শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

সাড়ে ৩ বছরে সাড়ে ৩ টাকার বিদ্যুৎ পৌনে ১৩ টাকা : সাবাস আওয়ামী লীগ!


 আসিফ আরসালান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছেন যে, বাংলাদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে কম। তিনি সঠিক না বেঠিক সেটি আজকের আলোচনার প্রধান উপজীব্য নয়। তার এই উক্তি সঠিক না বেঠিক সেটি জানা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কারণ ইন্টারনেটের এই যুগে আপনি যদি বিভিন্ন ওয়েব সাইট ঘাঁটাঘাটি করেন তাহলে যে কোনো তথ্য মুহূর্তের মধ্যে আপনার নখ দর্পনে এসে যায়। কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় আমাদের রেট কম কি বেশি সেটি এখানে মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, তাঁর সরকারের আমলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যতগুণ বেড়েছে সেই অনুপাতে জনগণের আয় বৃদ্ধি হয়েছে কি না। প্রথমে স্পষ্ট বলতে চাই যে, যে হারে বা অনুপাতে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে জনগণের আয় বা ইনকাম সেই অনুপাতে তো দূরের কথা, তার অর্ধেকও বাড়েনি। আমার এই বক্তব্য কিছুক্ষণ পর আমি পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করব। তার আগে বলে রাখছি যে, আজকের এই লেখা আমি খুব সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করব। এমন সহজ ভাষা, যেন ক্লাশ এইট নাইন পাশ করা একজন মানুষও বুঝতে পারেন। আরেকটি কথা বলা দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ একটি হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। এখানে অনেক টেকনিক্যাল পরিভাষা আছে। আমি সেগুলি পরিহারের চেষ্টা করব। আমার মূল কথা হলো, আমরা দৈনন্দিন কতখানি বিদ্যুৎ পাচ্ছি এবং সেটা কি দামে পাচ্ছি।
কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তার সরকার নাকি সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তখন আমি একটি লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম যে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যদি উৎপাদিত হয়ে থাকে তাহলে সেই বিদ্যুৎ গেলো কোথায়? সেই মার্চ মাস  থেকে এই জুন মাস পর্যন্ত ভয়াবহ গরমে যে ভয়াবহ লোডশেডিং হলো সেটি আমার মতো আপনারাও, অর্থাৎ পাঠক পাঠিকা ভাই বোনেরাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। আমার এই বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় এতো লোডশেডিং আর দেখিনি। কাজেই কি হবে আমার বা আপনার ঐসব মেগাওয়াট বা কিলোওয়াটের হিসাব রেখে? আমার আপনার যেটি দরকার সেটি হলো বিরতিহীন বিদ্যুৎ এবং সেই বিদ্যুতটিই আমি পেতে চাই আমার সাধ্যের মধ্যে। অর্থাৎ আমার যে ইনকাম সেই ইনকাম দিয়ে আমি বিদ্যুৎ পেতে চাই। সরকার যদি বিদ্যুতের দাম ৫ গুণ বাড়ায় এবং বলে যে এই দামে তুমি বিদ্যুৎ নাও, তাহলে সেই বিদ্যুতের সুবিধা আমি আপনি কি এ্যাফোর্ড করতে পারি? সোজা কথা হলো, সরকার যে জিনিসটি আমাদেরকে দেবে সেটি যেন এ্যাফোর্ড্যাবল প্রাইসে দেয়া হয়। অর্থাৎ সেটি যেন আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। সুতরাং সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো এই যে, কথায় কথায় বিদেশের বিভিন্ন পণ্যের মূল্যের সাথে বাংলাদেশের সেই পণ্যমূল্যের তুলনা করবেন কেন?
\ দুই \
এখানে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। তাহলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ২০০৮ সালে নিউইয়র্কের এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক এক ডজন মুরগীর ডিম কেনে। দাম পড়ে এক ডলার। এখন তার দাম ২ ডলার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১ ডজন ডিমের দাম ১২০ টাকা। সাধারণ মানুষের বেতন বা আয় মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ২০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে তাকে এক ডজন ডিম কিনতে হয় ১২০ টাকায়। কিন্তু নিউইয়র্কে সেই লোকটির সর্বনিম্ন ইনকাম ২৬০০ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় ২ লাখ  ২০ হাজার টাকা। তো ২৬০০ ডলার ইনকামে ১ ডজন ডিমের জন্য তাকে দিতে হয় মাত্র ২ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে যার ইনকাম ২০ হাজার টাকা তার ১ ডজন ডিম কিনতে ব্যয় হয় তার আয়ের ১৬৬ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু নিউইয়র্কে যার আয় ২৬০০ ডলার তার ১ ডজন ডিম কিনতে ব্যয় হয় তার আয়ের ১৩০০ ভাগের ১ ভাগ। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী বিদেশের সাথে তুলনা করেন কোন্ যুক্তিতে?
এদেশে মোটামুটি মানসম্পন্ন একটি এ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটের দাম কম করে হলেও ৫০ টাকা। কাউকে যদি এক সপ্তাহ এ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয় তাহলেও তার খরচ হবে এক হাজার টাকা। এছাড়া ডাক্তারের ফি গড়ে ৭০০ টাকা। কিন্তু নিউইয়র্কে যিনি মার্কিন নাগরিক (বাংলাদেশী মার্কিন নাগরিক হলেও) তার স্বাস্থ্য সেবা ফ্রী। এমন কি যিনি গ্রীণ কার্ডধারী তার স্বাস্থ্য সেবাও ফ্রী। আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় ভার্জিনিয়া থাকে। এক দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে তার অপারেশন হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় তার চিকিৎসার খরচ পড়েছে ১ কোটি টাকার ওপর। তার নিজ থেকে দিতে হয় ৮ লাখ  টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার। অবশিষ্ট ৯২ লাখ  টাকার ওপর ব্যয় করেছে সরকার। এই ধরনের অনেক সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা রয়েছে বিদেশে। বাংলাদেশ থেকে যারা যায় তারা কেউ বেকার থাকে না। প্রথম দিকে কিছু না জুটলেও দোকান পাটে সেলস ম্যান বা সেলস গার্লের চাকুরি পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এসব জানেন। একমাত্র তিনি ছাড়া তার সকলেই তো বিদেশ আছে। দেশে তো তাঁর কেউ নাই। যারা বিদেশে আছে তাদের কেউবা আমেরিকায়, কেউবা কানাডায়, কেউবা ইংল্যান্ডে অথবা কেউবা ফিনল্যান্ডে। তাই বলছি যে প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ টানেন কেন? বিদেশের উদাহরণ টানতে গেলে তো সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কে আনতে হবে।
\ তিন \
ফিরে আসছি বিদ্যুতের কথায়। ২০০৯ সালের মে মাসে একটি বাসা বাড়ীর ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ মূল্য ছিলো ৩ টাকা ৪২ পয়সা। পরের বছর ২০১০ সালে কিঞ্চিত বৃদ্ধি পেয়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ মূল্য হয় ৩ টাকা ৬১ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১৩ পয়সা। ২০১১ সালে প্রতি ইউনিটের মূল্য হয় ৩ টাকা ৯৩ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি মূল্য বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩২ পয়সা। কিন্তু ২০১২ সালে এই মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ টাকা ৫৩ পয়সা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি মূল্য বৃদ্ধি পায় ৪ টাকা ৬ পয়সা। প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করবেন যে, ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে বিদ্যুতের গৃহস্থালী মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। অথচ ২০১১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১ বছর ২ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। ৩ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে উল্লম্ফন গতিতে ৮ টাকা ৫৩ পয়সায় উন্নীত করেই তারা  ক্ষান্ত হননি। চলতি মাসে অর্থাৎ জুন মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে আরো ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র দেড় বছরে ইউনিট প্রতি মূল্য ৮ টাকা ৫৩ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১২ টাকা ৭৫ পয়সা হতে যাচ্ছে। পাঠক লক্ষ্য করে দেখবেন যে, মাত্র দেড় বছরে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ৮ টাকা ৮২ পয়সা। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে বৃদ্ধি প্রায় ৩০০ শতাংশ। এখানেও তারা ক্ষান্ত হচ্ছেন না। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা বেসরকারি খাতের রেন্টাল প্ল্যান্টের নিকট থেকে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছে ১৪ টাকা ৫০ পয়সায়। এনার্জী রেগুলেটরী কমিশন বলে দিয়েছে যে, কয়েক দিন পর যে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো হবে সেটাই শেষ নয়। পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না সেটি কুইক রেন্টালের সাড়ে ১৪ টাকার সমান  হয়।
রেন্টাল বা কুইক রেন্টালওয়ালারা সরকারের সাথে যোগসাজস করে দুই হাতে টাকা কামাই করছে। তারা দেশটাকে লুটেপুটে খাবে, আর জনগণ নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে ঐ সব শোষকের পকেট ভারী করবে কেন?
\ চার \
কুইক রেন্টালের পক্ষে  সর্ব প্রথম কথা শোনা গেলো জনাব আনিসুল হকের কন্ঠে। ভদ্রলোক বলেছেন যে, দেশে কুইক রেন্টাল না হলে নাকি দেশের অর্থনীতিতে ১০ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হতো। তিনি আরো বলেছেন যে, কুইক রেন্টাল না থাকলে নাকি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম হতো। অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা কম হতো। এমন বিশাল অংকের একটি পরিসংখ্যান এই ভদ্রলোক কোত্থেকে আবিস্কার করলেন? আজ রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল নিয়ে আমি বিশদ আলোচনায় যাবো না। কিন্তু এই ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকার আলোচনায় না গেলে দেশে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তাই এটি নিয়ে দু'টি কথা বলতেই হচ্ছে।
 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, তার আমলে নাকি অতিরিক্ত ৩ হাজার ৩ শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। সাথে সাথে সচেতন মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, ঐ ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গেলো কোথায়? পরে সরকার বলল যে, তারা নাকি নতুন সংযোগ দিয়েছে ২১ লাখ । আর সেই সংযোগ দিতে গিয়েই নাকি এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টিকারী বিদ্যুৎ কোত্থেকে এলো? যদি ২১ লাখ  নতুন সংযোগের কথা সত্যি হয় তাহলে ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকা জিডিপিতে সংযুক্ত হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আর যদি ১ লাখ  ২৭ হাজার কোটি টাকা জিডিপিতে যুক্ত হওয়ার দাবি সঠিক হয় তাহলে ২১ লাখ  নতুন সংযোগ দেয়ার দাবিটি বানোয়াট। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো যে, এই ভদ্রলোক একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আগে তিনি বিটিভির অনুষ্ঠানের একজন উপস্থাপক ছিলেন। গার্মেন্টস ব্যবসাতে তিনি সফল হন এবং বিজিএমই-এর প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ‘দেশ এনার্জী' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ৪৮ মেগাওয়াট করে ৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দুইটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স পান। দেশের যে ২৬ ব্যক্তি রেন্টাল প্ল্যান্ট স্থাপন করে শত শত কোটি টাকা কামাই তথা লুন্ঠনের বিরাট  মওকা পেয়েছেন এই ভদ্রলোক সেই ২৬ জন ভাগ্যবানের একজন। সারাদেশ যেখানে কুইক রেন্টালের সর্বনাশা ফলাফলের বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেখানে এই ভদ্রলোকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী হিসাবে নেমক হালালী করার জন্য কুইক রেন্টালের স্বপক্ষে সোচ্চার দালালী করছেন। হতে পারে যে এই দালালীর বিনিময়ে এরা হয়ত আরো কিছু এনাম পাবেন।
জনগণের ২ টাকা মূল্যের বিদ্যুৎকে এই ভদ্রলোকেরা ১২ টাকায় উন্নীত করেছেন। এখন এদের পৌষমাস আর জনগণের সর্বনাশ।
Email: asifarsalan15@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন