ন জ র“ ল খা ন
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হল জনপ্রশাসন। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসন শুর“ হয়েছে। রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র যে কাঠামোর রাষ্ট্রই হোক না কেন, জনপ্রশাসন ছাড়া কোন দেশ চলতে পারে না। উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকেই মূলত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে জনপ্রশাসন শুর“ হয়। মোগল বা তার আগের আমলগুলোয়ও প্রশাসন ছিল তবে তা স্বীকৃত জনপ্রশাসন নয়। ব্রিটিশের বিদায়ের পর তাদের জনপ্রশাসনের আদলেই ভারত ও পাকিস্তানে জনপ্রশাসন চলতে থাকে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরও একইভাবে চলতে থাকে, তবে গণতান্ত্রিক ব্যব¯’াপনার আলোকে সময়ে সময়ে বাস্তবের নিরিখে বিধিমালায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে ৩০টি ক্যাডার সার্ভিস প্রচলিত আছে। তার মধ্যে পেশাভিত্তিক ও প্রশাসনভিত্তিক উভয় ক্যাডারেই নিয়োগ নীতিমালা একই রূপ। সরকারের আদর্শগত নীতিমালার আলোকে দেশে সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনাই সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। প্রচলিত আইন অনুসারে সরকার পরিবর্তন হলেও সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পরিবর্তন হয় না। ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও মঙ্গলের বিশাল দায়দায়িত্ব বর্তায় সরকারি কর্মচারীদের নিষ্ঠা ও সততার ওপর। ব্রিটিশ সরকার অনেক আগেই তাদের জনপ্রশাসন কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আমেরিকার ফেডারেল সরকারও বাস্তবতার নিরিখে তাদের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজিয়ে অধিকতর জবাবদিহিতার আওতায় এনেছে। আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা প্রচলিত আইনের আওতায় আনা একান্ত দরকার। দেশের জনপ্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে যথাশিগগির এ ব্যব¯’ার আশ্রয় নিতে হবে। জবাবদিহিতার অভাবেই আমাদের দেশের সরকারি অফিসের কাজের পরিমাণ ও মান নিতান্তই কম। সুখের বিষয়, সম্প্রতি দুর্নীতির কারণে সরকারি কর্মচারীদের সরকারের পূর্বানুমতি নেয়ার বিধান তুলে দেয়ার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এটা আশা করি সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় আর দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছুটা সহায়ক হবে।
বর্তমানে দেশে ২৭টি মন্ত্রণালয় রয়েছে। অল্প কিছু মন্ত্রণালয় ছাড়া প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক বা একাধিক অধিদফতর বা পরিদফতর রয়েছে। মূলত এই অধিদফতর বা পরিদফতরগুলোই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। এসব অধিদফতর-পরিদফতরই দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এগুলোর কোন কোনটি রয়েছে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আবার কোন কোনটি স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত। তবে স্ব-স্ব কাঠামোর আলোকেই নিয়ন্ত্রিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন কৃষি সম্প্রসারণ, এসআরডিআই, বিরি, বারি ইত্যাদি অধিদফতরের বিশাল গবেষণালব্ধ কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের জনশক্তি দ্বারাই সম্পন্ন হয়। ঠিক তেমনি শিল্প মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের কাজ সম্পন্ন হয় তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের (সার, সিমেন্ট, কাগজ, লেদার কারখানা ইত্যাদি) জনশক্তি দ্বারা। তেমনিভাবে অর্থ মন্ত্রণায়াধীন এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক ইত্যাদি এবং আইন ও বিচার, পূর্ত, বেসামরিক ও পর্যটন, ডাক ও টেলিফোন এবং তথ্য প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের অধিদফতরও একইভাবে পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের এককালের প্রবেশনারি কর্মকর্তারাই অবশেষে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আরোহণ করেন। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠান বা অধিদফতরে নিয়োজিত থাকার ফলে অধিদফতরের সব কর্মকাণ্ড তাদের নখদর্পণে থাকে, এমনকি প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগ্যতা, দক্ষতা, আচরণ, উদ্যোগ ইত্যাদি সম্বন্ধে তাদের থাকে স্ব”ছ ধারণা। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন শিক্ষাগত, পেশাগত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ক্যাডারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও সহকারী সচিবরা; যাদের অনেকেরই সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোর কর্মকাণ্ডের ব্যপারে প্রত্যক্ষ ধারণা থাকে না। দেখা গেছে, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কোন ধরনের ‘টেকনিক্যাল’ সভায় বা আলোচনায় সচিবরা হন্তদন্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের বিশেষজ্ঞদের তলব করতে থাকেন। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর সচিবদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা হয়তো সীমিত বা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। প্রশাসন পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ যে কেউ কম-বেশি পারদর্শী, কিš‘ বিশেষ পেশাদারি কর্মকাণ্ড অবিশেষজ্ঞের দ্বারা পরিচালনা করা কঠিন।
সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বদলি বা পদায়ন এত ঘন ঘন হয়ে থাকে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১-২ বছরের বেশি কেউ একই পদে অব¯’ান করেন না, এমনকি ৩-৬ মাসের মধ্যেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা অধিদফতরগুলোর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, অর্জন, মনিটরিং ইত্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন বাস্তবিকই কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুর“তর সমস্যায় পড়তে হয়। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বেশি পারদর্শী হওয়াই স্বাভাবিক। অধিকাংশ অধিদফতর-পরিদফতর উ”চ ডিগ্রিধারী ‘বিশেষজ্ঞ’ দ্বারা ভরপুর থাকে। এখানে একটি অপ্রিয় সত্য কথা হল, বদলি আতংকে সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সব সময়ই থাকেন অ¯ি’র। স্বল্পসময়ের অব¯’ানে কাজে মনোনিবেশ করাই কঠিন হয়ে ওঠে। কাজকর্ম বুঝে ওঠার আগেই হয়তো অন্যত্র বদলির আদেশ হাতে এসে যায়। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ পদায়ন ¯’ানের সুযোগ-সুবিধা, ভালো-মন্দ, যশ-খ্যাতি ইত্যাদি আনুষঙ্গিক উপাদান সব সময়ই তাদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে থাকে। এগুলো সব মানুষেরই মানবিক দোষগুণের অংশ বটে! বদলি¯’লগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র।
বর্তমান যুগ হল ‘বিশেষজ্ঞে’র যুগ। একক ব্যক্তি সব ক্ষেত্রের নিয়ামক হতে পারেন না। প্রশাসন ক্যাডারেও কিছু বিশেষজ্ঞ হয়তো আছেন, কিš‘ তারা তাদের লব্ধ জ্ঞান যথাযথ প্রয়োগের সুযোগ পান না। তাই আমি মনে করি, মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদফতর-পরিদফতরগুলো থেকেই সচিব থেকে উপসচিব পর্যন্ত সব পদে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান অধিকতর যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ জনপ্রশাসন (সং¯’াপন) মন্ত্রণালয়ের আওতায় যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন জেলা/বিভাগীয় প্রশাসন, পিএটিসি ইত্যাদি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় পুলিশ, আনসার-ভিডিপি ইত্যাদি দফতর বা অধিদফতর থেকেই জ্যেষ্ঠতা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণ হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলো। ক্যাডার-ননক্যাডার ব্যাপারটি বিশেষ ব্যব¯’ায় সুরাহা করতে হবে। সব মন্ত্রণালয় পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অথবা নতুন সৃষ্ট কোন মন্ত্রণালয় দ্বারা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মন্ত্রণায়গুলো উপরোক্ত সুপারিশের আলোকে বিন্যাস করা হলে জনপ্রশাসন তথা সরকারি কর্মকাণ্ড অধিকতর গতিশীল হবে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত হ”েছ সম্পূর্ণ পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা। কারণ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা কঠিন। তেমনি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা প্রযোজ্য নয় কি? তবে এ ব্যাপারে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
জনপ্রশাসন সার্ভিস ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি ইত্যাদি নিয়ে প্রায়ই বিব্রত হতে হয় সরকারকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জনপ্রশাসন ক্যাডারে কিছুদিন আগে যে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে সেখানে নির্দিষ্ট ¯’ায়ী পদের বিপরীতেও বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি দিতে হয়েছে, যা সরকারি কর্মচারী আইনবিধির কিছুটা ব্যত্যয়। এতে অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। দেশব্যাপী এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। পদোন্নতিবঞ্চিতদের ক্ষোভ-দুঃখের কারণে কাজের গতি স্বাভাবিকতায় আনতে অনেক সময় লেগে যাবে। সরকারের দলীয়করণ তো এখন দিবালোকের মতো সত্যে পরিণত হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যব¯’ায় দলীয়করণ রহিত করা প্রায় অসম্ভব! পদ্ধতিগত ত্র“টির কারণেই সরকারকে এ পথ বেছে নিতে হয়। যতদিন পর্যন্ত এ ব্যব¯’া বহাল থাকবে ততদিন বিগত সরকারগুলোর মতো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারও এ বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তা ছাড়া ক্যাডারগুলোর মধ্যে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পদোন্নতিসহ অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ দ্বন্দ্ব কোন কোন সময় প্রকট রূপ ধারণ করে। এসব জটিল পরি¯ি’তি সরকারকে প্রায়ই বিব্রত করে থাকে। ফলে জনপ্রশাসনে নেমে আসে এক অ¯ি’র পরি¯ি’তি ও ¯’বিরতা। এ ব্যব¯’া থেকে উত্তরণে একমাত্র বিকল্প হল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। এর ফলে প্রশাসনে এহেন বিড়ম্বনা অনেকটাই প্রশমিত হবে এবং প্রশাসনে অধিকতর গতিশীলতা আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া আন্তঃক্যাডার কলহ, বদলি আতংক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর হবে। সর্বোপরি সরকার জনপ্রশাসন নিয়ে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা থেকে রেহাই পাবে।
নজর“ল খান : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
হরশযধহ৫৫৯৪@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন