণতন্ত্র কেবলই সরকার সমর্থক পত্রিকায় ও মিডিয়ায় ছবি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু আমরা সাধারণ নাগরিকরা কী বলতে পারি? দূর হ', দুশাসন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন