আবু সাঈদ খান
যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে
উন্নয়নের আবশ্যিক শর্ত শিক্ষা। কোনো পরিবারের সন্তান শিক্ষিত হলে ওই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলায়। সাংস্কৃতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। কথাটি জাতির ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য। মানবসম্পদের উন্নয়নই সব উন্নয়নের উৎসমুখ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সত্য অনুধাবনে নীতিনির্ধারকরা বরাবরই অপারগ। শিক্ষার তাৎপর্য মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবে যৌক্তিক পদক্ষেপ দেখি না। হরহামেশাই বলা হয়, শিক্ষার হার বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৪১ বছরে এই অগ্রগতি কি যথেষ্ট? গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত শ্রীলংকায় এখন শিক্ষিতের হার শতকরা ১০০ ভাগ। ভারতের কেরালাও প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে পেরেছে। আর আমরা মাত্র অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে পেরেছি। আসলে এটি স্বাক্ষর জানা নরনারীর হিসাব। প্রকৃত শিক্ষিতের সংখ্যা যে এর থেকে অনেক কম তা বলাই বাহুল্য।
উচ্চ শিক্ষিতের হার আরও হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবেশী ভারতে যখন উচ্চ শিক্ষিত শতকরা প্রায় ১২ ভাগ, তখন আমাদের দেশে তা মাত্র ৪ শতাংশ অর্থাৎ ভারতের তিন ভাগের এক ভাগ।
শিক্ষিতের হার যতটুকু বেড়েছে, সে অনুযায়ী মান বাড়েনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা নিম্নগামী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর দিকে তাকালেই সে চিত্র পাওয়া যায়। রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ডিগ্রি ও অনার্স কোর্স মিলিয়ে ১ হাজার ৮৮৯টি কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ। সংখ্যায় প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ এ কলেজগুলো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত।
পাকিস্তান আমলে জেলা সদরের কলেজগুলোর বেশ সুনাম ছিল। যোগ্য শিক্ষকসহ উন্নম্নততর অবকাঠামো ছিল। পর্যাপ্ত ছিল আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। তখন ওইসব কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করত, মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকত। ছাত্র আন্দোলনেও এ কলেজগুলোর অগ্রণী ভূমিকা থাকত। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কলেজ পর্যায় থেকেই শুরু হয়েছিল। '৬৯ সালের গণআন্দোলনে কলেজগুলো ছিল ব্যাপকভাবে সক্রিয়। এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অথচ স্বাধীনতার পর এ কলেজগুলো ক্রমে জৌলুস হারিয়েছে। শিক্ষার মান নেমেছে, ভালো শিক্ষক কমে গেছে। পুরনো অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে, নতুন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়। অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কলেজের প্রতিটি অনার্স কোর্সের জন্য ৭ জন ও মাস্টার্স ক্লাসের জন্য ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা, বাস্তবে এর অর্ধেক বা সিকিভাগ শিক্ষক দিয়ে কাজ চালানো হয়। এ ব্যাপারে অভিমত (সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মুখপত্র) পত্রিকার তথ্য তুলে ধরতে চাই_ 'ঢাকার তিতুমীর কলেজে ৪৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন ১৪৫ জন। সিলেটের এমসি কলেজের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১০০ জন। এই কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও মনোবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক আছেন দু'জন, ইতিহাস ও পরিসংখ্যান বিভাগে তিনজন। চট্টগ্রাম কলেজের ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন ১৩৯ জন। দিনাজপুর সরকারি কলেজে সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের শিক্ষক আছেন মাত্র দু'জন করে। চাঁদপুর সরকারি কলেজে গণিত ও ইংরেজিতে শিক্ষক আছেন তিনজন করে। ২২ হাজার ছাত্রের বরিশাল বিএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক আছেন মাত্র তিনজন।' অন্যসব কলেজেরও একই চিত্র। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যত জন শিক্ষক থাকার কথা, তার চেয়ে অনেক কম শিক্ষক আছেন। প্রসঙ্গক্রমে গাইবান্ধা কলেজের কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ২৯৪ : ১। লাইব্রেরিতে বইয়ের অভাব, ল্যাবরেটরিতে যন্ত্রপাতির অভাব প্রকট। আবাসিক হলগুলোতে আসন সংকট। পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেণীকক্ষও নেই। তার ওপর সেশনজট। এই যখন কলেজগুলোর হাল, তখন শিক্ষার মান কী করে বাড়বে?
আসলে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যাই দায়ী। শিক্ষাকে অধিকার বিবেচনায় যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা তারা নিতে নারাজ। শিক্ষাকে দেখা হচ্ছে পণ্য হিসেবে। ভাবখানা এমন যে, যার মা-বাবার টাকা আছে, তারা রাজধানীর হাতেগোনা ভালো কলেজে পড়বে, ভালো রেজাল্ট করবে। বড় চাকরিও মিলবে তাদের ভাগ্যে। আর নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সমস্যাসংকুল কলেজগুলোয় পড়বে। শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে কোচিং সেন্টারে যাবে। অর্থনৈতিক কারণে যারা যেতে পারবে না, তারা হা-হুতাশ করবে। শিক্ষার মর্মবাণী হবে ভূলুণ্ঠিত।
যে দেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত, সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু যে দেশের, সে দেশের শিক্ষার দায় রাষ্ট্র নেবে_ সেটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আশির দশকে ব্যক্তিমালিকানায় স্কুল প্রতিষ্ঠার দ্বার অবারিত করা হলে পাবলিক স্কুল-কলেজগুলো প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চটকদারি বিজ্ঞাপনের ভাষায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হয়। কোচিং টিউশনির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ ভ্রান্ত নীতিতে রাজধানীসহ জেলার কলেজগুলো গুরুত্ব হারায়, শিক্ষার মান নেমে যেতে থাকে।
এর অনিবার্য পরিণতিতে নিম্নবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের সন্তানরা হচ্ছে বঞ্চিত। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। একদা মফস্বলের স্কুল-কলেজ পড়ূয়ারা স্ট্যান্ড করত। এখন তা সম্ভব নয়। তখন গরিব চাষির ছেলেও সিভিল সার্ভেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হতে পারত। আমলা-শিল্পপতিদের পাশাপাশি কৃষক সন্তানের প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল। আজ তা ভাবা যায় না। নিম্নবিত্তের কোনো সন্তানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। এমনকি ঢাকাসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। শুধু স্কুল-কলেজগুলোতে পড়ে, টিউশনি-কোচিং না করে ভালো রেজাল্ট করা যায় না। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। কোচিং-টিউশনি নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তা অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের নিশ্চয়তা, স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষা সুযোগ না বাড়িয়ে এর বাস্তবায়ন কি আদৌ সম্ভব?
কেবল পাবলিক কলেজগুলোই নয়, একইভাবে সমস্যায় জর্জরিত পাবলিক স্কুল, সরকারি ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। সেখানে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা আছে, তবে সবচেয়ে বড় সংকট_ প্রয়োজনীয় ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব। মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না। এর মূল কারণ অন্যান্য চাকরির তুলনায় শিক্ষকদের বেতন কম। উন্নত দেশে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শিক্ষকতাই বেতনে ও মর্যাদায় অন্যতম আকর্ষণীয় চাকরি। মেধাবীরা এদিকে আকৃষ্ট হন। কিন্তু বাংলাদেশ শিক্ষকতার ক্ষেত্রে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ।
শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিভাজন রেখা আজ স্পষ্ট। একদিকে সচ্ছল মধ্যবিত্তের জন্য নগরের নামিদামি স্কুল, সেরা কলেজ থেকে পাস করে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ, পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমে ও-লেভেল, এ-লেভেল পাস করে বিদেশে পড়ার সুযোগ। অন্যদিকে সরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়-মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক কলেজে পড়া। এর চেয়ে নাজুক অবস্থায় মাদ্রাসা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাপড়ূয়া শিক্ষার্থীরা। মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মোটিভেশন আছে সত্য। তবে এসব ছাড়িয়ে যেটি প্রবলভাবে কাজ করে সেটি অর্থনৈতিক কারণ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে দান-খয়রাতের টাকায় পরিচালিত বিনা পয়সায় মাদ্রাসায় পড়তে পারাই তাদের কাছে বড় ব্যাপার।
দেশের সামগ্রিক কল্যাণে, মানবসম্পদের উন্নয়নে পাবলিক স্কুল-কলেজগুলোর উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কলেজগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার। প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যে বরাদ্দ আছে তা দিয়ে পাবলিক কলেজ, পাবলিক স্কুল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে কি? না, তা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষা খাতে ব্যয় হয় জিডিপির শতকরা ২.২৩ ভাগ, যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ একে ৬ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে, কিন্তু তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে দেশের মানবগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে আছে, যতই সম্পদ থাকুক, সে দেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে না। যোগ্য ও দক্ষ মানবগোষ্ঠীই দেশের বড় সম্পদ। মানবগোষ্ঠী তখনই সম্পদ হয়ে ওঠে, যখন তারা শিক্ষার আলোতে দীপ্ত হয়। সে বিবেচনায় আজ আমাদের শিক্ষা ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জিত হলে তা উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে শিক্ষায় শ্রেণীগত বৈষম্য, কারিকুলামগত বিভাজন রেখা আছে, সেটি দূর করাও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের দেশের পাবলিক স্কুল-কলেজগুলোকে সাধারণ শিক্ষালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে বিশেষায়িত শিক্ষার সুযোগ নেই। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি, শিল্পসহ বৃত্তিমূলক শিক্ষা, আইটি, বিবিএ-এমবিএ ইত্যাদি পড়ানো হয় না। পাবলিক স্কুল-কলেজগুলোয় বিশেষায়িত শিক্ষা প্রচলন করা দরকার।
জাতীয় উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে_ যাতে শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা চাকরি পেতে পারে, দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বিদেশে গেলে যেন ভালো চাকরি নিশ্চিত হয়। আমরা সেই শিক্ষা চাই, যা হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দেশপ্রেম-মানবপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন