এডভোকেট ফিরোজ আহমেদ :
আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর প্রচারিত সংবাদে মিয়ানমারে দাঙ্গায় রোহিঙ্গাদের নদীপার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কোস্টগার্ডের সে অনুপ্রবেশ রোধ করে আবার পুশব্যাকের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা এও জেনেছি মানবিক কারণে এসব শরণার্থীদের পুশব্যাকের পূর্বে বাংলাদেশ খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে, এমনকি যে যন্ত্রচালিত নৌকায় নদী পার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিল, সেই যন্ত্রচালিত নৌকার জ্বালানি না থাকলে জ্বালানি সাহায্যও প্রদান করা হচ্ছে। জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের সর্বত্র রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণের বর্বরতার ছবির ফুটেজ প্রচারিত হচ্ছে, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয় স্পর্শ করার জন্য। হয়ত একইভাবে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকাতেও প্রচার চলছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত যেমনটি আমাদের দেশের শরণার্থীদের তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল, তেমনিভাবে আমাদেরও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া উচিত। গত কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের দেশে চট্টগ্রাম এলাকায় শরণার্থী হিসাবে আছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে ত্রাণ কাজে এনজিওদের বাণিজ্যের অভিযোগ, জঙ্গি কানেকশন, নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত-এসব অভিযোগ বিদ্যমান। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রি ডা. দিপু মনি বাংলাদেশের এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এদের বাংলাদেশ শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দেবে না এবং এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করছে।
রোহিঙ্গারা পূর্বতন বার্মা বর্তমান মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়। প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের পাশে উত্তর রাখাইন রাজ্য নামে নামকরণ করা পূর্ববর্তী আরাকান রাজ্যের ৩টি টাউনশিপে বাস করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা, উগ্র রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়ে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা বর্তমানে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় ১৪৩০ থেকে ১৫৩১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বার্মা গৌড় সালতানাতের পরোক্ষ শাসনাধীন ছিল, সে সময়ে ঐ অঞ্চলে মুসলমানদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। আরাকান রাজারা যদিও ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন, তবুও সালতানাতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে তারা মুসলিম পদবী ধারণ করতেন। এই রাজবংশের দ্বাদশ রাজা শাহ্ পদবীধারী রাজা মিনবিন এর মোগল সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা আক্রমণকালীন সময়ে অস্থিরতার সুযোগে তৎকালীন পূর্ববাংলার বিশাল অংশ দখল করে নেয়। ফলে চট্টগ্রামসহ আরাকান রাজ্যের সংস্কৃতি ও রীতিনীতিতে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন সপ্তম শতকে আরাকানে আসা পার্সিয়ান বণিকদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মুসলমানরা ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা হিসাবে পরিচিত ও আত্মিকৃত হয়ে পড়ে। ১৭৮৪ সালে ব্রিটিশ আরাকান দখল করে নিলে ভারত ও বাংলার সঙ্গে বার্মার যোগাযোগ বেড়ে যায়। বনজ সম্পদ আহরণ ও অন্যান্য কাজে বহু বাঙালি বার্মায় ভাগ্য অন্বেষণে গমন করে। ঐ অঞ্চলে দাঙ্গার ইতিহাস পুরনো। ১৯৪২ সালে ২৮ মার্চ রাখাইন অধ্যুষিত মিমবিয়া ও ম্রোহাং টাউনশিপে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে রাখাইনরা। পাল্টা প্রতিশোধ রোহিঙ্গারা প্রায় ২০ হাজার রাখাইনদের হত্যা করেছিল। ১৯৪৫ সালে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলায় চলে আসে। সে সময়ে মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আলাদা রাজ্য গঠন করে দেবে ব্রিটিশের এই প্রতিশ্রুতির কারণে ব্রিটিশকে সমর্থন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ে আসবার চেষ্টা করে। এমনকি রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গ্রুপও গঠন করেছিল। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সেই সময় থেকেই রোহিঙ্গাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রিয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যে নাগরিক আইন পাস করে তাতে মিয়ানমারে বাস করা ১৩৫টি গোত্রভুক্ত মানুষকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু রোহিঙ্গাদের গোত্র হিসাবে অস্বীকার করে সামরিক সরকার। সামরিক সরকারের বক্তব্য ছিল এরা ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী। এমনকি সহযোগী ও অভিভাষী নাগরিক হিসাবেও রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা হয়। ১৯৮৯ সালে মিয়নমারে তিন ধরনের যে নাগরিক কার্ড প্রদান করা হয় তা থেকেও বঞ্চিত করা হয় রোহিঙ্গাদের। এই কার্ড চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, পড়াশুনা, চিকিৎসা ইত্যাদি সুযোগ সুবিধায় কার্ড আবশ্যক থাকায় রোহিঙ্গারা এই সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্ম নিবন্ধন বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার সরকার। শুধুমাত্র মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনীর খাতাতে রোহিঙ্গাদের নাম লেখা থাকে। বলা চলে রোহিঙ্গারা নিজ গ্রামে এক ধরনের কারাগারে বন্দি হিসাবে বাস করছিল, নিজ গ্রামের বাইরে যেতে হলে তাদের ট্রাভেল পাস নিতে হত। ১৯৯০ সালে আরাকান রাজ্যে যে স্থানীয় আইন জারি করা হয় তাতে রোহিঙ্গাদের বিয়ের আগে সরকারি অনুমোদন এবং ২ সন্তানের অধিক সন্তান নেয়া যাবে না এ রকম মুচলেকা প্রদানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০১ সালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করা হয়। তখন ঘরে বসে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো রোহিঙ্গারা। ২০০৫ সাল থেকে সেই অধিকারটুকুও বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার জান্তা। ১৯৭৪ সালে ইমার্জেন্সি ইমিগ্রেশন এ্যাক্টে মিয়ানমারে নাগরিক কার্ড বহন করা বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিক কার্ড দেয়া হয় না। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের উপর অপারেশন নাগামিন বা ড্রাগন রাজের নামে ব্যাপক অত্যাচার চালায় তাতে ২ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ১৯৯০ সালে রোহিঙ্গাদের সমস্ত নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হলেও তাদের নির্বাচনের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এই নির্বাচনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় অং সাং সূচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এন এল ডি) বিজয়ী হয়। কিন্তু সামরিক জান্তারা সূচির হাতে ক্ষমতা ছাড়তে রাজী না হওয়ায় মিয়ানমার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ আর বিক্ষোভ। ২১টি এথনিক গ্রুপ নিয়ে গঠিত হয় ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স অব বার্মা বা ড্যাব। ড্যাব ঘোষণা করে সামরিক সরকারের হাত থেকে গণতন্ত্র ছিনিয়ে আনতে তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করবে। রোহিঙ্গাদের দুটি সংগঠন অল বার্মা মুসলিম ইউনিয়ন ও আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট ড্যাব কে সমর্থন জানায়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা জনরোষকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পর্যবসিত করতে আক্রমণ শুরু করে রোহিঙ্গাদের উপর। রাখাইনদের উস্কে দেয়া হয়। এই সময় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ২য় দফা আগমন ঘটে বাংলাদেশে। ১৯৯২ সালে ২৮ এপ্রিল মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে থেকে যায়। ১৯৯৫ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাবার কথা থাকলেও মিয়ানমারের অসহযোগীতায় তা হয়ে ওঠেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা কোন সাময়িক বিপর্যয় নয়, এটি রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসা এথনিক ক্লিনজিং এর অংশ। মিয়ানমার সরকার ২০ লাখ রোহিঙ্গার দায় বাংলাদেশের কাঁধে চাপাতে চায়। এটা সত্য যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্বিক গঠনে চট্টগ্রাম আদিবাসীদের মিল আছে। শুধুমাত্র একারণে শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য গ্রহণ করা কঠিন। বিষয়টি মানবিক স্পর্শকাতর ও কষ্টদায়ক। বাংলাদেশকে তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক কাজ করতে হবে, যাতে করে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে নাগরিকের সম্মান পায় এবং অত্যাচারের কারণে নিজ দেশ ত্যাগ না করে। অস্ত্রের জোরে মিয়ানমারের জান্তা গণতন্ত্রকে পদদলিত করছে, রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলব-৮০ লাখ বাঙালি শরণার্থীকে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যায়নি। রোহিঙ্গাদেরও দেশ ত্যাগে বাধ্য করে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক স্রোতধারাকে রোধ করা যাবে না। আর আমরাও ৭১ এর বেদনাদায়ক স্মৃতিকে বহন করে চলেছি, তাই রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের ভালবাসা ও মমত্ববোধকেও সমুন্নত রাখতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন