বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পথ

মো. আবদুল হাই


যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সুশীল সমাজ তথা কবি-লেখক-সাংবাদিক-আইনজীবী-সমাজকর্মী ও পেশাজীবীরা হলেন গণতন্ত্রের নেয়ামক শক্তি এবং প্রেসার গ্রুপ। দলীয় রাজনীতির ডামাডোলে নিষ্পেষিত গণতন্ত্রকে সঠিক পথে চলতে তারাই সহায়তা করতে পারেন। অনেকের আশঙ্কা (জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, জনকণ্ঠ ২৫/০৫/২০১১), বাংলাদেশে দুটি রাজনৈতিক দলের দেশ শাসনের ব্যর্থতায় ত্যক্ত-বিরক্ত জনগণের অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে আমাদের মুরবি্ব দেশগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার কাজে সাহায্য-সহযোগিতার নামে একটি সিভিল ক্যু ঘটাতে পারে। আর এ সিভিল ক্যু ঘটানোর জন্য বাংলাদেশের সিভিল সমাজ এবং তাদের জাঁদরেল কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবীরা উন্মুখ হয়ে আছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান_ আদর্শের বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ দ্বারা নিরসনের কথা যারা ভাবেন তারা হয় সত্যকে অস্বীকার করেন, না হয় সত্য-মিথ্যা ব্যবধান তাদের কাছে গৌণ। বর্তমান আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমস্যা_ কেউ চিরস্থায়ী ক্ষমতায় থাকতে চায় আর কেউ ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায়। তৃতীয় কোনো গণতান্ত্রিক ধারাকে ছাড় দিতে তারা নারাজ।

আমাদের বুঝতে হবে যেমন খুশি তেমন করার নাম গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র ধারণ করলে সংবিধান মানতে হবে। সংবিধান বলছে, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ'। জনগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে, কোনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না_ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে জাতীয় সংসদ। রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের বাহক। গণতন্ত্রের বড় স্টেকহোল্ডার হলো জনগণ। রাজনৈতিক দল ফুটবলের মাঠের প্রতিযোগী দল। খেলতে হবে নিয়ম মেনে, না হয় লাল কার্ড। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যদি খেলার নিয়ম ভঙ্গ করে খেলতে চায় তাহলে এদেশের জনগণ কি তাদের বারবারই ক্ষমা করে যাবে। তাদের আচরণে মনে হয় বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্রের ঠিকা_ এ দুই দল নিয়ে বসে আছে। দ্বিদলীয় রাজনীতি সংসদীয় গণতন্ত্র অনেক দেশেই বিদ্যমান। কিন্তু এমন কোনো গণতন্ত্রী দেশ নেই, যেখানে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে দুটি দলই পরিচালিত হচ্ছে একক ব্যক্তিত্বের কর্তৃত্বে। সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হলে স্বৈরাচার বলে গালি দেওয়া হয়। আর ব্যক্তিশাসন দীর্ঘায়িত হলে তাকে বলা হয় স্বেচ্ছাচারিতা। জনগণের কাছে স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচার দুটোই সমান। দুটোর বিরুদ্ধেই জনগণ ফুঁসে উঠে। আমাদের দেশে বারবারই জনগণ ফুঁসে উঠেছে। কিন্তু সমাধান পাচ্ছে না একক কর্তৃত্বে পরিচালিত দুটো দলের কারণে। এরকম অবস্থায় যেখানে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব, শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া হয় (ব. দ. চৌধুরীর কথা মনে করুন) সেখানে দেশের সচেতন সমাজ_ বুদ্ধিজীবীরাই কেবল পারেন এর সমাধান দিতে। দুটি দল তাদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য যেভাবে জনগণকে নিয়ে খেলছে, তার প্রতিকার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানো সুশীল সমাজ। আর্মি-সিভিল-ব্যুরোক্রেসি-সংবাদমাধ্যম-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সর্বোপরি প্রগতিশীল শক্তি_ যারা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে উদ্দাম নৃত্য করে না। কিন্তু রাজনীতির গুণগতমান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের অবশ্যই গণ্য করতে হবে। জনগণের ভোট কিভাবে আদায় করা হয়, এটা সবারই জানা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, নির্বাচন করতে দেব না_ অন্য দলের দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এটা কি গণতন্ত্রের ভাষা, না জনগণের সমস্যা সমাধানের কোনো মন্ত্র? এটা তো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচনে জেতার হীন প্রচেষ্টা। সুতরাং নির্বাচনে সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে_ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেলে দেশ ও জাতির সংকট মুহূর্তে কথা বলা যাবে না এমন তো নয়। যে কোনো দেশে দেশের সুশীল সমাজই রাজনীতির প্রেসার গ্রুপ। এরাই দলীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ যেখানে গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা। জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত দেশটিকে উন্নয়নের ধারায় রাখার জন্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত নগরায়ন যেখানে সময়ের দাবি সেখানে দুটি প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে মারামারি হানাহানি সৃষ্টি করছে, হরতাল জ্বালাও-পোড়াও ভাঙচুরের নামে দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে। সেখানে সুশীল সমাজ অবশ্যই দুই দলের সমালোচনায় মুখর থাকবে। এটাকে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রচলিত মাইনাস টু থিউরি বা সংস্কারপন্থি বলে নাক ছিটকানোর কোনো কারণ নেই।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন_ কুমিল্লা সিটি নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জনগণের ক্ষমতা আইন করে কেড়ে না নিলে নির্বাচনে জনগণ ঠিকই রায় দেয়। দল সেখানে গৌণ। জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া অনুসৃত হলে জাতীয় নির্বাচনেও যোগ্য, দক্ষ, সৎ প্রার্থীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে দলবাজি, নমিনেশন বাণিজ্য, অাঁতাত, পাতানো নির্বাচন_ এসবের খেলা চলে নির্বাচনী আইনের ছত্রছায়ায়। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনকে দলীয়, আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে নির্দলীয় অ্যাখ্যা দিয়ে জাতীয় নির্বাচনকে দলীয় মাস্তানির এক চরম আখড়ায় পরিণত করেছে। নির্বাচনের কোনো প্রকারভেদ সংবিধানে অনুপস্থিত। সংবিধানের ৬৬ ধারা অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আরপিওর মাধ্যমে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। প্রার্থী যে দলেরই হোক নির্বাচন কমিশনের কাছে সবাই সমান। কেউ স্বতন্ত্র, কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি বা অন্য দলীয় পরিচয় থাকার কোনো সুযোগ সংবিধান 'এলাও' করে না। বর্তমান সমস্যা হলো নির্বাচন কমিশনকে আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করছে দুটি রাজনৈতিক দল। এ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তা হবে '৭২-এর সংবিধানে যেভাবে আছে সে অনুযায়ী। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে তিন মাস আগে। রাষ্ট্রপতির অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে তিন মাস দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এখানে প্রয়োজনে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল থেকেও মন্ত্রী নেওয়ার ব্যবস্থা বর্তমান সংবিধানেই করা যায়। এ ব্যবস্থা করার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংলাপ যারা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন তাদের সঙ্গে একমত হওয়া কষ্টকর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতাভোগী, ক্ষমতাপ্রার্থী, ক্ষমতালোভী দুটি রাজনৈতিক দল। এদের মুখ্য উদ্দেশ্য ক্ষমতার লড়াই দুই দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। তৃতীয় কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব দুই দলই প্রতিহত করেছে, প্রতিহত করছে এবং ভবিষ্যতেও প্রতিহত করবে যার যার অবস্থান থেকে। নির্বাচনের আগে জনগণকে অস্থির করে তুলবে 'জনগণের ক্ষমতায়ন অথবা দুর্নীতির মূল উৎপাটন অথবা গণতন্ত্র রক্ষার নামে তাদের নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী দুই দলের মধ্যে মারামারি-হানাহানি সৃষ্টি করে। প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল জলিলের মধ্যকার সংলাপের কথা নিশ্চয়ই জাতি ভুলে যায়নি। আমাদের দরকার অবাধ নির্বাচন, সংবিধান নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে সংবিধানের ক্ষমতাবলে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমঝোতা অনুযায়ী নয়। জাতীয় সংসদ যদি মনে করে নির্বাচনী আইনে কোথাও সংশোধনী প্রয়োজন বা বিয়োজন প্রয়োজন, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখার স্বার্থে জাতীয় সংসদ তা করতেই পারে। জাতীয় সংসদে সরকারি দল বা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তাদের কোনো প্রস্তাব থাকলে তুলে ধরতে পারে। জাতীয় সংসদের বাইরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা যে কোনো দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে যে কোনো রকম আইনি সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন জাতীয় সংসদে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে। দলীয় স্বার্থের ঊধের্্ব ওঠে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের খোলা মন নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব নাকচ করে দিলে কিংবা একপেশে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিলে জনগণ এর সমুচিত জবাব নির্বাচনকালেই দেবে।

'৭২-এর সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যকাল, জাতীয় সংসদের মেয়াদ, নির্বাচন অনুষ্ঠান_ সবকিছু নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী তিন মাসের মধ্যে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি তাও করতে পারেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো জাতীয় সংসদে আস্থাভাজন সংসদ সদস্যকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে সমঝোতা হলে রাষ্ট্রপতি তাও করতে পারেন। তবে মনে হয় না এর কোনো প্রয়োজন আছে। শুধু আইন করে নিশ্চিত করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। প্রশাসন ব্যবস্থা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে। বর্তমান আইনি ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা সবার কর্তব্য_ এ রকম ভদ্র ভাষায় আমাদের যেহেতু চলছে না সেহেতু ভাষা সুনির্দিষ্ট করে আইন করে নিতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন নির্বাচনকালীন প্রশাসন থাকবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এর আইনি রূপ দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বর্তমান সরকারপ্রধান বারবারই বলছেন, এত এত নির্বাচন যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ রকম বক্তব্য না দেওয়াই ভালো। করেননি বলে ভবিষ্যতে যে করবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়। কারও দয়ার ওপর অথবা 'সুইট উইল'-এর ওপর আস্থা রাখার অবস্থা বর্তমান দুই দল সৃষ্টি করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার আর বর্তমান সরকার এক হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার চরিত্রে সম্পূর্ণ নির্দলীয়। কাজেও তার প্রমাণ থাকতে হবে। আমাদের যেহেতু অভ্যাস খারাপ আইন করে তা বলে দিতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন