ড. মু হ. আ মি নু ল ই স লা ম আ ক ন্দ
২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কর শনাক্তকরণ নম্বরবিহীন (টিআইএন) ব্যাংক আমানতকারীদের ক্ষেত্রে সুদ-আয়ের ওপর করহার শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সরকারের উদ্দেশ্য একদিকে যেমন বেশি রাজস্ব আহরণ, অন্যদিকে নতুন করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ। এই কর বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকে সঞ্চয়কারীরা যদি টিআইএন সংগ্রহ করেন এবং সে অনুযায়ী নিয়মিত কর প্রদান অব্যাহত রাখেন, তাহলে তা বর্তমান করদাতাদের জন্য করভার বণ্টিত হওয়ার সুখবরটি বয়ে আনতে পারে। তবে তা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ওপর কিরূপ প্রভাব বয়ে আনবে, তা-ই মূল বিবেচ্য। সরকারের এ সিদ্ধান্ত যদি বিগত কিছু সিদ্ধান্তের মতো সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে নির“ৎসাহিত করতেই থাকে, তাহলে তা সুদূর ঋণাÍক প্রভাব বয়ে আনবে।
এ আলোচনার প্রাক্কালে গত কয়েক বছরের সরকারি নীতির প্রভাব বিশ্লেষণ প্রয়োজন। গত বছর পর্যন্ত সরকারের পরিকল্পনা ছিল সুদহার এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনা, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কম সুদে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এটা করার জন্য একটি প্রচেষ্টা ছিল, ব্যাংক সুদের মার্জিন শতকরা পাঁচ ভাগে কমিয়ে আনা। তবে ব্যাংক মার্জিন, যা ব্যাংকের প্রদেয় ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ ও গৃহীত আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের ব্যবধান, কখনও ছয় ভাগের বেশি ছিল না। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা ছিল সঞ্চয়ের ওপর সুদহার হ্রাস। এজন্য সরকারকে ব্যাংক আমানতকারী ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হ্রাস করতে হয়েছে। এটা করতে সরকারকে খুব একটা ভাবতে হয়নি। কারণ ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়ের উদ্বৃত্ত প্রায় তিন থেকে ছয় ভাগে উন্নীত হয়েছিল। অন্য পদক্ষেপের মধ্যে ছিল ২০০৯ সালের এপ্রিলে কতিপয় ঋণের ওপর সর্বো”চ সুদহার ১৬ থেকে কমিয়ে ১৩ ভাগে নির্ধারণ, ২০১০ সালের জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের ওপর এক দশমিক পাঁচ ভাগ পর্যন্ত সুদ হ্রাস ও সুদহার হ্রাসের বিষয়ে মুদ্রানীতির টুলসগুলোকে পরিচালিত করা। ফলে বিগত পাঁচ বছরে ঋণদানের গড় সুদহার ১৩ থেকে কমে ২০১১ সালের প্রথম দিকে ১১ দশমিক ২৭ ভাগে নেমে এসেছিল। কিš‘ প্রশ্ন হলÑ সঞ্চয়কারীদের এভাবে কম সুদ দিয়েই কি বিনিয়োগের মাত্রা বেড়েছিল?
সুদহার হ্রাসের প্রক্রিয়াটি অর্থনীতিকে ঋণাÍকভাবে প্রভাবিত করেছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, প্রত্যেক কাজের কিছু অননুমেয় ফলাফল থাকে যা কর্র্মপরিকল্পনার সময় নির্ধারিত থাকে না। ব্যাংক সুদের ওপর দৃশ্যমান হস্তক্ষেপে সুদের হার হয়তো কমেছিল কিš‘ অর্থ ব্যাংকে না থেকে গিয়েছিল শেয়ারবাজারে, এমএলএম ব্যবসায় এবং জমি কেনার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে। অন্যদিকে টাকা ব্যাংকে না রেখে যখন মানুষের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছিল, তা তো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে সরকার বাজার থেকে নগদ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সহজ কৌশল হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নগদ বাধ্যতামূলক জমার হার বা সিআরআর বৃদ্ধি করেছিল। তার পরিণতি যে এতটা খারাপের দিকে যাবে, তা কি সরকার চিন্তা করেছিল? দ্রব্যমূল্য না কমে, কমেছিল শেয়ারের দাম এবং পরিশেষে ধস। আবার উ”চ আয়ের এমএলএম ব্যবসার এতই প্রসার ঘটেছিল যে, তা নিয়ে সরকারকে নতুন করে হিসাব করতে হ”েছ। আর জমি খাতে বিনিয়োগ তো দাম বৃদ্ধি করে এর কেনাবেচাকে একটি ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছে। সরকারের সহজ নীতিগুলো যে ভ্রান্ত হয়েছিল তা হিসাবে ছিল না।
এত কিছু ঘটার পর সরকার ২০১২ সালের প্রথম দিকে আগের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত যে নীতি গ্রহণ করে তা হল বাজারভিত্তিক সুদ নির্ধারণ। কিš‘ আজ পর্যন্ত পরিবর্তন সঞ্চয়কারীদের যে ব্যাংকবিমুখ করেছিল সেজন্য বাজারমূল্যে সুদ নির্ধারণের পর ব্যাংকগুলোকে বেশি মাত্রায় সুদ প্রদান করতে হ”েছ এবং ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও অতি উ”চমাত্রার সুদ পরিলক্ষিত হ”েছ। সরকার যেখানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে দিয়েছিল, সেখানে সুদহার বৃদ্ধি করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার প্রচার চালা”েছ। সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রির ধনাÍক প্রবৃদ্ধি ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল ৬০ ভাগ, তা ২০১০-১১ অর্থবছরে কমে আসে ঋণাÍক ৩৩ ভাগে এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে যা ঋণাÍকই রয়েছে। ফলাফলে যা দাঁড়িয়েছে তা হল, ঋণ প্রদানে ব্যাংক সুদের গড়হার ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের এপ্রিলের মধ্যে শতকরা ১১ দশমিক ৩৪ থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ৭২ ভাগে পৌঁছেছে। যদিও সঞ্চয় ও ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি তুলনা করলে দেখা যায়, সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। ২০০৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৯৪ এবং সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ দশমিক ৫১ ভাগ। আর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ২৬ ভাগ যা ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৯ দশমিক ৯২ ভাগের চেয়ে কম। এ অব¯’ায় সঞ্চয় প্রবৃদ্ধির অর্জন সরকারি নীতিমালায় প্রাধান্য পাওয়াটা স্বাভাবিক।
কিš‘ বর্তমান সুদ-আয়ের ওপর প্রস্তাবিত উ”চ করহার সঞ্চয়কে নির“ৎসাহিত করতে পারে। সরকার মনে করেছে, সুদ-আয়ের ওপর করহার বৃদ্ধি করা হলে তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকে টিআইএন গ্রহণে প্রণোদিত হবে। তবে আমানতকারীরা টিআইএন গ্রহণ করবেন নাকি ব্যাংকে সঞ্চয়ই করবেন না, তা বিবেচনার বিষয়। মনে হতে পারে, যেহেতু ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের এপ্রিলের মধ্যে ব্যাংক প্রদেয় গড় সুদের হার ৬ দশমিক ৩৯ থেকে ৮ দশমিক ১৭ ভাগে বেড়ে গেছে, তাই হয়তো আমানতকারীরা অনুৎসাহিত নাও হতে পারেন। কিš‘ যেখানে মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে, তাতে সঞ্চয়কারীরাই বা কতটুকু প্রকৃত সুদ পা”েছন। আর যদি ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী, যাদের আয় করসীমার নিচে তাদের কথা চিন্তা করা হয়, তাদের তো উ”চমাত্রায় কর প্রদান করতে হবে। এ অব¯’ায় অতিরিক্ত করের বোঝা সঞ্চয়কারীদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। এতে ব্যাংকে সঞ্চয় যেমন কমতে পারে, উৎপাদনশীল বিনিয়োগও সেভাবে কমবে, যা অর্থনীতির জন্য শুভ হবে না।
আর দ্বিতীয় যে কৌশলটি সরকার গ্রহণ করতে পারে তা হল, টিআইএনধারীদের কর রেয়াত দেয়া। করদাতাকে যদি অন্তত দুই ভাগ কর রেয়াত দেয়া হয় তবে তা তাদের সš‘ষ্টকরণে বেশি সহায়তা করবে। টিআইএন সংগ্রহপূর্বক কম হারে কর পরিশোধ করাতে করদাতার কাছে কম করভার অনুভূত হবে, যা প্রণোদনার মূলনীতির সঙ্গে বেশি সামঞ্জ্যপূর্ণ। করদাতার কর প্রদানে তুলনামূলক স্বস্তি কর-ব্যব¯’া আপাত সহজ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রকাশে অবদান রাখবে। এতে সরকার হয়তো কিছু রাজস্ব কম পাবে, তবে তা সঞ্চয়কে উৎসাহিত করবে। আর সরকার যদি আপাত সহজ উপায়ে বেশি কর পেতে চায় তাহলে স্বল্পমেয়াদে সুদ-আয় থেকে বেশি কর পেলেও দীর্ঘমেয়াদে কর আদায় যে বেশি হবে তার নিশ্চয়তা কী?
বিগত কয়েক বছরে একটি আলোচিত বিষয় হল, তিন দশমিক চার মিলিয়ন কর শনাক্তকৃত ব্যক্তির মধ্যে এক মিলিয়নেরও কম লোক কর প্রদান করেন। এখন ব্যাংক আমানতের ওপর হস্তক্ষেপ করে বেশি করদাতা শনাক্ত করলেই যে করদাতার সংখ্যা দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধি পাবে তার নিশ্চয়তা কী? বিগত বছরগুলোতে যেসব টিআইএনধারী কর প্রদান করেননি তাদের ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ড কি উপযুক্ত ব্যব¯’া গ্রহণ করেছে? উত্তরটা তো অবশ্যই ‘না’। আর যেখানে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়াটি নিয়মিত, সেখানে কালো টাকার মালিকদের করের আওতায় না নিয়ে বরং ব্যাংকে করজালে আবদ্ধ আমানতকারীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ কতটা যুক্তিযুক্ত। এ অব¯’ায়, এত সহজভাবে সুদ-আয় থেকে কর আদায় বৃদ্ধির কৌশলটি প্রয়োগ না করে বরং সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপগুলোই আপাত সুবিবেচিত বলে মনে হয়। এত নতুন কিছু না করে যে বিষয়টি দরকার তা হল, আমাদের কর-ব্যব¯’াকে শক্তিশালী করা।
ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
ধশধহফধথধর@যড়ঃসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন