রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

ধনবান মন্ত্রী-সাংসদদের গাড়ি-ক্ষুধা


সোহরাব হাসান 

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালে যে নির্বাচন করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত সংসদে থাকতে পারেনি। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে নূর হোসেনের জীবন দেওয়া আন্দোলনের মুখে এরশাদ সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করলেও তাঁদের আমলের গণবিরোধী আইনগুলো পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার ঠিকই রেখে দিয়েছিল। এ রকমই একটি গণবিরোধী আইন হলো ১৯৮৭ সালের ২৪ মে পাস করা সাংসদদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি। এই আইনের সুবিধা নিয়েছেন পরবর্তীকালে নির্বাচিত সাংসদেরা। মাঠে-ময়দানে যাঁরা এরশাদকে স্বৈরাচার বলে কষে গাল দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর কাছ থেকে বৈধ-অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। এ কারণেই স্বৈরাচারী শাসক নয় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। 
সামরিক স্বৈরাচারের আমলে করা অনেক আইনই পরবর্তীকালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দেয়। বিএনপি প্রথম সুযোগে উপজেলা পদ্ধতি রহিত করে দলীয় সাংসদদের আবদারে। আওয়ামী লীগ উপজেলা পদ্ধতি ফের চালু করলেও উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছে। নারীর ক্ষমতায়নের যুগে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের কোনো কাজ নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বহুবার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে কিছু করেনি।
শনিবার ‘এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি: অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ’ শিরোনামে দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার প্রতিযোগিতায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছেন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। এখন পর্যন্ত ২৭৫টি গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। এসব গাড়ি আমদানিতে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সপ্তম জাতীয় সংসদে এই রাজস্বের পরিমাণ ছিল পৌনে ২০০ কোটি টাকা, অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্যরা ২৭৫টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ২৮০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন।’ (দৈনিক সংবাদ, ২৩ জুন, ২০১২)
অতীতে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির নামে সাংসদেরা কী কী করেছিলেন, তা কমবেশি সবারই জানা। কেউ কেউ গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করানোর পরই অনেক বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামাই করেছেন। সাংসদ পদটিকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার করেছিলেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার পক্ষে যুক্তি ছিল, এর মাধ্যমে সাংসদেরা নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারবেন। বিপদে-আপদে তাদের পাশে থাকতে পারবেন। কিন্তু সপ্তম ও অষ্টম সংসদের অনেক সাংসদই কথা রাখেননি। দামি গাড়ি এনে বিক্রি করে দিয়েছেন। এবারও যে তাঁরা একই কাজ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, এবার যেসব গাড়ি আমদানি করা হয়েছে, তার অধিকাংশই ল্যান্ডক্রুজার, সর্বশেষ মডেলের টয়োটা, কিংবা ডিজেলচালিত ভিএক্স। গত বছরের ২৯ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জারি করা পরিপত্রে স্পষ্ট বলা ছিল—শুল্কমুক্ত গাড়ি কখনোই হস্তান্তর করা যাবে না, বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করা যাবে না, সরকারের রাজস্ব কর পরিশোধ করতে হবে এবং গাড়ির নম্বরপ্লেটে নিজ জেলা, নির্বাচনী এলাকার আসন নম্বর ও এলাকা উল্লেখ বাধ্যতামূলক। পরবর্তীকালে সাংসদদের আপত্তির মুখে গাড়ির নম্বর ও এলাকা লেখার বিধানটি বাতিল করা হয়।
এর পাশাপাশি আমরা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাবটি নিলে কী দেখতে পাই। এই সংসদে একজন লাখপতিও নেই। সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ প্রায় চার কোটি টাকা। অনেকের মাসিক আয়ও কোটি টাকার ওপর। তাহলে কেন তাঁরা শুল্কমুক্ত গাড়ি পাবেন? এই সুযোগ তাঁদেরই পাওয়া উচিত, যাঁদের শুল্ক দিয়ে গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু সাংসদ পদটি এখন ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সর্বাধুনিক মডেলের গাড়ি আমদানি করবেন এবং সেই গাড়ি কিছুদিন নিজের হেফাজতে রেখে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে দেবেন। বিএনপি সরকারের আমলে শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রির খবর কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি বিএনপির ক্ষমতাচ্যুতির পর। এবার কখন জানতে পারব?
সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সাংসদেরা পাল্লা দিয়ে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেছেন। গাড়ি যত দামি হবে, তার আমদানি শুল্কের হারও তত বেশি। দামভেদে এসব গাড়ির বিপরীতে ৪৪০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। অর্থাৎ একজন সাংসদ বিনা শুল্কে যে গাড়ি ৫০-৬০ লাখ টাকায় আমদানি করেন, সেই গাড়িই একজন অ-সাংসদ বা সাধারণ নাগরিককে আমদানি করতে হবে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকায়। একই দেশে কি দুই আইন চলতে পারে? এ জন্যই ভারতে সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। সংসদ অধিবেশন চলাকালে তাঁরা সরকারি পুল থেকে গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। 
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘যে দেশে হাসপাতালে রোগীরা না খেয়ে মারা যায়, সে দেশে সাংসদেরা কীভাবে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেন? রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব না কমলে রাষ্ট্রকে কখনোই কল্যাণমূলক করা যাবে না।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ২৪ জানুয়ারি, ২০১০, নাগরিক অধিকার ও জনসেবা সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের অধিকার শীর্ষক সেমিনার)
একই বছর ২৪ মার্চ এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ এনবিআর আয়োজিত এক সেমিনারে সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়ার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘একই দেশে যখন বৈষম্য করা হয়, তখন আমরা আহতবোধ করি, আমরা ব্যথিত হই, যখন দেখি আমাদের দেওয়া করের অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে।’ 
শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটি বাতিল করে দিয়েছিল। তখন অনেক ধনবান ব্যক্তির গাড়ি রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। অনেকের গাড়ি আটক করা হয়েছিল। যেসব সাংসদ দামি গাড়ি এনে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তাঁরা সেই মুনাফার কথা এনবিআরকে জানিয়েছিলেন? সেই আয়ের বিপরীতে কি তাঁরা আয়কর দিয়েছিলেন? 
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার বিষয়টি সামনে আসে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। একবার সাংসদদের গাড়ি কিনে দেওয়ার কথাও ভাবা হয়েছিল। সেসব গাড়ি নিশ্চয়ই কম দামের হতো এবং তাতে তাঁদের ইজ্জত থাকত না। এ কারণেই তাঁরা বিনা পয়সায় সরকারি গাড়ি না নিয়ে শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি আমদানি করেছেন। 
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান জাতীয় সংসদে এ পর্যন্ত ৩১৫ জন সাংসদ গাড়ি আমদানির অনুমোদন নিয়েছেন। ইতিমধ্যে ২৭৫ জন গাড়ি আমদানি করেছেন। এর মধ্যে ১৬ জনই আমদানি করেছেন ছয় কোটি টাকা দামের ল্যান্ডক্রুজার সর্বশেষ মডেলের টয়োটা, ৩৬ জন এনেছেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দামের ডিজেলচালিত ভিএক্স এবং রিকন্ডিশন্ড বিলাসবহুল গাড়ি। 
এই শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিকারকদের মধ্যে সাধারণ সাংসদের বাইরে মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী পদমর্যাদার সাংসদেরাও আছেন। যেমন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শাজাহান খান। প্রথমজন জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করেন। শেষোক্ত দুজন মন্ত্রিসভার সদস্য। বিএনপির সাংসদদের মধ্যে শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়েছেন জয়নুল আবদিন ফারুক, তিনি বিরোধী দলের চিফ হুইপ হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা পান। আরও আছেন সরকারি দলের একাধিক হুইপ। আছেন সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক জাঁদরেল সদস্য। যাঁরা গত এক বছরে এক দিনও সংসদে যাননি, শুল্কমুক্ত গাড়ি নিতে তাঁরাও পিছিয়ে নেই। 
সব বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিবাদ থাকলেও এই একটি ব্যাপারে তাঁরা এককাট্টা। জাতীয় ঐকমত্য প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। 
সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়ে এর আগেও অনেক খবর ছাপা হয়েছে। ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ল্যান্ডক্রুজার ও প্রাডো সাংসদদের পছন্দ।’ প্রাডো না পেলেও ল্যান্ডক্রুজার তাঁরা পাচ্ছেন।
তখনো পর্যন্ত ‘মন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ এবং প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার হুইপদের কেউ শুল্কমুক্ত গাড়ির জন্য আবেদন করেছিলেন না। মন্ত্রীদের এ কোটায় গাড়ি আনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাঁরা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেছেন।’
কিন্তু মন্ত্রীদের সেই ধীরে চলো নীতি ত্বরিত হতে সময় লাগেনি। প্রতিবেদনে কয়েকজনের নাম এসেছে। নিশ্চয়ই আরও কেউ কেউ পাইপলাইনে আছেন। এখানে প্রশ্নটি আইনের নয়, নীতির। একজন মন্ত্রী হয়ে জনগণের করের পয়সায় বেতন-ভাতা নেবেন, গাড়ি-বাড়ি নেবেন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেবেন। আবার শুল্কমুক্ত গাড়িও নেবেন? কার জন্য? তিনি কোন গাড়িতে এলাকায় যাবেন—সরকার থেকে পাওয়া গাড়িতে, না শুল্কমুক্ত আমদানি করা গাড়িতে? এই হলো আমাদের জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র! 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্ভবত ২০০৮ সালের মার্চে উপদেষ্টাদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনার উদ্যোগসংক্রান্ত একটি খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে আরও একটি খবর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বঙ্গভবনে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে অন্যের ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে নিয়েছিলেন সন্তানদের জন্য। আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার সহধর্মিণী সেই খবরটি লিখেছিলেন অপর একটি পত্রিকায়। সেই খবর পড়ে আমি লিখেছিলাম, ‘উপদেষ্টাদের জন্য লাক্সারি গাড়ি ও বঙ্গভবনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জায়ার ক্ষুধার্ত মুখ’। সেই লেখা পড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছিলেন, ‘যে দেশে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বঙ্গভবনে খাবার কুড়িয়ে খান, সেই বঙ্গভবনে আমি কখনো যাব না।’ 
পরে সেই মুক্তিযোদ্ধার জায়ার সাহায্যার্থে যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তাতেও তিনি আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। 
সমালোচনার মুখে অনির্বাচিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলাসবহুল গাড়ি কেনা থেকে বিরত থেকেছিল। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীরা শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগটি ছাড়েননি। এসব নিয়ে আলোচনাকালে একবার প্রধানমন্ত্রী নাকি ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা মন্ত্রিত্ব চান, না গাড়ি চান।’এখন মনে হচ্ছে, তাঁরা দুটোই চান। দেশসেবা নয়, শুল্কমুক্ত গাড়িই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। সব ক্ষুধাকে ছাড়িয়ে মন্ত্রী-সাংসদদের গাড়ি-ক্ষুধাই বড় হয়ে উঠেছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন