ম ন জু র আ হ ম দ
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকেও আখ্যায়িত হতে হলো রাষ্ট্রদ্রোহী অভিধায়। তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সাধারণ পর্যায়ের কোনো নাগরিক কিংবা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নয়, এ অভিযোগ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন মাননীয় বিচারপতির। তিনি দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের একটি সংসদীয় কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে এ কার্যক্রমকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’ বলে মন্তব্য করেছেন। এই বিচারপতি হলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছরে তার দেয়া বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম চাঞ্চল্য কিংবা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে তাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে জবাবদিহি করতে হবে কিনা। প্রথম কাতারের অনেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও বহু আইনজীবী তার সম্পর্কে এই ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তুলেছেন।
তিনি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মাননীয় স্পিকারের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে। রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা তার সমান অপরাধে অপরাধী বলার যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে পুরো জাতীয় সংসদ। সংসদ সদস্যরা একযোগে তার অপসারণ দাবি করেছিলেন। তাকে ইমপিচ করা, এর জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রভৃতির দাবিতেও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তারা। বিচারপতি শামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংসদে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের পক্ষেও মত দিয়েছিলেন তারা। অবশেষে স্পিকার আবদুল হামিদ বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতির হাতে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন সংসদ সদস্যদের। তবে আলোচ্য বিচারপতির মন্তব্যাদি সম্পর্কে তিনি স্পষ্টভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই লেখার সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়নি। অন্যদিকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন করেছিলেন তা আইন মন্ত্রণালয়ে নথিভুক্ত হয়ে রয়েছে। সেটা ওই নথি থেকে মুক্ত হয়ে প্রধান বিচারপতির হাতে পৌঁছায় কিনা তাও লক্ষ্য করছেন দেশের মানুষ।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্যের কারণে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদ একরকম মুখোমুখি অবস্থায় চলে যাচ্ছিল। এতে জনগণ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভের মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগের এই মুখোমুখি অবস্থানে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন দেশের বিদগ্ধ জনরাও। সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে আইনজীবী মহল দুই বিভাগের দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রবীণ ও প্রভাবশালী আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং ড. কামাল হোসেন এ বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিয়েছেন।
তারা তাগিদ দিয়েছেন, তবে একই সঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিচার বিভাগ সম্পর্কে তার অসন্তোষের কথাও প্রকাশ করেছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, গত সাড়ে তিন বছরে বিচার বিভাগকে এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, সেখান থেকে নিরপেক্ষ বিচার আর আশা করা যায় না। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের এই পর্যবেক্ষণ আজকের বিচার বিভাগ সম্পর্কে এক নির্মম বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে সর্বতোভাবে। এই বাস্তবতার এক দৃষ্টান্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ টেনে সিদ্ধান্ত দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে বারবার। রাজনীতির মাঠে-ময়দানের বাইরেও প্রচার মাধ্যমে এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতেও কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাকে আদালতে তলব করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। এদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে তার একটি হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল একটি টকশোতে দেয়া বক্তব্যের কারণে এই বিচারপতির আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আসামি হয়েছেন। তলব পেয়ে তাকে আদালতে সশরীরে হাজির হতে হয়েছে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এজলাসে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা বিচারপতি শামসুদ্দিনের এক বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ নিয়ে তারই আদালতে তার ও ড. কামাল হোসেনের মধ্যে আইনি বিতর্ক হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য এ মাননীয় বিচারপতিকে ‘স্যাডিস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন সংসদে আলোচনার সময়। এ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গেই তিনি রূঢ় আচরণ করেছেন। খবরে পড়েছি, একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এই বিচারপতির আদালতের ডকে চার ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এই বিতর্কিত বিচারপতি সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হয়, সেদিকেই তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে বিচারপতি শামসুদ্দিনের বেঞ্চ বদল করে তার জন্য ভিন্ন বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। জানি না এই নতুন দায়িত্বে তার ক্ষমতা খর্ব হয়েছে না বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নতুন দায়িত্বে নিয়োজিত হলেও তার যেসব সিদ্ধান্তের দরুন নিকট অতীতে অস্বস্তিকর ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো কি ভবিষ্যতে ‘আইনের বিচারিক ব্যাখ্যা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে? তা হওয়ার আগেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আইনি মাধ্যমে, যেমন আপিল, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে রাখা প্রয়োজন। বিচার বিভাগ কারও খেয়াল-খুশির স্থানে পরিণত হোক, তা হতে পারে না।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আদালত আর সংসদের সম্পর্কের মধ্যে যে অস্বস্তি তৈরি করেছেন, তার সুরাহা সরকার ও বিজ্ঞজনরা নিশ্চয় করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহী বলে মাননীয় বিচারপতি যাদের গায়ে ছাপ এঁকে দিয়েছেন তাদের কী হবে? আসিফ নজরুলরা ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। তাদের নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতে লড়তে হবে। কিন্তু স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের মতো রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি? তাকেও কি প্রমাণ করতে হবে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী নন, তিনি দেশপ্রেমিক।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন আমি সবার বিবেচনার জন্য উত্থাপন করতে চাই। কথায় কথায় যাকে-তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা কেন? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেই কিংবা ভিন্ন মত পোষণ করলেই কারও ওপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় চাপানো কি আদৌ সমীচীন? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানাতে হবে কেন? রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এই অপরাধের দণ্ডও বেশ গুরু। এমন একটি গুরুতর অভিযোগ কারও ওপর চাপানোর আগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু হালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিষয়টির যেমন যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এ অভিযোগ তার গুরুত্ব হারিয়ে ক্রমেই সস্তা হয়ে পড়ছে। হয়ে যাচ্ছে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ তার হাতিয়ার। যেমন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র আমদানি করে দেশের জনগণের ঘাড়ে ভর্তুকির বোঝা চাপানো হয়েছে মর্মে যারা সমালোচনা করেন, তাদেরও সরকারি ক্ষমতাধর এক উপদেষ্টা আখ্যা দিয়েছেন ‘দেশবিরোধী’ বলে।
আগেই বলেছি, অবস্থানের দিক দিয়ে রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্পিকার আবদুল হামিদ, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি সঙ্গত কাজ হয়েছে! কেমন করে একজন বিচারপতির পক্ষে সম্ভব হলো তার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করা?
বিচারপতি শামসুদ্দিন যেভাবে স্পিকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা উচ্চারণ করেছেন, বলছিলাম এমন যথেচ্ছভাবে গুরুতর একটি অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী নয়। ভুলে গেলে চলবে না, তারা তাদের দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধে। আজ কেন কথায় কথায় যাকে-তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা? এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে প্রতিপক্ষ বা অপছন্দনীয়দের রাষ্ট্রদ্রোহী বলার হিড়িক চললে, আশঙ্কা হয়, এমন একদিন আসবে যখন হয়তো দেশে কোনো দেশপ্রেমিক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সবার নাম রাষ্ট্রদ্রোহীর তালিকায় স্থান পাবে।
তিনি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মাননীয় স্পিকারের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে। রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা তার সমান অপরাধে অপরাধী বলার যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে পুরো জাতীয় সংসদ। সংসদ সদস্যরা একযোগে তার অপসারণ দাবি করেছিলেন। তাকে ইমপিচ করা, এর জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রভৃতির দাবিতেও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তারা। বিচারপতি শামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংসদে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের পক্ষেও মত দিয়েছিলেন তারা। অবশেষে স্পিকার আবদুল হামিদ বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতির হাতে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন সংসদ সদস্যদের। তবে আলোচ্য বিচারপতির মন্তব্যাদি সম্পর্কে তিনি স্পষ্টভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই লেখার সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়নি। অন্যদিকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন করেছিলেন তা আইন মন্ত্রণালয়ে নথিভুক্ত হয়ে রয়েছে। সেটা ওই নথি থেকে মুক্ত হয়ে প্রধান বিচারপতির হাতে পৌঁছায় কিনা তাও লক্ষ্য করছেন দেশের মানুষ।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্যের কারণে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদ একরকম মুখোমুখি অবস্থায় চলে যাচ্ছিল। এতে জনগণ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভের মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগের এই মুখোমুখি অবস্থানে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন দেশের বিদগ্ধ জনরাও। সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে আইনজীবী মহল দুই বিভাগের দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রবীণ ও প্রভাবশালী আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং ড. কামাল হোসেন এ বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিয়েছেন।
তারা তাগিদ দিয়েছেন, তবে একই সঙ্গে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিচার বিভাগ সম্পর্কে তার অসন্তোষের কথাও প্রকাশ করেছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, গত সাড়ে তিন বছরে বিচার বিভাগকে এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, সেখান থেকে নিরপেক্ষ বিচার আর আশা করা যায় না। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের এই পর্যবেক্ষণ আজকের বিচার বিভাগ সম্পর্কে এক নির্মম বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে সর্বতোভাবে। এই বাস্তবতার এক দৃষ্টান্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ টেনে সিদ্ধান্ত দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে বারবার। রাজনীতির মাঠে-ময়দানের বাইরেও প্রচার মাধ্যমে এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতেও কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাকে আদালতে তলব করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। এদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে তার একটি হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল একটি টকশোতে দেয়া বক্তব্যের কারণে এই বিচারপতির আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আসামি হয়েছেন। তলব পেয়ে তাকে আদালতে সশরীরে হাজির হতে হয়েছে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এজলাসে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা বিচারপতি শামসুদ্দিনের এক বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ নিয়ে তারই আদালতে তার ও ড. কামাল হোসেনের মধ্যে আইনি বিতর্ক হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য এ মাননীয় বিচারপতিকে ‘স্যাডিস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন সংসদে আলোচনার সময়। এ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গেই তিনি রূঢ় আচরণ করেছেন। খবরে পড়েছি, একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এই বিচারপতির আদালতের ডকে চার ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এই বিতর্কিত বিচারপতি সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হয়, সেদিকেই তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে বিচারপতি শামসুদ্দিনের বেঞ্চ বদল করে তার জন্য ভিন্ন বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। জানি না এই নতুন দায়িত্বে তার ক্ষমতা খর্ব হয়েছে না বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নতুন দায়িত্বে নিয়োজিত হলেও তার যেসব সিদ্ধান্তের দরুন নিকট অতীতে অস্বস্তিকর ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো কি ভবিষ্যতে ‘আইনের বিচারিক ব্যাখ্যা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে? তা হওয়ার আগেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আইনি মাধ্যমে, যেমন আপিল, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে রাখা প্রয়োজন। বিচার বিভাগ কারও খেয়াল-খুশির স্থানে পরিণত হোক, তা হতে পারে না।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আদালত আর সংসদের সম্পর্কের মধ্যে যে অস্বস্তি তৈরি করেছেন, তার সুরাহা সরকার ও বিজ্ঞজনরা নিশ্চয় করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহী বলে মাননীয় বিচারপতি যাদের গায়ে ছাপ এঁকে দিয়েছেন তাদের কী হবে? আসিফ নজরুলরা ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। তাদের নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতে লড়তে হবে। কিন্তু স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের মতো রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি? তাকেও কি প্রমাণ করতে হবে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী নন, তিনি দেশপ্রেমিক।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন আমি সবার বিবেচনার জন্য উত্থাপন করতে চাই। কথায় কথায় যাকে-তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা কেন? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেই কিংবা ভিন্ন মত পোষণ করলেই কারও ওপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় চাপানো কি আদৌ সমীচীন? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানাতে হবে কেন? রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তো অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এই অপরাধের দণ্ডও বেশ গুরু। এমন একটি গুরুতর অভিযোগ কারও ওপর চাপানোর আগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু হালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিষয়টির যেমন যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এ অভিযোগ তার গুরুত্ব হারিয়ে ক্রমেই সস্তা হয়ে পড়ছে। হয়ে যাচ্ছে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ তার হাতিয়ার। যেমন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র আমদানি করে দেশের জনগণের ঘাড়ে ভর্তুকির বোঝা চাপানো হয়েছে মর্মে যারা সমালোচনা করেন, তাদেরও সরকারি ক্ষমতাধর এক উপদেষ্টা আখ্যা দিয়েছেন ‘দেশবিরোধী’ বলে।
আগেই বলেছি, অবস্থানের দিক দিয়ে রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্পিকার আবদুল হামিদ, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি সঙ্গত কাজ হয়েছে! কেমন করে একজন বিচারপতির পক্ষে সম্ভব হলো তার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করা?
বিচারপতি শামসুদ্দিন যেভাবে স্পিকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা উচ্চারণ করেছেন, বলছিলাম এমন যথেচ্ছভাবে গুরুতর একটি অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী নয়। ভুলে গেলে চলবে না, তারা তাদের দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধে। আজ কেন কথায় কথায় যাকে-তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা? এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। নইলে প্রতিপক্ষ বা অপছন্দনীয়দের রাষ্ট্রদ্রোহী বলার হিড়িক চললে, আশঙ্কা হয়, এমন একদিন আসবে যখন হয়তো দেশে কোনো দেশপ্রেমিক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সবার নাম রাষ্ট্রদ্রোহীর তালিকায় স্থান পাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন